Close
দারসুল কোরআন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দারসুল কোরআন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী। সূরা আল মু'মিনুন এর ১ম রুকু (১ থেকে ১১ নং আয়াত)

দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী
সূরা আল মু'মিনুন, 
 সুরা নং-২৩, আয়াত নং- ১ থেকে ১১ 

الرَّحِيمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ 1

 الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ 2

 وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ 3

 وَالَّذِينَ هُمْ لِلرَّكوة فَعِلُونَ 4

 وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ 5

 إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَةٌ 6

 فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ 7

 وَالَّذِينَ هُم لاَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَعُونَ 8

 وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلوتِهِمْ يُحَافِظُونَ 9

 أولئك هم الورثونه 10

 الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَهُمْ فِيهَا خَلِدُونَ 11 .

সরল অনুবাদ: ইরশাদ হচ্ছে 
(১) অবশ্যই (সেই সব) মু'মিনেরা সফলকাম হয়ে গেছে, 
(২) যারা তাদের নামাযে বিনয়ী-নম্র। 
(৩) যারা ৰাজে বা বেহুদা কথা-কাজ থেকে দূরে থাকে, 
(৪) যারা তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর। 
(৫) এবং যারা তাদের যৌনাঙ্গকে (অবৈধ ব্যবহার থেকে) হেফাজত করে। 
(৬) তবে তাদের স্ত্রীদের এবং অধিনস্থ দাসীদের বেলায় (যৌনাঙ্গ) হেফাজত না করলে তারা তিরস্কৃত হবে না। 
(৭) তবে কেউ যদি এদের ছাড়া অন্য কাউকে (যৌনক্ষুধা মেটার জন্য) কামনা করে, তবে (এক্ষেত্রে) তারা হবে সীমালংঘনকারী। 
(৮) আর যারা তাদের আমানত এবং প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে হুশিয়ার থাকে। 
(৯) এবং যারা তাদের নামায সমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। 
(১০) তারাই (অর্থাৎ এসব গুণের অধিকারীরাই) হবে উত্তরাধিকারী। 
(১১)  তারা শীতল ছায়াঢাকা উদ্যানের (অর্থাৎ জান্নাতুল ফেরদাউসের) উত্তরাধিকারী হবে এবং তাতে তারা চিরকাল থাকবে । 

সূরার নামকরণঃ অত্র সূরার প্রথম আয়াত قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ এর ‘আল-মু’মিনুন' শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। যদিও নামকরণের ক্ষেত্রে সব বিষয়ের সাথে মিল রেখে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় না । কিন্তু এই সূরার ১ম থেকে ১১ নং আয়াত পর্যন্ত একই সাথে মু'মিনদের বৈশিষ্ট সম্পর্কে যেসব গুণের কথা পেয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, এই সূরার বিষয়ের সাথে নামকরণের বেশ মিল আছে।

নাযিল হবার সময়কাল: সূরার বর্ণনাভঙ্গী এবং বিষয়বস্তু থেকে প্রমাণ হয় যে, এটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময় নাযিল হয়েছিলো। বিধায় সুরাটি মাক্কী। হযরত ওমর (রাঃ) এর এক উক্তি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর এর বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়— এ সময় হযরত উমর (রাঃ) সবেমাত্র ঈমান এনেছিলেন। আর হযরত উমরের ইসলাম কবুলের সময় ছিলো রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরের শেষের দিকে। এ হাদীসে হযরত উমর (রাঃ) নিজে বলেন : “এ সূরাটি তার সামনেই নাযিল হয়েছে। তিনি নবী করীম (সাঃ) এর উপর ওহী নাযিলের যে বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হয় তা দেখতে পান। পরে নবী করীম (সাঃ) যখন সেই অবস্থা থেকে অবসর পেলেন, তখন তিনি আমাদেরকে বললেন : “এইমাত্র আমার প্রতি এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যদি কেউ তার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে তবে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতে চলে যাবে।” অতঃপর তিনি এই সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শুনালেন। (আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও হাকেম।) 

সূরাটি নাযিলের সময় মক্কায় রাসূল (সাঃ) এর সাথে কাফেরদের প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব চলছিলো। তবে তখনো কাফেরদের যুলুম নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেনি । তাছাড়া সূরাটি নাযিলের সময় মক্কায় চরম দুর্ভিক্ষও চলছিলো।

বিষয়বস্তু : এই সূরাটির মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আনুগত্য । তিলাওয়াতকৃত ১১টি আয়াতের মূল বিষয় হচ্ছে, যেসব লোক এই নবীর কথা মেনে নেবে, তাদের মধ্যে এসব গুণ সৃষ্টি হবে। আর নিঃসন্দেহে এসব লোকেরাই দুনিয়া এবং আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে ।

সূরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব : মুসনাদে আহমদ কিতাবের এক বর্ণনায় হযরত উমর ফারুক (রাঃ) বলেন : রাসূল (সাঃ) এর উপর যখন ওহী নাযিল হতো, তখন পাশের লোকজনের কানে ঘন্টার ধ্বনি বা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আওয়াজ হতো। একদিন তাঁর কাছে এমনি ধরনের আওয়াজ পেয়ে আমরা সদ্যপ্রাপ্ত ওহী শুনার জন্য থেমে গেলাম ৷ ওহীর বিশেষ অবস্থা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেবলামুখী হয়ে বসে গেলেন এবং এই দোআ পাঠ করতে লাগলেন :

اللهمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تَهَنَا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمُنَا وَأَيْرُنَا وَلَا تُؤْثِرُ عَلَيْنَا وَارْضَ عَنَا وَارْضَنَا

“হে আল্লাহ আমাদের বেশী বেশী দাও- কম দিও না। আমাদের সম্মান বাড়িয়ে দাও- লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান করো মাহরূম করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও- অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ো না এবং আমাদের প্রতি রাযি-খুশী থাকো আর আমাদেরকে তোমার রাযীতে রাযী করো।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে বললেন : এখনই আমার উপর যে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। যে কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে চলে যাবে এরপর তিনি এই সূরার ১ম দশটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন ।

ইমাম নাসায়ী তাঁর কিতাবের তাফসীর অধ্যায়ে ইয়াযীদ ইবনে বাবনুস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি একবার হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর চরিত্র কেমন ছিলো? তিনি (আয়েশা) বলেছিলেন : তাঁর চরিত্র আল কুরআনে বর্ণিত আছে। অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে বললেন : এগুলোই ছিলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র। (ইবনে কাসীর)

শানে নুযুল : অত্র সূরা বিশেষ করে এই আয়াতগুলো নাযিলের সময় প্রেক্ষাপট ছিলো এই যে, এ সময় একদিকে মক্কার কাফের সর্দারেরা ইসলামী দাওয়াতের চরম বিরোধী ছিলো। তাদের ব্যবসা-বানিজ্য ছিলো উন্নতমানের এবং চাকচিক্য পূর্ণ। তাদের টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ ছিলো প্রচুর । দুনিয়া স্বাচ্ছন্দের সব উপায় উপকরণ তাদের নাগালের মধ্যে ছিলো। আর অপরদিকে ছিলো ইসলামের অনুসারী রাসূলের সংগী-সাথীরা । এদের মধ্যে কিছু লোক যারা স্বচ্ছল ছিলো এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা আগে থেকেই সাফল্য মণ্ডিত হচ্ছিলো। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত কবুল করার ফলে কাফেরদের চরম বিরোধিতার কারণে তাদেরকে খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এতে কাফের সর্দারেরা নিজেদেরকে বেশী সফল ও সার্থক বলে দাবী করতো এবং নবীর অনুসারীদেরকে বিফল ও ব্যর্থ মনে করতো। তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করলেন, নিশ্চয়ই কল্যাণ বা সফলতা লাভ করেছে ইসলামের দাওয়াত কবুলকারী রাসূলের অনুসারীরা । আর কাফেরেরা দুনিযায় যে সফলতা এবং স্বার্থকতার দাবী করছে, এটাই প্রকৃত সফলতা ও স্বার্থকতা নয়, বরং আখেরাতের সফলতাই হলো প্রকৃত এবং স্থায়ী সফলতা ।

ব্যাখ্যাঃ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ - “অবশ্য অবশ্যই ঈমান গ্রহণকারী - লোকেরা কল্যাণ বা সফলতা লাভ করেছে।”

মু'মিন কারাঃ এখানে ঈমান কবুলকারী বা মু'মিন বলে সেসব লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দাওয়াত কবুল করেছে, তাঁকে যারা নিজের মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক ও নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং তাঁর উপস্থাপিত জীবন যাপনের নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে প্রস্তুত হয়েছে।

‘ফালাহ’ শব্দের মানে-কল্যাণ, সাফল্য এবং স্বাচ্ছন্দ। এটা (খুশরান) বা ক্ষতি বা ব্যর্থতার বিপরীত। সাফল্য শব্দটি কুরআন এবং হাদীসে ব্যাপক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আযান ও একামতে প্রতিদিন পাঁচবার প্রতিটি মুসলমানকে ডাকা হয়। এর প্রকৃত অর্থ হলো প্রত্যেক মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়া এবং প্রতিটি কষ্ট দূর হওয়া। এ শব্দটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর অর্থ সুদূর দুনিয়ার কোন মানুষ বা শক্তির পক্ষে মানুষের প্রতিটি মনোবাঞ্ছা পূরণ করা এবং প্রতিটি কষ্ট বিদূর করা সম্ভব নয়। এটা পারেন একমাত্র বিশ্ব জাহানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাবারাকাওয়া তাআলা ।

পুরোপুরিভাবে সফলতা লাভ করা দুনিয়াতে কোনভাবেই সম্ভব নয় । এটা একমাত্র আখেরাতে জান্নাত লাভের মাধ্যমেই হতে পারে। কুরআন এবং হাদীসে যেখানেই এই ‘ফালাহ' বা সফলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে- তা চিরস্থায়ী আখেরাতের সফলতার কথাই বলা হয়েছে। এখানেও মক্কার কাফের সর্দারদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরত্তর সফলতার বড়াই এর পরিপেক্ষিতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন : তোমরা দুনিয়ার যে সফলতা এবং স্বার্থকতার বড়াই করছো এটাই প্রকৃত সফলতা বা স্বার্থকতা নয় । তোমাদের এই সফলতা ক্ষণস্থায়ী। বরং মুমিন লোকদের জন্য আখেরাতের যে সফলতা সেটাই হচ্ছে প্রকৃত এবং চিরস্থায়ী সফলতা । বর্তমানে আমাদের সমাজেও অনুরূপ লোক দেখা যায়। প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরত্তর উন্নতির জন্য এবং নিজের সন্তানদের লেখা-পড়ার ভাল ফলাফল ও দামী চাকুরী পাবার কারণে নিজেকে সফল হয়েছে বলে বড়াই করে। অথচ আখেরাতের জন্য সে কোন কাজই করে না। তাদের দুনিয়ায় এ ধরনের বড়াই পরকালে কোনো কাজেই আসবে না। বরং তারাই ব্যর্থ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যারা মুমিন, ইসলামের পথে চলার জন্য দুনিয়ায় বাধাগ্রস্ত হয়ে কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করতে হয়েছে, বাতিলের বিরোধিতা এবং হামলার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকুরী-বাকরী ক্ষতি হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে তারাই আখেরাতে নেয়ামতে ভরা জান্নাত লাভের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সফলতা লাভ করবে ।

আল-কুরআনে অন্যত্র সূরা আ'লায় সাফল্য লাভের ব্যবস্থা পত্র দিতে গিয়ে বলা হয়েছে - قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى অর্থাৎ “যে নিজেকে পাপ কাজ থেকে পবিত্র রেখেছে সেই সফলকাম হয়েছে।” এর সাথে সাথে আরও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, পরিপূর্ণ সফলতা লাভের জায়গা আসলে দুনিয়া নয় পরকাল । যে সফলতা কামনা করে, তার কাজ শুধু দুনিয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা নায়। এ সম্পর্কে সূরা আ'লায় আরো বলা হয়েছে— بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيُوةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَابْقى

(হে মানুষ!) “তোমরা দুনিয়াকেই পরকালের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছো । অথচ দুনিয়ার তুলনায় পরকালের জীবন অতি উত্তম এবং স্থায়ী।” সুতরাং পরিপূর্ণ এবং স্থায়ী সফলতা তো একমাত্র পরকালে জান্নাতেই পাওয়া যেতে পারে- দুনিয়া এর স্থান নয়। তবে দুনিয়াতেও আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রকৃত বান্দাদের মনের প্রশান্তির মাধ্যমে সফলতা দান করে থাকেন ৷

মু'মিনদের সাতটি গুণ:-

আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা সেই সব মু'মিনদেরকে সফলতা দানের ওয়াদা করেছেন যাদের মধ্যে সাতটি গুণ রয়েছে। সর্ব প্রথম গুণ হচ্ছে ঈমানদার হওয়া। কিন্তু এটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুণের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে । নীচে সেগুলো ধারাবাহীকভাবে আলোচনা করা হলোঃ

প্রথম গুণঃ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ  অর্থাৎ "যারা তাদের নামাযে বিনয়ী-নম্র।” নামাযে ‘খুশূ’ বলতে বিনয়-নম্র হওয়া বুঝায় ৷ ‘খুশূর’ আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। শরীয়াতের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকা; অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে না করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও স্থির থাকা; অর্থাৎ অনর্থক নড়াচড়া না করা । (বয়ানুল কুরআন)। তাছাড়া এর আরো অর্থ হলো কারও সামনে বিনয়াবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, লুণ্ঠিত হওয়া, নিজের কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা ইত্যাদি ।

দিলের ‘খুশূ’ হয় তখন, যখন কারও ভয়ে ও দাপটে দেল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। আর দেহের ‘খুশৃ’ এভাবে প্রকাশ পায় যে, কারও সামনে গেলে তার মাথা নীচু হয়ে যায়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে পড়ে, চোখের দৃষ্টি নতো হয়ে আসে, গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায় । ভীত সন্ত্রস্ত হবার সেসব লক্ষণই বেশী প্রকাশ হয়ে পড়ে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মহাশক্তির প্রচণ্ড দাপটের অধিকারী কোনো সত্তার সামনে হাজির হয়। আর নামাযে ‘খুশূ’ বলতে বুঝায় মন ও দেহের অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়াকে । কেননা নামাযী তার মহাশক্তিধর প্রভুর সামনে হাজির হয় ।

নামাযে বিনয় ও একাগ্রতা বা খুশু-খুজু পয়দা হবার জন্য নামাযের বাহ্যিক কাজেরও বেশ প্রভাব রয়েছে। ইসলামী শরীয়াতে নামাযের যেগুলো নিয়ম-নীতি ও কায়দা-কানুন হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তা যথাযত ভাবে নিষ্ঠার সাথে আদায় করলে মনের একাগ্রতা বা খুশূ সৃষ্টির জন্য সাহায্য করে। আবার সেসব কাগুলো ঠিকমত না করলেও নামাযের একাগ্রতা ও খুশূ সৃষ্টিতে বাধা দেয় ৷

নামাযের যেসব বাহ্যিক কাজ নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ পয়দায় বাধা সৃষ্টি করে তা হলোঃ

→ নামাযের মধ্যে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা বা নড়া-চড়া করলে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে- একবার নবী করীম (সাঃ) এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে মুখের দাড়ী নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন :

لَوْ خَشِعَ قَلْبَهُ خَشِعَتِ جَوَارِحِه

“যদি এ লোকটির দেলে খুশূ থাকতো তাহলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরেও খুশূ বা স্থিরতা থাকতো।” (মাযহারী)

→ নামাযে এদিক ওদিক তাকালে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়। বুখারী এবং তিরমিযী শরীফের হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি নবী করীম (সাঃ) কে নামাযে এদিক ওদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় রাসূল (সাঃ) বললেন :

هُوَ اِخْتِلَاسُ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلَاةِ الْعَبْدِ “এটা নামাযীর (মনোযোগের) উপর শয়তানের থাবা ।”

→ নামাযে ছাদ বা আকাশের দিকে তাকালে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ . নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ আছে। হযরত জাবির বিন সামুর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন :

لَيَنْتَهِينَ أَقْوَامٌ يَرْفَعُونَ اَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِي الصَّلَاةِ أَوْلَا تَرْجِعُ إِلَيْهِمُ

“লোকেরা যেনো নামাযে তাদের চোখকে আকাশমুখী না করে। (কেননা তাদের চোখ) তাদের দিকে ফিরে নাও আসতে পারে।” (অর্থাৎ নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট করে দিবে।)” (মুসলিম)।

→ নামাযে হেলা-দোলা করা ও নানা দিকে ঝুকে পড়লে নামাযের

একাগ্রতা বা খূশূ নষ্ট হয়ে যায়।

→ পরনের জামা-কাপড় বারবার গুটানো বা ঝাড়া কিংবা তা নাড়াচাড়া করলে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়।

→ সিজদায় যাবার সময় বসার জায়গা বা সিজদাহর জায়গা বারবার পরিষ্কার করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। (তবে ক্ষতিকারক হলে একবার সরানো যাবে )

এসম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন :

إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ فِي الصَّلَاةِ فَلَا يَمْسَحِ الْحَصَى فَإِنَّ

الرَّحْمَةَ تُوَاجِهة

“কোন ব্যক্তি যেন নামাযের অবস্থায় (সিজদাহর জায়গা হতে) কংকর না সরায়। কেননা আল্লাহর রহমত নামাযী ব্যক্তির সামনে প্রসারিত হয়। (আহমদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ও ইবনে মাযাহ) ।

