Close
Showing posts with label ইতিহাস ঐতিহ্য. Show all posts
Showing posts with label ইতিহাস ঐতিহ্য. Show all posts

Tuesday, May 20, 2025

মীর জুমলা থেকে মীর মুগ্ধ | ড. আবদুল বারী


আত্মত্যাগ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইস্পাহানে জন্ম লাভ করা এক মুসলিম বনিক পরিবারের সন্তান বাংলায় মুঘল মসনদের হাত শক্তিশালী করার জন্য আমৃত্যু নিজেকে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় নিয়োজিত রাখেন। তিনি ইতিহাসে মীর জুমলা নামে অধিক পরিচিত। তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর হতে বাংলার সার্বভৌম অধিকার স্থিতিশীল রাখার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন। তারই উত্তরসূরি একবিংশ শতকের বাংলাদেশের বীরযোদ্ধা শহীদ আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ফয়সাল, ওয়াশিমসহ অসংখ্য বীর শহীদদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে করেছে ঋণী। মীর জুমলার জীবন যেমন বাংলাকে করেছিল স্থিতিশীল অঞ্চল, তেমনি ২০২৪ সালের শত শত শহীদের রক্ত এবং হাজার হাজার আহত, পঙ্গু, চোখ হাত-পা হারা এবং জ্ঞান হারাদের অসীম ত্যাগে বাংলাদেশকে তৈরি করবে সাম্য, মানবিক এবং নৈতিক দেশে হিসেবে এবং এ দেশ স্থিতিশীল হিসেবে টিকে থাকবে ভবিতব্য ইতিহাসে।


মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির পতনের কারণ

মুসলিম জাতি কোনো রাজনৈতিক শক্তির নাম নয়, যা আজ বিশ্বে বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। মুসলিম হলো এক মানবিকতার উম্মাহ বা জাতি, যা কোনো ধর্মের ছাঁচে বিবেচনা করা যায় না। একজন মুসলিম বিবেচনা করে সত্য, ন্যায়, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতাকে পুঁজি করে। প্রত্যেক মানবসন্তানের কষ্টই হলো মুসলিম শাসকের কষ্ট বা যাতনার কারণ। মানবতার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওহি জ্ঞান (ওহি মাতলু ও গায়রে মাতলু তথা কুরআন ও হাদীস), প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে মদিনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং বৈদেশিক সম্পর্কের নমুনা সৃষ্টি করেন, যার আলোকে তাঁর তিরোধানের পর খলিফাগণ দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। এমতাবস্থায় মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি একটি ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এবং অমুসলিম শাসকরা তাদের প্রভাব, শক্তি ও শিক্ষার আলোকে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে ব্যাখ্যা করে।

তখন যদি মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি নিজেদেরকে রাসূলের সঠিক অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ হয়, তবে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এবং মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির মৌলিকত্ব বলতে আর কিছু থাকে না; যা আজকের তথাকথিত বা প্রচলিত মুসলিম শক্তির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসূলের রাজনৈতিক জ্ঞানকে অবজ্ঞা এবং পরিত্যাগ করে অমুসলিম রাজনৈতিক শক্তির কৌশল, জ্ঞান, অভিজ্ঞতাকে মুসলিম রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নিজেদের পদ-পদবিকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বেচ্ছাচারীর ন্যায় প্রশাসন পরিচালনা করে এবং তা মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা বলে চালিয়ে দিতে থাকলে প্রকৃত মুসলিম আদর্শ বা রাসূলের রাজনৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়ে যায়। ফলে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আজকের সময়ের অনেক তথাকথিত মুসলিম যাদুঘরের ব্যবস্থাপনা বলে বর্ণনা করেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই মুসলিমদের রাজনীতির সঠিক পাঠ না থাকা এবং এ পঠনকে সঠিকভাবে অনুসরণ না করার ফলে মুসলিম বিশ্বে এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার পতন বা মৃত্যু ঘটেছে।


•মীর জুমলার জন্ম ও পরিচয়

তিনি ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের বিখ্যাত ইস্পাহান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সেখানকার এক দরিদ্র তৈল ব্যবসায়ী ছিলেন। ছোটো বয়সে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন। তদানিন্তন সময়ে হীরার খনিসমৃদ্ধ ভারতের গোলকুণ্ডা তথা হায়দারাবাদ রাজ্যে অন্যের ব্যবসায়িক কাজের সহযোগিতার করার নিমিত্তে ছোটো চাকুরীতে যোগদান করেন। সময়ের বিবর্তনে তিনি নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে কেরানির চাকুরী থেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মীর জুমলা ব্যবসা-বাণিজ্যে এত বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেন যে, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শুরাট (ভারতের গুজরাট), আরাকান, আয়ুথায়া (বর্তমানে দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড), বালাশোর (উড়িষ্যা প্রদেশে), আচেহ (ইন্দোনেশিয়া), মালাক্কা (মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া), যোহোর (মালয়েশিয়া), বান্তাম (ইন্দোনেশিয়া), মাকাস্সার (ইন্দোনেশিয়া), জেদ্দা, বন্দর আব্বাস (ইরান), সিলন (শ্রীলংকা), বসরা (ইরাক), এডেন (ইয়েমেন), মাস্কাট (ওমান), মালদ্বীপ এবং মুখা (ইয়েমেন) প্রভৃতি বন্দরে তাঁর নিজ ব্যবসায়ী কাজ পরিচালনা করার জন্য গমন করেন এবং তদানিন্তন সময়ে একজন সফল ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


মীর জুমলার রাজনৈতিক জীবন

ব্যবসায়িক জীবনে সফলতার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি প্রথমে গোলকুণ্ডার কুতুবশাহী সুলতানকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে শাসকের নিকট নিজের অবস্থা সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা করেন। অতঃপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেখানকার সুলতানের দরবারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাজদরবারের প্রধান উজিরের দায়িত্ব পান। কিন্তু রাজদরবারের অন্য সদস্যদের কূটকৌশলের কারণে তাঁর ওপর শাসকের নেক নজর না থাকলে তিনি তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে যোগাযোগ করেন এবং কুতুবশাহী রাজার পরিবর্তে মুঘল সম্রাটের আনুকুল্য লাভের মাধ্যমে তাঁর ভবিষ্যৎ পথ বিনির্মাণ করেন।

তিনি মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময়ে গোলকুণ্ডা, বিজাপুরসহ দাক্ষ্যিনাত্যের আরও অনেক অঞ্চল মুঘলদের করদ-রাজ্য হিসেবে পদানত করতে সক্ষম হন। তিনি নিজ প্রতিভা বলে ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ির পুত্র ও কেরানি পদের ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠতম সমরনায়ক এবং সুবাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলার মুঘল সুবাদার হিসেবে ক্ষমতা লাভের পর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে আসামে অভিযান প্রেরণ করেন জুমলা। তিনি একজন সেনা ও নৌ বিদ্যায় পারদর্শী এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি হওয়ায় আসাম, কোচবিহার এবং কামরূপ দখল করেন।


বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

মীর জুমলাকে মুঘল আমলে বাংলার সুবাদার করে ‘খাঁন ই খানান মুয়াজ্জাম খান’ উপাধী দেওয়া হয়। তিনি বাংলার অস্থির রাজনৈতিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। মীর জুমলা শুধ বাংলারই সুবাদার ছিলেন না; এর পূর্বাঞ্চলীয় গৌহাটি, কোচবিহার, কামরূপ (আসাম), অহম (আসাম) এলাকাকে সুবাহ বাংলার সাথে এতত্রিত করে মুঘল প্রশাসনের কর্তৃত্বে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চালান তিনি। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সুবাদারি আমলে এ সকল অঞ্চলে নিজের অবস্থান মজবুত রাখতে সক্ষম হন।


মীর মুগ্ধের জন্ম ও শাহাদাত

তাঁর নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (১৯৯৮-২০২৪ খ্রি.)। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে অনার্স পাশ করে ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনাল্স থেকে এমবিএ করছিলেন। বাংলাদেশের জুলাই অভ্যূত্থানের সময় ছাত্রদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিতরণের সময় গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন মুগ্ধ। আজকের আলোচনায় মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের আত্মত্যাগ বাংলা, বাংলাদেশ এবং বিশ্ব মুসলিম প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য ও মিলের বিষয়টি ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা এ সময়ের দাবি।


•মীর জুমলার সময়ে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা

বাংলা ছিল তখন দিল্লির অধীনস্ত এক শক্তিশালী মুসলিম-প্রধান এলাকা। সে সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলোর মধ্যে শুধু আমেরিকা মহাদেশে মুসলিমদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ইতিহাস এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুসলিম শাসকের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় নিজেদেরকে তৎপর রাখত। তৎকালীন সময়ে উসমানীয় খলিফাদের আনুকূল্য লাভের জন্য ইউরোপের আজকের প্রভাশালী ফ্রান্স, বৃটিশ, ইতালি, রাশিয়াসহ অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধানরা সজাগ থাকত সর্বদা। অনুরূপভাবে এশিয়ার রাজাদের মধ্যে আজকের প্রভাবশালী চীন ও অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা ভারতের সুলতানী, মুঘল, সাফাবী এবং উসমানীয় শাসকদের সাথেও সদ্ভাব রেখে চলত তারা। অমুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা তাদের প্রয়োজনে মুসলিম সরকারপ্রধানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করত।

উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের মুঘল এবং উসমানীয় তুর্কিদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলত। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে উসমানীয়দের ক্ষমতা স্তিমিত হতে থাকলে মুসলিম অঞ্চলে তারা নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম অঞ্চল দখল করতে থাকে। বৃটিশ, ইতালি, পর্তুগিজ, ডাচসহ অন্যান্য কোম্পানি ও সরকার তাদের প্রয়োজনে মুসলিম এ সকল প্রভাবশালী সরকারের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখত। কিন্তু মুসলিম অনৈক্যের সুযোগ তৈরি এবং সেই সুযোগে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। সময়ের বাস্তবতায় অমুসলিম শক্তির কাছে মুসলিম শাসকগণ পরাজিত হন। আজ অবধি এ শক্তির পুনরুত্থান বা পুনরুদ্ধার হয়নি।

•মীর মুগ্ধের শাহাদাতকালে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা

আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে চলছে, মীর জুমলার সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তা থেকে ভিন্ন। মুসলিম শাসক ও নেতাদের অনৈক্যের সুযোগে বৃটিশসহ অন্যান্য ইহুদী-খ্রিস্টান শক্তির পরোক্ষ মদদে ১৮২৫ সালের পর সৌদ-উসমানী দ্বন্দ্ব প্রকট রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ১৮৫৭ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতে বৃটিশ শাসন শুরু হলে মুসলিম নেতা ও শাসকগণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। ১৯১৭ ও ১৯৩৯ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মুসলিম নেতৃত্ব ও দুর্বল প্রশাসন শতধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।

তখন সৃষ্টি হয় বিশ্ব নেতৃত্বের নতুন পঞ্চ শক্তির উত্থান; যেখানে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিশালী অবস্থায় ছিল না। ফলে মুসলিম রাজারা সম্পূর্ণভাবে একেক সময়ে একেক শক্তির পেছনে জোট করে ছুটতে থাকে। কিন্তু তারা ইউরোপীয় শক্তি বা অন্যান্য দিকে ঝুঁকলেও নিজেদের রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণ বিশ্বে কোনো শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তাই একসময়ের নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম শাসকগণ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, যা আজকের রাজনৈতিক ইতিহাসে লক্ষণীয়।


অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাপনার ইতিহাস

মীর জুমলা হতে মীর মুগ্ধের সময়ের মুসলিম প্রতিবেশ পরিবর্তনের কারণ খোঁজ করা অতীব জরুরি। মুসলিম শাসকদের এ অবস্থা কেন হলো, কিসের অভাবে, কাদের জন্য, কিভাবে এ অবস্থা হতে আবার পূর্ব ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া সম্ভব; তা আজকের ভাবনার বিষয়।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে- ইস্পাহানের এক ছোট্টো তেল ব্যবসায়ির সন্তান অল্পকিছু শিক্ষা লাভের পরও নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় নিজের রাজনৈতিক ইতিহাসের আসন উজ্জল স্থানে নিতে সক্ষম হন। সে সময় ইস্পাহান হতে বাংলা পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রের প্রধান মুসলিম শাসক বা মুসলিম শাসকের আনুকূল্যে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে ছিল। তদানিন্তন সময়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তিনটি প্রধান শক্তি তথা উসমানীয়, সাফাবী এবং মুঘল রাজনৈতিক বলয়ে আবর্তিত হতো।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা দেশ, এমনকি অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম শক্তিও আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ই.ইউ, রাশিয়া, ভারত, চীনের নানা কৌশল ও পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ রাজনৈতিক গতি পরিবর্তনের ইতিহাস আজকের বাস্তবতায় গবেষণার দাবি রাখে। কেননা বর্তমান শাসকদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রশাসনের বাইরের রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। আশার দিক হলো- আজকের পৃথিবীর বাস্তবতায় মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রের শাসকদের স্থলে দেশপ্রেমিক সুসংগঠিত নকীবদের পদচারণা পৃথিবীব্যাপী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সেকেলে পুরাতন মানসিকতার শাসকশ্রেণির পরিবর্তন করা সম্ভব হলে নতুন মুসলিম বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। যার মাধ্যমে রাসূলের মানবিক, সাম্য এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হবে বিশ্বজুড়ে।


বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা

১৯৭১ সালে এদেশের দামাল ছেলেদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা চুয়ান্ন বছরেও অধরা থেকে যাচ্ছে। এর কারণ খুঁজে বের করার এ মোক্ষম সময়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা থাকা একটি স্বাধীন দেশের জন্য খুবই জরুরি। কেননা এতদিন যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কাগজে কলমে ছিল, তা এত বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে এ দেশের জনসাধারণ দেখতে পায়নি। তাই বিভিন্ন সময়ে এ দেশের তরুণ দামাল সন্তানদের দিতে হয়েছে অনেক উচ্চমূল্য। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে এদেশ দেখেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনাঅভ্যূত্থান, দেখেছে একই বছরের ৩ ও ৭ নভেম্বরের অনেক লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস। 

এদেশ আরও দেখেছে ১৯৮১ সালের আরেক পৈশাচিক রক্তাক্ত বাস্তবতা, এরশাদের স্বৈরশাসন এবং ১৯৯০ সালে গণঅভ্যূত্থান, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গণতন্ত্রের মডেলে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন। আরও সম্ভব হয়নি বিদেশী হায়েনাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে দেশী প্রশাসকদের পদ লেহনের কারণে। এ সুদীর্ঘ চুয়ান্ন বছরে দেশের মানুষ হয়েছে শতধাবিভক্ত। তাই এদেশকে গড়তে হলে নিতে হবে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সেটা সম্ভব হবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন করার মাধ্যমে। মানুষের আকাঙ্খাকে মর্যাদা দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে, যেন তারা একেকজন হয়ে ওঠে দেশমাতৃকার সেবক ও সাচ্চা প্রেমিক। তবেই এ দেশ সুসংগঠিত হবে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্থায়ীত্ব হবে অনেকদিন।


•রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের উপায়

মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের এই দেশে রাজনৈতিক সংকট যেভাবে চেপে বসেছে, তা দূর করতে হলে নিম্নোক্ত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি:

- বাংলাদেশের সকল শিক্ষিত ব্যক্তিকে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় ন্যূনতম মাত্রার শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশের সকল দলের নেতা, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ইসলামী শিক্ষা বা মানবিক ও নৈতিক মৌলিক পাঠ অবশ্যই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করবে।

- বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষের তাদের নিজ নিজ ধর্মের নৈতিক শিক্ষা লাভের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা থাকবে।

- শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত সকলকে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিদিনের দৈনন্দিন বা প্রাত্যহিক জীবনে যে সকল আরবি শ্লোক উচ্চারণ করে, তা জেনে ও বুঝে উচ্চারণের জন্য বাধতামূলক করতে হবে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

- সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন জীবনে উচ্চারিত আরবি শ্লোকগুলো অর্থসহ পঠন-পাঠনের জন্য সিলেবাসভুক্ত করতে হবে, যা মুসলিম ছাত্র অন্যান্য আবশ্যিক বিষয়ের ন্যায় পড়তে এবং অর্থসহ মুখস্ত করতে বাধ্য থাকবে। সরকারিভাবে এ ব্যবস্থা সকল মাদরাসা, প্রাইমারি হতে বিশ্বদ্যিালয়, মেডিকেল, প্রকৌশল, কারিগরিসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু থাকতে হবে।

- দেশ একটি পর্যায়ে এলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল মুসলিমের জন্য ইসলামকে জানা ও বোঝার সুপরিকল্পিত সিলেবাস তৈরি করতে হবে।


পরিশেষে বলা যায়- শিক্ষা মানুষকে যে পথ দেখায়, সেই পথে সে পরিচালিত হতে থাকে। আমাদের দেশে সমন্বিত এ শিক্ষাব্যবস্থা বৃটিশ ও বৃটিশ পরবর্তীকালে দেখা যায় না; যা ছিল একটি জাতি গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। তা না হয়ে চলছে এক অপরিকল্পিত শিক্ষামাধ্যম, যার মাধ্যমে জাতি হচ্ছে বহুধাবিভক্ত। যেমন একটি বাড়িতে দুইজন ছেলে রয়েছে। একজন সন্তান কওমী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা শেষ করলে তার শারীরিক, মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয় একভাবে। তেমনি অন্যজন আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া শেষে তার বিকাশ কেমন হয়? তারা দুই ভাই আর এক চিন্তার হয়? হয় না কেন? কারণ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের মানুষের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা নয়।

তেমনিভাবে আমাদের দেশে সরকারি প্রাইমারি, বেসরকারি প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম বা ভার্সন স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। যার ফলে আজকের বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে মানসিক ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য বেশি লক্ষণীয়। তাই মীর জুমলা ও শহীদ মীর মুগ্ধের এ বাংলাদেশে আজকের দাবি হলো- দেশকে সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে, কোনো বৈষম্যের স্থান এখানে থাকবে না। দেশে সুবিচার থাকবে, কোনো অবিচার মানুষ সহ্য করবে না। দেশের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, মানবিকতা। থাকবে না অসততা, অন্যায়, অনৈতিকতা, অমানবিকতা। দুই মীরের বাংলাদেশে আজ হোক এই শপথ।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

Monday, May 5, 2025

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

•ভূমিকা: 
ইতিহাসের পাতাজুড়ে সত্য ও স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের বহু গৌরবগাথা রচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধ বদর থেকে শুরু করে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ রক্তস্নাত সংগ্রামের উদাহরণ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বালাকোটের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনা একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। এই অসমযুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রেরণাদায়ী নেতা শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সাহসী সহযোদ্ধাদের নিয়ে যে শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপী ৬ মে দিনটিকে "বালাকোট দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন করে থাকে। বালাকোটের শহীদদের সেই ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ ভারতীয় মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা একটি স্বাধীন আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

•বালাকোটের ঐতিহাসিক পটভূমি:

উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর বালাকোট, যা আজকের পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার মেনশেহরা জেলার কাগান উপত্যকার প্রবেশপথে অবস্থিত। আঠারো শতকের শেষ দিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আফগান দুররানি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে, শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৮ সালে শিখ বাহিনী পেশোয়ার দখল করে নেয়, যার ফলে সেই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী শিখ শাসনের অধীনে চলে আসে। শিখ শাসকদের অধীনে মুসলমানরা তখন জুমার নামাজ, আজান, কুরবানি, এমনকি ধর্মীয় পোশাক পরিধানেও বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। এই অবমাননাকর অবস্থা মুসলমানদের মনে তীব্র কষ্ট ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার অনেক মুসলিম সরদার ও খান নিজেদের জীবন ও ধর্ম রক্ষার জন্য দিল্লির একজন প্রখ্যাত ইসলামী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শরণাপন্ন হন। একই সময় ভারতজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদও তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী পরিচয় বজায় রাখা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার তাগিদ তীব্র হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় একটি অখণ্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজাদী আন্দোলন। এই ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী (১৭৮৬-১৮৩১) - ভারতের এক খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও সামরিক নেতা।

•সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর জীবন ও আন্দোলনের বিস্তৃত পটভূমি:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ১৭৮৬ সালে এলাহাবাদের রায়বেরেলভী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলমুল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিল্লি যান এবং বিখ্যাত আলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একসময় টঙ্কের নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যখন আমীর খান ইংরেজদের সাথে আপস করেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী সেই আপসের বিরোধিতা করে সৈন্যদল ত্যাগ করেন এবং স্বাধীন ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। ১৮১৮ সালে দিল্লি ফিরে এসে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে রোহিলখণ্ড, আগ্রা, মিরাট, মুজাফফরনগর, সাহারানপুর, লক্ষ্ণৌ, বেনারসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংস্কার ও ইসলামী জাগরণমূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা এমন ছিল যে, বহু বিখ্যাত আলেম তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

১৮২১ সালে তিনি প্রায় ৪০০ ভক্তসহ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন, যেখানে উপমহাদেশের বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। এ সময় বাংলার সাহসী নেতা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর তাঁর সান্নিধ্যে আসেন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে সৈয়দ আহমদের প্রভাব উপমহাদেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন এবং তিতুমীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমান্তরালে চলছিল, যা মুসলমানদের একসাথে জাগরণের পরিচায়ক।

হজ থেকে ফিরে এসে সৈয়দ আহমদ দুই দিক দিয়ে তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যান:
সমাজ থেকে কুসংস্কার, শিরক, বিদআত ও জুলুম নির্যাতন দূর করে মুসলমানদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করা;

এবং ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর আন্দোলনে সুফি তরিকার আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট।

১৮২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হিজরত করেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ারে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় এক থেকে দুই হাজার মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এই অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রতি গভীর প্রেম ও স্বাধীনতার দৃঢ়সংকল্পের প্রতিফলন।

পেশোয়ারে পৌঁছে স্থানীয় মুসলমানরা তাঁকে "আমীরুল মুমিনিন" (মুমিনদের নেতা) হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি সেখানে একটি ইসলামী শাসন কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেন এবং স্থানীয় পাঠান গোত্রগুলোর সহায়তায় শিখ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নেন।

প্রথমেই আকোড়া নামক স্থানে এক অতর্কিত রাতের যুদ্ধে তাঁর মুজাহিদ বাহিনী প্রায় ৭০০ শিখ সৈন্যকে পরাজিত করে, যদিও এতে প্রায় ৮০ জন মুসলিম মুজাহিদ শহীদ হন। এই বিজয় মুজাহিদদের মনোবলে নতুন উদ্দীপনা আনে এবং জিহাদের ময়দানে তাদের অটুট বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

মহারাজা রঞ্জিত সিং গোপনে পাঠান গোত্রপতিদের ঘুষ দিয়ে সৈয়দ আহমদের বিপক্ষে দাঁড় করান। ১৮৩০ সালের শেষ দিকে স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে তাঁর বহু সেনা হতাহত হয় এবং তিনি বাধ্য হন পেশোয়ার ত্যাগ করে পাহাড়ি অঞ্চল বালাকোটে আশ্রয় নিতে। তবুও তিনি হার মানেননি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা কৌশলে শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে, তিনি মানসেহরা জেলার দুর্গম পার্বত্য এলাকা বালাকোটকে জিহাদের শেষ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেন, যা পরিণত হয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে।

•বালাকোটের চূড়ান্ত যুদ্ধ: আত্মত্যাগের অমরগাথা:


একদিকে সীমান্ত এলাকার সর্দারদের অর্থলোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে শিখদের বিশাল সুসজ্জিত বাহিনী-এই অসম পরিস্থিতিতেও বীর মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) হাল ছাড়েননি। পাহাড়ঘেরা দুর্গম উপত্যকায় থেকেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দৃঢ়সংকল্পে অটল ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যাচারী শিখ ও ইংরেজ শাসকদের বিতাড়ন করে ভারতবর্ষে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।

