Close
দারসুল হাদিস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দারসুল হাদিস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)


দারসুল হাদিস || পরকালের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস

• আরবি ইবারত:
عَنِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ حَتَّى يَسْئَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَ عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ (ترمذ ی)

• বাংলা অনুবাদ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (সা) হতে বর্ণনা করেছেনঃ কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও (স্ব-স্থান হতে) নড়তে দেয়া হবে না। (১) তাঁরজীবনকাল কিতাবে অতিবাহিত করেছে। (২) যৌবনের সময়টাকে কিভাবে ব্যয় করেছে। (৩) ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে। (৪) তা কোনপথে ব্যয় করেছে। এবং (৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞানার্জন করেছে সে অনুযায়ী আমল করেছে কিনা। (তিরমিযি)

• শব্দার্থ:
لاتزلُ - নাড়াতে পারবে না। পদদ্বয়। ابن ادم - আদম সন্তান। حَتَّى - যতক্ষণ। يَسْتَلُ - জিজ্ঞাসা করবে। عَنْ خَمْسٍ - পাঁচটি বিষয়ে। عمره -তার জীবন। أَقْنَاهُ ধ্বংস করেছে, ব্যয় করেছে। شبابه তার যৌবনকাল। آبده (এখানে) সে কিভাবে কাটিয়েছে। এ তার ধন-সম্পদ। اَيْن -কোথায়। اكتسبه সে উপার্জন করেছে। اين কোনখানে। انفقه সে ব্যয় করেছে। عمل আমল করেছে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। علم - সে শিখেছে।

• রাবীর পরিচয়:
"ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবী করীম (সা) এর মদীনায় হিজরতের পর মদীনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন এবং ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতেন। আবু মুসা আশায়ারী (রা) বলেন, "আমার ইয়েমেন হতে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদ (রা) কে নবী পরিবারের লোক বলে ধারণা করতাম।"

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কুরআন, হাদীস, ফেকাহ ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে কজন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। নবী করীম (সা) বলেনঃ "কুরআন শরীফ যেভাবে নাযিল হয়েছে হুবুহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেনো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর নিকট যায়।"

এই জনের বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৮৪৮টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২১৫টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
আলোচ্য হাদীসে মানুষের নৈতিক চরিত্রের সংশোধনকল্পে আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালে জাবাদিহির অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের সংশোধনের আশা করা বৃথা। কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্তকালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পূর্নরূপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্মফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সূক্ষ্মভাবে বিচার -বিশ্লেষণ করা হবে। একমাত্র এ অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।

তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার-আচরণ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদীসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদীসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

• ব্যাখ্যা:
★১.
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ 
"আমি মানুষ আর জ্বীনকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।"
(সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬)

ইবাদাত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ "ইয়াবুদুন" শব্দটি "আবদুন হতে নির্গত। আর "আবদুন" শব্দের অর্থ হল গোলাম দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহূর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবনব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَ أَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ . (المؤمنون)
"তোমরা কি মনে করেছো যে, আমরা তোমাদেরকে অকারণেই সৃষ্টি করেছি, আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না? (সূরা আল মু'মিনুন-১১৫)

তাই দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর চাকচিক্যময় প্রতিটি বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি, ছোট্ট একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবনব্যাপী বিস্তৃত।

★২. প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে তার যৌবনকাল। নিম্নোক্ত চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এ যৌবকালেই। যথা-

(ক) চিন্তাশক্তি (Thinking Power)
(খ) ইচ্ছাশক্তি (Will Power)
(গ) মনন শক্তি (Power of soul)
(ঘ) কর্মশক্তি (Physical strength for working capacity)

অতএব দেখা যাচ্ছে ভালো অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবনই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারণ মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার, ব্যাভিচার ইত্যাদি সবকিছুই করে যৌবনকালে। দেখা যায় যৌবনে দুর্ধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গো-বেচারায় রূপান্তরিত হয়। কারণ বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ অসহায় করে দেয়। তাই বার্ধক্যে যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ হয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং চেষ্টাই থাক না কেন বার্থক্য আসার পর কোন একটি ভালো কাজও সুচারুভাবে সমাপ্ত করা যায় না। এখানেও বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবনের এতো গুরুত্ব।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
اغْتَنِمْ خَمْسًا شَبَابِكَ قَبْلَ هَرَمِكَ 
পাঁচটি বস্তুকে গনীমতের মালের মতোই মনে করো। তার একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনের। (মিশকাত)

অনেকেই মনে করে যৌবনে যা কিছু মনে চায় করে বার্ধক্য পর আল্লাহ্র নিকট তওবা করে সৎ কাজে মনোনিবেশ করবো। এ ধারণাই মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। তাই হাদীসে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এইজন্যই পরকালের প্রশ্নবলীর মধ্যে যৌবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি তার অন্যতম।

★৩. মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগলপারা। তার একটা লক্ষ্য ধন- সম্পদের স্তূপে সুখের সন্ধান করা। এজন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ, অথবা ধোকাবাজী যা কিছুই হোক না কেন তাতে কোন পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্বপ্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন, যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার নষ্ট না হয় এবং সকলেই সমভাবে সম্পদ ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ উপার্জনের মৌলিক বিধি-নিষেধ সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

(১) কারো অধিকার নষ্ট করে সম্পদ উপার্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মোহরের প্রাপ্য টাকা না দিয়ে নিজে ভোগ করা। এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
(২) ব্যাভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(৩), চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকার্জন বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৪) কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৫) গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবিকার পেশা নির্ধারণ করা যাবে না।
(৬) হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে। এমন কি হালাল পশু পাখীর মৃতদেহও এর অন্তর্ভুক্ত।
(৭) হালাল মালের ব্যবসা করলেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মূল্য বৃদ্ধির নিয়তে ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফালব্ধ টাকার মাধ্যমে।
(৮) সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ বা বর্ধিত করা যাবে না।
(৯) জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(১০) কোন পশু পাখীর দ্বারা খেলা দেখিয়ে।
(১১) মূর্তি অথবা প্রাণীর ছবির ব্যবসায়ের মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা না জায়েজ।
(১২) ওজনে কম দেয়া। ইত্যাদি।


★৪. উপরের বিধি নিধেগুলো সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। 

ব্যয়ের মৌলিক খাতসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
(১) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় করা যাবে না।
(২) নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
(৩) ছদকাহ্।
(৪) 'নিকটাত্মীয়ের হক।
(৫) ইয়াতিমের হক।
(৬) মিসকিন, ভিক্ষুকের হক।
(৭) আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যয় "জিহাদ ফি ছাবিলিল্লাহ"।
(৮) বিভিন্ন ধরনের কাফফারা আদায়কল্পে।
(৯) পথিক বা পর্যটকদের হক।

বস্তুতঃ প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে, উপরোক্ত শর্তবলী পালন করেই সে সম্পদ আয় এবং ব্যয় করেছে কিনা?

★৫. বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে রাসূলে আকরাম (সা) এর মাধ্যমে আল্লাহ'রাব্বুল আলামীনের প্রথম ফরমান- হলো:

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (علق) -
"পড় তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আলাকঃ১)

আয়াতে কারীমার তাৎপর্য হলো রবকে জানা বা বুঝার উদ্দেশ্যে পড়তে হবে। অন্য কথায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহানবী (সা) বলেছেনঃ
طلب العلمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ -
"মুসলমান প্রতিটি নর-নারীর উপর (দ্বীনের) জ্ঞানার্জন অবশ্য কর্তব্য-ফরজ (মুসলিম)।

স্রষ্টা-সৃষ্টি ও বিশ্বজাহান সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই প্রতিটি লোক তার নিজের এবং স্রষ্টা সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে আরও বুঝতে পারে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি আর তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি। এমনিভাবে যখন মানুষ তার স্রষ্টাকে জানতে ও বুঝতে পারে তখন স্রষ্টার দেয়া দায়িত্ব-কর্তব্য পালনও তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ইরশাদ করেনঃ
তবে আল্লাহর উপর ঈমান "তাগুদ"কে অস্বীকার করেই আনতে হবে। সূরা বাকারায় অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَة
(البقرة) الْوُسْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا 
"যে তাগুত (খোদাদ্রোহী শক্তি) কে অস্বীকার করে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো সে এমন একটি মজবুত রশি ধারণ করলো যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। (সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬)"

এখানে রশি বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা হতে বুঝা যায়, পৃথিবীতে দুটো শক্তি আছে। একটি তাগুদী বা শয়তানী শক্তি অপরটি আল্লাহর শক্তি। আর যে কান এক শক্তির আনুগত্য অপর শক্তিকে অস্বীকার করেই করতে হবে। এখানেও দেখা যাচ্ছে হক ও বাতিল চেনার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ইল্ম বা জ্ঞান। তাই দ্বীনি ইলম শিখতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।

অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ
النَّاسُ كُلُّهُمْ مَلْكَاءُ إِلَّا الْعَالِمُوْنَ وَالْعَالِمُونَ كُلُّهُمْ هَلْكَاء إِلَّا الْعَامِلُونَ .
সমস্ত মানুষই জাহান্নামী একমাত্র আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া, আর সমস্ত আলেমই জাহান্নামী হবে একমাত্র আমলদায় আলেম ছাড়া। (বুখারী) অর্থাৎ শুধু জ্ঞানার্জন করাই মুক্তির পথ নয় সাথে জ্ঞানানুযায়ী আমলের ও প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারে অবশ্যই রাব্বুল আলমীনের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। এখানে আলেম বলতে মাদ্রাসা থেকে সনদপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিতদেরকে বুঝানো হয়নি। ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে যারা মৌলিক জ্ঞান রাখেন তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।

• শিক্ষাবলী:
১। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে।
২। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌবন। তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
৩। ধন সম্পদ আয় এবং ব্যয় আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে হতে হবে এবং আল্লাহর সন্তোষ অর্জন হবে একমাত্র লক্ষ্য।
৪। দ্বীনের যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এবং
৫। জ্ঞানানুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে।

• তথ্যসূত্র:
১। জামেউত তিরমিযি
২। সহীহ আল বুখারী
৩। সাহাবা চরিত-ইসলামিক ফাউন্ডেশন
৪। সুপ্ত শক্তিও ঘুমস্ত প্রতিভা-ডেল কার্ণেগী
৫। সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং-সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৬। তাফহীমুল কুরআন-ঐ 
৭। মিশকাত শরীফ-

বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব || হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত বাইয়াতের দাবি সংক্রান্ত হাদিস

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


• আরবী ইবারত:
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ أَخْبَرَنَا يَعْقُوْبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَخِي ابْنِ شِهَابٍ عَنْ عَمِّهِ قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُوْ إِدْرِيسَ عَابِدُ اللَّهِ أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ مِنْ الَّذِينَ شَهِدُوا بَدْرًا مَعَ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم وَمِنْ أَصْحَابِهِ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةُ مِنْ أَصْحَابِهِ تَعَالَوْا بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُوْنَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلَا تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ لَهُ كَفَّارَةٌ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ   وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ قَالَ فَبَايَعْتُهُ عَلَى ذَلِكَ

• বাংলা অনুবাদ:

"হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা) হ'তে বর্ণিত- তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এবং আকাবা রাত্রিতে নিযুক্ত নেতাদের অন্যতম-তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন-তখন তাঁর চারদিকে একদল সাহাবী উপস্থিত ছিলেন- তোমরা আমার নিকট এ কথার উপর 'বাইয়াত' করো যে, 'তোমরা আল্লাহর সাথে কোন জিনিসের শরীক করবে না। চুরি করবে না, যেনা-ব্যাভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তোমরা পরস্পর পরস্পরের উপর অপবাদ দিবে না এবং ভালো কাজের ব্যাপারে কখনো নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই 'বাইয়াত' যথাযথভাবে পালন করবে তার বিনিময় ও পুরষ্কার স্বয়ং আল্লাহ্ দিবেন। আর যে ব্যক্তি নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে কোন একটি কাজও করবে এবং এজন্য পৃথিবীতে কোন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হবে, তবে তা তার গুনাহর কাফ্ফারা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর যদি কোন নিষিদ্ধ কাজ কেউ করে ফেলে এবং আল্লাহ্ তা ঢেকে রাখেন, তবে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর বর্তাবে। তিনি ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করে দিবেন অথবা ইচ্ছে করলে তাকে শাস্তি দিবেন। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আমরা কথাগুলো মেনে নবী করীম (সা) এর 'বাইয়াত' গ্রহণ করলাম।" (বুখারী)। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬০৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৬১০)

• শব্দার্থ:
شَهِدَ -উপস্থিত ছিলো। التَّقَبَاءُ -প্রতিনিধিবর্গ। ليلة -রাত্রি। العقبة - আকাবা )মিনা নামক স্থানে অবস্থিত একটি পাহাড়। حول -তাঁর চতুর্দিকে। بايِعُونِي -আমার নিকট 'বাইয়াত' করো। لتشرِكُوا শরীক করোনা। খায় -আল্লাহর সাথে لاتسرقوا -তোমরা চুরি করো না। لا تزنُوا ব্যাভিচার করোন لا تقتلُوا -হত্যা করোনা। اَولادكم তোমাদের সন্তান। এর্দা -তোমরা আরোপ করে না। بهتان -মিথ্যা بين أيديكم وأرجلكم -সামনা-সামনি। لاتعصوا -সীমা লংঘন করোনা। أجره তার বিনিময়। عَلَى اللهِ -আল্লাহর উপর। أَصَابَ সম্পাদন করা। تفعُوقب অতঃপর হদ্ )নির্দিষ্ট শাস্তি) জারী করা হয়। سَتَرَهُ اللهُ -আল্লাহ্ তাকে গোপন রাখলেন। اثنشاء - যদি চান। عَقَاعَنهُতা মাফ করবেন। তাকে শাস্তি দিবেন।

• রাবীর পরিচয়:
নাম উবাদা। ডাক নাম আবুল ওয়ালিদ। পিতা সামেত ইবনে কায়েস। মাতা কুররাতুল আইন। মদীনার খাজরাজ বংশের সালেম গোত্রের লোক। তিনি ছিলেন আনসার সাহাবী।

তিনি সাহাবাদের মধ্যে দু'টি বিষয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। একটি হচ্ছে, আকাবার প্রথম শপথে অংশগ্রহণ সহ মদীনা হতে ক্রমাগত তিন বৎসরে মক্কায় আগত প্রত্যেকটি প্রতিনিধি দলের সংগে তিনি শামিল ছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী। তাছাড়া তিনি নবী করীম (সা) এর সাথে সবগুলো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন এবং 'বাইয়াতে রিদওয়ান' এর সময়ও তিনি রাসুলে করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। হযরত উবাদা (রা) উচু স্তরের একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি শুদ্ধরূপে কুরআন পাঠ করতেন এবং পবিত্র কুরআনের হাফিজ ছিলেন। আহলে সুফফাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তিনি ছিলেন তার তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষক। মহানবী (সা) তাঁকে যাকাত আদায়ের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া তিনি হযরত উমর (রা) এর সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পলন করেন। সিরিয়া ও হোমসের শাসনকর্তা এবং ফিলিস্তিনের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। হিজরী ৩৪ সনে ৭২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১টি। তারমধ্যে ৬টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
বুখারী শরীফে হাদীসটি পাঁচ জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া মুসলিম, তিরমিযি ও নাসায়ী শরীফেও সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের পূর্বে কি ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করা প্রয়োজন এবং তাদের নৈতিক ও তাকওয়ার মান কিরূপ হওয়া উচিত তা অত্র হাদীসে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। আরও তুলে ধরা হয়েছে একটি ইসলামী সমাজ কিভাবে ধ্বংস হয় সেই চোরা পথগুলো। যেহেতু আল্লাহর রাসূল (সা) একটি ইসলামী রাষ্টের স্বপ্ন দেখছিলেন সেহেতু নিষিদ্ধ রাস্তাগুলোর প্রবেশ দ্বারে অর্গল এঁটে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজ দেহে কোন ক্রমেই পঁচন না ধরে।

• ব্যাখ্যা:
বাইয়াতঃ 'বাইয়াত' শব্দটি আরবী بَيْعَةُ শব্দ থেকে গঠিত। অর্থ বিক্রি করা, ক্রয় করা, চুক্তি, শপথ, অংগীকার, শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার করা ইত্যাদি।

প্রতিটি মু'মিন স্বেচ্ছায় এবং সন্তুষ্টির সাথে নিজের জান এবং মালকে আল্লাহ্ নিকট বিক্রি করে দেয়; তাঁর সন্তোষ ও জান্নাতের বিনিময়ে। আর আল্লাহ্ শুধুমাত্র মু'মিনদের নিকট হতে জান-মাল খরিদ করেন। আল্লাহ্ মুমিন ছাড়া আর কারো সাথে ক্রয়-বিক্রয় করেন না। করা সম্ভবও নয়। কেননা বিক্রিত বস্তু ক্রেতার নিকট চাহিবা মাত্র হস্তান্তর করতে বিক্রেতা বাধ্য। এ মূলনীতি অনুসরণ করা একমাত্র মু'মিনদের পক্ষে সম্ভব। কারণ প্রতিটি মু'মিনের অন্তরে এ অনুভূতি সর্বদা জাগ্রত থাকে যে "আমার জান এবং মালের মালিক আমি নই। আল্লাহ্ মেহেরবানী করে তা আমার নিকট আমানত রেখেছেন মাত্র। কাজেই তিনি যেভাবে চান সেভাবেই এর ব্যবহার করতে হবে। পক্ষান্তরে একজন মুনাফিক, কাফের কিংবা মুশরিক তা মনে করে না। এজন্য আল্লাহ্ তাদের সাথে কেনা বেচাও করেন না। এটা তো একটি সাধারণ কথা যে, যে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট হতে মূল্য আদায় করতে চায় কিন্তু তাকে বিক্রিত মাল হস্তান্তর করতে চায় না তার সাথে কোন বুদ্ধিমানই ক্রয়-বিক্রয় করবে না। সূরা তওবায় বলা হয়েছে-

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِاتٌ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ مَن وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَ الْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ

নিশ্চয় আল্লাহ্ মুমিনদের জান মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে। তাহা আল্লাহ্ পথে লড়াই করে, (দুশমনকে) হত্যা করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তাদের জন্য (জান্নাত দেবার এ ওয়াদা) আল্লাহ্ দায়িত্বে একটি পাকা ওয়াদা বটে। (তাওবাঃ ১১১) কাফেরদের সাথে এ বেচা-কেনা এজন্য সম্ভব নয় যে তারা পরকালকেই অস্বীকার করে। আর মুশরিক এবং মুনাফিকেরা যদিও পরকালকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না তবুও তারা অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করে না। এরা দুনিয়ার জীবন এবং ভোগ বিলাসকে সব কিছুর উপর প্রাধান্য দেয়। পক্ষান্তরে একজন মুমিন দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের জীবনকে প্রাধান্য দেয়। এজন্য পৃথিবীর লোভ-লালসা, মায়া-মোহ, কোন কিছুই তাকে পিছনে টানতে পারে না। প্রয়োজনে সর্বাধিক প্রিয়বস্তু জীবনটাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে দেয়।

বিক্রিত জান-মাল আল্লাহ্ নিজে এসে গ্রহণ করেন না। আবার নিজে নিজেও তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। এজন্য আল্লাহ্ কর্তৃক ক্রয়কৃত জান- মাল তাঁর আদিষ্ট পথে ব্যয় করার জন্য একজন প্রতিনিধির প্রয়োজন। আর সেই প্রতিনিধি হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। কিন্তু যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পরে আর কোন নবী ও রাসূল নেই তাই মুমিনদের নির্বাচিত খলিফা বা নেতাই হচ্ছেন সেই প্রতিনিধি। তাঁর নিকট বাইয়াত করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। তবে নবী করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত এবং অন্য ইমাম বা নেতার হাতে বাইয়াতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। নবী করীম (সা) এর আনুগত্য হচ্ছে বিনা শর্তে কিন্তু অন্য নেতাদের আনুগত্য হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে কিন্তু রাসূল (সা) ছাড়া আর কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা যাবে না। সে আনুগত্য হতে হবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা) অধীন। বাইয়াতের মাধ্যমে যে দাবীগুলো পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়, সেগুলো হচ্ছেঃ

(১) জান-মাল আল্লাহর নিকট যে বিক্রি করা হয়েছে তা বাইয়াতের মাধ্যমে তাঁর নিকট সোপর্দ করা, যেন তিনি জান ও মাল আল্লাহ্ ও রাসূল প্রদত্ত নিয়মে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে পারেন।

(২) বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির পক্ষ হতে তাকে সে নির্দেশ দেয়া হবে তা যদি কুরআন সুন্নাহ্ বিরোধী না হয় তবে বিনা দ্বিধায় তা মানতে হবে। এ ব্যাপারে পার্থিব কোন ক্ষয় ক্ষতির পরওয়া করা যাবে না।

(৩) যদি বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির কোন নির্দেশ সঠিক নয় বলে মনে হয় তবে এ ব্যাপারে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশ না মানা কোনক্রমেই ঠিক নয়।

(৪) কোন বিশেষ কারণে যদি নির্দেশ পালন করা সম্ভব না হয় তবে তাঁকে অবহিত করতে হবে এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত মনে করতে হবে।

ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করতে গেলেই প্রথমে প্রয়োজন একটি সুসংঘবদ্ধ জামায়াতের। দীন কায়েম করা যেমন ফরজ ঠিক তেমনি জামায়াত বদ্ধ হওয়াও ফরজ। কেননা জামায়াতদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন ক্রমেই আল্লাহ্ দীন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আবার জামায়াতবদ্ধ হবার বন্ধনসূত্রই হচ্ছে বাইয়াত।

এজন্যেই ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব এত বেশী।

আকাবার ১ম, ২য়, ৩য় বাইয়াত এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যে বাইয়াত সংঘটিত হয়েছিল যাকে "বাইয়াতে রিদওয়ান" বলা হয়, এ সমস্ত বাইয়াত ছাড়াও নবী করীম (সা) বিভিন্ন সময় পুরুষ ও মহিলা সাহাবীদের নিকট হতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ বাইয়াতকে ঈমানের রুহ্ মনে করতেন। তাই দেখা যায় কোন পুরুষ অথবা মহিলা সাহাবী যদি কখনো কোন ভুল করে ফেলতেন সাথে সাথে নবী করীম (সা) এর নিকট এসে পুণরায় বাইয়াত করানোর অনুরোধ করতেন। যদি আল্লাহর রাসূলের (সা) নিকট কালেমা পড়াই যথেষ্ট হতো তবে বাইয়াতের ব্যাপারে এমন পেরেশানী তাদের মধ্যে থাকতো না। এ সমস্ত ঘটনা থেকেও বুঝা যায় যে, ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব কতটুকু।

শিরক না করাঃ শিরক হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কাউকে এমন মনে করা যা একমাত্র আল্লাহরই হওয়া বা করা সম্ভব। এ রকম ধারণা বা কর্ম করা যাবে না। অর্থাৎ কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ যাই হোক না কেন আল্লাহ্ ছাড়া কেউই তা করতে সক্ষম নয়। প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ মোচনকারী, প্রার্থনা শ্রবণকারী, রিজিক প্রদানকারী, বিপদাপদে আশ্রয়স্থল একমাত্র আল্লাহ্। তাছাড়া কাউকে এ রকম প্রভাবশালী মনে না করা যার সুপারিশে আল্লাহ্ ফায়সালা পরিবর্তন হতে পারে। বৈষয়িক, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক যে কোন বিষয়েই হোকনা কেন আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আইন- কানুন মানা যাবে না। চাই, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক অথবা অর্থনৈতিক যাই হোকনা কেন। এসব সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে গ্রহণ করে তার উপর অবিচল থাকাই হচ্ছে তৌহিদের দাবী বা শির্কমুক্ত জীবন-যাপন।

চুরি না করাঃ চুরি হচ্ছে কোন বস্তু তার মালিকের অগোচরে ও অসম্মতিতে নিজে ভোগ করা বা এর মালিক হয়ে যাওয়া। ইসলামী বিধানে এটা একটি গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। শরীয়তের পরিভাষায় কবিরা গুনাহ্। তবে মানুষ যাতে খেতে পরতে না পেয়ে চুরি করতে বাধ্য না হয় সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের। যদি কোন চোর ধরার পর প্রমাণিত হয় যে জীবন বাঁচানোর জন্য চুরি ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা তার ছিলো না; তবে তাকে শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা সরকারের প্রতিটি ব্যক্তিই উল্টা তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

ব্যাভিচার না করাঃ আল্লাহ্ জাল্লাহ ইরশাদ করেনঃ (اسری) ولا تقربوا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا.

তোমরা ব্যাভিচারের ধারে কাছেও যেও না কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জ কাজ ও অতীব নিকৃষ্ট পথ। (সূরা বনী ইসরাইলঃ৩২)

উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্যাভিচার করা তো দূরের কথা এমন কাজ বা আচরণ করাও হারাম যা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ব্যাভিচারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যে সব কাজ মানুষকে যৌন সুড়সুড়ি দেয় সেগুলোও উপরোক্ত আয়াতের আদেশের আওতাভুক্ত। যেমন অশ্লীল যৌন আবেদনমূলক পত্র-পত্রিকা, যৌন সুড়সুড়িমূলক সাহিত্য, নারী দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গির অশ্লীল চিত্র, নগ্ন ও অর্ধনগ্ন চিত্র ইত্যাদি। এ সমস্ত কাজে যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে অংশগহণ করবে তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةَ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابُ .
اليم في الدنيا والآخرة

যারা চায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার প্রচার হোক, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।

সন্তান হত্যা না করাঃ মানুষ প্রধানত দুই কারণে সন্তান হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
এক- বেশী সন্তান হলে তাদেরকে ঠিকমত খাওয়ানো পরানো যাবে না এবং তাদেরকে মানুষ করা যাবে না। অভাব অনটনে নিমজ্জিত হওয়ার আশংকা। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
ولا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ
অভাব অনটনের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। (বনী ইসরাইল)

দুই- কন্যা সন্তান হলে সমাজে তাদের নিরাপত্তা নেই। বয়োঃসন্ধিকালে উপযুক্ত পাত্র ক্রয়ের অসামর্থ্যতা। মেয়ে সন্তানের জনক জননীকে সমাজে হেয় মনে করা এবং তাদেরকে মানসিক পীড়া দেয়া।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যার আওতাভুক্ত কিনা? হ্যাঁ। অবশ্যই ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যারই শামিল। কেননা ভ্রুণ হত্যা করা হয় সন্তানের জন্মকে ঠেকানোর জন্যেই। এ প্রবণতা অত্যন্ত মারাত্মক। আমি বাসে উঠছি আর কউকে উঠতে দেবো না, এ রকমই যেন এক স্বার্থপর মনোভাব একাজে উদ্বুদ্ধ করে। স্বার্থপরতা নামক বিষবৃক্ষ হতেই এর অংকুরোদগম হয়।

কাউকে দোষারোপ না করাঃ কাউকে দোষারোপ করার প্রবণতা একটি নৈতিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যখন মাহামারীর আকার ধারন করে তখন সমাজ তিক্ততায় জর্জরিত হয়ে যায়। তখন সমাজ হতে ভালোবাসা, সম্প্রীতি, স্নেহ- মমতা ইত্যাদি নির্বাসিত হয়। ইসলামী সমাজ এটাকে কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজী নয়। তাই শরীয়ত এটাকে শাস্তি মূলক অপরাধ বলে গণ্য করেছে।

ভালো কাজের নাফরমানী না করাঃ এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছেঃ
وه تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الإثم والعدوان - তোমরা একে অপরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করো ন্যায়নীতি ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। (সাবধান) যা গুনাহ ও সীমা লংঘনের কাজ তাতে কারও এক বিন্দু সাহায্য ও সহযোগিতা করো না। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেনঃ (সূরা আল মায়েদাঃ ২)
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَاءِ الْمُسْلِمِ فِي مَا أَحَبُّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرُ
بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أَمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ .
'মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের সামাজিক ও সামগ্রীক দায়িত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি (উলিল আমর) দের কথা শোনা ও মানা। তা পছন্দ হোক বা না হোক।

যতোক্ষণ না অন্যায় কাজের আদেশ দিবে। আর যখন কোন অন্যায় বা পাপ কাজের আদেশ দিবে তখন তা শোনা কিংবা মানা মুসলমানদের কর্তব্য নয়।'
(বুখারী, মুসলিম)

পরিশেষে বলা হয়েছে, এর পরও যদি কেউ উল্লিখিত অপরাধসমূহের কোন একটি করে এবং ধৃত হয় তবে অবশ্যই তাকে শরীয়তের দন্ড ভোগ করতে বাধ্য করা হবে।

বিভিন্ন হাদীস ও আসার হতে একথা প্রমাণিত যে কোন অপরাধীকে শরীয়তের দন্ড প্রদানের পর তার অপরাধকৃত পাপের কাফফারা হয়ে যায়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাকে ঐ অপরাধের জন্য পুনরায় শাস্তি দিবেন না। যেমন হযরত আলী (রা) হ'তে বর্ণিত হয়েছে যে-
الدُّنْيَا فَاللَّهُ أَكْرَمُ مِنْ أَن يَثْنِي بِالعقوبة وَ مَنْ أَصَابَ ذَنْبًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَاللهُ أَكْرَمُ .
على عبده في الآخرة .

কোন অপরাধীকে যদি পৃথিবীতে তার কৃত অপরাধের জন্য দন্ডিত করা হয় তবে পরকালেও তাকে আল্লাহ্ দ্বিতীয় বার শাস্তি দিবেন-আল্লাহ্ এ সবের উর্ধে।

আর যদি অপরাধ করে ধৃত না হয় এবং আল্লাহ্ তা গোপন রাখেন তবে সে অপরাধের দায়-দায়িত্ব কোন ইসলামী সরকাররের নয়। আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করবেন অথবা শাস্তি দিবেন। অথবা তাকে প্রথমে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নির্ধারিত শাস্তি দিয়ে পরে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইখতিয়ারভূক্ত।

গ্রন্থসূত্র:
১। তাফহীমুল কুরআন-সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ)
২। 
হাদীস শরীফ ১ম খন্ড- মাওঃ আবদুর রহীম (রহ) 
৩। বাইয়াতের হাকীকাত-অধ্যাপক গোলাম আযম
৪। সাহাবা চরিত-৫ম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা
৫। মাসিক পৃথিবী-বিভিন্ন সংখ্যা।

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

দারসুল হাদীস : হযরত উমর রা. বর্নিত নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস : হযরত উমর রা. বর্নিত নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস
দারসুল হাদীস
নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস
عَنْ عُمَرَ بْن الْخَطَّابِ (رض) عَلَى الْمِنْبَر يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ )صلعم( يَقُولُ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لأَمْرِئ مَّا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى اِمْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهَجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ الَيْهِ (بخاری)
অনুবাদ: আমীরুল মু'মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি মিম্বারের উপর উঠে বলেছিলেন: আমি রাসূলূল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্ৰত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। কাজেই যার হিজরত দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য কিংবা কোন রমণীকে বিবাহ করার নিয়তে হয়েছে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হয়েছে। (সহীহ বুখারী-০১)

শব্দার্থ : عَنْ : হতে। يَقُولُ : তিনি বলেছেন। إِنَّمَا : নিশ্চয়ই । الْأَعْمَالُ : কর্মসমূহ। بِالنِّيَّاتِ : নিয়তসমূহ (বহুবচন)। لأَمْرِئ : প্রত্যেক মানুষের জন্য। مَّا: যা। نَوَى: সে নিয়ত করল। فَ: অতঃপর। مَنْ: যে (ব্যক্তি)। هِجْرَتُهُ : তার হিজরত। كَانَتْ : ছিল। إِلَى : প্রতি, দিকে । دُنْيَا : পৃথিবী। يُصِيبُهَا : সে তা লাভ করবে। اِمْرَأَةٍ : স্ত্রী লোক । يَنْكِحُهَا : সে তাকে বিবাহ করবে। هَاجَرَ : সে হিজরত করল। مَنْ: যে ব্যক্তি। كَانَتْ : সে (স্ত্রী) ছিল। هَجْرَتُهُ: তার হিজরত। الَيْهِ: তার দিকে।

ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসখানায় নিয়তের গুরুত্ব, আমল ও হিজরত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি কর্ম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা উচিত । কোন কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত না থাকলে সে কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আল্লাহর নিকট কোন কাজের পুরস্কার পেতে হলে প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা অপরিহার্য । এমনকি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ দীনি কাজেও নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হবে না এবং তার প্রতিদান পাওয়া যাবে না । আল্লাহ তা'য়ালা কাজের সাথে বান্দার অন্তরের অবস্থাও দেখতে চান ।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رض قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلعم إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَاعْمَالِكُمْ- مسلم
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন: “আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম)
বিশুদ্ধ নিয়ত প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : “আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনাহঃ ৫)
“আপনি বলুন, তোমরা তোমাদের মনের কথা গোপন রাখ অথবা প্ৰকাশ কর, তা সবই আল্লাহ জানেন”। (সূরা আলে-ইমরান : ২৯)
মুসলিম শরীফের অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যিনি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছেন। তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির করে তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় নি'য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে । সে ঐ সব নি'য়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে । অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে উত্তরে বলবে আমি আপনার পথে লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন : তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বীর খ্যাতি অর্জনের জন্য লড়াই করেছো এবং সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো । অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবে সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। এরপর আল্লাহর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছে, দীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং আল-কুরআন পড়েছে। তাকে তার প্রতি প্ৰদত্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ঐ সব নিয়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি দীনি ইল্‌ম অর্জন করেছি, তা অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য আল-কুরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছো । তুমি আলেম খ্যাতি লাভের জন্য ইল্‌ম অর্জন করেছো। তুমি কারীরূপে খ্যাত হওয়ার জন্য আল-কুরআন পড়েছো । সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো। তারপর ফয়সালা দেয়া হবে, অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে ।

এরপর হাজির করা হবে এমন এক ব্যক্তিকে যাকে আল্লাহ সচ্ছলতা ও নানা রকম ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার প্রতি প্রদত্ত নি'য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে । সে ঐ সব নিয়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি আপনার পছন্দনীয় সব খাতেই আমার সম্পদ খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো । তুমি দাতারূপে খ্যাতি লাভের জন্যেই দান করেছো । তারপর ফয়সালা দেয়া হবে। অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। (মুসলিম) কাজেই বুঝা গেল যারা দুনিয়ার স্বার্থ লাভের নিয়তে কাজ করবে তারা দুনিয়াই লাভ করবে আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সাফল্য লাভ করবে ।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ আল-বুখারী।

হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ 'মুসনাদ' আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত ‘সিহাহ সিত্তা' বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয় । এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহুল বুখারী' ।

ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা । তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু‘ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্ৰহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন । তিনি নিজেই বলেন : ‘তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে।

হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন । সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী । তাই বলা হয় :
آصَحُ الْكُتُبِ بَعْدَ كِتَابِ اللَّهِ تَحْتَ السَّمَاءِ صَحِيحُ الْبُخَارِي.
“আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নিচে সর্বাধিক সহীহ গ্রন্থ হচ্ছে সহীহুল বুখারী ।” (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ওয়া উমদাতুল কারী)

ইমাম বুখারী (র) সহজ-সরল, বিনয়ী, দয়ালু উন্নত চারিত্রিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, “আমি জীবনে কোন দিন কারো কোন গীবত করিনি।” এই মহা মনীষী ২৫৬ হিজরী ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর ভোর রাতে ইনতিকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

রাবী পরিচিতি : হযরত উমর (রা)। মূল নাম : উমর । উপনাম : আবু হাফস। উপাধি ঃ আল-ফারুক। পিতার নাম : খাত্তাব । মাতার নাম : হানতামা বিনতে হাশেম ইবনে মুগিরা । জন্মগ্রহণ ঃ হযরত উমর (রা) হিজরতের ৪০ বছর পূর্বে রাসূল (সা)-এর জন্মের ১৩ বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ।

প্রাথমিক জীবন : প্রাথমিক জীবনে হযরত উমর (রা) পিতা-মাতার আদরে লালিত-পালিত হন। পিতার উট চরাতে সাহায্য করেন। যৌবনের প্রারম্ভে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা এবং নসবনামা শিক্ষা লাভ করে আত্ম-প্রত্যয়ী যুবক হিসাবে বেড়ে ওঠেন।

ইসলাম গ্রহণ : তিনি নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন । তাঁর পূর্বে ৩৯ জন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করায় তাকে নিয়ে ৪০ জন পূর্ণ হয়। অতঃপর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। রাসূল (সা) তাঁকে ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন। (উসদুল গাবা)

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ : হযরত আবু বকর (রা)-এর ইনতিকালের পর হিজরী ১৩ সালের ২৩ জমাদিউল উখরা মোতাবেক ২৪শে আগষ্ট ৬৩৪ সালে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খিলাফত কাল ছিল ১০ বছর ৬ মাস। তাঁর শাসনামলে সর্বাধিক রাজ্য জয় হয়। বিজিত রাজ্যের সংখ্যা ছিল ১০৩৬। তিনি সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন। সামরিক কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠা, কাজীর পদ সৃষ্টি ও বিধর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মূল কথা তিনিই ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তব ভিত্তির উপর স্থাপিত করেন। (তাবাকাতে ইবনে সা'দ)

হাদীস বর্ণনার সংখ্যা : তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯ খানা। বুখারী শরীফে এককভাবে ৯ খানা ও মুসলিম শরীফে এককভাবে ১৫ খানা । উভয় গ্রন্থে সর্বমোট ২৪ খানা হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে । তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করেন ও লিপিবদ্ধ করে রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের নিকট প্রেরণ করেন। জনসাধারণকে হাদীস শিক্ষা দানের জন্য তিনি বড় বড় সাহাবীদেরকে বিভিন্ন রাজ্যে পাঠান। সেখানে তারা হাদীসের প্রশিক্ষণ দেন ও হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুহাদ্দিস তৈরী করেন ।

ইমাম যাহ্বী বলেন, “হাদীস, রিওয়ায়াতের ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসগণের জন্য মজবুত নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।” রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর হাদীস বর্ণনার সংখ্যা কম। তাছাড়া তিনি হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে এ আশংকায় জড়িত হয়ে পড়েন যে সুসংঘবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ জনসাধারণের হাতে পৌঁছলে তারা কুরআনের তুলনায় হাদীসকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে বসতে পারে ৷

শাহাদাত লাভ : হিজরী ২৩ সালের ২৪শে জিলহাজ্জ বুধবার মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতি করার সময় মুগীরা বিন শু'বার দাস আবু লু'লু’ বিষাক্ত তরবারি দ্বারা আঘাত করলে আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত করার পর ২৭শে জিলহাজ্জ শনিবার শাহাদাত লাভ করেন । (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর । (তাবাকাতে ইবনে সা'দ )

হাদীসের পটভূমি : এ হাদীসের একটি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ও উপলক্ষ্য রয়েছে। তা হলো, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মক্কার লোকদেরকে দীনে হকের প্রতি আহ্বান করলে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি সে কাজে বাধা দেয়। আল্লাহর বাণী তথা দীনে হকের দাওয়াত গণ-মানুষের কর্ণ কুহরে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাসূলে করীম (সা) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন এবং অন্যান্য সকল মুসলমানকে চতুর্দিক থেকে হিজরত করে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। তখন নিষ্ঠাবান সকল মুসলমানগণ হিজরত করে মদীনায় হাজির হন। তাদের মধ্যে উম্মে কায়েস বা কায়েলা নামের একজন মহিলা ছিলেন। একজন পুরুষ উক্ত মহিলাকে বিবাহ করার জন্য মদীনায় হিজরত করেন । কিন্তু হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন ও সাওয়াব লাভ করার দিকে তার বিন্দুমাত্র লক্ষ্য ছিল না । আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত না করায় তাঁর হিজরত গ্রহণযোগ্য হয়নি । অনুরূপভাবে প্রত্যেক কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকলে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। তাই হিজরতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টকর আমলের মধ্যেও যদি নিয়তের বিশুদ্ধতা না পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কোন প্রতিদান পাওয়ার আশা করা যায় না ৷

হাদীসে উল্লেখিত মহিলার পরিচয় : যাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তার নাম হলো- কায়েলা, তার উপনাম উম্মে কায়েস, আর যে পুরুষ লোকটি তাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছিলেন তার নাম জানা যায় নাই ৷ তবে তাকে মুহাজিরে উম্মে কায়েস বলা হত। সম্ভবতঃ একজন সাহাবীর পরিচয়ের সাথে তার কাজের মিল না থাকায় তার নাম উল্লেখ করা হয় নাই । (উমদাতুল কারী)

হাদীসটির গুরুত্ব : ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম নিয়তের এ হাদীসখানা ইসলামের একটি মূল ফর্মূলা হিসেবে গণ্য ৷ এতে অল্প শব্দে অধিক অর্থ নিহিত রয়েছে। কারো কারো মতে ইসলাম সম্পর্কিত ইলমে এর গুরুত্ব এক-তৃতীয়াংশ ।

আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেন, সকল কাজের পরিশুদ্ধতা ও তার ফলাফল লাভ নিয়ত অনুযায়ী হয়। কেননা নিয়তই মানুষের কাজের দিক নির্ণয় করে। বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদীসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের সর্ব প্রথমে ইমাম বুখারী (র) নিয়তের হাদীসখানা উপস্থাপন করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (র) বলেন, ইমাম মালেকের মুওয়াত্তা ব্যতীত অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে নিয়তের এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে । হযরত উমর (রা) তাঁর প্রত্যেক ভাষণের সূচনাতে এ হাদীসখানা পাঠ করে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। নিয়তের অর্থ : নিয়তের আভিধানিক অর্থ- BINI, iii ইচ্ছা, স্পৃহা, মনের দৃঢ় সংকল্প ইত্যাদি । শরীয়াতের দৃষ্টিতে- আল্লাহ তা'য়ালার সন্তোষ লাভ ও তাঁর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার দিকে হৃদয় মনের লক্ষ্য আরোপ ও উদ্যোগকে নিয়ত বলে ।

ফতহুর রব্বানী গ্রন্থকার বলেন :
تَوَجُهُ الْقَلْبِ جَهَةَ الْفِعْل ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ تَعَالَى وَاِمْتِتَالاً لأمره. “আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনার্থে কোন কাজের দিকে মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ও অভিপ্রায় প্রয়োগ করা।” (ফতহুর রব্বানী ২য় খণ্ড পৃ. ১৭) আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেন :
هُوَ قَصْدُكَ الشَّيْئَ بِقَلْبِكَ وَتَحَرِّى الطلبِ مِنْكَ.
“মনে কোন কাজ করার সদিচ্ছা পোষণ করা এবং উহা বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করাকে নিয়ত বলা হয়।” নূরুল ইযা গ্রন্থকার বলেন :
النَّيَّةُ هُوَ قَصْدُ الْقَلْبِ عَلَى الْفِعْل.
“কাজের উপর মনের ইচ্ছা পোষণ করাকে নিয়ত বলা হয় ।” প্রত্যেকটি কাজের শুরুতেই নিয়ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইমাম বায়যাবী (র) তাঁর মতামত নিম্নের ভাষায় ব্যক্ত করেন :
إِنْبِعَاتُ الْقَلْبِ نَحْوَ مَا يَرَاهُ مُوَافِقًا لِغَرْضِ مِّنْ جَلْبٍ نَفْعِ أَوْ دَفْعِ ضَرَرِ
حَالاً أَوْ مَالاً.
“বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোন উপকার লাভ বা কোন ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অনুকূল কাজ করার জন্যে মনের উদ্যোগ ও উদ্বোধনকেই নিয়ত বলে।” (উমদাতুল কারী ১ম খণ্ড ৬৩ পৃঃ) মোটকথা কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়াশীল থাকে, চাই তা ভাল কাজ হউক কিংবা মন্দ কাজ, তাকেই ‘নিয়ত' নামে অভিহিত করা হয় ৷

ইবাদতমূলক কাজে নিয়তের গুরুত্ব

ইবাদত বুনিয়াদী পর্যায়ে দু'প্রকার। যথা—

১ । মাকসুদা বা মূল ইবাদত;
২। গায়রে মাকসুদা বা সহায়ক ইবাদত ।

১। ইবাদতে মাকসুদা: যে ইবাদতের দ্বারা সওয়াব পাওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে তাকে ইবাদতে মাকসুদা বা মূল ইবাদত বলে । যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি ।

২। ইবাদতে গায়রে মাকসুদা : যে ইবাদত মূল ইবাদতের সহায়ক । যে ইবাদত দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে করা হয় না বরং উহা মাকসুদা বা মূল ইবাদতের সহায়ক বা মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- অযু, তায়াম্মুম। ইহা সরাসরি ইবাদত নয় বরং সালাত উহার উপর নির্ভরশীল আর নামাযের জন্য উহা সহায়ক বা মাধ্যমও বটে ।

ইমামদের মতভেদঃ

ইমাম শাফি'ঈ, মালেক ও আহমদ (র) প্রমুখ মনীষীগণ বলেন, ইবাদতে মাকসুদা বা গায়রে মাকসুদা যে ধরনের ইবাদতই হোক না কেন, উহার বিশুদ্ধতার জন্য নিয়ত করা পূর্বশর্ত । আল্লাহর বাণী :
وَمَا أُمِرُوا إِلا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.
“আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তারই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনা : ৫)
আল্লাহ তা'য়ালা কুরআনে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন : إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللهِ وَاخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلهِ.
“তবে তাদের মধ্যে যারা তওবা করবে ও নিজেদের কার্যাবলী সংশোধন করে নিবে ও আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধারণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দীনকে খালেস করে নিবে।” (সূরা আন-নিসা : ১৪৬)
إِنَّمَا صِحَّةُ الْأَعْمَال بِالنِّيَّاتِ.
“আমল ও ইবাদতের বিশুদ্ধতা একনিষ্ঠভাবে নিয়তের উপরই নির্ভরশীল ।” হানাফী ইমামগণ বলেন, ইবাদতে সাওয়াব প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল। তাদের মতে বর্ণিত হাদীসে Liii শব্দের পরে । শব্দটি উহ্য রয়েছে। মূল বাক্য ছিল এরূপ : Lil “ইবাদতের সওয়াবের প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল ।”

গায়েরে মাকসুদা দুরস্ত হওয়ার জন্য নিয়তের প্রয়োজন নেই । কেননা, নিয়ত ব্যতিরেকেই শুদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু সওয়াব পাওয়া যাবে না । উহা নিয়ত ও ইরাদার মধ্যে পার্থক্য কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়শীল থাকে, চাই তা ভাল হোক বা মন্দ হোক তাকেই নিয়ত বলা হয় । আর শুধু কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করার নাম হলো ইরাদা ।

হিজরত অর্থ

হিজরত অর্থ- ত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, ছেড়ে দেয়া, কোন জিনিস ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া ইত্যাদি । (আল-ওয়াসীত : ২/৯৭৩)
শরীয়তের পরিভাষায়-নিজের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে দীন ও ঈমান রক্ষার নিমিত্তে ‘দারুল হরব' থেকে ‘দারুল ইসলামে' প্রস্থান করাকে শরীয়তে হিজরত বলে ।
ইবনে হাজার আসকালানির (র) মতে, “আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করাকে হিজরত বলে ।”
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে 'দারুল হরব' থেকে ‘দারুল ইসলামে' প্রস্থান করাকে হিজরত বলে। যেমন— নবী করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) দীন ও ইসলামের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে মক্কাভূমি (দারুল হরব) পরিত্যাগ করে মদীনা (দারুল ইসলাম) চলে গিয়েছিলেন । সুতরাং সে চলে যাওয়াকে হিজরত নামে অভিহিত করা হয় । তাছাড়া শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজসমূহকে পরিত্যাগ করাকেও হিজরত বলে ।

হিজরতের বিধান : হিজরতের বিধান পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। এ বিধানটির উপর মুসলমানদের বহুবিদ কল্যাণ নিহিত আছে। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই মহানবী (সা) নিম্নের হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন :
لاَ تَنْقَطِعُ الْهَجْرَةُ حَتَّى لا تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَتَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا.
“তওবা করার অবকাশ থাকা পর্যন্ত হিজরতের ধারা বা সিলসিলা বন্ধ হবে না। আর তওবার অবকাশও বন্ধ হবে না পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত ।” (আবু দাউদ)

গোটা বিশ্বের যে কোন স্থানে যে কোন সময় দীন ও ঈমান হিফাযত করার জন্য হিজরতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে । বর্তমান বিশ্বে যেভাবে মুসলমানদের উপর দেশে দেশে নির্যাতন চলছে তাতে হিজরত করার অপরিহার্যতা আরো ব্যাপক করে তোলে । এমনকি কোন স্থানে বা দেশে অন্ততঃ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী বিধি-বিধান পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, তখন নিরাপদ স্থানে হিজরত করার বিধান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে । (লোমাআত)

শিক্ষা
১। সকল কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল
২। মুসলমানদের সকল কাজের পূর্বে নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া উচিত ।
৩। দীন ও ঈমানের হিফাযতের জন্য প্রয়োজনে হিজরত করতে হবে।
৪ । সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া অপরিহার্য।
৫। শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ ভাল নিয়তেও করা জায়েয নয় ।


-সংকলিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত।

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দারসুল হাদীস: হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: 
হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

আরবী ইবারতঃ

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ابْن سَمُرَةَ (رض) قَالَ قَالَ لِي رَسُوْلُ اللَّهِ (صلعم) لَا تَسْئل الْإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا عَنْ مُسْئَلَةٍ وكُلَتْ إِلَيْهَا وَإِنْ أَعْطِيتَهَا عَنْ غَيْر مَسْئَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا. (بخاری، مسلم)

বাংলা অনুবাদঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) আমাকে বললেন : তুমি নেতৃত্বের পদপ্রার্থী হবে না । কারণ, তুমি যদি তা চেয়ে নাও তবে তোমাকে ঐ পদের বোঝা দেয়া হবে (দায়িত্ব পালনে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না)। আর যদি প্ৰাৰ্থনা ছাড়াই তোমাকে ঐ পদ দেয়া হয়, তবে তুমি ঐ পদের দায়িত্ব পালনে (আল্লাহর) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারী, মুসলিম)


শব্দার্থঃ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ ابْنِ سَمُرَةَ (رض) : হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। قَالَ : সে বলল। لِي : আমাকে । لَا تَسْئل : তুমি চেয়ে নেবে না। الْإِمَارَةَ : নেতৃত্ব। فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا : নিশ্চয়ই তোমাকে উহা দেয়া হবে। عَنْ مَّسْئَلَةٍ : তুমি চাওয়ার কারণে । وَكَلَتْ إِلَيْهَا : তোমাকে ঐ পদের বোঝা চাপানো হবে। غَيْر مَسْئَلَةٍ : প্রার্থনা ব্যতীত। ُعِنْتَ عَلَيْهَا : তাতে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে ।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদ' আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত সিহাহ সিত্তা' বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয় । এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহ্ আল-বুখারী'।
☆সহীহ্ আল-বুখারী: 
ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু’ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন । তিনি নিজেই বলেন : “তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী ।
☆সহীহ্ আল-মুসলিম:
সহীহ্ আল-মুসলিম গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ইমাম মুসলিম (র), যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুরে ২০৪ হিজরী ২৪শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ২১৮ হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি হিজায, ইরাক, মিশর, বাগদাদ, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম জাহানের ইলম শিক্ষার কেন্দ্রভূমিসমূহে ভ্রমণ করেন। তিনি সে কালের জ্ঞানসাগর ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ইমাম মুসলিম (র) সরাসরি ওস্তাদগণের থেকে শ্রুত তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে (তাহযীবুল আসমা ১০ম খণ্ড) দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা ও গবেষণা করে এ শ্রেষ্ঠ গ্রন্থখানি সংকলন করেন । এতে তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০ । তাকরার বাদে হাদীস সংখ্যা ৪,০০০ মাত্র। (তাদরীবুর রাবী) সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থকে বিশুদ্ধ ও অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ প্রায় বার শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সহীহ্ মুসলিমের সমমানের কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি।
বুখারী ও মুসলিম শরীফকে একত্রে ‘সহীহাইন’ বলা হয়।

রাবী পরিচিতিঃ

হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা)। নাম : আবদুর রহমান । পিতার নাম : সামুরা। নসবনামা : আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীব ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কুসাই । কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল আবদুল কাবা । ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা) তার নাম রাখেন আবদুর রহমান । তিনি ছিলেন একজন আরব সেনাপতি । ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। খলীফা উসমানের (রা) খিলাফতকালের পরবর্তী বছরগুলোতে সিজিস্তানে সর্বপ্রথম সেনাপতিরূপে নিযুক্ত হন। তিনি দক্ষতার সাথে যারাজ ও যামীন-ই দাওয়ার জয় করেন এবং কিরমান এর শাসনকর্তার সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁকে সিজিস্তানের শাসনভার অর্পণ করা হয় । আমীর মুয়াবিয়া (রা) যিয়াদকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করার পর আবদুর রহমান ইবনে সামুরাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করেন। তিনি ফিরে আসেন এবং ৬৭০ সালে বসরায় ইনতিকাল করেন । পরবর্তীকালে তার বংশধরগণ বসরায় একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গোত্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । (আল-বালাযুরী ফুতহুল বুলদান )

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কারণ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার মত খারাপ প্রবণতা লোভ থেকে সৃষ্টি হয়। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যেই রাসূল (সা) বলেছেন, নেতৃত্ব চেয়ে নিলে তাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়া যায় না। আর আল্লাহর রহমত ও সাহায্য ছাড়া কোন কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । সাধারণ কাজের চেয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব বেশী কঠিন। প্রার্থনা ব্যতীত যে নেতৃত্ব লাভ হয়, তাতে আল্লাহর রহমত থাকে । সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালা এই নেতাকে সাহায্য করেন, ফলে সহজেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (সা) পদপ্রার্থীদেরকে কোন পদের উপযুক্ত মনে করতেন না এবং তাদেরকে সে পদে অধিষ্ঠিত করতেন না। এ সত্যতা আমরা নাসায়ী শরীফের একটি হাদীসে দেখতে পাই যা হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-এর নিকট আগমন করি, আমার সাথে আশয়ারী গোত্রের দু'ব্যক্তি ছিলেন। তারা রাসূলের (সা)-এর নিকট রাষ্ট্রীয় পদে চাকুরী প্রার্থনা করেন, কিন্তু রাসূল (সা) তাদেরকে বলে দেন, যারা নিজেরা রাষ্ট্রীয় পদের নেতৃত্ব চায় তাদেরকে আমরা নেতৃত্ব দেই না বা নেতৃত্ব লাভে সাহায্যও করি না । অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে ইয়ামেনে গভর্নর করে পাঠালেন অপর আর একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেন :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) تَجِدُونَ مِنْ خَيْرٍ النَّاسِ أَشَدُّهُمْ كَرَاهِيَةً لِهَذَا الْأمْر حَتَّى يَقَعَ فِيْهِ. (بخاری، مسلم)
“হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন : “যারা পদকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে । অতঃপর যখন তাতে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তোমরা তাদেরকে সর্বোত্তম লোক হিসেবে পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)

ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের পরিবর্তনঃ

প্রত্যেক মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর তাদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা ফরয। এ প্রসঙ্গে ইমাম জুরযানী বলেন :
أَنْ نَصَبَ الْإِمَامِ مِنْ آتِمِّ مَصَالِحِ الْمُسْلِمِينَ وَاعْظَمِ مَقَاصِدِ الدِّينِ. “ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের পূর্ণতম ব্যবস্থা এবং দীন ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে সর্বাধিক মাত্রায় বাস্তবায়ন।”

আকাইদে নাসাফী গ্রন্থকার বলেন :
“মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য একজন ইমাম অবশ্যই থাকতে হবে। ইহা অপরিহার্য। তিনি আইন কানুনসমূহ কার্যকর করবেন, শরীয়ত নির্দিষ্ট হৃদ জারি করবেন, বিপদ-আপদের সকল দিক বন্ধ করবেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বন্ধের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত ও সদা প্রস্তুত করে রাখবেন। যাকাত গ্রহণ ও বণ্টন করবেন, বিদ্রোহী, দুষ্কৃতিকারী, চোর, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের কঠিন শাসন ও দমন করবেন। জুম'আ ও ঈদের সালাতসমূহ কায়েম করবেন, লোকদের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করবেন। মানুষের অধিকার প্রমাণের জন্য (বিচার ব্যবস্থা চালু করবেন সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন দুর্বল, অক্ষম বালক- বালিকাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। (আকাঈদে নাসাফীঃ ৩৩৮ পৃঃ)

অসৎ নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা ।
هِيَ خِلافَةُ الرَّسُوْل فِي إِقَامَةِ الدِّيْنِ.
“নেতৃত্ব হলো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারিত্ব।” (কিতাবুল মাওয়াকিফ)
আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা, উহার প্রচার ও প্রসার এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাই সমাজের লোকদেরকে সুসংগঠিত হয়ে অসৎ ও খোদা বিমুখ লোকদের নেতৃত্বকে উৎখাত করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে ঈমানদার, খোদাভীরু ও যোগ্য লোকদের হাতে সে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। যখন সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তখন তোমাদেরকে আল্লাহর দীনের উপর অটল থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী :
فَاصْبِرْ لِحُكُم رَبِّكَ وَلاَ تُطِعْ مِنْهُمْ اثِمًا أَوْكَفُورًا. 
“অতঃপর তোমার প্রভুর হুকুম, নির্দেশ ও কর্তৃত্বের উপর অটল, অবিচল হয়ে থাকো, আর তাদের কোন এক একজন পাপিষ্ঠ অবিশ্বাসীর আনুগত্য ও করো না । (সূরা-আদ্-দাহার : ২৪)

اِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْآمَنَتِ إِلَى أَهْلِهَا.
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সূরা-আন্ নিসা : ৫৮)

এ আয়াতের তাফসীরে মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) বলেন : রাষ্ট্রীয় যত পদ ও মর্যাদা আছে, সবই আল্লাহর আমানত । এসব পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা আমানতদার। রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের জন্যে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করা অবশ্য কর্তব্য। রাষ্টীয় পদের সাথে জনগণের অধিকার জড়িত, তাই সেটাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। এসব আমানতের অধিকারী সেসব লোক যারা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সমর্থনের দিক থেকে সর্বোত্তম, আর বিশ্বস্ততা ও রাষ্ট্রীয় আমানত রক্ষার দিক থেকে অগ্রগণ্য । এদের ছাড়া কাউকে রাষ্ট্রীয় আমানত অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।” (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট)

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র) বলেন : “বনি ঈসরাঈল সম্প্রদায়ের একটি বড় অপরাধ ছিল তারা তাদের পতনের যুগে দায়িত্বপূর্ণ পদ অযোগ্য, অসৎ, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খিয়ানতকারী ও ব্যভিচারী লোকদের হাতে অর্পণ করেছিল। আর এসব অসৎ নেতৃত্বের কারণে গোটা জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল । (সংক্ষিপ্ত)

অথচ আল্লাহর আদেশ হচ্ছে, “এমন লোকের (নেতৃত্ব) আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে এবং যার কার্যক্রম উগ্র ও উদাসীন।” (সূরা আল-কাহাফ ২৮)

এ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যোগ্য লোকদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা ফরয। আর এ জন্যই অসৎ নেতৃত্ব উৎখাত করে, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়া অপরিহার্য।

অনৈসলামিক রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচনঃ

যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কোন ইসলামী দল দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ভোট প্রার্থনা করলে তা জায়েয ৷ কারণ, ইহা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অংশ বিশেষ । আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য যখন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে করলে তাতে কোন দোষ নেই । তাছাড়া জনগণের সামনে না আসলে কি করে সৎ ও অসৎ নেতৃত্বের পার্থক্য বুঝতে পারবে । আল্লাহর বাণী : “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে শক্ত হয়ে দাড়াও, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে দাড়াও।” (সূরা-নিসা : ১৩৫) “হযরত ইউসুফ (আ) বললেন, আমাকে দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল বানিয়ে দাও, আমি অধিক সংরক্ষণকারী ও বিষয়টি সম্পর্কে আমি অধিক অবহিত। (সূরা ইউসুফ : ৫৫)

ইহা এক প্রকার জিহাদ যাকে ভোটের জিহাদ বা ভোট যুদ্ধ বলে । এ জিহাদে প্রার্থী হয়ে এবং ভোট দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে । যার উদ্দেশ্য হবে- !
مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةَ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيْلِ اللهِ.
“যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে।” (বুখারী)
কুরআন হাদীসের এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া একান্ত জরুরী। রাসূল (সা) মদীনায় রাষ্ট্র প্রধান হওয়ায় এবং দেশের সকল কর্তৃত্ব তাঁর হাতে থাকায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। আর খুলাফায়ে রাশেদা ও তাঁর পদাংক অনুসরণ করেন ।

নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাঃ

যে কোন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দেশ পরিচালনা কিংবা আইন প্রবর্তনের জন্যে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা হলে আল্লাহ তা'য়ালার আইন বাস্তবায়ন ও রাসূল (সা)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু ও আমানতদার লোকদেরকে নির্বাচিত করার জন্য ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। যদিও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় তথাপি মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতিকে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট, মুফতী মুহাম্মদ শফী র.)

ইসলামী দলে নেতা নির্বাচনঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজেকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার কারো নেই। সেভাবেই ইসলামী দলেও কোন পদের জন্য প্রার্থী হওয়া যায় না। কিন্তু পদের জন্য অন্য কোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা জায়েয। তাতে নিজের লোভের কোন প্রকাশ থাকে না। ব্যক্তির নিজের প্রার্থী হওয়ার অর্থ হলো নিজেকে বড় মনে করা, যা ইসলামে না জায়েয। কিন্তু দলের পক্ষ হতে ইসলামী সংগঠনের নেতাকে ঐ গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের কর্মীগণ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সে দায়িত্ব পালন করা ফরয। ইসলামী দল কোন ব্যক্তিকে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন অথবা মনোনীত করলে সে ক্ষেত্রে তার আপত্তি করার কোন সুযোগ থাকবে না এবং দুর্বলতাও প্রদর্শন করা যাবে না । তখন দলের দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য ।

ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদের নাম নয়, ইহা দায়িত্বের নাম। কাজেই দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ববান লোক নিয়োগ করা জরুরী । এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন : “লোকদের ইমাম বা নেতা হবেন সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান সবচেয়ে বেশী রাখেন, এ ব্যাপারে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম হবেন, যদি এ বিষয়েও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সকলের আগে হিজরত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সমান হলে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি ইমামতি করবেন। কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির প্রভাবাধীন এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

বুঝা গেল রাষ্ট্র প্রধানকে
১ । নামাযের ইমামতি করার যোগ্যতা থাকতে হবে ।
২। কুরআনের জ্ঞান থাকতে হবে।
৩। সুন্নাহ তথা ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে ।
৪ । হিজরতে অগ্রগামী অর্থাৎ নির্দেশ পালনে অগ্রসর হতে হবে ।
৫। বয়সে প্রবীণ হতে হবে ।

শরীয়তে নামায ও রাষ্ট্রীয় ইমামতিতে একই গুণাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। নামাযের ইমামতি রাষ্ট্রীয় ইমামতির প্রশিক্ষণ দেয়। এ কারণেই ইসলামী সংগঠন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের জন্যে নিম্নের গুণাবলীকে প্রাধান্য দেয় ।
১. দীনি ইলম অর্থাৎ সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। যার ইসলামী সংগঠন পরিচালনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে ।
২. খোদাভীরু অর্থাৎ তাকওয়াবান । যিনি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেন।
৩. রাসূলের আনুগত্য অর্থাৎ সুন্নাহ মোতাবেক সার্বিক কাজ পরিচালনা করবেন ।
৪. আমানতদার অর্থাৎ যিনি হবেন সকল কাজের ও সম্পদের আমানত রক্ষায় সচেষ্ট ব্যক্তি
৫. উন্নত আমল অর্থাৎ তাঁর আমল-আখলাক হবে সবচেয়ে উন্নত ও অনুসরণীয় ।
৬. অনড় মনোবল অর্থাৎ কাপুরুষ, ভীরু নয়; অনড় মনোবলের অধিকারী।
৭. কর্মে দৃঢ়তা অর্থাৎ যার কর্মে দৃঢ়তা আছে, যিনি অস্থিরতা ও হীনমন্যতায় ভোগেন না ।
তাছাড়া যিনি সাহসী, পরিশ্রমী, ইনসাফগার, ধৈর্যশীল, পরামর্শ গ্রহণের ও জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিশ্লেষণ শক্তি, উদ্ভাবন শক্তি, প্রশস্ত চিত্ততা, সুন্দর ব্যবহার, মেজাজের ভারসাম্য, সাংগঠনিক প্ৰজ্ঞা ও সাংগঠনিক শৃংখলা বিধানের যোগ্যতা রাখেন ।

দারসের শিক্ষাঃ

১। ইসলামী রাষ্ট্র বা দলে পদ প্রার্থী হওয়া যায় না ।
২। কোন পদের জন্য লালায়িত হওয়া উক্ত পদের জন্য অযোগ্যতার শামিল ।
৩। কোন পদ জবর দখল করলে তাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে না ।
৪। জনগণের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে তা পালন করা কর্তব্য।
৫। না চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে।

সোমবার, ২৩ মে, ২০২২

দারসুল হাদিস: হাদিসে জিবরিল (আ.)

কিতাবুল ঈমান (كتاب الإيمان), সহীহ মুসলিম: ১ (ই.ফা.)।
✅আরবী ইবারতঃ

حَدَّثَنِي أَبُو خَيْثَمَةَ، زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ كَهْمَسٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ يَعْمَرَ، ح وَحَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُعَاذٍ الْعَنْبَرِيُّ، - وَهَذَا حَدِيثُهُ - حَدَّثَنَا أَبِي، حَدَّثَنَا كَهْمَسٌ، عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ يَعْمَرَ، قَالَ كَانَ أَوَّلَ مَنْ قَالَ فِي الْقَدَرِ بِالْبَصْرَةِ مَعْبَدٌ الْجُهَنِيُّ فَانْطَلَقْتُ أَنَا وَحُمَيْدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحِمْيَرِيُّ حَاجَّيْنِ أَوْ مُعْتَمِرَيْنِ فَقُلْنَا لَوْ لَقِينَا أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلْنَاهُ عَمَّا يَقُولُ هَؤُلاَءِ فِي الْقَدَرِ فَوُفِّقَ لَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ دَاخِلاً الْمَسْجِدَ فَاكْتَنَفْتُهُ أَنَا وَصَاحِبِي أَحَدُنَا عَنْ يَمِينِهِ وَالآخَرُ عَنْ شِمَالِهِ فَظَنَنْتُ أَنَّ صَاحِبِي سَيَكِلُ الْكَلاَمَ إِلَىَّ فَقُلْتُ أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ إِنَّهُ قَدْ ظَهَرَ قِبَلَنَا نَاسٌ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ وَيَتَقَفَّرُونَ الْعِلْمَ - وَذَكَرَ مِنْ شَأْنِهِمْ - وَأَنَّهُمْ يَزْعُمُونَ أَنْ لاَ قَدَرَ وَأَنَّ الأَمْرَ أُنُفٌ ‏.‏ قَالَ فَإِذَا لَقِيتَ أُولَئِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنِّي بَرِيءٌ مِنْهُمْ وَأَنَّهُمْ بُرَآءُ مِنِّي وَالَّذِي يَحْلِفُ بِهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ لَوْ أَنَّ لأَحَدِهِمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا فَأَنْفَقَهُ مَا قَبِلَ اللَّهُ مِنْهُ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ ثُمَّ قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ لاَ يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ وَلاَ يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ وَقَالَ يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الإِسْلاَمِ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً ‏.‏ قَالَ صَدَقْتَ ‏.‏ قَالَ فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ ‏.‏ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإِيمَانِ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ صَدَقْتَ ‏.‏ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإِحْسَانِ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَتِهَا ‏.‏ قَالَ ‏"‏ أَنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَهَا وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِي الْبُنْيَانِ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ ثُمَّ انْطَلَقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا ثُمَّ قَالَ لِي ‏"‏ يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ ‏"‏ ‏.‏ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ ‏"‏ ‏.

✅বাংলা অনুবাদঃ


‏১। আবূ খায়সামা যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার) বলেন, সর্বপ্রথম তাকদীর’ সম্পর্কে বসরা শহরে মাবাদ আল জুহানী কথা তোলেন। আমি (ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার) এবং হুমায়দ ইবনু আব্দুর রহমান আল হিমায়রী হাজ্জ (হজ্জ) অথবা উমরা আদায়ের জন্য মক্কা মু’আযযামায় আসলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম যে, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কোন সাহাবীর সাক্ষাৎ পাই তাহলে তাঁর কাছে এসব লোক তাকদীর সম্পর্কে যা বলে বেড়াচ্ছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম।

সৌভাগ্যক্রমে মসজিদে নববীতে আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর দেখা পাই। আমরা তাঁর কাছে গিয়ে একজন তাঁর ডানপাশে এবং আর একজন বামপাশে বসলাম। আমার মনে হলো, আমার সাথী চান যে, আমিই কথা বলি। আমি আরয করলাম, হে আবূ আবদুর রহমান! আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ)-এর কুনিয়াত ছিল আবূ আবদুর রহমান। আমার দেশে এমন কতিপয় লোকের আবির্ভাব হয়েছে যারা কুরআন পাঠ করে এবং ইল্‌মে দ্বীন সম্পর্কে গবেষণা করে। তিনি তাদের অবস্হা সম্পর্কে আরো কিছু উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, তারা মনে করে তাকদীর- বলতে কিছু নেই। সবকিছু তাৎক্ষনিকভাবে ঘটে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বললেন, তাদের সাথে তোমাদের দেখা হলে বলে দিও যে, তাদের সাথে আমার কোন সস্পর্ক নেই এবং আমার সঙ্গে তাদেরও কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহর কসম! যদি এদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিক হয় এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, তাকদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আল্লাহ তা কবুল করবেন না।

তারপর তিনি বললেন, আমাকে আমার পিতা উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) হাদীস শুনিয়েছেন যে, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর খিদমতে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমাদের কাছে এসে হাযির হলেন। তাঁর পরিধানের কাপড় ছিল সা’দা ধবধবে, মাথার কেশ ছিল কাল কুচকুচে। তাঁর মধ্যে সফরের কোন চিহ্ন ছিল না। আমরা কেউ তাঁকে চিনি না। তিনি নিজের দুই হাঁটু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর দুই হাঁটুর সাথে লাগিয়ে বসে পড়লেন আর তার দুই হাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর দুই উরুর উপর রাখলেন।

তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইসলাম হল, তুমি এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, সালাত (নামায/নামাজ) কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রামাযানের রোযা পালন করবে এবং বায়তুল্লাহ পৌছার সামর্থ্য থাকলে হাজ্জ (হজ্জ) পালন করবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তার কথা শুনে আমরা বিষ্মিত হলাম যে, তিনই প্রশ্ন করেছেন আর তিনই-তা সত্যায়িত করছেন।

আগন্তুক বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঈমান হল আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি, তার রাসুলগণের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনবে, আর তাকদিরের ভালমন্দের প্রতি ঈমান রাখবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।

তারপর বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইহসান হলো, এমনভাবে ইবাদত-বন্দেগী করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, যদি তুমি তাকে নাও দেখ, তাহলে ভাববে তিনি তোমাকে দেখছেন।

আগন্তুক বললেন, আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চাইতে যাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি অধিক অবহিত নন। আগন্তুক বললেন, আমাকে এর আলামত সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল বললেনঃ তা হলো এই যে, দাসী তার প্রভুর জননী হবে; আর নগ্নপদ, বিবস্ত্রদেহ দরিদ্র মেষপালকদের বিরাট বিরাট অট্টালিকার প্রতিযোগিতায় গর্বিত দেখতে পাবে।

উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বললেন যে, পরে আগন্তুক প্রস্হান করলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে উমর! তুমি জানো, এই প্রশ্নকারী কে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সম্যক জ্ঞাত আছেন। রাসুল বললেনঃ তিনি জিবরীল। তোমাদের তিনি দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।

-সহিহ মুসলিম : ১ (ই.ফা.)

✅রাবি পরিচিতিঃ-

নাম- উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। উপনাম - আবুল হাফস। উপাধি - আল-ফারুক। পিতা - খাত্তাব, মাতা - হানতামা বিনতে হাশেম ইবনে মুগীরা। জন্ম - হিজরতের ৪০ বছর পূর্বে রাসূল (সাঃ) এর জন্মের ১৩ বছর পর ৫৮৩ খৃষ্টাব্দে। 

প্রাথমিক জ্ঞান - উট চরাতেন। যৌবনে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা শিক্ষা লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণ - নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সালে ৪০ তম ব্যক্তি হিসাবে। 

খিলাফতের দায়িত্ব - হিজরী ১৩ সালের ২৩ জমাদিউল উলা। ২৪ শে আগষ্ট ৬৩৪ সাল। খিলাফতকাল ১০ বছর ৬ মাস। 

মর্যাদা-হুজুর স বলেন, আমার পরে কেউ যদি নবী হতো, তাহলে সে হতো ওমর (রা)। তিনি মোট হাদীস বর্ণনা করেছেন - মোট ৫৩৯টি। এককভাবে বুখারীতে ৯টি মুসলিমে ১৫টি। 

হিজরী ২৩ সালের ২৪শে জিলহজ্জ বুধবার মসজিদে নববীতে ইমামতি করার সময় মুগীরা বিন শুরার দাস আবু লুল’র বিষাক্ত তরবারীর আঘাতে আহত হয়ে ৩দিন পর ২৭শে জিলহজ্জ শনিবার শাহাদাত বরন করেন।

হাদীস পরিচিতি:-
এই হাদিস টি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত, এটি প্রশিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ সহীহ মুসলিম শরীফে ইমাম মুসলিম রাহি: উল্লেখ করেছেন।
সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনের সাথে এটা হজরত আবু হোরায়রা (রা:) ও বর্ণনা করেছেন। তাতে (কেয়ামতের নিদর্শন) সম্পর্কে এরূপ রয়েছে; নাঙ্গাপা, নাঙ্গা শরীর মূক-বধিরকে (যার কোন উপযুক্ততা নেই)দেশের রাজা বা শাসক হতে দেখবে। (এবং কেয়ামত রয়েছে) এটা সেই পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্গত যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নয়। অত:পর রসূলুল্লাহ (সা:) প্রমাণ স্বরূপ কোরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন। অর্থাৎ, ‘আল্লাহর নিকট রয়েছে কেয়ামতের এলম তা কবে হবে, কিরূপে হবে। তিনি বৃষ্টি নাযেল করে থাকেন’। (বোখারী ও মুসলিম)

এটাকে হাদীসে জিবরীল বলার কারণ:-
প্রশ্নকারী হজরত জিবরাইল (আ:) ছিলেন বলে হাদীসটি ‘হাদীসে জিবরীল’ নামে প্রসিদ্ধ, যেহেতু এতে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলির বর্ণনা রয়েছে এজন্য একে ‘উম্মুস সুন্নাহ’ও বলা হয়ে থাকে। যেভাবে সূরা ফাতেহাকে ‘উম্মুল কোরআন’ বলা হয়ে থাকে।

✅হাদিসের ব্যাখ্যাঃ

ইসলামের অর্থ

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত বাহ্যিক কাজকে, অর্থাৎ কথা ও আমলকে। এসব কাজের প্রথমটি হল মৌখিক  – আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র রাসুল – এটা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা। এই ঘোষণার দেওয়ার পর একজন মুসলিমের উপর যা করা ফরয তা হল সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাদানে সিয়াম পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে হজ করা।

 

ইসলামকে প্রদত্ত শ্রেণীগুলোতে ভাগ করা হয়েছেঃ

(১) শরীরের আমল (সালাত ও সিয়াম),

(২) আর্থিক আমল (যাকাত আদায় করা),

(৩) উপরোক্ত দুটি মাধ্যমের সম্মিলিত আমল (হজ পালন করা)।

 

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস – “একজন মুসলিম তো সে, যে অন্য মুসলিমদের জিহ্বা (মুখের কথা) বা হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকে” (বুখারি – কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ১০;  মুসলিম – কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ৪০/৬৪) – এটা ইঙ্গিত করে যে সব বাহ্যিক আমলই ইসলামের শ্রেণীর অধীনে অন্তর্ভুক্ত।

আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলো, “ইসলামে কোন ধরনের (অথবা কোন গুণসম্পন্ন) আমল উত্তম ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দরিদ্র লোকদের খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তিদের সালাম দেওয়া।” (বুখারি – কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ১২;  মুসলিম – কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ৩৯/৬৩)

একইভাবে, নিষিদ্ধ কাজগুলো ছেড়ে দেওয়াও ইসলামের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের সর্বোত্তম বৈশিস্টগুলোর একটি হল যা তার সম্পর্কিত  নয়,তা পরিত্যাগ করা।” (তিরমিযি – কিতাবুল যুহদ, হাদিস ২৩১৭;  ইবন মাজাহ – কিতাবুল ফিকহ, হাদিস ৩৯৭৬)

নাওাস বিন সাম’আন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ সরল পথের যে উপমা দেখিয়েছেন তা হল এই যে – এটি দুই পাশের দেয়াল দ্বারা ঘেরা রয়েছে। দেয়ালগুলোর সামনে রয়েছে উন্মুক্ত দরজা যেখানে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রবেশপথে রয়েছে এক আহবানকারী যে বলে, ‘হে লোকসকল, তোমরা সবাই এই পথে প্রবেশ করো এবং বিপথে যেয়ো না।’ সেই পথের ভিতরে রয়েছে আরেকজন আহ্বানকারী যে সবাইকে (যারা অন্য কোন দরজা খুলতে চায়) আহবান করে, ‘তোমাদের উপর দুঃখ আপতিত হোক, এই দরজা খুলবে না!’ এটি হল ইসলামের পথ, আর দেয়ালগুলো হল আল্লাহ্‌র বেঁধে দেওয়া সীমারেখা। উন্মুক্ত দরজাগুলো হল সেগুলো যেগুলোকে আল্লাহ হারাম করেছে এবং পথের মাথায় আহ্বানকারী হল আল্লাহ্‌র কিতাব আর ভিতরের পথের আহ্বানকারী হল আল্লাহ্‌র দেওয়া উপদেশ যা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে থাকে।” (মুসনাদে আহমাদ – ৪/১৮২,১৮৩; তিরমিযি – কিতাবুল আমসাল, ২৮৫৯; নাসাঈ’র আল কুবরা কিতাব – কিতাবুত তাফসীর, ১১২৩৩)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের সরল পথের এই উপমাবিশিস্ট পথ প্রদর্শন করে গেছেন যার ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের আদেশ দিয়েছেন দৃঢ় থাকার জন্য এবং নিষেধ করেছেন যেন এর সীমার বাইরে না যাওয়া হয়, যে ব্যক্তি কোন নিষিদ্ধ কাজ করলো সে আল্লাহ্‌র বেঁধে দেওয়া সীমা অতিক্রম করলো।

 

ঈমানের অর্থ

এই হাদিসে এটি বলার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈমানকে সংজ্ঞায়িত করেছেন আন্তরিক বিশ্বাস হিসেবে – “ঈমান হল আল্লাহ্‌কে, তার ফেরেশতাদেরকে, কিতাবসমুহকে, নবী রাসুলদেরকে, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে এবং প্রত্যেক ভাল মন্দ সম্পর্কে তাকদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করা।”

এই পাঁচটি বিষয়ের উপর ঈমান আনার ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন অংশে উল্লেখ করেছেন, যেমনঃ

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّـهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ

 

“রাসুল সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে যা তার উপর তার রবের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, আর মুমিনরাও (ঈমান এনেছে); তারা সবাই ঈমান এনেছে আল্লাহ্‌র উপর, তার ফেরেশতাদের উপর, তার কিতাবসমুহের উপর, তার রাসুলদের উপর…” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :২৮৫)

وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ

“… বরং সৎ কাজ হল এই যে, মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহ্‌র উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর, আল্লাহ্‌র কিতাবের উপর, নবীদের উপর …” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :১৭৭)

الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ

“… যারা গায়ব এর প্রতি ঈমান আনে এবং সালাত কায়েম করে এবং তাদের রিযক থেকে (তাদের যা দান করা হয়েছে) (তা আমার নির্দেশিত পথে) ব্যয় করে।” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :৩)

নবী রাসুলদের উপর ঈমান আনার ফলে অপরিহার্য হয়ে পড়ে সেসব কিছুর উপর ঈমান আনা যা তারা প্রচার করতে আদিস্ট হয়েছিলেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করে ফেরেশতাদের উপর, নবী রাসুলদের উপর, কিতাবের উপর (আল কুরআন), পুনরুত্থানের উপর, তাকদিরের উপর, আল্লাহ্‌র গুণাবলীর উপর, বিচার দিবসের উপর, *আস সিরাত এর উপর, আমল পরিমাপের মাপকের উপর এবং বেহেশত ও দোযখের উপর ঈমান আনা।

[* আস সিরাতঃ এটি হল একটি সেতু যেটা প্রত্যেক ব্যক্তিকে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে পাড়ি দিতে হবে। চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম এই সেতুর নিচে দোযখের আগুন জ্বলতে থাকবে। ]

প্রত্যেক ভাল মন্দ সম্পর্কে তাকদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করাটাও ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। এটি ইবন উমার (রাঃ) এই হাদিসটির উপর ভিত্তি করে জানা যায়, যেখানে তিনি তাকদিরের বিষয়টি প্রত্যাখ্যানকারীদের ব্যাপারে বলেছেন। হাদিসটি হলঃ

ইয়াহইয়া বিন ইয়া’মুর থেকে বর্ণিতঃ “যে ব্যক্তি আল-কদরের ব্যাপারে প্রথম কথা বলেছিল সে ছিল বসরার লোক মা’বাদ আল জুহানি। আমি (ইয়াহইয়া) আর হুমাইদ বিন আব্দুর রহমান আল হিমাইরি হজ বা উমরা করার জন্য বের হয়ে পড়েছিলাম আর বললাম, ‘যদি এমনটি ঘটে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোন এক সাহাবীর সাথে আমাদের সাক্ষাত লাভ হয়, তবে আমরা তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করবো যে তারা (সাহাবীরা) তাকদিরের ব্যাপারে কি বলেন।’ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের সাথে আবদুল্লাহ বিন উমার বিন আল খাত্তাব (রাঃ) এর সাথে দেখা হয়ে গেল তিনি মাসজিদে প্রবেশ করার সময়। আমার সাথী আর আমি তার কাছে গেলাম। আমাদের মধ্যে একজন তার ডানে এবং অপরজন তার বামে দাঁড়ালো। আমি আশা করেছিলাম যে আমার সাথী আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবে। তাই আমি বললাম, ‘হে আবু আবদুর রহমান (আবদুল্লাহ বিন উমার), আমাদের দেশে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়েছে যারা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে এবং জ্ঞান অন্বেষণ করে।’ এরপর তাদের সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার পর আমি বললাম, ‘তারা দাবী করে যে আল-কদর বলতে কিছুই নেই এবং কোন কিছুই পূর্বে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয় নি।’ তিনি (আবদুল্লাহ বিন উমার) বললেন, ‘তোমার সাথে যদি সেই লোকগুলোর দেখা হয় তবে তুমি তাদের বলবে যে আমার তাদের ব্যাপারে করার কিছু নেই এবং তাদেরও আমার ব্যাপারে করার কিছু নেই।’ আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বললেন, ‘যদি তাদের (যারা আল-কদরে ঈমান আনে না) কেউ তার কাছে থাকা উহুদ পাহাড়ের সমান স্বর্ণও (আল্লাহ্‌র পথে) ব্যয় করে, আল্লাহ সেটা গ্রহণ করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আল-কদরের উপর ঈমান আনবে।’ ”  (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১/৮)

ঈমানের শ্রেণীবিভাগের মধ্যে আমলও অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّـهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ﴿٢﴾ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ ﴿٣﴾ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ

“মুমিন তো হল সেসব লোক, (যাদের) আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ করানো হলে তাদের হৃদয় কম্পিত হয়ে উঠে এবং যখন তাদের সামনে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা (সব সময়) তাদের মালিকের উপর নির্ভর করে। যারা সালাত কায়েম করে আর আমি তাদের যা কিছু (অর্থ সম্পদ) দান করেছি তা থেকে তারা (আমার পথে) খরচ করে। (মুলত) এ (গুণসম্পন্ন) লোকগুলোই হল সত্যিকারের মু্মিন, তাদের রবের কাছ তাদের জন্য রয়েছে (বিপুল) মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা (-র ব্যবস্থা)।” (সূরা আল আনফাল, ৮ :২-৪)

ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল কায়েস গোত্র থেকে আসা এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে চারটি কাজ করতে আদেশ দিচ্ছিঃ এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনবে । তুমি কি জান এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনা বলতে কি বুঝায় ? এটি বুঝায় এই ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এমন কারো অধিকার নেই যে তার ইবাদাহ করা যাবে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র রাসুল, এবং সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাদানের সিয়াম পালন করা এবং আল খুমুস (গনিমতের পাঁচ ভাগের এক অংশ যা তোমার অংশে পড়ে) এর অর্থ প্রদান করা।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৫৩; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস – ১৭/২৩)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ঈমানের রয়েছে ষাট অথবা সত্তরটির কিছু বেশী সংখ্যক শাখা, এদের মধ্যে সর্বোত্তম হল এটা ঘোষণা দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই; এবং এদের মধ্যে সবার নিচে যেটা রয়েছে সেটা হল পথ থেকে ক্ষতিকর কিছু সরিয়ে ফেলা; আর লজ্জাশীলতা হল ঈমানের একটি শাখা।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৯; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, ৩৫/৫৮)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। কোন ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় চুরিতে লিপ্ত হতে পারে না। কোন ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় মদ পানে লিপ্ত হতে পারে না।” (বুখারি – কিতাবুল মাযালিম, হাদিস ২৪৭৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৫৭/১০০)

এভাবে, এই বড় গুনাহগুলো ছেড়ে দেওয়া যদি ঈমানের কোন অংশ না হতো, যে ব্যক্তি এই পাপগুলোর কোন একটি করে, সে ব্যক্তির ব্যাপারে ‘ইমানদার’ পরিভাষাটি অস্বীকার করা হতো না। কারন ‘ইমানদার’ পরিভাষাটি অস্বীকার করা হবে না যদি না এই পরিভাষার স্তম্ভ অথবা ফরয অস্বীকার করা হয়।

 

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য হল – ঈমান হল বিশ্বাস, স্বীকারোক্তি ও অন্তর সম্পর্কিত জ্ঞান, এটি হল আল্লাহ্‌র কাছে তার দাসের নিজেকে উপস্থাপন করা, তার প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা আর তার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা। এভাবে ইসলাম হল আমল বা কাজ (অপরপক্ষে, বিশ্বাস ও জ্ঞান)।

এটি হল সেই আমল যাকে আল্লাহ কুরআনে “আদ দ্বীন” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অপরদিকে হাদিসে জিব্রাইলে দেখা যায়, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ইসলাম, ঈমান ও ইহসান কে।

এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, যদি এই দুই পরিভাষার কোন একটি পরিভাষা ব্যাবহার করা হয়, তবে অপর পরিভাষার অর্থও গৃহীত পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কিন্তু যখন একটির সাথে অপরটির তুলনা করা হয়, যেক্ষেত্রে ঈমানের সংজ্ঞা অন্তরের বিশ্বাসের একটি শ্রেণীভুক্ত এবং ইসলাম হল আমলের শ্রেণীভুক্ত; সেক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাতে দুয়া করতেন, “হে আল্লাহ, আপনি আমাদের যাকে জীবিত রাখেন, তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন এবং আমাদের যাকে মৃত্যু দেন, তাকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দিন।” (মুসনাদে আহমাদ – খণ্ড ২, হাদিস ৩৬৮; আবু দাউদ – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ৩২০১; তিরমিযি – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ১০২৩; ইবন মাজাহ – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ১৪৯৮; সবকটি হাদিসই আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে)

কারন মানুষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করতে পারে কেবল এই দুনিয়ার জীবনেই; পক্ষান্তরে, মৃত্যুর সময় অন্তরের ঈমান ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

এই পয়েন্ট থেকে নির্ভরযোগ্য আলিমরা বলেছেন, “সকল মুমিনই মুসলিম। যারা ঈমান এনেছে এবং তা অন্তরে দৃঢ়ভাবে বসিয়ে নিয়েছে, সেটা তাদেরকে দ্বীন ইসলামের আমলগুলো করতে উদ্বুদ্ধ করে।”

এটা তো সেটাই, যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “সাবধান! শরীরে এমন এক টুকরো মাংস রয়েছে তা যদি ভালভাবে সংশোধন করা হয় তবে পুরো শরীর ভাল হয়ে যাবে, কিন্তু যদি এটি বিনস্ট হয় তবে পুরো শরীরই বিনস্ট হয়ে যাবে; আর এটি হল কলব।”

এভাবে, যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইসলামের আমল অনুসরন না করে তবে অন্তর ঈমান অর্জন করবে না। তবে প্রত্যেক মুসলিমই মুমিন নয়। কারন তার ঈমান দুর্বল অথবা পূর্ণ ঈমান অর্জন করতে পারে নি তার শরীরের অঙ্গের দ্বারা ইসলামের আমলগুলো সম্পাদন করা সত্তেও। এক্ষেত্রে সে একজন মুসলিম তবে পূর্ণ ঈমান বিশিস্ট মুমিন নয়। এটি ঠিক তেমন, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন,

قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا وَلَـٰكِن قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ

 

“বেদুইনরা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। তুমি বল, ‘না, তোমরা (সঠিক অর্থে এখনও) ঈমান আনোনি, তোমরা (বরং) বল – আমরা (ইসলামে) আত্মসমর্পণ করলাম’, কারন তোমাদের অন্তরে এখনও (যথার্থ) ঈমান প্রবেশ করেনি …” (সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ :১৪)

এভাবেই, কুরআনের বেশীরভাগ সঠিক তাফসিরকারকদের মতে বেদুইনেরা পুরোপুরিভাবে মুনাফিক নয়, বরং তাদের ঈমান দুর্বল। এটি ইবন আব্বাস (রাঃ) ও অন্যান্যদের মতামত। আর এই বিষয়টি আল্লাহ্‌র এই আয়াত দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছেঃ

وَإِن تُطِيعُوا اللَّـهَ وَرَسُولَهُ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا ۚ إِنَّ اللَّـهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

“এবং তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো, তবে আল্লাহ তোমাদের কর্মফলের সামান্য পরিমাণও কমিয়ে দেবেন না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ বারবার ক্ষমাকারী ও পরম করুণাময়।” (সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ :১৪)

 

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসঃ “তার পুরষ্কারের কিছুই কমানো হবে না”

এটা স্পষ্ট হল, সেই বেদুইনদের কিছু পরিমাণ ঈমান ছিল যার কারনে তাদের আমল গ্রহণযোগ্য ছিল।

একইভাবে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সেই হাদিস – যখন সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), অমুক ব্যক্তিকে আপনি দান করলেন না কেন ? সে তো একজন মুমিন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “নাকি মুসলিম ?” … (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ২৭; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১৫০)

এই হাদিসটি ইঙ্গিত করে, সে ব্যক্তি ঈমানের লেভেলে পৌঁছায় নি। বাহ্যিকভাবে যেটা অনুসারে বিচার করা হয়েছিলো তা হল এই যে, সে ইসলামের লেভেলে ছিল।

কোনও সন্দেহ নেই যে, যখন অভ্যন্তরীণভাবে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, এর ফলে শরীরের অঙ্গ দ্বারা সংঘটিত বাহ্যিক আমলগুলো দুর্বল হতে থাকে। ফরয আমল উপেক্ষা করার মাধ্যমে কোন ব্যক্তির ঈমান বাতিল হয়ে যায়। যেমনটি এই হাদিসে বলা আছে – “ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না।” (বুখারি – কিতাবুল মাযালিম, হাদিস ২৪৭৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস – ৫৭/১০০)

 

ইহসানের অর্থ

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ইহসানের উল্লেখ করা আছে – কখনো ঈমানের সাথে ইহসান এক সাথে উল্লেখ করা আছে, আবার কোথাও ইসলাম, তাকওয়া অথবা সৎ আমলের সাথে এর উল্লেখ আছে।

ইহসান ও ঈমান একসাথে কুরআনে উল্লেখ আছে, যেমনঃ

لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوا وَّآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوا وَّآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوا وَّأَحْسَنُوا ۗ وَاللَّـهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে, (এ নিষেধাজ্ঞা জারির আগে) তারা যা কিছু খেয়েছে তার জন্য তাদের উপর কোন গুনাহ নেই, যদি তারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে (তার নিষিদ্ধ ঘোষিত আমল থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে) আর ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে, অতপর তাকওয়া অবলম্বন করে করে আর ঈমান আনে, অতঃপর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সৎ কর্ম করতে থাকে, এবং আল্লাহ মুহসিন (সৎকর্মশীল) লোকদের ভালবাসেন।” (সূরা আল মাইদাহ, ৫ :৯৩)

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا

“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে (তাদের কোন আশংকা নেই), যারা সৎ কর্ম করে আমি কখনো তাদের বিনিময় নস্ট করি না।” (সূরা আল কাহফ, ১৮ :৩০)

 

ইহসানের সাথে ইসলামের উল্লেখ রয়েছে এমন কিছু আয়াতঃ

بَلَىٰ مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّـهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِندَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

“যে ব্যক্তিই (আল্লাহ্‌র সামনে) নিজের সত্তাকে সমর্পণ করে দিবে এবং সে হবে অবশ্যই একজন মুহসিন ব্যক্তি, তার জন্য তার রবের কাছে (এর) বিনিময় আছে, তাদের কোন ভয় নেই আর না তারা (সেদিন) চিন্তিতও হবে।” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :১১২)

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّـهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ ۗ وَإِلَى اللَّـهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

“যদি কোন মুহসিন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে (সম্পূর্ণ) সমর্পণ করে দেয়, সে (এর দ্বারা) একটি মযবুত হাতল ধরলো, আর যাবতীয় কাজকর্মের চূড়ান্ত পরিণাম আল্লাহ্‌র কাছে।” (সূরা লুকমান, ৩১ :২২)

 

ইহসানের সাথে তাকওয়ার উল্লেখ রয়েছেঃ

إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوا وَّالَّذِينَ هُم مُّحْسِنُونَ

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা মুহসিন।” (সূরা নাহল, ১৬ :১২৮)

 

ইহসানকে এককভাবেও কুরআনে উল্লেখ করা আছেঃ

لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ

 

“যারা সৎ কর্ম করেছে তাদের জন্য থাকবে উত্তম পুরস্কার (জান্নাত) এবং এর থেকেও বেশী (অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখার এক বিরাট সম্মান)।” (সূরা ইউনুস, ১০ :২৬)

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরোক্ত আয়াতের “এর থেকেও বেশী” – এর তাফসীর করেছেন যে, এটা দ্বারা বুঝানো হচ্ছে জান্নাতে আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখতে পাওয়া। (এই হাদিসটি রয়েছে এখানে – মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, ১৮১/২৯৮; মুসনাদে আহমাদ – ৪/৩৩২,৩৩৩)

আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখার এই মর্যাদা পাবে মুহসিন ব্যক্তিরা। এই বিরাট সম্মানজনক পুরষ্কারের কারন হল, ইহসান হল মুমিন বান্দার তার রবের প্রতি এমন এক ইবাদাত যেন তার রব তার সামনেই উপস্থিত আছেন। সে তার রবকে ভয় করে এমনভাবে যেন সে রবকে তার অন্তর দিয়ে দেখছে এবং ইবাদাত করার সময় সে তাকে দেখছে। তাই পরকালে তার পুরস্কার হবে তার নিজ চোখে সত্যিকার অর্থেই আল্লাহ্‌কে দেখতে পাওয়া। এটি বুঝা যায় কুরআনের সেই আয়াত থেকে, যেখানে আল্লাহ পরকালে অবিশ্বাসীদের জন্য তার প্রতিদানের কথা উল্লেখ করেছেন,

 

كَلَّا إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ

“নিঃসন্দেহে পাপী ব্যক্তিদেরকে তাদের রবকে দেখা থেকে আড়াল করে রাখা হবে।” (সূরা আল মুতাফফিফিন, ৮৩ : ১৫)

আল্লাহ পাপী ব্যক্তিদের এই বিনিময় দিবেন দুনিয়াতে তাদের অবস্থার কারনে (তাদের অন্তরে জমিয়ে রাখা পাপ ও অসৎ কাজ, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্‌কে জানা ও ভয় করা থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখে)। তাই পরকালে আল্লাহ্‌র কাছে এর প্রতিদান হল পরকালেও তাদের পর্দা টেনে দেওয়া, যাতে তারা তখনও আল্লাহ্‌কে দেখতে না পারে।

ইহসানের ব্যাখ্যার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস – “ইহসান হল এটি যে, তুমি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ ……” – এটি ইঙ্গিত করে, বান্দা আল্লাহ্‌র ইবাদাত করবে, তার নৈকট্য খুঁজবে এবং মনে করবে যে সে আল্লাহ্‌র হাতের মধ্যে রয়েছে যেন সে আল্লাহ্‌কে দেখতে পাচ্ছে। এর ফলে সৃষ্টি হয় তাকওয়া, তার প্রতি সশ্রদ্ধ ভয় এবং এতে তার নিকট পদমর্যাদার উন্নতি ঘটে; এছাড়াও ইবাদাতে শুদ্ধতা আর কর্ম প্রচেষ্টার উদ্যমের উন্নতি ঘটে এবং আরও নির্ভুল হয়।

 

“যদি তুমি মনে করো যে তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ না, তবে জেনে রাখো তিনি তোমাকে দেখছেন”

বলা হয় যে হাদিসের এ অংশটুকু এর প্রথম অংশের (“তুমি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ”) কারন।

যখন আদেশ দেওয়া হল, তখন আল্লাহ্‌র বান্দা তার ইবাদাত করার ক্ষেত্রে তাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারে এবং যতক্ষন পর্যন্ত না তাকে দেখতে পাচ্ছে ততক্ষন তার নিকটে অবস্থানের অনুভূতি – এসব ক্ষেত্রে কাঠিন্যতার মুখোমুখি হতে পারে।

তাই সে এভাবে তার ঈমান অবলম্বন করবে যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন এবং তিনি তার গোপন বিষয় ও নিয়্যত সম্পর্কে জানেন, তিনি জানেন তার গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় এবং তার কোন কিছুই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে গোপন নয়। সে যদি এই ধাপ অর্জন করতে পারে, তবে তার জন্য দ্বিতীয় ধাপে চলে যাওয়া সহজ হবে, যেটা হল আল্লাহ্‌র সাহায্য ও তার নৈকট্যের ব্যাপারে সবসময়ই দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত থাকা, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে যেন আল্লাহ্‌কে দেখতে পেলো।

অন্যান্য আলিমরা বলেছেন, “বরং এটি আল্লাহ’র ইবাদাতে কাঠিন্যতা পাওয়া ব্যক্তির প্রতি নির্দেশনা – আল্লাহ তাকে দেখছেন এটা জেনে এমনভাবে ইবাদাত করা যেন সে আল্লাহ্‌কে দেখছে।”

এই জ্ঞানের কারনে আল্লাহ্‌র দৃষ্টির সামনে তার লজ্জাশীলতা অনুভূত হবে, যেমনটি বলেছেন কিছু আলিম, “আল্লাহ্‌কে ভয় করুন, যাতে তিনি যেন তাদের মধ্যে ন্যূনতম একজন না হয়ে যান, যিনি আপনাকে দেখছেন (যারা আপনাকে দেখছে তাদের কাছ থেকে আপনার লজ্জাশীলতার ব্যাপারটি বিবেচনা করো)।”

আবার কিছু আলেম বলেছেন, “আপনাদের উপর আল্লাহ্‌র ক্ষমতার পরিমানের ব্যাপারে ভয় করুন এবং আপনাদের সাথে আল্লাহ্‌র নৈকট্যের পরিমানের ব্যাপারে তার সামনে লজ্জাশীল থাকুন।”

আমাদের পূর্ববর্তী ধার্মিক ব্যক্তিগনের (সালাফদের) মধ্য থেকে কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন, “যে ব্যক্তি কাজ করার সময় আল্লাহ্‌কে (অন্তর দিয়ে) দেখে, সে তাদের মধ্যে একজন যে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত আছে; আর আল্লাহ দেখছে এটা জেনে যে ব্যক্তি কাজ করে, সে মুখলিস (একনিষ্ঠ) ব্যক্তিদের একজন।”

শেষের এই বিবৃতিতে দুই পদমর্যাদার উল্লেখ আছে যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিলঃ

(১) ইখলাসের অবস্থা :ইখলাস হল আল্লাহ্‌র পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারটি অন্তরের ভিতর ও বাইরে উপস্থিত রেখে আল্লাহ্‌কে দেখার ইচ্ছা আর তার নিকটস্থ হওয়ার লক্ষ্যে বান্দা কতৃক আমল। বান্দা যখন তার আমলের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র পর্যবেক্ষণ কামনা করে আর এর শেষ পর্যন্ত কাজ করে যেতে থাকে, তখন সে সত্যিই মুখলেস বান্দা হয়ে যায়, যে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য আমল করে থাকে। কারন সে তার আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি খুঁজে, যা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কিছুকে সন্তুষ্টি করা থেকে তাকে ফিরিয়ে রাখে।

(২) আল্লাহ্‌কে দেখার ব্যাপারে অবস্থা :এটা হল বান্দা কতৃক সংগ্রাম করা, যা ভিত্তি করে সেটার উপর, যেটার কারনে অন্তর আল্লাহ্‌কে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে ও আল্লাহ্‌র দিকে মুখ করে এবং যেটা অন্তরকে ঈমানের আলোয় আলোকিত করে। অন্তর্দৃষ্টি জ্ঞানের ভিতর প্রবেশ করে যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি চোখের ন্যায় হয়ে পড়ে। এটি হল ইহসানের অবস্থার বাস্তবতা,যা হাদিসে জিব্রাইলে উল্লেখ করা আছে। আর এই অবস্থার ব্যক্তিরা তাদের অন্তর্দৃষ্টির প্রবলতা অনুযায়ী জাগরিত হয়।

কুরআনের বিভিন্ন অংশে এই অর্থগুলো নির্দেশ করা হয়েছেঃ

وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

“…… এবং তিনি তোমাদের সাথেই আছেন (তার জ্ঞানের মাধ্যমে), তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ তার সব কিছুই দেখছেন।” (সূরা আল হাদিদ, ৫৭ :৪)

 

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّـهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ مَا يَكُونُ مِن نَّجْوَىٰ ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَىٰ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

“কখনো এমন হয় না যে, তিন ব্যক্তির মধ্যে কোন গোপন সলাপরামর্শ হয় এবং (সেখানে) ‘চতুর্থ’ হিসেবে আল্লাহ উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ জনের মধ্যে ‘ষষ্ঠ’ হিসেবে সেখানে থাকেন না, (এ সলাপরামর্শকারীদের সংখ্যা) তার চেয়ে কম হোক কিংবা বেশী, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, আল্লাহ সবসময়ই তাদের সাথে আছেন, অতঃপর কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সবাইকে বলে দিবেন তারা কি কাজ করে এসেছে; আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন।” (সূরা আল মুজাদিলাহ, ৫৮ :৭)

 

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِن قُرْآنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ ۚ وَمَا يَعْزُبُ عَن رَّبِّكَ مِن مِّثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ

“(হে নবী,) তুমি যে কাজেই থাকো না কেন এবং সে (কাজ) সম্পর্কে কুরআন থেকে যা কিছু তিলাওয়াত করো না কেন (তা আমি জানি, হে মানুষেরা), তোমরা যে কোন কাজ করো, কোনও কাজে তোমরা যখন প্রবৃত্ত হও, আমি তার ব্যাপারে তোমাদের উপর সাক্ষী হয়ে থাকি, তোমাদের মালিকের (দৃষ্টি) থেকে একটি অনু পরিমাণ জিনিষও গোপন থাকে না, আসমান ও জমিনে এর চাইতে ছোট কিংবা এর চাইতে বড় কোন কিছুই নেই যা এ সুস্পস্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ নেই।” (সূরা ইউনুস, ১০ :৬১)

وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

“…… আমি তার ঘাড়ের রগ থেকেও তার অনেক কাছে থাকি (আমার জ্ঞানের মাধ্যমে)।” (সূরা কাফ, ৫০ :১৬)

يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّـهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَىٰ مِنَ الْقَوْلِ ۚ وَكَانَ اللَّـهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا

“… কিন্তু তারা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে (নিজেদের অপরাধ) লুকোতে পারবে না …… তিনি তাদের সাথে আছেন (তার জ্ঞানের মাধ্যমে)।” (সূরা আন নিসা, ৪ :১০৮)

নির্ভরযোগ্য হাদিসে মুসলিমদেরকে ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য চাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসঃ

“তোমাদের মধ্যে যে কেউই সালাতে দাঁড়ায়, সে তার রবের সাথে গোপনে কথা বলে অথবা তার রব থাকে তার আর কিবলা উভয়ের মাঝে।” (বুখারি – কিতাবুস সালাহ, হাদিস – ৪০৫; মুসলিম – কিতাবুল মাসাজিদ, ৫৪/৫৫১)

এছাড়াও এটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অপর হাদিসেও পাওয়া যায়ঃ

“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তার সামনে থাকেন।” (বুখারি – কিতাবুস সালাহ, হাদিস – ৪০৬; মুসলিম – কিতাবুল মাসাজিদ, ৫০/৫৪৭)

যারা উচ্চস্বরে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে তাদের ব্যাপারে একই অর্থ প্রকাশ করে এমন আরেক হাদিসঃ

“তোমরা এমন কারো ইবাদাত করছো না যিনি বধির বা অনুপস্থিত। নিঃসন্দেহে তোমরা যাকে ডাকছো তিনি সবই শুনেন এবং তোমাদের কাছেই আছেন আর তোমাদের সাথেই আছেন।” (বুখারি – কিতাবুল কদর, হাদিস ৬৬১০; মুসলিম – কিতাবুজ জিকর ওয়াদ দু’য়া, ৪৪/২৪০৭)

আরেক বর্ণনায় আছেঃ

“তোমার ঘাড় থেকে মাথা যতখানি নিকটবর্তী, তিনি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তির প্রতি তার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী।”

এবং আরেকটি বর্ণনা হলঃ

“তিনি তোমাদের ঘাড়ের শিরার থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” (মুসলিম – কিতাবুয যিকর ওয়াদ দু’আ, ৪৬/২৭০৪)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেন, “আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে থাকে আমি বান্দার সে ধারনার নিকটেই আছি। অর্থাৎ সে ধারণা অনুযায়ী ফল দিয়ে থাকি। এবং বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথেই থাকি। বান্দা যদি আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে তবে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি আর সে যদি কোন জনসমষ্টি নিয়ে স্মরণ করে তবে আমিও বিশেষ দল নিয়ে স্মরণ করি যা তাদের জনসমষ্টি থেকে উত্তম। বান্দা যখন আমার নিকট এক বিঘত নিকটবর্তী হয় তখন আমি তার নিকট একহাত নিকটবর্তী হই। আর সে একহাত অগ্রসর হলে আমি দুই হাত অগ্রসর হই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে তবে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” (বুখারি – কিতাবুত তাওহীদ, হাদিস ৭৪০৫; মুসলিম – কিতাবুজ জিকর ওয়াদ দু’আ, ২১/২৬৭৫)

যে ব্যক্তি বুঝে নিবে যে এই হাদিসটি নাস্তিকতা, অবতারত্ব অথবা আল্লাহ ও তার সৃষ্টিকে একত্রীকরণ করাকে নির্দেশ করে, এটা তার অজ্ঞতা এবং আল্লাহ্‌ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বুঝার ত্রুটি থেকে তার এই অনুমান উদ্ভুত হবে।

নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব আনুমানিক ব্যাপার থেকে মুক্ত, আর মহান আল্লাহ্‌ তার সৃষ্টির কোন কিছুর মতো নয় (অদ্বিতীয়), তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।

 

কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে ?

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিব্রাইল জিজ্ঞেস করেছিলেন কিয়ামতের সময় সম্পর্কে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জবাব দিয়েছিলেন, “জিজ্ঞাসাকৃত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারীর অপেক্ষা বেশী জানেন না।”

এর অর্থ হল কেয়ামতের দিনকাল সম্পর্কে সকল সৃষ্টির জ্ঞানই সমান (অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কেউই এ ব্যাপারে জানে না)।

এটি একটি নিদর্শন যে একমাত্র আল্লাহই এই জ্ঞানের অধিকারী, যেমনটি আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এমন পাঁচটি বিষয় আছে যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানেন না,” এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ

 

إِنَّ اللَّـهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ

“নিঃসন্দেহে একমাত্র আল্লাহ্‌রই রয়েছে কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান” (সূরা লুকমান, ৩১ : ৩৪)

আল্লাহ বলেছেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي ۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ۚثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً

 

“তারা তোমার কাছে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, এ দিনটি কখন সংঘটিত হবে; তুমি (তাদের) বল, এ জ্ঞান তো (রয়েছে কেবল) আমার রবের কাছে, এর সময় আসার আগে তিনি তা প্রকাশ করবেন না, (তবে) আকাশমণ্ডল ও জমিনের জন্য সেদিন তা হবে একটি ভয়াবহ ঘটনা; এটি তোমাদের কাছে আকস্মিকভাবে আসবে …” (সূরা আল আ’রাফ, ৭ : ১৮৭)

ইবন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “গায়বের চাবি পাঁচটি যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না”, এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন – “নিঃসন্দেহে একমাত্র আল্লাহ্‌রই রয়েছে কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান, তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন ……” {সূরা লুকমান, ৩১ : ৩৪}

(বুখারি – কিতাবুত তাফসীর, হাদিস ৪৭৭৮)

 

কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ

হাদিসটিতে জিব্রাইল যা জিজ্ঞেস করেছিলেন – “আমাকে কিয়ামতের কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন” – দ্বারা বুঝানো হচ্ছে কিয়ামত আবির্ভাবের নিদর্শন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দুটি নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেনঃ

 

প্রথম নিদর্শনঃ দাসী তার কত্রী (অথবা কর্তা) কে জন্ম দিবে

“তার কত্রী” বলতে বুঝানো হচ্ছে দাসীর মালিককে। আবু হুরাইরা (রাঃ) এর হাদিসে বলা আছে “তার কর্তা”।

এটি একটি নিদর্শন যা ইঙ্গিত দেয় অনেক দেশ উদ্ভুত হওয়ার আর প্রচুর পরিমাণ দাস পাওয়ার, যতক্ষণ না পর্যন্ত বন্দীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের সন্তানও একইভাবে বৃদ্ধি পায়, যাতে করে বন্দী নারীরা তাদের মালিকের দাসে পরিনত হয় এবং তার সন্তানেরা তার মালিকের অবস্থানে, কারন মালিকের সন্তানের অবস্থান আর মালিকের অবস্থান একই, দাসীদের সন্তান তার মালিকের অবস্থানে পৌঁছে যায়।

বলা হয় যে, দাসী পাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন মেয়েকে দাস বানানো হবে এবং অতঃপর মুক্ত করে দেওয়া হবে, এরপর মাকে দাস বানানো হবে এবং মেয়েটি তাকে কিনে নিবে এবং তাকে ব্যবহার করবে এটা না জেনে যে সে-ই তার মা। এটি ইসলামের বিভিন্ন যুগে ঘটেছিল।

এটাও বলা হয় যে দাসিরা তাদের রাজাদেরকে জন্ম দিবে।

 

দ্বিতীয় নিদর্শনঃ আপনি দেখবেন যে নগ্নপদবিশিস্ট , নিঃস্ব……….

নিঃস্ব (আল ‘আলাহ) অর্থ হল নিঃস্ব ও দরিদ্র, যেমনটি আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ

وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَىٰ

“তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পেয়েছেন অতঃপর সমৃদ্ধ করে দিয়েছেন” (সূরা আদ দুহা, ৯৩ :৮)

“ছাগলের রাখালেরা একে অপরের সাথে বিশাল বিশাল ভবন তৈরিতে প্রতিযোগিতা করবে।” – এর অর্থ পাওয়া যায় উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে। এর অর্থ হল সমাজের নিচু শ্রেণীর লোকেরা তাদের নেতা ও শাসকে পরিণত হবে এবং তাদের সম্পদ বাড়তে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ভবনের উচ্চতা, ডিজাইন ও পরিপূর্ণতা/উৎকর্ষতা নিয়ে নিজেদের ব্যাপারে অহংকার করবে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনটি নিদর্শনের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে একটি হল, “যখন আপনি দেখবেন নগ্নপদ বিশিষ্ট লোকেরা জনগনের নেতা হবে এবং যখন কালো উটের রাখালেরা গর্ব/অহংকার আর একে অপরের সাথে সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা শুরু করবে।”

এভাবে, কিয়ামতের নিদর্শনসমুহের মধ্যে একটি নিদর্শন পাওয়া গেল যে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের ছাড়া অন্যদের (অযোগ্য) হাতে সমাজের দায়িত্ব অর্পিত হবে; যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই ব্যক্তিকে বলেছিলেন, যে ব্যক্তি কিয়ামত সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল -“যোগ্য ব্যক্তি ছাড়া যদি অন্য কারো হাতে দায়িত্ব চলে যায়, তবে কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করো।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ৫৯)

এভাবে, যদি নগ্নপদ বিশিস্ট রাখালেরা (যারা অজ্ঞ আর কর্কশ হিসেবে পরিচিত) সমাজের নেতা হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে যায়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের সুদীর্ঘ ভবন তৈরি সম্পন্ন হয়, এর ফলে দ্বীন ইসলামের নিয়মশৃঙ্খলা ও জীবন হয়ে পড়বে বিকৃত। কারন, যদি সমাজের লোকদের নেতা নিঃস্ব ও দরিদ্র লোকদের মধ্য থেকে হয় এবং এরপর লোকজনের নেতা হয়, হোক তার কতৃত্ব ব্যাপক অথবা সর্বনিন্মস্থ, তবে এটি বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব যে সেই ব্যক্তি মানুষজনের অধিকার আদায় করবে, বরং সে নিজের জন্য সম্পদ বেদখল করবে এবং জনগনের সম্পদ দখল করে নিবে।

পূর্বের কিছু ধার্মিক ব্যক্তিগন (সালাফ) বলেছেন, “ড্রাগনের মুখের দিকে তোমার হাত প্রসারিত করা এর থেকেও উত্তম যে তুমি সম্পদশালী ব্যক্তির হাতের দিকে তোমার হাত প্রসারিত করবে, কারন ড্রাগন তোমার হাত খাবলিয়ে ছিড়ে নিবে  কিন্তু সেই সম্পদশালী ব্যক্তি তোমাকে গরীব করে ছাড়বে।”

এছাড়াও, যদি সে অজ্ঞ আর রুক্ষ হয়ে থাকে, তাহলে এভাবে দ্বীন ইসলাম বিকৃত হয়ে যাবে কারন তার কাছে দ্বীনের উন্নতির বা শিক্ষার কোন গুরুত্তই নেই। বরং সে অগ্রাধিকার দেয় সম্পদ সংগ্রহ ও একত্র করাকে। সে এই ব্যাপারে কোন তোয়াক্কাই করে না যে দ্বীনের বিষয়সমূহের কি কি বিকৃত হচ্ছে,আর না সে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখে যাদের এই সিস্টেমের কারনে সর্বনাশ হচ্ছে।

যখন সমাজের নেতা ও প্রধানরা এই অবস্থায় পৌঁছায়, তখন পুরো সমাজটাই উল্টে যায়। মিথ্যুকদের বিশ্বাস করা হয় আর সত্যবাদীদের মিথ্যুক বলে অভিহিত করা হয়, বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস করা হয় আর বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, অজ্ঞরা কথা বলে অথচ আলেমরা চুপ থাকে অথবা সেখানে একদম কেউই থাকে না। যেমনটি জানা যায় একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “নিঃসন্দেহে কিয়ামতের নিদর্শন সমুহের একটি হল যে জ্ঞানকে তুলে নেওয়া হবে এবং অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ৮০,৮১; মুসলিম – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭১)

এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান তুলে নেন না। তিনি জ্ঞানীদের তুলে নেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান তুলে নেন, যাতে করে যখন তিনি সকল অজ্ঞ ব্যক্তিদের ছেড়ে দেন,মানুষ তখন সেই অজ্ঞ লোকদের কাছে যায় যারা তাদের নেতা; এরপর লোকেরা দ্বীনের কোন ফয়সালা জানতে চায় এবং সেই অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে কোন জ্ঞান ছাড়াই উত্তর প্রদান করে, এতে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্য লোকদেরও পথভ্রষ্ট করে।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ১০০; মুসলিম – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭৩)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসের অংশ – “সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করবে” – হল তাদের গর্ব ও অহংকারের প্রমাণ, বিশেষ করে ভবন এর উচ্চতা সম্পর্কে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তার সাহাবীদের সময়ে সুদীর্ঘ ভবন পরিচিত ছিল না। বরং তাদের ঘর ছিল তাদের চাহিদা অনুযায়ী নিচু।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “ততক্ষন পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত লোকেরা সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে।”

আল হাসান থেকে হারিস বিন আস সা’ইব বর্ণনা করেন, “আমি উসমান (রাঃ) এর খিলাফাহ চলাকালীন সময়টাতে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের ঘরে প্রবেশ করেছিলাম, এবং আমি আমার হাত দিয়ে ঘরের ছাদ স্পর্শ করতে পারছিলাম।”

উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে তিনি লিখেছিলেন, “তোমাদের ভবনগুলো উঁচু করবে না কারন নিশ্চয়ই এটি মন্দ কাজ।”

এবং আম্মার বিন আবু আম্মার থেকে বর্ণিত, “কোন ব্যক্তি যদি তার ঘরের উচ্চতা সাত হাতের উপর নিয়ে যায়, এটা তাকে সাথে সাথে বলে, ‘হে পাপীদের মধ্যে পাপিষ্ঠ ব্যক্তি, কোথায় তুমি তোমার ঘর নির্মাণ করছ ?’ ”

 

ইমাম ইবন রজবের প্রসিদ্ধ হাদিস তাফসীর কিতাব জামি’ আল ‘উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে অনুবাদকৃত