→ একটানা ভাবে গর্দান খাড়া করে দাঁড়ানো, খুব কর্কর্ষ সূরে কোরআন পাঠ করা কিংবা গীতের সূরে কেরআত পাঠ করলে নামাযের খুশূ বা বিনয়তা নষ্ট হয়ে যায় ।

জোরে জোরে হাই এবং ঢেকুর তোললে, ইচ্ছা করে গলা খেকাড়ী বা কাশি দিলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়। হাদীসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ التَّنَانُ مِنَ الشَّيْطَانِ، فَإِذَا تَشَاءَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَكْظِمْ مَا

اسْتَطَاعَ

“নামাযে হাই উঠে শয়তানের প্রভাব থেকে । যদি কারো হাই উঠে তবে সে যেনো সাধ্যমত হাই প্রতিরোধ করে।” (মুসলিম, তিরমিযী)।

→ খুব তাড়াহুড়ো করে নামায আদায় করলে নামাযের বিনয়তা বা একাগ্রতা থাকে না। এ সম্পর্কে “হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসে মহানবী (সাঃ) ‘মুখতাসির' (অর্থাৎ নামাযের কাজগুলোকে হাল্কা ও ঝটপট) রূপে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন । ”

→ নামাযের রুকু, সিজদাহ, কিয়াম, বৈঠক সঠিকভাবে আদায় না করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়। হাদীসে আছে “নোমান ইবনে মোররাহ বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন : মদখোর, ব্যভিচারী ও চোর সম্পর্কে তোমাদের মতামত কি? তারা বললেন : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাঃ) বললেন : ওগুলো কবীরা গোনাহ এবং এর সাজাও খুব। (এবার শুনে নাও) সবচেয়ে জঘন্য চুরি হলো সেই চুরি যে ব্যক্তি নামাযে চুরি করে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, নামাযে আবার চুরি কিভাবে হয় হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন : যে নামাযে রুকু ও সেজদাহ্ ঠিকমত করে না” (মালেক, আহমদ, দারেমী, মেসকাত )

→ নামাযীর সামনে পর্দায় কোন ছবি বা সিনারী থাকলে নামাযের খুশূ বা একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়। “হযরত আনাস (রাঃ) বলেন : হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর একটি কাপড়ের পর্দা ছিলো তিনি তা ঘরের একদিকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন । এতে নবী করীম (সাঃ) বললেন : তুমি এ পর্দাটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে রাখো । কারণ এর ছবিগুলো সর্বদা আমার নামাযের ক্ষতি (অর্থাৎ একাগ্রতা নষ্ট) করে।” (বুখারী)

অন্তরের যেসব কাজ নামাযের খুশূ বা একাগ্রতা নষ্ট করে তাহলো :

→ নামাযের মধ্যে জেনে শুনে অপ্রাসংগিক কথা-বার্তা চিন্তা বা খেয়াল করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বে কোনো চিন্তা ভাবনা মনে জাগলে তা জাগতে পারে। মানুষের এটা স্বাভাবিক ব্যাপার । কেননা শয়তান মানুষের মনে আসওয়াসা দিয়ে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট করার জন্য সদাসর্বদা চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। এ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) হাদীসে বলেন : “নামাযের জন্য যখন আযান দেয়া হয় তখন শয়তান পিঠ ফিরিয়ে বাতকর্ম করতে করতে পালাতে থাকে- যাতে সে আযানের ধ্বনি না শুনতে পায়। অতঃপর যখন আযান শেষ হয়ে যায় তখন সে ফিরে আসে। আবার যখন একামত বলা হয় তখন সে পিঠ ফিরিয়ে পালাতে থাকে এবং যখন একামত শেষ হয়ে যায় তখন ফিরে আসে ও মানুষের মনে (একাগ্রতা নষ্ট করার জন্য) খটকা দিতে থাকে। সে বলে : অমুক বিষয়ে খেয়াল করো, অমুক অমুক বিষয়ে খেয়াল করো- যেসব বিষয় তার মনে ছিলো না। অবশেষে নামাযী এরূপ (অমনোযোগী) হয়ে যায় যে, সে বলতে পারে না কত রাকাআত নামায পড়েছে।” (আবু হুরাইরা, বুখারী, মুসলিম)।

নামাযে অন্তরের খুশূ বা একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য যেসব কাজ করতে হবে-

→ নামাযে সব সময় আল্লাহ তাআলাকে হাজির-নাজির জানতে হবে। নামাযী যখন নামাযে দাঁড়বে তখন সে মনে করবে যেনো সে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে। এ সম্পর্কে “হাদীসে জিবরীলে” “ইসান' সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) কে জিবরাঈল (আঃ) প্রশ্ন করলে, তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন :

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ “তুমি এভাবে আল্লাহর ইবাদাত (নামায আদায়) করবে, যেন তুমি স্বয়ং আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাচ্ছো; আর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়, তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নিবে যে, আল্লাহ তোমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন।” (হযরত উমর, মুসলিম)।

→ নামাযে যেসব দোআ-কালাম পড়া হয় তা অন্তর থেকে পড়তে হবে। স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে ধীর-স্থিরভাবে পড়তে হবে। নামাযে অন্য মনস্ক হয়ে গেলে যখনই খেয়াল হবে তখনই মনকে পুনরায় নামাযের মধ্যে আনতে হবে। সদাসর্বদা এ চেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে ।

→ নামাযে মনোনিবেশ বা খুশূ সৃষ্টি করার জন্য নামাযীর দৃষ্টি সেজদার দিকে থাকবে। এ সম্পর্কে হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন : “হে আনাস! যেখানে তুমি সেজদাহ্ দেবে সেই জায়গাতেই তোমার দৃষ্টি রাখবে । ” (বায়হাকী, মেশকাত)

→ নামাযে মনোনিবেশ সৃষ্টির জন্য নামাযে যা পড়া হবে তার অর্থ নিজের ভাষায় জানতে হবে। দোআ-কালামের মানে জানলে স্বাভাবিকভাবেই নামাযে মনের একাগ্রতা সৃষ্টি হবে ৷

মুমিনদের গুণাবলীর প্রথম গুণ নামাযে খুশূ বা বিনয়ী বা একাগ্রতার বিষয়টি এতো দীর্ঘ আলোচনার কারণই হলো একজন মু'মিন বান্দার প্রথম গুণই হবে নামায। আর নামাযের রূহ বা প্রাণই হলো নামাযে খুশূ-খুজু বা একাগ্রতা। যদি তা না হয় তাহলে নামায পড়াই হবে কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এজন্য আমাদের নামায পড়তে হলে খুশু-খুজুর সাথেই নামায আদায় করতে হবে ।

দ্বিতীয় গুণঃ وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ অর্থাৎ “যারা বেহুদা বা অপ্রয়োজনীয় কথা এবং কাজ থেকে দূরে থাকে ।” মুমিনদের দ্বিতীয় গুণ হলো তারা বেহুদা, অপ্রয়োজনীয় ও অকল্যাণকর কথা, কাজ এবং চিন্তা থেকে দূরে থাকে ।

اللَّغْوِ'লাগয়ুন' বলা হয় এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং নিষ্ফল । যেসব কথা এবং কাজের কোনই ফল নেই; উপকার নেই, যা থেকে কল্যাণবহ ফলও লাভ করা যায় না। যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা হতে কোনো ভালো উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় না- এসবই অর্থহীন, বেহুদা ও বাজে জিনিস ।

مُعْرِضُونَ মানে যদিও দূরে থাকা । কিন্তু এতে শব্দটির পূর্ণ অর্থ বুঝায় না। আয়াতটির পূর্ণ অর্থ হলো : তারা বাজে, বেহুদা কাজ বা জিনিসের দিকে লক্ষ্য করে না। সেদিকে যায় না। যেখানে এ ধরনের কাজ বা কথা হয় সেদিকে আকৃষ্ট হয় না। সেখানে যাওয়া হতে দূরে থাকে। সে কাজে অংশগ্রহণ করে না, পরহেয করে, পাশ কেটে চলে যায়, কোথাও কখনও মুখোমুখী হয়ে পড়লেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য এড়িয়ে চলে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا

“তারা যদি এমন কোনো স্থানে যেয়ে পড়ে যেখানে বেহুদা অর্থহীন বাজে কাজ বা কথা হচ্ছে, তা হলে সেখান থেকে তারা নিজের মান সম্মান রক্ষা করে চলে যায়।” (ফুরকান-৭২)

আসলে মুমিন ব্যক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রতিটি সময় হিসাব-নিকাশ করে চলে। কেননা আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি মূহুর্তের হিসাব নেবেন। মুমিনের জন্য প্রতিটি মূহুর্ত একজন পরিক্ষার্থীর মতো মূল্যবান। পরীক্ষার্থী যেমন পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পাবার পর পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল লাভের জন্য প্রতিটি প্রশ্নের যথাযত উত্তর দেবার মাধ্যমে প্রতিটি মূহুর্তকে কাজে লাগায়, সে আজেবাজে কথা লিখে বা চিন্তা করে সময় কাটায় না। অনুরূপভাবে একজন মুমিন ব্যক্তিও দুনিয়ার এ জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে সঠিকভাবে ও যথাযতভাবে কাটায়। সে চিন্তা করলে কল্যাণকর চিন্তা করে, কথা বললে কল্যাণকর ও গ্রহণযোগ্য কথা বলে, কাজ করলে উপকারী কাজ করে । সে গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা ও চোগলখোরী করে বেড়ায় না । সে হাটে-বাজারে, দোকানে বা রাস্তায় বসে বাজে আড্ডা দেয় না । সে বাজে বা অশ্লীল কোন কাজ করে না। সে গল্প করে, কিন্তু অর্থহীন অশ্লীল গল্প-গুজব করে না। সে হাসি-তামাসা ও রসিকতা করে, কিন্তু তাৎপর্যহীন হাসি-তামাসা ও রসিকতা করে না। সে বিতর্ক করে, কিন্তু অশ্লীল কথা ব্যবহার করে ঝগড়া বিবাদ করে না। সে যে সমাজে গান-বাজনা, রং-তামাসা, অশ্লীল গালি-গালাজ, অন্যায় অভিযোগ, মিথ্যা দোষারোপ, লজ্জাহীন কথা-বার্তার চর্চা হয় সেই সমাজ তার জন্য গাত্রদাহ এবং আযাব বলে মনে হয়। এসব ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন : “মানুষ যখন অনর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন তার (দ্বীন) ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে থাকে।” একারণেই আয়াতে একে কামেল মুমিনদের বিশেষ গুণ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এসব বান্দাদের জন্য জান্নাতে আল্লাহ্ তাআলার অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে একটি বড় নিয়ামত হলো-

لا تَسْمَعُ فِيهَا لَاغِيَهُ

“সেখানে তারা কোনো প্রকার অর্থহীন বাজে কথা-বার্তা শুনতে পাবে না।” (সূরা গাশিয়া )


তৃতীয় গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ لِلرَّكوة فَعِلُونَ অর্থাৎ “যারা যাকাত বা পবিত্রতার কাজে কর্মতৎপর।” ‘যাকাত’ দেয়া এবং ‘যাকাতের' পন্থায় কর্মতৎপর হবার মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এই আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে কুরআনের প্রচলিত প্রচলিত যাকাত আদায় এর কথা না বলে لِلرَّكوة فَعِلُونَ বলে বিশেষ ধরনের কথা বলা হয়েছে । এটা বলার পেছনে বেশ তাৎপর্য রয়েছে।

আরবী ভাষায় ; শব্দের দু'টি অর্থ— একটি ‘পবিত্রতা' আর অপরটি ‘বৃদ্ধি’। অর্থাৎ একটা জিনিসের উন্নতি লাভের পথে যেসব বাধা-বিপত্তি আছে, তা দূর করা এবং উহার মূল জিনিসকে বৃদ্ধি করা। এ দুটি ধারণার সমন্বয়ে 'যাকাত' সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা সৃষ্টি হয়।

আর ইসলামী পরিভাষায় উহার ব্যবহার হয় দু'টি অর্থে। একটি সেই মাল-সম্পদ, যা পবিত্রতা অর্জনের জন্য হিসাব করে আলাদা করা হয় । আর দ্বিতীয়টি খোদ এই পবিত্রতা অর্জনের কাজ। যদি يُؤْتُونَ الزَّكوة বলা হয়, তবে তার অর্থ হবে, তারা পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিজের মাল-সম্পদের একটা অংশ দেয়। এতে শুধু মাল দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থকে । কিন্তু যদি বলা হয় لِلرَّكوة فَعِلُونَ তবে তার অর্থ হবে তারা পবিত্রতা বা তাকিয়ার বিধানের কাজ করছে। এতে কেবলমাত্র যাকাত আদায় করার অর্থই বুঝাবে না; বরং এর মানে ব্যাপক অর্থে বুঝাবে। যেমন-

* সে তার মন ও দেহের পবিত্রতা অর্জন করে ।

* সে তার চরিত্রের পবিত্রতা অর্জন করে ।

* সে তার জীবনের পবিত্র-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে । 

* সে তার পরিবারকে পবিত্র বা তাকিয়া করে ।

* সে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে তাকিয়ার কাজে ভূমিকা রাখে ।

* আর সে তার ধন-সম্পদেরও যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধন-সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করে । ইত্যাদি ।

মোট কথা মুমিন ব্যক্তি সে তার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং ধন-সম্পদের পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করে। এক কথায় সে নিজেকেও পবিত্র করে এবং অন্য লোককেও পবিত্র করার কাজ আঞ্জাম দেয়। আল্লাহ তাআলা সূরা আ'লায় বলেন :

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّىٰ ۚ وَذَكَرَاسُمَ رَبِّهِ فَصَلَّى অর্থাৎ “কল্যাণ ও সফলতা লাভ করলো সে, যে পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়লো।” 

আল্লাহ্ তাআলা সূরা শামসে আরও বলেনঃ قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّهَا هِ ْ অর্থাৎ “সফলকাম হলো সে, যে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে, যে নিজেকে কলুষিত করলো ।

তবে আলোচ্য আয়তটি এ দু'টি আয়াত থেকে বেশী অর্থপূর্ণ। কেননা এ দু'টি আয়াতে শুধুমাত্র নিজের নফসের পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আর আলোচ্য আয়াতে নিজের এবং গোটা সমাজ জীবনের পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে ।


চতুর্থ গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে।” মুমিনদের চতুর্থ গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজেদের স্ত্রী এবং অধীনস্থ দাসীদের ছাড়া সব রকমের নারী ভোগ থেকে যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে ।

حَفِظُونَ এর দু'টি অর্থ রয়েছে- (১) নিজের দেহের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখে, উলঙ্গপনাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং নিজের লজ্জাস্থানকে অপর লোকের সামনে প্রকাশ করে না।  (২) তারা নিজেদের পবিত্রতা ও সতীত্বকে রক্ষা করে। 

اِلَّا عَلى اَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ ملومين  অর্থাৎ “তবে যদি তারা তাদের স্ত্রী এবং মালিকানাধীন দাসীদের সাথে যৌন কামনা পূরণ করে তবে তারা তিরস্কৃত হবে না।” তবে এখানে একটা ইঙ্গিত আছে যে, এই প্রয়োজনকে প্রয়োজনের সীমার মধ্যে রাখতে হবে- জীবনের লক্ষ্য বানানো যাবে না। মাঝখানে একথা বলার আসল উদ্দেশ্য হলো- লজ্জাস্থানের ‘হেফাজত' করার কথা বলার ফলে যে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করা। অতীতকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এক শ্রেণীর লোক আছে যারা যৌন শক্তিকে একটা খারাপ কাজ মনে করে । তারা মনে করে দ্বীনদার এবং পরহেজগার লোকদের জন্য এ খারাপ কাজ করা ঠিক নয়। যদি “সফলকামী ঈমানদার লোকেরা নিজেদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে” এই কথা বলেই ক্ষান্ত হতো তা হলে প্রচলিত এই ভূল ধারণাকে সাপোর্ট দেয়া হতো। তাই মাঝখানে আল্লাহ তাআলা একথা বলে এটা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, নিজের স্ত্রীদের এবং শরীয়ত সম্মত অধীনস্থ দাসীদের সাথে যৌন খাহেস পূরণ করলে কোনো দোষের কাজ হবে না।

فَمَنِ ابْتَغَى وَراءَ ذلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ “বিবাহিত স্ত্রী অথবা শরীয়ত সম্মত দাসীর সাথে শরীয়াতের নিয়মানুযায়ী যৌন কামনা-বাসনা পূরণ করা ছাড়া কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার আর কোনো পথ বৈধ নয়। আর যারা একাজ করে তারাই হবে সীমালংঘনকারী।” যেমন-

* যিনা যেমন হারাম, তেমনি হারাম নারীকে বিয়ে করাও যিনার মধ্যে গণ্য হবে ।

* স্ত্রী অথবা দাসীর সাথে হায়েয-নেফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস করা হারাম ।

* পুরুষ অথবা বালক অথবা জীব-জন্তুর সাথে যৌন ক্ষুধা মিটানো হারাম।

* অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে হস্ত মৈথুনও এর অর্ন্তভূক্ত। 

* তাছাড়া যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করার মতো কোনো অশ্লীল কাজ করা। এসব কিছুই সীমালংঘনের মধ্যে গণ্য হবে।

وَالَّذِينَ هُم لاَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَعُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।”

এখানে পঞ্চম ও ষষ্ঠ দু'টি গুণের কথা বলা হয়েছে।


পঞ্চম গুণঃ لاَمُنْتِهِمْ ‘আমানাত' শব্দটির অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। এর আভিধানিক অর্থে এমন প্রতিটি বিষয় শামিল, যার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোনো ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়। এখানে অনেক বিষয় জড়িত বিধায় 'আমানাত' শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।

এতে দু' ধরনের আমানত সংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে।

(১) হক্‌কুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক সংক্রান্ত আমানত ।

(২) হক্‌কুল ইবাদ বা বান্দার হক সংক্রান্ত আমানত ৷


হুক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক সংক্রান্ত আমানত হলো-

(১) খেলাফত বা প্রতিনিধি সংক্রান্ত আমানাত। আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে তার খেলাফতের দায়িত্বের আমানাত দিয়ে পঠিয়েছেন। আল্লাহ্ সূরা বাকারায় বলেন- “নিশ্চয় আমি (মানুষকে) আমার প্রতিনিধি হিসাবে (দুনিয়াতে) পাঠাতে চাই।” সুতরাং আল্লাহ্ এই খিলাফতের আমানত রক্ষা করা প্রতিটি বান্দার জন্য বড় ধরনের দায়িত্ব।

(২) শরীয়াতে আরোপিত সকল ফরয ও ওয়াজিব যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি আল্লাহ্র হক । বিধায় তা ঠিকমত পালন করা এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা হলো আল্লাহ্র হকের আমানত ৷

বান্দার হক বা অধিকার সংক্রান্ত আমানত হলো-

(১) টাকা-পয়সার আমানত। যদি কেউ কারো কাছে টাকা-পয়সা আমানাত হিসেবে জমা রাখে তাহলে তা ঠিকমত হেফাজাত করা এবং চাওয়ামাত্র কোন প্রকার গড়িমসি না করে তাৎক্ষণিক ফেরৎ দেয়া ।

(২) ধন-সম্পদের আমানাত। যদি কেউ কারো কাছে কোন ধন-সম্পদ বা জমি জায়গার দলিলপত্র গচ্ছিত রাখে, তাহলে তা ঠিকমত হেফাজত করা এবং তা ব্যবহার না করা (হ্যাঁ যদি দাতা ব্যবহার করার অনুমতি দেয় তবে ব্যবহার করা যাবে।) এবং চাওয়ামাত্র টালবাহানা না করে তা ফেরৎ দেয়া । 

(৩) গোপন কথার আমানত। কেউ যদি কাউকে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলে, তাহলে তা গোপন রাখাই হলো কথার আমানত হেফাজত করা।

যদি কেউ কারো গোপন কথা ফাঁস করে দেয় তার পরিণতি সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি তার অপর কোন ভাইয়ের গোপন কথা প্রকাশ করে দেয় তাহলে আল্লাহ তাআলাও কিয়াতের দিন তার গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন।”

(৪) মজুর, শ্রমিক এবং চাকুরী জীবিদের জন্য যে সময় এবং কাজ নির্দ্ধারণ করে দেয়া হয় তা যথাযতভাবে পালন করা তার দায়িত্বের আমানত । এর মধ্যে নিজের কাজ করা এবং সময় দেয়া আমানতের খেয়ানত । কামচুরি এবং সময় চুরি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এ ব্যাপারে তাকে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মহানবী (সাঃ) বলেন :

وَعَبْدُ الرَّجُلُ رَاعٍ عَلى مَالِ سَيّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ

অর্থাৎ “কোনো লোকের চাকর বা কর্মচারী তার মালিকের সম্পদ এবং দায়-দায়িত্বের রক্ষক এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে (কিয়ামতের দিন আল্লাহ্র কাছে) জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম)

(৫) দায়-দায়িত্বের আমানাত। সাংগঠনিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যার যে দয়িত্ব আছে তা যথাযতভাবে পালন করা তার জন্য আমানাত । প্রতিটি দায়িত্বের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল বলেনঃ

اَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعْيَتِهِ فَالِاِمَامُ الَّذِى عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعْيَتِهِ

“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই (আল্লাহ্র দরবারে) আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। রাষ্ট্র নায়ক যিনি তিনি তার অধিনস্থদের এবং তার দায়-দায়ত্বের রক্ষক । তিনি তার দায়-দায়িত্ব এবং অধিনস্থ নাগরিকদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।” (বুখারী, মুসলিম)

(৬) সংগঠন বা সমাজের কোন সম্পদের আমানত। যদি কোন নেতার কাছে সংগঠনের বা সমাজের কোনো সম্পদ থাকে সেটা রক্ষণাবেক্ষণকরা তার জন্য বড় ধরনের আমানাত । সুতরাং এই সম্পদের যতেচ্ছা ব্যবহার না করে তা যথাযতভাবে ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করতে হবে।

(৭) গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারদের ভোটের বা মতামতের আমানত । এই ভোটের ক্ষমতা যথাযত এবং যথা যায়গায় প্রয়োগ করা ভোটের বা মাতামতের আমানাত। এটা আমরা গুরুত্ব না দিলেও আমরা ভোটের বা মতামতের ক্ষমতা যার পক্ষে প্রয়োগ করলাম সে যদি কল্যাণকর কাজ করে তবে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে। আবার যদি সেই প্রতিনিধি অন্যায় এবং খোদাদ্রোহী কাজ করে তবে তারও অন্যায়ের শাস্তির অংশ ভোগ করতে হবে।

মোট কথা মু'মিনের জন্য প্রতিটি বিষয়ের আমানাত সঠিকভাবে হেফাজত বা সংরক্ষণ করা ঈমানের পরিচয়। যদি কেউ আমানাত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তার সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন : “তার ঈমান নেই যার মধ্যে আমানাতদারী নেই।” (বায়হাকী)


ষষ্ঠ গুণ : َعَهْدِ ওয়াদা বা অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি পালন করা। অঙ্গীকার দু'ধরনের হতে পারে । :

প্রথমতঃ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, অর্থাৎ যে চুক্তির মধ্যে দু'টি পক্ষ থাকে এবং উভয় পক্ষই একটা বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। তবে উভয়েরই সেই চুক্তি পালন করা অপরিহার্য। কেউ এর খেলাপ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার মধ্যে গণ্য হবে ।

দ্বিতীয়তঃ অঙ্গীকার, ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ একতরফাভাবে একজন অন্যজনকে কোনো কিছু দেবার বা কোনো কাজ করে দেবার ওয়দা করা । এরূপ ওয়াদা পূর্ণ করাও শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরী এবং অপরিহার্য। হাদীসে আছে-“ওয়াদা এক প্রকার ঋণ।” ঋণ আদায় করা যেমন অতীব জরুরী তেমনি ওয়াদা পূরণ করাও জরুরী ।

তবে যদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা একতরফা ওয়াদা কোন কারণে পালন করতে সমস্য দেখা দেয় তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলাপ করে তার সম্মতির ভিত্তিতে রিভিউ করা বা সময় বাড়িয়ে নেয়া ওয়াদা খেলাপের মধ্যে গণ্য হবে না ।

আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে-কামে ওয়াদা করে থাকি, যেমন- পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রীর সাথে একে অপরে ওয়াদা করে থাকি, যাকে আমরা খুবই হালকা করে দেখে থাকি। যদি এই ওয়াদা পূরণ করা না হয়, তাহলে প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে যাবে। তাছাড়া চাকরী-বাকরী, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংগঠনিক এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে ওয়াদা করে থাকি যা পালন করা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। অথচ দেখা যায় প্রতিনিয়ত এরকমের অসংখ্য ওয়াদা করা হচ্ছে এবং তার খেলাফও করা হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো ওয়াদা পালনের যে গুরুত্ব রয়েছে তার সম্পর্কে চেতনা কম। অথচ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা দ্বীনদারীর সাথে সম্পৃক্ত। এ ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) বলেন :

وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدِ لَهُ

অর্থাৎ “তার দ্বীনদারী নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই।” (বায়হাকী) 


সপ্তম গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلوتِهِمْ يُحَافِظُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের নামাযে যত্নবান।” নামাযে যত্নবান হবার অর্থ হলো নামাযের পাবন্দী করা এবং প্রত্যেক মোস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা। (রুহুল মা'আনী

এখানে صَلوةٌ শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এখানে পাঁচ ওয়াক্তের নামায বোঝানো হয়েছে। যেগুলো মোস্তাহাব অর্থাৎ আওয়াল ওয়াক্তে যথাযতভাবে পাবন্দী সহকারে আদায় করা বোঝায়।

মু'মিনদের গুণাবলীর মধ্যে প্রথমে বলা হয়েছে, তারা নামায বিনয়ের সাথে মনোনিবেশ সহকারে আদায় করে। তাই এখানে صَلوةٌ শব্দটি একবচন ব্যবহার করা হয়েছে । অর্থাৎ এখানে নামাযের জাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই সে নামায ফরয অথবা ওয়াজিব কিম্বা সুন্নত অথবা নফল নামায হোক— নামায মাত্রেরই প্রাণ হচ্ছে বিনয়-নম্রভাবে আদয় করা । এখানে নামাযসমূহের 'সংরক্ষণ' হলো- নামাযের বাইরের এবং ভিতরের যাবতীয় নিয়ম নীতি যথাযতভাবে পালন করা । যেমন-

* নামাযের পূর্বশর্তগুলো যেমন- শরীর, পোশাক, নামাযের স্থান (জায়নামায) ইত্যাদি পাক-পবিত্র হওয়া।

* সময় মতো মোস্তাহাব ওয়াক্তে, অর্থাৎ আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়া ৷

হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন : الْوَقْتُ الْاَوَّلَ مِنَ الصَّلوةِ رِضْوَانُ اللهِ وَالْوَقْتُ الْأَخِرُ عَفْرُ اللهِ

অর্থাৎ “নামায ওয়াক্তের প্রথম সময়ে আদায় করলে আল্লাহ্র সন্তোষ লাভ করা যায় এবং শেষ সময় আদায় করলে আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়া যায় (অর্থাৎ শেষ ওয়াক্তে নামায পড়লে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না, কেবল গুনাহ থেকে বাঁচা যায় মাত্র)।” (তিরমিযী)

* মসজিদে জামায়াতের সাথে নাময আদায় করা। হযরত ওমর (রাঃ) لَا صَلوةَ إِلَّا بِالْجَمَاعَةِ বলেন : করে অর্থাৎ “জামায়াত ছাড়া নামায কল্পনা করা যায় না।”

* শুদ্ধ, ধীর স্থির ভাবে দোআ-কালাম পাঠ করা ৷

* নামাযের রোকন যেমন- রুকু, সিজদাহ্, কিয়াম এবং বৈঠক ইত্যাদি মনোযোগের সাথে ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা ।

* খুশূ-বিনয়-নম্র এবং মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করা। 

* ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নামাযের হেফাজত করা । মুয়াত্তা ইমাম মালেকের হাদীসের কিতাবে আছে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর সমস্ত গভর্ণরদের কাছে এই মর্মে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে,

اِنَّ اَهُم أُمُورِكُمْ عِنْدَى الصَّلَوةُ فَمَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَافِظَ دِيْنَهُ وَمَنْ صَيْعُهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ

অর্থাৎ “তোমাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্বের মধ্যে নামাযই হলো আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং যে সাবধানতার সাথে নিজের নামায আদায় করলো এবং (অন্যদের) নামাযের তত্ত্বাবধান করলো সে যেনো তার পূর্ণ দ্বীনের হেফাজাত করলো। আর যে নামাযের খেয়াল রাখলো না তার পক্ষে অন্যান্য দায়িত্ব পালনে খেয়ানত আদৌ অসম্ভব কিছু নয়।”

সর্বপরি নামায হেফাজাত করা না করার মধ্যে আখেরাতের মুক্তির এবং ধ্বংসের কারণ রয়েছে। এ সম্পর্কে মহানবীর হাদীস। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাযের হেফাজাত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন : “যে লোক নামায সঠিকভাবে হেফাজাত করবে, তার এ নামায কিয়ামতের দিনে তার জন্যে আলো, দলীল ও মুক্তির কারণ হবে এবং যে তা সঠিকভাবে হেফাজাত করবে না, তার জন্যে নামায কিয়ামতের দিনে আলো, দলীল কিংবা মুক্তির কারণ হবে না। আর ঐ ব্যক্তি হাশরের দিনে কারুন, ফেরাউন ও উবাই ইবনে খালফের ন্যায় কাফেরদের সাথে উঠবে (আহমদ, দারেমী, বায়হাকী)


এখানে বিবেচ্য বিষয় এই যে, মুমিনদের সাতটি গুণ নামায দিয়েই শুরু করা হয়েছে এবং নামায দিয়েই শেষ করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, নামায এমন একটি ইবাদাত যা পরিপূর্ণভাবে এবং পাবন্দী ও নিয়ম-নীতির সাথে আদায় করলে অন্যান্য যাবতীয় গুণগুলো আপনা-আপনি নামাযির মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকবে ।

আলোচ্য আয়াতগুলোতে চিন্তা করলে দেখা যায়, উল্লিখিত সাতটি গুণের মধ্যে আল্লাহ্ ও বান্দার যাবতীয় হক বা অধিকার এবং এ সম্পর্কিত সব বিধি-বধান প্রবৃষ্ট হয়ে গেছে। যেসব ব্যক্তি এসব গুণে গুণান্বিত হয়ে যাবে এবং এতে অবিচল অটল থাকবে সে কামেল মুমিন হবে এবং ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের হকদার হয়ে যাবে ।


أولئِكَ هُمُ الْنُورِثُونَ الَّذِيْنَ يَرِثُونَ الْفِردَوسَ هُم فِيْهَا خَالِدُونَ

উল্লিখিত সাতটি গুণে গুণান্বিত লোকদেরকে এই আয়াতে জান্নাতুল ফেরদাউসের ওয়ারীশ বা উত্তরাধীকারীর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এখানে এজন্য উত্তরাধীকারী বলা হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকরীদের জন্য প্রাপ্য ও অনিবার্য হয়ে যায় তেমনি এসব গুণের অধিকারী মুমিন ব্যক্তিদের জন্য জান্নাত প্রবেশও সুনিশ্চিত হয়ে যায় ৷ আল্লাহ্ তাআলা এখানে জান্নাতের কথা বলতে গিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসের কথা বলেছেন। জান্নাতের যে আটটি স্তর রয়েছে তার মধ্যে সর্বউত্তম স্তর হচ্ছে জান্নাতুল ফেরদাউস। যেহেতু মুমিনদের এই সাতটি গুণ বিশেষ গুণ সে কারণে তাদের জন্য বিশেষ জান্নাত “ফেরদাউসের” ওয়াদা করেছেন । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের জন্য এবং তার উম্মতদেরকে জান্নাত কামনার জন্য

উত্তম জান্নাত চাওয়ার বাণী শিখিয়ে দিয়ে বলেছেন : اللهمَّ اِنّى اَسْتَلْكَ الْجَنَّةُ الْفِرْدَوُش

“হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করছি।”


শিক্ষাঃ সূরা মু'মিনুনের প্রথম ১১টি আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেসব শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলোঃ

* ঈমানদার হবার জন্য ঈমানের যেসব শর্ত রয়েছে তা যথাযতভাবে মানতে হবে। অর্থাৎ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে হবে।

* যে নামাযই হোক না কেনো তা আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে খুশূ-খুজু ও মনোযোগের সাথে ধীর-স্থিরভাবে আদায় করতে হবে।

* আজে-বাজে এবং অকল্যাণকর কথা, কাজ এবং চিন্তা থেকে দূরে থেকে কল্যাণকর এবং আখেরাতমুখী কথা, কাজ, ও চিন্তা করতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত করতে হবে।

* ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও ধন-সম্পদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধির জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে ।

* অবৈধ পথে যৌনক্ষুধা না মিটিয়ে বৈধ স্ত্রীর সাথে বৈধ পথে যৌন চাহিদা মিটাতে হবে। তবে একে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বানানো যাবে না। তাছাড়া যৌন সুড়সুড়ি সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজে বা পরিবেশে নিজেকে জড়ানো যাবে না । বেহায়াপনা ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। জেনার যে মূল দরজা পর্দা, তা ঠিকমত মেনে চলতে হবে।

* আল্লাহর পক্ষ থেকে হোক আর মানুষের পক্ষ থেকে হোক আমানত সমূহ যথাযতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে ।

* দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হোক আর একপক্ষ থেকে ওয়াদা হোক তা যথাযতভাবে মেনে চলতে হবে এবং ওয়াদা ও চুক্তি মতো আদায় করতে হবে।

* পাঁচ ওয়াক্ত নামায হেফাজতের জন্য নিজে যথাযতভাবে যথা সময়ে জামায়াতের সাথে মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ভাবে নামায প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

* সর্বপরি উপরোক্ত আমলগুলো বিশুদ্ধ নিয়্যাত এবং নিষ্টার সাথে কেবলমাত্র আল্লাহকে রাজী-খুশী করে জান্নাতুল ফেরদাউস পাবার আশায় করতে হবে। সাবধান থাকতে হবে যাতে করে মনের মধ্যে কোনোভাবেই রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি না হয়।


দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী
সূরা আল মু'মিনুন,
সুরা নং-২৩, আয়াত নং- ১ থেকে ১১

সংকলনেঃ ইমাম হোসেন আরমান (আরমানের খেরোখাতা)
ফেইসবুকে- www.facebook.com/Arman005.Blog