বালাকোট-চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ উপত্যকা, সৈয়দ আহমদের ইসলামী আন্দোলনের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে, শুক্রবার ভোরবেলা, এই উপত্যকায় শেষ লড়াই শুরু হয়। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধা শাহ ইসমাঈল দেহলভী প্রায় ৬০০-৭০০ মুজাহিদ নিয়ে বালাকোটে অবস্থান নেন। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল শিখ সাম্রাজ্যের প্রায় ১০,০০০ সৈন্য, যাদের নেতৃত্বে ছিল কনওয়ার শের সিং, মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সেনাপতি।

ভোর হওয়ার আগেই মুজাহিদরা মসজিদে বালার কাছে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হঠাৎ করে শিখ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিক আক্রমণে তারা সাফল্যও পায়-শিখদের একটি দলকে আশ্চর্যজনকভাবে ঘায়েল করা সম্ভব হয়। কিন্তু শিখদের সংখ্যাগত ও অস্ত্রশক্তির আধিক্যের কারণে পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শের সিং পুরো উপত্যকাকে ঘিরে ফেলে এবং মেটিকোট পাহাড়ের ওপর থেকে অসংখ্য শিখ সৈন্য নিচে নেমে চারদিক থেকে মুজাহিদদের আক্রমণ করে।

সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং আত্মত্যাগের এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে সৈয়দ আহমদ শহীদ হন মেটিকোট পাহাড়ের একটি ঝরনার পাশে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহ ইসমাঈল দেহলভীও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। তাঁদের শাহাদাতের খবর মুজাহিদদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে না পৌঁছানোয় অনেকে ইমামকে খুঁজতে খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়ে শত্রুর হাতে নিহত হন। এদিকে কিছু সাহসী মুজাহিদ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সংখ্যার ভারে দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় গুজর গোত্রের কিছু ব্যক্তি প্রচার করে, "সৈয়দ সাহেব নিরাপদে পাহাড়ের ওপরে আছেন, সবাই দ্রুত সেদিকে চলে যান।" এই ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক মুজাহিদ পিছনে সরে যান এবং সেই সুযোগে শিখ বাহিনী পুরোপুরি জয়লাভ করে। এই দিনের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ৩০০ মুজাহিদ শহীদ হন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের (তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের) মুজাহিদরাও ছিলেন। শিখ সৈন্যরা সৈয়দ আহমদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে শিরশ্ছেদ করে এবং বহু অনুসারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষে বালাকোটের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তারা মুসলমানদের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।

তবুও এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মাত্র ৭০০ মুজাহিদের বাহিনী প্রায় ১,০০০ শিখ সৈন্যকে হতভম্ব করে অসীম সাহসিকতার যে উদাহরণ স্থাপন করেছিল, তা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় অধ্যায়। এত বড় আত্মত্যাগের ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৩১ সালের ১৮ মে, অর্থাৎ ১১ দিন পর বাংলায় বঙ্গবীর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ কামানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদের "তরীকা-এ-মুহাম্মদী" আন্দোলন তাঁর শাহাদাতের পরও থেমে যায়নি-বরং তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এই আন্দোলনই পরবর্তী মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করে।

•আন্দোলনের আদর্শিক ও আধ্যাত্মিক দিক:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে বালাকোটের আন্দোলন "তরীক-এ-মুহাম্মদী" নামে পরিচালনা করেন, যার মূলমন্ত্র ছিল-হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা। শাহ ইসমাঈল দেহলভী-সহ বিশিষ্ট আলেমরা তাঁর সহযোগী ছিলেন। তিনি খিলাফতের আদলে একটি শরিয়াহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলে তিনি অল্প সময়ের জন্য হলেও শরিয়তের আলোকে শাসন চালু করেন। তিনি:
পণপ্রথা ও জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ করেন,
জাকাত ও উশর আদায় করে বায়তুলমাল গঠন করেন,
এবং গোত্রীয় রীতি না মেনে শরিয়তের বিধান মানার নির্দেশ দেন।

এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমে কিছু গোত্র ও নেতা অসন্তুষ্ট হলেও এটি ছিল ন্যায়ভিত্তিক ইসল, সাহসী প্রয়াস। সৈয়দ আহমদের এই আন্দোলনের আদর্শিক ধারা আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহ।, ভারতের হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তিতুমীর-এর আন্দোলনের সঙ্গেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধোত্তর পরিণতি ও আন্দোলনের উত্তরাধিকার:


বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধাদের শাহাদাত আন্দোলনটির তাৎক্ষণিক সামরিক পরাজয় নিশ্চিত করেছিল। তবে এই পরাজয়ের মধ্যেও তাঁদের আত্মত্যাগ ও আদর্শিক দৃঢ়তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। যুদ্ধের পর শিখ বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৈয়দ আহমদের পরিবারের কিছু সদস্য ভারতে টঙ্কে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরও আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি।

ইমাম মাহমুদ, যিনি সৈয়দ আহমদের খলিফা ছিলেন, কিছুদিন আন্দোলনের হাল ধরার চেষ্টা করেন। এরপর উইলায়ত আলী ও এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ১৮৫০'র দশক পর্যন্ত ছোট পরিসরে আন্দোলনের কার্যক্রম চলমান ছিল। তবুও ব্রিটিশরা সংগঠিতভাবে এই অবশিষ্ট অনুসারীদেরও দমন করে। সংখ্যায় ও অস্ত্র-সরঞ্জামে দুর্বলতা একটি কারণ হলেও অধিকাংশ গবেষক স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখেন।

শুরুর দিকে যেসব স্থানীয় মুসলিম নেতা সৈয়দ আহমদকে আহ্বান জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় তারা অনেকেই পাশে ছিলেন না। বরং কেউ কেউ শিখদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন। এমনকি মুজাহিদ বাহিনীতে গুপ্তচর হিসেবে প্রবেশ করে শিখদের গোপন পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দেয়, যা তাদের আক্রমণ সফল করে তোলে। হাজারা এলাকার এক গোত্রপ্রধান শিখদের বালাকোট ঘিরে ধরার গোপন রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আবার পেশোয়ারে সৈয়দ আহমদ যাকে শাসক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই সুলতান মুহাম্মদ খান বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক শীর্ষ মুজাহিদকে হত্যা করেন এবং শত্রুপক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দেন।

সৈয়দ আহমদ শহীদ উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে "শাহাদাত" ও "ইসলামী রাষ্ট্র" চেতনার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে বহু আন্দোলনে অঙ্কুরিত হয়। পশ্চিমা গবেষক এডওয়ার্ড মোর্টিমার বলেছেন, “সৈয়দ আহমদ ছিলেন আধুনিক ইসলামপন্থিদের একজন প্রথমদিকের চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রামকে একত্রিত করে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।" তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মুজাহিদ বাহিনী মুসলমানদের মধ্যে যে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল, এই আদর্শ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে-
দেওবন্দি উলামাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে,
তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহে,
আধুনিক কালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলের ইসলামী সংগঠনগুলোর মাঝেও।
সর্বসম্মতিক্রমে বলা যায়- সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের প্রথমদিককার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন, যাঁর আদর্শ, সংগ্রাম, জীবন ও মৃত্যু একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় ইসলামী জাগরণের উজ্জ্বল প্রতীক।

•বালাকোটের শিক্ষা ও আমাদের প্রেরণা:


বালাকোটের যুদ্ধ এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) যেমন মুসলমানরা ইসলামী আদর্শ ও স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আজও ঠিক তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা একই সংগ্রামে লিপ্ত। আজ কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইহুদিদের, চীনের জিনজিয়াংয়ে বৌদ্ধ-চিনপন্থি শাসকদের, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নির্যাতন-এসবই দেখায় যে মুসলিম জাতি এখনো চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামও এই একই ঐতিহাসিক ধারার অংশ, যা বালাকোটের চেতনা থেকেই অনুপ্রাণিত।

প্রথমত, ঐক্যের শিক্ষা
সৈয়দ আহমদের আন্দোলন স্থানীয় মুসলমানদের বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বিজয়ী হয়েছে। আজকের তরুণদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে-মতপার্থক্য ভুলে ন্যায়ের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

দ্বিতীয়ত, আদর্শের প্রতি অবিচলতা ও আত্মত্যাগ
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তাঁর সাথীরা ঈমান, ন্যায় ও স্বাধীনতার আদর্শে অটল ছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে,
সত্য ও ইসলামী চেতনার পক্ষে দৃঢ় থাকা এবং প্রয়োজনে প্রাণ দেওয়াড়এই গুণটি মুসলমানদের শক্তির মূলভিত্তি। তারা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি-আমাদেরও সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে।

তৃতীয়ত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির গুরুত্ব
ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা-এই তিনটি গুণই দুর্বলকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আজকের তরুণদের জীবনের যেকোনো সংগ্রামে-হোক তা সামাজিক ন্যায়, নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জাতির উন্নয়ন-নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সততাই তাদের সফলতার প্রধান হাতিয়ার।

চতুর্থত, সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) সীমিত সম্পদ নিয়েও একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন-যার নিজস্ব অর্থসংগ্রহ, কাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বব্যবস্থা ছিল। আজকের বাংলাদেশে কিংবা মুসলিম সমাজে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নয়, দরকার সৎ নেতৃত্ব ও সংগঠিত কর্মপন্থা।

পঞ্চমত, চেতনার উত্তরাধিকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ইতিহাস ও বালাকোটের ইতিহাসের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাকে এক জায়গায় মিলিত করে। স্বাধীনতা মুখের কথা নয়-এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। তাই আমরা যেন কখনো আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ভুলে না যাই।

•উপসংহার:

বদর থেকে বালাকোট-এই দীর্ঘ সময়সীমায় মুসলিম উম্মাহ বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা ঈমান, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতি অটল থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত বালাকোট আন্দোলন সেই ধারাবাহিক সংগ্রামের ধর্মীয় আদর্শ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একসূত্রে মিলিত হয়ে গড়েছিল এক অনন্য ইতিহাস।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরি ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখান থেকে আমরা ঐক্য, আত্মত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা সম্পর্কে শিক্ষা পাই। সত্য ও স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্মৃতি আমাদের সাহস জোগায়। তাদের আত্মত্যাগের মূল্যেই আজ আমরা স্বাধীন সেই শিক্ষা আমাদের জাতি গঠনের দায়িত্বে আরও সচেতন করে। বালাকোটের শহীদগণ আমাদের প্রেরণা জোগান। আসুন, আমরা নিজ নিজ আদর্শে অটল থেকে জাতির কল্যাণ ও ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করি। আমরা যদি অতীতের সেই মহান শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আগামীর সুন্দর ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।


তথ্যসূত্র:
১. বদর থেকে বালাকোট, বদরুজ্জামান, দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ, ২০২১
২. চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমিন দুলাল, প্রফেসর'স পাবলিকেশন্স, ৬ষ্ঠ প্রকাশ, ২০১২
৩. কারবালা থেকে বালাকোট, মুহাম্মদ সোলায়মান ফররুখ আবাদী, প্রতীতি প্রকাশন
৪. শহীদে বালাকোট (শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. (১২৪৬-১৮৩১), আল্লামা খালেদ মাহমূদ, মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরী
(অনুবাদক), নূরুল কুরআন প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ, ২০১৮
৫. বালাকোটের প্রান্তর, আরীফুর রহমান, আবরণ প্রকাশন, ১ম প্রকাশ, ২০২১

[ বুকলেট প্রকাশনায়: বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ]

Tuesday, March 11, 2025

১১ মার্চ: ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঐতিহাসিক শহীদ দিবস || শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা

১১ মার্চ: ঐতিহাসিক শহীদ দিবস— শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিরোধী শক্তির আঘাতে প্রাণ হারান আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার।

• ঘটনার সূত্রপাত:
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীরা ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীনবরণের প্রচার কার্য চালানোর সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, এতে কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হন। শিবির তাদের শত উসকানি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে।

• ১১ মার্চের রক্তাক্ত সকাল:
১১ মার্চ সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহ্বানে নবাগত ছাত্রসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবিরকর্মী গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পাশের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র।

শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। শিবির নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল শিবিরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তথাকথিত বামপন্থার কেন্দ্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে।

একপর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চতুর্দিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবিরকর্মীরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাকভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দেয়।

সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় নিরস্ত্র ছাত্রশিবির কর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও তারা সন্ত্রাসীদের নৃশংস আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

সন্ত্রাসীরা পাশবিক কায়দায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহীদ শাব্বির আহম্মেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে মাথায় লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ আব্দুল হামিদকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আরেকটি ইট দিয়ে তার মাথায় একের পর এক আঘাত করে। এতে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান।

শহীদ আইয়ুব ভাই ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহাদাত বরণ করেন। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই।

সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাকাণ্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবিরবিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।

১১ মার্চের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শিবিরকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মরণকামড় দিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। তারাই তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়ে। তারা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি, বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর, শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত।

মতিহারের সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করেছে—এ সত্য আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন: 

Saturday, January 11, 2025

ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৫২তম শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন || ০৪ আগস্ট ১৯৭১ - ১২ জানুয়ারি ১৯৯৩


শাহাদাতের ঘটনা:

ইসলামের জন্য যুগ যুগান্তরে সাহসী মুজাহিদ ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। দ্বীনের পথে তেমনি একজন সাহসী সৈনিক মোশাররফ হোসাইন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পিতার যোগ্যতম এক সন্তান। বাবা-চাচা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী দলের ছাত্রসংগঠনের ফ্যাসিবাদী আচরণের নির্মম শিকার হন শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন।

পারিবারিক পরিচয়:

শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার জয়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা কাজী সামছুল হুদা তার স্ত্রীকেসহ পরিবারকে সীমান্তের ওপারে ভারতের করিমাটিয়া রেখে দেশে চলে আসেন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে। স্ত্রী হোসনে আরা তার একমাত্র কন্যা কাজী দিলারা আকতারকে নিয়ে ভারতে বসবাস করতে লাগলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সামছুল হুদার পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, আদরের কন্যা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানো গেল না দিলার আকতারকে। মেয়ের শোকে ভেঙে পড়ে মা হোসেনে আরা। ঠিক সে মুহূর্তে অমবস্যার কালো আঁধারের মাঝে দেখা গেলো পূর্ণমিার চাঁদ। ৪ আগস্ট ১৯৭১। পৃথিবীতে আসলেন কাজী মোশাররফ হোসাইন। যাকে পেয়ে মা হোসনে আরা বেগম মেয়ের শোক কিছুটা কম অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু না; হোসনে আরা বেগমের সে আনন্দ বেশি স্থায়ী হতে দেয়নি মুজিববাদী ছাত্রলীগ। একদিন মোশাররফের মত নিষ্পাপ উদীয়মান তরুণকেও মুজিববাদী হায়েনাদের নির্মম ব্রাশফায়ারে শিকার হতে হয়েছে।

শিক্ষাজীবন:

শিক্ষার হাতে খড়ি পিতার কাছেই। ভর্তি করালেন শুভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। ভর্তি হলেন জয়পুর সরোজিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত মেধার সাক্ষ্য রাখলেন আগের মতই। এসএসসি পাস করলেন ১ম বিভাগে। ভর্তি হলেন ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে। শরিক হলেন শহীদী কাফেলায়। এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন মোশাররফ হোসাইন। তিনি শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না বরং সুবক্তা ছিলেন। তাইতো তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার জন্য নিয়ে যেতেন।

সাংগঠনিক জীবন:

কাজী মোশাররফ হোসাইন সংগঠনের কর্মী ছিলেন। ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে অধ্যায়নকালে সংগঠনে যোগ দেন। মেধাবী ছাত্র কাজী মোশাররফ হোসাইন পড়াশোনা ছাড়া অন্য সময়গুলো দাওয়াতি কাজে লাগাতেন। তার চরিত্র ছিল চুম্বকের মত আকর্ষণীয়। তিনি তার দাওয়াতি চরিত্র দিয়ে সহপাঠী বন্ধু বান্ধব সকলকে আকৃষ্ট করেছিলেন। শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতেন।

শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা:

১২ জানুয়ারি ১৯৯৩ এর সকালবেলা কাজী মোশাররফ হোসাইন তাঁর রুমমেটদের শোনালেন এক দুঃস্বপ্নের কথা। ছাত্রলীগের গুন্ডারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ হস্তান্তরে জন্য বিশ হাজার টাকা দাবি করে। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সারাদিন আনমনে কেটে যায় তার। বিকালে কখনও ফুটবল না খেললেও সেদিন ফুটবল খেলতে নামেন প্যারেড ময়দানে। অনেকের চেয়ে ভাল খেললেন তিনি। মনও কিছুটা হালাকা হয়েছে তার। মাগরিবের নামাজ পড়ে সরলেন পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো শিবির কর্মী জিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে মিছিল বের হল। মিছিলে যোগদান করলেন মোশাররফ। মিছিল চলছিল সিরাজউদদৌলা রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে। সামনের সারিতে দৃঢ়পদে চললেন কাজী মোশাররফ । মিছিল যখন দেওয়ান বাজার সাব এরিয়ায় পৌঁছল তখন গলির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে ব্রাশফায়ার শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হলো সামনে থাকা মোশাররফ, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পান করলেন শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা। আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি। অকালে ঝরে গেল একটি প্রাণ। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল একটি তাজা গোলাপ। ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের পথে অগ্র পথিক হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। শহীদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন সহপাঠী বন্ধু, শিক্ষক সবাই। তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. আব্দুস সবর প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শহীদের কফিন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে মা প্রশ্ন করেন কোন অপরাধে তার সন্তানকে জীবন দিতে হল। যদি তার ছেলে অপরাধ না করে তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে। মা সন্তানকে ফিরে পাবেন না, সে জন্য ব্যথিত হৃদয়ে আজীবন কাটাবেন। ছেলে কিন্তু ব্যথিত নয়। কারণ তার তিনি জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গল্প করছেন জান্নাতের সুবজ পাখিদের সাথে।
একনজরে শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন:

-নাম: কাজী মোশাররফ হোসাইন
-পিতার নাম : মাস্টার কাজী সামছুল হুদা
-মাতার নাম : হোসনে আরা বেগম।
-ভাইবোনদের সংখ্যা : ২ ভাই, ৩ বোন
-ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়।
-স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম- জয়পুর, পো: শুভপুর, -থানা: ছাগলনাইয়া, জেলা: ফেনী।
-জন্মতারিখ : ৪ আগস্ট ১৯৭১
-শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স ২য় বর্ষ, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ
-শহীদ হওয়ার তারিখ : ১২.০১.১৯৯৩ সাল (১১ তারিখ সন্ধ্যায় আহত)
-শহীদ হওয়ার স্থান : দেওয়ান বাজার সাব এরিয়া, চট্টগ্রাম
-কবরস্থান : নিজবাড়ির আঙিনা
-যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
-সাংগঠনিক মান : কর্মী
-যাদের হাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী।


•শহীদের চাচার বক্তব্য:

শহীদের চাচা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। আমরা কি জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিলাম সন্তান হারাবার জান্য? সন্ত্রাস মদদ দানের জন্য? হোসনে আরা আজো কাঁদেন পুত্রশোকে। কেউ তাকে দেখতে গেলে ছেলের মতই ভাববেন তাদেরকে। এক সন্তানকে হারিয়ে লক্ষ সন্তানের মাতা আর সামছুর হুদা লক্ষ ছেলের পিতা হলেন। শহীদ মোশাররফ তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জান্নাত থেকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। দায়িত্ব আমাদের এ জমিনে কালেমার পাতাকা উড়াবার। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কষ্ট পাবেন, অভিযোগ করবেন আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দাঁড়াতে হবে আখেরাতের কাঠগড়ায়।

Sunday, December 29, 2024

ইবনে আল-হাইসাম: জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা ও আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ


ইবনে আল-হাইসাম (৯৬৫–১০৪০): সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আবু আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাইসাম, যিনি আলহাজেন (Alhazen) নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন ইসলামের স্বর্ণযুগের একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। তার গবেষণায় অপটিক্স, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী এই বিজ্ঞানী তার গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য আজও সম্মানিত।

• ইবনে আল-হাইসামের বৈজ্ঞানিক অবদান

১. অপটিক্স ও আলোর গতি
ইবনে আল-হাইসামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ "কিতাব আল-মানাযির" (Book of Optics)। এতে তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করেন।

চোখের গঠন ও দৃষ্টির ব্যাখ্যা: তিনি প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে চোখ থেকে রশ্মি বের হয় না; বরং আলোর রশ্মি চোখে প্রবেশ করে চিত্র তৈরি করে।

পিনহোল ক্যামেরা আবিষ্কার: তার গবেষণা থেকেই আধুনিক ক্যামেরার ধারণা গড়ে ওঠে।

আলোর বক্রতা ও প্রতিবিম্ব: তিনি বক্র ও সমতল আয়নার মাধ্যমে আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিবিম্বের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন।

লেন্সের ধারণা: পরবর্তীতে এই গবেষণা থেকেই চশমা, টেলিস্কোপ ও মাইক্রোস্কোপের ভিত্তি তৈরি হয়।

২. গণিত ও জ্যামিতি:
পার্থিব জ্যামিতির ব্যবহার: ইবনে আল-হাইসাম পরিপ্রেক্ষিত ও আলোর গতি বোঝার জন্য জ্যামিতির ব্যবহার করেন।

অপরিবর্তনশীল রশ্মি: তার গবেষণাগুলো গণিতের ত্রিভুজ ও কোণের তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের ভিত্তি: গণিতের এই শাখায় তার কাজ আধুনিক গাণিতিক গবেষণার পথ দেখিয়েছে।

৩. জ্যোতির্বিদ্যা:
তিনি চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব ও গ্রহের গতি নিয়ে গবেষণা করেন।

তার আবিষ্কারগুলো ইউরোপের মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।

চাঁদের প্রকৃতি ও আলোক বিচ্ছুরণ নিয়ে তিনি পরীক্ষামূলক গবেষণা চালান।

৪. পদার্থবিজ্ঞান:
তরল পদার্থের চাপ ও গতিবিধি নিয়ে তিনি গবেষণা করেন।

তিনি পানির প্রবাহ বিশ্লেষণ করেন যা আধুনিক জলবিদ্যুৎ প্রকৌশলের ভিত্তি স্থাপন করে।

ভারসাম্য ও মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তার গবেষণাগুলো নিউটনের গতিসূত্রের ভিত্তি গড়ে তোলে।

৫. বিজ্ঞান পদ্ধতির জনক:
ইবনে আল-হাইসামই প্রথম বিজ্ঞানকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাইয়ের ধারায় নিয়ে আসেন।

তিনি পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ওপর জোর দেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক।

তার এই পদ্ধতি পরবর্তীতে গ্যালিলিও ও বেকনের 
গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


• ইবনে আল-হাইসাম ও ইসলামিক দর্শন:
ইবনে আল-হাইসাম কুরআনের জ্ঞান ও চিন্তার নির্দেশনাকে অনুসরণ করে গবেষণায় ব্রতী হন।

১. কুরআনের প্রেরণা:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"তারা কি দৃষ্টি দেয় না আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে?" (সূরা আল-আ’রাফ: ১৮৫)

এ আয়াত তাকে মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনে অনুপ্রাণিত করে।

২. জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ:
"তোমরা বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?" (সূরা যুমার: ৯)

এই আয়াত ইবনে আল-হাইসামকে সত্যের অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে।


• পশ্চিমা বিশ্বের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি:
ইউরোপে তার প্রভাব:
১২ শতাব্দীতে ইবনে আল-হাইসামের গ্রন্থগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়।

রজার বেকন, কেপলার, এবং গ্যালিলিও তার গবেষণা থেকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন।

তার "Book of Optics" ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়।

• আধুনিক সম্মাননা:
২০১৫ সালে ইউনেস্কো তার সম্মানে "International Year of Light" ঘোষণা করে।

নাসা তার নাম অনুসারে চাঁদে একটি গর্তের নাম রেখেছে—"Alhazen Crater"।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তাকে ‘আধুনিক অপটিক্সের জনক’ বলে অভিহিত করেন।

উপসংহার:
ইবনে আল-হাইসাম শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ এবং অনুসন্ধানী মননশীলতা ও কুরআনের নির্দেশনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার গবেষণা এবং অবদান আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়েছে।

কুরআনের আয়াত দিয়ে শেষ করি:
"তোমরা বল, হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।" (সূরা ত্বাহা: ১১৪)

ইবনে আল-হাইসাম আমাদের শিক্ষা দেন কীভাবে বিশ্বাস ও যুক্তির সমন্বয়ে আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়া যায়। তার গবেষণা ইসলামের বিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহ্য এবং আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপনের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।

Thursday, December 12, 2024

জান্নাতি পাখি || শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রহ.



মিথ্যার দেয়াল তুলে ধ্রুব সত্যকে কখনো আড়াল করা যায় না। সত্য উদ্ভাসিত হয় তার নিজস্ব আলোয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ফাঁসী দেয়া হয় জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিক নেতা শিক্ষাবিদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে। সরকার যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে ফাঁসী দিলেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা আজ স্মরণীয় শত কোটি প্রাণে; ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সত্যপ্রেমীদের হৃদয় থেকে কখনো মুছে যাবেন না, আলোর পথের যাত্রীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

১৯৪৮ সালের ২রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলাস্থ সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গী গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সানাউল্লাহ মোল্লা ও মাতার নাম বাহেরুন্নেসা বেগম। আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন নয় ভাইবোনের মাঝে ৪র্থ। তার জন্মের কিছুকাল পরে তার পিতা-মাতা সদরপুরেরই আমিরাবাদ গ্রামে এসে বাড়ি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।

প্রাথমিক শিক্ষাঃ 
তিনি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিষ্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সংকটের কারনে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। ফরিদপুরের শিব সুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছু কাল।

উচ্চশিক্ষাঃ 
১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি করার জন্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণকালে তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের কারনে ১৯৭১ সালে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি বাড়ি চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭২ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মত আবদুল কাদের মোল্লার লেখাপড়াতেও ছন্দ পতন ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইন্সিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রীতে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হন।

কর্মজীবনঃ 
আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এমএড পরীক্ষার রেজাল্টের পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ সংস্কৃতি কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে রিসার্চ স্কলার হিসাবে বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টারে যোগ দেন। গৌরব-সাফল্যের ধারাবহিকতায় উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, রাইফেল পাবলিক স্কুল এবং মানারাত স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় যে সত্যের পরশ পেয়েছিলেন, তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এ সময়ে তাঁর ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে। বীক্ষণ ছদ্মনামে তার লেখা আর্টিকেল গুলো সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বৈবাহিক জীবনঃ 
জনাব মোল্লা দিনাজপুর নিবাসী বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেগম সানোয়ার জাহান ইডেন কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনিও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মত বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ও ইডেন কলেজের ছাত্রী ইউনিয়নের জিএস ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বেগম সানোয়ার জাহান তার বাবার সাথে কুষ্টিয়াতে ছিলেন ও সক্রিয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন। বেগম সানোয়ার জাহানদের বাসা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাবার যেত। দুই পুত্র ও চার কন্যার সুখী সংসার তাদের। সব সন্তানই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেছেন। পরিবারের সকলেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত। বেগম সানোয়ার জাহান জামায়াতের রুকন ও দায়িত্বশীলা ।

সাংবাদিক কাদের মোল্লাঃ 
সেসময়েরই একজন নির্ভীক সাংবাদিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বর্ণাঢ্য জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে তিনি আমাদের কাছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল সময়টা অতিবাহিত করেছেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে।
সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে প্রত্রিকাগুলো তখন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে সর্বমহলের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিল তাদের মধ্যে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর এ পত্রিকাটিতে দক্ষ হাতে দায়িত্ব পালনের ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে। ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দু’বার তিনি ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্তরে দ্রোহ আর বিপ্লবের চেতনা লালন করেও সদা হাস্যোজ্জল এ মানুষটি ছিলেন সাংবাদিক আড্ডার প্রাণ-ভ্রমরা। তার রসময় গল্পকথার সজীবতায় ভরে উঠতো গনমানুষের চেতনার প্রতীক জাতীয় প্রেসক্লাব।

কিন্তু একজন সাংবাদিকের জীবন সাধারণভাবেই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। কখনো সমাজের বিপথগামী অংশ, কখনো কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল, আবার কখনওবা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির রোষানলে পড়তে হয় তাকে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দন্দ্বে উৎসর্গিত হয় সাংবাদিকের জীবন। চারপাশের চেনাজন, পরিচিত বন্ধুমহল একসময়ে পরিণত হয় তার শত্রুতে। হানে প্রাণঘাতি ছোবল। যে ছোবলের রূপ হয় নানারকম। মানসিক যন্ত্রণায় বিপন্নতা, শারিরিক আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ, প্রাণঘাতি হামলায় মৃত্যু, কারাবন্দিত্বের নিঃসঙ্গ যাতনা কিংবা প্রহসনের বিচারে জীবনাবসান। এসবই ছিল যুগে যুগে সাংবাদিক জীবনের অনিবার্য উপাদান। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় একসময় সাংবাদিকতার পেশাকে বিদায় জানাতে হয় তাঁকে। কিন্তু যে পেশা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এর মহত্বকে তিনি ধারণ করতেন সবসময়। তাইতো তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের প্রতিটি ধুলিকণা এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে কাদের মোল্লার স্মৃতি ।

রাজনৈতিক জীবনঃ 
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রয়েছে সংগ্রামী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়ন কালেই তিনি কম্যূনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পর তাফহীমুল কুরআনের হৃদয়স্পর্শী ছোঁয়ায় তিনি ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষিত হন এবং আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি ছাত্রসংঘের তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান শাখায় যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ সংগঠনের সদস্য হন। ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারী ও একই সাথে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের রুকন হন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যাক্তিগত সেক্রেটারি এবং ঢাকা মহানগরীর শূরা সদস্য ও কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনের ব্যাবধানেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশ-এ-শূরার সদস্য হন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারী ও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে ঢাকা মহানগরীর নায়েব-এ-আমীর, অতঃপর ১৯৮৭ সালে ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ১৯৮৮ সালের শেষ ভাগে তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন যা বাতিলের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়।

১৯৯১ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তিনি জামায়াতের প্রধান নির্বাচনী মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ২০০৪ সালের মার্চ মাসে স্বল্প সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত দায়িত্বের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি চারদলীয় জোটের লিয়াজো কমিটির গুরুত্বপূর্ন সদস্য হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশর প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বিশেষ করে ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে লিয়াঁজো কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তখন কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এবং তা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। লিয়াঁজো কমিটিতে বিভিন্ন সময়ে নানা দায়িত্ব পালন করার কারনে বিএনপি দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ উভয় দলের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দের সাথে আন্দোলনের নীতি নির্ধারণী সভাতে মিলিত হতেন তিনি।

জনাব মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে চার চারবার জেলে যেতে হয়। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দায়ে ১৯৬৪ সালে প্রথম বারের মত তিনি বাম রাজনীতিক হিসেবে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু স্থানীয় জনতার বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কাস্টোডী থেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারনে আব্দুল কাদের মোল্লাকে আবারও আটক করে রাখা হয় ১৯৮৫ সালের ২২শে এপ্রিল থেকে ১৪ই অগাস্ট । প্রায় চারমাস আটক থাকার পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি মুক্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে গ্রেফতার হন। সাত দিন পরে তিনি মুক্ত হন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার কূটনীতিকদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জল ও রসময় কাদের মোল্লার কথা ছাড়া কোন প্রোগ্রাম জমজমাট হতো না। জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নানা কূটনীতিক প্রোগ্রামে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনাব মোল্লা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভারত সহ নানা দেশ সফর করেছেন।

জনাব মোল্লা সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে বাদশাহ ফয়সাল ইন্সটিটিউট, ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি ও এর স্কুল, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী, সদরপুর মাদরাসা ও এতিমখানা, ফরিদপুর জেলার হাজিডাঙ্গি খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা ও এতিমখানা, সদরপুর আল-আমিন অন্যতম। এছাড়াও তিনি ঢাকার গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন।

জনাব মোল্লা দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিষয়ের উপর একাধিক কলাম ও প্রবন্ধ লিখেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, পালাবদল, মাসিক পৃথিবী, কলম ইত্যাদি নানা জায়গায় তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রত্যাশিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে বিদেশে তিনি বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাওয়া যায়। তার লেখা কলাম ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ও বস্তুবাদ ও কম্যূনিজমের উপরে তার বৈজ্ঞানিক সমালোচনা শিক্ষিত মহলের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তিনি প্রথমে আব্দুল কাদের নামে লেখা শুরু করেন।পরবর্তীতে তিনি বীক্ষণ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন ও উনার লেখা গুলো খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সমসাময়িক সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার লেখা মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে ঢেউ তুলতে শুরু করে।

জনাব মোল্লা নিয়মিত কুরআন পড়তে ও কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পছন্দ করতেন। তিনি সাংগঠনিক ব্যস্ত সময় মধ্যেও তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত লেখক, কবি যেমন আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী, সাইয়্যেদ কুতুব ইত্যাদি নানা লোকের লেখা পড়তে পছন্দ করতেন।

শাহাদাতঃ 
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সরকার তাকে রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে এবং পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। ট্রাইবুনালের রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এরপর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চের দাবি অনুযায়ী সরকার আইন সংশোধন করে আপিল দায়ের করে। সংশোধিত আইনের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয়। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাননি। এমনকি রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই তড়িঘড়ি করে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁকে ফাসি দেয়ার প্রায় দেড় বছর পর তার রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বিচারের নামে কত বড় প্রহসনের শিকার হয়েছেন!

Sunday, December 8, 2024

বইনোট : ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় (ইসলামী বিপ্লবের পথ) || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রহ.



এটি ১৯৪০ সনের বক্তৃতা, জামায়াতে ইসলামী তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 
[বইয়ের মুল নাম: ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়]

• ভূমিকা:
ইসলামী বিপ্লবের পথ বইটির মূল কথা হল 'ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা হবে' এই লক্ষ্যে বইটির লেখক মরহুম মাওলানা মওদুদী (র) ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচী হলে এ সম্পর্কে এক অনুপম বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল '
ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়' এর অর্থ হল ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

• মূল আলোচনা:
বইটির মূল আলোচনাকে ৮টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা.
১. ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়
২. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন
৩. আদর্শিক রাষ্ট্র
৪. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র।
৫. ইসলামী বিপ্লবেরপদ্ধতি বা পন্থা
৬. অবাস্তব কল্পনা বা ধারনা
৭. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
৮. সংযোজন

 ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়:
১. বর্তমানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ নাম শিশুদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে।
২. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা এটা জানেন না কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং জানার চেষ্টাও করেন না।
৩. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা যে প্রস্তাব দেয় মোটর সাইকেলে যেমন আমেরিকায় পৌঁছানো সম্ভব নয় তেমনি তাদের প্রস্তাবে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

• রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
“কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক উপায়ে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।”
১. একজায়গা থেকে তৈরি করে এনে অন্য জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
২. কোন একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্মপ্রক্রিয়ার ফলশ্রতিতে।
৩. সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্মলাভ করে ইসলামী রাষ্ট্র।
৪. সামাজিক উদ্যম, উদ্দীপনা, ঝোঁক-প্রবণতা প্রভৃতি নিবিড় সম্পর্ক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত।
৫. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন।
৬. সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৭. দীর্ঘ প্রানান্তকর চেষ্টা (যেমন বীজ হতে ফল)।

• আদর্শিক রাষ্ট্র:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

(i) ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শিক রাষ্ট্র।
(ii) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রভাবমুক্ত।

২. ফরাসী বিপ্লবের আদর্শিক রাষ্ট্রের ক্ষীণ রশ্মি দেখা গেলেও জাতীয়তাবাদের প্রভাবে চাপা পড়ে তা বিলুপ্ত হয়। 
(i) রাশিয়ার কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও অতিসত্ত্বর তা আদর্শচ্যুত হয়। 
(ii) মুসলিম দেশের কতৃত্বশীল লোকেরা জাতীয়তাবাদের আখড়ায় পড়ে ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা হারিয়ে ফেলেছে। 

৩. আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রয়োজন:
ক) ভিত্তি স্থাপন হতে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্তপ্রায় অস্তিত্ব রক্ষা করা। উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করা।
খ) জাতীয়তাবাদী চিন্তা-পদ্ধতি সংগঠন প্রণালী পরিহার করা।

৪. আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের লক্ষ্যে:
ক) জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে এর আদর্শ পেশ করা। 
খ) সেই আদর্শ অনুযায়ী সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করে কল্যাণ সাধন।

• আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
(ক) ইহার বৈশিষ্ট্যঃ
১. ইসলামী রাষ্ট্রের মূল বুনিয়াদ
২. নিখিল বিশ্ব জগৎ আল্লাহতাআলার রাজ্য। তিনি ইহার প্রভূ, শাসক ও বিধানদাতা।
৩. মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহরপ্রতিনিধি।
৪. খেলাফতের এই দায়িত্বের জন্য প্রত্যেককেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

(খ) ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপঃ
১. এটা ধর্মহীন রাষ্ট্র হতে সম্পূর্ণ আলাদা।
২. এটা পরিচালনার জন্য এক বিশেষ মনোবৃত্তি বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ ধরনের নির্ধারন আবশ্যক।
৩. ধর্মহীন রাষ্ট্রের জজ ও প্রধান বিচার প্রতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
৪. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের জন্য খোদাভীতি, নিজ কর্তব্য পালন ও সেজন্য আল্লাহরকাছে জবাব দিহির তীব্র অনুভূতি ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকের প্রয়োজন।

(গ) ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা কারীদের বৈশিষ্ট্যঃ
• পৃথিবীর বিপুল পরিমান সম্পত্তি হস্তগত থাকলেও তারা তার পূর্ন আমানতদার।
• রাজশক্তি করায়ত্ত হলেও সুখ নিদ্রা ত্যাগ করে জনস্বার্থে রক্ষণাবেক্ষণ।
• যুদ্ধে বিজয়ী দেশে হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হয়ে তাদের ইজ্জত আব্রর হেফাজতকারী।
• নিজেদের স্বার্থকে ধুলিস্যাৎ করে অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া।
• আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এমন মর্যাদার অধিকারী হবে যে, তাদের সততা, সত্যবাদীতা, ন্যায়পরয়নতা, নৈতিক ও চারিত্রিক, মূল নীতির অনুসরণ এবং প্রতিশ্রুতিও চুক্তি পালনের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব তাদের উপর আস্থাশীল হবে।

• ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি বা পন্থা:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের অলৌকিক আবির্ভাব ঘটনা
• ইসলামী জীবন দর্শন চরিত্র ও প্রকৃতির বিশেষ মাপকাঠি অনুযায়ী গঠিত ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করা। নেতা ও কর্মীদের এই বিশিষ্ট আদর্শে আত্মগঠন করা।
• সমাজ জীবনে অনুরূপ মনোবৃত্ত ও নৈতিক উদ্দীপনা জাগ্রত করা।
• ইসলামী আদর্শে নাগরিকদের গড়ে তুলতে একটি অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা।
• জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা ও কাজ করতে সক্ষম এমন লোক গড়ে তোলা।
• ইসলামী আদর্শের চিন্তা-চেতনা ও কর্ম জীবনের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন।
• ইসলামী আন্দোলন চতুপার্শ্বে যাবতীয় অবাঞ্চিত জীবন-ধারার বিরূদ্ধে প্রকাশ্যে সংগ্রাম করবে।

২. ইহাতে নিম্নোক্ত ফল পাওয়া যাবে:
• পরীক্ষার অগ্নিদহনে উত্তীর্ণ ত্যাগী লোক তৈরি হবে।
• এ আন্দোলনে এমনসব লোক পর্যায়ক্রমে যোগদান করবে যাদের প্রকৃতিতে সত্য-ন্যায়ের উপাদান অন্তর্নিহিত রয়েছে।
• সর্বশেষে কাঙ্খিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

৩. যে কোন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন:
• একটি বিশেষ ধরনের আন্দোলন।
• বিশেষ ধরনের সামাজিক চেতনা সম্পন্ন নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃাষ্ট। উদাহরণ, রুশ বিপব, জার্মানির সমাজতন্ত্রের বিপব।

• অবাস্তবকল্পনা বা ধারনা:
১. কিছু লোকের ধারণা মুসলিম জাতিকে একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে একই পাটফর্মে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে পারলেই ইসলামী রাষ্ট্র আপনা আপনিই প্রতিষ্ঠিত হবে। 
২. মুসলমানদের বর্তমান নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার স্বরূপ যেমন- চরিত্রগত দিক থেকে দুনিয়ার মুসলিম ও অমুসলিম জাতিগুলোর সবগুলোর অবস্থা প্রায় একই। উদাহরণঃ আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতি, রোজার দিনে একই সাথে খাওয়া, সুদ, ঘুষ, জেনা ইত্যাদির সাথে লিপ্ত হওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা:
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কর্মপন্থাই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা। তার অনুসৃত বিশিষ্ট কর্মপন্থাগুলো নিম্নরূপ:

১. ইসলাম হলো সেই আন্দোলনের নাম যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মান করতে চায় এক আলাহর সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
২. ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়।
৩. মূল লক্ষ্য আলাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের দাওয়াত দেওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতির চারটি দিক রয়েছেঃ
ক) আলাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান।
খ) অগ্নী পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমানিত হওয়া।
গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল।
ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপব।

ক) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান:
১. বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী হয়ে থাকা তবে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববাদীতার দাবী হলো সেই মহান সম্রাটের হুকুমের সম্মুখে মাথা নত করে দাও তার একান্ত আনুগত্য দাস হয়ে যাও।
২. গোটা জাতির একজনই সম্রাট মালিক এবং সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। অন্য কারো কতৃত্ব করার কোন অধিকার নাই।
৩. আলাহ ছাড়া আমি সকলের বিরূদ্ধে বিদ্রোহী এবং যারা আলাহকে মানে তারা ব্যতিত] ৪. এই ঘোষণা উচ্চারণ করার সাথে সাথে বিশ্ববাসী আপনার শত্রুহবে এবং চতুর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।

খ) অগ্নি পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমাণিত হওয়াঃ
১. লা ইলাহা ইলালাহ এই ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে পোপ (খৃস্টান) ঠাঁকুরদের সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলো এগুলো গঠন করে হলো ঐক্যজোট।
২. তাদের উপর নেমে আসে কঠিন অত্যাচার এবং এর ফলেই ইসলামী আন্দোলন মজবুত হয় এবং ক্রমবিকাশ ও প্রসার লাভ করে।
৩. এর ফলেই সমাজের মনি-মুক্তাগুলো আন্দোলনে শরিক হয়।
৪. একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরিক হচ্ছিল বাস্তবে ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ।
৫. কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে এ দেখে কিছু মানুষ উৎসাহী হয় এরা কি কারণে মার খাচ্ছে।

গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেলঃ
১. বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের সেই মহান নেতার নেতৃত্ব আদর্শ, সহানুভূতি এবং সার্বিকভাবে তার মডেলকে অনুসরণ করা একান্ত দরকার।
২. এই নেতার স্ত্রী ছিলেন বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক।
৩. কালিমার দাওয়াত কবুল ও মানুষকে এ দাওয়াত দেওয়ার সাথে সাথে তাদের সম্পদ শেষ হয়ে যায়।
৪. নেতা ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহনশীল।
৫. সমকালীন সময়ে তাকে ইসলামী আন্দোলনের কাজ না করার প্রতিফল হিসাবে আরব জাহানের বাদশাহী এবং আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী দিতে চেয়ে ছিল। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন এবং তিরস্কার আর প্রস্তাব্যগত সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।
৬. অত্যন্ত গরমের সময় মরুভূমির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন সাথীদের সাথে নিয়ে।
৭. হাশেমী গোত্রের লোকেরা এই আন্দোলনের প্রতি অনীহা ছিল।

ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লব:
ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একদল লোককে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছিল যারা ইসলামের পূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়ে এতটা যোগ্য হয়েছিল যে তারা যেকোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিল। উদাহরণ, মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র।

একথা সত্য যে, একাজের জন্য প্রযোজন ঈমান, ইসলামীক চেতনা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবুত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ, উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবাণী। 

 

একাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মত অটল হয়ে থাকবে। অন্যকোন দিকে তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুকনা কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না।

Tuesday, October 29, 2024

আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার || আবুল আসাদ || একুশ শতকের এজেন্ডা


সেই ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম শুনি যে, ধর্ম-জ্ঞান, গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী। তারপর এই কথা নানাভাবে আরও অনেকের কাছে শুনেছি। লেখা-পড়া যাদের মূর্খ বানিয়েছে, তারা এখনও এসব কথা বলে থাকেন সুযোগ পেলেই। এদের রাগ ইসলামের উপরই বেশি। খ্রিস্টান ধর্ম প্রধানত পাশ্চাত্যের এবং হিন্দুধর্ম ভারতের, তাই এসব ধর্ম ওদের কাছে প্রগতিশীল। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র বলে ইসলামকেও ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ ও অনুন্নয়নের প্রতীক বলে চলছে। অথচ ইসলাম সবচেয়ে বিজ্ঞানমুখী ও সবচেয়ে প্রগতিশীল ধর্ম। ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই। Prof. Joseph Hell বলেন, "মানব জাতির ইতিহাসে স্বীয় ছাপ মুদ্রিত করা সব ধর্মেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ইসলাম যতটা দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্ব মানবের হৃদয় স্পর্শকারী মহা পরিবর্তন সাধন করেছে, জগতের অন্যকোন ধর্ম তা পারেনি।" এই কথাই আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ঐতিহাসিক O. J. Thatcher Ph. D এবং F. Schwill Ph. D তাদের ইতিহাস গ্রন্থে, "পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশ' বছর তার অনুগামিরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।" আর Meyrs তার Mediaeval and Modern History' তে বলেন, "সেখানে এমন এক সভ্যতার উত্থান ঘটে, দুনিয়া যা দেখেছে এমন সবকিছুকেই তা অতিক্রম করে যায়।"


সত্যই ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া-আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামণ্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন সবদিক থেকেই মানব জাতিকে ইসলাম এক অন্যান্য সভ্যতা দান করে।

পাশ্চাত্যের ওরা এখন গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সাংঘাতিক প্রবক্তা সেজেছেন। আর ইসলামকে বলা হচ্ছে মানবতা বিরোধী, অসহিষ্ণু ইত্যাদি। এসব কথা বলার সময় তারা অতিতের দিকে তাকায় না এবং নিজের চেহারার উপর একবারও নজর ফেলেনা। যে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সে সভ্যতায় গণতন্ত্রতো দূরের কথা কোনপ্রকার সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের কোন স্থান নেই। আভ্যন্তরীণভাবে তাদের নীতি ছিল 'সারভাইভেল অব দা ফিটেস্ট/ এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা অনুসারী ছিল 'মাইট ইজ রাইট'। গ্রীকরা বলতো 'যারা গ্রীক নয় তারা গ্রীকদের কৃতদাস হবে এটা প্রকৃতির ইচ্ছা।' আর রোমানরা মনে করতো, তারাই পৃথিবীর মালিক, পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের জন্যই। ইউরোপের এই অন্ধকার যুগে মানবাধিকার বলতে কোন ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। পরাজিত ও ভাগ্যাহতদের নিহত হওয়া অথবা চিরতরে দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হওয়াই ছিল ভবিতব্য। নারীদের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ অধিকার থাকা দূরের কথা তারা পূর্ণ মানুষ কিনা তা নিয়েই ছিল বিতর্ক। শত্রু ও বাদী জাতীয় লোকদের কোন মানবিক অধিকার স্বীকৃত ছিলনা।

এই দুঃসহ অন্ধকারের হাত থেকে ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে, পৃথিবীকে নিয়ে আসে আইনী শাসনের আলোকে। চৌদ্দশ' বছর আগে ইসলাম ঘোষণা করে, বংশ, বর্ণ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এই নীতি হিসেবে ইসলাম সব মানুষকেই আইনের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে রক্ষা করেছে যথেচ্ছচার থেকে। শত্রু ও পরাজিত বন্দীদেরকেও ইসলাম মানুষ হিসাবে দেখতে বলে। কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের স্থানে মানবসুলভ, মেহমানসুলভ ব্যবহার করতে বলেছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বন্দীদের সুখাদ্য দিতে হবে, বন্দীদের উত্তাপ ও শৈত্য থেকে রক্ষা করতে হবে, কোন কষ্ট অনুভব করলে দ্রুত তা দূর করতে হবে, বন্দীদের মধ্যে কোন মাতাকে তার সন্তান থেকে, কোন আত্মীয়কে অন্য আত্মীয় থেকে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান-মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের কাছ থেকে জবরদস্তী কোন কাজ নেয়া যাবে না। যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এ নীতিমালা ইসলাম দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে, পাশ্চাত্য এই শিক্ষা, আংশিকভাবে, গ্রহণ করে মাত্র ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব আকারে। ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে বিধান দেয় যে, চিকিৎসা পুরাপুরি মানবীয় সেবা। চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কোন অনিষ্ট করা যাবে না। ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করেই পাশ্চাত্য মাত্র ১৮৬৪ সালে রেডক্রস গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সুযোগকে শত্রু-মিত্র বিবেচনার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মানবতা বিরোধী দাস প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা করে ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ইসলামে পুরুষের মতই নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ইসলামের এই শিক্ষার পরও ১১শ' বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য নারীদের শিক্ষার উপযুক্ত ভাবেনি। অবশেষে ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা প্রথম স্কুলে যাবার সুযোগ পায়। আর নিজ নামে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় ১৮৪৮ সালে। অথচ ইসলাম নারীদের এ অধিকার দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে। পাশ্চাত্য যেখানে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের আগ পর্যন্ত বিজিত দেশের মানুষকে দাস মনে করতো এবং এখনও লুটতরাজের যোগ্য মনে করে, সেখানে ইসলাম বিজিত দেশের মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দেখে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোন নতুন ভূখণ্ড মুসলমানদের দখলে এলে সেখানকার মানুষকে আর শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হতোনা। মুক্ত মানুষ হিসাবে তাদের এ অধিকার দেয়া হতো যে, তারা একবছর সময়কালের মধ্যে যেন সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা পছন্দের কোন দেশে চলে যাবে, না মুসলিম দেশের নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে।

মানবতাকে ইসলাম সম্মান করে বলেই ইসলাম ও মুসলমানরা সহিষ্ণুতার প্রতীক। একটা উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে, তখন তারা ৭০ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। আর মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করে, তখন একজন খ্রিস্টানের গায়েও হাত দেয়া হয়নি। চৌদ্দশ' বছর ইসলাম যে বিচার ব্যবস্থা পত্তন করে, বিশ্ব সভ্যতায় তা অন্যান্য সংযোজন। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুরু থেকেই ইসলাম শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন, কিন্তু বিচারপতিরা শাসন-কর্তৃত্বের অধীন হতেন না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে তারা সাধারণ আসামিদের মতই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখিন হতেন। অনেক মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাবে খলিফারা হেরেছেন। এবং এই হেরে যাওয়াকে তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।

মানবাধিকারের মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম বিশ্ব সভ্যতায় অনন্য এক কল্যাণ ধারার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিস্বার্থ সমূহের পদতলে সামষ্টিক স্বার্থ নিক্ষেপ হতো। ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থ ও সামষ্টিক স্বার্থ উভয়কেই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করে এবং উভয়ের মধ্যে কল্যাণকর এক ভারসাম্য বিধান করে। সমাজের একক ইউনিট হিসেবে ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারপর পরিচয় ও সহযোগিতার জন্য বংশ ও সামাজিকতাকে এবং শাসন ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করেছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিতরণধর্মীতা ও পুঁজিগঠন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ইসলামে ম্যাক্রো অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো অর্থনীতি। ব্যক্তিগত বৈধ সম্পত্তির ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ ইসলাম করেনি, কিন্তু শর্ত দিয়েছে প্রতিবেশী কেউ যেন না খেয়ে না থাকে এবং সঞ্চয়ের বদলে সম্পদ যেন বিনিয়োগমুখী হয়। চৌদ্দশত বছর আগের ইসলামের এই অর্থনীতি আজকের আধুনিক অর্থনীতির চেয়েও আধুনিক ও কল্যাণকর।

সবশেষে আগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের কথা।

ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর ধর্ম বলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে নতুন সাজে সজ্জিত করেছে। খ্রিস্টায় এগার শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে পাশ্চাত্য যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে অষ্টম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত কাল ছিল মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মার্টন তার পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে ইসলামের অবদানকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। ৪ তাঁর এই ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ- নিরবচ্ছিন্ন এই ৩৫০ বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের চূড়ান্ত আধিপত্যের যুগ। এই সময় যেসব 
মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জারীর, খাওয়ারিজাম, রাজী, মাসুদী, ওয়াফা, বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইয়াম এবং ওমর খৈয়াম। এই বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীতে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সে আলোকে স্নাত হচ্ছিল অন্ধকার ও ঘুমন্ত ইউরোপ। ইউরোপীয় ছাত্ররা তখন স্পেন ও বাগদাদের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের পদতলে বসে জ্ঞান আহরণ করছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই ইউরোপীয় ছাত্ররাই জ্ঞানের আলোক নিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফল হিসেবে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে ক্রিমোনোর জেরার্ড, রজার বেকন- এর মত বিজ্ঞানীদের নাম সামনে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মাটনের মতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু'শ পঞ্চাশ বছরের এ সময়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার সম্মানটা মুসলমানরা ও ইউরোপ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন নাসিরউদ্দিন তুসী, ইবনে রুশদ এবং ইবনে নাফিসের মত বিজ্ঞানীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় গৌরবপূর্ণ সূর্য অস্তমিত হয় এবং পাশ্চাত্যের কাছে হারতে শুরু করে মুসলমানরা। অবশ্য এর পরেও মুসলমানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চমক কখনও কখনও দেখা গেলেও (যেমন ১৪৩৭ সালে সমরখন্দে আমির তাইমুর পৌত্র উলুগ বেগের দরবার এবং ১৭২০ সালে মোগল সম্রাটের দরবারে জীজ মোহাম্মদ শাহীর সংকলন) তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

তবে বিজ্ঞানে ছয়'শ বছরের যে মুসলিম অবদান তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং বিজ্ঞান-রেনেসাঁর জনক। মুসলমানরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থারও জনক। 'ইউরোপ যখন গির্জা ও মঠ ব্যতীত অপর সকল শিক্ষালয়ের কথা কল্পনাও করেনি, তার শত শত বছর আগে মুসলমানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, যেখানে হাজারো ছাত্র উন্নত পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতো। গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নও ইসলামি সভ্যতার অবদান। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল লাখো গ্রন্থে ঠাসা। ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর তখন ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক Dosy-এর মতে স্পেনের আলমেরিয়ার ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অসংখ্য পুস্তিকা ছাড়া শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ। এসব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারটি ছিল বিজ্ঞান-

চর্চা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির সুতিকাগৃহ। বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের গৌরবজনক বিচরণ। গণিত শাস্ত্রে রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। আমরা যে ৯ পর্যন্ত নয়টি সংখ্যা ব্যবহার করি, তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। কিন্তু 'শূন্য' (Zero)-এর বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা সর্বপ্রথম 'শূন্য' আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে ইনিই সর্বপ্রথম 'দশমিক বিন্দু' (decimal notation) ব্যবহার করেন। সংখ্যার স্থানীয় মান' (value of position) তারই আবিষ্কার। বীজগণিত বা 'এলজেব্রা' মুসলমানদের সৃষ্টি। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল জাবের-এর নাম অনুসারে'এলজেব্রা' নামকরণ হয়। শিঞ্জিনী (sine), সার্শ-জ্যা (tangent) ও প্রতি স্পর্শ-ক্যক (co-tangent) প্রভৃতি আবিষ্কার করে বর্তুলাকার ক্রিকোণমিতির উন্নতি করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আলোক বিজ্ঞানে focus' নির্ণয়, চশমা আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজানের কীর্তি। কিন্তু রজার বেকন এই আবিষ্কার পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কারক সেজেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে 'মানমন্দির' (observatory) ব্যবহার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। এর আগে 'মানমন্দির' সম্পর্কে কোন ধারণা কারও ছিল না। গণনা দ্বারা রাশি- চক্রের কোণ (angle of the ecliptic), সমরাত্রি দিনের প্রাগয়ন (pre- cission of the equinoxes), Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মন্ত্রকোর্দ্ধ নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু), প্রভৃতির উদ্ভাবন মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চিকিৎসার বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দান করেন।
ইউরোপ যখন খ্রিস্টান গির্জা ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা রোগের ব্যবস্থা দিতেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান মুসলমানদের হাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীয় আল রাজীর চিকিৎসা বিষয়ক 'বিশ্বকোষ' দশখণ্ডে সমাপ্ত। এই চিকিৎসা বিশ্ব-কোষ ও ইবনে সিনা'র ব্যবস্থা' ইউরোপী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল। বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা কেমিস্ট্রির নামকরণই হয় মুসলিম বিজ্ঞানী 'আল কেমী'র নাম অনুসারে। কেমিস্ট্রি'-এর সুবাসার (Alcohol), কাঠ ভষ্ম-ক্ষারের ধাতার্বকমূল (patassium), পারদ বিশেষ (corrosive sublimate), কার্ষকি (Nitrate of silver, যবক্ষার দ্রাবক (Nitric Acid) গন্ধক দ্রাবক (Sulphuric Acid), জুলাপ (Julep), অন্তসার (Elixer), কপূর (Caurphar), এবং সোমামুখী (senna), প্রভৃতি। মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইউরোপ যখন মনে করতো পৃথিবী সমতল, তখন বাগদাদে গোলাকার পৃথিবীর পরিধী নির্ণিত হয়েছিল। চন্দ্র যে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, একথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা জানতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের কক্ষ নির্ধারিত করেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ কম্পাস যন্ত্র মুসলিম বিজ্ঞানির আবিষ্কার। মুসলমানরা নকশার বৈচিত্র ও সৌন্দর্য এবং শিল্প কৌশলের পূর্ণতা বিধানে ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বি। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, লৌহ, ইস্পাত, প্রভৃতির কাজে তারা ছিলো দক্ষ। বস্ত্র শিল্পে এখনও মুসলমানদের কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। উত্তম কাচ, কালী, মাটির পাত্র, নানা প্রকার উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুত করাসহ রং পাকা করার কৌশল ও চর্ম-সংস্কারের বহুবিধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম কুশলীরা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। তাদের এসব কাজ ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল। সিরাপ ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে মুসলমানদের ছিল একাধিপত্য। মুসলমানদের কৃষি পদ্ধতি ছিল খুবই উন্নত। তারা স্পেনে যে কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করেন, ইউরোপের জন্য তা তখনও বিস্ময়। পানি সেচ পদ্ধতি তাদের উৎকৃষ্ট ছিল। মাটির গুণাগুণ বিচার করে তারা ফসল বপন করতেন। সারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা জানতেন। 'কলম' করা ও নানা প্রকার ফল-ফুলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে তারা ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ।

বহু শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বাণিজ্য-জগতের ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। নৌ যুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ছিলেন অতুলনীয় সমুদ্রচারী। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত সাগর ও চীন সাগরে এককভাবে চষে ফিরত। মুসলিম নাবিকদের ছাত্র হিসাবেই ইউরোপীয়রা গভীর সমুদ্রে প্রথম পদচারণা করে। ভন ক্রেমার বলেন, আরব নৌবহর ছিল বহু বিষয়ে খ্রিস্টানদের আদর্শ।' মুসলমানদের যুদ্ধ-পদ্ধতি ও যুদ্ধ বিদ্যাও ইউরোপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ইউরোপের Chivalry স্পেনীয় মুসলিম বাহিনীর অনুকরণ।


মোট কথা, বলা যায়, মুসলমান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার যে অবদান রাখেন, তা এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, বিশ্ব সভ্যতাকে করে নতুন এক রূপে রূপময় যা চিন্তা, চেতনা, আচার-আচরণ, জীবন-যাপন, জীবনাপোকরণ সবদিক দিয়েই আধুনিক। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে সভ্যতার এই নতুন-উত্থান- যাত্রা থেমে না গেলে আরও কয়েকশ' বছর অগেই বিশ্ব আধুনিক বিজ্ঞান যুগে প্রবেশ করতো। কিন্তু তা হয়নি। না হলেও তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকশ' বছর পরে হলেও মুসলমানদের কাজ সম্পন্ন করেছে। ইসলামি সভ্যতাকে বাদ দিলে বা মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আর থাকে না, তার সভ্যতাও অন্ধকারে তলিয়ে যায়।


লিওনার্দো এজন্যই লিখেছেন, "আরবদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও মানসিক সমৃদ্ধি এবং অভ্রান্ত শিক্ষা-প্রথা বিদ্যমান না থাকলে ইউরোপকে আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকতে হতো।


রেফারেন্স:
১। S. Khuda Bakhsh, M. A. BCL. Bar-at Law, প্রণীত 'Arab civilization গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৬
২। 'A general History of Europe, Vol-1 Page-172 ৩। Mayers, 'Mediaeval and Modern History' Page-54
৪। নোবেল বিজ্ঞানী আবদুস সালাম' এর 'Ideas and Realities' গ্রন্থে উদ্ধৃত
(বাংলা অনুবাদঃ 'আদর্শ ও বাস্তবতা,' পৃষ্ঠা, ২৬৮ ৫। Mayers, "Mediaeval and Modern History, Page, 56
৬। Dozy, Spanish Islam'. Page 610
৭। Thateher Ph. D and F. Schwill Ph. D. 'A general History Europe', vol-1 page, 173
৮। Von Kremar এই উক্তি S. khuda Bakhsh এর 'Arab civilization' এর উদ্বৃত, Page, 72
৯। Thatcher and F. Schwill, 'A general History of Europe, Vol-1 pages, 174-188

Wednesday, October 9, 2024

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ হতে যুগান্তকারী ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’



৯ অক্টোবর বুধবার দুপুরে ঢাকার গুলশানস্থ হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষকদের সামনে স্বাগত বক্তব্য পেশ করেন। আমীরে জামায়াতের পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ উপস্থাপন করেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের।

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, জনাব হামিদুর রহমান আযাদ সাবেক এমপি, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান মিলন ও জনাব মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা সকলেই জানি দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর একটি দল ও তাদের দোসররা ক্ষমতায় ছিলেন। তারা দেশকে যে শাসন উপহার দিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের মানুষকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিল। এর লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক হয়েছিলেন। তাদের অপশাসনের হাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। এমনকি রাস্তার ভিক্ষুকও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। শিশু-বৃদ্ধ সকলেই এই কুশাসনের নজরে পড়েছিলেন। গত জুলাই মাসে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সরকারের পতন ঘটে। বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন। অনেকেই হাজারো মামলায় পড়েছেন, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন, অনেকের ওপর আঘাত এসেছে, আমরা তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

আমরা মনে করি সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই দেশে এমন একটি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে। যার সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারির পর। তার পূর্ণতা পেয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এটা ঠিক রাজনৈতিক দল এবং পক্ষ দফায় দফায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দলের নাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই দলের ১১ জন শীর্ষ নেতাকে মিথ্যা অযুহাতে সাজানো আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অপশাসনের প্রতিবাদ করেছেন এমন হাজারো মানুষকে দুনিয়া থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। আয়নাঘর নামক কুখ্যাত কূপখানায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। তাদেরকে দিনের পর দিন নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নয়, মাসের পর মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের পরিবার জানতো না, আদৌ তারা বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। যদি তারা চলে গিয়ে থাকেন তাহলে তাদের লাশটি কোথায়? কখন কীভাবে তাদেরকে দাফন করা হয়েছে কিছুই তারা জানেন না। খুব অল্প সংখ্যক সৌভাগ্যবান মানুষ ফিরে এসেছেন সেই কুখ্যাত আয়নাঘর থেকে। বাকীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে এ জাতি জানে না এবং তাদের আপনজনও জানে না। এইসব ব্যথিত আপনজনদের সাথে আমরাও সমানভাবে ব্যথিত।

তিনি আরও বলেন, অপশাসনের কালো অধ্যায় আল্লাহ তাআলা তার মেহেরবানী দিয়ে সাহায্য করে অপসারিত করেছেন গত ৫ আগস্ট। এজন্য মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি আরেকবার আলহামদুলিল্লাহ। শেষ পর্যন্ত আমাদের তরুণ-তরুণীদের হাতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। আমি আরেকবার তাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।

উপস্থিত প্রিয় সাংবাদিক এবং দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় সংগঠনের পক্ষ থেকে আপনাদের এবং জাতির জন্য আমাদের ভালবাসা। আমরা মৌলিক কী কী সংস্কার প্রয়োজন মনে করি সেই ভাবনা এখনই আপনাদের সামনে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। আমাদের ভাবনাগুলো অনলাইনের মাধ্যমে আপনাদের হাউজ-এ আমরা পৌঁছাব। আমরা আপনাদের প্রতি আবারো শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ জাতির উদ্দেশে তুলে ধরা হলো:

“রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
৯ অক্টোবর ২০২৪

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি- আলহামদুলিল্লাহ। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামীন তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকারের সাথে সমঝোতা করে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে। তারা দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য সংবিধানসহ সিভিল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে।তারা নিজেদের সুবিধামত সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়া হয়। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধীমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। হত্যা, গুম এবং মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করে জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালানো হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান সেক্টরের সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো।

ডা. শফিকুর রহমান
আমীর
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।


১। আইন ও বিচার

● উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

● বিচার বিভাগ থেকে দ্বৈত শাসন দূর করতে হবে।

● বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

● আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও গণমানুষের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল আইন প্রণয়ন করতে হবে।

● ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ওসকল কালো আইন বাতিল করতে হবে।

● বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● নিম্ন আদালতের যথাযথ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে।

● সকল ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

● দেওয়ানি মামলার জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং ফৌজদারি মামলাসমূহ সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করতে হবে।




২। সংসদ বিষয়ক সংস্কার

● সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে।

● সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

● সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।




৩। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার

● জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (Proportional Representation-PR) চালু করতে হবে।

● সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে।

● নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রত্যাখ্যাত ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।

● কোনো সরকারি চাকরিজীবী তাদের চাকরি ছাড়ার কমপক্ষে ৩ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

● স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে।

● অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ২০০৮ সালে প্রবর্তিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা বাতিল করতে হবে।

● নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হবে।

● জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

● NID-ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনতে হবে।




৪। আইনশৃঙ্খলা সংস্কার

ক) পুলিশ বাহিনীর সংস্কার

● ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য একটি পলিসি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

● পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যূতির জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।

● নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যূতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না তথা সর্বপ্রকার দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব বা হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

● পুলিশ ট্রেনিং ম্যানুয়ালের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

● পুলিশের মধ্যে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল করতে হবে।

● রিমান্ড চলাকালে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি এবং মহিলা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

● বিচার বিভাগীয় সদস্যদের দ্বারা পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকতে হবে।

● পুলিশের ডিউটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে।

● ‘পুলিশ আইন’ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করতে হবে।




খ) র‌্যাব বিষয়ক সংস্কার

● র‌্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।

● গত সাড়ে ১৫ বছর যারা র‌্যাবে কাজ করেছে তাদেরকে স্ব স্ব বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদেরকে পুনরায় র‌্যাবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

● বিচারবহির্ভূত সকল প্রকার হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে।

● র‌্যাবের সামগ্রিক কার্যক্রম মনিটরিং-এর জন্য সেল গঠন করতে হবে। কোনো র‌্যাব সদস্য আইনবহির্ভূত কোনো কাজে জড়িত হলে এই সেল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবে।

● মিডিয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।




৫। জনপ্রশাসন সংস্কার

● জনবল নিয়োগ, বদলি, পদায়নে তদবির, সুপারিশ ও দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

● যে কোনো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ না করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।

● সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনামূল্যে করতে হবে।

● চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আগামী ২ বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে।

● চাকরির আবেদনে সকল ক্ষেত্রে বয়সসীমার বৈষম্য নিরসন করতে হবে।

● সকল সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি নিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে করে কেউ দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়। এ জন্য প্রয়োজনীয় মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।

● চাকরিতে বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে।

● বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি চাকরিতে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও দলীয় বিবেচনায় চাকরি পেয়েছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।




৬। দুর্নীতি

● দুর্নীতি দমন কমিশনে পরীক্ষিত সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।

● রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

● দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।

● বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

● মন্ত্রণালয় ভিত্তিক দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে।

● দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনসংস্কার, জনবল ও পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।

● রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ দখলকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে।




৭। সংবিধান সংস্কার

● রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে।

● একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।




৮। শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কার

ক) বিরাজমান সমস্যার আলোকে শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাব

● ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চমাধ্যমিক হিসেবে বলবৎ রাখতে হবে। অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে পূর্বের পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

● পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে হবে।

● সকল শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দিতে হবে।

● সকল শ্রেণিতে নবী করিম সা. এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনী সংবলিত প্রবন্ধ সংযোজন করতে হবে।

● স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যমান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে সরকারিকরণ করতে হবে।

● প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে কামিল মাদরাসাকে সরকারিকরণ করতে হবে।

● কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।

● Department of Higher Education নামে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে।

● শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সকল ধারা তথা সাধারণ, আলিয়া, কওমীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।




খ) সংস্কৃতি সংস্কার

● জাতির ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মূল্যবোধের আলোকেবিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।

● জাতির ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।

● নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো অশ্লীলতামুক্ত করতে হবে। নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন কন্টেন্টে বিভিন্ন ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামকে হেয় করা থেকে বিরত থাকার বিধান প্রণয়ন করতে হবে।

● প্রাণীর মূর্তিনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ না করে দেশীয় প্রকৃতি, ঐতিহ্যকে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন-ভাস্কর্যে তুলে আনতে হবে।

● সকল গণমাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রচার নিশ্চিত করতে হবে।




৯। পররাষ্ট্র বিষয়ক সংস্কার

● পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল গণতান্ত্রিক দেশের সাথে সাম্য ও নায্যতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

● জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগনিতে হবে।

● আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে।

● অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বিগত সরকারের আমলে সম্পাদিত সকল চুক্তি রিভিউ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটিরিভিউ কমিশন গঠন করতে হবে।

● বাংলাদেশকে আসিয়ান জোটভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● শক্তিশালী SAARC পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● কোনো দেশের সাথে চুক্তি অথবা সমঝোতা চুক্তি হলে পরবর্তী সংসদঅধিবেশনে সেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক উত্থাপন করে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বক তা অনুমোদন করতে হবে।




১০। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কার

● ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে (ইফাবা) রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

● ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে স্বতন্ত্র সংস্থা বা দপ্তরে রূপান্তর করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

● ইসলামিক মিশনকে সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● হজ্জব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● হজ্জ ও উমরার খরচ কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● ইসলামিক ফাউন্ডেশনে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে দেশের বরণ্যে আলেমগণ সম্পৃক্ত থাকবেন।

● বিতর্কিত সকল বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে।

● সকল ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।