Close

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দারসুল হাদীস: হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: 
হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

আরবী ইবারতঃ

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ابْن سَمُرَةَ (رض) قَالَ قَالَ لِي رَسُوْلُ اللَّهِ (صلعم) لَا تَسْئل الْإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا عَنْ مُسْئَلَةٍ وكُلَتْ إِلَيْهَا وَإِنْ أَعْطِيتَهَا عَنْ غَيْر مَسْئَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا. (بخاری، مسلم)

বাংলা অনুবাদঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) আমাকে বললেন : তুমি নেতৃত্বের পদপ্রার্থী হবে না । কারণ, তুমি যদি তা চেয়ে নাও তবে তোমাকে ঐ পদের বোঝা দেয়া হবে (দায়িত্ব পালনে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না)। আর যদি প্ৰাৰ্থনা ছাড়াই তোমাকে ঐ পদ দেয়া হয়, তবে তুমি ঐ পদের দায়িত্ব পালনে (আল্লাহর) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারী, মুসলিম)


শব্দার্থঃ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ ابْنِ سَمُرَةَ (رض) : হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। قَالَ : সে বলল। لِي : আমাকে । لَا تَسْئل : তুমি চেয়ে নেবে না। الْإِمَارَةَ : নেতৃত্ব। فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا : নিশ্চয়ই তোমাকে উহা দেয়া হবে। عَنْ مَّسْئَلَةٍ : তুমি চাওয়ার কারণে । وَكَلَتْ إِلَيْهَا : তোমাকে ঐ পদের বোঝা চাপানো হবে। غَيْر مَسْئَلَةٍ : প্রার্থনা ব্যতীত। ُعِنْتَ عَلَيْهَا : তাতে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে ।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদ' আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত সিহাহ সিত্তা' বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয় । এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহ্ আল-বুখারী'।
☆সহীহ্ আল-বুখারী: 
ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু’ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন । তিনি নিজেই বলেন : “তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী ।
☆সহীহ্ আল-মুসলিম:
সহীহ্ আল-মুসলিম গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ইমাম মুসলিম (র), যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুরে ২০৪ হিজরী ২৪শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ২১৮ হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি হিজায, ইরাক, মিশর, বাগদাদ, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম জাহানের ইলম শিক্ষার কেন্দ্রভূমিসমূহে ভ্রমণ করেন। তিনি সে কালের জ্ঞানসাগর ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ইমাম মুসলিম (র) সরাসরি ওস্তাদগণের থেকে শ্রুত তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে (তাহযীবুল আসমা ১০ম খণ্ড) দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা ও গবেষণা করে এ শ্রেষ্ঠ গ্রন্থখানি সংকলন করেন । এতে তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০ । তাকরার বাদে হাদীস সংখ্যা ৪,০০০ মাত্র। (তাদরীবুর রাবী) সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থকে বিশুদ্ধ ও অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ প্রায় বার শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সহীহ্ মুসলিমের সমমানের কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি।
বুখারী ও মুসলিম শরীফকে একত্রে ‘সহীহাইন’ বলা হয়।

রাবী পরিচিতিঃ

হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা)। নাম : আবদুর রহমান । পিতার নাম : সামুরা। নসবনামা : আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীব ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কুসাই । কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল আবদুল কাবা । ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা) তার নাম রাখেন আবদুর রহমান । তিনি ছিলেন একজন আরব সেনাপতি । ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। খলীফা উসমানের (রা) খিলাফতকালের পরবর্তী বছরগুলোতে সিজিস্তানে সর্বপ্রথম সেনাপতিরূপে নিযুক্ত হন। তিনি দক্ষতার সাথে যারাজ ও যামীন-ই দাওয়ার জয় করেন এবং কিরমান এর শাসনকর্তার সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁকে সিজিস্তানের শাসনভার অর্পণ করা হয় । আমীর মুয়াবিয়া (রা) যিয়াদকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করার পর আবদুর রহমান ইবনে সামুরাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করেন। তিনি ফিরে আসেন এবং ৬৭০ সালে বসরায় ইনতিকাল করেন । পরবর্তীকালে তার বংশধরগণ বসরায় একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গোত্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । (আল-বালাযুরী ফুতহুল বুলদান )