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২২

দারসুল কোরআন: সুরা হা-মীম আস্-সাজদাহ ৩০-৩৬ নং আয়াত

দারসুল কোরআন, সুরা হা-মীম আস-সাজদাহ ৩০-৩৬ নং আয়াত


৪১. সূরা হামীম আস্-সাজদাহ
মক্কায় অবতীর্ণ । আয়াত-৫৪, রুকু-৬
আলোচ্য: ৩০-৩৬ নং আয়াত ৷

بسم الله الرحمن الرحيم

إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَبْشِرُوا۟ بِٱلْجَنَّةِ ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ ٣٠ نَحْنُ أَوْلِيَآؤُكُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَفِى ٱلْـَٔاخِرَةِ ۖ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِىٓ أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ ٣١ نُزُلًۭا مِّنْ غَفُورٍۢ رَّحِيمٍۢ ٣٢ وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًۭا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَـٰلِحًۭا وَقَالَ إِنَّنِى مِنَ ٱلْمُسْلِمِينَ ٣٣ وَلَا تَسْتَوِى ٱلْحَسَنَةُ وَلَا ٱلسَّيِّئَةُ ۚ ٱدْفَعْ بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِى بَيْنَكَ وَبَيْنَهُۥ عَدَٰوَةٌۭ كَأَنَّهُۥ وَلِىٌّ حَمِيمٌۭ ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُوا۟ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍۢ ٣٥ وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ٱلشَّيْطَـٰنِ نَزْغٌۭ فَٱسْتَعِذْ بِٱللَّهِ ۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ ٣٦

সরল অনুবাদ : (৩০) “যারা ঘোষণা দিয়েছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতঃপর দৃঢ়ভাবে স্থির থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল হয় এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশী হও, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (৩১) আমরা এ দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাইবে তাই পাবে আর যে জিনিসের ফরমায়েশ করবে তাই লাভ করবে। (৩২) এটা মেহমানদারি ক্ষমাশীল ও দয়াবান আল্লাহর পক্ষ থেকে। (৩৩) সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎকাজ করলো এবং ঘোষণা দিল, আমি মুসলমান। (৩৪) উত্তম কাজ ও মন্দ কাজ সমান নয়। মন্দ প্রতিহত করো সবচেয়ে উত্তম দ্বারা। তাহলে দেখবে, যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। (৩৫) ধৈর্যশীল ব্যতীত এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ব্যতীত এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না। (৩৬) যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পার তাহলে আল্লাহর আশ্রয় কামনা কর। তিনি সবকিছু শোনেন এবং জানেন।”

নামকরণ: দু'টি শব্দযোগে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। একটি (হা-মীম) অপরটি (আস সাজদাহ। অর্থাৎ (হা-মীম) শব্দ দিয়ে এ সূরা শুরু হয়েছে এবং এ সূরার ৩৭ নং আয়াতে এক স্থানে সিজদার আয়াত আছে । এই সুরার আরো একটি নাম হলো ’ফুসসিলাত‘।

নাযিল হওয়ার সময়কাল : নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত অনুসারে এ সূরা নাযিল হওয়ার সময়কাল হচ্ছে, হযরত হামযা (রা)-র ঈমান আনার পর এবং হযরত উমর (রা)-এর ঈমান আনার পূর্বে। নবী (সা)-এর প্রাচীনতম জীবনীকার মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইবনে কা'ব আল-কুরাযীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, একদা কুরাইশ নেতারা মসজিদে হারামে একত্র হয়ে আসর জমিয়ে বসেছিল এবং মসজিদের অন্য এক কোণে রাসূলুল্লাহ (সা) একাকী বসেছিলেন। এটা এমন এক সময়ের ঘটনা যখন হযরত হামযা (রা) ঈমান গ্রহণ করেছিলেন। কুরাইশরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের সাংগঠনিক উন্নতি দেখে অস্থির হয়ে উঠছিল। এ সময় উতবা ইবনে রাবিয়া (আবু সুফিয়ানের শ্বশুর) কুরাইশ নেতাদের বললেন : ভাইসব! আপনারা যদি মত দেন তাহলে আমি মুহাম্মাদ (সা)-এর সাথে আলাপ করে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করতে পারি। সে যদি কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেয় তবে আমাদের নিকটও তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আর এভাবে সে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে । উপস্থিত সবাই তার সাথে একমত হলো। উতবা উঠে নবী (সা)-এর কাছে গিয়ে বসলো। নবী (সা) তার দিকে ফিরে বসলে সে বললো, ভাজিতা! বংশ ও গোত্রের বিচারে তোমার কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা তা তুমি অবগত আছ। কিন্তু তুমি তোমার কওমকে এক মসিবতের মধ্যে ফেলেছ। তুমি কওমের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছ। গোটা কওমকে নির্বোধ প্ৰতিপন্ন করেছ। কওমের ধর্ম ও তাদের উপাস্যদের সমালোচনা করছ এবং এমন কথা বলতে শুরু করেছ যে আমাদের বাপ-দাদারা নাকি কাফের ছিল । এখন আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। আমি তোমার কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখছি, তা তুমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ। হয়তো তার কোনটি তুমি গ্রহণ করতে পার কিনা?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে আবুল ওয়ালিদ, আপনি বলুন, আমি শুনবো ।
সে বললো:
১। ভাতিজা! তুমি যে কাজ শুরু করেছ তা দিয়ে সম্পদ অর্জন যদি তোমার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে এতো সম্পদ দেব যে, তুমি আমাদের মধ্যে সবার চেয়ে সম্পদশালী হয়ে যাবে ।
২। তুমি যদি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করে থাকো তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দিচ্ছি, তোমাকে ব্যতীত কোন বিষয়ে ফায়সালা করবো না ।
৩। যদি তুমি বাদশাহী চাও তাহলে আমরা তোমাকে বাদশা বানিয়ে দেবো ৷
৪ । আর যদি তোমাকে কোন জিনে আছর করে থাকে তাহলে আমরা ভাল ভাল চিকিৎসক ডেকে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি
৫। যদি তোমার কোন সুন্দরী নারীর প্রয়োজন মনে কর তাহলে আমরা তোমাকে দেশের সেরা সুন্দরী জোগাড় করে দেবো ।

উতবা বলছিল আর নবী করীম (সা) চুপচাপ তার কথা শুনছিলেন । অতঃপর তিনি বললেন : তাহলে এখন আমার কথা শুনুন। এরপর তিনি বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম পড়ে এই সূরা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। উতবা তার দুই হাত পেছনের দিকে মাটিতে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে থাকলো। সিজদার ৩৮ নং আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করে তিনি সিজদা করলেন এবং মাথা তুলে বললেন : “হে আবুল ওয়ালীদ! আমার জবাবও আপনি পেয়ে গেলেন। এখন যা ইচ্ছা করুন।”

উতবা উঠে কুরাইশ নেতাদের আসরের দিকে অগ্রসর হলে লোকজন দূর থেকে তাকে দেখেই বললো, আল্লাহর শপথ! উতবার চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে । যে চেহারা নিয়ে সে গিয়েছিল এটা সেই চেহারা নয়। সে এসে বসলে লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, কি শুনে এলে? সে বলোল, “আল্লাহর কসম! আমি এমন কথা শুনেছি যা এর আগে কখনও শুনিনি । আল্লাহর কসম! এটা না কবিতা, না যাদু, না গণনা বিদ্যা। হে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ! আমার কথা শোন এবং তাকে তার কাজ করতে দাও। আমার বিশ্বাস এ বাণী সফল হবেই । মনে কর যদি আরবের লোকেরা তার বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তাহলে নিজের ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা থেকে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে এবং অন্যরাই তাকে পরাভূত করবে। আর সে যদি আরবদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয় তাহলে তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব এবং তাঁর সম্মান ও মর্যাদা তোমাদের সম্মান ও মর্যাদা হবে।” তার কথা শুনামাত্র কুরাইশ নেতারা বলে উঠলো, ওয়ালীদের বাপ! শেষ পর্যন্ত তোমার উপর তার যাদুর প্রভাব পড়লো? উতবা বললো, “আমি আমার মত তোমাদের সামনে পেশ করলাম । এখন তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পারো।”

কোন কোন তাফসীরকারের বর্ণনায় একথাও আছে যে, নবী (সা) তিলাওয়াত করতে করতে فَإِنْ أَعْرَضُوا۟ فَقُلْ أَنذَرْتُكُمْ صَـٰعِقَةًۭ مِّثْلَ صَـٰعِقَةِ عَادٍۢ وَثَمُودَ (এখন যদি এসব লোক মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এদেরকে বলে দাও, আমি তোমাদেরকে আদ ও ছামূদ জাতির আযাবের মত অকস্মাৎ আগমনকারী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি)। আয়াতে পৌঁছলে উতবা আপনা থেকেই তাঁর মুখের উপর হাত চেপে ধরে বললো, “আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের কওমের প্রতি সদয় হও।”পরে সে কুরাইশ নেতাদের নিকট তার এ কাজের কারণ বর্ণনা করেছে এই বলে যে, আপনারা জানেন, মুহাম্মদের (সা) মুখ থেকে যে কথা বের হয় তা সত্যে পরিণত হয়। তাই আমি আমাদের উপর আযাব নাযিল না হয় এই ভেবে আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম ।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : উতবার এ কথার জওয়াবে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে যে কালামে পাকের ভাষণ নাযিল হয়, তাতে উতবার কথাগুলোর প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি, বরং কাফেরদের মূল বিরোধিতাকেই আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাফেররা কুরআন মজীদের দাওয়াতকে প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অত্যন্ত হঠকারিতা ও অনৈতিকতা সহকারে চেষ্টা করছিল। তারা নবী করীম (সা)-কে বলছিল, আপনি যাই করুন না কেন আমরা আপনার কোন কথাই শুনব না । আমরা আমাদের দিলের উপর পর্দা, কানে তালা ও আমাদের ও আপনার মাঝে একটা প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, তা উভয়কে একত্র হতে দেবে না ।

তারা পরিষ্কার ভাষায় নবী করীম (সা)কে জানিয়ে দিয়ে ছিল যে, আপনি আপনার দাওয়াতী কাজ করে যান, আমরা যথাসাধ্য আপনার বিরোধিতা করে যাব। তারা নবী করীম (সা)-কে প্রতিরোধ করার জন্য একটা পরিকল্পনা তৈরী করে ফেললো। নবী করীম (সা) ও তাঁর পক্ষের কোন লোক সাধারণ মানুষকে কুরআন মজীদ পড়ে শুনাতে চেষ্টা করলে তারা আকস্মিকভাবে এত উচ্চকণ্ঠে হাঙ্গামা ও চিৎকার করতো যে কানে তালা লেগে যেতো। কুরআনের আয়াতসমূহের উল্টো অর্থ করে জনগণের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি করতো। কুরআনের আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে, কিছু অংশ বাদ দিয়ে তদস্থলে নিজেদের মনগড়া কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিয়ে একটা নূতন কথা দাঁড় করাতো, যেন কুরআন ও রাসূল সম্পর্কে লোকদের ধারণা খারাপ হয় ৷

আশ্চর্য ধরনের সব প্রশ্ন ও আপত্তি করতো তারা। তার একটা নমুনা এ সূরায় পেশ করা হয়েছে। একজন আরব যদি আরবী ভাষায় কোন কালাম শুনায়, তবে তাতে মুজিযার কি আছে? আরবী তো তার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় যার ইচ্ছা সেই কোন না কোন কালাম রচনা করতে পারে, তা আল্লাহর নিকট থেকে নাযিল হয়েছে বলে দাবী করার কি আছে? তবে তিনি যে ভাষা জানেন না সেই ভাষায় উচ্চ মানের কোন কালাম যদি সহসা শুনাতে পারতেন তবে না হয় বুঝা যেতো, এটা তাঁর নিজস্ব রচিত নয়, এটা উপর হতে নাযিল হয়েছে। এ অন্ধ বিরোধিতার জবাবে যা কিছু বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো এই :

“মহান আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন আরবী ভাষায়ই নাযিল হয়েছে। এতে স্পষ্ট ভাষায় যে তত্ত্বকথা প্রকাশ করা হয়েছে মূর্খ লোকেরা তাতে কোন জ্ঞানের সন্ধান পায়নি বটে; কিন্তু সমঝদার লোকেরা তা হতে জ্ঞানের আলোর সাথে ফায়দাও পেতে পারেন। আর যারা তা হতে বিমুখ হয়, তাদের পরিণাম সম্পর্কে তাদের ভয় করা উচিত। তোমাদের হিদায়াতের জন্য এ কুরআন যদি কোন অনারব ভাষায় নাযিল করা হতো তাহলে তোমরাই তখন বলতে, আরববাসীদের হিদায়াতের জন্য অনারব ভাষায় কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা কেউ বুঝে না। আসলে তোমরা হিদায়াত পেতেই চাও না । তা না মানার জন্য নিত্য নূতন বাহানা তালাশ করছো ।

তোমরা নিজেদের চোখ কান যতই বন্ধ করে রাখ না কেন, নিজেদের দিলের উপর যত পর্দাই লাগাও না কেন, আসল সত্য কথা এই যে, তোমাদের আল্লাহ আর আমাদের আল্লাহ একই আল্লাহ । আল্লাহ ছাড়া তোমরা আর কারও বান্দা নও। তোমরা জিদ করলেই এ সত্য বদলে যাবে না। তোমরা যদি ইলম ও আমল ঠিক করে নাও, তবে তাতে তোমাদেরই কল্যাণ হবে। আর যদি নাই মানো তবে নিজেরাই ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

তোমরা এ শিরক ও কুফরী কার সঙ্গে করছ, সে বিষয়ে কোন অনুভূতি আছে কি? সেই আল্লাহর সাথে যিনি নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, যিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা, যিনি মৃত যমীন থেকে ফসল উৎপন্ন করে তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করছেন। তাঁরই নিকৃষ্ট সৃষ্টিকে তাঁর সাথে শরীক করছ। তোমাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করা হলে জিদের বশবর্তী হলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ। তোমরা যদি হিদায়াতের মধ্যে না আস তবে জেনে রেখো, তোমাদের উপর তেমনি আযাব সহসাই ভেঙ্গে পড়ার জন্য তৈরী হয়ে রয়েছে যেমন আদ ও ছামূদ জাতির উপর ভেঙ্গে পড়েছিল। আর সে আযাবও তোমাদের অপরাধের শেষ শাস্তি নয়, পরে হাশরের ময়দানে তোমাদের হিসাব নেয়া হবে এবং জাহান্নামের আগুন তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।

তোমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছ, কুরআন যদি সত্যিই আল্লাহর কালাম হয়ে থাকে তাহলে তা অমান্য করে এমনভাবে তার বিরোধিতা করলে তোমাদের পরিণতি কতখানি মর্মান্তিক হবে?

সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যখন নিজেদের চোখেই তোমরা দেখতে পাবে যে, এ কুরআনের দাওয়াত দিগ-দিগন্তে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, আর তোমরা তার প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছ। একথা প্রচার হওয়ার পর প্রচণ্ড বিরোধিতার পরিবেশে ঈমানদারগণ ও স্বয়ং নবী করীম (সা) যে পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেদিকেও বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করা হয়েছে। দ্বীনের তাবলীগ করা তো দূরের কথা, তখন ঈমানের পথে দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। দুশমনদের ভয়াবহ ঐক্যজোট ও চারদিকে সমাচ্ছন্ন শক্তির মুকাবিলায় তারা নিজেদেরকে নিতান্ত অসহায় ও বন্ধু-বান্ধবহীন মনে করছিলেন। এ অবস্থায় প্রথমত তাদেরকে একথা বলে সাহস দেয়া হয়েছে যে, আসলে তোমরা অসহায় ও বন্ধু-বান্ধবহীন নও । বরং যে ব্যক্তি আল্লাহকে একবার নিজের রব মেনে এ আকীদায় অটল ও মযবুত হয়ে থাকে, তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা নাযিল হয় এবং দুনিয়া হতে পারলোক পর্যন্ত তাকে সাহচর্য দান করে। পরে তাদের মনে অভয় দান করা হয়েছে একথা বলে যে, যারা নেক আমল করে, অন্য লোককে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানায় এবং শক্ত হয়ে বলে, আমরা “মুসলমান,” প্রকৃতপক্ষে তারাই উত্তম মানুষ।

নবী করীম (সা)-এর সন্মুখে একটি প্রশ্ন কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করছিল । প্রশ্নটা হলো, দ্বীনের এ দাওয়াতের পথে যখন এ কঠিন দুর্লংঘ্য পাহাড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে তখন এর মধ্য হতে ইসলাম প্রচারের পথ উন্মুক্ত হবে কেমন করে? জওয়াবে বলে দেয়া হয়েছে যে, এসব প্রদর্শনীমূলক প্রতিবন্ধকতার পাহাড় বাহ্যত খুবই কঠিন ও দুর্লংঘ্য মনে হয় বটে, কিন্তু উত্তম উন্নত মানের চরিত্রই হলো এমন হাতিয়ার যা তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। অতীব ধৈর্যের সাথে কাজ করে যাও এবং আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও ।“

ব্যাখ্যা :
(ক) - إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ .....ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ-কাফেরদের ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করার পর এখন ঈমানদার ও নবী করীম (সা)-কে সম্বোধন করা হচ্ছে। যারা আল্লাহকে রব বলে ঘোষণা করার পর অন্য কোন আকীদা গ্রহণ করেননি এবং নিজেদের কর্মজীবনে তাওহীদের আকীদার দাবীসমূহও পূরণ করেছেন । তাওহীদের উপর দৃঢ় থাকার অর্থ কি নবী (সা) ও প্রধান সাহাবাগণ তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, নবী (সা) বলেছেন : “বহু মানুষ আল্লাহকে তার রব বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ‍ই আবার কাফের হয়ে গিয়েছে। দৃঢ়পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।” (ইবনে জারীর, নাসাঈ, ইবনে আবু হাতেম) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

لم يشركوا بالله ولم يلتفتوا الى اله غيره -
“এরপর আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেননি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্টও হননি।” (ইবনে জারীর)
একবার হযরত উমর (রা) মিম্বরে উঠে এ আয়াত পাঠ করে বললেন : “আল্লাহর শপথ! নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, শিয়ালের মত এদিক থেকে সেদিকে এবং সেদিক থেকে এদিকে ছুটে বেড়ায়নি।” (ইবনে জারীর
হযরত উছমান (রা) বলেন : “নিজের আমলকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” (কাশশাফ )
হযরত আলী (রা) বলেন : “আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধিবদ্ধ করা ফরযসমূহ আনুগত্যের সাথে আদায় করেছে।” (কাশশাফ)
যে পরিস্থিতিতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে এই পৃথিবীতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য যারা জীবনপাত করছে তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতরণের কথা বর্ণনা করাই যে এখানে মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারে, মনোবল ফিরে পায় এবং এই অনুভূতিতে তাদের হৃয়দমন পরিতৃপ্ত হয় যে, তারা সহযোগী ও বন্ধুহীন নয়, বরং আল্লাহর ফেরেশতা তাদের সাথে আছে। মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা ঈমানদারদের স্বাগত জানাতে আসে, কবরেও তারা তাদের স্বাগত জানায় এবং যেদিন কিয়ামত হবে সেদিনও হাশরের শুরু থেকে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত সব সময় তারা তাদের সাথে থাকবে। তাদের এই সাহচর্য সেই জগতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এ পৃথিবীতেও চলছে। কথার ধারাবাহিকতা বলছে হক ও বাতিলের সংঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে, তেমনি ঈমানদারদের সাথে ফেরেশতারা থাকে ৷ শয়তান বাতিলপন্থীদের কর্তৃকর্মসমূহকে তাদের সঙ্গী-সাথীদের সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে যুলুম-অত্যাচার ও বেঈমানী করছো সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। আর হকপন্থীদের কাছে আল্লাহর ফেরেশতারা এসে যে সুখবরটি পেশ করে তা পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হচ্ছে :

(খ) : نَحْنُ أَوْلِيَآؤُكُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ .... وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ ٣١ এটা একটা ব্যাপক অর্থবোধক কথা বা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে । পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিলের শক্তি যতই পরাক্রান্ত হোক না কেন তাদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সহইতে হোক সেজন্য দুঃখ করবে না। কেননা ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তুচ্ছ। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছো সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমান। আর দুনিয়াতে যা কিছু তুমি ছেড়ে যাচ্ছ সেজন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা এখানে আমি তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু । আলমে বারযাখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা একথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে, এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছ, সেজন্য দুঃখ করো না এবং আখেরাতে যা কিছু সামনে আসবে সেজন্য ভয় পাবে না। কারণ আমরা তোমাদেরকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছি যার প্রতিশ্রুতি আগেই তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে ।

(গ) - وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًۭا .... إِنَّنِى مِنَ ٱلْمُسْلِمِينَ - "সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি মুসলিম!”
তোমরা নিজেরা নেক কাজ কর, অন্যদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে ডাক এবং ইসলামের ঘোষণা দেয়াই যেখানে নিজেদের জন্য বিপদজনক এবং দুঃখ-মুসিবতকে আহ্বান জানানোর শামিল, এমন কঠিন পরিবেশেও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করো, আমি মুসলমান। মানুষের এর চেয়ে উচ্চস্তর ঘোষণা আর কিছু নেই। এ কথার গুরুত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করার জন্য যে পরিস্থিতিতে তা বলা হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সে সময় অবস্থা এই ছিল যে, যে ব্যক্তিই মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করতো সে হঠাৎ করেই অনুভব করতো যেন হিংস্র শ্বাপদ ভরা জংগলে পা দিয়েছে, যেখানে সবাই তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য ছুটে আসছে। যে ব্যক্তি আরও একটু অগ্রসর হয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য মুখ খুলছে, সে যেন তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য হিংস্র পশুকুলকে আহ্বান জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে সোজা পথ গ্রহণ করা এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া নিঃসন্দেহে দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ।

নিজে মুসলমান বলে ঘোষণা দেয়া, সৃষ্টিকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহ্বান জানানো এবং কেউ যেন ইসলাম ও তার ঝাণ্ডাবাহীদের দোষারোপ ও নিন্দাবাদ করার সুযোগ না পায় এরূপ কাজ করতে গিয়ে নিজের তৎপরতাকে সেভাবে পবিত্র রাখা হচ্ছে পূর্ণ মাত্রার ঈমানদারি ।

(ঘ) - وَلَا تَسْتَوِى ٱلْحَسَنَةُ وَلَا ....ۥ عَدَٰوَةٌۭ كَأَنَّهُۥ وَلِىٌّ حَمِيمٌۭ - হে নবী, সৎ কাজ আর অসৎ কাজ সমান হতে পারে না। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা আবৃত কর যা সবচেয়ে ভাল । তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।
তখন অবস্থা ছিল এই যে, চরম হঠকারিতা এবং আক্রমণাত্মক বিরোধিতার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের মুকাবিলা করা হচ্ছিল। নৈতিকতা, মানবতা ও ভদ্রতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছিল। নবী (সা) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে সব রকমের মিথ্যা আরোপ করা হচ্ছিল। তাঁর বদনাম করা এবং তাঁর সম্পর্কে লোকদের মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য সব রকমের দুষ্টবুদ্ধি ও কূটকৌশল কাজে লাগানো হচ্ছিল । তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছিল এবং শত্রুতামূলক প্ররোচনার জন্য পুরো একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। তাঁকে, তাঁর সঙ্গীদেরকে সর্বপ্রকারে কষ্ট দেয়া হচ্ছিল । তাতে অতিষ্ঠ হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাঁর ইসলাম প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পরিকল্পনা মাফিক হৈ চৈ ও হট্টগোল করার জন্য একদল লোককে সবসময় তৈরী রাখা হতো। যখনই তিনি ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত দেয়ার জন্য কথা বলতে শুরু করতেন তখনই তারা শোরগোল করতো কেউ তাঁর কথা শুনতে না পায়। এটা এমন একটা নিরুৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি ছিল যে, বাহিক্যভাবে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ বলে মনে হচ্ছিল। বিরোধিতা নস্যাৎ করার জন্য সেই সময় নবী (সা)-কে পন্থা বলে দেয়া হয়েছিল । প্রথমে বলা হয়েছে, সৎ কর্ম ও দুষ্কর্ম সমান নয়। তোমাদের বিরোধীরা যত ভয়ানক তুফানই সৃষ্টি করুক না কেন এবং তার মুকাবিলায় নেকীকে যত অক্ষম ও অসহায়ই মনে হোক না কেন দুষ্কর্মের নিজের মধ্যেই এমন দুর্বলতা আছে যা শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্বভাব প্রকৃতি দুষ্কর্মকে ঘৃণা না করে পারে না। দুষ্কর্মের সহযোগীই শুধু নয়, তার ধ্বজাধারী পর্যন্ত মনে মনে জানে, সে মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী এবং সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটি অন্যদের মনে তার প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করা তো দূরের কথা, নিজের কাছেই তাকে খাটো করে দেয়। এভাবে তার নিজের মনের মধ্যেই এক চোর জন্ম নেয়। শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এ চোর ভিতর থেকেই তার সংকল্প ও মনোবলের উপর সংগোপনে হানা দিতে থাকে । এই দুষ্কর্মের মুকাবিলায় যে সৎকর্মকে সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় বলে মনে হয়, তার প্রচারের তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকলে শেষ পর্যন্ত সেই বিজয়ী হবে। কারণ প্রথমত সৎকর্ম নিজেই একটি শক্তি যা হৃদয়-মনকে জয় করে এবং ব্যক্তি যতই শত্রুতাভাবাপন্ন হোক না কেন সে নিজের মনে তার জন্য সম্মানবোধ না করে পারে না। তাছাড়া নেকী ও দুষ্কর্ম যখন সামনাসামনি সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং উভয়ের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয় এমন পরিস্থিতিতে কিছুকাল সংঘাতে লিপ্ত থাকার পর খুব কম লোকই এমন থাকতে পারে যারা দুষ্কর্ম ঘৃণা করবে না এবং সৎ কর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে না ।

দ্বিতীয়ত, দুষ্কর্মের মুকাবিলায় শুধু মাত্র সৎকর্ম দিয়ে নয়, অনেক উচ্চ মানের সৎকর্ম দিয়ে মুকাবিলা কর । অর্থাৎ কেউ যদি তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে আর তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও তাহলে শুধু সৎ কর্ম হলো । উন্নত পর্যায়ের সৎকর্ম হচ্ছে, যে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবে সুযোগ পেলে তুমি তার প্রতি অনুগ্রহ কর, তার উপকার কর ।

এর সুফল এই যে, জঘন্যতম শত্রুও এভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে। কারণ এটিই মানুষের প্রকৃতি । আপনি যদি গালির জবাব না দিয়ে চুপ থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি নেকী বা সৎ কর্ম । অবশ্য তা গালিদাতার মুখ বন্ধ করতে পারবে না। কিন্তু গালির জবাবে আপনি যদি তার কল্যাণ কামনা করেন তাহলে চরম নির্লজ্জ শত্রুও লজ্জিত হবে এবং আর কখনও আপনার বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলার জন্য মুখ খোলা তার পক্ষে কঠিন হবে। একজন লোক আপনার ক্ষতি করার কোন সুযোগই হাতছাড়া হতে দেয় না। আপনি যদি তার অত্যাচার বরদাশত করে যেতে থাকেন তাহলে সে হয়তো তার দুষ্কর্মের ব্যাপারে আরও সাহসী হয়ে উঠবে । কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেখে যদি আপনি তাকে রক্ষা করেন তাহলে সে আপনার একান্ত অনুগত হয়ে যাবে। কারণ ঐ সুকৃতির মুকাবিলায় কোন দুষ্কৃতিই টিকে থাকতে পারে না। তা সত্ত্বেও এই সাধারণ নিয়মকে এ অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, উন্নত পর্যায়ের সৎকর্মের মাধ্যমে সব রকমের শত্রু অনিবার্যরূপে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন জঘন্য মনের মানুষও আছে যে তার অত্যাচার ক্ষমা করা ও দুষ্কৃতির জবাব অনুকম্পা ও সুকৃতির মাধ্যমে দেয়ার ব্যাপারে আপনি যতই তৎপর হোন না কেন তার বিচ্ছুর ন্যায় বিষাক্ত হুলের দংশনে কখনো ভাটা পড়বে না। তবে এ ধরনের খারাপ মানুষ ততটাই বিরল যতটা বিরল উন্নত পর্যায়ের ভাল মানুষ ৷

(ঙ) - ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ .... إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍۢ - ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না ।

এটা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হলেও এজন্য দরকার দৃঢ়সংকল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা । এটা কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই এসব গুণের বাহক হওয়া সম্ভব যে বুঝেশুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানবুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকী ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামী তাকে তার উচ্চাসন থেকে নীচে নামিয়ে আনতে সক্ষম নয় ।
এটা প্রকৃতির বিধান। অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার মানুষই কেবল এই গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে । আর যে ব্যক্তি এই গুণাবলীর অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনজিলে মকসুদে পৌছা থেকে বিরত রাখতে পারে না । কেউ নীচ আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনভাবেই সম্ভব নয় ।

(চ) وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ....هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ - যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পার তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন ।

শয়তান যখন দেখে, হক ও বাতিলের লড়াইয়ে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দ্বারা হীনতার এবং সুকৃতি দ্বারা দুষ্কৃতির মুকাবিলা করা হচ্ছে, তখন সে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। সে চায় কোনভাবে একবারের জন্য হলেও হকের পক্ষে সংগ্রামকারী, বিশেষ করে তাদের বিশিষ্ট লোকজন ও তাদের নেতৃবৃন্দের দ্বারা এমন কোন ত্রুটি সংঘটিত করিয়ে দেয়া যায় কিনা যাতে সাধারণ মানুষকে বলা যায়, দেখুন খারাপ কাজ এক তরফা হচ্ছে না। একপক্ষ থেকে নীচ ও জঘন্য কাজ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু অপর পক্ষের লোকেরাও খুব একটা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ নয়, তারাও তো অমুক হীন আচরণ করেছে। এক পক্ষের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষের জবাবী তৎপরতার মধ্যে ইনসাফের সাথে তুলনামূলক বিচারের যোগ্যতা সাধারণ মানুষের থাকে না ।

যতক্ষণ তারা দেখে বিরোধীরা সব রকমের জঘন্য আচরণ করছে, কিন্তু এই লোকগুলো ভদ্রতা ও শিষ্টাচার এবং মর্যাদা, নেকী ও সত্যবাদিতার পথ থেকে বিন্দুমাত্রও দূরে সরে যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর তার গভীর প্রভাব পড়তে থাকে। কিন্তু যদি কোথাও তাদের পক্ষ থেকে কোন অযৌক্তিক বা তাদের মর্যাদার পরিপন্থী আচরণ হয়ে যায়, তা কোন বড় যুলুমের প্রতিবাদে হলেও তাদের দৃষ্টিতে তারা উভয়েই সমান হয়ে যায় এবং বিরোধীরাও একটি শক্ত কথার জবাব হঠকারিতার সাহায্যে দেয়ার অজুহাত পেয়ে যায়। এ করণে বলা হয়েছে, শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে তোমরা সাবধান থাকো। সে অত্যন্ত দরদী ও মঙ্গলকামী সেজে এই বলে তোমাদেরকে উত্তেজিত করবে যে, অমুক অত্যাচার কখনো বরদাশত করা উচিত নয়, অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এই আক্রমণের জবাবে লড়াই করা উচিত। অন্যথা তোমাদেরকে কাপুরুষ মনে করা হবে এবং তোমাদের আদৌ কোন প্রভাব থাকবে না ।

এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমরা যখন নিজেদের মধ্যে কোন অযথা উত্তেজনা অনুভব করবে তখন সাবধান হয়ে যাও। কারণ তা শয়তানের প্ররোচনা। সে তোমাদের উত্তেজিত করে কোন ভুল সংঘটিত করাতে চায় ৷ সাবধান হয়ে যাওয়ার পর মনে করো না, আমি আমার মেজাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি, শয়তান আমাকে দিয়ে কোন ত্রুটি করাতে পারবে না। নিজের এই মনে করাটা হবে শয়তানের আরেকটি বেশী ভয়ংকর হাতিয়ার এর চেয়ে বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত । কারণ তিনি যদি তাওফীক দান করেন ও রক্ষা করেন তবেই মানুষ ভুলত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে পারে। ইমাম আহমাদ (রা) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেন, নবী (সা)-এর সামনে একদা এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে অকথ্য গালিগালাজ করতে লাগলো। হযরত আবু বকর (রা) চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী (সা) মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর (রা) ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটা কঠোর কথা বলে ফেললেন । তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবী (সা)-এর উপর চরম বিরক্তি ভাব ছেয়ে গেল এবং ক্রমে তা তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুটে উঠতে লাগলো। তিনি তখনই উঠে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরও উঠে তাঁর অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিল তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? নবী (সা) বললেন : আপনি যতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন ততক্ষণ একজন ফেরেশতা আপনার সাথে থেকে আপনার পক্ষ হয়ে জবাব দিচ্ছিল। যখন আপনি জবাব দিলেন তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল । শয়তান যেখানে আছে আমি তো সেখানে থাকতে পারি না ।

বিরোধিতার তুফানের মুখে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার পর যে জিনিসটি মুমিনের হৃদয়ে ধৈর্য, গভীর প্রশান্তি ও পরম তৃপ্তির সৃষ্টি করে তাতে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার মাথা নত হয়ে আসবে। আমাদের ও আমাদের বিরোধীদের সব কথাই তিনি শুনছেন এবং উভয়ের কর্মনীতি যা কিছুই হোক না কেন তা তিনি দেখছেন। এই অবস্থার কারণেই মুমিন বান্দা নিজের ব্যাপারটি এবং ন্যায় ও সত্যের দুশমনের ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হয়ে যান ।

কুরআন মজীদে এই পঞ্চমবার নবী (সা)-কে ও তাঁর মাধ্যমে ঈমানদারদেরকে দীন ইসলামের দাওয়াত এবং সমাজ সংস্কারের এ কৌশল শেখানো হয়েছে। এর পূর্বে আরও চার বার চার স্থানে এ কৌশল শেখানো হয়েছে ।

সে সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আ'রাফ : ১১০-১১১ আয়াত, সূরা আন-নাহল : ১২৫-১২৭ আয়াত, সূরা আল-মুমিনূন : ৯৬ আয়াত ও সূরা আনকাবূত : ৪৮ আয়াত ৷



শিক্ষা :

১। আমরা আল্লাহকে আমাদের রব বলে ঘোষণা দেবো, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি রহমতের ফেরেশতা নেমে এসে আমাদেরকে অভয় দান করবে এবং বেহেশতের সুসংবাদ দেবে। সেই ফেরেশতা দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে প্রত্যেক কাজে আমাদেরকে সহায়তা দেবে ।

২। আমরা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবো, সৎ কাজ করবো এবং নিজকে আত্মসমর্পণকারী হিসেবে ঘোষণা দেবো ।

৩। সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। সৎ কাজ দ্বারা অসৎ কাজের মুকাবিলা করবো, তাহলে প্রাণের দুশমনও অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে ।

৪ । শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । ঈমানদারগণ নিজেদের মধ্যে শয়তানের প্ররোচনা টের পেলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে ।





বাস্তবায়ন : আমরা যারা আল্লাহকে রব বলে স্বীকৃতি দেয়ার পর অবিচল থেকে রহমতের ফেরেশতার সহায়তা নিয়ে আল্লাহ ঘোষিত সর্বোত্তম কথা- আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান ও সৎ কাজ করবো এবং নিজেদেরকে আত্মসমর্পণকারী হিসেবে ঘোষণা দেবো। অসৎ কাজকে সৎ কাজ দ্বারা সংশোধনের চেষ্টা করতে গিয়ে শয়তানের প্ররোচনা টের পেলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবো। এভাবে আল্লাহর দ্বীনের সর্বোত্তম বৈশিষ্টগুলোর সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলন ঘটিয়ে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে । ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ ।




Tag: Darsul Quran-Sura Hamim As Sajdah দারসুল কোরআন-সূরা হামিম আস সাজদাহ

রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

দারসুল কোরআনঃ সূরা আল হুজরাত ১ম রুকু


👉সূরা আল হুজরাত, ১-১৩ নং আয়াত:-
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تُقَدِّمُوا۟ بَيْنَ يَدَىِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌۭ ١
 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَرْفَعُوٓا۟ أَصْوَٰتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ ٱلنَّبِىِّ وَلَا تَجْهَرُوا۟ لَهُۥ بِٱلْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَـٰلُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ ٢
 إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَٰتَهُمْ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُو۟لَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمْتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ ۚ لَهُم مَّغْفِرَةٌۭ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ ٣
 إِنَّ ٱلَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَآءِ ٱلْحُجُرَٰتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ ٤
 وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا۟ حَتَّىٰ تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًۭا لَّهُمْ ۚ وَٱللَّهُ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٥
 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِن جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَإٍۢ فَتَبَيَّنُوٓا۟ أَن تُصِيبُوا۟ قَوْمًۢا بِجَهَـٰلَةٍۢ فَتُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَـٰدِمِينَ ٦
 وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ ٱللَّهِ ۚ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِى كَثِيرٍۢ مِّنَ ٱلْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ ٱلْإِيمَـٰنَ وَزَيَّنَهُۥ فِى قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ ٱلْكُفْرَ وَٱلْفُسُوقَ وَٱلْعِصْيَانَ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ ٧
 فَضْلًۭا مِّنَ ٱللَّهِ وَنِعْمَةًۭ ۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ ٨
 وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُوا۟ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَهُمَا ۖ فَإِنۢ بَغَتْ إِحْدَىٰهُمَا عَلَى ٱلْأُخْرَىٰ فَقَـٰتِلُوا۟ ٱلَّتِى تَبْغِى حَتَّىٰ تَفِىٓءَ إِلَىٰٓ أَمْرِ ٱللَّهِ ۚ فَإِن فَآءَتْ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَهُمَا بِٱلْعَدْلِ وَأَقْسِطُوٓا۟ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ ٩
 إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌۭ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ١٠
 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا يَسْخَرْ قَوْمٌۭ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُوا۟ خَيْرًۭا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَآءٌۭ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيْرًۭا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوٓا۟ أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا۟ بِٱلْأَلْقَـٰبِ ۖ بِئْسَ ٱلِٱسْمُ ٱلْفُسُوقُ بَعْدَ ٱلْإِيمَـٰنِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّـٰلِمُونَ ١١
 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱجْتَنِبُوا۟ كَثِيرًۭا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ ٱلظَّنِّ إِثْمٌۭ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا۟ وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًۭا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٌۭ رَّحِيمٌۭ ١٢
 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَـٰكُم مِّن ذَكَرٍۢ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَـٰكُمْ شُعُوبًۭا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓا۟ ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ ٱللَّهِ أَتْقَىٰكُمْ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌۭ ١٣

👉বঙ্গানুবাদঃ
১. মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের চেয়ে অগ্রগামী হয়োনা এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
২. হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের আওয়াজ রাসূলের আওয়াজের চেয়ে উচু করোনা এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলোনা যেরুপ তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয় যে; তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়।
৩. যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের কন্ঠ নিচু রাখে তারাই সে সব লোক আল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।
৪. হে নবী, যারা আপনাকে ঘরের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে থাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।
৫. যদি তারা আপনার বের হয়ে আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারন করত তবে তাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
৬. হে ঈমানদারগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ। এমন যেন না হয় যে, না জেনে শুনেই তোমরা কোন গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।
৭. ভালো করে জেনে রাখ আল্লাহর রাসূল তোমাদের মাঝে রয়েছেন। তিনি যদি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তোমাদের কতা মেনে নেন তবে তোমরাই অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ঈমানের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের কাছে পছন্দনীয় করে দিয়েছেণ। পক্ষান্তরে কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে ঘৃনিত করে দিয়েছেন।
৮. আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে এসব লোকই সৎপথের অনুগামী। আল্লাহ জ্ঞানী ও কুশলী।
৯. যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনছাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনছাফকারীদেরকে পছন্দ করেন।
১০. মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।
১১. মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।
১২. মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
১৩. হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।
👉নামকরণঃ ৪র্থ আয়াত থেকে গৃহীত।
👉নাযিল হওয়ার সময়কালঃ বিভিন্ন বর্ণনা ও সুরার বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায় এ সুরা বিভিন্ন পরিবেশ ও ক্ষেত্র নাযিল হওয়া হুকুম আহকাম ও নির্দেশ সমূহের সমষ্টি। বিষয়বস্তু সাদ্যৃশ্যের কারনে এগুলোকে এখানে একত্রিত করা হয়েছে।
৪র্থ আয়াত সম্পকে ঘটনা –
একবার বনী তামিম গোত্রের কিছু লোক রাসূল (সা:) এর নিকট উপস্থিত হয়। এই গোত্রের শাসনকর্তা নিয়োগ সম্পর্কিত আলোচনা চলছিল। হযরত আবু বকর (রা:) রা’কা ইবনে হাকিমের নাম এবং হযরত উমর (রা:) আকরা ইবনে হাফসের নাম প্রস্তাব করেন। হযরত আবু বকর (রা:) এবং হযরত উমর (রা:) এর মধ্যে চলমান এ আলোচনা এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটিতে উন্নীত হয়ে উভয়ের কন্ঠস্বর উচু হয়ে যায় (বুখারী)।
হিজরী ৯ম সন এ প্রতিনিধি দলের আগমনের সময়। আলোচ্য আয়াতসমূহের অবতরণ সম্পর্কে কুরতুযীর ভাষ্য অনুযায়ী ৬টি ঘটনা বর্ণিত আছে। সব ঘটনা নির্ভুল।
৬ষ্ঠ আয়াত সম্পর্কে ঘটনাঃ
মুসনাদে আহমাদের বরাত দিয়ে ইবনে কাসীর –
বনী মুস্তালিক গোত্রের সরদার হারেস ইবনে মেরাব ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা:) তাকে যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন। তিনি যাকাত প্রদানে স্বীকৃত হলেন এবং তারা গোত্রে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের যাকাত আদায় করে জমা করে রাখবেন বললেন এবং রাসূল (সা:) কে একটি নিদিষ্ট তারিখে যাকাতের অর্থ নেবার জন্য কোন দুত পাঠাতে বললেন। কিন্তু নির্ধারিত তারিখ পার হয়ে গেলেও দুতের দেখা না পেয়ে হারেস আশংকা করলেন রাসূল (সা:) কোন কারনে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং একথা তিনি ইসলাম গ্রহনকারী নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে প্রকাশ করে রাসূল (সা:) এর সাথে সবাই মিলে দেখা করার ইচ্ছা করলেন। এদিকে রাসূল নির্ধারিত তারিখে ওলীদ ইবনে ওকবা কে প্রেরণ করলেও তিনি পথিমধ্যে ধারনা করেন এই গোত্রের লোকদের সাথে তার পুরাতন শত্র“তা আছে। তাকে একা পেয়ে হত্যা না করে ফেলে। তিনি ফিরে আসেন এবং রাসূল (সা:) কে বলেন তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছে। রাসূল (সা:) রাগান্বিত হয়ে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ প্রেরণ করেন। অত:পর তা জানতে পেরে হারেস রাসূল (সা:) কে বলেন তিনি ওলীদকে দেখেনইনি।
কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে – ওলীদ ইবনে ওকবা (রা:) নির্দেশ অনুযায়ী বনু মুস্তালিক গোত্রে পৌছেন। গোত্রের লোকেরা অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে বস্তি থেকে বের হয়ে আসে। ওলীদ সন্দেহ করে তারা বোধ হয় পুরাতন শত্র“তার কারনে তাকে হত্যা করতে আসছে। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে এ ধারনা ব্যক্ত করলে রাসূল (সা:) খালিদ ইবনে ওলীদ কে ঘটনা পর্যবেক্ষনের নির্দেশ দিলেন। তিনি ফিরে এসে সংবাদ দিলেন তারা ঈমানের উপর অটল রয়েছে/যাকাত দিতে প্রস্তুত।
ওলীদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হয়েছিলেন।
তাই এটি স্পষ্ট যে এ যুগের বেশীর ভাগ অংশই মাদানী যুগের শেষ পর্যায়ে নাজিলকৃত।
👉আলোচ্য বিষয়ঃ
এ সুরার বিষয়বস্তু হলো মুসলমানদেরকে এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরন শিক্ষা দেয়া যা তাদের ঈমানসুলভ স্বভাব-চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই।
 প্রথম পাঁচ আয়াতে আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে আদব কায়দা শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
 এরপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রতিটি খবর বিশ্বাস করা এবং সে অনুযায়ী কর্মকান্ড করে বসা ঠিক নয়।
 মুসলমানদের দুটি দল যদি কোন সময় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে অন্য মুসলমানদের কর্মনীতি।
 মুসলমানদেরকে কিছু খারাপ বিষয় থেকে আতœরক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
★একে অপরকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করা
★বদনাম উপহাস করা
★উপনামে ডাকা
★গোপন বিষয় খোজাখুজি
 সবশেষে বলা হয়েছে- ঈমানের মৌখিক দাবী প্রকৃত জিনিস নয় বরং সরল মনে আল্লাহ ও রাসূলকে মানা, কার্যত অনুগত থাকা এবং কুরবানী।
১. প্রথম আদব – আল্লাহ ও রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী না হওয়া। এটা ঈমানের প্রাথমিক ও মৌলিক দাবী।
 নিজের মতামত ও ধ্যান ধারনাকে আল্লাহ রাসূলের সিদ্ধান্তের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পারেনা এবং বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাধীন মতামত পোষন করতে পারেনা।
 সুরা আহযাবের ৩৬ আয়াতে এরুপ নির্দেশ আল্লাহ ও তার রাসূল যে বিষয়ে ফয়সালা করে দিয়েছেন সে বিষয়ে আলাদা কোন ফয়সালা করার ইখতিয়ার কোন ঈমানদারের জন্য আর অবশিষ্ট থাকে না।
 এ নির্দেশটি শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং মুসলমানদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য (সরকার, বিচারালয়, পার্লামেন্ট) সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসঃ
মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেনের বিচারক করে পাঠানোর সময় নবী (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কিসের ভিত্তিতে ফয়সালা করবে?” তিনি বললেন- “আল্লাহ কিতাব অনুসারে।” নবী (সা:) বললেন যদি কিতাবে না পাওয়া যায় তিনি জবাব দিলেন আল্লাহ রাসূলের সুন্নাতের সাহায্য নেব? নবী (সা:) বললেন যদি সেখানে না পাও তিনি জবাব দিলেন তাহলে আমি নিজে ইজতেহাদ করব। তাই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাবই সর্বপ্রথম উৎস এবং তারপরই হাদীসের স্থান। এবং এক্ষেত্রে নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিলে বোঝাপড়া হবে আল্লাহর সাথে।
২. যারা রাসূল (সা:) এর মজলিশে যাতায়াত করত তাদেরকে এ আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্যে তার সাথে কথা বলার সময় যেন তার মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রাখা হয়।
 এক্ষেত্রে যখনই নবী (সা:) এর আলোচনা করা হয় এবং তার হাদীস বর্ণনা করা হয় তখন পরবর্তী সময়ের লোকদের অনুরুপে শিষ্টতা বজায় রাখা দরকার
 এছাড়া নিজের চাইতে উচ্চ মর্যাদার লোকদের সাথে কথা বলার শিষ্টতা এখানে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
 ইসলামে রাসূলের ব্যক্তিসত্ত্বার মর্যাদা এ আয়াত থেকে বোঝা যায়। রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সামান্য শিথিলতায় সারা জীবনের সঞ্চিত পুজি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা না করা মূলত আল্লাহর প্রতি করা না করার পর্যায়ভুক্ত।
৩. অর্থ্যাৎ যে হৃদয়ে রাসূলের মর্যাদা নেই সে হৃদয়ে তাকওয়া থাকতে পারেনা। যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা রাসূলের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করে।

৪. আরবের সে পরিবেশে যেখানে সাধারন ভাবে মানুষ কোন প্রকার শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়নি তাদের অনেকেই সময়ে সময়ে রাসূলের সাথে সাক্ষাতের জন্য হাজির হতো তার হুজরার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বাইরে থেকেই তাকে ডাকতো। স্বভাবগত কারনেই রাসূল (সা:) এসব সহ্য করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলেন।

৫. অর্থ্যাৎ চিৎকার না করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে রাসূল নিজেই এসে তাদের সাথে সাক্ষাত করতেন। এ আয়াতে এ ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
৬. অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে এটি ওলীদ ইবনে ওকবা ইবনে আবা মুআ’ইত সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।
হারেস ইবনে মেরার (উম্মুখ মুমিনিন হযরত জুয়াইরিয়ার পিতা) এক প্রতিনিধি দল নিয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হন।
হযরত উম্মে সালামা বর্ণিত হাদীসে পুরো ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামের নাজুক পরিস্থিতিতে যখন একটি ভিত্তিহীন সংবাদকে কেন্দ্র করে এত বড় ভুল সংঘটিত হতে যাচ্ছিল সে মুহুর্তে আল্লাহ এ মৌলিক নির্দেশ দিলেন যে, যখন এমন কোন খবর পাওয়া যাবে যার ভিত্তিতে বড় রকমের কোন ঘটনা সংঘটিত হতে পারে তখন তা বিশ্বাস করার পূর্বে বার্তাবাহক কেমন ব্যক্তি তা যাচাই করতে হবে।
 যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেই প্রতীয়মান হয় যে বার্তাবাহক নির্ভরযোগ্য নয় (ফাসেক) তবে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী কাজ করার পূর্বে তা যাচাই করা দরকার।
 যার চরিত্র ও কর্ম নির্ভরযোগ্য নয় এমন কোন সংবাদদাতার সংবাদের উপর ভিত্তি করে কোন, ব্যক্তি, জাতি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা ইসলামী সরকারের জন্য বৈধ নয়।
হাদীস শাস্ত্রবিদগণ এ প্রেক্ষিতে ‘জারহ ও তা’দীল’ এর নীতি উদ্ভাবন করেছেন।
 যাতে যাদের মাধ্যমে নবী (সা:) এর হাদীস পরবর্তী বংশধরদের নিকট পৌছেছিল তাদের অবস্থা যাচাই করা যায়।
 তাছাড়া সাক্ষ্য আইনের ক্ষেত্রে নীতি হলো এমন কোন ব্যাপারে ফাসেক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহনযোগ্য হবেনা যা দ্বারা শরীয়তের কোন নির্দেশ প্রমানিত হয় কিংবা কোন মানুষের উপর কোন অধিকার বর্তায়।
তবে সাধারন পার্থিব ব্যাপারে প্রতিটি খবর অনুসন্ধান এবং সংবাদাতার নির্ভরযোগ্যতা জরুরী নয়। কারন আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ খবর বলা হয়েছে।
৭. বন্ধু মুসতালিক গোত্র সম্পর্কে ওয়ালীদ ইবনে উকরার খবরের ভিত্তিতে নবী (সা:) তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহন করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু কিছু সাহাবী তৎক্ষনাৎ তাদের বিরুদ্ধে আক্রমন করার জন্য নবী (সা:) কে পীড়াপীড়ি করছিল। এ প্রেক্ষিতে এই আয়াত।
৮. অর্থ্যাৎ কতিপয় লোক তাদের অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত জানালেও মুসলমানদের গোটা জামায়াত ভুল করেনি। মুমিনদের সঠিক পথের উপর কায়েম থাকার কারন হচ্ছে আল্লাহ তার দয়া ও মেহেরবানীতে ঈমানী আচরনকে তাদের জন্য প্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন এবং নাফরমানী আচরনকে ঘৃনিত করে দিয়েছেন।
আয়াতের দুটি অংশে দুটি ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। “যারা বনু মুসতালিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য পীড়াপীড়া করছিল তাদের কথা বলা হয়েছে।”
“কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করেনি। বরং ঈমানের দাবীর উপর ছিলেন।
তবে তারা ঈমানের প্রতি অটল ছিলনা একথা বলা হয়নি, বরং শিথিলতার কথা বলা হয়েছে। তাই তিনি (আল্লাহ) প্রথমে এর ভুল ও কুফল তুলে ধরেছেন।
৯. আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী কোন ভাগ বাটোয়ারা নয়। তিনি এ বিরাট নেয়ামত জ্ঞান যুক্তির ভিত্তিতে দান করেন।

👉ব্যাখ্যাঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

১. হে ঐ সব লোকযারা ঈমান এনেছো। তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূল থেকে এগিয়ে যেও না। আর আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ সব কিছু শুনেন ও জানেন।

 

 

 

·   لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ – আল্লাহ ও তাঁর রসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না৷

— ঈমানের প্রথম ও মৌলিক দাবী হচ্ছেঃ যে আল্লাহকে নিজের মালিক হিসাবে মানে এবং রাসূল সা.কে জান্নাতের পথ প্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করেতাহলে তাকে তার এই ঈমানের উপর সত্যবাদীতা প্রমাণ করতে হবে এই ভাবে যে,

ক. নিজ মতামত ও ধ্যান-ধারণাকে কখনো আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের চেয়ে অগ্রাধিকার দেবে না।

খ. বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাধীন মতামত পোষণ করতে পারবে না।

গ. সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব সময় আগে দেখে নেবে যেএই ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ কি।

— لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ-” আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অগ্রগামী হয়ো না৷” মানেঃ

          তার আগে আগে চলবে না।

          পেছনে পেছনে চলো ৷

          তার আনুগত্য হয়ে থাকো ৷

          নির্দেশ দাতা হয়োনাআনুগত্যকারী হও।

– সূরা আহযাবে  একই কথা বলা হয়েছে একটু নরম ভাবেঃ  وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا  যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখ কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই৷ আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়৷ (আয়াতঃ ৩৬)

— অর্থাৎ ঈমানদার নিজেদের ব্যাপারে কখনো আপনা থেকে অগ্রগামী হয়ে কোন বিষয় ফায়সালা করবেনা। বরং তার দেখা উচিত যেসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব বা রাসূলের সুন্নাহতে কি নির্দেশনা রয়েছে।

— এটি ইসলামী আইনের একটি মৌলিক দফা। অগ্রগামী না হওয়ার এই নির্দেশ কেবল ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয়বরং সামাজিক ব্যাপারেও প্রযোজ্য। প্রযোজ্য সরকারবিচারালয় এবং পার্লামেন্ট সব কিছুতে।

— মুয়াজ বিন জবল রা.কে যখন ইয়ামানের শাসনকর্তা নিয়োগ করে পাঠানো হয়েতখন নবী সা প্রশ্ন করেছিলেনঃ তুমি কিসের ভিত্তিতে ফায়সালা করবেতিনি জবাব দিলেনঃ “আল্লাহর কিতাব অনুসারে” ৷ নবী ( সা) বললেনঃ যদি কোন বিষয়ে কিতাবুল্লাহর মধ্যে হুকুম না পাওয়া যায় তাহলে কোন জিনিসের সাহায্য নেবেতিনি জবাব দিলেন আল্লাহর রসূলের সুন্নাতের সাহায্য নেব৷ তিনি বললেনঃ যদি সেখানেও কিছু না পাওতিনি বললেনঃ তাহলে আমি নিজে ইজতিহাদ করবো৷ একথা শুনে নবী ( সা) তার বুকের ওপর হাত রেখে বললেনঃ সে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছি যিনি তাঁর রসূলের প্রতিনিধিকে এমন পন্থা অবলম্বন করার তাওফীক দান করেছেন যা তার রসূলের কাছে পছন্দনীয় ৷

— মুসলিম বিচারক আর অমুসলিম বিচারকের মধ্যকার মূল পার্থক্য তুলে ধরে এমন বস্তু হচ্ছেঃ নিজের ইজতিহাদের চেয়ে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং হিদায়াত লাভের জন্য সর্বপ্রথম এ দুটি উৎসবের দিকে ফিরে যাওয়া

— আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাবই যে সর্বপ্রথম উৎস এবং তারপরই যে রসূলের সুন্নাত- এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠীত ৷

ব্যক্তির কিয়াস ও ইজতিহাদ তো দূরের কথা গোটা উম্মতের ইজমাও এ দুটি উৎসের পরিপন্থী কিংবা তা থেকে স্বাধীন হতে পারে না ৷

— নবী (সাঃ) হযরত যায়েদের (রা) জন্য হযরত যয়নবের (রা) সাথে বিয়ের পয়গাম দিয়েছিলেন এবং হযরত যয়নব ও তার আত্মীয়রা তা নামঞ্জুর করেছিলেন৷ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেননবী (সাঃ) যখন এ পয়গাম দেন তখন হযরত যয়নব (রা) বলেনঃ أنا خير منه  لا أرضاه لنفسي  وأنا  أيم قريش “আমি বংশীয় দিক দিয়ে তার থেকে উত্তম” “আমি অভিজাত কুরাইশ পরিবারের মেয়েতাই আমি তাকে নিজের জন্য পছন্দ করি না৷” তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশও (রা) এ ধরনের অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন এর কারণ ছিল এই যেহযরত যায়েদ নবী (সাঃ) এর আযাদ করা গোলাম ছিলেন এবং হযরত যয়নব ছিলেন তাঁর ফুফু (উমাইমাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব)-এর কণ্যা৷ এত উঁচু ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েতাও আবার যাতা পরিবার নয়নবীর নিজের ফুফাত বোন এবং তার বিয়ের পয়গাম তিনি দিচ্ছিলেন নিজের আযাদ করা গোলামের সাথে একথা তাদের কাছে অত্যন্ত খারাপ লাগছিল৷ এ অবস্থায় এ আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াত শুনতেই হযরত যয়নব ও তাঁর পরিবারের সবাই নির্দ্বিধায় আনুগত্যের শির নত করেন৷ এরপর নবী (সাঃ) তাদের বিয়ে পড়ান৷ তিনি নিজে হযরত যায়েদের (রা) পক্ষ থেকে ১০ দীনার ও ৬০ দিরহাম মোহরানা আদায় করেন কনের কাপড় চোপড় দেন এবং কিছু খাবার দাবারের জিনিসপত্র পাঠান৷

·  وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ – আল্লাহকে ভয় করো৷ আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।

– অর্থাৎঃ এই নির্দেশনার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। যদি তোমরা কখন এই নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে মুক্ত ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার নীত গ্রহণ করো কিংবা নিজ মতামতকে অগ্রাধিকার দাও। তাহলে মনে রেখোআল্লাহ দেখছেন-তিনি বুঝাপড়া করবেন। 

– একদিন রাসূল (সা.) আবু দারদা (রাঃ) কে আবু বকর (রাঃ) এর অগ্রে চলতে দেখে সর্তক করে বললেনঃ তুমি কি এমন ব্যক্তির অগ্রে চল যিনি ইহকাল ও পরকালে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতিনি আরও বললেনঃ দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তির উপর সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত হয়নি যে পয়গম্বরদের পর হযরত আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। (রুহুল বয়ান)

·  আমরা কি করি?

– আমরা দ্বীনের জন্য লম্বা লম্বা বক্তব্য দেই। কিন্তু আমল করার বিষয় যখন আসেতখন ভূলে যাই।

– আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশনা দেখিনা।

– আমরা খুব সামান্য সমস্যায় পড়ে রুখসতের তরিকা গ্রহণ করি।

– আমরা চাকুরীর জন্য ওয়াস্তা খোঁজিজরিমানা মাফ করানোর জন্য ওয়াসতা খোঁজিজাওয়াজাতের কাজ করার জন্য খরচ যা লাগবেতা সমস্যা নয় অফার দিয়ে ওয়াস্তা খোঁজি।

– আমরা দ্বীন সম্পর্কে খুব কম জানি। অথচ আমাদের বক্তব্যে তা মনে হয়না।

– আমরা বড় বড় মাওলানাদের সমালোচনা করি। মাত্র ২/১টি বাংলা বই পড়ে আমরা মহা পন্ডিত। মনে করিঃ যাহা জানার তা কেবল আমি জানি অথবা আমাদের সংগঠনের লোকে জানে।

– আমরা ফেইসবুক চালাই মন্তব্য করি-আমার সংগঠনের দৃষ্টিভংগী দেখিনা।

– সংগঠনের সমালোচনার জবাবে আমি সমালোচনা করি। কিন্তু আমার সংগঠনে একজন জবাব দেয়ার দায়িত্বে আছেনতা মনে রাখিনা।

– আমরা মুজিবুর রহমান মনজুর ১৪ গোষ্ঠী উদ্ধার করি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমীরে জামায়াত বলেছেনঃ আমরা এই সম্পর্কে কোন কথা বলবো না। পক্ষেও নাবিপক্ষেও না।

– আমরা চলার সময় দায়িত্বশীলকে সামনে দেই না।

– দায়িত্বশীল রেখে আমরা মন্তব্য করা শুরু করি।

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ

২. হে মুমিনগণতোমরা নিজেদের আওয়াজ রাসূলের আওয়াজের চেয়ে উচু করোনা এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলোনা যেরুপ তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয় যেতোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়।

·  يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ – হে মু’মিনগণ! নিজেদের আওয়ায রসূলের আওয়াযের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলো নাযেমন তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো৷ 

– এ বক্তব্যে মাধ্যমে রাসূল সা. এর মজলিসে উঠাবসা ও যাতায়াতের আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

– নবীর সাথে সাক্ষাত বা কথাবার্তার সময় নবীর স্টেটাস তথা তাঁর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেমনঃ

ক. কারো কন্ঠ যেন নবীর কন্ঠ থেকে উচ্চ না হয়।

খ. তাকে সাধারণ মানুষের মতো এড্রেস করা যাবেনা।

– নবী এখন নাই। কিন্তু তার মজলিস আছে। তাই যে সব মাহফিলে কুরআন বা হাদীসের আলোচনা হয় তখন সেই সব মাহফিলেও এমনি আদব রক্ষা করতে হবে।

– নবীর অবর্তমানে নবীর কাজ যারা করছেনতাদের মধ্যে যারা নবীর আন্দোলনের দায়িত্বশীলতাদের সাথে আচরণ কিভাবে হবেএই আয়াতে সে হেদায়াত দেয়া হয়েছে।

– সম্মাণিত লোকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবেতার নসিহত এখানে পাওয়া যায়।
·  أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ-এমন যেন না হয় যেতোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজ-কর্ম ধ্বংস হয়ে যায়৷
– আয়াতের এই অংশে রাসূল সা. এর ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ও অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে।
– দুনিয়াতে যত সম্মাণিত লোক হোকতার সাথে বেয়াদবী যেমন কুফুরী হবে নাতেমনি শাস্তি যোগ্য হবেনা। কিন্তু রাসূলের সাথে বেয়াদবী শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও যা কুফুরী এবং গোনাহ।

– রাসূলের প্রতি সম্মাণ প্রদর্শনে অবহেলাআল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে অবহেলার পর্যায়ভূক্ত।

– ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের প্রতি অসম্মাণও একই পর্যায়ে পড়ে।
 
إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِندَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ ۚ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ
 ৩. যারা আল্লাহর রাসূলের সাথে কথা বলার সময় নিজেদের আওয়াজ নিচু রাখেতারা আসলে ঐসব লোকআল্লাহ যাদের অন্তর তাকওয়ার জন্য যাচাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও মহান বদলা।
·  إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِندَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ  যারা আল্লাহর রসূলের সামনে তাদের কণ্ঠ নিচু রাখে তারাই সেসব লোকআল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন৷ 
– মানেঃ
** আল্লাহ ও তার রাসূলের সম্মাণের প্রতি তারাই লক্ষ রাখবেযারা আল্লাহর পরীক্ষায় পাস করেছে। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ দিয়েছে যেতাদের অন্তরে তাকওয়া রয়েছে।
** যে দিলের মাঝে রাসূলের জন্য মর্যাদাবোধ নাইসে দিলে তাকওয়া নাই।
** রাসূলের সামনে বড় গলায় কথা বলাঃ অন্তরে তাকওয়া না থাকার প্রমাণ।
** দায়িত্বশীলের সামনে বড় গলায় কথা বলাঃ অন্তরে তাকওয়া না থাকার প্রমাণ।
·  لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ– তাদের রয়েছে ক্ষমা ও বড় পুরস্কার৷
·  এ ব্যাপারে একটা কাহিনী আছেঃ একবার বনী তামিম গোত্রের কিছু লোক রাসূল (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়। এই গোত্রের শাসনকর্তা নিয়োগ সম্পর্কিত আলোচনা চলছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) রা’কা ইবনে হাকিমের নাম এবং হযরত উমর (রাঃ) আকরা ইবনে হাফসের নাম প্রস্তাব করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) এর মধ্যে চলমান এ আলোচনা এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটিতে উন্নীত হয়ে উভয়ের কন্ঠস্বর উচু হয়ে যায়। (বুখারী)
·  উচ্চ স্বরে কথা না বলা প্রসংগেঃ
** এ আয়াত নাযিলের পর হযরত আবুবকর (রাঃ) আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ আল্লাহর কসম! এখন মৃত্যু পর্যন্ত আপনার সাথে কানাকানির অনুরুপে কথা বলব। (বায়হাকী)
** হযরত উমর (রাঃ) এরপর থেকে এত আস্তে কথা বলতেন যেপ্রায়ই পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হতো। (সেহাহ)
** হযরত সাবেত ইবনে কায়সের কন্ঠস্বর স্বভাবগতভাবেই উচু ছিল। এ আয়াত নাযিলের পর তিনি ভয়ে সংযত হলেন এবং কন্ঠস্বর নিচু করলেন। (দুররে মনসুর)
** কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী (রহঃ) বলেন রাসূল (সা.) এর সম্মান ও আদব তার ওফাতের পরও জীবদ্দশার ন্যায় ওয়াজিব।
** কোন কোন আলেম বলেন তার কবরের সামনে উচ্চস্বরে কথা বরা আদবের খেলাফ। যে মজলিসে হাদীস পাঠ হয় সেখানে হট্টগোল করা বে-আদবী।
** কন্ঠস্বর উচু করলে আমল বিনষ্ট হবে কেনসৎকর্ম বিনষ্ট করাঃ ১) কুফরী ২) ঈমান ইচ্ছাধীন কাজ কুফরীও ইচ্ছাধীন কাজ
** কিন্তু আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং এখানে কুফরীর শাস্তি কিভাবে হতে পারে। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) তার বায়ানুল কুরআনে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন – রাসূলের কন্ঠ থেকে উচু হলে বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে কারন রাসূল কষ্ট পাবেন।
 ·  আমরা কি করি?
** দায়িত্বশীলদের যে একটা শরয়ী মর্যাদা আছেতা আমরা ভূলে যাই।
** বৈঠকে কথা বলা আমার অধিকার মনে করি-তাই যেমন খুশী তেমন বলি।
** আমিরে জামায়াতের নসিহত হচ্ছেঃ আমরা অধিকারের কথা ভূলে যেতে হবেদায়িত্বের কথা স্মরণে রাখতে হবে।
** আমরা বৈঠকে অনুমতি ছাড়া কথা বলি।
** একজন কথা বলেছেসাথে সাথে আমি জবাব দেই। অথচ আমাকে জবাব দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
** বৈঠকে আমরা দুইজন কথা বলি। আমাদেরকে কথা থামাতে হয়।
** দায়িত্বশীলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
** বৈঠকে আপনাকে কথা বলার সুযোগ দেয়া দায়িত্বশীলের কর্তব্য। সে কর্তব্য উনি পালন না করলে তার জবাবদিহি উনি করবেন। কিন্তু উনার কর্তব্য পালনে আপনি তাকে জোর করতে পারেন না।
** বৈঠকের অধিকাংশের মতামতের আলোকে দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু উনি বাধ্য নন। অধিকাংশের মত নয়এমন সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকারও দায়িত্বশীলের রয়েছে। এমন অবস্থায়ও দায়িত্বশীলের আনুগত্য করতে হবে।
** কোন অবস্থায়ই দায়িত্বশীলের উপরের মুরব্বীয়ানা করা যাবেনা।
** দায়িত্বশীলের সাথে যখন কথা বলবেনতখন হিসাব করবেনঃ কে কথা বেশী বলেছে। আপনি না দয়িত্বশীল। মনে রাখবেনঃ বলবেন কমশুনবেন বেশী। আপনার কথা কম হতে হবেদায়িত্বশীলের কথা বেশী হতে হবে 
 
إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ 
৪. (হে রাসূল) যারা আপনাকে হুজরার বাহির থেকে ডাকাডাকি করে তাদের বেশীর ভাগ লোকেরই কান্ডজ্ঞান নেই।

 ·  إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ  – হে নবী! যারা তোমাকে গৃহের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে থাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ৷

·  এ ব্যাপারে একটা কাহিনী আছেঃ نزلت هذه الآيات الكريمة، في أناس من الأعراب، الذين وصفهم الله تعالى بالجفاء، وأنهم أجدر أن لا يعلموا حدود ما أنزل الله على رسوله، قدموا وافدين على رسول الله صلى الله عليه وسلم، فوجدوه في بيته وحجرات نسائه، فلم يصبروا ويتأدبوا حتى يخرج، بل نادوه: يا محمد يا محمد، [أي: اخرج إلينا]، فذمهم الله بعدم العقل، حيث لم يعقلوا عن الله الأدب مع رسوله واحترامه، كما أن من العقل وعلامته استعمال الأدب.

   ইমাম বগাভী (রহঃ) কাতাদাহ (রাঃ) এর রেওয়ায়েতক্রমে বর্ণনা করেন বনু তামীমের লোকগণ দুপুরের সময় মদীনায় উপস্থিত হয়েছিল। তখন রাসূল (সা.) কোন এক হুজরায় বিশ্রামরত ছিলেন। তারা ছিল বেদুঈন এবং সামাজিকতার রীতি নীতি থেকে অজ্ঞ। তারা হুজরার বাইরে থেকেই ডাকাডাকি শুরু করলঃ হে মুহাম্মদ আমাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসুন” (মাযহারা)

   সাহাবী ও তাবেয়ীগণ তাদের আলেমদের সাথেও অনুরুপ ব্যবহার করতেন।

   হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে- আমি যখন কোন আলেম সাহাবীর কাছে থেকে কোন হাদীস লাভ করতে চাইতাম তখন তার গৃহে পৌছে ডাকাডাকি বা দরজার কড়া নাড়া থেকে বিরত থাকতাম এবং দরজার বাইরে বসে অপেক্ষা করতাম। তিনি যখন নিজেই বাইরে আসতেন তখন আমি তার নিকট হাদীস জিজ্ঞেস করতাম। তিনি দেখে বলতেন হে রাসূলুল্লাহর চাচাত ভাই আমাকে আপনি কড়া নেড়ে সংবাদ দিলেনা কেন। উত্তরে বলতাম-আল্লাহর নির্দেশ তাদের বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। হযরত আবু ওবায়দা (রহঃ) বলেন আমি কোনদিন কোন আলেমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া দেইনি বরং অপেক্ষা করেছি যেতিনি নিজেই বাইরে আসলে সাক্ষাত করব। (রুহুল মা’আনী)

   শিষ্টাচার শিক্ষা দিলেন।

   হে মুহাম্মদ বলে ডাকা নয়।

   আমরা নাম ধরে না ডেকে অন্য ভাবে ডাকবো।

   কারো বাসায় গেলেউনি বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। যাওয়ার আগে ফোন করে যাবেন বা আগে এপোয়েন্টম্যান্ট নিয়ে যাবেন।

   দায়িত্বশীল রোবট ননতিনিও রক্তে মাংসে মানুষ। তারও ব্যক্তিগত সুবিধা – অসুবিধাচাওয়া পাওয়াবিশ্রাম ইত্যাদির জরুরত আছে।

   আমার পাঠচক্র ও মেহমান-উনারা অবাঞ্চিত ননকিন্তু এই সময়ের জন্য অবাঞ্চিত।

   এ্যাপোয়েন্টম্যান্ট নিয়ে হোক আর এমনি এমনি যাওয়া হোকসর্বাবস্তায় আদব হচ্ছেঃ আপনি কারো ঘরে প্রবেশ করতে সালামের মাধ্যমে অনুমতি চাইবেন। ৩বার সালাম দিয়েও উত্তর না পেলে ফিরে আসবেন।

   আল কুরআনের নির্দিশঃ সূরা নিসাঃ ২৭  يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَىٰ أَهْلِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

   একজন সাহবীর প্রশ্নঃ মায়ের ঘরে ঢুকার আগে কি অনুমতি লাগবে?

   মায়ের ঘরে ঢুকতে অনুমতি লাগলেবোনের ঘরে ঢুকতে অনুমতি লাগবে কিনা?

    শাশুড়ির ঘরে ঢুকতে অনুমতি লাগলেশালীর ঘরে ঢুকতে অনুমতি লাগবে কিনা?

    আপনি দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ দেবেন না। যারা জীবনে ব্যর্থতারা অভিযোগ করে। সফল ব্যক্তিরা অভিযোগ না করে শুকরিয়া আদায় করে।

 وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّىٰ تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

৫. যদি আপনার বের হওয়া পর্যন্ত তারা সবর করে থাকতোতাহলে সেটা তাদেরই জন্য ভাল হতো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।

·  وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّىٰ تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ– যদি তারা তোমার বেরিয়ে আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করতো তাহলে তাদের জন্য ভাল হোত৷

    নবী সা. এর সাহাবী যারা তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলতারাঃ

** ইসলামী আদব-কায়দাভদ্রতাও শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন।

** সবসময় নবীর ( সা) সময়ের প্রতি লক্ষ রাখতেন ৷ কারণ তিনি আল্লাহর কাজে কতটা ব্যস্ত জীবন যাপন করেন সে ব্যাপারে তাদের পূর্ণ উপলব্ধি ছিল ৷

** ক্লান্তিকর ব্যস্ততার ভেতরে কিছু সময় তার আরামের জন্যকিছু সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এবং কিছু সময় পারিবারিক কাজকর্ম দেখা-শোনার জন্যও অবশ্যই থাকা প্রয়োজন ৷

** তারা নবীর সাথে দেখা করার জন্য এমন সময় গিয়ে হাজির হতো যখন তিনি ঘরের বাইরেই অবস্থান করতেন।

** তাঁকে মজলিসে না-ও পেতো তাহলে তাঁর বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতো ৷

** অত্যাধিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁকে বাইরে আসার জন্য কষ্ট দিতো না ৷

    আরবের সে পরিবেশে যেখানে সাধারণভাবে মানুষ কোন প্রকার শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়নি সেখানে বারবার এমন সব অশিক্ষিত লোকেরা নবীর ( সা) সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে হাজির হতো যাদের ধারণা ছিলঃ

** ইসলামী আন্দোলন ও মানুষকে সংশোধনের কাজ যারা করেন তাদের কোন সময় বিশ্রাম গ্রহণের অধিকার নেই।

** রাতের বেলা বা দীনের বেলা যখনই ইচ্ছা তাঁর কাছে এসে হাজির হওয়ার অধিকার তাদের আছে ৷

** তাঁর কর্তব্য হচ্ছেযখনই তারা আসবে তাদের সাক্ষাত দানের জন্য তিনি প্রস্তুত থাকবেন ৷

    এ প্রকৃতির লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে এবং আরবের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে এমন কিছু অজ্ঞ অভদ্র লোকও থাকতো যারা নবীর ( সা) সাথে সাক্ষাত করতে আসলে কোন খাদেমের মাধ্যমে ভিতরে খবর দেয়ার কষ্টটাও করতো না ৷

    নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীদের হুজরার চারদিক ঘুরে ঘুরে বাইরে থেকেই তাঁকে ডাকতে থাকতো ৷সাহাবীগণ হাদীসে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৷

    লোকজনের এ আচরণের রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুব কষ্ট হতো ৷কিন্তু স্বভাবগত ধৈর্যের কারণে তিনি এসব সহ্য করে যাচ্ছিলেন।

    শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলেন এবং এ অবশিষ্ট কর্মনীতির জন্য তিরস্কার করে লোকজনকে এ নির্দেশনা দান করলেন যে,

** যখন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে তাঁকে পাবে নাতখন চিৎকার করে তাঁকে ডাকার পরিবর্তে ধৈর্যের সাথে বসে সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যখন তিনি নিজেই তাদেরকে সাক্ষাতদানের জন্য বেরিয়ে আসবেন ৷

 

·  وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷

** ভূলের যদি পুনরাবৃত্তি না করা হয়তবে অতীতের সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন।

** আল্লাহ যে ক্ষমা করবেনএটা আপনার আমার কৃতিত্ব নয়বরং তার দয়া।

** অতএবআমরা দায়িত্বশীলদের সময়সূচীকে বিবেচনায় রাখবো।

** যখন তখন কারো বাসায় যাবো না।

** আগে না জানিয়ে যাবো না।

** টেলিফোন করার সময় নজর রাখবোঃ

১. নামাযের সময় কি না?

২. ঘুমের সময় কিনা?

৩. উনি এই সময়ে সাধারণতঃ ব্যস্ত থাকেন কি না?

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

 ৬. হে ঐসব লোক যারা ঈমান এনেছো! যদি কোন ফাসেক লোক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসেতাহলে এর সত্যতা যাচাই করে নিও। এমন যেন না হয় যেতোমরা না যেনে কোন কাওমের ক্ষতি করে বসো এবং তারপর যা করেছোসে জন্য আফসোস করতে থাকো।

·  ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ﴾  হে ঈমান গ্রহণকারীগণযদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ৷ এমন যেন না হয় যেনা জেনে শুনেই তোমরা কোন গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে৷

·  এ ব্যাপারে একটা কাহিনী আছেঃ

*** মুসনাদে আহমাদের বরাত দিয়ে তাফসীর ইবনে কাসীরঃ

** বনী মুস্তালিক গোত্রের সরদার হারেস ইবনে মেরাব ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা.) তাকে যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন।

** তিনি যাকাত প্রদানে স্বীকৃত হলেন এবং তারা গোত্রে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের যাকাত আদায় করে জমা করে রাখবেন বললেন।

** রাসূল (সা.) কে একটি নিদিষ্ট তারিখে যাকাতের অর্থ নেবার জন্য কোন দুত পাঠাতে বললেন।

** কিন্তু নির্ধারিত তারিখ পার হয়ে গেলেও দুতের দেখা না পেয়ে হারেস আশংকা করলেন রাসূল (সা.) কোন কারনে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

** একথা তিনি ইসলাম গ্রহনকারী নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে প্রকাশ করে রাসূল (সা.) এর সাথে সবাই মিলে দেখা করার ইচ্ছা করলেন।

** এদিকে রাসূল নির্ধারিত তারিখে ওলীদ ইবনে ওকবা কে প্রেরণ করলেন।

** ওলীদ ইবনে ওকবা (রাঃ) নির্দেশ অনুযায়ী বনু মুস্তালিক গোত্রে পৌছেন। গোত্রের লোকেরা অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে বস্তি থেকে বের হয়ে আসে।

** ওলীদ সন্দেহ করে তারা বোধ হয় পুরাতন শত্রুতার কারণে তাকে হত্যা করতে আসছে।

** তিনি ফিরে আসেন এবং রাসূল (সা.) কে বলেন তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছে।

** রাসূল (সা.) রাগান্বিত হয়ে খালিদ ইবনে ওলীদ কে ঘটনা পর্যবেক্ষনের নির্দেশ দিলেন।

** খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ প্রেরণ করেন। তিনি ফিরে এসে সংবাদ দিলেন তারা ঈমানের উপর অটল রয়েছে এবং যাকাত দিতে প্রস্তুত। অতঃপর তা জানতে পেরে হারেস রাসূল (সা.) কে বলেন তিনি ওলীদকে দেখেনইনি।

** ওলীদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হয়েছিলেন।তাই এটি স্পষ্ট যে এ যুগের বেশীর ভাগ অংশই মাদানী যুগের শেষ পর্যায়ে নাজিলকৃত।

·  এ আয়াত আমাদেরকে কি শিখালো?

** বড় ধরণের ঘটনা ঘটে যেতে পারেএমন ধরণের খবরের ক্ষেত্রে খবর প্রদানকারী ব্যক্তিকে যাচাই করে দেখতে হবে।

** খবর প্রদানকারী যদি ফাসেক হয়তার বাহ্যিক অবস্থা দেখেই বুঝা যাবে যেতার কথা নির্ভর যোগ্য নয়। এমন অবস্থায় প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করতে হবে।

** শরীয়ার হুকুম হচ্ছেঃ যার চরিত্র ও কর্ম নির্ভরযোগ্য নয়এমন সংবাদদাতার সংবাদ গ্রহণ করে কোন ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বৈধ নয়।

** এই নীতির ভিত্তিতে হাদীস সহীহ কি নাতা যাচাই করার জন্য হাদীস বিশারদগন ‍”জারহ ও তাদীল” নীতি  উদ্ভাবন করেন।

** ফকীহরা নীতি গ্রহণ করেছেন যেএমন কোন ব্যাপারে ফাসেক ব্যক্তির সাক্ষ গ্রহণযোগ্য হবে না যার দ্বারা শরীয়াতের কোন নির্দেশ প্রমাণিত হয় কিংবা কোন মানুষের ওপর কোন অধিকার বর্তায় ৷

পণ্ডিতগণ একমত যেসাধারণ পার্থিব ব্যাপারে প্রতিটি খবরই যাঁচাই ও অনুসন্ধান করা এবং খবরদাতার নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরী নয় ৷  সাধারণ এ খুঁটিনাটি ব্যাপারে এ নীতি খাটে না ৷

👉শিক্ষাঃ
১) ধর্মীয় আলেমদের ক্ষেত্রে এ বিধান কার্যকর কারন তারা পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী।
– একদিন রাসূল (সা:) আবু দারদা (রা:) কে আবু বকর (রা:) এর অগ্রে চলতে দেখে সর্তক করে বললেন: তুমি কি এমন ব্যক্তির অগ্রে চল যিনি ইহকাল ও পরকালে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ? তিনি আরও বললেন: দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তির উপর সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত হয়নি যে পয়গম্বরদের পর হযরত আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। (রুহুল বয়ান)
২) উচ্চ স্বরে কথা না বলাঃ
এ আয়াত নাযিলের পর –
 হযরত আবুবকর (রা:) আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ আল্লাহর কসম! এখন মৃত্যু পর্যন্ত আপনার সাথে কানাকানির অনুরুপে কথা বলব। (বায়হাকী)
 হযরত উমর (রা:) এরপর থেকে এত আস্তে কথা বলতেন যে, প্রায়ই পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হতো। (সেহাহ)
 হযরত সাবেত ইবনে কায়সের কন্ঠস্বর স্বভাবগতভাবেই উচু ছিল। এ আয়াত নাযিলের পর তিনি ভয়ে সংযত হলেন এবং কন্ঠস্বর নিচু করলেন। (দুররে মনসুর)
 কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী (রহ:) বলেন রাসূল (সা:) এর সম্মান ও আদব তার ওফাতের পরও জীবদ্দশার ন্যায় ওয়াজিব। কোন কোন আলেম বলেন তার কবরের সামনে উচ্চস্বরে কথা বরা আদবের খেলাফ। যে মজলিসে হাদীস পাঠ হয় সেখানে হট্টগোল করা বে-আদবী।
 কন্ঠস্বর উচু করলে আমল বিনষ্ট হবে কেন?
 সৎকর্ম বিনষ্ট করে-
১) কুফরী ২) ঈমান ইচ্ছাধীন কাজ কুফরীও ইচ্ছাধীন কাজ।
কিন্তু আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং এখানে কুফরীর শাস্তি কিভাবে হতে পারে।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ:) তার বায়ানুল কুরআনে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন – রাসূলের কন্ঠ থেকে উচু হলে বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে কারন রাসূল কষ্ট পাবেন।
৩) হুজরার বাইরে থেকে ডাকাডাকি করাঃ
– ইমাম বগাভী (রহ:) কাতাদাহ (রা:) এর রেওয়ায়েতক্রমে বর্ণনা করেন বনু তামীমের লোকগণ দুপুরের সময় মদীনায় উপস্থিত হয়েছিল। তখন রাসূল (সা:) কোন এক হুজরায় বিশ্রামরত ছিলেন। তারা ছির বেদুঈন এবং সামাজিকতার রীতি নীতি থেকে অজ্ঞ। তারা হুজরার বাইরে থেকেই ডাকাডাকি শুরু করল।
– “হে মুহাম্মদ আমাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসুন” (মাযহারা)
সাহাবী ও তাবেয়ীগণ তাদের আলেমদের সাথেও অনুরুপ ব্যবহার করতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে- আমি যখন কোন আলেম সাহাবীর কাছে থেকে কোন হাদীস লাভ করতে চাইতাম তখন তার গৃহে পৌছে ডাকাডাকি বা দরজার কড়া নাড়া থেকে বিরত থাকতাম এবং দরজার বাইরে বসে অপেক্ষা করতাম। তিনি যখন নিজেই বাইরে আসতেন তখন আমি তার নিকট হাদীস জিজ্ঞেস করতাম। তিনি দেখে বলতেন হে রাসূলুল্লাহর চাচাত ভাই আমাকে আপনি কড়া নেড়ে সংবাদ দিলেনা কেন। উত্তরে বলতাম- আল্লাহর নির্দেশ তাদের বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
হযরত আবু ওবায়দা (রহ:) বলেন আমি কোনদিন কোন আলেমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া দেইনি বরং অপেক্ষা করেছি যে, তিনি নিজেই বাইরে আসলে সাক্ষাত করব। (রুহুল মা’আনী)

আরো কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাঃ

– সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল উৎস হচ্ছেন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল। তাই বাকী সব সিদ্ধান্ত হবে সেই উৎসের ভিত্তিতে।

– চলা ফেরায় যেমন দায়িত্বশীলের আগে চলা যাবেনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দায়িত্বশীলের আগে যাওয়া যাবেনা-পাশ কাঠিয়ে যাওয়া যাবে না।

– রাসূলের মজলিসে তথা কুরআন হাদীসের আলোচনা হয় এমন বৈঠকে অথবা বৈঠক চলাকালীন এর আশে পাশে কথা বলা যাবেনা।

– দায়িত্বশীলের সামনে উচ্চ কন্ঠে কথা বলা যাবেনা। দায়িত্বশীলের কথার উপরে কথা বলা যাবেনা।

– কারো সাথে দেখা করতে এ্যাপোয়েন্টম্যান্ট নিয়ে দেখা করতে হবে। টেলিফোন করতে সময় জ্ঞান থাকা চাই।

– বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ সংক্রান্ত তথ্য ভাল ভাবে যাচাই করে নিতে হবে।



সংগৃহীত, সংকলিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত।