Close

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী। সূরা আল মু'মিনুন এর ১ম রুকু (১ থেকে ১১ নং আয়াত)

দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী
সূরা আল মু'মিনুন, 
 সুরা নং-২৩, আয়াত নং- ১ থেকে ১১ 

الرَّحِيمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ 1

 الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ 2

 وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ 3

 وَالَّذِينَ هُمْ لِلرَّكوة فَعِلُونَ 4

 وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ 5

 إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَةٌ 6

 فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ 7

 وَالَّذِينَ هُم لاَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَعُونَ 8

 وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلوتِهِمْ يُحَافِظُونَ 9

 أولئك هم الورثونه 10

 الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَهُمْ فِيهَا خَلِدُونَ 11 .

সরল অনুবাদ: ইরশাদ হচ্ছে 
(১) অবশ্যই (সেই সব) মু'মিনেরা সফলকাম হয়ে গেছে, 
(২) যারা তাদের নামাযে বিনয়ী-নম্র। 
(৩) যারা ৰাজে বা বেহুদা কথা-কাজ থেকে দূরে থাকে, 
(৪) যারা তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর। 
(৫) এবং যারা তাদের যৌনাঙ্গকে (অবৈধ ব্যবহার থেকে) হেফাজত করে। 
(৬) তবে তাদের স্ত্রীদের এবং অধিনস্থ দাসীদের বেলায় (যৌনাঙ্গ) হেফাজত না করলে তারা তিরস্কৃত হবে না। 
(৭) তবে কেউ যদি এদের ছাড়া অন্য কাউকে (যৌনক্ষুধা মেটার জন্য) কামনা করে, তবে (এক্ষেত্রে) তারা হবে সীমালংঘনকারী। 
(৮) আর যারা তাদের আমানত এবং প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে হুশিয়ার থাকে। 
(৯) এবং যারা তাদের নামায সমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। 
(১০) তারাই (অর্থাৎ এসব গুণের অধিকারীরাই) হবে উত্তরাধিকারী। 
(১১)  তারা শীতল ছায়াঢাকা উদ্যানের (অর্থাৎ জান্নাতুল ফেরদাউসের) উত্তরাধিকারী হবে এবং তাতে তারা চিরকাল থাকবে । 

সূরার নামকরণঃ অত্র সূরার প্রথম আয়াত قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ এর ‘আল-মু’মিনুন' শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। যদিও নামকরণের ক্ষেত্রে সব বিষয়ের সাথে মিল রেখে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় না । কিন্তু এই সূরার ১ম থেকে ১১ নং আয়াত পর্যন্ত একই সাথে মু'মিনদের বৈশিষ্ট সম্পর্কে যেসব গুণের কথা পেয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, এই সূরার বিষয়ের সাথে নামকরণের বেশ মিল আছে।

নাযিল হবার সময়কাল: সূরার বর্ণনাভঙ্গী এবং বিষয়বস্তু থেকে প্রমাণ হয় যে, এটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময় নাযিল হয়েছিলো। বিধায় সুরাটি মাক্কী। হযরত ওমর (রাঃ) এর এক উক্তি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর এর বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়— এ সময় হযরত উমর (রাঃ) সবেমাত্র ঈমান এনেছিলেন। আর হযরত উমরের ইসলাম কবুলের সময় ছিলো রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরের শেষের দিকে। এ হাদীসে হযরত উমর (রাঃ) নিজে বলেন : “এ সূরাটি তার সামনেই নাযিল হয়েছে। তিনি নবী করীম (সাঃ) এর উপর ওহী নাযিলের যে বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হয় তা দেখতে পান। পরে নবী করীম (সাঃ) যখন সেই অবস্থা থেকে অবসর পেলেন, তখন তিনি আমাদেরকে বললেন : “এইমাত্র আমার প্রতি এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যদি কেউ তার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে তবে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতে চলে যাবে।” অতঃপর তিনি এই সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শুনালেন। (আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও হাকেম।) 

সূরাটি নাযিলের সময় মক্কায় রাসূল (সাঃ) এর সাথে কাফেরদের প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব চলছিলো। তবে তখনো কাফেরদের যুলুম নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেনি । তাছাড়া সূরাটি নাযিলের সময় মক্কায় চরম দুর্ভিক্ষও চলছিলো।

বিষয়বস্তু : এই সূরাটির মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আনুগত্য । তিলাওয়াতকৃত ১১টি আয়াতের মূল বিষয় হচ্ছে, যেসব লোক এই নবীর কথা মেনে নেবে, তাদের মধ্যে এসব গুণ সৃষ্টি হবে। আর নিঃসন্দেহে এসব লোকেরাই দুনিয়া এবং আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে ।

সূরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব : মুসনাদে আহমদ কিতাবের এক বর্ণনায় হযরত উমর ফারুক (রাঃ) বলেন : রাসূল (সাঃ) এর উপর যখন ওহী নাযিল হতো, তখন পাশের লোকজনের কানে ঘন্টার ধ্বনি বা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আওয়াজ হতো। একদিন তাঁর কাছে এমনি ধরনের আওয়াজ পেয়ে আমরা সদ্যপ্রাপ্ত ওহী শুনার জন্য থেমে গেলাম ৷ ওহীর বিশেষ অবস্থা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেবলামুখী হয়ে বসে গেলেন এবং এই দোআ পাঠ করতে লাগলেন :

اللهمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تَهَنَا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمُنَا وَأَيْرُنَا وَلَا تُؤْثِرُ عَلَيْنَا وَارْضَ عَنَا وَارْضَنَا

“হে আল্লাহ আমাদের বেশী বেশী দাও- কম দিও না। আমাদের সম্মান বাড়িয়ে দাও- লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান করো মাহরূম করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও- অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ো না এবং আমাদের প্রতি রাযি-খুশী থাকো আর আমাদেরকে তোমার রাযীতে রাযী করো।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে বললেন : এখনই আমার উপর যে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। যে কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে চলে যাবে এরপর তিনি এই সূরার ১ম দশটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন ।

ইমাম নাসায়ী তাঁর কিতাবের তাফসীর অধ্যায়ে ইয়াযীদ ইবনে বাবনুস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি একবার হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর চরিত্র কেমন ছিলো? তিনি (আয়েশা) বলেছিলেন : তাঁর চরিত্র আল কুরআনে বর্ণিত আছে। অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে বললেন : এগুলোই ছিলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র। (ইবনে কাসীর)

শানে নুযুল : অত্র সূরা বিশেষ করে এই আয়াতগুলো নাযিলের সময় প্রেক্ষাপট ছিলো এই যে, এ সময় একদিকে মক্কার কাফের সর্দারেরা ইসলামী দাওয়াতের চরম বিরোধী ছিলো। তাদের ব্যবসা-বানিজ্য ছিলো উন্নতমানের এবং চাকচিক্য পূর্ণ। তাদের টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ ছিলো প্রচুর । দুনিয়া স্বাচ্ছন্দের সব উপায় উপকরণ তাদের নাগালের মধ্যে ছিলো। আর অপরদিকে ছিলো ইসলামের অনুসারী রাসূলের সংগী-সাথীরা । এদের মধ্যে কিছু লোক যারা স্বচ্ছল ছিলো এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা আগে থেকেই সাফল্য মণ্ডিত হচ্ছিলো। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত কবুল করার ফলে কাফেরদের চরম বিরোধিতার কারণে তাদেরকে খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এতে কাফের সর্দারেরা নিজেদেরকে বেশী সফল ও সার্থক বলে দাবী করতো এবং নবীর অনুসারীদেরকে বিফল ও ব্যর্থ মনে করতো। তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করলেন, নিশ্চয়ই কল্যাণ বা সফলতা লাভ করেছে ইসলামের দাওয়াত কবুলকারী রাসূলের অনুসারীরা । আর কাফেরেরা দুনিযায় যে সফলতা এবং স্বার্থকতার দাবী করছে, এটাই প্রকৃত সফলতা ও স্বার্থকতা নয়, বরং আখেরাতের সফলতাই হলো প্রকৃত এবং স্থায়ী সফলতা ।

ব্যাখ্যাঃ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ - “অবশ্য অবশ্যই ঈমান গ্রহণকারী - লোকেরা কল্যাণ বা সফলতা লাভ করেছে।”

মু'মিন কারাঃ এখানে ঈমান কবুলকারী বা মু'মিন বলে সেসব লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দাওয়াত কবুল করেছে, তাঁকে যারা নিজের মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক ও নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং তাঁর উপস্থাপিত জীবন যাপনের নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে প্রস্তুত হয়েছে।

‘ফালাহ’ শব্দের মানে-কল্যাণ, সাফল্য এবং স্বাচ্ছন্দ। এটা (খুশরান) বা ক্ষতি বা ব্যর্থতার বিপরীত। সাফল্য শব্দটি কুরআন এবং হাদীসে ব্যাপক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আযান ও একামতে প্রতিদিন পাঁচবার প্রতিটি মুসলমানকে ডাকা হয়। এর প্রকৃত অর্থ হলো প্রত্যেক মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়া এবং প্রতিটি কষ্ট দূর হওয়া। এ শব্দটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর অর্থ সুদূর দুনিয়ার কোন মানুষ বা শক্তির পক্ষে মানুষের প্রতিটি মনোবাঞ্ছা পূরণ করা এবং প্রতিটি কষ্ট বিদূর করা সম্ভব নয়। এটা পারেন একমাত্র বিশ্ব জাহানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাবারাকাওয়া তাআলা ।

পুরোপুরিভাবে সফলতা লাভ করা দুনিয়াতে কোনভাবেই সম্ভব নয় । এটা একমাত্র আখেরাতে জান্নাত লাভের মাধ্যমেই হতে পারে। কুরআন এবং হাদীসে যেখানেই এই ‘ফালাহ' বা সফলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে- তা চিরস্থায়ী আখেরাতের সফলতার কথাই বলা হয়েছে। এখানেও মক্কার কাফের সর্দারদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরত্তর সফলতার বড়াই এর পরিপেক্ষিতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন : তোমরা দুনিয়ার যে সফলতা এবং স্বার্থকতার বড়াই করছো এটাই প্রকৃত সফলতা বা স্বার্থকতা নয় । তোমাদের এই সফলতা ক্ষণস্থায়ী। বরং মুমিন লোকদের জন্য আখেরাতের যে সফলতা সেটাই হচ্ছে প্রকৃত এবং চিরস্থায়ী সফলতা । বর্তমানে আমাদের সমাজেও অনুরূপ লোক দেখা যায়। প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরত্তর উন্নতির জন্য এবং নিজের সন্তানদের লেখা-পড়ার ভাল ফলাফল ও দামী চাকুরী পাবার কারণে নিজেকে সফল হয়েছে বলে বড়াই করে। অথচ আখেরাতের জন্য সে কোন কাজই করে না। তাদের দুনিয়ায় এ ধরনের বড়াই পরকালে কোনো কাজেই আসবে না। বরং তারাই ব্যর্থ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যারা মুমিন, ইসলামের পথে চলার জন্য দুনিয়ায় বাধাগ্রস্ত হয়ে কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করতে হয়েছে, বাতিলের বিরোধিতা এবং হামলার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকুরী-বাকরী ক্ষতি হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে তারাই আখেরাতে নেয়ামতে ভরা জান্নাত লাভের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সফলতা লাভ করবে ।

আল-কুরআনে অন্যত্র সূরা আ'লায় সাফল্য লাভের ব্যবস্থা পত্র দিতে গিয়ে বলা হয়েছে - قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى অর্থাৎ “যে নিজেকে পাপ কাজ থেকে পবিত্র রেখেছে সেই সফলকাম হয়েছে।” এর সাথে সাথে আরও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, পরিপূর্ণ সফলতা লাভের জায়গা আসলে দুনিয়া নয় পরকাল । যে সফলতা কামনা করে, তার কাজ শুধু দুনিয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা নায়। এ সম্পর্কে সূরা আ'লায় আরো বলা হয়েছে— بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيُوةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَابْقى

(হে মানুষ!) “তোমরা দুনিয়াকেই পরকালের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছো । অথচ দুনিয়ার তুলনায় পরকালের জীবন অতি উত্তম এবং স্থায়ী।” সুতরাং পরিপূর্ণ এবং স্থায়ী সফলতা তো একমাত্র পরকালে জান্নাতেই পাওয়া যেতে পারে- দুনিয়া এর স্থান নয়। তবে দুনিয়াতেও আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রকৃত বান্দাদের মনের প্রশান্তির মাধ্যমে সফলতা দান করে থাকেন ৷

মু'মিনদের সাতটি গুণ:-

আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা সেই সব মু'মিনদেরকে সফলতা দানের ওয়াদা করেছেন যাদের মধ্যে সাতটি গুণ রয়েছে। সর্ব প্রথম গুণ হচ্ছে ঈমানদার হওয়া। কিন্তু এটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুণের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে । নীচে সেগুলো ধারাবাহীকভাবে আলোচনা করা হলোঃ

প্রথম গুণঃ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ  অর্থাৎ "যারা তাদের নামাযে বিনয়ী-নম্র।” নামাযে ‘খুশূ’ বলতে বিনয়-নম্র হওয়া বুঝায় ৷ ‘খুশূর’ আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। শরীয়াতের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকা; অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে না করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও স্থির থাকা; অর্থাৎ অনর্থক নড়াচড়া না করা । (বয়ানুল কুরআন)। তাছাড়া এর আরো অর্থ হলো কারও সামনে বিনয়াবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, লুণ্ঠিত হওয়া, নিজের কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা ইত্যাদি ।

দিলের ‘খুশূ’ হয় তখন, যখন কারও ভয়ে ও দাপটে দেল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। আর দেহের ‘খুশৃ’ এভাবে প্রকাশ পায় যে, কারও সামনে গেলে তার মাথা নীচু হয়ে যায়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে পড়ে, চোখের দৃষ্টি নতো হয়ে আসে, গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায় । ভীত সন্ত্রস্ত হবার সেসব লক্ষণই বেশী প্রকাশ হয়ে পড়ে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মহাশক্তির প্রচণ্ড দাপটের অধিকারী কোনো সত্তার সামনে হাজির হয়। আর নামাযে ‘খুশূ’ বলতে বুঝায় মন ও দেহের অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়াকে । কেননা নামাযী তার মহাশক্তিধর প্রভুর সামনে হাজির হয় ।

নামাযে বিনয় ও একাগ্রতা বা খুশু-খুজু পয়দা হবার জন্য নামাযের বাহ্যিক কাজেরও বেশ প্রভাব রয়েছে। ইসলামী শরীয়াতে নামাযের যেগুলো নিয়ম-নীতি ও কায়দা-কানুন হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তা যথাযত ভাবে নিষ্ঠার সাথে আদায় করলে মনের একাগ্রতা বা খুশূ সৃষ্টির জন্য সাহায্য করে। আবার সেসব কাগুলো ঠিকমত না করলেও নামাযের একাগ্রতা ও খুশূ সৃষ্টিতে বাধা দেয় ৷

নামাযের যেসব বাহ্যিক কাজ নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ পয়দায় বাধা সৃষ্টি করে তা হলোঃ

→ নামাযের মধ্যে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা বা নড়া-চড়া করলে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে- একবার নবী করীম (সাঃ) এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে মুখের দাড়ী নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন :

لَوْ خَشِعَ قَلْبَهُ خَشِعَتِ جَوَارِحِه

“যদি এ লোকটির দেলে খুশূ থাকতো তাহলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরেও খুশূ বা স্থিরতা থাকতো।” (মাযহারী)

→ নামাযে এদিক ওদিক তাকালে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়। বুখারী এবং তিরমিযী শরীফের হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি নবী করীম (সাঃ) কে নামাযে এদিক ওদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় রাসূল (সাঃ) বললেন :

هُوَ اِخْتِلَاسُ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلَاةِ الْعَبْدِ “এটা নামাযীর (মনোযোগের) উপর শয়তানের থাবা ।”

→ নামাযে ছাদ বা আকাশের দিকে তাকালে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ . নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ আছে। হযরত জাবির বিন সামুর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন :

لَيَنْتَهِينَ أَقْوَامٌ يَرْفَعُونَ اَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِي الصَّلَاةِ أَوْلَا تَرْجِعُ إِلَيْهِمُ

“লোকেরা যেনো নামাযে তাদের চোখকে আকাশমুখী না করে। (কেননা তাদের চোখ) তাদের দিকে ফিরে নাও আসতে পারে।” (অর্থাৎ নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট করে দিবে।)” (মুসলিম)।

→ নামাযে হেলা-দোলা করা ও নানা দিকে ঝুকে পড়লে নামাযের

একাগ্রতা বা খূশূ নষ্ট হয়ে যায়।

→ পরনের জামা-কাপড় বারবার গুটানো বা ঝাড়া কিংবা তা নাড়াচাড়া করলে নামাযের একাগ্রতা বা খুশূ নষ্ট হয়ে যায়।

→ সিজদায় যাবার সময় বসার জায়গা বা সিজদাহর জায়গা বারবার পরিষ্কার করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। (তবে ক্ষতিকারক হলে একবার সরানো যাবে )

এসম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন :

إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ فِي الصَّلَاةِ فَلَا يَمْسَحِ الْحَصَى فَإِنَّ

الرَّحْمَةَ تُوَاجِهة

“কোন ব্যক্তি যেন নামাযের অবস্থায় (সিজদাহর জায়গা হতে) কংকর না সরায়। কেননা আল্লাহর রহমত নামাযী ব্যক্তির সামনে প্রসারিত হয়। (আহমদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ও ইবনে মাযাহ) ।

→ একটানা ভাবে গর্দান খাড়া করে দাঁড়ানো, খুব কর্কর্ষ সূরে কোরআন পাঠ করা কিংবা গীতের সূরে কেরআত পাঠ করলে নামাযের খুশূ বা বিনয়তা নষ্ট হয়ে যায় ।

জোরে জোরে হাই এবং ঢেকুর তোললে, ইচ্ছা করে গলা খেকাড়ী বা কাশি দিলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়। হাদীসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ التَّنَانُ مِنَ الشَّيْطَانِ، فَإِذَا تَشَاءَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَكْظِمْ مَا

اسْتَطَاعَ

“নামাযে হাই উঠে শয়তানের প্রভাব থেকে । যদি কারো হাই উঠে তবে সে যেনো সাধ্যমত হাই প্রতিরোধ করে।” (মুসলিম, তিরমিযী)।

→ খুব তাড়াহুড়ো করে নামায আদায় করলে নামাযের বিনয়তা বা একাগ্রতা থাকে না। এ সম্পর্কে “হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসে মহানবী (সাঃ) ‘মুখতাসির' (অর্থাৎ নামাযের কাজগুলোকে হাল্কা ও ঝটপট) রূপে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন । ”

→ নামাযের রুকু, সিজদাহ, কিয়াম, বৈঠক সঠিকভাবে আদায় না করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়। হাদীসে আছে “নোমান ইবনে মোররাহ বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন : মদখোর, ব্যভিচারী ও চোর সম্পর্কে তোমাদের মতামত কি? তারা বললেন : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাঃ) বললেন : ওগুলো কবীরা গোনাহ এবং এর সাজাও খুব। (এবার শুনে নাও) সবচেয়ে জঘন্য চুরি হলো সেই চুরি যে ব্যক্তি নামাযে চুরি করে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, নামাযে আবার চুরি কিভাবে হয় হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন : যে নামাযে রুকু ও সেজদাহ্ ঠিকমত করে না” (মালেক, আহমদ, দারেমী, মেসকাত )

→ নামাযীর সামনে পর্দায় কোন ছবি বা সিনারী থাকলে নামাযের খুশূ বা একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়। “হযরত আনাস (রাঃ) বলেন : হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর একটি কাপড়ের পর্দা ছিলো তিনি তা ঘরের একদিকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন । এতে নবী করীম (সাঃ) বললেন : তুমি এ পর্দাটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে রাখো । কারণ এর ছবিগুলো সর্বদা আমার নামাযের ক্ষতি (অর্থাৎ একাগ্রতা নষ্ট) করে।” (বুখারী)

অন্তরের যেসব কাজ নামাযের খুশূ বা একাগ্রতা নষ্ট করে তাহলো :

→ নামাযের মধ্যে জেনে শুনে অপ্রাসংগিক কথা-বার্তা চিন্তা বা খেয়াল করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বে কোনো চিন্তা ভাবনা মনে জাগলে তা জাগতে পারে। মানুষের এটা স্বাভাবিক ব্যাপার । কেননা শয়তান মানুষের মনে আসওয়াসা দিয়ে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট করার জন্য সদাসর্বদা চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। এ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) হাদীসে বলেন : “নামাযের জন্য যখন আযান দেয়া হয় তখন শয়তান পিঠ ফিরিয়ে বাতকর্ম করতে করতে পালাতে থাকে- যাতে সে আযানের ধ্বনি না শুনতে পায়। অতঃপর যখন আযান শেষ হয়ে যায় তখন সে ফিরে আসে। আবার যখন একামত বলা হয় তখন সে পিঠ ফিরিয়ে পালাতে থাকে এবং যখন একামত শেষ হয়ে যায় তখন ফিরে আসে ও মানুষের মনে (একাগ্রতা নষ্ট করার জন্য) খটকা দিতে থাকে। সে বলে : অমুক বিষয়ে খেয়াল করো, অমুক অমুক বিষয়ে খেয়াল করো- যেসব বিষয় তার মনে ছিলো না। অবশেষে নামাযী এরূপ (অমনোযোগী) হয়ে যায় যে, সে বলতে পারে না কত রাকাআত নামায পড়েছে।” (আবু হুরাইরা, বুখারী, মুসলিম)।

নামাযে অন্তরের খুশূ বা একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য যেসব কাজ করতে হবে-

→ নামাযে সব সময় আল্লাহ তাআলাকে হাজির-নাজির জানতে হবে। নামাযী যখন নামাযে দাঁড়বে তখন সে মনে করবে যেনো সে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে। এ সম্পর্কে “হাদীসে জিবরীলে” “ইসান' সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) কে জিবরাঈল (আঃ) প্রশ্ন করলে, তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন :

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ “তুমি এভাবে আল্লাহর ইবাদাত (নামায আদায়) করবে, যেন তুমি স্বয়ং আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাচ্ছো; আর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়, তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নিবে যে, আল্লাহ তোমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন।” (হযরত উমর, মুসলিম)।

→ নামাযে যেসব দোআ-কালাম পড়া হয় তা অন্তর থেকে পড়তে হবে। স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে ধীর-স্থিরভাবে পড়তে হবে। নামাযে অন্য মনস্ক হয়ে গেলে যখনই খেয়াল হবে তখনই মনকে পুনরায় নামাযের মধ্যে আনতে হবে। সদাসর্বদা এ চেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে ।

→ নামাযে মনোনিবেশ বা খুশূ সৃষ্টি করার জন্য নামাযীর দৃষ্টি সেজদার দিকে থাকবে। এ সম্পর্কে হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন : “হে আনাস! যেখানে তুমি সেজদাহ্ দেবে সেই জায়গাতেই তোমার দৃষ্টি রাখবে । ” (বায়হাকী, মেশকাত)

→ নামাযে মনোনিবেশ সৃষ্টির জন্য নামাযে যা পড়া হবে তার অর্থ নিজের ভাষায় জানতে হবে। দোআ-কালামের মানে জানলে স্বাভাবিকভাবেই নামাযে মনের একাগ্রতা সৃষ্টি হবে ৷

মুমিনদের গুণাবলীর প্রথম গুণ নামাযে খুশূ বা বিনয়ী বা একাগ্রতার বিষয়টি এতো দীর্ঘ আলোচনার কারণই হলো একজন মু'মিন বান্দার প্রথম গুণই হবে নামায। আর নামাযের রূহ বা প্রাণই হলো নামাযে খুশূ-খুজু বা একাগ্রতা। যদি তা না হয় তাহলে নামায পড়াই হবে কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এজন্য আমাদের নামায পড়তে হলে খুশু-খুজুর সাথেই নামায আদায় করতে হবে ।

দ্বিতীয় গুণঃ وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ অর্থাৎ “যারা বেহুদা বা অপ্রয়োজনীয় কথা এবং কাজ থেকে দূরে থাকে ।” মুমিনদের দ্বিতীয় গুণ হলো তারা বেহুদা, অপ্রয়োজনীয় ও অকল্যাণকর কথা, কাজ এবং চিন্তা থেকে দূরে থাকে ।

اللَّغْوِ'লাগয়ুন' বলা হয় এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং নিষ্ফল । যেসব কথা এবং কাজের কোনই ফল নেই; উপকার নেই, যা থেকে কল্যাণবহ ফলও লাভ করা যায় না। যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা হতে কোনো ভালো উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় না- এসবই অর্থহীন, বেহুদা ও বাজে জিনিস ।

مُعْرِضُونَ মানে যদিও দূরে থাকা । কিন্তু এতে শব্দটির পূর্ণ অর্থ বুঝায় না। আয়াতটির পূর্ণ অর্থ হলো : তারা বাজে, বেহুদা কাজ বা জিনিসের দিকে লক্ষ্য করে না। সেদিকে যায় না। যেখানে এ ধরনের কাজ বা কথা হয় সেদিকে আকৃষ্ট হয় না। সেখানে যাওয়া হতে দূরে থাকে। সে কাজে অংশগ্রহণ করে না, পরহেয করে, পাশ কেটে চলে যায়, কোথাও কখনও মুখোমুখী হয়ে পড়লেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য এড়িয়ে চলে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا

“তারা যদি এমন কোনো স্থানে যেয়ে পড়ে যেখানে বেহুদা অর্থহীন বাজে কাজ বা কথা হচ্ছে, তা হলে সেখান থেকে তারা নিজের মান সম্মান রক্ষা করে চলে যায়।” (ফুরকান-৭২)

আসলে মুমিন ব্যক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রতিটি সময় হিসাব-নিকাশ করে চলে। কেননা আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি মূহুর্তের হিসাব নেবেন। মুমিনের জন্য প্রতিটি মূহুর্ত একজন পরিক্ষার্থীর মতো মূল্যবান। পরীক্ষার্থী যেমন পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পাবার পর পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল লাভের জন্য প্রতিটি প্রশ্নের যথাযত উত্তর দেবার মাধ্যমে প্রতিটি মূহুর্তকে কাজে লাগায়, সে আজেবাজে কথা লিখে বা চিন্তা করে সময় কাটায় না। অনুরূপভাবে একজন মুমিন ব্যক্তিও দুনিয়ার এ জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে সঠিকভাবে ও যথাযতভাবে কাটায়। সে চিন্তা করলে কল্যাণকর চিন্তা করে, কথা বললে কল্যাণকর ও গ্রহণযোগ্য কথা বলে, কাজ করলে উপকারী কাজ করে । সে গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা ও চোগলখোরী করে বেড়ায় না । সে হাটে-বাজারে, দোকানে বা রাস্তায় বসে বাজে আড্ডা দেয় না । সে বাজে বা অশ্লীল কোন কাজ করে না। সে গল্প করে, কিন্তু অর্থহীন অশ্লীল গল্প-গুজব করে না। সে হাসি-তামাসা ও রসিকতা করে, কিন্তু তাৎপর্যহীন হাসি-তামাসা ও রসিকতা করে না। সে বিতর্ক করে, কিন্তু অশ্লীল কথা ব্যবহার করে ঝগড়া বিবাদ করে না। সে যে সমাজে গান-বাজনা, রং-তামাসা, অশ্লীল গালি-গালাজ, অন্যায় অভিযোগ, মিথ্যা দোষারোপ, লজ্জাহীন কথা-বার্তার চর্চা হয় সেই সমাজ তার জন্য গাত্রদাহ এবং আযাব বলে মনে হয়। এসব ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন : “মানুষ যখন অনর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন তার (দ্বীন) ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে থাকে।” একারণেই আয়াতে একে কামেল মুমিনদের বিশেষ গুণ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এসব বান্দাদের জন্য জান্নাতে আল্লাহ্ তাআলার অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে একটি বড় নিয়ামত হলো-

لا تَسْمَعُ فِيهَا لَاغِيَهُ

“সেখানে তারা কোনো প্রকার অর্থহীন বাজে কথা-বার্তা শুনতে পাবে না।” (সূরা গাশিয়া )


তৃতীয় গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ لِلرَّكوة فَعِلُونَ অর্থাৎ “যারা যাকাত বা পবিত্রতার কাজে কর্মতৎপর।” ‘যাকাত’ দেয়া এবং ‘যাকাতের' পন্থায় কর্মতৎপর হবার মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এই আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে কুরআনের প্রচলিত প্রচলিত যাকাত আদায় এর কথা না বলে لِلرَّكوة فَعِلُونَ বলে বিশেষ ধরনের কথা বলা হয়েছে । এটা বলার পেছনে বেশ তাৎপর্য রয়েছে।

আরবী ভাষায় ; শব্দের দু'টি অর্থ— একটি ‘পবিত্রতা' আর অপরটি ‘বৃদ্ধি’। অর্থাৎ একটা জিনিসের উন্নতি লাভের পথে যেসব বাধা-বিপত্তি আছে, তা দূর করা এবং উহার মূল জিনিসকে বৃদ্ধি করা। এ দুটি ধারণার সমন্বয়ে 'যাকাত' সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা সৃষ্টি হয়।

আর ইসলামী পরিভাষায় উহার ব্যবহার হয় দু'টি অর্থে। একটি সেই মাল-সম্পদ, যা পবিত্রতা অর্জনের জন্য হিসাব করে আলাদা করা হয় । আর দ্বিতীয়টি খোদ এই পবিত্রতা অর্জনের কাজ। যদি يُؤْتُونَ الزَّكوة বলা হয়, তবে তার অর্থ হবে, তারা পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিজের মাল-সম্পদের একটা অংশ দেয়। এতে শুধু মাল দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থকে । কিন্তু যদি বলা হয় لِلرَّكوة فَعِلُونَ তবে তার অর্থ হবে তারা পবিত্রতা বা তাকিয়ার বিধানের কাজ করছে। এতে কেবলমাত্র যাকাত আদায় করার অর্থই বুঝাবে না; বরং এর মানে ব্যাপক অর্থে বুঝাবে। যেমন-

* সে তার মন ও দেহের পবিত্রতা অর্জন করে ।

* সে তার চরিত্রের পবিত্রতা অর্জন করে ।

* সে তার জীবনের পবিত্র-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে । 

* সে তার পরিবারকে পবিত্র বা তাকিয়া করে ।

* সে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে তাকিয়ার কাজে ভূমিকা রাখে ।

* আর সে তার ধন-সম্পদেরও যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধন-সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করে । ইত্যাদি ।

মোট কথা মুমিন ব্যক্তি সে তার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং ধন-সম্পদের পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করে। এক কথায় সে নিজেকেও পবিত্র করে এবং অন্য লোককেও পবিত্র করার কাজ আঞ্জাম দেয়। আল্লাহ তাআলা সূরা আ'লায় বলেন :

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّىٰ ۚ وَذَكَرَاسُمَ رَبِّهِ فَصَلَّى অর্থাৎ “কল্যাণ ও সফলতা লাভ করলো সে, যে পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়লো।” 

আল্লাহ্ তাআলা সূরা শামসে আরও বলেনঃ قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّهَا هِ ْ অর্থাৎ “সফলকাম হলো সে, যে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে, যে নিজেকে কলুষিত করলো ।

তবে আলোচ্য আয়তটি এ দু'টি আয়াত থেকে বেশী অর্থপূর্ণ। কেননা এ দু'টি আয়াতে শুধুমাত্র নিজের নফসের পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আর আলোচ্য আয়াতে নিজের এবং গোটা সমাজ জীবনের পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে ।


চতুর্থ গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে।” মুমিনদের চতুর্থ গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজেদের স্ত্রী এবং অধীনস্থ দাসীদের ছাড়া সব রকমের নারী ভোগ থেকে যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে ।

حَفِظُونَ এর দু'টি অর্থ রয়েছে- (১) নিজের দেহের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখে, উলঙ্গপনাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং নিজের লজ্জাস্থানকে অপর লোকের সামনে প্রকাশ করে না।  (২) তারা নিজেদের পবিত্রতা ও সতীত্বকে রক্ষা করে। 

اِلَّا عَلى اَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ ملومين  অর্থাৎ “তবে যদি তারা তাদের স্ত্রী এবং মালিকানাধীন দাসীদের সাথে যৌন কামনা পূরণ করে তবে তারা তিরস্কৃত হবে না।” তবে এখানে একটা ইঙ্গিত আছে যে, এই প্রয়োজনকে প্রয়োজনের সীমার মধ্যে রাখতে হবে- জীবনের লক্ষ্য বানানো যাবে না। মাঝখানে একথা বলার আসল উদ্দেশ্য হলো- লজ্জাস্থানের ‘হেফাজত' করার কথা বলার ফলে যে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করা। অতীতকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এক শ্রেণীর লোক আছে যারা যৌন শক্তিকে একটা খারাপ কাজ মনে করে । তারা মনে করে দ্বীনদার এবং পরহেজগার লোকদের জন্য এ খারাপ কাজ করা ঠিক নয়। যদি “সফলকামী ঈমানদার লোকেরা নিজেদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে” এই কথা বলেই ক্ষান্ত হতো তা হলে প্রচলিত এই ভূল ধারণাকে সাপোর্ট দেয়া হতো। তাই মাঝখানে আল্লাহ তাআলা একথা বলে এটা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, নিজের স্ত্রীদের এবং শরীয়ত সম্মত অধীনস্থ দাসীদের সাথে যৌন খাহেস পূরণ করলে কোনো দোষের কাজ হবে না।

فَمَنِ ابْتَغَى وَراءَ ذلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ “বিবাহিত স্ত্রী অথবা শরীয়ত সম্মত দাসীর সাথে শরীয়াতের নিয়মানুযায়ী যৌন কামনা-বাসনা পূরণ করা ছাড়া কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার আর কোনো পথ বৈধ নয়। আর যারা একাজ করে তারাই হবে সীমালংঘনকারী।” যেমন-

* যিনা যেমন হারাম, তেমনি হারাম নারীকে বিয়ে করাও যিনার মধ্যে গণ্য হবে ।

* স্ত্রী অথবা দাসীর সাথে হায়েয-নেফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস করা হারাম ।

* পুরুষ অথবা বালক অথবা জীব-জন্তুর সাথে যৌন ক্ষুধা মিটানো হারাম।

* অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে হস্ত মৈথুনও এর অর্ন্তভূক্ত। 

* তাছাড়া যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করার মতো কোনো অশ্লীল কাজ করা। এসব কিছুই সীমালংঘনের মধ্যে গণ্য হবে।

وَالَّذِينَ هُم لاَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَعُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।”

এখানে পঞ্চম ও ষষ্ঠ দু'টি গুণের কথা বলা হয়েছে।


পঞ্চম গুণঃ لاَمُنْتِهِمْ ‘আমানাত' শব্দটির অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। এর আভিধানিক অর্থে এমন প্রতিটি বিষয় শামিল, যার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোনো ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়। এখানে অনেক বিষয় জড়িত বিধায় 'আমানাত' শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।

এতে দু' ধরনের আমানত সংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে।

(১) হক্‌কুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক সংক্রান্ত আমানত ।

(২) হক্‌কুল ইবাদ বা বান্দার হক সংক্রান্ত আমানত ৷


হুক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক সংক্রান্ত আমানত হলো-

(১) খেলাফত বা প্রতিনিধি সংক্রান্ত আমানাত। আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে তার খেলাফতের দায়িত্বের আমানাত দিয়ে পঠিয়েছেন। আল্লাহ্ সূরা বাকারায় বলেন- “নিশ্চয় আমি (মানুষকে) আমার প্রতিনিধি হিসাবে (দুনিয়াতে) পাঠাতে চাই।” সুতরাং আল্লাহ্ এই খিলাফতের আমানত রক্ষা করা প্রতিটি বান্দার জন্য বড় ধরনের দায়িত্ব।

(২) শরীয়াতে আরোপিত সকল ফরয ও ওয়াজিব যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি আল্লাহ্র হক । বিধায় তা ঠিকমত পালন করা এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা হলো আল্লাহ্র হকের আমানত ৷

বান্দার হক বা অধিকার সংক্রান্ত আমানত হলো-

(১) টাকা-পয়সার আমানত। যদি কেউ কারো কাছে টাকা-পয়সা আমানাত হিসেবে জমা রাখে তাহলে তা ঠিকমত হেফাজাত করা এবং চাওয়ামাত্র কোন প্রকার গড়িমসি না করে তাৎক্ষণিক ফেরৎ দেয়া ।

(২) ধন-সম্পদের আমানাত। যদি কেউ কারো কাছে কোন ধন-সম্পদ বা জমি জায়গার দলিলপত্র গচ্ছিত রাখে, তাহলে তা ঠিকমত হেফাজত করা এবং তা ব্যবহার না করা (হ্যাঁ যদি দাতা ব্যবহার করার অনুমতি দেয় তবে ব্যবহার করা যাবে।) এবং চাওয়ামাত্র টালবাহানা না করে তা ফেরৎ দেয়া । 

(৩) গোপন কথার আমানত। কেউ যদি কাউকে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলে, তাহলে তা গোপন রাখাই হলো কথার আমানত হেফাজত করা।

যদি কেউ কারো গোপন কথা ফাঁস করে দেয় তার পরিণতি সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি তার অপর কোন ভাইয়ের গোপন কথা প্রকাশ করে দেয় তাহলে আল্লাহ তাআলাও কিয়াতের দিন তার গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন।”

(৪) মজুর, শ্রমিক এবং চাকুরী জীবিদের জন্য যে সময় এবং কাজ নির্দ্ধারণ করে দেয়া হয় তা যথাযতভাবে পালন করা তার দায়িত্বের আমানত । এর মধ্যে নিজের কাজ করা এবং সময় দেয়া আমানতের খেয়ানত । কামচুরি এবং সময় চুরি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এ ব্যাপারে তাকে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মহানবী (সাঃ) বলেন :

وَعَبْدُ الرَّجُلُ رَاعٍ عَلى مَالِ سَيّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ

অর্থাৎ “কোনো লোকের চাকর বা কর্মচারী তার মালিকের সম্পদ এবং দায়-দায়িত্বের রক্ষক এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে (কিয়ামতের দিন আল্লাহ্র কাছে) জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম)

(৫) দায়-দায়িত্বের আমানাত। সাংগঠনিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যার যে দয়িত্ব আছে তা যথাযতভাবে পালন করা তার জন্য আমানাত । প্রতিটি দায়িত্বের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল বলেনঃ

اَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعْيَتِهِ فَالِاِمَامُ الَّذِى عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعْيَتِهِ

“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই (আল্লাহ্র দরবারে) আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। রাষ্ট্র নায়ক যিনি তিনি তার অধিনস্থদের এবং তার দায়-দায়ত্বের রক্ষক । তিনি তার দায়-দায়িত্ব এবং অধিনস্থ নাগরিকদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।” (বুখারী, মুসলিম)

(৬) সংগঠন বা সমাজের কোন সম্পদের আমানত। যদি কোন নেতার কাছে সংগঠনের বা সমাজের কোনো সম্পদ থাকে সেটা রক্ষণাবেক্ষণকরা তার জন্য বড় ধরনের আমানাত । সুতরাং এই সম্পদের যতেচ্ছা ব্যবহার না করে তা যথাযতভাবে ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করতে হবে।

(৭) গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারদের ভোটের বা মতামতের আমানত । এই ভোটের ক্ষমতা যথাযত এবং যথা যায়গায় প্রয়োগ করা ভোটের বা মাতামতের আমানাত। এটা আমরা গুরুত্ব না দিলেও আমরা ভোটের বা মতামতের ক্ষমতা যার পক্ষে প্রয়োগ করলাম সে যদি কল্যাণকর কাজ করে তবে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে। আবার যদি সেই প্রতিনিধি অন্যায় এবং খোদাদ্রোহী কাজ করে তবে তারও অন্যায়ের শাস্তির অংশ ভোগ করতে হবে।

মোট কথা মু'মিনের জন্য প্রতিটি বিষয়ের আমানাত সঠিকভাবে হেফাজত বা সংরক্ষণ করা ঈমানের পরিচয়। যদি কেউ আমানাত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তার সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন : “তার ঈমান নেই যার মধ্যে আমানাতদারী নেই।” (বায়হাকী)


ষষ্ঠ গুণ : َعَهْدِ ওয়াদা বা অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি পালন করা। অঙ্গীকার দু'ধরনের হতে পারে । :

প্রথমতঃ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, অর্থাৎ যে চুক্তির মধ্যে দু'টি পক্ষ থাকে এবং উভয় পক্ষই একটা বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। তবে উভয়েরই সেই চুক্তি পালন করা অপরিহার্য। কেউ এর খেলাপ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার মধ্যে গণ্য হবে ।

দ্বিতীয়তঃ অঙ্গীকার, ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ একতরফাভাবে একজন অন্যজনকে কোনো কিছু দেবার বা কোনো কাজ করে দেবার ওয়দা করা । এরূপ ওয়াদা পূর্ণ করাও শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরী এবং অপরিহার্য। হাদীসে আছে-“ওয়াদা এক প্রকার ঋণ।” ঋণ আদায় করা যেমন অতীব জরুরী তেমনি ওয়াদা পূরণ করাও জরুরী ।

তবে যদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা একতরফা ওয়াদা কোন কারণে পালন করতে সমস্য দেখা দেয় তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলাপ করে তার সম্মতির ভিত্তিতে রিভিউ করা বা সময় বাড়িয়ে নেয়া ওয়াদা খেলাপের মধ্যে গণ্য হবে না ।

আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে-কামে ওয়াদা করে থাকি, যেমন- পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রীর সাথে একে অপরে ওয়াদা করে থাকি, যাকে আমরা খুবই হালকা করে দেখে থাকি। যদি এই ওয়াদা পূরণ করা না হয়, তাহলে প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে যাবে। তাছাড়া চাকরী-বাকরী, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংগঠনিক এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে ওয়াদা করে থাকি যা পালন করা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। অথচ দেখা যায় প্রতিনিয়ত এরকমের অসংখ্য ওয়াদা করা হচ্ছে এবং তার খেলাফও করা হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো ওয়াদা পালনের যে গুরুত্ব রয়েছে তার সম্পর্কে চেতনা কম। অথচ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা দ্বীনদারীর সাথে সম্পৃক্ত। এ ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) বলেন :

وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدِ لَهُ

অর্থাৎ “তার দ্বীনদারী নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই।” (বায়হাকী) 


সপ্তম গুণঃ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلوتِهِمْ يُحَافِظُونَ অর্থাৎ “যারা তাদের নামাযে যত্নবান।” নামাযে যত্নবান হবার অর্থ হলো নামাযের পাবন্দী করা এবং প্রত্যেক মোস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা। (রুহুল মা'আনী

এখানে صَلوةٌ শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এখানে পাঁচ ওয়াক্তের নামায বোঝানো হয়েছে। যেগুলো মোস্তাহাব অর্থাৎ আওয়াল ওয়াক্তে যথাযতভাবে পাবন্দী সহকারে আদায় করা বোঝায়।

মু'মিনদের গুণাবলীর মধ্যে প্রথমে বলা হয়েছে, তারা নামায বিনয়ের সাথে মনোনিবেশ সহকারে আদায় করে। তাই এখানে صَلوةٌ শব্দটি একবচন ব্যবহার করা হয়েছে । অর্থাৎ এখানে নামাযের জাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই সে নামায ফরয অথবা ওয়াজিব কিম্বা সুন্নত অথবা নফল নামায হোক— নামায মাত্রেরই প্রাণ হচ্ছে বিনয়-নম্রভাবে আদয় করা । এখানে নামাযসমূহের 'সংরক্ষণ' হলো- নামাযের বাইরের এবং ভিতরের যাবতীয় নিয়ম নীতি যথাযতভাবে পালন করা । যেমন-

* নামাযের পূর্বশর্তগুলো যেমন- শরীর, পোশাক, নামাযের স্থান (জায়নামায) ইত্যাদি পাক-পবিত্র হওয়া।

* সময় মতো মোস্তাহাব ওয়াক্তে, অর্থাৎ আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়া ৷

হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন : الْوَقْتُ الْاَوَّلَ مِنَ الصَّلوةِ رِضْوَانُ اللهِ وَالْوَقْتُ الْأَخِرُ عَفْرُ اللهِ

অর্থাৎ “নামায ওয়াক্তের প্রথম সময়ে আদায় করলে আল্লাহ্র সন্তোষ লাভ করা যায় এবং শেষ সময় আদায় করলে আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়া যায় (অর্থাৎ শেষ ওয়াক্তে নামায পড়লে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না, কেবল গুনাহ থেকে বাঁচা যায় মাত্র)।” (তিরমিযী)

* মসজিদে জামায়াতের সাথে নাময আদায় করা। হযরত ওমর (রাঃ) لَا صَلوةَ إِلَّا بِالْجَمَاعَةِ বলেন : করে অর্থাৎ “জামায়াত ছাড়া নামায কল্পনা করা যায় না।”

* শুদ্ধ, ধীর স্থির ভাবে দোআ-কালাম পাঠ করা ৷

* নামাযের রোকন যেমন- রুকু, সিজদাহ্, কিয়াম এবং বৈঠক ইত্যাদি মনোযোগের সাথে ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা ।

* খুশূ-বিনয়-নম্র এবং মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করা। 

* ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নামাযের হেফাজত করা । মুয়াত্তা ইমাম মালেকের হাদীসের কিতাবে আছে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর সমস্ত গভর্ণরদের কাছে এই মর্মে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে,

اِنَّ اَهُم أُمُورِكُمْ عِنْدَى الصَّلَوةُ فَمَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَافِظَ دِيْنَهُ وَمَنْ صَيْعُهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ

অর্থাৎ “তোমাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্বের মধ্যে নামাযই হলো আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং যে সাবধানতার সাথে নিজের নামায আদায় করলো এবং (অন্যদের) নামাযের তত্ত্বাবধান করলো সে যেনো তার পূর্ণ দ্বীনের হেফাজাত করলো। আর যে নামাযের খেয়াল রাখলো না তার পক্ষে অন্যান্য দায়িত্ব পালনে খেয়ানত আদৌ অসম্ভব কিছু নয়।”

সর্বপরি নামায হেফাজাত করা না করার মধ্যে আখেরাতের মুক্তির এবং ধ্বংসের কারণ রয়েছে। এ সম্পর্কে মহানবীর হাদীস। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাযের হেফাজাত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন : “যে লোক নামায সঠিকভাবে হেফাজাত করবে, তার এ নামায কিয়ামতের দিনে তার জন্যে আলো, দলীল ও মুক্তির কারণ হবে এবং যে তা সঠিকভাবে হেফাজাত করবে না, তার জন্যে নামায কিয়ামতের দিনে আলো, দলীল কিংবা মুক্তির কারণ হবে না। আর ঐ ব্যক্তি হাশরের দিনে কারুন, ফেরাউন ও উবাই ইবনে খালফের ন্যায় কাফেরদের সাথে উঠবে (আহমদ, দারেমী, বায়হাকী)


এখানে বিবেচ্য বিষয় এই যে, মুমিনদের সাতটি গুণ নামায দিয়েই শুরু করা হয়েছে এবং নামায দিয়েই শেষ করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, নামায এমন একটি ইবাদাত যা পরিপূর্ণভাবে এবং পাবন্দী ও নিয়ম-নীতির সাথে আদায় করলে অন্যান্য যাবতীয় গুণগুলো আপনা-আপনি নামাযির মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকবে ।

আলোচ্য আয়াতগুলোতে চিন্তা করলে দেখা যায়, উল্লিখিত সাতটি গুণের মধ্যে আল্লাহ্ ও বান্দার যাবতীয় হক বা অধিকার এবং এ সম্পর্কিত সব বিধি-বধান প্রবৃষ্ট হয়ে গেছে। যেসব ব্যক্তি এসব গুণে গুণান্বিত হয়ে যাবে এবং এতে অবিচল অটল থাকবে সে কামেল মুমিন হবে এবং ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের হকদার হয়ে যাবে ।


أولئِكَ هُمُ الْنُورِثُونَ الَّذِيْنَ يَرِثُونَ الْفِردَوسَ هُم فِيْهَا خَالِدُونَ

উল্লিখিত সাতটি গুণে গুণান্বিত লোকদেরকে এই আয়াতে জান্নাতুল ফেরদাউসের ওয়ারীশ বা উত্তরাধীকারীর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এখানে এজন্য উত্তরাধীকারী বলা হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকরীদের জন্য প্রাপ্য ও অনিবার্য হয়ে যায় তেমনি এসব গুণের অধিকারী মুমিন ব্যক্তিদের জন্য জান্নাত প্রবেশও সুনিশ্চিত হয়ে যায় ৷ আল্লাহ্ তাআলা এখানে জান্নাতের কথা বলতে গিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসের কথা বলেছেন। জান্নাতের যে আটটি স্তর রয়েছে তার মধ্যে সর্বউত্তম স্তর হচ্ছে জান্নাতুল ফেরদাউস। যেহেতু মুমিনদের এই সাতটি গুণ বিশেষ গুণ সে কারণে তাদের জন্য বিশেষ জান্নাত “ফেরদাউসের” ওয়াদা করেছেন । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের জন্য এবং তার উম্মতদেরকে জান্নাত কামনার জন্য

উত্তম জান্নাত চাওয়ার বাণী শিখিয়ে দিয়ে বলেছেন : اللهمَّ اِنّى اَسْتَلْكَ الْجَنَّةُ الْفِرْدَوُش

“হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করছি।”


শিক্ষাঃ সূরা মু'মিনুনের প্রথম ১১টি আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেসব শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলোঃ

* ঈমানদার হবার জন্য ঈমানের যেসব শর্ত রয়েছে তা যথাযতভাবে মানতে হবে। অর্থাৎ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে হবে।

* যে নামাযই হোক না কেনো তা আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে খুশূ-খুজু ও মনোযোগের সাথে ধীর-স্থিরভাবে আদায় করতে হবে।

* আজে-বাজে এবং অকল্যাণকর কথা, কাজ এবং চিন্তা থেকে দূরে থেকে কল্যাণকর এবং আখেরাতমুখী কথা, কাজ, ও চিন্তা করতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত করতে হবে।

* ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও ধন-সম্পদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধির জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে ।

* অবৈধ পথে যৌনক্ষুধা না মিটিয়ে বৈধ স্ত্রীর সাথে বৈধ পথে যৌন চাহিদা মিটাতে হবে। তবে একে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বানানো যাবে না। তাছাড়া যৌন সুড়সুড়ি সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজে বা পরিবেশে নিজেকে জড়ানো যাবে না । বেহায়াপনা ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। জেনার যে মূল দরজা পর্দা, তা ঠিকমত মেনে চলতে হবে।

* আল্লাহর পক্ষ থেকে হোক আর মানুষের পক্ষ থেকে হোক আমানত সমূহ যথাযতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে ।

* দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হোক আর একপক্ষ থেকে ওয়াদা হোক তা যথাযতভাবে মেনে চলতে হবে এবং ওয়াদা ও চুক্তি মতো আদায় করতে হবে।

* পাঁচ ওয়াক্ত নামায হেফাজতের জন্য নিজে যথাযতভাবে যথা সময়ে জামায়াতের সাথে মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ভাবে নামায প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

* সর্বপরি উপরোক্ত আমলগুলো বিশুদ্ধ নিয়্যাত এবং নিষ্টার সাথে কেবলমাত্র আল্লাহকে রাজী-খুশী করে জান্নাতুল ফেরদাউস পাবার আশায় করতে হবে। সাবধান থাকতে হবে যাতে করে মনের মধ্যে কোনোভাবেই রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি না হয়।


দারসুল কুরআন: মু'মিনদের গুণাবলী
সূরা আল মু'মিনুন,
সুরা নং-২৩, আয়াত নং- ১ থেকে ১১

সংকলনেঃ ইমাম হোসেন আরমান (আরমানের খেরোখাতা)
ফেইসবুকে- www.facebook.com/Arman005.Blog

1 Comments:

ইয়াছিন আহাদ বলেছেন...

আলহামদুলিল্লাহ। উপকৃত হলাম। জাজাকাল্লাহু খাইরান।