Close

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

দারসুল হাদীস : হযরত উমর রা. বর্নিত নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস : হযরত উমর রা. বর্নিত নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস
দারসুল হাদীস
নিয়তের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদীস
عَنْ عُمَرَ بْن الْخَطَّابِ (رض) عَلَى الْمِنْبَر يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ )صلعم( يَقُولُ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لأَمْرِئ مَّا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى اِمْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهَجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ الَيْهِ (بخاری)
অনুবাদ: আমীরুল মু'মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি মিম্বারের উপর উঠে বলেছিলেন: আমি রাসূলূল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্ৰত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। কাজেই যার হিজরত দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য কিংবা কোন রমণীকে বিবাহ করার নিয়তে হয়েছে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হয়েছে। (সহীহ বুখারী-০১)

শব্দার্থ : عَنْ : হতে। يَقُولُ : তিনি বলেছেন। إِنَّمَا : নিশ্চয়ই । الْأَعْمَالُ : কর্মসমূহ। بِالنِّيَّاتِ : নিয়তসমূহ (বহুবচন)। لأَمْرِئ : প্রত্যেক মানুষের জন্য। مَّا: যা। نَوَى: সে নিয়ত করল। فَ: অতঃপর। مَنْ: যে (ব্যক্তি)। هِجْرَتُهُ : তার হিজরত। كَانَتْ : ছিল। إِلَى : প্রতি, দিকে । دُنْيَا : পৃথিবী। يُصِيبُهَا : সে তা লাভ করবে। اِمْرَأَةٍ : স্ত্রী লোক । يَنْكِحُهَا : সে তাকে বিবাহ করবে। هَاجَرَ : সে হিজরত করল। مَنْ: যে ব্যক্তি। كَانَتْ : সে (স্ত্রী) ছিল। هَجْرَتُهُ: তার হিজরত। الَيْهِ: তার দিকে।

ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসখানায় নিয়তের গুরুত্ব, আমল ও হিজরত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি কর্ম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা উচিত । কোন কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত না থাকলে সে কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আল্লাহর নিকট কোন কাজের পুরস্কার পেতে হলে প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা অপরিহার্য । এমনকি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ দীনি কাজেও নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হবে না এবং তার প্রতিদান পাওয়া যাবে না । আল্লাহ তা'য়ালা কাজের সাথে বান্দার অন্তরের অবস্থাও দেখতে চান ।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رض قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلعم إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَاعْمَالِكُمْ- مسلم
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন: “আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম)
বিশুদ্ধ নিয়ত প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : “আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনাহঃ ৫)
“আপনি বলুন, তোমরা তোমাদের মনের কথা গোপন রাখ অথবা প্ৰকাশ কর, তা সবই আল্লাহ জানেন”। (সূরা আলে-ইমরান : ২৯)
মুসলিম শরীফের অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যিনি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছেন। তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির করে তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় নি'য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে । সে ঐ সব নি'য়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে । অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে উত্তরে বলবে আমি আপনার পথে লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন : তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বীর খ্যাতি অর্জনের জন্য লড়াই করেছো এবং সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো । অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবে সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। এরপর আল্লাহর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছে, দীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং আল-কুরআন পড়েছে। তাকে তার প্রতি প্ৰদত্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ঐ সব নিয়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি দীনি ইল্‌ম অর্জন করেছি, তা অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য আল-কুরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছো । তুমি আলেম খ্যাতি লাভের জন্য ইল্‌ম অর্জন করেছো। তুমি কারীরূপে খ্যাত হওয়ার জন্য আল-কুরআন পড়েছো । সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো। তারপর ফয়সালা দেয়া হবে, অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে ।

এরপর হাজির করা হবে এমন এক ব্যক্তিকে যাকে আল্লাহ সচ্ছলতা ও নানা রকম ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার প্রতি প্রদত্ত নি'য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে । সে ঐ সব নিয়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি'য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি আপনার পছন্দনীয় সব খাতেই আমার সম্পদ খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো । তুমি দাতারূপে খ্যাতি লাভের জন্যেই দান করেছো । তারপর ফয়সালা দেয়া হবে। অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। (মুসলিম) কাজেই বুঝা গেল যারা দুনিয়ার স্বার্থ লাভের নিয়তে কাজ করবে তারা দুনিয়াই লাভ করবে আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সাফল্য লাভ করবে ।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ আল-বুখারী।

হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ 'মুসনাদ' আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত ‘সিহাহ সিত্তা' বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয় । এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহুল বুখারী' ।

ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা । তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু‘ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্ৰহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন । তিনি নিজেই বলেন : ‘তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে।

হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন । সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী । তাই বলা হয় :
آصَحُ الْكُتُبِ بَعْدَ كِتَابِ اللَّهِ تَحْتَ السَّمَاءِ صَحِيحُ الْبُخَارِي.
“আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নিচে সর্বাধিক সহীহ গ্রন্থ হচ্ছে সহীহুল বুখারী ।” (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ওয়া উমদাতুল কারী)

ইমাম বুখারী (র) সহজ-সরল, বিনয়ী, দয়ালু উন্নত চারিত্রিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, “আমি জীবনে কোন দিন কারো কোন গীবত করিনি।” এই মহা মনীষী ২৫৬ হিজরী ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর ভোর রাতে ইনতিকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

রাবী পরিচিতি : হযরত উমর (রা)। মূল নাম : উমর । উপনাম : আবু হাফস। উপাধি ঃ আল-ফারুক। পিতার নাম : খাত্তাব । মাতার নাম : হানতামা বিনতে হাশেম ইবনে মুগিরা । জন্মগ্রহণ ঃ হযরত উমর (রা) হিজরতের ৪০ বছর পূর্বে রাসূল (সা)-এর জন্মের ১৩ বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ।

প্রাথমিক জীবন : প্রাথমিক জীবনে হযরত উমর (রা) পিতা-মাতার আদরে লালিত-পালিত হন। পিতার উট চরাতে সাহায্য করেন। যৌবনের প্রারম্ভে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা এবং নসবনামা শিক্ষা লাভ করে আত্ম-প্রত্যয়ী যুবক হিসাবে বেড়ে ওঠেন।

ইসলাম গ্রহণ : তিনি নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন । তাঁর পূর্বে ৩৯ জন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করায় তাকে নিয়ে ৪০ জন পূর্ণ হয়। অতঃপর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। রাসূল (সা) তাঁকে ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন। (উসদুল গাবা)

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ : হযরত আবু বকর (রা)-এর ইনতিকালের পর হিজরী ১৩ সালের ২৩ জমাদিউল উখরা মোতাবেক ২৪শে আগষ্ট ৬৩৪ সালে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খিলাফত কাল ছিল ১০ বছর ৬ মাস। তাঁর শাসনামলে সর্বাধিক রাজ্য জয় হয়। বিজিত রাজ্যের সংখ্যা ছিল ১০৩৬। তিনি সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন। সামরিক কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠা, কাজীর পদ সৃষ্টি ও বিধর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মূল কথা তিনিই ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তব ভিত্তির উপর স্থাপিত করেন। (তাবাকাতে ইবনে সা'দ)

হাদীস বর্ণনার সংখ্যা : তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯ খানা। বুখারী শরীফে এককভাবে ৯ খানা ও মুসলিম শরীফে এককভাবে ১৫ খানা । উভয় গ্রন্থে সর্বমোট ২৪ খানা হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে । তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করেন ও লিপিবদ্ধ করে রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের নিকট প্রেরণ করেন। জনসাধারণকে হাদীস শিক্ষা দানের জন্য তিনি বড় বড় সাহাবীদেরকে বিভিন্ন রাজ্যে পাঠান। সেখানে তারা হাদীসের প্রশিক্ষণ দেন ও হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুহাদ্দিস তৈরী করেন ।

ইমাম যাহ্বী বলেন, “হাদীস, রিওয়ায়াতের ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসগণের জন্য মজবুত নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।” রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর হাদীস বর্ণনার সংখ্যা কম। তাছাড়া তিনি হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে এ আশংকায় জড়িত হয়ে পড়েন যে সুসংঘবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ জনসাধারণের হাতে পৌঁছলে তারা কুরআনের তুলনায় হাদীসকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে বসতে পারে ৷

শাহাদাত লাভ : হিজরী ২৩ সালের ২৪শে জিলহাজ্জ বুধবার মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতি করার সময় মুগীরা বিন শু'বার দাস আবু লু'লু’ বিষাক্ত তরবারি দ্বারা আঘাত করলে আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত করার পর ২৭শে জিলহাজ্জ শনিবার শাহাদাত লাভ করেন । (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর । (তাবাকাতে ইবনে সা'দ )

হাদীসের পটভূমি : এ হাদীসের একটি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ও উপলক্ষ্য রয়েছে। তা হলো, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মক্কার লোকদেরকে দীনে হকের প্রতি আহ্বান করলে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি সে কাজে বাধা দেয়। আল্লাহর বাণী তথা দীনে হকের দাওয়াত গণ-মানুষের কর্ণ কুহরে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাসূলে করীম (সা) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন এবং অন্যান্য সকল মুসলমানকে চতুর্দিক থেকে হিজরত করে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। তখন নিষ্ঠাবান সকল মুসলমানগণ হিজরত করে মদীনায় হাজির হন। তাদের মধ্যে উম্মে কায়েস বা কায়েলা নামের একজন মহিলা ছিলেন। একজন পুরুষ উক্ত মহিলাকে বিবাহ করার জন্য মদীনায় হিজরত করেন । কিন্তু হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন ও সাওয়াব লাভ করার দিকে তার বিন্দুমাত্র লক্ষ্য ছিল না । আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত না করায় তাঁর হিজরত গ্রহণযোগ্য হয়নি । অনুরূপভাবে প্রত্যেক কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকলে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। তাই হিজরতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টকর আমলের মধ্যেও যদি নিয়তের বিশুদ্ধতা না পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কোন প্রতিদান পাওয়ার আশা করা যায় না ৷

হাদীসে উল্লেখিত মহিলার পরিচয় : যাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তার নাম হলো- কায়েলা, তার উপনাম উম্মে কায়েস, আর যে পুরুষ লোকটি তাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছিলেন তার নাম জানা যায় নাই ৷ তবে তাকে মুহাজিরে উম্মে কায়েস বলা হত। সম্ভবতঃ একজন সাহাবীর পরিচয়ের সাথে তার কাজের মিল না থাকায় তার নাম উল্লেখ করা হয় নাই । (উমদাতুল কারী)

হাদীসটির গুরুত্ব : ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম নিয়তের এ হাদীসখানা ইসলামের একটি মূল ফর্মূলা হিসেবে গণ্য ৷ এতে অল্প শব্দে অধিক অর্থ নিহিত রয়েছে। কারো কারো মতে ইসলাম সম্পর্কিত ইলমে এর গুরুত্ব এক-তৃতীয়াংশ ।

আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেন, সকল কাজের পরিশুদ্ধতা ও তার ফলাফল লাভ নিয়ত অনুযায়ী হয়। কেননা নিয়তই মানুষের কাজের দিক নির্ণয় করে। বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদীসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের সর্ব প্রথমে ইমাম বুখারী (র) নিয়তের হাদীসখানা উপস্থাপন করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (র) বলেন, ইমাম মালেকের মুওয়াত্তা ব্যতীত অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে নিয়তের এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে । হযরত উমর (রা) তাঁর প্রত্যেক ভাষণের সূচনাতে এ হাদীসখানা পাঠ করে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। নিয়তের অর্থ : নিয়তের আভিধানিক অর্থ- BINI, iii ইচ্ছা, স্পৃহা, মনের দৃঢ় সংকল্প ইত্যাদি । শরীয়াতের দৃষ্টিতে- আল্লাহ তা'য়ালার সন্তোষ লাভ ও তাঁর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার দিকে হৃদয় মনের লক্ষ্য আরোপ ও উদ্যোগকে নিয়ত বলে ।

ফতহুর রব্বানী গ্রন্থকার বলেন :
تَوَجُهُ الْقَلْبِ جَهَةَ الْفِعْل ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ تَعَالَى وَاِمْتِتَالاً لأمره. “আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনার্থে কোন কাজের দিকে মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ও অভিপ্রায় প্রয়োগ করা।” (ফতহুর রব্বানী ২য় খণ্ড পৃ. ১৭) আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেন :
هُوَ قَصْدُكَ الشَّيْئَ بِقَلْبِكَ وَتَحَرِّى الطلبِ مِنْكَ.
“মনে কোন কাজ করার সদিচ্ছা পোষণ করা এবং উহা বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করাকে নিয়ত বলা হয়।” নূরুল ইযা গ্রন্থকার বলেন :
النَّيَّةُ هُوَ قَصْدُ الْقَلْبِ عَلَى الْفِعْل.
“কাজের উপর মনের ইচ্ছা পোষণ করাকে নিয়ত বলা হয় ।” প্রত্যেকটি কাজের শুরুতেই নিয়ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইমাম বায়যাবী (র) তাঁর মতামত নিম্নের ভাষায় ব্যক্ত করেন :
إِنْبِعَاتُ الْقَلْبِ نَحْوَ مَا يَرَاهُ مُوَافِقًا لِغَرْضِ مِّنْ جَلْبٍ نَفْعِ أَوْ دَفْعِ ضَرَرِ
حَالاً أَوْ مَالاً.
“বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোন উপকার লাভ বা কোন ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অনুকূল কাজ করার জন্যে মনের উদ্যোগ ও উদ্বোধনকেই নিয়ত বলে।” (উমদাতুল কারী ১ম খণ্ড ৬৩ পৃঃ) মোটকথা কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়াশীল থাকে, চাই তা ভাল কাজ হউক কিংবা মন্দ কাজ, তাকেই ‘নিয়ত' নামে অভিহিত করা হয় ৷

ইবাদতমূলক কাজে নিয়তের গুরুত্ব

ইবাদত বুনিয়াদী পর্যায়ে দু'প্রকার। যথা—

১ । মাকসুদা বা মূল ইবাদত;
২। গায়রে মাকসুদা বা সহায়ক ইবাদত ।

১। ইবাদতে মাকসুদা: যে ইবাদতের দ্বারা সওয়াব পাওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে তাকে ইবাদতে মাকসুদা বা মূল ইবাদত বলে । যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি ।

২। ইবাদতে গায়রে মাকসুদা : যে ইবাদত মূল ইবাদতের সহায়ক । যে ইবাদত দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে করা হয় না বরং উহা মাকসুদা বা মূল ইবাদতের সহায়ক বা মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- অযু, তায়াম্মুম। ইহা সরাসরি ইবাদত নয় বরং সালাত উহার উপর নির্ভরশীল আর নামাযের জন্য উহা সহায়ক বা মাধ্যমও বটে ।

ইমামদের মতভেদঃ

ইমাম শাফি'ঈ, মালেক ও আহমদ (র) প্রমুখ মনীষীগণ বলেন, ইবাদতে মাকসুদা বা গায়রে মাকসুদা যে ধরনের ইবাদতই হোক না কেন, উহার বিশুদ্ধতার জন্য নিয়ত করা পূর্বশর্ত । আল্লাহর বাণী :
وَمَا أُمِرُوا إِلا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.
“আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তারই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনা : ৫)
আল্লাহ তা'য়ালা কুরআনে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন : إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللهِ وَاخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلهِ.
“তবে তাদের মধ্যে যারা তওবা করবে ও নিজেদের কার্যাবলী সংশোধন করে নিবে ও আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধারণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দীনকে খালেস করে নিবে।” (সূরা আন-নিসা : ১৪৬)
إِنَّمَا صِحَّةُ الْأَعْمَال بِالنِّيَّاتِ.
“আমল ও ইবাদতের বিশুদ্ধতা একনিষ্ঠভাবে নিয়তের উপরই নির্ভরশীল ।” হানাফী ইমামগণ বলেন, ইবাদতে সাওয়াব প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল। তাদের মতে বর্ণিত হাদীসে Liii শব্দের পরে । শব্দটি উহ্য রয়েছে। মূল বাক্য ছিল এরূপ : Lil “ইবাদতের সওয়াবের প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল ।”

গায়েরে মাকসুদা দুরস্ত হওয়ার জন্য নিয়তের প্রয়োজন নেই । কেননা, নিয়ত ব্যতিরেকেই শুদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু সওয়াব পাওয়া যাবে না । উহা নিয়ত ও ইরাদার মধ্যে পার্থক্য কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়শীল থাকে, চাই তা ভাল হোক বা মন্দ হোক তাকেই নিয়ত বলা হয় । আর শুধু কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করার নাম হলো ইরাদা ।

হিজরত অর্থ

হিজরত অর্থ- ত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, ছেড়ে দেয়া, কোন জিনিস ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া ইত্যাদি । (আল-ওয়াসীত : ২/৯৭৩)
শরীয়তের পরিভাষায়-নিজের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে দীন ও ঈমান রক্ষার নিমিত্তে ‘দারুল হরব' থেকে ‘দারুল ইসলামে' প্রস্থান করাকে শরীয়তে হিজরত বলে ।
ইবনে হাজার আসকালানির (র) মতে, “আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করাকে হিজরত বলে ।”
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে 'দারুল হরব' থেকে ‘দারুল ইসলামে' প্রস্থান করাকে হিজরত বলে। যেমন— নবী করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) দীন ও ইসলামের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে মক্কাভূমি (দারুল হরব) পরিত্যাগ করে মদীনা (দারুল ইসলাম) চলে গিয়েছিলেন । সুতরাং সে চলে যাওয়াকে হিজরত নামে অভিহিত করা হয় । তাছাড়া শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজসমূহকে পরিত্যাগ করাকেও হিজরত বলে ।

হিজরতের বিধান : হিজরতের বিধান পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। এ বিধানটির উপর মুসলমানদের বহুবিদ কল্যাণ নিহিত আছে। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই মহানবী (সা) নিম্নের হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন :
لاَ تَنْقَطِعُ الْهَجْرَةُ حَتَّى لا تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَتَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا.
“তওবা করার অবকাশ থাকা পর্যন্ত হিজরতের ধারা বা সিলসিলা বন্ধ হবে না। আর তওবার অবকাশও বন্ধ হবে না পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত ।” (আবু দাউদ)

গোটা বিশ্বের যে কোন স্থানে যে কোন সময় দীন ও ঈমান হিফাযত করার জন্য হিজরতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে । বর্তমান বিশ্বে যেভাবে মুসলমানদের উপর দেশে দেশে নির্যাতন চলছে তাতে হিজরত করার অপরিহার্যতা আরো ব্যাপক করে তোলে । এমনকি কোন স্থানে বা দেশে অন্ততঃ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী বিধি-বিধান পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, তখন নিরাপদ স্থানে হিজরত করার বিধান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে । (লোমাআত)

শিক্ষা
১। সকল কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল
২। মুসলমানদের সকল কাজের পূর্বে নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া উচিত ।
৩। দীন ও ঈমানের হিফাযতের জন্য প্রয়োজনে হিজরত করতে হবে।
৪ । সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া অপরিহার্য।
৫। শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ ভাল নিয়তেও করা জায়েয নয় ।


-সংকলিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত।