Close
ইসলামী আন্দোলন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইসলামী আন্দোলন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

 বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ
লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
(১৯৮৫ সালে রাজশাহী মহানগরীর দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ে শব্বেদারীতে প্রদত্ত বক্তব্য পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন রাজশাহী মহানগরী আমীর ছিলেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।)

লেখক পরিচিতি:
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী(রহ.)।
১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা লুৎফুর রহমান। মাতা মোমেনা খাতুন। তিনি ১৯৭০-৭১ দুই সেশন নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ১৯৮৮-২০০০ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্ব-পদে বহাল ছিলেন। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে ২য় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ২২মে পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা নিজামীর ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। তিনি ২০১০ সালের জুন মাসে গ্রেফতার হন এবং ২০১৬ সালের ১১ মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে আওয়ামী ট্রাইবুনালের ভিত্তিহীন অভিযোগে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করেন।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ

ইনফাকের অর্থ:
ইনফাকের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ: ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু (نفق) যার অর্থ সুড়ঙ্গ। যার একদিক দিয়ে প্রবেশ করে আর একদিন দিয়ে বের হওয়া যায়।
মুনাফিক এবং নিফাক শব্দদ্বয়ও এই একই ধাতু থেকে গঠিত। অর্থের দিক দিয়ে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য আছে। নাফাকুন থেকে ইনফাক গঠিত হয়েছে। 
শাব্দিক অর্থের আলোচনায় আমরা ইনফাকের দুটো দিক পেয়ে থাকি। 
এক. এ পরিমাণ খরচ করতে হবে যাতে অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ না আসে। বা দাতার মনে সঞ্চয়ের ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার সুযোগ না আসে।
দুই. ভরণ-পোষণ বা খোরপোষের অর্থের তাৎপর্য হল দাতা যার জন্যে দান বা খরচ করবে তার প্রয়োজন পূরণ করার মত অর্থ অবশ্যই ব্যয় করবে।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ:

ইনফাকের অর্থ এবং ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ একত্রে মিলালে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ দাঁড়ায়: জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রয়োজন পূরণ, এর উপায়-উপকরণ যোগাড় ও এই মহান কাজটি পরিচালনার জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যে অর্থসম্পদ খরচ করা। চাঁদার মনোভাব নিয়ে অর্থ দান করার মাধ্যমে এর হক আদায় হতে পারে না। তাই ইসলামী আন্দোলনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে চাঁদার পরিভাষা ব্যবহার না করে 'এয়ানাত'-এই আরবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ সহযোগিতা দান।

ইনফাকের তাৎপর্য:
আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার খাতে আমাদেরকে মাল সম্পদ খরচ করতে হবে কেন?
আল্লাহর তাআলা তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর পথে জিহাদের যে আহবান দিয়েছেন তার মধ্যেই উপরিউক্ত প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণাঃ "তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে মাল দিয়ে এবং জান দিয়ে।" অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই জিহাদে বা সংগ্রামে মালের কোরবানী এবং জানের কোরবানীর প্রয়োজন আছে। এই দুটো জিনিসের কোরবানী দেয়ার মত একদল মর্দে মুমিন, মর্দে মুজাহিদ তৈরি হলেই আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম বিজয় হবে যেমন বিজয়ী হয়েছিল রাসূলে পাক (সা.)-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) মালের কোরবানী ও জানের কোরবানীর বিনিময়ে। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের এই মহান সংগ্রাম দাবী করে যে এ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের কাছে তাদের নিজের জান ও মালের তুলনায় তথা ইহ জাগতিক যাবতীয় স্বার্থ ও লোভ-লালসার তুলনায় আল্লাহর রহমত ও সন্তোষই হতে হবে অধিকতর প্রিয়।


ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর ভূমিকা:

আমরা জানি, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.) আরবের একজন অন্যতম ধনী ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী খাদিজাতুল কুবরার (রা.) ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তিনি এ অবস্থায় উন্নীত হন। তাছাড়া হযরত খাদিজার সম্পদ ব্যবহারের তাঁর সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পর থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাঁর সম্পদ আর বিন্দু পরিমাণও বৃদ্ধি পায়নি। বরং তিলে তিলে সব আল্লাহর পথে নিঃশেষ হয়েছে।

ইনফাকের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের ভূমিকা:

আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের (রা.) ভূমিকা দুনিয়ার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা আল্লাহর রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়ে মালের ও জানের কোরবানী পেশের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁদের এই ভূমিকার জন্যে স্বয়ং আল্লাহ্ সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, "তাদের প্রতি আল্লাহ্ খুশি হয়েছেন আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি খুশি হয়েছে।"

  • হযরত খাদিজাতুল কুবরার (রা.)
  • হযরত আবু বকর (রা.)
  • হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)
  • হযরত উসমান (রা.)
  • আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)
  • মুহাজির ও আনসারগণ।

যে সকল সাহাবায়ে কেরাম রা: ভূমিকা রেখেছেন:

বর্তমান যুগে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ও তাদের প্রস্তুতি:

ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ প্রস্তুতি নিতে হলে বর্তমান যুগ-সন্ধিক্ষণে এ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রস্তুতিরও যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বর্তমান বিশ্বে যে দেশেই পরিচালিত হোকনা কেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ দুই পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিপক্ষ হল তাদের প্রভাব বলয়াধীন রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। বাংলাদেশের জন্যে ঐ দুই প্রধান প্রতিপক্ষের সাথে আর একটি বাড়তি প্রতিপক্ষ হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে আমাদের নিকট প্রতিবেশী একটি পাতি বৃহৎ শক্তি। এই প্রতিপক্ষ সার্বিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামের পুনর্জাগরণ ঠেকানোর জন্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের পারস্পরিক স্বার্থের, দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও ইসলামের ইস্যুতে প্রায় সর্বত্র তারা এক ও অভিন্ন ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির কারণে কোথাও কোথাও কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পরিলক্ষিত হলেও সেটা বাহ্যিক ব্যাপার মাত্র। মূলে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও আন্দোলনকে ঠেকানোর ব্যাপারে তাদের কোন শৈথিল্য নেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে তাঁরা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমসমূহ ইহুদীদের সহায়তায় ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে চিন্তার বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে রীতিমত Intelectual and cultural Agression চালাচ্ছে। (বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন) বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে প্রশাসনকে পর্যন্ত ব্যবহার করছে। এনজিওদের জাল বিস্তার করে সামাজিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পাশাপাশি আমাদের স্বকীয় মূল্যবোধ ধ্বংসের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সেই জালে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তুগত সহযোগিতা দিয়ে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের উপর সরাসরি আঘাত হানার ব্যবস্থা করছে।

ইসলামের অর্থ ব্যয়ের বিভিন্ন দিক:

ইসলাম ও ঈমানের মূল দাবীই যেহেতু আল্লাহর কাছে জান ও মাল সোপর্দ করার। ইসলামের বাস্তব কাজ যেহেতু আল্লাহর এবাদত এবং বান্দাদের সেবা করা, সেহেতু মুসলিম সমাজের বিভিন্ন দিকে ও বিভাগে অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা ঐতিহ্যগতভাবেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। 'নদী মরে গেলেও রেখা থাকে' এই প্রবাদ বাক্যের মতই মুসলিম সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ প্রায় হারিয়ে ফেললেও তাদের অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা বা ঐতিহ্য একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

ইসলাম অর্থ-সম্পদের কোরবানীর দু'ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। একটা বাধ্যতামূলক যেমন- যাকাত। অপরটি স্বেচ্ছামূলক। যেমন- গরীব, নিকট আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে দুঃস্থ অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা। কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি কায়েমের কাজে অর্থ ব্যয় করা। স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে অর্থ ব্যয়ের মন-মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্য বাধ্যতামূলক দান যাকাতের একটা ভূমিকা আছে। বরং সত্যি বলতে কি, প্রতিদানের আশা ছাড়া, কোন বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়া মানুষ অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত হোক এটা যাকাতের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।

যাই হোক, বাধ্যতামূলক দান অর্থাৎ যাকাতের যে আটটি খাত আছে তার মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর একটা খাত আল্লাহ্ রেখেছেন। মানুষ স্বেচ্ছামূলকভাবে যে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে, তার-মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর খাতে বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ আছে। শুধু সুযোগ আছে তাই নয় বরং আল্লাহর কোরআন এবং রাসূলের হাদীসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, আল্লাহর পথে জিহাদ হলো সর্বোত্তম আমল। অতএব এই সর্বোত্তম আমলের জন্যে অর্থ ব্যয় হবে সর্বোত্তম খাতে অর্থ ব্যয়- এটাই স্বাভাবিক।

যেই দেশে আল্লাহর দ্বীন কায়েম নেই সেখানে যাকাতের আটটি খাতের মধ্য থেকেও ফি সাবিলিল্লাহর খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হলে যাকাতের উদ্দেশ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দানের সকল দিক ও বিভাগের তুলনায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে দান করাই সর্বোত্তম দান। যে কোন দানের তুলনায় এ কাজের দানে সওয়াব হবে সবচেয়ে বেশি। ইসলামের এই শিক্ষাটা আমরা ভুলতে বসেছি বলেই আজ ইসলামী আন্দোলনের কাজে পয়সা দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক দলে চাঁদা দেয়ার শামিল মনে করে। সর্বোত্তম সওয়াবের কাজতো দূরের কথা, আদৌ সওয়াব হয় কিনা এ সম্পর্কেই সন্দেহ-সংশয় পোষণ করেন। 

ইনফাকের ক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের ঐতিহ্য:

ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্নমুখী ঐতিহ্য সৃষ্টিতে প্রধানতঃ অবদান রেখেছেন আম্বিয়ায়ে কেরামগণ (আ.)। এরপর আল্লাহর সেইসব বান্দাদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য যাদেরকে আল কোরআনে সিদ্দিকীন, সালেহীন এবং শোহাদা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁদের ভূমিকা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হওয়া সত্ত্বেও মনের কোণে প্রশ্ন জাগতে পারে। নবীদের ব্যাপার তো আলাদা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর ব্যাপার তো আরো ব্যতিক্রম। নবীদের সাথী-সঙ্গীদের ব্যাপারও আলাদা। কাজেই দূর অতীতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিকট অতীতের বা আজকের সমসাময়িক বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস-ঐতিহ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।

নিকট অতীতে আমাদের উপমহাদেশে হযরত সৈয়দ আহাম্মদ শহীদ ব্রেলভী পরিচালিত মুজাহিদ আন্দোলনের কথা আমাদের মোটামুটি জানা থাকার কথা। এই আন্দোলনে বাংলার তৌহিদী জনতা যেমন পায়ে হেঁটে যোগদানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অকাতরে এই আন্দোলনের জন্যে আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে মুজাহিদ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বসবাস ছিল সেইসব অঞ্চলের লোকদের মধ্যে এখনও ওশর দান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বীনি খেদমতে স্বতস্ফূর্তভাবে দানের রীতি চালু দেখা যায়। আজকের বিশ্বের দু'টি আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াতে ইখওয়ানুল মুসলেমিনের প্রতিষ্ঠাতা ও এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সাহাবায়ে কেরামগণের জানের কোরবানী ও মালের কোরবানীর ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। সাহাবায়ে কেরামগণ ঈমানের ঘোষণা দিয়ে যেভাবে জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, ইসলামী আন্দোলনে শরীক লোকেরা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুরূপ জুলুম ও নির্যাতনেরই সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁরা যেভাবে অর্থ-সম্পদ এ পথে ব্যয় করতেন আজকের যুগের ইসলামী আন্দোলনের লোকেরাও অনুরূপ ত্যাগ, কোরবানীর প্রয়াস পাওয়ার চেষ্টা করছে। 
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র.) তাঁর অসংখ্য বই-পুস্তকের আয় থেকে কোটিপতি হতে পারতেন কিন্তু তাঁর মধ্য থেকে মাত্র ২/৩টি বইয়ের আয় পরিবারের জন্যে রেখে বাদবাকী সমস্ত বইয়ের (যার অসংখ্য সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। অসংখ্য ভাষায় যার অনুবাদ ও প্রকাশ হয়েছে) ইসলামী আন্দোলনকে ওয়াকফ করেছেন। তাঁর সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাঁরা অনেকেই জীবনের ক্যারিয়ার এই আন্দোলনের জন্যে কোরবানী দিয়েছেন। 

নোট সংকলনে- আরমানের খেরোখাতা 

শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

বইনোট: ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.

ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী

লেখক: সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.
অনুবাদক: মাওলানা আব্দুল মান্নান তালিব

প্রকাশকের কথা :
কোন উদ্দেশ্য, কোন আন্দোলন, কোন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ সফল হতে হলে সে আন্দোলনের সৈনিকদের বিশেষ কতগুলো গুণ থাকা দরকার। যথা: 
১. সুন্দর, বলিষ্ঠ, উন্নত আর উজ্জল চরিত্রের অধিকারী হওয়া।
২. আন্দোলন ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ।
৩. আখেরাতে আল্লাহরসন্তুষ্টি লাভ।

★★মূল বইটি দু'ভাগে বিভক্ত-
০১. ভূমিকা ও 
০২. মূল বক্তব্য।

★বইয়ের ভূমিকাকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

০১. হতাশার দিক :
১) আগ্রহ, উদ্যোগ ও যোগ্যতার অভাব
২) প্রভাবশালী অংশ সমাজ ভাঙ্গনে লিপ্ত
৩) সমাজ ভাঙ্গনে বৃহত্তম শক্তি সরকার।

০২. আশার দিক :
১) সমাজে কিছু সৎ ও যোগ্যলোক রয়েছে
২) সামষ্টিক ভাবে লোকজন অসৎ প্রবণ নয়
৩) ইসলাম বিরোধী শক্তির দুটি জিনিসের অভাব-
ক) চারিত্রিক শক্তি
খ) ঐক্যের শক্তি।

০৩. করণীয় কাজ সমূহ :
১) আবেগ বর্জিত ধীর ও সুস্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে
২) হঠাৎ ফল পাওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে
৩) সুশিক্ষীত কর্মী বাহিনী গঠন করতে হবে
৪) ব্যক্তি গঠন করতে হবে।

★★ মূল বক্তব্য কে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে :

০১. ব্যক্তিগত গুণাবলি সমূহ :

১) ইসলামের যথার্থ জ্ঞান
২) ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
৩) চরিত্র ও কর্ম
৪) দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য।

০২. দলীয় গুণাবলি সমূহ : 

১) ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা
২) পারস্পরিক পরামর্শ
৩) সংগঠন ও শৃঙ্খলা
৪) সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।

০৩. পূর্ণতা দানকারীর গুণাবলি সমূহ :
১) আল্লাহ সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা
২) আখেরাতের চিন্তা
৩) চরিত্র মাধুর্য

০৪. মৌলিক ও অসৎ গুণাবলি সমূহ :
১) গর্ব ও অহংকার
২) প্রদর্শনেচ্ছা
৩) ত্রুটিপূর্ণ নিয়ত।

০৫. মানবিক দুর্বলতা সমূহ :
১) আত্মপূজা
২) আত্মপ্রীতি
৩) হিংসা ও বিদ্বেষ
৪) কুধারণা
৫) গীবত
৬) চোগলখোরী
৭) কানাকানি ও ফিসফিসানী
৮) মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
৯) একগুঁয়েমী
১০) একদেশদর্শীতা
১১) সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতা
১২) সংকীর্ণমনতা
১৩) দুর্বল সংকল্প।

★ গর্ব অহংকার থেকে বাঁচার উপায় সমূহ :
১) বন্দেগীর অনুভূতি
২) আত্মবিচার
৩) মহৎ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি
৪) দলগত প্রচেষ্টা।

★★কয়েকটি বিষয়ে বইয়ের আলোকে ব্যাখ্যা :

★ চরিত্র মাধুর্যের মূল বিষয়বস্তু :
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হতে হবে উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতা দরদী। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাব সম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্ট সহিষ্ণু। তাদের দ্বারা অন্যদের উপকার বিনে ক্ষতি হবে এমন ধারণাও কেউ করতে পারবে না। তারা নিজের প্রাণের চাইতে কমের উপর সন্তুষ্ট থাকবে ও অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশী দিবে। তারা নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করবে ও অন্যের গুণাবলীর কদর করবে।
তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেবার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষত্রুটি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর উপর প্রতিশোধ নেবে না। তারা অন্যের সেবা গ্রহন করে নয় বরং অন্যকে সেবা করে আনন্দিত হবে। তারা কোন প্রকার প্রসংশার অপেক্ষা না করে এবং কোন প্রকার নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। আল্লাহ ছাড়া কারো পুরষ্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। ধন-সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে ক্রয় করা যাবে না কিন্তু সত্য ন্যায়ের সামনে তারা নির্দ্বিধায় ঝুকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের উপর বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থাই তারা ভদ্রতা ও ন্যায়নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এ চারিত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এগুলো তলোয়ারের চাইতেও ধারালো এবং হীরা মনি মুক্তার চাইতেও মূল্যবান। যে এহেন চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনকারী সে তার চারপাশের জনবসতির উপর বিজয় লাভ করে।

★ "দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য" এর ব্যাখ্যা :
সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায় ভুক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরনের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সংগে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যত প্রতিষ্ঠিত থাকলে এরা তার ভালো নাগরিক হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরনের সৎ লোকদের উপস্থিতি কোন কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোক প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্য রুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যই করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদন করার জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্য নিজেদের সময় সামর্থ ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন- মস্তিষ্কের সকল যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমনকি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরনের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিষ্কার করতে পারে। দ্বীনের সঠিক নির্মূল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্য পরিণত করা এগুলো এমনসব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগত ভাবে অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না। বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দলভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেত পারে না। এজন্য বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

★ দূর্বল সংকল্প :
দুর্বল সংকল্পের কারণে মানুষ প্রথম দিকে কাজে ফাঁকি দিতে তাকে। দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইতস্তত করে। উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হয়। যে কাজকে সে নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গন্য করে এগিয়ে এসেছিল দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজকে তার উপর অগ্রাধিকার দিতে থাকে। তার সময়, শ্রম ও সম্পদের মধ্যে তার ঐ তথাকথিত জীবন উদ্দেশ্যের অংশ হ্রাস পেতে থাকে এবং যে দলকে সত্য মনে করে সংযুক্ত হয়েছিল তার সাথেও সে নিছক যান্ত্রিক ও নিয়মানুগ সম্পর্ক কায়েম রাখে। ঐ দলের ভালমন্দের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না এবং তার বিভিন্ন বিষয়ে কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করে না।

★ ধৈর্য :
ক) তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার তড়িৎ ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত না হারানো।
খ) তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতা রোগে আক্রান্ত না হওয়া
গ) বাধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবিলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা।
ঘ) দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া।
ঙ) সকল প্রকার ভয় ভীতি ও লোভ লালসার মোকাবিলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েসের বিপক্ষে কর্তব্য সম্পাদন করা।

★ চরিত্র ও কর্ম :
চরিত্র ও কর্ম হচ্ছে কথা অনুযায়ী কাজ। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে সে তার অনুসরণ করে। যাকে বাতিল বলে গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে থাকে। যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করে। সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, বিরোধীতা ও সকল প্রকার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্য পথে অবিচল থাকে।

★ প্রজ্ঞা :
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। (যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্ব প্রথম যে জিনিসটি সে কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে)। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কম বশেী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এজন্য এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোন কথা অবশ্য নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যই ইসলামী আকিদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা-কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হবে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নিজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্য যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ সরল ভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিক্ষিত লোকদের সকল সন্দেহ সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামী আকিদা ও চিন্তার ভিত্তির উপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মতো গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে।

★ চোগলখোরী :
গীবত যে আগুন জ্বালায় চোগলখোরী তাকে বিস্তৃত করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। স্বার্থবাদিতার প্রেরণাই হয় এর মধ্যে আসল কার্যকর শক্তি। চোগলখোর ব্যক্তি কারুর কল্যাণকামী হতে পারে না। নিন্দিত দুজনের কারুর কল্যাণ তার অভিস্পীত হয় না। সে দুজনেরই বন্ধু সাজে কিন্তু অমঙ্গল চায়। তাই সে মনযোগ দিয়ে দু'জনেরই কথা শুনে, কারোর প্রতিবাদ করে না। তারপর বন্ধুর নিকট এ খবর পৌঁছে দেয়। এভাবে যে আগুন এক জায়গায় লেগেছিল তাকে অন্য জায়গায় লাগাতেও সাহায্য করে। ইসলামী শরীয়তে এ কাজকে হারাম গণ্য করা হয়েছে।

★ "আখেরাতের চিন্তা" এর ব্যাখ্যা :
যারা মুমিন তারা দুনিয়ার সমস্ত কাজ আখেরাতের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই করে। দুনিয়া মুমিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদসত্বেও সে দুনিয়ার জন্যে কাজ করে না বরং আখেরাতের জন্য করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে লক্ষ্য থাকে না বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি। আখেরাতে অকল্যাণ বয়ে আনে এমন সকল কাজ থেকে মুমিন সর্বদা দূরে থাকে। মুমিন তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আখেরাতের জবাবদিহীতার অনুভূতি নিয়ে অতিবাহিত করেন। কারণ আখেরাতের শান্তি ও পুরস্কার দুনিয়ার কাজের উপর ভিত্তি করেই দেয়া হবে। আখেরাতে আল্লাহই একমাত্র বিচারক থাকবেন। আল্লাহকে ভয় করা, তার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আখেরাতের উপলব্ধির উপর নির্ভর করে। তাই বলা যায় আখেরাতের চিন্তা মুমিনের নেক আমল বৃদ্ধির টনিক হিসাবে কাজ করে।

সংকলনে:
আরমানের খেরোখাতা 

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

বইনোট : চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান || লেখক : নঈম সিদ্দিকী


চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান

নঈম সিদ্দিকী


লেখক পরিচিতি:

নঈম সিদ্দিকী, প্রসিদ্ধ ইসলামী সাহিত্যিক। মাসিক তরজমানুল কুরআন এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত "চেরাগে রাহ" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রাসূল (সা.) এর সীরাত "মুহসিনে ইনসানিয়্যাত" নামক গ্রন্থটি (অনুবাদঃ- মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সাঃ) প্রণয়ন করেন। এ বইয়ের মূল নাম ছিল 'তামীরে সীরাত কে লাওয়াযিম'।


চরিত্র: আচার, আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতি, ব্যবহারবিধি, রীতিনীতি, কায়দাকানুন অর্থাৎ যা দ্বারা মানুষের ভালমন্দ বিচার করা যায় তাকে চরিত্র বলে।

ইসলামী সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে কর্মীদের চরিত্রই মুখ্য হাতিয়ার।



বইটি চার ভাগে বিভক্ত :


১. ভূমিকা


২. আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৩. সংগঠনের সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৪. সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক।



ভূমিকাঃ-

মানুষের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, শয়তানের হস্তক্ষেপও ততই ব্যাপকতর হতে থাকে।


শয়তানী তৎপরতার রুপঃ


* পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপুজারী সভ্যতা জাতির নৈতিক পতনকে চরম পর্যায়ে উপনীত করেছে


* সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা জাতির মৌলিক ঈমান আকীদার মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে।


এটি যেন সূরা আরাফের ১৭ নং আয়াতে বর্ণিত শয়তানের চ্যালেঞ্জেরই বাস্তবরুপঃ


" আমি (হামলা করার জন্য) এদের (মানব জাতির) সামনে থেকে পেছন থেকে, ডান দিক থেকে বাম দিক থেকে আসবো।"


. এ অবস্থায় বৈরাগ্যবাদী চিল্লার কিছু মুসলমান আত্মরক্ষার উপদেশ দান করে, যদিও নৈতিক উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশে উন্নত নৈতিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও তা যথেষ্ট নয়-


উদাহারণঃ-


১. মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে আত্মরক্ষার্থে পলায়ন করা স্বার্থপরতার শামীল।


২. নূন্যতম পুজি হলেও তা নিয়ে ময়দানে নামা


৩. চরিত্রের মূলধনকে অনুৎপাদক না রেখে বাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে? এর পরিচালনা ও দেখাশুনার জন্য যাবতীয় উপায় অবলম্বন করা উচিত। মহামারি আক্রান্ত এলাকায় জনগণের সেবা করার জন্য আমাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।"


আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক: উপায় ৪টি


১. পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতা এবং আল্লাহভীতি, নত ও বিনম্ন ভাবসহ মৌলিক ইবাদত সমূহ পালন- বিশেষ করে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে। ইবাদাতের সাথে সাথে আত্মাবিচারে অভ্যস্ত হতে হবে।


২ . কোরআন ও হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন, সাথে ইসলামী সাহিত্যও অধ্যয়ন করতে হবে।


৩. নফল ইবাদত-নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ), নফল রোজা, আল্লাহরপথে অর্থ ব্যয় এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা।


৪. সার্বক্ষণিক যিকির ও দোয়া।


সংগঠনের সাথে সম্পর্ক


আমাদের নিকট সংগঠন কেবল একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনই নয় বরং আমাদের দ্বীনদারী, নৈতিকতা, আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্যের মূর্তপ্রকাশ।


১. আদেশ আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করা। (নিসা-৫৮)


২. অন্ধ আনুগত্য না করা। (মায়েদা-২)


৩. সমালোচনা সুধারণার ভিত্তিতে


৪. ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন না করা। (ইমরান-১৪৪)


৫. কর্মীদের তুলনায় কর্তৃত্বশীলদের দায়িত্ব অনেক বেশী নাজুক প্রকৃতির।


(ক) কোন ভেদাভেদ না করা


(গ) মাফ করে দেয়া সংশোধন করা ও তাদের জন্য দোয়া করা


(গ) বিভিন্ন বিষয়ে কর্মীদের সাথে পরামর্শ করা। (ইমরান-১৫৯)


(ঘ) স্থির সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর তার উপর একাগ্রচিত্তে অটল থাকা।


৫. (ক) চিঠি সার্কুলারকে গুরুত্ব দান


(খ) সময়মত বৈঠকে হাজির হওয়া


(গ) আল্লাহরকাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি নিয়ে কাজ করা। দলীয় চরিত্রে দুর্বলতার প্রকাশ বৃহত্তর গোনাহ এ অনুভূতি নিয়ে কাজ করা।


(ঘ) দায়িত্বানুভূতি নিয়ে কাজ করা। (আল্লাহরনিকট অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করা)।


সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক: ৮টি


১. ফাসেক সংবাদ-বাহকের সংবাদে তড়িৎ সিদ্ধান্ত না নেয়া। বরং অনুসন্ধান করা। (হুজুরাত-৬)


২. ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা। (হুজুরাত-১০)


৩. কাউকে বিদ্রূপ না করা।


৪. পরস্পরের সম্পর্কে কুধারণা না করা, অবস্থা জানবার জন্য গোয়েন্দাগিরি না করা, গীবত না করা। (হুজুরাত-১২)


-সংকলিত

মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়? -মাওলানা ইমাম হোসাইন


দ্বীন বিজয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিহত হয় ইসলামের পরিভাষাগত তাদেরকে শহীদ বলা হয়।

"শহীদ" এই পরিভাষাকে রাসুল (স) আরো ব্যাপকতা অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন: জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে, আগুনে পুড়ে নিহত হওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে,পানিতে ডুবে মারা যাওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুকেও শহীদি মৃত্যু বলে। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রেখে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকেও শহীদি মৃত্যু বলে।

কিন্তু সম্মুখ সমরে দ্বীনের জন্যে লড়াই করে শাহাদাত আর উল্লেখিত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, আগুন এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের মর্যাদা এক নয়। বস্তুত এই দুই অবস্থার মৃত্যুকে তখনই শহীদি মৃত্যু বলা যাবে যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়। অর্থাৎ শাহাদাতের সাথে ঈমান বা বিশ্বাসের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর সকল ন্যায় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তি কি শহীদ?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অধিকার, সাম্য সমতা, মানবিক মর্যাদা, দেশ জাতির জন্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মানুষ অসংখ্য আন্দোলনে মারা গিয়েছে। এদের সবাইকে শরীয়াহর মানদন্ডে শহীদ বলা যাবেনা। শহীদ বলতে হলে ঐ ন্যায্য আন্দোলনের সাথে ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, দেশ ও জাতির দ্বীন এবং ঈমানের অপরিহার্যতার সম্পর্ক লাগবে। এইজন্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের শহীদ বলা গেলেও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নিহতদেরকে ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ডে কি শহীদ বলা যাবে? শহীদ হতে হলে ইসলামের বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। কারণ শহীদ মর্যাদাটি ইসলামী পরিভাষা। মোটকথা কাউকে শহীদ বলতে হলে তার ইমানের অপরিহার্য সম্পৃক্ততা লাগবেই।

বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীদের শহীদ বলা হলেও কথিত মুলধারার জাতিয়তাবাদি, সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী কর্মীদেরকে কি শহীদ বলা যাবে?

[এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার পুর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটগত এবং ব্যবহারগত শহীদ শব্দটির ২টি ধারা বিদ্যমান। যেমন: বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় মর্যাদাগত উপাধিতে দেশের আন্দোলনের যেকোন ব্যক্তিকে শহীদ বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক হিন্দু, নাস্তিক বামদেরকেও শহীদ উপাধি দিয়ে থাকে রাস্ট্র। যা ইসলামের মুলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাইকে মানতে হয়।

দ্বিতীয়ত, দ্বীন আর ইসলামী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিকে ইসলামী দলসমূহ শহীদ বলে থাকে।ফিকহী উসুলের দিক থেকে ইসলামে এটাকেই শাহাদাত বলা হয়ে থাকে যা সকল যুগেরই প্রারম্ভনা আজ পর্যন্ত। ]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো স্বৈরাচার জুলুমকে প্রতিহত করতে সকল দলমতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিহত সবাইকে শহীদ বলতে হলে তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে বলতে হবে। উদাহরণগত জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রবাদি, সেকুলারদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ন্যায্য হলেও পরক্ষণে তাদের বিশ্বাস যে তারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের মানব রচিত বিশ্বাসকে তারা প্রতিষ্ঠিত করবে। সুতরাং তাদের ন্যায্যত আন্দোলন সত্বেও বিশ্বাসের বিচ্যুতকারনে ইসলামী মুলনীতিতে শহীদ হবেনা। বিপরীতে ইসলামি দলগুলো স্বৈরাচার বিরোধী ন্যায্যত আন্দোলনে জুলুমের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামকেই প্রতিষ্ঠারই কর্মপ্রয়াস চালাবে। ফলশ্রুতি তাদের ন্যায্যত আন্দোলনে মাকাসাদ শরীয়াহ থাকার কারণে তাদের কোন কর্মী নিহত হলে শরীয়াহর মূলনীতিতে তাদেরকে শহীদ বলা যাবে।

মৌলিক জিজ্ঞাসা হলো স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামি দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়?

সাধারণত ইসলামি দলগুলো সামগ্রিক গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে না। মুলত গনতন্ত্র হলো আজকের বিশ্বের একটা নিয়মাতান্ত্রিক রাস্ট্রিয় পরিচালনা প্রক্রিয়া। যেখানে গনতন্ত্রের সকল মুলনীতির মাঝে কিছু আছে ইসলামের মূলনীতি সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে আর কিছু আছে যা ইসলামের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামস্টিক দিক ইসলামের সমর্থন যোগ্য।তাই ইসলামি দলগুলো রাস্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে গনতন্ত্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাহন হিসেবে দেখে। যা একালের সকল ইসলামী রাস্ট্রচিন্তাবিদ্বের সর্বসম্মত মত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনমত তৈরীর একটি বাহন হিসেবে গনতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীকে শহীদ বলা যাবে। বাহনগত দিক থেকে তা গনতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও মাকাসাদে শরিয়াহ তথা উদ্দ্যেশ্যগত দিক থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

[এছাড়াও বাংলাদেশের এখনকার আন্দোলন মুলত নিয়মাতান্ত্রিক জুলুম তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ জাতি এবং সামগ্রিক ইসলামকে অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলন। শুধুমাত্র একটা গনতন্ত্র শব্দ দিয়ে এই ন্যায্য আন্দোলনকে হালাল হারাম ফতোয়ার প্যাঁচে ফেলানো নিতান্তই চাটুলতা। ]

সুতরাং সকল আন্দোলনে যে কাউকে শহীদ বলতে হলে তার বিশ্বাস এবং মাকাসাদ তথা উদ্দ্যেশ্যে হতে হবে ইসলাম এবং শরীয়াহ। আর সকল ইসলামী দল তাদের সকল আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের মাকাসাদ থাকে মূলত হুকুমতে শরিয়াহ এবং ইকামাতে দ্বীন।

[বি: দ্র: শাহাদাতের কবুলিয়াত আল্লাহর দিকেই নিসবত। কাউকে আমাদের শহীদ বলা না বলার মধ্যে শহীদি মর্যাদা নির্ভর করে না। মূলত এটি আখেরাতের অর্জন। দুনিয়াতে আপনি যাকে শহীদ বলতেছেন পরকালে সে হয়তো আল্লাহর নিকট শহীদ না। আবার আমরা যাকে শহীদ মনে করতেছিনা হয়তো সে আল্লাহর নিকট শহীদ। এইজন্য মুমিন সবসময় তার ভাইয়ের শাহাদাতের দোয়া করবে।]


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।

মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪

দারসুল কুরআন : সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭



【 দারসুল কুরআন : সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭ 】
বিষয় : মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় আমাদের তৎপরতা
- প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলাম
---------------------------------------------------
يَآ أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১) قُمْ فَأَنْذِرْ (২) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (৩) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (৪) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (৫) وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِر (৬) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ. (৭)
✦ সরল অনুবাদ
১. হে কম্বল মুড়ি দিয়ে শায়িত ব্যক্তি ২. উঠুন এবং সতর্ক করুন ৩. এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব ঘোষণা করুন ৪. আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন ৫. প্রতিমা থেকে দূরে থাকুন ৬. অধিক প্রাপ্তির আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করবেন না ৭. এবং আপনার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন। (সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭)

✦ নামকরণ
প্রথম আয়াতের ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) অর্থ বস্ত্র বা কম্বল আচ্ছাদনকারী। এখানে ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করা হয়েছে।

✦ নাযিল হওয়ার সময়কাল

সূরা আল-মুদ্দাসসির দু’টি অংশে নাযিল হয়। প্রথম অংশে সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয়। এটি সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরাহ আলাকের পর নাযিল হয়। অর্থাৎ সম্ভবত এ আয়াতগুলো ৬১০ খ্রি. শাওয়াল মাসে নাযিল হয়।
দ্বিতীয় অংশে অষ্টম আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল হয়। এটি প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথমবার মক্কায় হজের মওসুম সমাগত হলে নাযিল হয়।

✦ সূরার বিষয়বস্তু

- সূরার প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মহান রবের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা তাওহিদের প্রতি আহ্বান এবং আহ্বানের ক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৮-৫৩ আয়াতে সত্য দ্বীন অমান্যকারীদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে কিয়ামতের দিবসে তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৫৪-৫৬ আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশ। কিন্তু এ উপদেশ কবুল করার জন্য আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন না। যে গ্রহণ করবে সে-ই উপকৃত হবে; আর যে গ্রহণ করবে না সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

✦ নির্বাচিত আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয়

সূরাহ আল-মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি সংক্রান্ত ছয়টি নির্দেশনা প্রদান হয়েছে।
প্রথম নির্দেশ : قُمْ فَأَنْذِر অর্থাৎ উঠুন এবং বিশ্ববাসীকে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপনের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
দ্বিতীয় নির্দেশ : وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ অর্থাৎ মহান রবের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করুন ও প্রতিষ্ঠা করুন।
তৃতীয় নির্দেশ : وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ অর্থাৎ পোশাক, দেহ, অন্তর ও মনকে পবিত্র করুন।
চতুর্থ নির্দেশ : وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ অর্থাৎ প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকুন।
পঞ্চম নির্দেশ : وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ অর্থাৎ পার্থিব প্রতিদানের আশায় কাউকে দান ও অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থাকুন।
ষষ্ঠ নির্দেশ : وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ অর্থাৎ সর্বাবস্থায় রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন।

✦ নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ

» প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা
: يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ “ওহে বস্ত্র আচ্ছাদিত ব্যক্তি।”
আরবীতে কাউকে ডাকার জন্য ‘হরফে নিদা’ (حرف ندا) ব্যবহার করা হয়। এখানে ‘ইয়া আইয়ুহা’ (يَا أَيُّهَا) ‘হরফে নিদা’। আর যাকে ডাকা হয় বা সম্বোধন করা হয় সেটি মুনাদা। এ আয়াতে মুহাম্মাদ সা.-কে ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) তথা ‘ওহে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এটি প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন। মহান আল্লাহ অন্য সকল নবীকে আহ্বান করার সময় নাম ধরেই সম্বোধন করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ সা.-কে কখনও ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বলেননি, বরং তাঁকে অতি আদর করে সম্বোধন করেছেন। এটি রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি বিশেষ সম্মান।
সূরাহ আলাক নাযিলের পর কিছুকাল পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপর অহি নাযিল বন্ধ থাকে। এ সময়কে ‘ফাতরাতুল অহি’ বলে। সে সময় রাসূলুল্লাহ সা. এতো কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। অহি নাযিলের বিরতির শেষভাগে একদিন রাসূল সা. পবিত্র মক্কায় পথ চলাকালে ওপর দিক থেকে কিছু আওয়াজ শুনতে পান। তিনি ওপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পান যে, ফেরেশতা জিবরিল (আ) আকাশে একটি ঝুলন্ত আসনে উপবিষ্ট আছেন। ফেরেশতাকে এমতাবস্থায় দেখে তিনি ভীত-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরে বললেন- زمِّلونى زمِّلونى (আমাকে চাদরাবৃত কর, আমাকে চাদরাবৃত কর।) অতঃপর তিনি চাদরাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন।
সে অবস্থায় রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে ডেকে বলা হচ্ছে, হে আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ সা.! আপনি চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছেন কেন? আপনার ওপরে তো একটি বিরাট মহৎ কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য আপনাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে। অতঃপর তাঁকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ছয়টি কাজের নির্দেশ দেয়া হয়। (ইবনে জারির)

» দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা : قُمْ فَأَنْذِر “উঠুন অতঃপর সতর্ক করুন।”
এখানে ‘কুম’ (قُمْ) এবং ‘আনযির’ (أَنْذِر) দু’টি শব্দে একটি আয়াত। দু’টি শব্দই ‘আমর’ বা আদেশ সূচক। ‘কুম’ (قُمْ) অর্থ উঠুন, দ-ায়মান হোন, কর্মে তৎপর হোন ইত্যাদি। আর ‘আনযির’ (أَنْذِر) অর্থ সতর্ক করুন, ভয় দেখান ইত্যাদি।
এ আয়াতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দেন, হে কম্বলজড়ানো ব্যক্তি! আপনার কম্বল জড়িয়ে শয্যা গ্রহণের অবকাশ কোথায়। আপনার প্রতি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার এক বিরাট দায়িত্ব চাপানো হয়েছে, আপনি উঠুন। আমার একত্ববাদ প্রচার করুন এবং যারা আমার সত্তায়, গুণে ও ক্ষমতায় আমার সাথে অন্যান্য বস্তুকে শরিক করে তাদেরকে এটার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি এ নির্দেশ এমন এক সময় ও পরিবেশে অবতীর্ণ হয়, যখন মক্কাসহ সমগ্র আরবের লোক ও জনপদগুলো শিরকে নিমজ্জিত ছিল আর তিনি ছিলেন একাকী। তাঁর সঙ্গী-সাথী কেউই ছিল না। এহেন পরিবেশে সর্বজন বিরোধী একটি মতাদর্শ নিয়ে দ-ায়মান হওয়া এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা কত বড় বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার ছিল তা একটু চিন্তা করলেই বোধগম্য হয়। এহেন পরিবেশের মধ্যেই আল্লাহ বললেন, আপনি তৌহিদের পতাকা নিয়ে দ-ায়মান হোন এবং মানুষকে তৌহিদের পরিপন্থী আকিদা-বিশ^াসের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকুন। এটাই আপনার প্রথম কাজ। এ যেন মহা স্রােতের বিপরীতে চলার এক কঠিন নির্দেশ।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলকে সা. ‘নাযির’ তথা সতর্ককারীর দায়িত্বসহ প্রেরণের কথা বলা হয়েছে।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا.
“হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে।” (সূরাহ আহযাব : ৪৫)
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ.
“আমি তোমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী বানিয়ে। আর এমন কোন সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যার মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।” (সূরাহ ফাতির : ২৪)
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (১) قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ.
“আমি নূহকে তার কওমের কাছে পাঠিয়েছিলাম, যেন তিনি তার কওমের লোকদের ওপর এক ভীষণ কষ্টদায়ক আযাব আসার পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করে দেন। তিনি বলেছিলেন, হে আমার দেশবাসী! আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সাবধানকারী।” (সূরা নূহ : ১-২)

» তৃতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা : وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ “আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।”
সূরাহ আল-মুদ্দাসসিরে দ্বিতীয় নির্দেশনায় মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী! মানুষ আমার মহানত্ব, বিরাটত্ব ও অসীমত্বের কথা ভুলে আমার জমিনে শয়তানের কথামত রাজত্ব পরিচালনা করছে। আমার জমিনে এখন বাতিলের রাজত্ব চলছে। লাত, মানতের পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে। অথচ জমিনের মালিক হলাম আমি আল্লাহ। আমার জমিনে শয়তানের রাজত্ব চলতে পারে না। মানবরচিত মতবাদ চলতে পারে না। আপনি উঠুন এবং আল্লাহর তাকবির ঘোষণা করুন। ‘ওয়া রাব্বাকা ফাকাব্বির’ (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ সব জায়গায় ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر) ধ্বনিত হবে। জগতের সর্বত্রই থাকবে আমার শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। মানুষের আকিদা-বিশ^াস হতে শুরু করে তাদের কর্মময় জীবনের প্রতিটি স্তরে থাকবে আমারই শ্রেষ্ঠত্বের ফলিতরূপ। একজন মু’মিন ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر)-এর তাকবির বা স্লোগান ছাড়া কোনো মানুষের তাকবির বা স্লোগান দিতে পারে না। এটি কুফরি স্লোগান। আল্লাহ বলেন, জমিনের মালিক আমি আল্লাহ। এ জমিন এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমার হুকুমে তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ জমিনে আইন চলবে একমাত্র আল্লাহর। এ সম্পর্কে সূরাহ আরাফের ৫৪তম আয়াতে বলা হয়েছে,
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“সাবধান! সৃষ্টি যার, আইন চলবে একমাত্র তার। বরকতময় আল্লাহই বিশ^ জগতের মালিক।”
পৃথিবীতে যতজন নবী ও রাসূল আগমন করেছেন, এটিই ছিলো তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। এ ব্যাপারে সূরাহ আন-নাহলের ৩৬তম আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ.
“প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রাসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, “আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাগুতের বন্দেগি পরিহার করো।”
সকল নবীরই প্রধান কাজ ছিলো মহান রবের একত্ববাদের দিকে আহ্বান করা। সূরাহ আরাফের ৫৯, ৬৫, ৭৩ ও ৮৫তম আয়াতে হযরত নূহ, হুদ, সালেহ, শুয়াইব (আ) এর দাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে,
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ.
“হে আমার দেশবাসী! আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।”
তাই একজন নবীর প্রথম কাজই হলো, অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ পৃথিবীতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ মেনে চলছে তাদের সবাইকে অস্বীকার করবে এবং গোটা পৃথিবীর সামনে উচ্চকণ্ঠে এ কথা ঘোষণা করবে যে, এ বিশ্বজাহানে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ নেই।
ইসলামে ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر) তথা ‘আল্লাহই শ্রেষ্ঠ’ কথাটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘আল্লাহু আকবার’ ঘোষণার মাধ্যমেই আযান শুরু হয়। ‘আল্লাহু আকবার’ এ কথাটি বলে মানুষ সালাত শুরু করে এবং বারবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠে ও বসে। কোন পশুকে জবাই করার সময়ও ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করে। জন্মের সময় শিশুর কানে দেয়া হয় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আবার মৃত্যুর পর সালাতু যানাজার মাধ্যমেও দেয়া হয় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। তাকবির ধ্বনি বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সর্বাধিক স্পষ্ট ও পার্থক্যসূচক প্রতীক। কারণ, মহানবী সা. আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব¡ ঘোষণার মাধ্যমেই রিসালাতের কাজ শুরু করেছিলেন। অতএব একজন মুমিনের ‘আল্লাহু আকবার’ ছাড়া অন্য কোনো স্লোগান হতে পারে না।
» চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যা : وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ “আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন।”
এ আয়াতে ‘সিয়াব’ (ثِيَابْ) ও ‘তাহির’ (طَهِّرْ) দু’টি শব্দ রয়েছে। ‘সিয়াব’ (ثِيَابْ) শব্দটি ‘সাওবুন’ (ثَوْبً) এর বহুবচন। একে ‘লিবাস’ (لباس)ও বলা হয়। এর আসল অর্থ কাপড় বা পোশাক। এর রূপক অর্থ অন্তর, মন, দেহ, কর্ম ইত্যাদি।
অতএব, এ আয়াতে নবীকে সা. নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, হে নবী! আপনি স্বীয় পোশাক ও দেহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখুন, পোশাকের নৈতিক দোষত্রুটি হতে মুক্ত রাখুন। অর্থাৎ পোশাকে অহংকার, গৌরব, রিয়া বা লৌকিকতা থেকে মুক্ত রাখুন। অনুরূপভাবে অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং অসৎচরিত্রতা থেকে মুক্ত রাখুন।
ইসলাম মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হতে শিক্ষা দেয়। হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। তাই মুমিনগণকে সর্বাবস্থায় দেহ, স্থান ও পোশাক বাহ্যিক অপবিত্রতা থেকে এবং অন্তরকে অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখার প্রতি সচেষ্ট হতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা., ইবরাহিম নাখয়ী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ, কাতাদাহ, সায়ীদ ইবন যুবাইর, হাসান বসরী (রহ.) ও অন্যান্য বড় বড় মুফাসসির এ আয়াতের তাৎপর্যে বলেছেন, আপনার চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখুন ও সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজেকে মুক্ত রাখুন।
রাসূলুল্লাহ সা. যে সমাজে ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন তা শুধু আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক আবিলতার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল না বরং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রাথমিক ধারণা স¤পর্কে পর্যন্ত সে সমাজের লোক অজ্ঞ ছিল। এসব লোককে সব রকমের পবিত্রতা শিক্ষা দেয়া ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাজ। তাই তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জীবনের সকল পবিত্রতার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখেন।
নবী করীম সা. স্বভাবগতভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতেন। তাই তিনি যেন সচেতনতার সাথে পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখেন তারই শিক্ষা রয়েছে এই আয়াতে। নৈতিক দিক দিয়ে পোশাক পবিত্রতার অর্থ হচ্ছে- পোশাক এমন হতে হবে যাতে অহংকার প্রকাশ পাবে না, তাতে কুরুচির ছাপও থাকবে না।
মহান আল্লাহ পবিত্রতাকে পছন্দ করেন। যেমন- পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “অবশ্যই মহান আল্লাহ অধিক হারে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা আল-বাকারাহ : ২২২)
পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব স¤পর্কে রাসূল সা. বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন।” (তিরমিজি)
অনুরূপভাবে সূরাহ মায়িদার ষষ্ঠ আয়াতে সালাতের পূর্বে পবিত্রতা তথা অজুর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এক কথায় বলা যেতে পারে, এই আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে-
১. পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
২. পোশাক পরিচ্ছদ নৈতিক দোষত্রুটি থেকে পবিত্র রাখা।
৩. সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজ চরিত্রকে পবিত্র রাখা।
অতএব দায়ী হিসেবে আমাদের সকলকে পবিত্রতার ক্ষেত্রে এ তিনটি দিকেই সতর্ক থাকতে হবে।

» পঞ্চম আয়াতের ব্যাখ্যা : وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ “প্রতিমা থেকে দূরে থাকুন।”
অত্র আয়াতে ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ।
- প্রসিদ্ধ তাবিঈ মুজাহিদ, ইকরামা, কাতাদাহ, যুহরী, ইবন যায়েদ, আবূ সালামা (রহ.) প্রমুখ বলেছেন, ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) অর্থ মূর্তি। অর্থাৎ মূর্তিগুলোকে বর্জন করো, এগুলোর কাছেও যেয়ো না।
- ইবন আব্বাস রা. বলেছেন, এর অর্থ হলো পাপাচার।
- আবু আলিয়া এবং রবী (রহ.) বলেছেন, এর অর্থ অপবিত্রতা এবং গুনাহ।
- ইমাম যাহহাক বলেছেন, এর অর্থ শিরক।
- কালবী বলেছেন, এর অর্থ আজব।
- আল্লামা সাবুনি বলেছেন, এর দ্বারা সর্বপ্রকার খারাপ জিনিস উদ্দেশ্য হতে পারে।
অতএব আয়াতের অর্থ হলো, হে নবী! আপনি প্রতিমা পূজা এবং যাবতীয় গুনাহ ও অপবিত্রতা পরিত্যাগ করুন।
এখানে অপবিত্রতা বলতে, আকিদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার অপবিত্রতা হতে পারে, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্মের অপবিত্রতা হতে পারে আবার শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ এবং ওঠা-বসা চলাফেরার অপবিত্রতাও হতে পারে। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনা, আচার- ব্যবহার, ও দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজকর্ম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের সামান্যতমও যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য মুহাম্মাদ সা.-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং কুচরিত্র থেকে মুক্ত রাখুন।
এ বিষয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করে, রাসূলুল্লাহ সা. তো আগে থেকেই প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত ছিলেন, তার ধারে কাছেও ছিলেন না। তাহলে তাঁকে এ আদেশ দেয়ার অর্থ কী? এর উত্তরে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সা.-কে নির্দেশের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য।

» ষষ্ঠ আয়াতের ব্যাখ্যা : وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ “অধিক প্রতিদানের আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না।”
এ আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে কয়েকটি মেসেজ দেয়া হয়েছে।
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া পার্থিব বিনিময়ের আশায় সকল প্রকার দান-খয়রাত এবং মানব কল্যাণমূলক কাজ করতে এখানে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে কোনো কাজ যদিও ভালো মনে হয়, আর সে কাজের মধ্যে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য না থাকে, তবে সে কাজ আল্লাহর কাছে ভালো বলে গণ্য হবে না।
২. আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করছি, এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর একটি বড় হুকুম পালন করছি। তবে এ কাজটি যদি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য হয় বা নিজের কোনো উপকার হাসিলের জন্য হয়, তাহলে এ আন্দোলন করার মাধ্যমে নাজাত পাওয়া যাবে না।
৩. আমরা যারা সার্বক্ষণিকভাবে দ্বীনের পথে বা দ্বীনি আন্দোলনের পথে কাজ করছি তাদের এ কথা ভাবার বা মনে করার সুযোগ নেই যে, আমি দ্বীনের অনেক উপকার করলাম। বরং মনে রাখতে হবে যে, কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার বা কল্যাণ হয়।
এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার হবে।
১.قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।” (সূরা আনআম : ১৬২)
২.إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ.
“আমি একমুখী হয়ে ¯¦ীয় লক্ষ্য ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের মধ্যে শামিল নই।” (সূরা আনআম, ৬ : ৭৯)
৩. يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (১৭)
“তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ্ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক।”
. ৪وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“(নূহ, হুদ, সালেহ, লূত, শুআইব (আ) জাতির উদ্দেশ্যে বলেন) এ কাজে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদানের প্রত্যাশী নই। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব তো রাব্বুল আলামিনের।” (শুআ’রা : ১০৯; ১২৭; ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)
৫.عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না। তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও ‘আমলসমূহের দিকে। (সহীহ মুসলিম; সুনানু ইবন মাজাহ)
৬.أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.
নুমান ইবন বাশীর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জেনে রাখ, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে- তা বিশুদ্ধ থাকলে গোটা শরীর সুস্থ থাকে। আর তা বিনষ্ট হলে গোটা শরীরই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখো ঐ গোশতের টুকরাটি হলো মানুষের কলব বা আত্মা। (সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম)
৭. عَنِ الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: ্রذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا.
আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূল সা. বলেছেন, সে ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করেছে, যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সা.-কে নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে। (জামি তিরমিজি; সহীহ মুসলিম)
৮.عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
আবু উমামা আল-বাহলি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সে-ই পূর্ণ ঈমানদার। (সুনানু আবি দাউদ)

» সপ্তম আয়াতের ব্যাখ্যা : وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ “এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।”
অত্র আয়াতে সবর সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার।
১. ‘আস-সাবরু আলাল মা‘আসী’ তথা অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ধৈর্য।
২. ‘আস-সাবরু আলাত ত্বাওয়া’ তথা আনুগত্যে ওপর ধৈর্য।
৩. ‘আস-সাবরু আলাল মাসিবাহ’ তথা বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ। অতএব সকল অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক।
এ আয়াতটি নবুয়তের একেবারে প্রথম দিকের আয়াত এবং মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব¡ ও বড়ত্ব ঘোষণা নিয়ে মুহাম্মাদ সা. এখনো ময়দানে নামেননি। তাই তিনি এই ঘোষণা নিয়ে ময়দানে নামলে তার সাথে কী কী নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা.-কে আগেই সবরের শিক্ষা দিয়েছেন।
এ পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদ-মুসিবতই আসুক না কেন প্রভুর উদ্দেশ্যে সেসব বিপদের মুখে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে এবং অত্যন্ত অটল ও দৃঢ়চিত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গেলেই খোদাদ্রোহী শক্তির সাথে বিরোধ হবেই। এ জন্যই সকল নবী বা রাসূলের সাথে সমসাময়িক শাসকদের বিরোধ হয়েছে। আজও যারা বলে আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই। তাদের ওপরও জুলুম নির্যাতন চলে। অতএব এ বাধা, নির্যানত ছিল, আছে এবং থাকবে। এ অবস্থায় ধৈর্যের সাথে সামনে অগ্রসর হতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সা. প্রথম অহি প্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে খাদিজা রা.-কে ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি তাঁকে ওয়ারাকা ইবন নওফিলের কাছে নিয়ে গেলে ওয়ারাকা সব কথা শুনেই রাসূল সা.-কে বলেছিলেন, ইনি সে দূত (النَّامُوسُ) যাঁকে আল্লাহ মূসা (আ) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রা. ইন্তেকাল করেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও আল-হাদিসে সবরের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। আমরা এ আয়াতের ব্যাখ্যার জন্য এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস অধ্যয়ন করতে পারি। (যেমন- সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৩; আলে ইমরান : ২০০; আনফাল : ৪৬; সোয়াদ : ১৭; কাফ : ৩৯)

✦ আয়াতসমূহের শিক্ষা
১. আল্লাহর দ্বীনি দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি কিংবা মনের কষ্টের কারণে ঘরে শুয়ে বসে থাকা যাবে না।
২. রাসূল সা.-এর অনুকরণে আমাদেরকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে হবে এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
৩. আয়াতে পবিত্রতার শিক্ষা আমাদের পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মুমিন ও দায়ী হিসেবে বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি সকল প্রকার শিরক, কুফর, ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে অন্তর ও চরিত্রকে পবিত্র রাখতে হবে।
৪. আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। বৈষয়িক কোন উদ্দেশ্য এখানে থাকবে না।
৫. পার্থিব বিনিময় পাওয়ার আশায় অন্যকে দান করা যাবে না। কারো কোনো উপকার করলে তার বিনিময়ের আশা করা যাবে না। হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় পাওয়ার আশায় দেয়া যাবে না। এমনকি আল্লাহর কোনো বন্দেগি বা নেক কাজ করে কিংবা দ্বীনের কাজ করে মনে করা যাবে না যে, আল্লাহর মহা উপকার করলাম। কেননা কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার বা কল্যাণ হয় মনে করতে হবে।
৬. এ কাজ করতে গিয়ে বাতিলের আক্রমণ ও বাধার সম্মুখীন হলে চুপ থাকা যাবে না; বরং দৃঢ়পদে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে সবর অবলম্বনের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে আমরা সবাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, হে আল্লাহ! আমাদেরকে সকল প্রকার বাহ্যিক ও আত্মিক পাপাচার ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩

বইনোট | সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা | আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ

বইনোট  সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা  আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ
বইনোট 

সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা 
আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ


লেখক পরিচিতি

আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ উপমহাদেশের ইসলামি পুনর্জাগরণে এক প্রবাদ পুরুষ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এই মনীষী ১৯৭০ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা কেন্দ্রের সচিব ছিলেন। তাঁর সাহচর্যে সমৃদ্ধ হয়েছেন ইসলামি পুনর্জাগরণে নিবেদিত অনেক দায়িত্বশীল, যারা আজ এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামি জাগরণে ভূমিকা রাখছেন। তাঁর প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বই ইতোপূর্বে বাংলায় অনূদিত হয়েছে এবং ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছে। মসজিদুল হারাম কমপ্লেক্স পুননির্মাণে অবদানের জন্য তাঁর সম্মানে হারাম শরিফে একটি গেটের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাবে মুরাদ'।

বর্তমান গ্রন্থটি তাঁর ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্যে তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রদত্ত কতকগুলো ভাষণের সংকলন।

অনুবাদক পরিচিতি

ড. আবু খলদুন আল-মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি, ঢাকার বারডেম একাডেমি থেকে এমফিল এবং মালয়েশিরার ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স মালয়েশিয়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে এ পর্যন্ত তাঁর বিশটিরও বেশি মৌলিক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইসলাম সম্পর্কে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাতটি।

ড. শারমিন ইসলাম মাহমুদ ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স মালয়েশিয়া থেকে মেডিকেল এথিক্স এ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্নাস ও মাস্টার্স পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি দুটো স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। বর্তমানে তিনি নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। Ethics এর উপর তাঁর মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ IIIT, USA থেকে প্রকাশিত হয়েছে।


মূল বই

প্রথম অধ্যায়: আত্মোউন্নয়নের পদ্ধতি

জীবনের লক্ষ্য
জান্নাতের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ
আপনার মিশন
তাযকিয়া অর্জনের পূর্বশর্ত;
১.তাযকিয়া-আপনার ব্যক্তিগত দায়িত্ব
২.নিখাদ প্রচেষ্টা 
৩.সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি
৪.আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভরতা 
৫.সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার 
৬.তাযকিয়া-একটি সার্বিক প্রক্রিয়া 
আশীর্বাদ ও সুফল

প্রথম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

একজন মুসলমানের জন্য জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বেহেশত অর্জন। আর এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী, আজীবন স্থায়ী প্রক্রিয়া যা যে কোনো মুহূর্তেই শুরু করা যায়। এই লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ় ইচ্ছাই এই কাজের উপায় বাৎলে দেয় এবং লক্ষ্য অর্জনে গতি সঞ্চয় করে।

আত্মউন্নয়নের লক্ষ্যে আপনার আদর্শ হচ্ছে স্বয়ং রসুল মুহাম্মদ সা.। আর এই লক্ষ্যে এগুতে হলে আপনার দায়িত্বশীল আপনাকেই হতে হবে। আপনার মাঝে প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত করতে হবে। আপনার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে এবং প্রয়োজনীয় চেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে জীবনের সব কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত প্রতিটি বৈধ কাজই তাযকিয়া অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ক্ষমার গুণে আমাদের ছোট-ছোট ভুলগুলোকে মাফ করে দিতে পারেন এবং আল্লাহ তায়ালার এই দয়া বা ক্ষমালাভ আমাদের বেহেশত গমনের পূর্বশর্ত।

আর যে লোক নিজের খোদার সম্মুখে দাঁড়ানোর ভয় করেছিল এবং প্রবৃত্তির খারাপ কামনা-বাসনা হতে বিরত থেকেছিল, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা (সূরা নাযিয়াত, ৭৯ ৪০-৪১)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর সফল এবং পরিশুদ্ধ বান্দাদের মাঝে শামিল হওয়ার তৌফিক দান করুন কেন না, প্রকৃত পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি তো আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকেই দান করবেন (যারা এই পবিত্রতা ও শুদ্ধি পায় না) তাদের প্রতি এক বিন্দু পরিমাণ জুলুম করা হয় না (সুরা নিসা, ৪:৪৯ ) ।

আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং তাঁর দয়া যদি তোমাদের উপর না থাকতো তাহলে তোমাদের মধ্যে কেউই পাক পবিত্র হতে পারতো না। বরং আল্লাহ তায়ালাই যাকে চান পরিশুদ্ধ করে দেন। আর আল্লাহ তায়ালাই সর্ব-শ্রোতা সর্বাধিক শুনেন ও সর্বাজ্ঞে (সুরা নূর, ২৪ : ২১)।


দ্বিতীয় অধ্যায়: জিকিরপূর্ণ জীবন

জিকিরের তাৎপর্য জিকিরের অর্থ
জিকিরের পদ্ধতি
সদা-সর্বদা আল্লাহ তায়ালার স্মরণ
জিকিরের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মসূচি
জিকিরের ব্যক্তিগত পন্থা
সালাত (নামাজ)
মনস্তাত্বিক ও মানসিক প্রস্তুতি
শারীরিক প্রস্তুতি
সঠিক নিয়মে নামাজ আদায়
তাহাজ্জুদ নামাজ
সিয়াম (রোজা)
আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা পূরণ
ইচ্ছাশক্তি
শয়তান থেকে আত্মরক্ষা
কুরআন তেলাওয়াত/অধ্যয়ন
 কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি
কুরআন : আপনার নিত্যসাথী
সামষ্টিক জিকিরের পন্থাসমূহ
সত্যপন্থীদের সঙ্গ অনুসন্ধান
মানবতার সামনে সত্যের সাক্ষ্য হওয়া
আপনার জিকিরকে সংগঠিত করুন

দ্বিতীয় অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আপনার চূড়ান্ত সাফল্য ও মুক্তি নির্ভর করছে আপনার আত্মার পরিশুদ্ধির উপর। আত্মার পরিশুদ্ধির চাবিকাঠি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার জিকির।
আপনি একদিকে সার্বক্ষণিক এবং অব্যাহতভাবে অন্তরে আল্লাহ তায়ালা সচেতনতা জাগ্রত করে প্রতিদিনের সকল কথা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রিত করুন। অন্তরে এই চেতনা বদ্ধমূল করুন যে, আল্লাহ তায়ালা সব সময় আমাদের দেখছেন, সকল কথা কাজ এবং চিন্তার খবর রাখছেন, আমাদের সকল সম্পদ আসলে তাঁরই মালিকানাভুক্ত, তিনি এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং সর্বোপরি আপনাকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে জবাবদিহির জন্য। অপরদিকে আপনি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করুন। এই পন্থাগুলোর নিয়মিত সুসংগঠিত এবং আন্তরিক চর্চা ইনশাআল্লাহ আপনাকে সার্বক্ষণিক আল্লাহ তায়ালার স্মরণসম্পন্ন এক জীবন উপহার দেবে ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রায়ই বেশি বেশি করে তার স্মরণ করার তৌফিক দিন। আমাদের অন্তর আল্লাহ তায়ালার স্মরণে প্রশান্তি লাভ করুক।


তৃতীয় অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত হওয়া

আল্লাহ তায়ালাকে দৃঢ়ভাবে ধারণের বৈশিষ্ট্য
আল্লাহ তায়ালার শুকুরগুজার হওয়া
আল্লাহ তায়ালার ইবাদত
ইবাদতে আন্তরিকতা 
আল্লাহ তায়ালার প্রেম
আল্লাহ তায়ালার পথে হানিফ হওয়া
জিহাদ-আল্লাহ তায়ালার পথে সংগ্রাম
আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার পথে বাধা সমূহ:
ক. অহংকার
খ. মোনাফেকি
গ. হতাশাবাদ
ঘ. অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ
ঙ. জিহবার অপব্যবহার
চ. যৌন লালসা

তৃতীয় অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

সহজ সরল পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) চলার জন্য কুরআন কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, দৃঢ়ভাবে আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে ধারণ করা।

আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার মানে হচ্ছে আপনি আপনার সকল অর্জনের জন্য শুধুমাত্র তাঁরই হামদ ও শুকর করবেন, শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করবেন, পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভালোবাসবেন, শুধুমাত্র তাঁর জন্য সংগ্রাম করবেন এবং হানিফ হতে চেষ্টা করবেন।

একই সাথে আল্লাহ তায়ালার রজ্জু ধারণের বাধা গুলোর কথা খেয়াল রাখবেন, এগুলো হচ্ছে গর্ব, শঠতা, হতাশা, অনিয়ন্ত্রিত রাগ, জিহ্বার (কথা) অসংযত ব্যবহার এবং অননুমোদিত যৌন লালসা।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেদায়াতের পথে চালিত করুন, কারণ তিনি যাকেই চান তাকেই হেদায়াতের পথে চালিত করেন ( সুরা ইউনুস, ১০ : ২৫)।


চতুর্থ অধ্যায়: আল্লাহর রসুলের সা. সাথে সম্পর্কিত হওয়া

মু'মিনের জীবনে সুন্নাহর গুরুত্ব
রসুল সা.-এর মিশন
সুন্নাহ অধ্যয়নে দিক-নির্দেশনা
পশ্চিমা সমাজের প্রেক্ষাপটে সুন্নাহ
সুন্নাহ শব্দের প্রকৃত অর্থ
আপনার মিশন

চতুর্থ অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আমাদের জীবনে অনুকরণীয় মডেল হিসেবে রসুলকে সা. সবার আগে এবং সবার উপরে স্থান দিতে হবে। আমাদের সকল ভালোবাসা সবার উপরে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসুলের জন্য নির্দিষ্ট রাখতে হবে।

মানুষের সামনে আল্লাহ তায়ালার খলিফা হিসেবে তাঁর শেষ নবির সা. বাণী পৌঁছে দেওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমাদের কথা, কাজ, কর্তব্যনিষ্ঠা, দয়া ও ভালোবাসার গুণের মাধ্যমে আমাদের সকল সহকর্মী, প্রতিবেশীকে বুঝাতে হবে ইসলাম কি? এবং রসুল সা.-এর মিশন কি?

অবএব এই কাজে রসুল সা.-এর দয়ার গুণ অনুসরণে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁর গুণ অর্জনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত সুন্নাহ্ শেখাতে সক্ষম হবো। তখনই সম্ভবত আমাদের এই পৃথিবীর জীবন শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়ে দেখা দিবে।


পঞ্চম অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার পথে ব্যয়

দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয়
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ব্যয়
ছোট-ছোট দান
দানের ধরন
দুনিয়াপ্রীতি
অন্যদের ক্ষমা করা

পঞ্চম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আপনি যাই খরচ করতে পারেন তা খরচ করুন আপনার পরিবারের ভরণপোষণে এবং দরিদ্রদের কল্যাণে। ইসলামের প্রয়োজনে দান করতে আরও উদার ও মুক্তহস্ত হোন। মনে রাখবেন ইসলামের পথে খরচের এখনই সময়। আপনার হাতের সব ধরনের সম্পদের ব্যবহার করুন; আপনার সময়, মনোযোগ, হৃদয়, মন, বাচনভঙ্গি, লেখনি, যুক্তি, বুদ্ধি, যা কিছু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দিয়েছেন তা তাঁরই দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত করুন। দুনিয়ার প্রেম যেন আপানাকে গ্রাস না করে, আল্লাহ তায়ালার দয়া ও ভালোবাসা পেতে চাইলে মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন, তাদের প্রতি দয়ালু হোন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে নয় বরং দুনিয়াপ্রীতি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন। তিনি আমাদের যে নেয়ামত বা সম্পদ দিয়েছেন তা তাঁর পথে ব্যয় করার তৌফিক দিন।

ষষ্ঠ অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক

আমলের রেজিস্ট্রার
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
মালিক ও শ্রমিকের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
জীবজন্তুর অধিকার

ষষ্ঠ অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

সকল সৃষ্টজীব আল্লাহ তায়ালার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালাবাসেন যারা তাঁর পরিবারের সদস্যদের দয়া ও সেবা করেন। অন্যের প্রতি মামাদের দায়িত্ব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, ব্যক্তির হক নষ্ট করার কোনো ক্ষমা নেই।

আপনার নিজের প্রয়োজন পূরণের পর আপনার প্রথম দায়িত্ব আপনার পরিবারের প্রতি। বস্তুত আল্লাহ তায়ালার পর আপনার উপর সবচাইতে বড় দায়িত্ব আপনার পিতা-মাতার প্রতি। আপনার স্ত্রী/স্বামীর প্রতি আপনার দায়িত্ব পূরণ করুন এবং আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে আপনার সন্তানদের যত্ন নিন। আপনার পার্শ্ববর্তী মুসলিমের প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে মনে রাখবেন যে, ইমানের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালোবাসা । উদ্যোক্তা (মালিক) হিসেবে সব সময় মনে রাখবেন যে আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর উপর আপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। একইভাবে কর্মচারী (শ্রমিক) হিসেবেও আপনার দায়িত্ব হচ্ছে আপনার কাজ দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে করা।

আখেরাতে আপনার ভাগ্য আরও নির্ধারিত হবে এটার ভিত্তিতে যে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে আপনার প্রতিবেশীর উপর দায়িত্ব আপনি কীভাবে পালন করেছেন। রসুল সা. অমুসলিমদের প্রয়োজনের দিকে সবসময় বিশেষ খেয়াল রাখতেন, এমনকি মুসলিম সমাজের দারিদ্র সত্ত্বেও।

জীব-জানোয়ারেরও অধিকার আছে, কারণ তারাও আল্লাহ তায়ালার পরিবারভুক্ত। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন সেই সব প্রাণীর স্বার্থের বিষয়ে যারা কথা বলতে পারে না। তাদের উপর আরোহন করুন যখন তারা সুস্থ এবং তাদের গোশতও খাবেন যখন তারা সুস্থ্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে সক্ষম ও সচেতন করুন।

সপ্তম অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ

জীবনের লক্ষ্য
পরকালের বাস্তবতা
মৃত্যু নিশ্চিত ও অনিবার্য 
মানুষের পরকাল ভুলে যাওয়ার প্রবণতা
আল্লাহ তায়ালার দয়া অন্বেষণ
আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা অনুসন্ধান
আত্মসমালোচনা
মৃত্যুভয় জয় করা
 
সপ্তম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আমাদের জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। এটা হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যা আমাদের আজই এবং এখনই নিতে হবে। এই একটি সিদ্ধান্ত আমাদের গোটা জীবনের চলার দিক ও লক্ষ্যের নির্দেশনা দেবে। যে পথের কথা বলা হয়েছে কুরআনে, যে পথে চলার উদাহরণ রেখে গেছেন মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা.।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের যে জ্ঞান দিয়ে ধন্য করেছেন তাই হবে আমাদের এ পথে চলার সহায়ক। আমাদের মিশন যখন সফল হবে তখন আমরা দেখবো আমাদের দোয়ার জবাব আল্লাহ তায়ালা দিচ্ছেন, আমাদের প্রয়োজনে তাঁর সাহায্য ও মদদ পাচ্ছি ঠিক যেমনটি তিনি বলেছেন :

হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার অনুগত বান্দাদের মধ্যে শামিল হও আর আমার বেহেশতে প্রবেশ করো (সুরা ফজর, ৮৯ : ২৭-৩০)।



(পূর্ণাঙ্গ নোট চলমান)