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কারণ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার মত খারাপ প্রবণতা লোভ থেকে সৃষ্টি হয়। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যেই রাসূল (সা) বলেছেন, নেতৃত্ব চেয়ে নিলে তাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়া যায় না। আর আল্লাহর রহমত ও সাহায্য ছাড়া কোন কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । সাধারণ কাজের চেয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব বেশী কঠিন। প্রার্থনা ব্যতীত যে নেতৃত্ব লাভ হয়, তাতে আল্লাহর রহমত থাকে । সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালা এই নেতাকে সাহায্য করেন, ফলে সহজেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (সা) পদপ্রার্থীদেরকে কোন পদের উপযুক্ত মনে করতেন না এবং তাদেরকে সে পদে অধিষ্ঠিত করতেন না। এ সত্যতা আমরা নাসায়ী শরীফের একটি হাদীসে দেখতে পাই যা হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-এর নিকট আগমন করি, আমার সাথে আশয়ারী গোত্রের দু'ব্যক্তি ছিলেন। তারা রাসূলের (সা)-এর নিকট রাষ্ট্রীয় পদে চাকুরী প্রার্থনা করেন, কিন্তু রাসূল (সা) তাদেরকে বলে দেন, যারা নিজেরা রাষ্ট্রীয় পদের নেতৃত্ব চায় তাদেরকে আমরা নেতৃত্ব দেই না বা নেতৃত্ব লাভে সাহায্যও করি না । অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে ইয়ামেনে গভর্নর করে পাঠালেন অপর আর একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেন :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) تَجِدُونَ مِنْ خَيْرٍ النَّاسِ أَشَدُّهُمْ كَرَاهِيَةً لِهَذَا الْأمْر حَتَّى يَقَعَ فِيْهِ. (بخاری، مسلم)
“হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন : “যারা পদকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে । অতঃপর যখন তাতে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তোমরা তাদেরকে সর্বোত্তম লোক হিসেবে পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)

ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের পরিবর্তনঃ

প্রত্যেক মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর তাদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা ফরয। এ প্রসঙ্গে ইমাম জুরযানী বলেন :
أَنْ نَصَبَ الْإِمَامِ مِنْ آتِمِّ مَصَالِحِ الْمُسْلِمِينَ وَاعْظَمِ مَقَاصِدِ الدِّينِ. “ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের পূর্ণতম ব্যবস্থা এবং দীন ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে সর্বাধিক মাত্রায় বাস্তবায়ন।”

আকাইদে নাসাফী গ্রন্থকার বলেন :
“মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য একজন ইমাম অবশ্যই থাকতে হবে। ইহা অপরিহার্য। তিনি আইন কানুনসমূহ কার্যকর করবেন, শরীয়ত নির্দিষ্ট হৃদ জারি করবেন, বিপদ-আপদের সকল দিক বন্ধ করবেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বন্ধের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত ও সদা প্রস্তুত করে রাখবেন। যাকাত গ্রহণ ও বণ্টন করবেন, বিদ্রোহী, দুষ্কৃতিকারী, চোর, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের কঠিন শাসন ও দমন করবেন। জুম'আ ও ঈদের সালাতসমূহ কায়েম করবেন, লোকদের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করবেন। মানুষের অধিকার প্রমাণের জন্য (বিচার ব্যবস্থা চালু করবেন সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন দুর্বল, অক্ষম বালক- বালিকাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। (আকাঈদে নাসাফীঃ ৩৩৮ পৃঃ)

অসৎ নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা ।
هِيَ خِلافَةُ الرَّسُوْل فِي إِقَامَةِ الدِّيْنِ.
“নেতৃত্ব হলো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারিত্ব।” (কিতাবুল মাওয়াকিফ)
আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা, উহার প্রচার ও প্রসার এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাই সমাজের লোকদেরকে সুসংগঠিত হয়ে অসৎ ও খোদা বিমুখ লোকদের নেতৃত্বকে উৎখাত করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে ঈমানদার, খোদাভীরু ও যোগ্য লোকদের হাতে সে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। যখন সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তখন তোমাদেরকে আল্লাহর দীনের উপর অটল থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী :
فَاصْبِرْ لِحُكُم رَبِّكَ وَلاَ تُطِعْ مِنْهُمْ اثِمًا أَوْكَفُورًا. 
“অতঃপর তোমার প্রভুর হুকুম, নির্দেশ ও কর্তৃত্বের উপর অটল, অবিচল হয়ে থাকো, আর তাদের কোন এক একজন পাপিষ্ঠ অবিশ্বাসীর আনুগত্য ও করো না । (সূরা-আদ্-দাহার : ২৪)

اِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْآمَنَتِ إِلَى أَهْلِهَا.
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সূরা-আন্ নিসা : ৫৮)

এ আয়াতের তাফসীরে মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) বলেন : রাষ্ট্রীয় যত পদ ও মর্যাদা আছে, সবই আল্লাহর আমানত । এসব পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা আমানতদার। রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের জন্যে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করা অবশ্য কর্তব্য। রাষ্টীয় পদের সাথে জনগণের অধিকার জড়িত, তাই সেটাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। এসব আমানতের অধিকারী সেসব লোক যারা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সমর্থনের দিক থেকে সর্বোত্তম, আর বিশ্বস্ততা ও রাষ্ট্রীয় আমানত রক্ষার দিক থেকে অগ্রগণ্য । এদের ছাড়া কাউকে রাষ্ট্রীয় আমানত অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।” (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট)

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র) বলেন : “বনি ঈসরাঈল সম্প্রদায়ের একটি বড় অপরাধ ছিল তারা তাদের পতনের যুগে দায়িত্বপূর্ণ পদ অযোগ্য, অসৎ, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খিয়ানতকারী ও ব্যভিচারী লোকদের হাতে অর্পণ করেছিল। আর এসব অসৎ নেতৃত্বের কারণে গোটা জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল । (সংক্ষিপ্ত)

অথচ আল্লাহর আদেশ হচ্ছে, “এমন লোকের (নেতৃত্ব) আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে এবং যার কার্যক্রম উগ্র ও উদাসীন।” (সূরা আল-কাহাফ ২৮)

এ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যোগ্য লোকদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা ফরয। আর এ জন্যই অসৎ নেতৃত্ব উৎখাত করে, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়া অপরিহার্য।

অনৈসলামিক রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচনঃ

যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কোন ইসলামী দল দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ভোট প্রার্থনা করলে তা জায়েয ৷ কারণ, ইহা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অংশ বিশেষ । আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য যখন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে করলে তাতে কোন দোষ নেই । তাছাড়া জনগণের সামনে না আসলে কি করে সৎ ও অসৎ নেতৃত্বের পার্থক্য বুঝতে পারবে । আল্লাহর বাণী : “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে শক্ত হয়ে দাড়াও, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে দাড়াও।” (সূরা-নিসা : ১৩৫) “হযরত ইউসুফ (আ) বললেন, আমাকে দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল বানিয়ে দাও, আমি অধিক সংরক্ষণকারী ও বিষয়টি সম্পর্কে আমি অধিক অবহিত। (সূরা ইউসুফ : ৫৫)

ইহা এক প্রকার জিহাদ যাকে ভোটের জিহাদ বা ভোট যুদ্ধ বলে । এ জিহাদে প্রার্থী হয়ে এবং ভোট দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে । যার উদ্দেশ্য হবে- !
مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةَ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيْلِ اللهِ.
“যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে।” (বুখারী)
কুরআন হাদীসের এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া একান্ত জরুরী। রাসূল (সা) মদীনায় রাষ্ট্র প্রধান হওয়ায় এবং দেশের সকল কর্তৃত্ব তাঁর হাতে থাকায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। আর খুলাফায়ে রাশেদা ও তাঁর পদাংক অনুসরণ করেন ।

নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাঃ

যে কোন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দেশ পরিচালনা কিংবা আইন প্রবর্তনের জন্যে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা হলে আল্লাহ তা'য়ালার আইন বাস্তবায়ন ও রাসূল (সা)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু ও আমানতদার লোকদেরকে নির্বাচিত করার জন্য ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। যদিও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় তথাপি মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতিকে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট, মুফতী মুহাম্মদ শফী র.)

ইসলামী দলে নেতা নির্বাচনঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজেকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার কারো নেই। সেভাবেই ইসলামী দলেও কোন পদের জন্য প্রার্থী হওয়া যায় না। কিন্তু পদের জন্য অন্য কোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা জায়েয। তাতে নিজের লোভের কোন প্রকাশ থাকে না। ব্যক্তির নিজের প্রার্থী হওয়ার অর্থ হলো নিজেকে বড় মনে করা, যা ইসলামে না জায়েয। কিন্তু দলের পক্ষ হতে ইসলামী সংগঠনের নেতাকে ঐ গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের কর্মীগণ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সে দায়িত্ব পালন করা ফরয। ইসলামী দল কোন ব্যক্তিকে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন অথবা মনোনীত করলে সে ক্ষেত্রে তার আপত্তি করার কোন সুযোগ থাকবে না এবং দুর্বলতাও প্রদর্শন করা যাবে না । তখন দলের দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য ।

ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদের নাম নয়, ইহা দায়িত্বের নাম। কাজেই দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ববান লোক নিয়োগ করা জরুরী । এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন : “লোকদের ইমাম বা নেতা হবেন সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান সবচেয়ে বেশী রাখেন, এ ব্যাপারে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম হবেন, যদি এ বিষয়েও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সকলের আগে হিজরত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সমান হলে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি ইমামতি করবেন। কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির প্রভাবাধীন এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

বুঝা গেল রাষ্ট্র প্রধানকে
১ । নামাযের ইমামতি করার যোগ্যতা থাকতে হবে ।
২। কুরআনের জ্ঞান থাকতে হবে।
৩। সুন্নাহ তথা ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে ।
৪ । হিজরতে অগ্রগামী অর্থাৎ নির্দেশ পালনে অগ্রসর হতে হবে ।
৫। বয়সে প্রবীণ হতে হবে ।

শরীয়তে নামায ও রাষ্ট্রীয় ইমামতিতে একই গুণাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। নামাযের ইমামতি রাষ্ট্রীয় ইমামতির প্রশিক্ষণ দেয়। এ কারণেই ইসলামী সংগঠন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের জন্যে নিম্নের গুণাবলীকে প্রাধান্য দেয় ।
১. দীনি ইলম অর্থাৎ সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। যার ইসলামী সংগঠন পরিচালনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে ।
২. খোদাভীরু অর্থাৎ তাকওয়াবান । যিনি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেন।
৩. রাসূলের আনুগত্য অর্থাৎ সুন্নাহ মোতাবেক সার্বিক কাজ পরিচালনা করবেন ।
৪. আমানতদার অর্থাৎ যিনি হবেন সকল কাজের ও সম্পদের আমানত রক্ষায় সচেষ্ট ব্যক্তি
৫. উন্নত আমল অর্থাৎ তাঁর আমল-আখলাক হবে সবচেয়ে উন্নত ও অনুসরণীয় ।
৬. অনড় মনোবল অর্থাৎ কাপুরুষ, ভীরু নয়; অনড় মনোবলের অধিকারী।
৭. কর্মে দৃঢ়তা অর্থাৎ যার কর্মে দৃঢ়তা আছে, যিনি অস্থিরতা ও হীনমন্যতায় ভোগেন না ।
তাছাড়া যিনি সাহসী, পরিশ্রমী, ইনসাফগার, ধৈর্যশীল, পরামর্শ গ্রহণের ও জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিশ্লেষণ শক্তি, উদ্ভাবন শক্তি, প্রশস্ত চিত্ততা, সুন্দর ব্যবহার, মেজাজের ভারসাম্য, সাংগঠনিক প্ৰজ্ঞা ও সাংগঠনিক শৃংখলা বিধানের যোগ্যতা রাখেন ।

দারসের শিক্ষাঃ

১। ইসলামী রাষ্ট্র বা দলে পদ প্রার্থী হওয়া যায় না ।
২। কোন পদের জন্য লালায়িত হওয়া উক্ত পদের জন্য অযোগ্যতার শামিল ।
৩। কোন পদ জবর দখল করলে তাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে না ।
৪। জনগণের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে তা পালন করা কর্তব্য।
৫। না চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে।