Close
Showing posts with label ইসলামী আন্দোলন. Show all posts
Showing posts with label ইসলামী আন্দোলন. Show all posts

Monday, May 5, 2025

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

•ভূমিকা: 
ইতিহাসের পাতাজুড়ে সত্য ও স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের বহু গৌরবগাথা রচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধ বদর থেকে শুরু করে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ রক্তস্নাত সংগ্রামের উদাহরণ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বালাকোটের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনা একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। এই অসমযুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রেরণাদায়ী নেতা শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সাহসী সহযোদ্ধাদের নিয়ে যে শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপী ৬ মে দিনটিকে "বালাকোট দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন করে থাকে। বালাকোটের শহীদদের সেই ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ ভারতীয় মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা একটি স্বাধীন আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

•বালাকোটের ঐতিহাসিক পটভূমি:

উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর বালাকোট, যা আজকের পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার মেনশেহরা জেলার কাগান উপত্যকার প্রবেশপথে অবস্থিত। আঠারো শতকের শেষ দিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আফগান দুররানি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে, শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৮ সালে শিখ বাহিনী পেশোয়ার দখল করে নেয়, যার ফলে সেই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী শিখ শাসনের অধীনে চলে আসে। শিখ শাসকদের অধীনে মুসলমানরা তখন জুমার নামাজ, আজান, কুরবানি, এমনকি ধর্মীয় পোশাক পরিধানেও বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। এই অবমাননাকর অবস্থা মুসলমানদের মনে তীব্র কষ্ট ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার অনেক মুসলিম সরদার ও খান নিজেদের জীবন ও ধর্ম রক্ষার জন্য দিল্লির একজন প্রখ্যাত ইসলামী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শরণাপন্ন হন। একই সময় ভারতজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদও তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী পরিচয় বজায় রাখা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার তাগিদ তীব্র হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় একটি অখণ্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজাদী আন্দোলন। এই ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী (১৭৮৬-১৮৩১) - ভারতের এক খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও সামরিক নেতা।

•সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর জীবন ও আন্দোলনের বিস্তৃত পটভূমি:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ১৭৮৬ সালে এলাহাবাদের রায়বেরেলভী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলমুল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিল্লি যান এবং বিখ্যাত আলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একসময় টঙ্কের নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যখন আমীর খান ইংরেজদের সাথে আপস করেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী সেই আপসের বিরোধিতা করে সৈন্যদল ত্যাগ করেন এবং স্বাধীন ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। ১৮১৮ সালে দিল্লি ফিরে এসে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে রোহিলখণ্ড, আগ্রা, মিরাট, মুজাফফরনগর, সাহারানপুর, লক্ষ্ণৌ, বেনারসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংস্কার ও ইসলামী জাগরণমূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা এমন ছিল যে, বহু বিখ্যাত আলেম তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

১৮২১ সালে তিনি প্রায় ৪০০ ভক্তসহ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন, যেখানে উপমহাদেশের বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। এ সময় বাংলার সাহসী নেতা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর তাঁর সান্নিধ্যে আসেন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে সৈয়দ আহমদের প্রভাব উপমহাদেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন এবং তিতুমীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমান্তরালে চলছিল, যা মুসলমানদের একসাথে জাগরণের পরিচায়ক।

হজ থেকে ফিরে এসে সৈয়দ আহমদ দুই দিক দিয়ে তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যান:
সমাজ থেকে কুসংস্কার, শিরক, বিদআত ও জুলুম নির্যাতন দূর করে মুসলমানদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করা;

এবং ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর আন্দোলনে সুফি তরিকার আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট।

১৮২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হিজরত করেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ারে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় এক থেকে দুই হাজার মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এই অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রতি গভীর প্রেম ও স্বাধীনতার দৃঢ়সংকল্পের প্রতিফলন।

পেশোয়ারে পৌঁছে স্থানীয় মুসলমানরা তাঁকে "আমীরুল মুমিনিন" (মুমিনদের নেতা) হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি সেখানে একটি ইসলামী শাসন কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেন এবং স্থানীয় পাঠান গোত্রগুলোর সহায়তায় শিখ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নেন।

প্রথমেই আকোড়া নামক স্থানে এক অতর্কিত রাতের যুদ্ধে তাঁর মুজাহিদ বাহিনী প্রায় ৭০০ শিখ সৈন্যকে পরাজিত করে, যদিও এতে প্রায় ৮০ জন মুসলিম মুজাহিদ শহীদ হন। এই বিজয় মুজাহিদদের মনোবলে নতুন উদ্দীপনা আনে এবং জিহাদের ময়দানে তাদের অটুট বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

মহারাজা রঞ্জিত সিং গোপনে পাঠান গোত্রপতিদের ঘুষ দিয়ে সৈয়দ আহমদের বিপক্ষে দাঁড় করান। ১৮৩০ সালের শেষ দিকে স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে তাঁর বহু সেনা হতাহত হয় এবং তিনি বাধ্য হন পেশোয়ার ত্যাগ করে পাহাড়ি অঞ্চল বালাকোটে আশ্রয় নিতে। তবুও তিনি হার মানেননি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা কৌশলে শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে, তিনি মানসেহরা জেলার দুর্গম পার্বত্য এলাকা বালাকোটকে জিহাদের শেষ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেন, যা পরিণত হয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে।

•বালাকোটের চূড়ান্ত যুদ্ধ: আত্মত্যাগের অমরগাথা:


একদিকে সীমান্ত এলাকার সর্দারদের অর্থলোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে শিখদের বিশাল সুসজ্জিত বাহিনী-এই অসম পরিস্থিতিতেও বীর মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) হাল ছাড়েননি। পাহাড়ঘেরা দুর্গম উপত্যকায় থেকেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দৃঢ়সংকল্পে অটল ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যাচারী শিখ ও ইংরেজ শাসকদের বিতাড়ন করে ভারতবর্ষে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।

বালাকোট-চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ উপত্যকা, সৈয়দ আহমদের ইসলামী আন্দোলনের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে, শুক্রবার ভোরবেলা, এই উপত্যকায় শেষ লড়াই শুরু হয়। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধা শাহ ইসমাঈল দেহলভী প্রায় ৬০০-৭০০ মুজাহিদ নিয়ে বালাকোটে অবস্থান নেন। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল শিখ সাম্রাজ্যের প্রায় ১০,০০০ সৈন্য, যাদের নেতৃত্বে ছিল কনওয়ার শের সিং, মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সেনাপতি।

ভোর হওয়ার আগেই মুজাহিদরা মসজিদে বালার কাছে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হঠাৎ করে শিখ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিক আক্রমণে তারা সাফল্যও পায়-শিখদের একটি দলকে আশ্চর্যজনকভাবে ঘায়েল করা সম্ভব হয়। কিন্তু শিখদের সংখ্যাগত ও অস্ত্রশক্তির আধিক্যের কারণে পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শের সিং পুরো উপত্যকাকে ঘিরে ফেলে এবং মেটিকোট পাহাড়ের ওপর থেকে অসংখ্য শিখ সৈন্য নিচে নেমে চারদিক থেকে মুজাহিদদের আক্রমণ করে।

সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং আত্মত্যাগের এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে সৈয়দ আহমদ শহীদ হন মেটিকোট পাহাড়ের একটি ঝরনার পাশে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহ ইসমাঈল দেহলভীও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। তাঁদের শাহাদাতের খবর মুজাহিদদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে না পৌঁছানোয় অনেকে ইমামকে খুঁজতে খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়ে শত্রুর হাতে নিহত হন। এদিকে কিছু সাহসী মুজাহিদ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সংখ্যার ভারে দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় গুজর গোত্রের কিছু ব্যক্তি প্রচার করে, "সৈয়দ সাহেব নিরাপদে পাহাড়ের ওপরে আছেন, সবাই দ্রুত সেদিকে চলে যান।" এই ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক মুজাহিদ পিছনে সরে যান এবং সেই সুযোগে শিখ বাহিনী পুরোপুরি জয়লাভ করে। এই দিনের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ৩০০ মুজাহিদ শহীদ হন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের (তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের) মুজাহিদরাও ছিলেন। শিখ সৈন্যরা সৈয়দ আহমদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে শিরশ্ছেদ করে এবং বহু অনুসারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষে বালাকোটের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তারা মুসলমানদের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।

তবুও এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মাত্র ৭০০ মুজাহিদের বাহিনী প্রায় ১,০০০ শিখ সৈন্যকে হতভম্ব করে অসীম সাহসিকতার যে উদাহরণ স্থাপন করেছিল, তা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় অধ্যায়। এত বড় আত্মত্যাগের ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৩১ সালের ১৮ মে, অর্থাৎ ১১ দিন পর বাংলায় বঙ্গবীর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ কামানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদের "তরীকা-এ-মুহাম্মদী" আন্দোলন তাঁর শাহাদাতের পরও থেমে যায়নি-বরং তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এই আন্দোলনই পরবর্তী মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করে।

•আন্দোলনের আদর্শিক ও আধ্যাত্মিক দিক:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে বালাকোটের আন্দোলন "তরীক-এ-মুহাম্মদী" নামে পরিচালনা করেন, যার মূলমন্ত্র ছিল-হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা। শাহ ইসমাঈল দেহলভী-সহ বিশিষ্ট আলেমরা তাঁর সহযোগী ছিলেন। তিনি খিলাফতের আদলে একটি শরিয়াহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলে তিনি অল্প সময়ের জন্য হলেও শরিয়তের আলোকে শাসন চালু করেন। তিনি:
পণপ্রথা ও জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ করেন,
জাকাত ও উশর আদায় করে বায়তুলমাল গঠন করেন,
এবং গোত্রীয় রীতি না মেনে শরিয়তের বিধান মানার নির্দেশ দেন।

এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমে কিছু গোত্র ও নেতা অসন্তুষ্ট হলেও এটি ছিল ন্যায়ভিত্তিক ইসল, সাহসী প্রয়াস। সৈয়দ আহমদের এই আন্দোলনের আদর্শিক ধারা আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহ।, ভারতের হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তিতুমীর-এর আন্দোলনের সঙ্গেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধোত্তর পরিণতি ও আন্দোলনের উত্তরাধিকার:


বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধাদের শাহাদাত আন্দোলনটির তাৎক্ষণিক সামরিক পরাজয় নিশ্চিত করেছিল। তবে এই পরাজয়ের মধ্যেও তাঁদের আত্মত্যাগ ও আদর্শিক দৃঢ়তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। যুদ্ধের পর শিখ বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৈয়দ আহমদের পরিবারের কিছু সদস্য ভারতে টঙ্কে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরও আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি।

ইমাম মাহমুদ, যিনি সৈয়দ আহমদের খলিফা ছিলেন, কিছুদিন আন্দোলনের হাল ধরার চেষ্টা করেন। এরপর উইলায়ত আলী ও এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ১৮৫০'র দশক পর্যন্ত ছোট পরিসরে আন্দোলনের কার্যক্রম চলমান ছিল। তবুও ব্রিটিশরা সংগঠিতভাবে এই অবশিষ্ট অনুসারীদেরও দমন করে। সংখ্যায় ও অস্ত্র-সরঞ্জামে দুর্বলতা একটি কারণ হলেও অধিকাংশ গবেষক স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখেন।

শুরুর দিকে যেসব স্থানীয় মুসলিম নেতা সৈয়দ আহমদকে আহ্বান জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় তারা অনেকেই পাশে ছিলেন না। বরং কেউ কেউ শিখদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন। এমনকি মুজাহিদ বাহিনীতে গুপ্তচর হিসেবে প্রবেশ করে শিখদের গোপন পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দেয়, যা তাদের আক্রমণ সফল করে তোলে। হাজারা এলাকার এক গোত্রপ্রধান শিখদের বালাকোট ঘিরে ধরার গোপন রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আবার পেশোয়ারে সৈয়দ আহমদ যাকে শাসক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই সুলতান মুহাম্মদ খান বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক শীর্ষ মুজাহিদকে হত্যা করেন এবং শত্রুপক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দেন।

সৈয়দ আহমদ শহীদ উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে "শাহাদাত" ও "ইসলামী রাষ্ট্র" চেতনার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে বহু আন্দোলনে অঙ্কুরিত হয়। পশ্চিমা গবেষক এডওয়ার্ড মোর্টিমার বলেছেন, “সৈয়দ আহমদ ছিলেন আধুনিক ইসলামপন্থিদের একজন প্রথমদিকের চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রামকে একত্রিত করে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।" তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মুজাহিদ বাহিনী মুসলমানদের মধ্যে যে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল, এই আদর্শ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে-
দেওবন্দি উলামাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে,
তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহে,
আধুনিক কালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলের ইসলামী সংগঠনগুলোর মাঝেও।
সর্বসম্মতিক্রমে বলা যায়- সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের প্রথমদিককার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন, যাঁর আদর্শ, সংগ্রাম, জীবন ও মৃত্যু একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় ইসলামী জাগরণের উজ্জ্বল প্রতীক।

•বালাকোটের শিক্ষা ও আমাদের প্রেরণা:


বালাকোটের যুদ্ধ এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) যেমন মুসলমানরা ইসলামী আদর্শ ও স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আজও ঠিক তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা একই সংগ্রামে লিপ্ত। আজ কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইহুদিদের, চীনের জিনজিয়াংয়ে বৌদ্ধ-চিনপন্থি শাসকদের, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নির্যাতন-এসবই দেখায় যে মুসলিম জাতি এখনো চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামও এই একই ঐতিহাসিক ধারার অংশ, যা বালাকোটের চেতনা থেকেই অনুপ্রাণিত।

প্রথমত, ঐক্যের শিক্ষা
সৈয়দ আহমদের আন্দোলন স্থানীয় মুসলমানদের বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বিজয়ী হয়েছে। আজকের তরুণদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে-মতপার্থক্য ভুলে ন্যায়ের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

দ্বিতীয়ত, আদর্শের প্রতি অবিচলতা ও আত্মত্যাগ
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তাঁর সাথীরা ঈমান, ন্যায় ও স্বাধীনতার আদর্শে অটল ছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে,
সত্য ও ইসলামী চেতনার পক্ষে দৃঢ় থাকা এবং প্রয়োজনে প্রাণ দেওয়াড়এই গুণটি মুসলমানদের শক্তির মূলভিত্তি। তারা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি-আমাদেরও সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে।

তৃতীয়ত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির গুরুত্ব
ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা-এই তিনটি গুণই দুর্বলকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আজকের তরুণদের জীবনের যেকোনো সংগ্রামে-হোক তা সামাজিক ন্যায়, নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জাতির উন্নয়ন-নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সততাই তাদের সফলতার প্রধান হাতিয়ার।

চতুর্থত, সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) সীমিত সম্পদ নিয়েও একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন-যার নিজস্ব অর্থসংগ্রহ, কাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বব্যবস্থা ছিল। আজকের বাংলাদেশে কিংবা মুসলিম সমাজে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নয়, দরকার সৎ নেতৃত্ব ও সংগঠিত কর্মপন্থা।

পঞ্চমত, চেতনার উত্তরাধিকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ইতিহাস ও বালাকোটের ইতিহাসের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাকে এক জায়গায় মিলিত করে। স্বাধীনতা মুখের কথা নয়-এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। তাই আমরা যেন কখনো আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ভুলে না যাই।

•উপসংহার:

বদর থেকে বালাকোট-এই দীর্ঘ সময়সীমায় মুসলিম উম্মাহ বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা ঈমান, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতি অটল থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত বালাকোট আন্দোলন সেই ধারাবাহিক সংগ্রামের ধর্মীয় আদর্শ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একসূত্রে মিলিত হয়ে গড়েছিল এক অনন্য ইতিহাস।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরি ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখান থেকে আমরা ঐক্য, আত্মত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা সম্পর্কে শিক্ষা পাই। সত্য ও স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্মৃতি আমাদের সাহস জোগায়। তাদের আত্মত্যাগের মূল্যেই আজ আমরা স্বাধীন সেই শিক্ষা আমাদের জাতি গঠনের দায়িত্বে আরও সচেতন করে। বালাকোটের শহীদগণ আমাদের প্রেরণা জোগান। আসুন, আমরা নিজ নিজ আদর্শে অটল থেকে জাতির কল্যাণ ও ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করি। আমরা যদি অতীতের সেই মহান শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আগামীর সুন্দর ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।


তথ্যসূত্র:
১. বদর থেকে বালাকোট, বদরুজ্জামান, দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ, ২০২১
২. চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমিন দুলাল, প্রফেসর'স পাবলিকেশন্স, ৬ষ্ঠ প্রকাশ, ২০১২
৩. কারবালা থেকে বালাকোট, মুহাম্মদ সোলায়মান ফররুখ আবাদী, প্রতীতি প্রকাশন
৪. শহীদে বালাকোট (শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. (১২৪৬-১৮৩১), আল্লামা খালেদ মাহমূদ, মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরী
(অনুবাদক), নূরুল কুরআন প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ, ২০১৮
৫. বালাকোটের প্রান্তর, আরীফুর রহমান, আবরণ প্রকাশন, ১ম প্রকাশ, ২০২১

[ বুকলেট প্রকাশনায়: বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ]

Tuesday, March 11, 2025

১১ মার্চ: ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঐতিহাসিক শহীদ দিবস || শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা

১১ মার্চ: ঐতিহাসিক শহীদ দিবস— শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিরোধী শক্তির আঘাতে প্রাণ হারান আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার।

• ঘটনার সূত্রপাত:
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীরা ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীনবরণের প্রচার কার্য চালানোর সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, এতে কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হন। শিবির তাদের শত উসকানি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে।

• ১১ মার্চের রক্তাক্ত সকাল:
১১ মার্চ সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহ্বানে নবাগত ছাত্রসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবিরকর্মী গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পাশের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র।

শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। শিবির নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল শিবিরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তথাকথিত বামপন্থার কেন্দ্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে।

একপর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চতুর্দিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবিরকর্মীরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাকভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দেয়।

সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় নিরস্ত্র ছাত্রশিবির কর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও তারা সন্ত্রাসীদের নৃশংস আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

সন্ত্রাসীরা পাশবিক কায়দায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহীদ শাব্বির আহম্মেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে মাথায় লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ আব্দুল হামিদকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আরেকটি ইট দিয়ে তার মাথায় একের পর এক আঘাত করে। এতে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান।

শহীদ আইয়ুব ভাই ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহাদাত বরণ করেন। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই।

সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাকাণ্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবিরবিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।

১১ মার্চের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শিবিরকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মরণকামড় দিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। তারাই তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়ে। তারা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি, বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর, শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত।

মতিহারের সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করেছে—এ সত্য আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন: 

Saturday, March 1, 2025

বইনোট : কর্মপদ্ধতি || বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

বইনোট কর্মপদ্ধতি, ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মপদ্ধতি, শিবিরের দাওয়াতি কাজ, ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম, কর্মপদ্ধতির আলোকে কাজ, ছাত্রশিবিরের কর্মপদ্ধতি
কর্মপদ্ধতি: কাজ করার কৌশল/নীতিমালা; কর্মসূচীকে সফল করার জন্য যে নীতিমালা গ্রহণ করা হয় তা-ই কর্মপদ্ধতি।

ছাত্রশিবিরের কর্মপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য:

১. রাসুল (সঃ)-এর অনুসৃত পদ্ধতি
২. বিজ্ঞান সম্মত, যুক্তিভিত্তিক
৩. ইসলামী রেনেসাঁর ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত।
৪. সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী
৫. পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে পরিবর্তনশীল।

বইটি ২ ভাগে বিভক্ত:
১. ভূমিকা ২. মূল বই

ভূমিকা- ৬ ভাগে বিভক্ত
১. শিবিরের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য- উদ্দেশ্য
২. ছাত্র শিবির কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিষ্ঠার কারণ
৩. কর্মপদ্ধতির ব্যাখ্যা প্রয়োজনীয়তা
-কর্মপদ্ধতি ছাড়া কোন আন্দোলন সফলকাম হতে পারে না।
-কর্মশক্তি, জনশক্তি এবং জনসমর্থনের সুমাঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার
-প্রতিটি কর্মীর যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, চিন্তাশক্তি, আন্দোলনের
পিছনে সমর্থন সবকিছু আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এ আমানতের
সুষ্পষ্ট ব্যবহারের জন্য যথাযথ, সুষ্ঠ কর্মপদ্ধতির প্রয়োজন তা
না হলে তা খেয়ানতের শামিল হবে।
৪. বাতিল মতাদর্শের সাথে পার্থক্য:
(১) দর্শনগত (২) পদ্ধতিগত
৫. রাসুল (সঃ) এর অনুসৃত পদ্ধতি, উৎস।
৬. কর্মপদ্ধতির কৌশলগত দিক পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে পরিবর্তনশীল।

কর্মপদ্ধতির আলোকে শিবিরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

“আল্লাহর এই জমিনে সকল প্রকার যুলুম ও নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করে আল কোরআন ও আল হাদীসের আলোকে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সৌধের উপর এক আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়ে তোলার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। চমক লাগানো সাময়িক কোন লক্ষ্য হাসিল এর উদ্দেশ্য নয়”

সক্রিয় কর্মীর বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী ৮টি
১. মজবুত ঈমান
২. খোদাভীতি
৩. আদর্শের সুস্পষ্ট জ্ঞান
৪. আন্তরিকতা
৫. নিষ্ঠা
৬. কর্মস্পৃহা
৭. চারিত্রিক মাধুর্য
৮. কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির যথার্থ অনুধাবন

কর্মপদ্ধতি বুঝার জন্য প্রয়োজন-
১. বার বার অধ্যয়ন
২. চিন্তা, গবেষণা ও অধ্যবসায়
৩. সক্রিয় কাজ
৪. আলোচনা-পর্যালোচনা
৫. পুরাতন ও দায়িত্বশীল কর্মীদের অভিজ্ঞতা

মুলবইপাঁচ দফা কর্মসূচী ও তার বাস্তবায়ন

১. দাওয়াত
২. সংগঠন
৩. প্রশিক্ষণ
৪. ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যার সমাধান
৫. ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ


প্রথম দফাঃ দাওয়াত
“তরুণ ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহবান পৌঁছিয়ে তাদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।”

এ দফার ৩টি দিক
প্রথমতঃ ইসলামের ব্যাপক প্রচার
দ্বিতীয়তঃ ছাত্রদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।
তৃতীয়তঃ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার জন্য ছাত্রদের মাঝে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা

প্রথম দফার করণীয় কাজ- ৮টি
১. ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও সম্প্রীতি স্থাপন
২. সাপ্তাহিক ও মাসিক সাধারণ সভা
৩. সিম্পোজিয়াম, সেমিনার
৪. চা-চক্র, বনভোজন
৫. নবাগত সংবর্ধনা
৬. বিতর্ক সভা, রচনা এবং বক্তৃতা প্রতিযোগিতা ও সাধারণ জ্ঞানের আসর
৭. পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, পরিচিতি ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাময়িকী বিতরণ।
৮। সিডি ভিসিডি ক্যাসেট প্রভৃতি বিতরন

•টার্গেটকৃত ছাত্রের গুণাবলী- ৫টি
১. মেধাবী ছাত্র
২. বুদ্ধিমান ও কর্মঠ
৩. চরিত্রবান
৪. নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন
৫. সমাজে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী।

•ক্রমধারা অবলম্বন:
প্রথম সাক্ষাতে মূল দাওয়াত না দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপিতের মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

প্রথমত: টার্গেটকৃত ছাত্রের মন-মগজে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে যাবতীয় ভুল ধারণার অসারতা বুদ্ধিমত্তার সাথে তুলে ধরতে হবে।

দ্বিতীয়ত: আখেরাত তথা পরকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে এবং যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিচয় তুলে ধরতে হবে।

তৃতীয়তঃ তাকে ইসলামী আন্দোলন ও সাংগঠনিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে হবে।

পরবর্তী পর্যায়ে তাকে প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনে অংশগ্রহণ করার আহবান জানাতে হবে।

যোগাযোগকারীর বৈশিষ্ট্য: ১৩টি
১. কম কথা বলা
২. অত্যধিক ধৈর্যের পরিচয় দেয়া
৩. বেশী কথার পরিবর্তে চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে প্রভাব
সৃষ্টি করা।
৪. ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখা
৫. কোন প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে ব্যক্তিত্ব অক্ষুন্ন রেখে সময় নেয়া।
৬. গোঁজামিলের আশ্রয় না নেয়া।
৭. যার সাথে সাক্ষাত করা হচ্ছে তার মন মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখা।
৮. যোগাযোগকৃত ছাত্রের রোগ দূর করার জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করা।
৯. তার দুর্বলতার সমালোচনা না করে সৎগুণাবলীর বিকাশে সহায়তা করা
১০. ব্যবহারে অমায়িক হওয়া
১১. তার সুখ দুঃখের অংশীদার হওয়া।
১২. মনকে অহেতুক ধারণা থেকে মুক্ত রাখা।
১৩. সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে ভ্রমণ, একত্রে নাস্তা, খাওয়া, নিজ বাসায় নিয়ে আসা, তার বাসায় যাওয়া, উপহার দেয়া ইত্যাদি।

•ক্রমান্বয়ে কর্মী পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায়- ৫টি
১. সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আগ্রহী করতে হবে।
২. সাধারণ সভা, চা-চক্র ও বনভোজনে শামিল করা
৩. ছাত্রদের জ্ঞান, বুদ্ধি, আন্তরিকতা, মানসিকতা ও ঈমানের দৃঢ়তা লক্ষ্য করে পরিকল্পিতভাবে বই পড়ানো৪. বিভিন্ন ইবাদতের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা
৫. সময় সময় মন-মানসিকতা বুঝে ছোট খাট কাজ দেয়া

প্রথম দফার অতিরিক্ত কাজ: ৫টি
১. গ্রুপ দাওয়াতী কাজ
২. দাওয়াতী গ্রুপ প্রেরণ
৩. দাওয়াতী সপ্তাহ ও পক্ষ
৪. মুহরামাদের মাঝে কাজ
৫. মসজিদভিত্তিক দাওয়াতী কাজ


দ্বিতীয় দফা- সংগঠন
“যেসব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা”

সংবিধান অনুযায়ী জনশক্তির স্তর-
১. সদস্য
২. সাথী

কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী আরো ২ স্তর-
৩. কর্মী
৪. সমর্থক

কর্মীর কাজ- ৮টি
১. কুরআন ও হাদীস নিয়মিত বুঝে পড়ার চেষ্টা চালানো।
২. নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য পড়া
৩. ইসলামের প্রাথমিক দাবীসমূহ মেনে চলার চেষ্টা করা।
৪. বায়তুল মালে নিয়মিত এয়ানত দান।
৫. নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা ও দেখানো
৬. কর্মী সভা সাধারণসভা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে যোগদান
৭. সংগঠন কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
৮. অপরের কাছে সংগঠনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা।

সাথী
একজন কর্মীকে সংবিধানের ৯ নং ধারায় বর্ণিত শর্তাবলি পূরণ করে 'সাথী' হতে হয়। শর্তাবলি হচ্ছে- (৪টি)

১. সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা।
২. সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে সচেতনভাবে একমত হওয়া
৩. ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন করা।
৪. সংগঠনের সামগ্রিক তৎপরতায় পূর্ণভাবে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

সদস্য
সংবিধানের ৪ নং ধারায় বর্ণিত সদস্য হওয়ার শর্তসমূহ নিম্নরূপ : (৬টি)

১. সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা।
২. সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করা এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা।
৩. সংবিধানকে মেনে চলা।
৪. ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করা।
৫. কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা।
৬. শিবিরের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সাথে সম্পর্ক না রাখা।

২য় দফার করণীয় কাজ: (১০টি)
১. কর্মী বৈঠক,
২. সাথী বৈঠক,
৩. সদস্য বৈঠক,
৪. দায়িত্বশীল বৈঠক
৫. কর্মী যোগাযোগ,
৬. বায়তুলমাল,
৭. সাংগঠনিক সফর,
৮. পরিচালক নির্বাচন।
৯. পরিকল্পনা,
১০. রিপোর্টিং।

কর্মী বৈঠকের কর্মসূচী:
* অর্থসহ কুরআন তেলাওয়াত-১০মি.
* ব্যক্তিগত রিপোর্ট পেশ, মন্তব্য ও পরামর্শ ৩০ মি.
* পরিকল্পনা গ্রহণ-২০ মি.
* কর্ম বণ্টন-২০ মি.
* সভাপতির বক্তব্য ও মুনাজাত- ১০ মি.কর্মী

যোগাযোগের পদ্ধতি:
উদ্দেশ্যঃ নিষ্ক্রিয় কর্মীকে সক্রিয় করা ও ভুল বুঝাবুঝি দূর করা

১. পরিকল্পনা
২. স্থান ও সময় নির্বাচন
৩. ঐকান্তিকতা
৪. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা আলোচনা৫. সাংগঠনিক আলোচনা
৬. সার্বিক আন্দোলনের আলোচনা
৭. সালাম ও দোয়া বিনিময়

সাংগঠনিক পরিকল্পনা: প্রণয়নের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক নজর রাখতে হবে।
১. জনশক্তি (শ্রেণীবিন্যাসসহ)
২. কর্মীদের মান
৩. কাজের পরিধি ও পরিসংখ্যানমূলক তথ্য
৪. অর্থনৈতিক অবস্থা
৫. পারিপার্শ্বিক অবস্থা।
৬. বিরোধী শক্তির তৎপরতা


৩য় দফা: প্রশিক্ষণ
“এই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ার কার্যকরী ব্যবস্থা করা”

তৃতীয় দফার করণীয় কাজ- ১৩টি
ক. পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
খ. ইসলামী সাহিত্য পাঠ ও বিতরণ
গ. পাঠচক্র, আলোচনা চক্র, সামষ্টিক পাঠ ইত্যাদি
ঘ. শিক্ষাশিবির, শিক্ষাবৈঠক
ঙ. স্পিকারস ফোরাম
চ. লেখকশিবির
ছ. শববেদারি বা নৈশ ইবাদত
জ. সামষ্টিক ভোজন
ঝ. ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ
ঞ. দুআ ও নফল ইবাদত
ট. ইহতেসাব বা গঠনমূলক সমালোচনা
ঠ. আত্মসমালোচনা
ড. কুরআন তালিম/কুরআন ক্লাস

পাঠচক্র: পাঠচক্রের শর্ত ৯ টিঃ
১. সদস্য নির্দিষ্টকরণ
২. পরিচালক নির্ধারণ
৩. বিষয়বস্তু নির্ধারণ
৪. লক্ষ্য নির্ধারণ
৫. অধ্যয়ন
৬. নোট
৭. সময়ানুবর্তিতা
৮. মনোযোগ
৯. সক্রিয় সহযোগিতা

তওবার নিয়ম:
১. সর্বপ্রথম আন্তরিকতার সাথে নিজ ভুলের স্বীকৃতি দেয়া।
২. ভুলের জন্য আল্লাহরকাছে মাফ চাওয়া।
৩. দ্বিতীয়বার ভুল না করার ওয়াদা করা।
৪. নামাজ রোযা বা আর্থিক কুরবানীর বিনিময়ে ভুলের কাফফারা আদায় করা।

আত্ম সমালোচনার পদ্ধতি: ৭টি
১. সময় নির্বাচন: শোয়ার সময় এর চেয়ে ভাল
ফজরের পর এবং এর চেয়েও ভাল ঈশার নামাজের পর।
২. আল্লাহকেহাজির নাজির জেনে জায়নামাযে বসা।
৩. সারাদিনের কর্মব্যস্ততাকে স্মরণ করা (ভাল কাজের শুকরিয়া ও ভুলের জন্য তওবা করা)।
৪. ফরজ ও ওয়াজিব আদায়কালে আন্তরিকতা যথার্থ ছিল কি না চিন্তা করা।
৫. আজকের সাংগঠনিক কাজ নিয়ে চিন্তা করা, অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন হয়েছে কিনা এজন্যে সময় ও সামর্থ যা ছিল তা পুরোপুরি ব্যয় হয়েছে কি না।
৬. ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা।
৭. আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।


চতুর্থ দফা : ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যার সমাধান
“আদর্শ নাগরিক তৈরীর উদ্দেশ্যে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের দাবীতে সংগ্রাম এবং ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।”

এ দফার দিক দুটি
১. 'ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম' জানা।
২. ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।

•ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এর কর্মসূচী
১. ইসলামী শিক্ষা কি? এর বৈশিষ্ট্য কিভাবে প্রবর্তন করা যায়? বর্তমান শিক্ষাস্বরূপ দোষ-এটা কি কি? এর সুদূর প্রসারী শিক্ষাব্যবস্থা।
২. জনমত সংগ্রহ করা।
৩. পোস্টারিং পত্রিকায় বিবৃতি, পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে লিখা।
৪. শিক্ষার ইসলামীকরণের পরিকল্পনা প্রণয়ন মৌলিক গলদ কোথায় চিন্তাবিদদের দিয়ে ইসলামী শিক্ষার রূপরেখা প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করা।
৫. শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিশেষ সংকলন প্রকাশ করা।

ছাত্র সমস্যা দু'ভাগে বিভক্ত
১. ব্যক্তিগত
২. সমষ্টিগত

ব্যক্তিগত সমস্যা দূরীকরণে ছাত্রকল্যাণ বিভাগের কাজ
* লজিং যোগাড় করে দেয়া
* স্টাইপেন্ড চালু করা
* লেন্ডিং লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা
* ফ্রি কোচিং ক্লাশ চালু করা
* বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র বিলি
* ভর্তি সহায়িকা প্রকাশ
* কর্জে হাসানা

সমষ্টিগত সমস্যা-
*ভর্তি ও আসন সমস্যা।
*শিক্ষকের অভাব।
*পাঠাগারের অভাব।
*মসজিদ না থাকা।
*কেন্টিনের সমস্যা।
*নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা।
*পাঠ্য বই এর মূল্য ও বেতন বৃদ্ধি।

সমাধানের কর্মসূচী
১. কারণ নির্ণয় করে কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ।
২. প্রতিবাদ সভা, নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ, পোস্টারিং, পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান।
৩. প্রতীক ধর্মঘট পালন ও সুশৃংখল আন্দোলন

ছাত্র সংসদ নির্বাচন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী নেতৃত্বেও জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ।


পঞ্চম দফা কর্মসূচী- ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ
“অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।”

•এ দফার কাজ দুভাবে করা যায়:
১. যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী গঠন
(ক) ক্যারিয়ার তৈরি [TO BUILD UP CARREER]
(খ) নেতৃত্ব তৈরি [TO MAKE UP LEADERSHIP]
(গ) কর্মী তৈরি [TO BUILD WORKER]
(ঘ) জ্ঞান অর্জন [TO ACQUIRE KNOWLEDGE]

২. বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ।
(ক) সহযোগিতা
(খ) পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ

পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ: চারিত্রিক শক্তি দিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বদ্ধ পরিকর।

Career তৈরি: সকল Sector এ লোক দেয়ার মত যোগ্য লোক তৈরী।


সংকলনে:
সেক্রেটারি, 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 
ফেনী জেলা 

Saturday, January 11, 2025

ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৫২তম শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন || ০৪ আগস্ট ১৯৭১ - ১২ জানুয়ারি ১৯৯৩


শাহাদাতের ঘটনা:

ইসলামের জন্য যুগ যুগান্তরে সাহসী মুজাহিদ ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। দ্বীনের পথে তেমনি একজন সাহসী সৈনিক মোশাররফ হোসাইন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পিতার যোগ্যতম এক সন্তান। বাবা-চাচা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী দলের ছাত্রসংগঠনের ফ্যাসিবাদী আচরণের নির্মম শিকার হন শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন।

পারিবারিক পরিচয়:

শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার জয়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা কাজী সামছুল হুদা তার স্ত্রীকেসহ পরিবারকে সীমান্তের ওপারে ভারতের করিমাটিয়া রেখে দেশে চলে আসেন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে। স্ত্রী হোসনে আরা তার একমাত্র কন্যা কাজী দিলারা আকতারকে নিয়ে ভারতে বসবাস করতে লাগলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সামছুল হুদার পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, আদরের কন্যা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানো গেল না দিলার আকতারকে। মেয়ের শোকে ভেঙে পড়ে মা হোসেনে আরা। ঠিক সে মুহূর্তে অমবস্যার কালো আঁধারের মাঝে দেখা গেলো পূর্ণমিার চাঁদ। ৪ আগস্ট ১৯৭১। পৃথিবীতে আসলেন কাজী মোশাররফ হোসাইন। যাকে পেয়ে মা হোসনে আরা বেগম মেয়ের শোক কিছুটা কম অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু না; হোসনে আরা বেগমের সে আনন্দ বেশি স্থায়ী হতে দেয়নি মুজিববাদী ছাত্রলীগ। একদিন মোশাররফের মত নিষ্পাপ উদীয়মান তরুণকেও মুজিববাদী হায়েনাদের নির্মম ব্রাশফায়ারে শিকার হতে হয়েছে।

শিক্ষাজীবন:

শিক্ষার হাতে খড়ি পিতার কাছেই। ভর্তি করালেন শুভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। ভর্তি হলেন জয়পুর সরোজিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত মেধার সাক্ষ্য রাখলেন আগের মতই। এসএসসি পাস করলেন ১ম বিভাগে। ভর্তি হলেন ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে। শরিক হলেন শহীদী কাফেলায়। এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন মোশাররফ হোসাইন। তিনি শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না বরং সুবক্তা ছিলেন। তাইতো তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার জন্য নিয়ে যেতেন।

সাংগঠনিক জীবন:

কাজী মোশাররফ হোসাইন সংগঠনের কর্মী ছিলেন। ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে অধ্যায়নকালে সংগঠনে যোগ দেন। মেধাবী ছাত্র কাজী মোশাররফ হোসাইন পড়াশোনা ছাড়া অন্য সময়গুলো দাওয়াতি কাজে লাগাতেন। তার চরিত্র ছিল চুম্বকের মত আকর্ষণীয়। তিনি তার দাওয়াতি চরিত্র দিয়ে সহপাঠী বন্ধু বান্ধব সকলকে আকৃষ্ট করেছিলেন। শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতেন।

শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা:

১২ জানুয়ারি ১৯৯৩ এর সকালবেলা কাজী মোশাররফ হোসাইন তাঁর রুমমেটদের শোনালেন এক দুঃস্বপ্নের কথা। ছাত্রলীগের গুন্ডারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ হস্তান্তরে জন্য বিশ হাজার টাকা দাবি করে। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সারাদিন আনমনে কেটে যায় তার। বিকালে কখনও ফুটবল না খেললেও সেদিন ফুটবল খেলতে নামেন প্যারেড ময়দানে। অনেকের চেয়ে ভাল খেললেন তিনি। মনও কিছুটা হালাকা হয়েছে তার। মাগরিবের নামাজ পড়ে সরলেন পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো শিবির কর্মী জিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে মিছিল বের হল। মিছিলে যোগদান করলেন মোশাররফ। মিছিল চলছিল সিরাজউদদৌলা রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে। সামনের সারিতে দৃঢ়পদে চললেন কাজী মোশাররফ । মিছিল যখন দেওয়ান বাজার সাব এরিয়ায় পৌঁছল তখন গলির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে ব্রাশফায়ার শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হলো সামনে থাকা মোশাররফ, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পান করলেন শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা। আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি। অকালে ঝরে গেল একটি প্রাণ। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল একটি তাজা গোলাপ। ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের পথে অগ্র পথিক হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। শহীদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন সহপাঠী বন্ধু, শিক্ষক সবাই। তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. আব্দুস সবর প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শহীদের কফিন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে মা প্রশ্ন করেন কোন অপরাধে তার সন্তানকে জীবন দিতে হল। যদি তার ছেলে অপরাধ না করে তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে। মা সন্তানকে ফিরে পাবেন না, সে জন্য ব্যথিত হৃদয়ে আজীবন কাটাবেন। ছেলে কিন্তু ব্যথিত নয়। কারণ তার তিনি জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গল্প করছেন জান্নাতের সুবজ পাখিদের সাথে।
একনজরে শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন:

-নাম: কাজী মোশাররফ হোসাইন
-পিতার নাম : মাস্টার কাজী সামছুল হুদা
-মাতার নাম : হোসনে আরা বেগম।
-ভাইবোনদের সংখ্যা : ২ ভাই, ৩ বোন
-ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়।
-স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম- জয়পুর, পো: শুভপুর, -থানা: ছাগলনাইয়া, জেলা: ফেনী।
-জন্মতারিখ : ৪ আগস্ট ১৯৭১
-শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স ২য় বর্ষ, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ
-শহীদ হওয়ার তারিখ : ১২.০১.১৯৯৩ সাল (১১ তারিখ সন্ধ্যায় আহত)
-শহীদ হওয়ার স্থান : দেওয়ান বাজার সাব এরিয়া, চট্টগ্রাম
-কবরস্থান : নিজবাড়ির আঙিনা
-যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
-সাংগঠনিক মান : কর্মী
-যাদের হাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী।


•শহীদের চাচার বক্তব্য:

শহীদের চাচা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। আমরা কি জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিলাম সন্তান হারাবার জান্য? সন্ত্রাস মদদ দানের জন্য? হোসনে আরা আজো কাঁদেন পুত্রশোকে। কেউ তাকে দেখতে গেলে ছেলের মতই ভাববেন তাদেরকে। এক সন্তানকে হারিয়ে লক্ষ সন্তানের মাতা আর সামছুর হুদা লক্ষ ছেলের পিতা হলেন। শহীদ মোশাররফ তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জান্নাত থেকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। দায়িত্ব আমাদের এ জমিনে কালেমার পাতাকা উড়াবার। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কষ্ট পাবেন, অভিযোগ করবেন আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দাঁড়াতে হবে আখেরাতের কাঠগড়ায়।

Monday, January 6, 2025

২০২৫ সেশনের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সেটআপ সম্পন্ন

২০২৫ সেশনের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সেটআপ সম্পন্ন

সভাপতি : আবু হানিফ হেলাল
সেক্রেটারি : ইমাম হোসেন আরমান

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর একান্ত মেহেরবানিতে ২০২৫ সেশনের জন্য বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সভাপতি ও সেক্রেটারি মনোনয়ন সম্পন্ন হয়েছে।

আজ ০৩ জানুয়ারী ২০২৫ বাদ জুমআ ফেনী দারুল ইসলাম মিলনায়তনে ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সদস্যদের নিয়ে সদস্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমানের সঞ্চালনায় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রআন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলামের পরিচালনায় নতুন সেশনের সেটআপ ঘোষনা করা হয়।

সমাপনী সেশনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্রআন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলাম সদস্যদের উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন।

অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালী শহর শাখার সভাপতি আবু সাঈদ সুমন, ফেনী শহর শাখার সভাপতি শরীফুল ইসলাম ও ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সাবেক সভাপতিবৃন্দ।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএম কামাল উদ্দিন, ফেনী জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাড. জামাল উদ্দিন, ফেনী জেলা জামায়াতের প্রচার সেক্রেটারি আ.ন.ম আবদুর রহিম।

পরিশেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা আমীর মুফতি আব্দুল হান্নান হুজুরের নসিহত ও মুনাজাত পরিচালনার মাধ্যমে প্রোগ্রামের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

Thursday, December 12, 2024

জান্নাতি পাখি || শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রহ.



মিথ্যার দেয়াল তুলে ধ্রুব সত্যকে কখনো আড়াল করা যায় না। সত্য উদ্ভাসিত হয় তার নিজস্ব আলোয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ফাঁসী দেয়া হয় জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিক নেতা শিক্ষাবিদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে। সরকার যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে ফাঁসী দিলেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা আজ স্মরণীয় শত কোটি প্রাণে; ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সত্যপ্রেমীদের হৃদয় থেকে কখনো মুছে যাবেন না, আলোর পথের যাত্রীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

১৯৪৮ সালের ২রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলাস্থ সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গী গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সানাউল্লাহ মোল্লা ও মাতার নাম বাহেরুন্নেসা বেগম। আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন নয় ভাইবোনের মাঝে ৪র্থ। তার জন্মের কিছুকাল পরে তার পিতা-মাতা সদরপুরেরই আমিরাবাদ গ্রামে এসে বাড়ি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।

প্রাথমিক শিক্ষাঃ 
তিনি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিষ্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সংকটের কারনে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। ফরিদপুরের শিব সুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছু কাল।

উচ্চশিক্ষাঃ 
১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি করার জন্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণকালে তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের কারনে ১৯৭১ সালে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি বাড়ি চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭২ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মত আবদুল কাদের মোল্লার লেখাপড়াতেও ছন্দ পতন ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইন্সিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রীতে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হন।

কর্মজীবনঃ 
আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এমএড পরীক্ষার রেজাল্টের পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ সংস্কৃতি কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে রিসার্চ স্কলার হিসাবে বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টারে যোগ দেন। গৌরব-সাফল্যের ধারাবহিকতায় উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, রাইফেল পাবলিক স্কুল এবং মানারাত স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় যে সত্যের পরশ পেয়েছিলেন, তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এ সময়ে তাঁর ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে। বীক্ষণ ছদ্মনামে তার লেখা আর্টিকেল গুলো সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বৈবাহিক জীবনঃ 
জনাব মোল্লা দিনাজপুর নিবাসী বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেগম সানোয়ার জাহান ইডেন কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনিও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মত বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ও ইডেন কলেজের ছাত্রী ইউনিয়নের জিএস ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বেগম সানোয়ার জাহান তার বাবার সাথে কুষ্টিয়াতে ছিলেন ও সক্রিয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন। বেগম সানোয়ার জাহানদের বাসা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাবার যেত। দুই পুত্র ও চার কন্যার সুখী সংসার তাদের। সব সন্তানই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেছেন। পরিবারের সকলেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত। বেগম সানোয়ার জাহান জামায়াতের রুকন ও দায়িত্বশীলা ।

সাংবাদিক কাদের মোল্লাঃ 
সেসময়েরই একজন নির্ভীক সাংবাদিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বর্ণাঢ্য জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে তিনি আমাদের কাছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল সময়টা অতিবাহিত করেছেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে।
সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে প্রত্রিকাগুলো তখন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে সর্বমহলের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিল তাদের মধ্যে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর এ পত্রিকাটিতে দক্ষ হাতে দায়িত্ব পালনের ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে। ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দু’বার তিনি ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্তরে দ্রোহ আর বিপ্লবের চেতনা লালন করেও সদা হাস্যোজ্জল এ মানুষটি ছিলেন সাংবাদিক আড্ডার প্রাণ-ভ্রমরা। তার রসময় গল্পকথার সজীবতায় ভরে উঠতো গনমানুষের চেতনার প্রতীক জাতীয় প্রেসক্লাব।

কিন্তু একজন সাংবাদিকের জীবন সাধারণভাবেই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। কখনো সমাজের বিপথগামী অংশ, কখনো কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল, আবার কখনওবা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির রোষানলে পড়তে হয় তাকে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দন্দ্বে উৎসর্গিত হয় সাংবাদিকের জীবন। চারপাশের চেনাজন, পরিচিত বন্ধুমহল একসময়ে পরিণত হয় তার শত্রুতে। হানে প্রাণঘাতি ছোবল। যে ছোবলের রূপ হয় নানারকম। মানসিক যন্ত্রণায় বিপন্নতা, শারিরিক আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ, প্রাণঘাতি হামলায় মৃত্যু, কারাবন্দিত্বের নিঃসঙ্গ যাতনা কিংবা প্রহসনের বিচারে জীবনাবসান। এসবই ছিল যুগে যুগে সাংবাদিক জীবনের অনিবার্য উপাদান। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় একসময় সাংবাদিকতার পেশাকে বিদায় জানাতে হয় তাঁকে। কিন্তু যে পেশা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এর মহত্বকে তিনি ধারণ করতেন সবসময়। তাইতো তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের প্রতিটি ধুলিকণা এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে কাদের মোল্লার স্মৃতি ।

রাজনৈতিক জীবনঃ 
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রয়েছে সংগ্রামী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়ন কালেই তিনি কম্যূনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পর তাফহীমুল কুরআনের হৃদয়স্পর্শী ছোঁয়ায় তিনি ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষিত হন এবং আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি ছাত্রসংঘের তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান শাখায় যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ সংগঠনের সদস্য হন। ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারী ও একই সাথে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের রুকন হন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যাক্তিগত সেক্রেটারি এবং ঢাকা মহানগরীর শূরা সদস্য ও কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনের ব্যাবধানেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশ-এ-শূরার সদস্য হন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারী ও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে ঢাকা মহানগরীর নায়েব-এ-আমীর, অতঃপর ১৯৮৭ সালে ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ১৯৮৮ সালের শেষ ভাগে তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন যা বাতিলের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়।

১৯৯১ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তিনি জামায়াতের প্রধান নির্বাচনী মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ২০০৪ সালের মার্চ মাসে স্বল্প সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত দায়িত্বের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি চারদলীয় জোটের লিয়াজো কমিটির গুরুত্বপূর্ন সদস্য হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশর প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বিশেষ করে ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে লিয়াঁজো কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তখন কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এবং তা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। লিয়াঁজো কমিটিতে বিভিন্ন সময়ে নানা দায়িত্ব পালন করার কারনে বিএনপি দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ উভয় দলের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দের সাথে আন্দোলনের নীতি নির্ধারণী সভাতে মিলিত হতেন তিনি।

জনাব মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে চার চারবার জেলে যেতে হয়। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দায়ে ১৯৬৪ সালে প্রথম বারের মত তিনি বাম রাজনীতিক হিসেবে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু স্থানীয় জনতার বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কাস্টোডী থেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারনে আব্দুল কাদের মোল্লাকে আবারও আটক করে রাখা হয় ১৯৮৫ সালের ২২শে এপ্রিল থেকে ১৪ই অগাস্ট । প্রায় চারমাস আটক থাকার পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি মুক্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে গ্রেফতার হন। সাত দিন পরে তিনি মুক্ত হন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার কূটনীতিকদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জল ও রসময় কাদের মোল্লার কথা ছাড়া কোন প্রোগ্রাম জমজমাট হতো না। জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নানা কূটনীতিক প্রোগ্রামে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনাব মোল্লা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভারত সহ নানা দেশ সফর করেছেন।

জনাব মোল্লা সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে বাদশাহ ফয়সাল ইন্সটিটিউট, ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি ও এর স্কুল, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী, সদরপুর মাদরাসা ও এতিমখানা, ফরিদপুর জেলার হাজিডাঙ্গি খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা ও এতিমখানা, সদরপুর আল-আমিন অন্যতম। এছাড়াও তিনি ঢাকার গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন।

জনাব মোল্লা দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিষয়ের উপর একাধিক কলাম ও প্রবন্ধ লিখেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, পালাবদল, মাসিক পৃথিবী, কলম ইত্যাদি নানা জায়গায় তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রত্যাশিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে বিদেশে তিনি বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাওয়া যায়। তার লেখা কলাম ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ও বস্তুবাদ ও কম্যূনিজমের উপরে তার বৈজ্ঞানিক সমালোচনা শিক্ষিত মহলের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তিনি প্রথমে আব্দুল কাদের নামে লেখা শুরু করেন।পরবর্তীতে তিনি বীক্ষণ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন ও উনার লেখা গুলো খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সমসাময়িক সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার লেখা মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে ঢেউ তুলতে শুরু করে।

জনাব মোল্লা নিয়মিত কুরআন পড়তে ও কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পছন্দ করতেন। তিনি সাংগঠনিক ব্যস্ত সময় মধ্যেও তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত লেখক, কবি যেমন আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী, সাইয়্যেদ কুতুব ইত্যাদি নানা লোকের লেখা পড়তে পছন্দ করতেন।

শাহাদাতঃ 
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সরকার তাকে রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে এবং পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। ট্রাইবুনালের রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এরপর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চের দাবি অনুযায়ী সরকার আইন সংশোধন করে আপিল দায়ের করে। সংশোধিত আইনের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয়। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাননি। এমনকি রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই তড়িঘড়ি করে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁকে ফাসি দেয়ার প্রায় দেড় বছর পর তার রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বিচারের নামে কত বড় প্রহসনের শিকার হয়েছেন!

Sunday, December 8, 2024

বইনোট : ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় (ইসলামী বিপ্লবের পথ) || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রহ.



এটি ১৯৪০ সনের বক্তৃতা, জামায়াতে ইসলামী তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 
[বইয়ের মুল নাম: ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়]

• ভূমিকা:
ইসলামী বিপ্লবের পথ বইটির মূল কথা হল 'ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা হবে' এই লক্ষ্যে বইটির লেখক মরহুম মাওলানা মওদুদী (র) ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচী হলে এ সম্পর্কে এক অনুপম বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল '
ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়' এর অর্থ হল ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

• মূল আলোচনা:
বইটির মূল আলোচনাকে ৮টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা.
১. ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়
২. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন
৩. আদর্শিক রাষ্ট্র
৪. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র।
৫. ইসলামী বিপ্লবেরপদ্ধতি বা পন্থা
৬. অবাস্তব কল্পনা বা ধারনা
৭. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
৮. সংযোজন

 ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়:
১. বর্তমানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ নাম শিশুদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে।
২. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা এটা জানেন না কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং জানার চেষ্টাও করেন না।
৩. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা যে প্রস্তাব দেয় মোটর সাইকেলে যেমন আমেরিকায় পৌঁছানো সম্ভব নয় তেমনি তাদের প্রস্তাবে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

• রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
“কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক উপায়ে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।”
১. একজায়গা থেকে তৈরি করে এনে অন্য জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
২. কোন একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্মপ্রক্রিয়ার ফলশ্রতিতে।
৩. সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্মলাভ করে ইসলামী রাষ্ট্র।
৪. সামাজিক উদ্যম, উদ্দীপনা, ঝোঁক-প্রবণতা প্রভৃতি নিবিড় সম্পর্ক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত।
৫. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন।
৬. সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৭. দীর্ঘ প্রানান্তকর চেষ্টা (যেমন বীজ হতে ফল)।

• আদর্শিক রাষ্ট্র:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

(i) ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শিক রাষ্ট্র।
(ii) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রভাবমুক্ত।

২. ফরাসী বিপ্লবের আদর্শিক রাষ্ট্রের ক্ষীণ রশ্মি দেখা গেলেও জাতীয়তাবাদের প্রভাবে চাপা পড়ে তা বিলুপ্ত হয়। 
(i) রাশিয়ার কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও অতিসত্ত্বর তা আদর্শচ্যুত হয়। 
(ii) মুসলিম দেশের কতৃত্বশীল লোকেরা জাতীয়তাবাদের আখড়ায় পড়ে ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা হারিয়ে ফেলেছে। 

৩. আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রয়োজন:
ক) ভিত্তি স্থাপন হতে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্তপ্রায় অস্তিত্ব রক্ষা করা। উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করা।
খ) জাতীয়তাবাদী চিন্তা-পদ্ধতি সংগঠন প্রণালী পরিহার করা।

৪. আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের লক্ষ্যে:
ক) জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে এর আদর্শ পেশ করা। 
খ) সেই আদর্শ অনুযায়ী সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করে কল্যাণ সাধন।

• আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
(ক) ইহার বৈশিষ্ট্যঃ
১. ইসলামী রাষ্ট্রের মূল বুনিয়াদ
২. নিখিল বিশ্ব জগৎ আল্লাহতাআলার রাজ্য। তিনি ইহার প্রভূ, শাসক ও বিধানদাতা।
৩. মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহরপ্রতিনিধি।
৪. খেলাফতের এই দায়িত্বের জন্য প্রত্যেককেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

(খ) ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপঃ
১. এটা ধর্মহীন রাষ্ট্র হতে সম্পূর্ণ আলাদা।
২. এটা পরিচালনার জন্য এক বিশেষ মনোবৃত্তি বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ ধরনের নির্ধারন আবশ্যক।
৩. ধর্মহীন রাষ্ট্রের জজ ও প্রধান বিচার প্রতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
৪. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের জন্য খোদাভীতি, নিজ কর্তব্য পালন ও সেজন্য আল্লাহরকাছে জবাব দিহির তীব্র অনুভূতি ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকের প্রয়োজন।

(গ) ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা কারীদের বৈশিষ্ট্যঃ
• পৃথিবীর বিপুল পরিমান সম্পত্তি হস্তগত থাকলেও তারা তার পূর্ন আমানতদার।
• রাজশক্তি করায়ত্ত হলেও সুখ নিদ্রা ত্যাগ করে জনস্বার্থে রক্ষণাবেক্ষণ।
• যুদ্ধে বিজয়ী দেশে হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হয়ে তাদের ইজ্জত আব্রর হেফাজতকারী।
• নিজেদের স্বার্থকে ধুলিস্যাৎ করে অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া।
• আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এমন মর্যাদার অধিকারী হবে যে, তাদের সততা, সত্যবাদীতা, ন্যায়পরয়নতা, নৈতিক ও চারিত্রিক, মূল নীতির অনুসরণ এবং প্রতিশ্রুতিও চুক্তি পালনের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব তাদের উপর আস্থাশীল হবে।

• ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি বা পন্থা:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের অলৌকিক আবির্ভাব ঘটনা
• ইসলামী জীবন দর্শন চরিত্র ও প্রকৃতির বিশেষ মাপকাঠি অনুযায়ী গঠিত ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করা। নেতা ও কর্মীদের এই বিশিষ্ট আদর্শে আত্মগঠন করা।
• সমাজ জীবনে অনুরূপ মনোবৃত্ত ও নৈতিক উদ্দীপনা জাগ্রত করা।
• ইসলামী আদর্শে নাগরিকদের গড়ে তুলতে একটি অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা।
• জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা ও কাজ করতে সক্ষম এমন লোক গড়ে তোলা।
• ইসলামী আদর্শের চিন্তা-চেতনা ও কর্ম জীবনের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন।
• ইসলামী আন্দোলন চতুপার্শ্বে যাবতীয় অবাঞ্চিত জীবন-ধারার বিরূদ্ধে প্রকাশ্যে সংগ্রাম করবে।

২. ইহাতে নিম্নোক্ত ফল পাওয়া যাবে:
• পরীক্ষার অগ্নিদহনে উত্তীর্ণ ত্যাগী লোক তৈরি হবে।
• এ আন্দোলনে এমনসব লোক পর্যায়ক্রমে যোগদান করবে যাদের প্রকৃতিতে সত্য-ন্যায়ের উপাদান অন্তর্নিহিত রয়েছে।
• সর্বশেষে কাঙ্খিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

৩. যে কোন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন:
• একটি বিশেষ ধরনের আন্দোলন।
• বিশেষ ধরনের সামাজিক চেতনা সম্পন্ন নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃাষ্ট। উদাহরণ, রুশ বিপব, জার্মানির সমাজতন্ত্রের বিপব।

• অবাস্তবকল্পনা বা ধারনা:
১. কিছু লোকের ধারণা মুসলিম জাতিকে একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে একই পাটফর্মে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে পারলেই ইসলামী রাষ্ট্র আপনা আপনিই প্রতিষ্ঠিত হবে। 
২. মুসলমানদের বর্তমান নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার স্বরূপ যেমন- চরিত্রগত দিক থেকে দুনিয়ার মুসলিম ও অমুসলিম জাতিগুলোর সবগুলোর অবস্থা প্রায় একই। উদাহরণঃ আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতি, রোজার দিনে একই সাথে খাওয়া, সুদ, ঘুষ, জেনা ইত্যাদির সাথে লিপ্ত হওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা:
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কর্মপন্থাই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা। তার অনুসৃত বিশিষ্ট কর্মপন্থাগুলো নিম্নরূপ:

১. ইসলাম হলো সেই আন্দোলনের নাম যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মান করতে চায় এক আলাহর সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
২. ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়।
৩. মূল লক্ষ্য আলাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের দাওয়াত দেওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতির চারটি দিক রয়েছেঃ
ক) আলাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান।
খ) অগ্নী পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমানিত হওয়া।
গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল।
ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপব।

ক) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান:
১. বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী হয়ে থাকা তবে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববাদীতার দাবী হলো সেই মহান সম্রাটের হুকুমের সম্মুখে মাথা নত করে দাও তার একান্ত আনুগত্য দাস হয়ে যাও।
২. গোটা জাতির একজনই সম্রাট মালিক এবং সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। অন্য কারো কতৃত্ব করার কোন অধিকার নাই।
৩. আলাহ ছাড়া আমি সকলের বিরূদ্ধে বিদ্রোহী এবং যারা আলাহকে মানে তারা ব্যতিত] ৪. এই ঘোষণা উচ্চারণ করার সাথে সাথে বিশ্ববাসী আপনার শত্রুহবে এবং চতুর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।

খ) অগ্নি পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমাণিত হওয়াঃ
১. লা ইলাহা ইলালাহ এই ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে পোপ (খৃস্টান) ঠাঁকুরদের সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলো এগুলো গঠন করে হলো ঐক্যজোট।
২. তাদের উপর নেমে আসে কঠিন অত্যাচার এবং এর ফলেই ইসলামী আন্দোলন মজবুত হয় এবং ক্রমবিকাশ ও প্রসার লাভ করে।
৩. এর ফলেই সমাজের মনি-মুক্তাগুলো আন্দোলনে শরিক হয়।
৪. একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরিক হচ্ছিল বাস্তবে ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ।
৫. কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে এ দেখে কিছু মানুষ উৎসাহী হয় এরা কি কারণে মার খাচ্ছে।

গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেলঃ
১. বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের সেই মহান নেতার নেতৃত্ব আদর্শ, সহানুভূতি এবং সার্বিকভাবে তার মডেলকে অনুসরণ করা একান্ত দরকার।
২. এই নেতার স্ত্রী ছিলেন বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক।
৩. কালিমার দাওয়াত কবুল ও মানুষকে এ দাওয়াত দেওয়ার সাথে সাথে তাদের সম্পদ শেষ হয়ে যায়।
৪. নেতা ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহনশীল।
৫. সমকালীন সময়ে তাকে ইসলামী আন্দোলনের কাজ না করার প্রতিফল হিসাবে আরব জাহানের বাদশাহী এবং আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী দিতে চেয়ে ছিল। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন এবং তিরস্কার আর প্রস্তাব্যগত সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।
৬. অত্যন্ত গরমের সময় মরুভূমির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন সাথীদের সাথে নিয়ে।
৭. হাশেমী গোত্রের লোকেরা এই আন্দোলনের প্রতি অনীহা ছিল।

ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লব:
ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একদল লোককে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছিল যারা ইসলামের পূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়ে এতটা যোগ্য হয়েছিল যে তারা যেকোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিল। উদাহরণ, মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র।

একথা সত্য যে, একাজের জন্য প্রযোজন ঈমান, ইসলামীক চেতনা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবুত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ, উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবাণী। 

 

একাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মত অটল হয়ে থাকবে। অন্যকোন দিকে তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুকনা কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না।

Tuesday, December 3, 2024

বইনোট : একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ ও তার থেকে বাঁচার উপায় || মরহুম আব্বাস আলী খান রহ.



লেখক পরিচিতি || মরহুম আব্বাস আলী খান রহ.

•জন্মঃ ১৩২১ সালের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে।
•স্থানঃ জয়পুরহাট।
•পড়ালেখাঃ প্রথমে নিজ ঘরে কোরআনের ছবক নেন। ১৯২১ সালে ২য় শ্রেনিতে ভতি হন। ৬ষ্ঠ শ্রেনির পর হুগলী মাদ্রাসায় পড়তে যান। রাজশাহী ও কারমাইকেল কলেজে পড়েন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাশ করেন।
•স্কলারশীপঃ ৬ষ্ঠ শ্রেনিতে ১ বছরের গভর্নমেন্ট বৃত্তি ও চারবার মেয়াদী বৃত্তি লাভ করেন।

•কর্মজীবনঃ ১৯৩৫ সালে তিনি চাকুরী গ্রহণ করেন। কিন্তু নামাযে বাধা দেয়ায় চাকুরীতে ইস্তফা দেন। ১৯৩৬ সালে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট যোগ দেন এবং শেরে বাংলার সেক্রেটারি হন। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের সার্কেল অফিসার হন। ১৯৫২ সালে জয়পুরহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন।

•রাজনীতি ও আন্দোলনঃ
১৯৫৫ সালে তিনি মুত্তাফিক ফরম পূরন করেন।
১৯৫৬ সালে জামায়াতের রুকন হন।
১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিভাগীয় আমীর হন।
১৯৭৯ সালে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সিনিয়র নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ থেকে ৯২ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ থেকে ৯২ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। আইয়ুব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্য আন্দোলন করেন।
১৯৭১ সালের মন্ত্রী পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হন।
১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিপ্লবের ৭ দফা গণদাবী ঘোষণা করেন।

ষাটের দশকের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিভ মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন। গণ আন্দোলন কর্মসূচী ও কেয়ারটেকার সরকারের জন্য আন্দোলন করেন।
১৯৭৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যান।
১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে বৃটেন যান।

•সাহিত্য চর্চাঃ অনুবাদ ও মৌলিক রচনা ৩৫টি। মৌলিক গ্রন্থ মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ

১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
২. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক
৩. মুসলিম উম্মাহ
৪. ইসলামী আন্দোলন ও তার দাবী এবং অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম
৫. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং
৬. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
৭. ইসলামী অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য
৮. পর্দা ও ইসলাম

ইন্তেকালঃ ৩ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে ১:২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।


১. যে আদর্শের হাতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষমতা নেই জগতের কোথাও তার জন্য একটুও স্থান নেই। বিজয়ী সভ্যতার সমূহ কর্ম জগত থেকে দূরে সরে পরে। তার ব্যাপারে দুর দৃষ্টি ভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তিদের মনেও এ পদ্ধতি দুনিয়ায় চলতে পারে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগে।

২. কাজেই হুকুমতে এলাহিয়া কায়েম করে খোদার তরফ থেকে নবীগন যে ব্যবস্থা নিয়ে এসে ছিলেন তাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করাই ছিল নবীদের মিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

৩. জাহেলিয়াত পন্থিদের তারা এতটুকু অধিকার দিতে প্রস্তুত ছিলেন যে, ইচ্ছা করলে তারা জাহেলি আকিদা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। কিন্তু কর্তৃত্বের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না।

৪. এ জন্যই প্রত্যেক নবী রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

নবীদের কাজঃ
১. সাধারণ মানুষের মাঝে চিন্তার বিপ্লব সৃষ্টি করা।
২. নির্ভেজাল ইসলামী শিক্ষায় প্রভাবিত একটি শক্তিশালী দল গঠন।
৩. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করে তমুদ্দুনের সমস্ত বিভাগকে নির্ভেজাল ইসলামের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা।

খেলাফতে রাশেদাঃ
১. হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তেইশ বছর নবুয়াতী জিন্দেগীতে যে সমস্ত কাজ পূর্ণরূপে সম্পাদন করেন।
২. আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও ওমর ফারুক (রা.) এর নেতৃত্ব।
৩. উসমান (রা.) এর শাসনামলের ১ম দিককার সময়।


১। একটি আদর্শবাদী দলের পরিচয়:

উত্তর: প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা সমুলে উৎপাটিত করে তার স্থলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একটি আদর্শ বেছে নিতে হয়। এর সাথে পৃথক চিন্তাধারাও থাকে। এ চিন্তা ও আদর্শের সাথে যারা সকল দিক দিয়ে একমত পোষণ করে তারা একটি দল গঠন করে। একে বলা হয় আদর্শবাদী দল।

২। আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ বইয়ে উন্মাদ ও দেওয়ানা বলতে কি বোঝানো হয়েছে?

উন্মাদ: ময়দান নিশ্চিত হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ময়দানে নেমে পড়া আর জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া সমান। উম্মাদেরাই শুধু এটা সম্ভব করতে পারে।

দেওয়ানা: দুর্দান্ত কুফরী শক্তির কর্তৃত্ব দেখার পরও যে ব্যক্তি দারুল ইসলাম কায়েমের জন্য ময়দানে নেমে পড়বে সে অবশ্যই দেওয়ানী।


৩। একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ:

১. দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করা।
২. কুরআন হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন না করা।
৩. সময় ও আর্থিক কোরবানীর প্রতি অবহেলা করা।
৪. দলীয় মূলনীতি মেনে না চলা।
৫. ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করা।
৬. ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব।
৭. জনশক্তির মধ্যেনৈরাশ্য ও হতাশা সৃষ্টি হওয়া।
৮. নেতৃত্বের অভিলাষ।
৯. অর্থ - সম্পদের প্রতি লালসা।
১০. জীবনমান উন্নত করার প্রবণতা।
১১. সহজ সরল জীবন যাপন না করা।
১২. মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করতে না পারা।
১৩. নেতৃত্বের দুর্বলতা
১৪. নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা আন্দোলনের পতন ডেকে আনে।
১৫. বায়তুলমাল সম্পর্কে আমানতদারীর অভাব এবং আর্থিক লেনদেনে সততার অভাব।
১৬. সহজ সরল জীবনযাপন না করা।


৪। তার থেকে বাচাঁর উপায়:

১. নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা।
২. অতিরিক্ত যিকির আযকার করা
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
৪. আত্মসমালোচনা করা
৫. ক্রোধ দমন করা
৬. মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করা।
৭. বিরোধী পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া।
৮. ত্যাগ ও কোরবানী করা
৯. সমস্যার ত্বরিত ও সঠিক সমাধান না করা।

৫। পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ঠ হওয়ার কারন:

১. পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ।
২. গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা।
৩. পরশ্রীকাতরতা।
৪. একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখা।
৫. কারো বিপদে আপদে তার খোঁজ খবর না নেয়া।
৬. পরস্পরবৈষয়িক স্বার্থে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া।
৭. অযথা কারো প্রতি কু-ধারনা পোষণকরা।
৮. এসব কারণে শুধু একটি দলই নয়, বরং মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তি ও ন্নড়ে হয়ে পড়ে।

৬। দারুল ইসলাম ট্রাষ্ট গঠনের পটভূমি:-

১৯৩৭ সালে আল্লামা ইকবাল হায়দ্রাবাদ থেকে পাঞ্জাবে হিজরত করার জন্য মাওলানা মওদূদীকে আহ্বান জানান। আল্লামা ইকবাল তরজুমানুল কোরআনের মাধ্যমে মাওলানার গুনমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি কখনো সাইয়্যেদ নাযির নিয়াযী এবং কখনো মিয়া মুহাম্মদ শফিকে দিয়ে তরজমানুল কোরআন পড়াতেন এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ঠিক এই সময়ে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এস.ডিও চৌধুরী নিয়ায আলী তার ৬০/৭০ একর জমি ইসলামের খেদমতের জন্য ওয়াক্ত করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাকা ঘর বাড়ি তৈরি করে বিশেষ পরিকল্পনার অধীনে দ্বীনের বৃহত্তর খেদমতের অভিলাষী ছিলেন। এ ব্যপারে তিনি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ চাইলে তিনি একমাত্র মাওলানা মওদূদীকে এ কাজের জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। মাওলানা মওদূদী ড. ইকবালের অনুরোধে তার সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর এ কাজের দায়িত্ব গ্রহন করতে রাজি হন এবং চিরদিনের জন্য হায়দ্রাবাদ পরিত্যাগ করে ১৯৩৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোর্ট নামক স্থানে হিজরত করেন। অতপর দারুল ইসলাম নামে একটা ট্রাষ্ট গঠন করে তার মহান কাজের সূচনা করেন।

Wednesday, September 25, 2024

আলোচনা নোট || ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান

আলোচনা নোট || ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্খিত মান

মহান আল্লাহ তা'য়ালা মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এবং প্রতিপালক। প্রত্যেক সৃষ্টিই তার হুকুম অনবরত পালন করছে এবং জিকির করছে। সকল সৃষ্টিই নির্দিষ্ট একটি নিয়মে চলছে। শুধুমাত্র মানুষই ব্যতিক্রম সৃষ্টি। যাকে সৃষ্টি করার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।

এই মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যার কিনা স্রষ্টার হুকুম অমান্য করার সামর্থ রয়েছে। আর আল্লাহতায়ালা সেটাই দেখবেন যে, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাকে যে ভয় করে এবং যে করেনা। সেটা বিচার করার জন্যই দুনিয়ার সৃষ্টি। যাহোক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ আল্লাহরহুকুম এবং রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানুষ মহান প্রভুর হুকুম অমান্য করছে এবং মহান আদর্শ প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ এড়িয়ে চলছে। নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি বিধান অনুসরণ এবং অন্যদের নিকট তা পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করা এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করার নাম ইসলামী আন্দোলন।

এই ইসলামী আন্দোলন যারা করবেন তথা এই আন্দোলনের যারা কর্মী হবেন তাদের অপরিহার্য কিছু গুণাবলী অর্জন করতে হবে এবং ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনে আমল করতে হবে। তবেই নিজে ভাল মুসলমান হতে পারবে এবং চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সমাজের অপরাপর মানুষদেরকে আল্লাহরদ্বীনের দিকে ডাকতে পারবে।


•ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্খিত মান:

১. ব্যক্তিগত গুণাগুণ অর্জন এবং পালন,

২. সহীহ ঈমান

৩. ইসলামের যথার্থ জ্ঞান অর্জন

৪. সমসাময়িক জ্ঞান অর্জন

৫. ঈষর্ণীয় চরিত্র

৬. মার্জিত ব্যবহার

৭. ধৈর্য্য

৮. সর্বক্ষেত্রে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন


•সাংগঠনিক গুণাবলী অর্জন ও পালন

১. সঠিক নেতৃত্ব

২. যথাযথ আনুগত্য 

৩. সার্বিক শৃংখলা সংরক্ষণ

৪. অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সংরক্ষণ (সম্পর্ক ও আচরণ)

৫ . পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা (ভ্রাতৃত্ববোধ)

৬. পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করা

৭. অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া


•সামাজিক গুণাগুণ অর্জন ও পালন:

১. সমাজের আস্থাভাজন হিসেবে নিজেকে তৈরী করা

২. সমাজের যে কোন ঘটনায় মতামত প্রকাশ

৩. সামাজিক সমস্যার সমাধানে অংশগ্রহণ

৪. মানুষের দুঃখ ও দুর্দশায় পাশে দাড়ানো ও মানুষের

আনন্দে সাধুবাদ জানানো

৫. ব্যক্তির বয়স, পেশা, মর্যাদা হিসেবে ব্যবহার 

৬. ভালোকাজে উৎসাহ দান, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা 

৭. নিজ উদ্যোগে গঠনমূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ


•পারিবারিক গুণাগুণ অর্জন ও পালন:

১. পিতামাতার বাধ্য থাকা

২. বড় ছোট ভাই বোনদেরকে হক অনুযায়ী ব্যবহার

৩. পরিবারে ইসলামী নীতি অনুসরণ করানোর জন্য চেষ্টা করা 

৪. পরিকল্পিতভাবে সবার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো

৫. আত্মীয় স্বজনের সাথে পর্দা সংরক্ষণে যত্নবান হওয়া

৬. পরিবারের অর্থনৈতিক লেনদেনে ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীন থাকা

৭. আত্মীয় স্বজনের হক আদায়ে সচেষ্ট থাকা

উপরোল্লেখিত গুণাগুণ সমূহের মধ্যে অনেক কার্যাবলী ও উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের কোন কর্মী এসব গুণাগুণ অর্জন করলে তার অবস্থান যেখানে হোক সেখানেই যে নিজেকে প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় সৌরভ ছড়াতে সক্ষম হবে। আর যখন এমন কর্মী তৈরী বেশি হবে তখনই আমরা সমাজ পরিবর্তনের আশা করতে পারি।

উপরোল্লেখিত গুণের সমাবেশ ঘটানো খুব কঠিন কাজ নয়। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আরম্ভ করলে এই সব গুণাগুণ ব্যক্তির মধ্যে তৈরী হবে।

সেগুলো হল-

১. কুরআন হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন

২. বেশি বেশি ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন

৩. নবী জীন্দেগী ও সাহাবা জীন্দেগী, ইসলামী মনিষীদের জীবনী, বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনী অধ্যয়ন

৪. সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীন থাকা

৫. সাংগঠনিক মান উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা

৬. ক্ষমা করার প্রবণতা

৭. আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়

৮. বেশি বেশি নফল ইবাদত (নামাজ, রোজা, জিকির)

উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি আমল করতে পারলে ব্যক্তি একজন খাঁটি মুসলিম এবং ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ কর্মী হতে পারবেন। আর এই কর্মীদের সমন্বয়েই গঠিত হবে কাঙ্ক্ষিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রেষ্ঠ মানের কর্মী হিসেবে কবুল করুন। আমীন।