Close
ইসলাম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইসলাম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

মাহে রমজানে রোজার প্রয়োজনীয় যাবতীয় মাসআলা || একজন রোজাদারের যে সকল করণীয় ও বর্জনীয় কাজ


“রমজানে রোজার যাবতীয় মাসআলা”

‘একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ’


রমযানুল মুবারক মাস সেসব নেয়ামাতসমূহের মধ্যে একটি নেয়ামাত যা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন। এ মাসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স.-এর মত নেয়ামাত আমরা পেয়েছি। এ মাসেই কুরআন মাজীদ দেয়া হয়েছে, যা হেদায়াত, ফুরকান, রহমত, নূর ও শেফা। মুসলিম উম্মাহর প্রাণস্পন্দন ও উন্নতির নিগূঢ় রহস্য ফী সাবিলিল্লাহর মাঝেই পাওয়া যায় প্রথম মানুষের বা মানবতার হৃদয় জয় করার জন্য জিহাদ, পরে সাংস্কৃতিক বিজয়ের জন্য জিহাদ-আর এ সকল জিহাদের সাথে সাথে চূড়ান্ত কামিয়াবীর জন্য আপন নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে জিহাদ। যাতে করে অর্জিত হয় তাকওয়া, ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং সাথে সাথে সমষ্টির তাকওয়া; রাতে জাগরণে শীতের রাতে ইশকের সাথে ওযু করা, লাইফে সাদাকাত (দান-খয়রাত) দিয়ানত, আমানত, আদালত (সুবিচার করা), শুজাআত (নির্ভীকতা, উথুয়াত (ভ্রাতৃত্ব) ও মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান। পবিত্র মাহে রমজানে একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ আলোকপাত করা হলো।

রোজা অবস্থায় যখন কাফফারা ওয়াজিব হয়:

১. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কোনো খাদ্য আহার করলে অথবা ওষুধ খেলে অথবা সিঙ্গা কিংবা সুরমা লাগানোর পর অথবা গীবত করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত আহার বা পান করলে।
২. প্রিয়জনের প্রিয় থুতু ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি খেলে।
৪. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী মিলন করলে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্ত থাকলে তার ওপরও কাজা-কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর স্ত্রী রাজি না থাকলে বরং তার সঙ্গে জোরপূর্বক করা হলে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।
৫. কামভাবের সঙ্গে স্ত্রীকে স্পর্শ করল অথবা চুম্বল করল বা আলিঙ্গন করল, তবে বীর্যপাত হয়নি, কিন্তু সে মনে করল, রোজা ভেঙে গেছে। ফলে ইচ্ছাকৃত পানাহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা এবং কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। (বাদায়িউস সানায়ে ২/৫৫৮)
৬. কেউ গোঁফে তেল লাগালো আর মনে করল রোজা ভেঙে গেছে, অতঃপর ইচ্ছাকৃত আহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে। (বাদায়িস সানায়ে ২/২৫৮)
৭. বিনা ওজরে একই রমজানে এক বা একাধিক রোজা রাখার পর ভেঙ্গে ফেললে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর রোজাগুলো একাধিক রমজানের হলে প্রত্যেক রমজানের জন্য এক একটি করে কাফফারা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুখতার: ৩/৩)


রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ:

১. ইচ্ছা করে বমি করা
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে
৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
৯. মুখ ভরে বমি করলে
১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে
১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে
১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।


যেসব কারনে রোজা কাজা করতে হয়:
১. ইচ্ছা করে বমি করা,
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা,
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব,
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে,
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে,
৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে,
৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে,
৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে,
৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে,
১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে,
১১. মুখ ভরে বমি করলে,
১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে,
১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে,
১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে,
১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে,
১৬. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে,
১৭. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে।


যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।


যে সব কারণে রোজা ভাঙ্গে না/রোজার ক্ষতি হয় না:
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলা-বালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।

বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি


ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন

জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি 

জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বারংবার নামাজ কায়েমের পরই জাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিনের নির্দেশেই জাকাত আদায়ের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) সাহাবীগণকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এজন্যে একটা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। কেন জাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টন তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই জাকাত গণ্য হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্যে জাকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। জাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সব ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু সাধারণ করের ক্ষেত্রে কোন নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নেই।

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে পার্থক্য:

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে অন্তত চারটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যথা:


প্রথমত: নির্দিষ্ট আয়ের বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে নির্ধারিত হারে কর প্রদান করতে হয়। এ জন্য করদাতা কোন প্রত্যক্ষ উপকার প্রত্যাশা করতে পারে না। সরকার করের মাধ্যমে অর্জিত এই অর্থ দরিদ্র ও অভাবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যয়ের জন্যে বাধ্য থাকেন না। পক্ষান্তরে জাকাত হিসেবে আদায়কৃত অর্থ অবশ্যই আল-কুরআনে নির্দেশিত লোকদের মধ্যেই বন্টন করতে বা তাদের জন্যেই ব্যবহৃত হবে।


দ্বিতীয়ত: জাকাতের অর্থ রাষ্ট্রীয় সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু করের অর্থ যেকোন কাজে ব্যয়ের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা সরকারের রয়েছে।


তৃতীয়ত: জাকাত প্রদান শুধুমাত্র বিত্তশালী বা সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্যেই বাধ্যতামূলক। কিন্তু কর বিশেষত পরোক্ষ কর, সর্বসাধারণের উপর আরোপিত হয়ে থাকে। অধিকন্তু প্রত্যক্ষ করেরও বিরাট অংশ জনসাধারণের উপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।


চতুর্থত: জাকাতের হার পূর্বনির্ধারিত এবং স্থির। কিন্তু করের হার স্থির নয়। যে কোন সময়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী করের হার ও করযোগ্য বস্তু বা সামগ্রীর পরিবর্তন হয়ে থাকে।


সুতরাং, জাকাতকে কোনক্রমেই প্রচলিত অর্থে সাধারণ কর হিসেবে গণ্য করা যায় না বা তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।

যে সব বস্তুর উপর যাকাত ধার্য:

ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর উপর জাকাত ধার্য হয়েছে সেগুলি হলো-


১. ব্যাংকে/ হাতে সঞ্চিত/ জমাকৃত অর্থ;

২. সোনা, রূপা, এবং সোনা-রূপা দ্বারা তৈরি অলংকার;

৩. ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী:

৪. জমির ফসল;

৫. খনিজ উৎপাদন; এবং

৬. সব ধরনের গবাদি পশু।


উপরোক্ত দ্রব্যসামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যখন কোন মুসলমান অর্জন করে তখন তাকে জাকাত দিতে হয়। এই পরিমাণকে নিসাব বলে। নিসাবের সীমা বা পরিমাণ দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। একইভাবে জাকাতের হারও দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। জাকাতের সর্বনিম্ন হার শতকরা ২.৫%।

•জাকাতের খাত ও বন্টন নীতি:

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে জাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-


"দান-খয়রাত তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন (সত্যের প্রতি) সম্প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরজ এবং আল্লাহ সব জানেন ও বুঝেন।" (সূরা আত-তাওবা: ৬০ আয়াত)


উপরের আয়াত হতে আট শ্রেণীর লোকদের মধ্যে জাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়। সেগুলি হচ্ছে:


১. দরিদ্র জনসাধারণ;

২. অভাবী ব্যক্তি;

৩. যে সকল কর্মচারী জাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছে;

৪. নও-মুসলিম;

৫. ক্রীতদাস মুক্তি;

৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি;

৭. আল্লাহর পথে, এবং

৮. মুসাফির।


এই আটটি খাতের মধ্যে ছয়টিই দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দুটি খাতও (৩ ও ৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনা একটি কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ কাজ। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এটাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। সুতরাং, তাদের বেতন এই উৎস হতেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া যেসব ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে লিপ্ত তারাও অন্য কোনভাবে জীবিকা অর্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত। সুতরাং, উপরে বর্ণিত আটটি খাতেই যদি জাকাতের অর্থ ব্যয় হয় তাহলে দরিদ্রতা দূর হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার নিরসন হবে।

সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ে রাসুল সাঃ এর ভূমিকা:

রাসূলে করীম (সা) নিশ্চিতভাবেই জানতেন, ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাকাতের প্রতিষ্ঠা হলে বহুবিধ কল্যাণ সাধিত হবে। তাই তিনি জাকাত যথাযথ আদায় ও তার সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে কঠোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ের জন্যে রাসূলে করীম (সা) নবম ও দশম হিজরিতে আরব ভূখন্ডের বারোটি এলাকায় বারোজন প্রখ্যাত সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন।

অনুরূপভাবে পনেরোটি প্রধান গোত্র হতে জাকাত আদায়ের দায়িত্ব তিনি বারোজন খ্যাতনামা সাহাবীর উপর অর্পণ করেছিলেন।

রাসুল সাঃ এর বিলি বন্টন যারা করতেন:

জাকাত যথাযথ বিলি বন্টনের জন্যেও নবীজীর (সা) উদ্যোগেই বলিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল যা আজকের যেকোন উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে তুলনীয়। এ থেকেই বোঝা যায় জাকাত বায়তুলমালের কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে নিচে বর্ণিত আট শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। এরা হচ্ছে-


১. সায়ী = গবাদি পশুর জাকাত সংগ্রাহক;

২. কাতিব = করণিক;

৩. কাসাম = বন্টনকারী;

৪. আশির = জাকাত প্রদানকারী ও জাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী;

৫. আরিফ = জাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী;

৬. হাসিব = হিসাব রক্ষক;

৭. হাফিজ = জাকাতের বস্তু ও অর্থ সংরক্ষক; এবং

৮. কায়াল = জাকাতের পরিমাণ নির্ণয় ও ওজনকারী।

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য:

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বহুবিধ। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান এবং মুখ্য হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেওয়া। ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু নিন্দাই করে না, বরং তা দূরীভূত করার পদক্ষেপও অবলম্বন করতে বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাঁদের সম্পদের একটা অংশ ব্যয় করা উচিত। এর ফলে শুধু অসহায় ও দুস্থ মানবতার কল্যাণ হবে তাই নয়, আয়-বন্টনের বৈষম্যও হ্রাস পাবে। জাকাত প্রদানের ফলে সম্পদশালী মুসলিমের মন হতে ধন-সম্পদের লালসা দূরীভূত হবে। দরিদ্রদের অভাব মোচনের জন্যে নিজেদের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে তারা সচেতন হবে। বিত্তবান মুসলমানদের আল্লাহ সৎপথে তাদের সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বার্ষিক উদ্বৃত্ত অর্থ হতে নির্দিষ্ট হারে একটা অংশ দরিদ্র এবং দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের মধ্যে তারা বিতরণ করবেন। এর ফলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবেন।


জাকাত মজুতদারি বন্ধ করারও এক প্রধান ও বলিষ্ঠ উপায়। মজুতকৃত সম্পদের উপরই জাকাত হিসেব করা হয়ে থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এবং মজুত সম্পদ যেকোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়ে তাকে। অবৈধভাবে অর্থ মজুত করার ফলে নানারকম সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা এর প্রকৃষ্ট নজির। অল্প কিছু লোকের হাতে বিপুল অবৈধ ও কালো টাকা জমেছিল। সরকারের এমন কোন কৌশল বা পদ্ধতি ছিল না যার দ্বারা এই অবৈধ অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব ছিল। ফলে এসবের ব্যয় ও ব্যবহারের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়নি। পরিণামে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির ও সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যের।


কোন পদ্ধতিই সার্থকভাবে উপরোক্ত সমস্যার মুকাবিলা করতে সক্ষম নয়। একমাত্র ইসলামেই তার সমাধান রয়েছে। কারণ বিত্তবানদের জন্যে তাদের মজুতকৃত অর্থ বা সম্পদের একটা অংশ নিছক বিলিয়ে দেবার মতো কোন পার্থিব কারণ নেই। কিন্তু একজন মুসলমানের আল্লাহ ও আখিরাতের ভয় রয়েছে। উপরন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তিত আইনে সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতাও রয়েছে মজুত সম্পদকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যয়, বিতরণ বা সরকারের কাছে সমর্পণে বাধ্য করতে। এর ফলে বিত্তবানদের সামনে দু'টি মাত্র পথ খোলা থাকবে-


১. শিল্প বা ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করা, অথবা

২. ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী তা ব্যয় করা।


জাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দারিদ্র্য দূর করা। দারিদ্র্য মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্রবিশেষে তা কুফরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতির সৃষ্টি হয় দরিদ্রতার ফলে। পরিণামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দরিদ্রতার জন্যে। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে জাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে। জাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।


একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের লোকদের মধ্যে যখন জাকাতের অর্থসামগ্রী বন্টন করে দেওয়া হয় তখন শুধু যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নয়, বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। দরিদ্র ও দুর্গত লোকদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। বেকারত্ব তাদের নিত্যসঙ্গী। জাকাত প্রাপ্তির ফলে তাদের হাতে অর্থাগম হলে বাজারে কার্যকর চাহিদার সৃষ্টি হয়। এরই ফলে দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নির্মাণ ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অনুকূল পরিবেশ। ফলশ্রুতিতে প্রচলিত সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে আয়গত পার্থক্যও হ্রাস পেতে থাকে।

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪

দারসুল কুরআন: সুরাতুল বাক্বারাহ || ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত || মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি


মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি

দারসুল কুরআন | সুরা আল বাক্বারাহ | ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত
•আরবি ইবারত:
১৮৩:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ
১৮৪:
اَیَّامًا مَّعْدُوْدٰتٍ١ؕ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِیْضًا اَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ١ؕ وَ عَلَى الَّذِیْنَ یُطِیْقُوْنَهٗ فِدْیَةٌ طَعَامُ مِسْكِیْنٍ١ؕ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَیْرًا فَهُوَ خَیْرٌ لَّهٗ١ؕ وَ اَنْ تَصُوْمُوْا خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
১৮৫:
شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَـٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ‌ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ‌ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ‌ۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَٮٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
১৮৬:
 فَإِنِّى قَرِيبٌ‌ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِ‌ۖ فَلْيَسْتَجِيبُواْ لِى وَلْيُؤْمِنُواْ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ


•সরল বাংলা অনুবাদ:
১৮৩:
 হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।
১৮৪:
এ কতিপয় নির্দিষ্ট দিনের রোযা। যদি তোমাদের কেউ হয়ে থাকে রোগগ্রস্ত অথবা মুসাফির তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এই সংখ্যা পূর্ণ করে। আর যাদের রোযা রাখার সামর্থ আছে (এরপরও রাখে না) তারা যেন ফিদিয়া দেয়। একটি রোযার ফিদিয়া একজন মিসকিনকে খাওয়ানো। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে কিছু বেশী সৎকাজ করে, তা তার জন্য ভালো। তবে যদি তোমরা সঠিক বিষয় অনুধাবন করে থাকো তাহলে তোমাদের জন্য রোযা রাখাই ভালো।
১৮৫:
রমযানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাত পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোযা রাখা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় বা সফরে থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোযার সংখ্যা পূর্ণ করে। আল্লাহ তোমাদের সাথে নরম নীতি অবলম্বন করতে চান, কঠোর নীতি অবলম্বন করতে চান না। তাই তোমাদেরকে এই পদ্ধতি জানানো হচ্ছে, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূর্ণ করতে পারো এবং আল্লাহ‌ তোমাদের যে হিদায়াত দান করেছেন সেজন্য যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে ও তার স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
১৮৬:
আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে। 

নামকরণ:
সূরায়ে বাকারায় অষ্টম রুকুতে বণী ইসরাইলদের প্রতি- إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً - নির্দেশ দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সূরার নামকরণ করা হয়।
 

শানে নুযূল: 
হযরত সালমা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বর্ণনা করেন যে-
 وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطَيْقُونَهُ فَدْيَةٌ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল, যার ইচ্ছা হয় সে রোযা রাখতে পারে আর যে রোযা রাখতে না চায় ফিদিয়া দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ নাযিল হলো, তখন ফিদিয়া দেয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ সামর্থ্যবান লোকদের ওপর শুধুমাত্র রোযা রাখাই জরুরী সাব্যস্ত হয়ে গেল এবং বলা হলো যে, রোযা শুধুমাত্র তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি বরং পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও ফরয ছিলো। অতএব তোমাদের যার জীবনেই এটা পাবে অবশ্যই তাকে রোযা রাখতে হবে।

এ সূরাটি নাযিল হওয়ার আরো উল্লেখযোগ্য কারণ হল প্রথমতঃ ইহুদীদের ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের সামনে ইসলামের মূলনীতি উপস্থাপন। 
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষণা। 
তৃতীয়তঃ কাফেরদের সর্বাত্মক বিরোধীতার মোকাবিলার পদ্ধতি। 
চতুর্থঃ মুনাফিকদের চরিত্র বিশ্লেষণ।

আলোচ্য বিষয়:
১. 'সাওম' ইসলামের মৌলিক ইবাদত, এ অংশে তার গুরুত্ব ও বিধি বিধান শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
২ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে 'তাকওয়া' অর্জন করে কুরআন বুঝার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন।
৩. কুরআন নাজিলের কারণেই যে রমযান মাসের এত গুরুত্ব সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।

•শাব্দিক অর্থ ও তার ব্যাখ্যা:
كتب (কুতিবা) ফরয করে দেয়া হয়েছে। লিখে দেয়া হয়েছে। আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

الصَّيَامُ এটা صَوْمٌ সাওম শব্দের বহুবচন। আর সাওম শব্দের অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় 'সুবহেসাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা-সাথে সাথে সকল প্রকার রিপু বন্ধ রেখে আল্লাহ্ ও রাসূলের যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা।

قلكُمْ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের, অতীত জমানার লোকদের, পূর্বেকার যুগের লোকদের। এখানে অন্যান্য নবীগণের উম্মতদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

تَتَّقُوْن (তাত্তাকুন) তাওয়া অর্জন করবে, খোদাভীরু হবে, পরহেজগারী অবলম্বন করবে, আল্লাহভীতি অর্জন করবে, সংযমশীল হবে।

أَيَّامًا مَّعْدُودَات গনা কয়েকদিন, কতেক দিন, নির্দিষ্ট দিন, সুনির্ধারিত দিন। এখানে 'আইয়ামাম মা'দুদাত' বলে রমযান মাসের নির্ধারিত দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে।

مريضًا (মারিদান) রুগ্নাবস্থা, অসুস্থ, এমন অসুস্থতা যাতে সাওম পালন করার কারণে তার রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। ডাক্তার সাওম না রাখার পরামর্শ দিতে পারে।

سفر (সাফারিন) সফর অবস্থা, ভ্রমণ অবস্থায়, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুসাফির ঐ ব্যক্তিকে বলে, যিনি ৪৮ মাইল বা ৭৩ কিঃ মিঃ (প্রায়) পথ অতিক্রম করেন।

فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخْرَ উপরোক্ত দু'অবস্থা তার যতদিন থাকবে, আল্লাহর নির্দেশ হলো সে অন্য মাসে ততদিন রোযা রাখবে।

فدْيّة বদলা, পরিবর্তে যা দেয়া হয়। এখানে রোজা না রাখলে তার' বদলা তথা ফিদিয়া দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهُ থেকে আয়াতের শেষাংশটুকু ইসলামের প্রাথমিক যুগে লোকজনের রোযায় অভ্যস্ত করানোর উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে এর পরের আয়াত (১৮৫ নং আয়াত) অবতীর্ণ করে উপরোক্ত হুকুম রহিত করা হয়।
الزل নাযিল করা হয়েছে। অবতীর্ণ করা হয়েছে, এখানে انزل বলতে এক সাথে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ করার কথা বুঝানো হচ্ছে।
بینت (বাইয়েনাত) দলিল প্রমাণসমূহ, বিস্তারিত, বিশ্লেষণ, হিদায়াতের নির্দেশিকা বা নীতিমালা।

الْفَرْقَانِ (আলফুরক্বান) পার্থক্য সূচনাকারী গ্রন্থ, যে গ্রন্থ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এখানে মহাগ্রন্থ আলকুরআনকে বুঝানো হচ্ছে। এটা কুরআন এর একটি নামও বটে।

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ (ফামানশাহেদা মিনকুম) অতঃপর তোমাদের মধ্য হতে যে কেউ এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে। এ মাসে উপস্থিত থাকবে। রমযান মাস পাবে।

ٱلْيُسْرَ (ইউসরা) মূল ধাতু হচ্ছে 'ইউসরুন', অর্থ-সহজ আরামদায়ক, সহনশীল, ভারসাম্যপূর্ণ, সরল ইত্যাদি।

ٱلْعُسْرَ (উসুরুন) কাঠিন্যতা, এর বিপরীত শব্দ অর্থ সহজ-সরল নয় বরং কঠিন, সাধ্যের বাইরে।

لِتُكْمِلُوا الْعَدَّةَ যাতে তোমরা কাজা রোযার দিন পরবর্তীতে পুরো করে নিতে পারো। এজন্য কাজা করার সিস্টেম করা হয়েছে।

وَتُتُكْبَرُوا اللَّهُ যাতে করে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা করতে পারো। আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে পারো।

•রমজান (রোজা) সম্পর্কিত আলোচনা:

১. সাউম সংক্রান্ত শরয়ী বিধান:
ক) সাউম কাকে বলে: রোযাকে আরবী ভাষায় 'সাউম' বহুবচনে সিয়াম বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ হলো কোন কিছু থেকে বিরত থাকা বা কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা।
ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষায় সাউম হলো সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থেকে আল্লাহ্ ও রাসূলের নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।

খ) সাউম এর প্রকারভেদ: ইসলামী শরীয়াতের নিয়মানুযায়ী প্রাথমিকভাবে সাউম দুই প্রকার-

এক. ইতিবাচক (Positive)
দুই. নেতিবাচক (Nagative)

এক. ইতিবাচক সাউম আবার চার প্রকার-
ক) ফরয, খ) ওয়াজিব, গ) সুন্নাত, ঘ) নফল,

ক. ফরয : যা পবিত্র মাহে রমযানের (চন্দ্রমাস) একমাস আদায় করা হয়।
খ. ওয়াজিব: মান্নত বা কাফফারার সাউম।
গ. সুন্নাত: নবীকরীম (সাঃ) যা নিজে করতেন এবং উম্মাতের প্রতি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন যেমন আশুরার, আরাফার দিনে ও আইয়ামে বীযের ইত্যাদি।
ঘ. নফল: উল্লেখিত তিন প্রকার ব্যতীত সকল ইতিবাচক সাউমই নফল। যেমন শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা।

দুই. নেতিবাচক সাউম দুই প্রকার:
ক) মাকরুহ, খ) হারাম,

ক. মাকরুহ: যে কোন একদিন নির্দিষ্ট করে সাউম পালন করা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল সাউমও মাকরুহ।
খ. হারাম: বছরের পাঁচ দিন সাউম পালন করা হারাম। দুই ঈদের দুই দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। আইয়ামে তাশরীক হলো ১১, ১২, ও ১৩ই জিলহাজ্ব।

গ. সাওম ফরয হওয়ার সময়-কাল: হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় উপনীত হলেন তখন তিনি আশুরার রোযা পালন করেন এবং সাহাবীগণকে তা পালন করার নির্দেশ দেন। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রমযানের রোযা ফরয হয়। রমযানের রোয়া ফরয হওয়ার পূর্বে 'আশুরার' রোযা ফরয ছিল। হিজরতের পর 'আইয়ামুল বিয' এর রোযা ফরয করা হয়েছে। এরপর রমযান মাসের রোযা ফরয হওয়ায় 'আশুরার' ও 'আইয়ামুল বিযের' রোযা মানসুখ হয়ে গিয়েছে। উহা এখন সুন্নাতরূপে পরিগণিত।

. সাউম কেন ফরয করা হলো: সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি দুই কারণে সাউম ফরয করা হয়েছে।

প্রথমত: অতীতের সকল নবীর উম্মতের উপর সাউম এর ইবাদত ফরয ছিল তাই।
দ্বিতীয়ত: তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে সাউম ফরয হয়েছে।
সাওমের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও মর্যাদা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।

এই স্বল্প পরিসরে সাউমের ফজিলত বা গুরুত্ব আলোচনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি হাদীসের অনুবাদ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই।
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أمْثَالِهَا إلى سبع مائة ضعف قَالَ اللهُ تَعَالى الا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِى به .
(بخاری ، مسلم)
রাসূল (সা) বলেছেন- বনী আদমের সকল আমলের বিনিময় দশ থেকে সাতশতগুণ পর্যন্ত দেয়া হবে। (কিন্তু সাওম ব্যতিক্রম)
আল্লাহ্ বলেন- (বনী আদমের সকল আমল তার নিজের) কিন্তু সাউম আমার জন্য তাই আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেবো। (বোখারী ও মুসলিম)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . (بخاری ، مسلم)
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা করবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বোখারী ও মুসলিম)

قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّيَامُ جُنَّةٌ . (بخاری) 
সাউম ঈমানদারদের জন্য ঢাল স্বরূপ। (বোখারী)

এ ধরনের অসংখ্য হাদীসে রাসূলের মাধ্যমে সাওমের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা সাউমের কল্যাণ লাভ করতে পারবো। ইন্‌শাআল্লাহ্।

২. মাহে রমযানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ

ক) তাকওয়া অর্জনই মাহে রমযানের উদ্দেশ্য: আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে (সাউম ফরয হওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে) ঘোষণা করেছেন-
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (উম্মতদের) উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া, খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জন করতে পারো।

তাই নামায যেমনিভাবে মুমিনদেরকে দৈনিক পাঁচবার আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত হয়ে দাসত্বের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে চরিত্র গঠন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে শারীরিক ইবাদত সাউম একমাস পূর্ণ ঈমান ও ইহতেসাবের সহিত পালন করলে অবশ্যই খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জিত হবে। এই জন্য আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন- 'সাউম আমার জন্যই, যার প্রতিদানও আমি নিজেই' অর্থাৎ ইবাদাত লোক দেখানোর জন্য হতে পারে; কিন্তু সাউম এমন কি ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ্র ভয়ে আল্লাহর জন্যেই হয়ে থাকে।

খ) রমযানের সাথে কোরআনের সম্পর্ক: আমরা সাধারণত: প্রত্যেক বছর রমযান মাস এলেই ঈমাম, আলেমেদ্বীন ও জুময়ার খোতবার মাধ্যমে রমযান মাসের বিশেষ ফাজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে শুনে থাকি। এজন্য মুসলিম মিল্লাত রমযান মাসের বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, রমযান মাসের এত গুরুত্ব ও মর্যাদা কেন হয়েছে? আসুন আমরা রমযানের সাথে কোরআনের আলোচনা করে উক্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর গ্রহণ করি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَتِ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

মাহে রমযান তো সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের চলার পথের দিক নির্দেশক হিসেবে, যার মাঝে হেদায়াতের দলিল প্রমাণাদি সহ বিস্ত ারিত বিবরণ রয়েছে। আরো রয়েছে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের বিষয়সমূহ। সূরায়ে কদরে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন-
إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ -
"নিশ্চয় আমি এই কুরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি।"

সুতরাং উল্লেখিত দু'টি আয়াতের মর্মানুযায়ী আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি, কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের এত কদর এত গুরুত্ব হয়েছে। আর কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের সিয়াম সাধনা ফরয করা হয়েছে। অতএব রমযানের সাথে কুরআনের সম্পর্ক আমাদের কাছে এখন সুস্পষ্ট।

গ) তাকওয়া কাকে বলে: তাকওয়া শব্দটি ধাতুগত উৎপত্তির দিক থেকে চিন্তা করলে আরবী ভাষায় এর অর্থ শুধু খোদাভীতি বা খোদাপ্রেম হবে না। আল- কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে যেভাবে তাকওয়ার আলোচনা হয়েছে তাতে মূল উদ্দেশ্য এক হলেও দু'ধরনের অর্থ করতে হবে। যেমন সূরা তাহরীম- এর দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُوْ انْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا.
(হে ঈমানদারগণ) তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।

অতএব তাকওয়ার এক অর্থ যেমন খোদাভীতি অর্জন, মুত্তাকী হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্র নির্দেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকাই খোদাভীতি। আরেক অর্থ বাঁচা, মুক্তি লাভ করা, নিষ্কৃতি পাওয়া, বিজয় লাভ করা।

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে দু'অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং একটি অন্যটির সম্পূরক। সাউমের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যাতে করে তোমরা খোদাভীতি বা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তোমরা প্রকৃতপক্ষে পরিত্রাণ পাবে বা মুক্তি লাভ করবে।

ঘ) তাকওয়ার বাস্তব অবস্থা: এখানে তাকওয়ার বাস্তব অবস্থাটা বা তাকওয়ার সুফল আল-কুরআন থেকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন- وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ لَيَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقُهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

যারা আল্লাহ্ ভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করে, আল্লাহ্ তাদের চলার পথ খুলে দেন। আর তাদেরকে এমন জায়গা থেকে রিঙ্ক এর ব্যবস্থা করে দেন, যা তারা কোনদিন চিন্তাও করতে পারে না। (তালাক-২-৩)

সূরা আলে-ইমরানের ১২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং খোদাভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করো তাহলে তোমাদের শত্রুদের কোন ষড়যন্ত্র বা কলাকৌশল তোমাদের কোনই ক্ষতিসাধন করতে পারবে
وَانْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوْا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا . -
অতএব তাওয়ার অর্থ বুঝে তার আলোকে একজন মুমিন যদি তার সঠিক চরিত্র গঠন করে এবং জীবনকে তাওয়া ভিত্তিতে পরিচালনার শপথ গ্রহণ করে তাহলে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি সামষ্টিকভাবে ইহ ও পরকালে সুবিধার কথা উল্লেখিত আয়াতসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমাদের বাস্তব জীবনে তাওয়ার সুফল বয়ে আনবো, এটাই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।

ঙ) তাকওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছয়টি। যথা:
১। সত্যের সন্ধান;
২। সত্য গ্রহণ;
৩। সত্যের উপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা;
৪। আল্লাহভীতি;
৫। দায়িত্বানুভূতি;
৬। আল্লাহর নির্দেশ পালন।
এ বৈশিষ্ট্য আমাদের সকলের অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই কেবল তাকওয়াবান হওয়া যাবে।

৩. রমযানের সাথে কুরআন ও তাকওয়ার সম্পর্ক:
ইতিপূর্বে আমরা তাওয়ার অর্থ পরিচিতি ও বাস্তব দিক আলোচনা করেছি। এখন রমযান ও কুরআন তাওয়া অর্জনে কি ভূমিকা রাখে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

সূরা ফাতিহা আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করেছি এই বলে যে, হে রব, আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর পরিচালিত কর। এর উত্তরে রাব্বুল আলামীন সূরা বাকারার প্রথমেই সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর চলার শর্ত উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন-
ذلك الْكِتَابُ لأَرَيْبَ فِيهِ - هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ .
ইহা এমন এক কিতাব, যার মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যারা মুত্তাকী তাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিবে।

অতএব বুঝা যাচ্ছে, কুরআন থেকে হিদায়াত পেতে হলে মুত্তাকী হওয়। শর্ত। সাউম ফরয করা হয়েছে- তাকওয়া অর্জন করার জন্য এবং কুরআন নাযিলের কারণেই রমযান মাসের এতো গুরুত্ব হয়েছে।

সুতরাং আল-কুরআন মানব জাতির জন্য একমাত্র নির্ভুল জীবন বিধান। আল- কুরআন বুঝতে হলে তাওয়া অর্জন করতে হবে আর তাকওয়ার প্রশিক্ষণের জন্যই একমাত্র সিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই রমযানের প্রশিক্ষণ কুরআন বুঝে তা বাস্তবায়নের জন্য এক বিশেষ প্রশিক্ষণ।
অতএব আল-কুরআন, মাহে রমযান ও তাওয়ার পূর্ণতা অর্জন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নাম নয়, বরং পরিপূরক।

•শিক্ষাঃ 
আলোচ্য দারসের শিক্ষাগুলো নিম্নে দেয়া হচ্ছে:
১. পবিত্র রমযান মাসের সিয়াম সাধনা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয। রোয়া ফরয করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। 

২. অসুস্থ অবস্থায়, মুসাফির, মহিলাদের শরয়ী ওযর ও অক্ষম বৃদ্ধদের জন্য এ মাসে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। (এ ব্যাপারে শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গী ও নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে)

৩. মাহে রমযানের যথাযথ দায়িত্ব পালন বা মর্যাদা দিতে হলে আল- কুরআনকে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাঁর বিধানকে সহজ করেছেন; কঠিন করেন নাই।

৪. কুরআন যে মানব জাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে নাযিল করছেন তা যথাযথ উপলব্ধি করে সে মোতাবেক জীবন চলার শপথ নিতে হবে।

৫. 'রমযান, কুরআন, হিদায়াত ও লায়লাতুল কদর' বিষয়গুলো মজবুত ঈমানের সাথে বুঝে শুনে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৬. উল্লেখিত শিক্ষাগুলো পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে ই'তেকাফের গুরুত্বও কম নয়। তাই যথাসাধ্য আত্মগঠন ও তাকওয়া অর্জনের জন্য ই'তেকাফে অংশ গ্রহণের চেষ্টা থাকতে হবে।

দারস সংকলনে:
www.ArmansDiary.com

বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩

যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান | প্রেমরোগের চিকিৎসা | আবদুল হামীদ ফাইযী


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ১

১- প্রেম আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য এক বড় নেয়ামত। তা যথাস্থানে প্রয়োগ করা এক ইবাদত। আর তা অপপ্রয়োগ করা হল গোনাহর কাজ। অর্থাৎ অবৈধ প্রেম হল সচ্চরিত্রতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিবাহের পূর্বে হৃদয়ের আদান-প্রদান বা পছন্দ অথবা ভালোবাসার নামে যুবক-যুবতীর একত্রে ভ্রমণ-বিহার, নির্জনে খোশালাপ, অবাধ মিলামিশা ও দেখা-সাক্ষাৎ, গোপনে চিত্তবিনোদন প্রভৃতি আদর্শ ধর্ম ইসলামে বৈধ নয়। বর্তমান পরিবেশে কেবল সেই যুবকই অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে পারে, যার হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহর ভয় বুকে থাকলে শত বাধা ও বিপত্তির মাঝে চলার পথ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে -এই ভয়ে যে নিজের প্রবৃত্তি দমন করবে, তার ঠিকানা হবে বেহেশ্যে। বরং তার জন্য রয়েছে দুটি বেহেশ্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে থাকলে আল্লাহ বান্দাকে এমন নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে নেন। ঈমানে আল্লাহর প্রতি ইখলাস থাকলে তিনি বান্দাকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) ও যুলাইখার ব্যাপারে তিনি বলেন, “সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন। প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন।” (সূরা ইউসুফ ২৪ আয়াত)

সুতরাং মনের সন্দেহ ও কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হল ঈমান। ঈমান সুদৃঢ় রাখ, কারো অবৈধ ভালোবাসায় ফাসবে না এবং অবৈধ উপায়ে কেউ তোমার মন চুরি করতে পারবে না।

২- প্রেমরোগের সবচেয়ে বড় অব্যর্থ ও আসল ঔষধ হল ধৈর্য ও মনের দৃঢ়-সংকল্পতা এবং সুপুরুষের মত মনের স্থিরতা। ইচ্ছা পাকা থাকলে উপায়ের পথ বড় সহজ। ধৈর্য কঠিন হলেও তার পরিণাম বড় শুভ; যেমন গাছের ছাল তেঁতো হলেও তার ফল ভারি মিষ্টি।মনের খেয়াল-খুশীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়-সংকল্প হও যে, তুমি ঐ শয়তানী কুমন্ত্রণায় সায় দেবে না। শয়তান হল তোমার প্রধান শত্রু এবং এই প্রণয়ের প্রধান দূত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়---।” (সূরা নুর ২১ আয়াত)

অতএব ধৈর্যের সাথে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।

৩- নজর পড়ার সাথে সাথে মনের মানসপটে কোন রূপসীর ছবি অঙ্কিত হয়ে গেলে তার মন্দ দিকটা মনে করো। ভেবো, সে হয়তো আচমকা সুন্দরী, আসলে সুন্দরী নয়। নতুবা বোরকার ভিতরে হয়তো অসুন্দরী। নতুবা ওর হয়তো কোন অসুখ আছে। নতুবা ওর হয়তো বংশ ভালো নয়। নতুবা ওর হয়তো ঘর-বাড়ি ভালো নয়। নতুবা হয়তো ওর সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। নতুবা ও হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না। নতুবা ওর অতীত হয়তো কলঙ্কিত, ইত্যাদি। আঙ্গুর ফল নাগালের মধ্যে না পেলে টক মনে করলে মনে সবুর হয়।

তাছাড়া বেল পাকলে কাকের কি? দেখছ কি ভ্যাভ্যা? যার সরষে তার তেল! তাতে তোমার কাজও নেই, লাভও নেই।

৪- জীবনের প্রথম চাওয়াতে ভালো বলে যাকে তুমি ভালোবেসে মনের কাছে পেয়েছ, সেই তোমাকে ভালোবাসবে এবং সে ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, বা আর কেউ তোমার কদর করবে না এমন ধারণা ভুল। ভালো কে? যার মনে লাগে যে তোমার ঐ লায়লার চেয়ে আরো ভালো লায়লা পেতে পার। সুতরাং বিবাহের মাধ্যমেও প্রেমময়ী ও গুণবতী সঙ্গিনী পাবে। তবে অবৈধভাবে ওর পেছনে কেন?

৫- প্রেম-পাগলা মজনু বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসছ, যে তোমাকে তার চোখের ইশারায় প্রেমের জালে আবদ্ধ করেছে, আজ যাকে তুমি তোমার জানের জান মনে করছ, কাল হয়তো সে তোমার অভাব দেখে, কোন অসুখ দেখে, কোন ব্যবহার দেখে অথবা তোমার চাইতে ভালো আর কোন নাগরের ইশারা দেখে, তোমাকে টা-টা’ দিতে পারে। যে তোমার ইশারায় তার নিজের মা-বাপ, বংশ, মান-সম্ভ্রম প্রভৃতি অমান্য ও পদদলিত করে তোমার কাছে এসে যেতে পারে, সে যে তোমার ও তোমার মা-বাপের মান রাখবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কথাও জেনে রেখো যে, আজ তুমি মারা গেলে কাল সে আবার অন্যকে বিয়ে করে নতুন সংসারের নতুন বউ হবে। সুতরাং এমন প্রেমের প্রতিমার জন্য এত বলিদান কিসের?

প্রেমিক বন্ধু! পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্যময় জিনিস আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বেশী আশ্চর্যময় জিনিস হল মেয়ে মানুষের মন। সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। তাকে জয় করতে বড় পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকেও হিমসিম খেয়ে যায়। সুতরাং তুমি কে? তুমিও হয়তো। একদিন বলতে বাধ্য হবে যে,

এ তুমি আজ সে - তুমি তো নহ, আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী?
কিছু মেরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
---প্রাণ নিয়ে এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দলে অলক্তক পরে এরা পায়!

এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন প্রীতি।
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্থন,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি!
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন,
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন!

বন্ধু আমার যদি তুমি ভাব যে, সব নারী তো আর এক রকম নয়। আমার লায়লা আমাকে ধোকা দেবে না। কিন্তু এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় বন্ধু? তার কি কোন বন্ধনী বা বেষ্টনী আছে? আর একান্তই যদি তোমার ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবৈধ প্রেম খেলে কেন, লুকোচুরি করে ফিসফিসিয়ে কেন, গোপন প্রেম-পত্র লিখে কেন? বরং বৈধ উপায়ে পয়গাম পাঠিয়ে তাকে তোমার প্রণয়-সুত্রে গেঁথে নাও। হালাল উপায়ে তুমি তাকে তোমার জীবনে নিয়ে এস এবং আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করো না।

৬- কোন তরুণীর রূপ দেখেই ধোকা খেয়ো না বন্ধু! প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাই হল একমাত্র বিশ্বসুন্দরী। কিন্তু সে তো আবেগের খেয়াল, বাস্তব নয়। তাছাড়া দ্বীন ও চরিত্র না দেখে কেবল রূপে মজে গেলে সংসার যে সুখের হবে, তা ভেবো না। কারণ, চকচক করলেই সোনা হয় না। কাচ না কাঞ্চন তা যাচাই-বাছাই করা জ্ঞানী মানুষের কাজ। পরন্তু ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব ক’দিনের জন্য? তাই অন্তরের সৌন্দর্য দেখা উচিত। আর সত্যিকারের সে সৌন্দর্য কপালের দুটি চোখ দিয়ে নয়, বরং মন ও জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি দিয়েই দেখা সম্ভব। অতএব সেই মন যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পার তাহলে তুমি ‘ইন্না লিল্লাহ-- পড়। আর জেনে রেখো যে, এমন সৌন্দর্য ও দ্বীন ও গুণের অধিকারিণী রমণী কোন দিন লুকোচুরি করে তোমার সাথে প্রেম করতে আসবে না।

৭- স্ত্রী হল জীবনের চিরসঙ্গিনী। সংসারে যত রকমের সম্পদ ও ধন মানুষ পায়, তার মধ্যে পুণ্যময়ী স্ত্রীই হল সব চাইতে বড় ও শ্রেষ্ঠ ধন। সুখ ও দুঃখের সময় সাথের সাথী এই স্ত্রী। এই স্ত্রী ও সাথী নির্বাচন করতে হলে মনের আবেগ ও উপচীয়মান যৌবনের প্রেম ও কামনা দ্বারা নয়; বরং বিবেক ও মন দ্বারা দ্বীন ও চরিত্র দেখে ভেবে-চিন্তে নির্বাচন করতে হয়। তাহলেই পরিশেষে ঠকতে ও পস্তাতে হয় না।

৮- কারো চোখের অশ্রুর কথা বলছ? তবে জেনে রেখো যে, মেয়েদের চোখ থেকে দু’ রকমের অশ্রু ঝরে থাকে; একটি দুঃখের, অন্যটি ছলনার। আর এটাও তোমার মন ও প্রেমের আবেগ দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞার বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে।

প্রেম-বিহুল বন্ধু আমার পূর্বেই বলেছি, সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। নারীকে ছোট ও দুর্বল ভেবো না। সমুদ্র-উপকূলে দাঁড়িয়ে মহাসমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, ঠিক কোন নারীর ততটুকুই অংশ দেখা সম্ভব হয়। নারী দুয়ে, অজেয় নারীর মন। আর আমার মনে হয় যে, তুমি নিশ্চয়ই দিগবিজয়ী বীর নও।

৯- তুমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, সে ধনীর মেয়ে নয় তো? অর্থাৎ, কোন প্রকারে সে তোমার জীবনে এসে গেলে, তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বাসনা পূর্ণ করে চলতে পারবে তো? যদি তা না হয় তাহলে শোন, দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং প্রেমের নামে নিজের জীবনে বঞ্চনা ও অভিশাপ ডেকে এনো না।

আবার কাউকে শুধু ভালো লাগলেই হয় না। তুমি তার বা তাদের পরিবেশ ও বাড়ির উপযুক্ত কি না, তাও ভেবে দেখ। নচেৎ বাওনের চাদ চাওয়ার মত ব্যাপার হলে শুধু শুধু মনে কষ্ট এনে লাভ কি? তাছাড়া তুমি যদি তোমার শিক্ষা, চরিত্র, ব্যবহার ও সাংসারিক যোগ্যতায় তাদেরকে মুগ্ধ করতে পার, তাহলে গরীব হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। আর তুমিই হবে তাদের যোগ্য জামাই। পক্ষান্তরে লুকোচুরিতে চরিত্র নষ্ট করে থাকলে তুমি তাদের চোখে খারাপ হয়ে যাবে। শেষে আর জামাইও হতে পারবে না।

১০- প্রেম-ভিখারী বন্ধু আমার! প্রেম যদি করতেই চাও তাহলে ক্ষণস্থায়ী এ ঢলন্ত-যৌবনা ফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কেন? অসৎচরিত্রা অসতীদের সাথে কেন? হ্যা, সে অসতী বৈকি? যে তোমার সাথে অবৈধভাবে প্রেম করতে আসে, অবাধ মিলামিশ, দেখা-সাক্ষাৎ, চোখাচোখি, হাসাহাসি করে সে অসতী বৈকি?

সুতরাং প্রেম যদি করতেই হয় তাহলে চিরকুমারী অনন্ত-যৌবনা, অফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কর। কাঞ্চন-বদনা, সুনয়না, আয়তলোচনা, লজ্জা-বিনম্র, প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ, উদ্ভিন্ন-যৌবনা ষােড়শীদের সাথে কর। যে তরুণীরা হবে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা, যারা তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি নজর তুলেও দেখবে না। যে সুরভিতা রূপসীদের কেউ যদি পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি মারে, তাহলে তার ঝলমলে রূপালোকে ও সৌরভে সারা বিশ্বজগৎ আলোকিত ও সুরভিত হয়ে উঠবে। যে সুরমার কেবলমাত্র মাথার ওড়না খানিকে পৃথিবী ও তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও ক্রয় করা সম্ভব হবে না। (বুখারী ৬৫৬৮ নং)।

সুতরাং হালাল উপায়ে বিবাহ কর এবং তার সাথেই প্রেম কর। আর উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে ঐ রূপসীদেরকে বিবাহ করার জন্য দেন-মোহর সংগ্রহ করতে লেগে যাও।

১১- অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে নির্জনতা ত্যাগ কর। কারণ, নির্জনতায় ঐ শ্রেণীর কুবাসনা মনে স্থান পায় বেশী। অতএব সকল অসৎ-চরিত্রের বন্ধু থেকে দুরে থেকে সৎ-বন্ধু গ্রহণ করে বিভিন্ন সৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হও। আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দাও। বিভিন্ন ফলপ্রসু বইপুস্তক পাঠ কর। সম্ভব হলে সে জায়গা একেবারে বর্জন কর, যে জায়গায় পা রাখলে তার সহিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যে তোমার মন চুরি করে রেখেছে। টেলিফোন এলে তার কথার উত্তর দিও না। পত্র এলে জবাব দিও না। তোমার প্রণয়ের ব্যাপারে তাকে আশকারা দিও না। এমন ব্যবহার তাকে প্রদর্শন করো না, যার ফলে সে তোমার প্রতি আশা ও ভরসা করে ফেলতে পারে। বরং পারলে তাকে নসীহত করো এবং এমন অসৎ উপায় বর্জন করতে উপদেশ দিও। তাতে ফল না হলে পরিশেষে ধমক দিয়েও তাকে বিদায় দিও। আর বেকার বসে থেকো না। কোন না কোন কাজে, নিজের কাজ না থাকলে কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা কর।

একা না ঘুমিয়ে কোন আত্মীয়, ভাই বা হিতাকাঙ্খী সৎ-বন্ধুর কাছে ঘুমাবার চেষ্টা কর। রাত্রে ঘুম না এলে যত কুরআন ও শয়নকালের দুআ মুখস্থ আছে শুয়ে শুয়ে সব পড়ে শেষ। করার চেষ্টা কর। 'সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার, আহামদু লিল্লাহ’ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার” ৩৪ বার পাঠ কর। তার পরেও ঘুম না এলে, ঘুম না হলে তোমার কোন ক্ষতি হবে -এমন ভেবো না। অথবা রাত পার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে মনে আক্ষেপ করো না। এমন ভাবলে ও করলে আরো ঘুম আসতে চাইবে না। অতঃপর একান্ত ঘুম যদি নাই আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে নামায পড়তে শুরু কর। এর মাঝে ঘুমের আবেশ পেলে শুয়ে পড়। ঘুম না এলে বিছানায় উল্টাপাল্টা করলে অন্যান্য দুআ পড়ার পর এই দুআ পড়, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্দুস সামাওয়াতি অআরযি অমা বাইনাহুমাল আযীযুল গাফফার।

১২- গান-বাজনা শোনা থেকে দূরে থাক। কারণ, পুর্বেই জেনেছ যে, গানে যুব-মন প্রশান্তি পায় না; বরং মনের আগুনকে দ্বিগুণ করে জ্বালিয়ে তোলে। সুতরাং প্রেমময় মনের দুর্বলতা দূর করতে অধিকাধিক কবর যিয়ারত কর, জানাযায় শরীক হও, মরণকে স্মরণ কর। উলামাদের ওয়ায-মাহফিলে উপস্থিত হও, তাদের বক্তৃতার ক্যাসেট শোন।

১৩- অভিনয় দেখা পরিহার কর। কারণ, ফি-যাত্রা-নাটক-থিয়েটার ইত্যাদি তো প্রেমের আগুনে পেট্রোল ঢালে। আর এ সব এমন জিনিস যে, তাতে থাকে অতিরঞ্জিত প্রেম। অবাস্তব কাল্পনিক প্রেম-কাহিনী ও রোমান্টিক ঘটনাবলী। অতএব সে অভিনয় দেখে তুমি ভাবতে পার যে, তুমিও ঐ হিরোর মত প্রেমিক হতে পারবে, অথবা ঐ হিরোইনের মত তুমিও একজন প্রেমিকা পাবে, অথবা ঐ অভিনীত প্রেম তোমার বাস্তব-জীবনেও ঘটবে। অথচ সে ধারণা তোমার ভুল। পক্ষান্তরে ঐ সকল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গমঞ্চের ধারে-পাশে উপস্থিত হয়ে চিত্তবিনোদন করার মত গুণ আল্লাহর বান্দাদের নয়; বরং প্রবৃত্তির গোলামদের।

১৪- যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাকে কখনো একা নির্জনে কাছে পাওয়ার আশা ও চেষ্টা করো না। ব্যভিচার থেকে দুরে থাকলেও দর্শন ও আলাপনকে ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করো না। জেনে রেখো বন্ধু! যারা মহা অগ্নিকান্ডকে ভয় করে তাদের উচিত, আগুনের ছোট্ট অঙ্গার টুকরাকেও ভয় করা। উচিত নয় ছোট্ট এমন কিছুকে অবজ্ঞা করা, যা হল বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভূমিকা। ছোট্ট মশা নমরুদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছোট ছোট পাখীদল। হস্তিবাহিনী সহ আবরাহাকে ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ছিদ্র একটি বিশাল পানি-জাহাজকে সমুদ্র-তলে ডুবিয়ে দিতে পারে। বিছার কামড়ে সাপ মারা যেতে পারে। সামান্য বিষে মানুষ মারা যায়। ক্ষুদ্র হুদহুদ পাখী বিলকীস রাণীর রাজত্ব ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ইদুর কত শত শহর ভাসিয়ে দিতে পারে বন্যা এনে। আর এ কথাও শুনে থাকবে যে, হাতির কানে নগণ্য পিঁপড়া প্রবেশ করলে অনেক সময় হাতি তার কারণেই মারা যায়।


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ২

১৫- প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চোখ, কান, জিভ, হাত, পা এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের ব্যভিচার সংঘটিত করে অবৈধ পিরীত। প্রিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়া হল পায়ের ব্যভিচার। অতএব প্রেয়সীর প্রতি যে পথে ও পায়ে তুমি চলতে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত নও, সেই পথের উপর তোমার পায়ের নিশানা ও দাগকে কোন দিন ভয় করেছ কি?

ভেবেছ কি যে, তোমার ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক নিশানা সযত্নে হিফাযত করে রাখা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “আমিই মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা ওরা অগ্রে পাঠায় ও পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিসই স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসীন ১২) প্রিয়তমার সাথে খোশালাপ হল জিভের ব্যভিচার। গোপন প্রিয়ার সাথে প্রেম-জীবনের সুমিষ্ট কথার রসালাপ তথা মিলনের স্বাদ বড় তৃপ্তিকর। কিন্তু বন্ধু! এমন সুখ তো ক্ষণিকের জন্য। তাছাড়া এমন সুখ ও স্বাদের কি মূল্য থাকতে পারে, যার পরবর্তীকালে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। যে জিভ নিয়ে তুমি তোমার প্রণয়িণীর সাথে কথা বল, সে জিভের সকল কথা রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে, তা তুমি ভেবে দেখেছ কি? মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের নিকটই আছে।” (সূরা ক্বাফ ৫০ আয়াত)

রসিক নাগর বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে তুমি প্রেমিকার সাথে মিলে যে পাপ করছ, সে পাপ কি ছোট ভেবেছ? ভেবে দেখ, হয়তো তোমাদের মাঝে এমন পাপও ঘটে যেতে পারে, যার। পার্থিব শাস্তি হল একশত কশাঘাত, নচেৎ প্রস্তরাঘাতে খুন। কিন্তু দুনিয়াতে এ শাস্তি থেকে কোন রকমে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আছে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লী। অতএব যে পুকুরের জল খাব না, সে পুকুরের পাড় দিয়ে যাব না’ -এটাই সুপুরুষের দৃঢ়সংকল্প হওয়া উচিত নয় কি? ভেবেছ কি যে, তুমি তোমার ভালোবাসার সাথে যে অবৈধ প্রেমকেলি, প্রমোদ-বিহার করছ, তা ভিডিও-রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রীতির স্মৃতি রাখতে গিয়ে অনেক সময় যে ছবি তোমরা অবৈধ ও অশ্লীলভাবে তুলে রাখছ, তা একদিন ফাস হয়ে যাবে।

এ সব কিছুই মানুষের চোখে ফাকি দিয়ে করলেও কাল কিয়ামতে তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে। “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত) এবং তার যথার্থ প্রতিদানও পাবে। প্রেম-সুখী বন্ধু আমার! যে মাটির উপর তুমি ঐ অশ্লীলতা প্রেমের নামে করছ, সেই মাটি তোমার গোপন ভেদ গ্রামোফোন রেকর্ডের মত রেকর্ড করে রাখছে। কাল কিয়ামতে সে তা প্রকাশ করে দেবে। পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (ঐ ৪ আয়াত)

বন্ধু আমার। তুমি হয়তো তোমার ঐ প্রেমকেলিতে মানুষকে ভয় করছ, মা-বাপকে লজ্জা করছ। কিন্তু সদাজাগ্রত সেই সর্বস্রষ্টাকে লজ্জা ও ভয় করেছ কি? যে স্রষ্টা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ তোমার দেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার তৈরী দেহকে তারই অবাধ্যাচরণে ব্যবহার করছ। এ কথা তো তুমি বিশ্বাস কর যে, আমাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দান। আমাদের ব্যবহারের জন্য তিনি আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথাস্থানে স্থাপন করে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিয়ামতে যখন আমরা আমাদের স্বকৃত পাপের কথা ভয়ে অস্বীকার করে বসব, তখন ঐ অঙ্গসমূহ কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাক্ষি দেবে। (সূরা ইয়াসীন ৬৫ আয়াত)

সুতরাং এ দেহ আল্লাহর মালিকানায়, আমাদের মালিকানায় নয়। এ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যদি তার অবাধ্যাচরণ ও বিরোধিতায় প্রয়োগ করি তাহলে তার চেয়ে বড় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে তার ইবাদত করার জন্য পাঠালেন দুনিয়াতে এবং তার মহা প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন আখেরাতে। কিন্তু বান্দা যদি সেই প্রতিশ্রুতির কথা, আখেরাত ও মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াই সর্বশেষ মনে করে, তবে নিশ্চয়ই তা লজ্জার কথা। এ জন্যই মহানবী %ি বলেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা তো -আলহামদু লিল্লাহ- আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি। তিনি বললেন, “না ঐরূপ নয়।

আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান)কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (লিঙ্গ, হাত, পা ও হৃদয়)কে (তার অবাধ্যাচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সব কিছু করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” (সহীহ তিরমিযী ২০০০ নং)

ভেবেছ কি বন্ধু! তোমার চোখ, কান, হাত, পা এবং শরীরের চামড়া পর্যন্ত কাল কিয়ামত কোর্টে আল্লাহর সামনে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে? কুরআন বলে, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকট পৌছবে, তখন ওদের চোখ, কান ও ত্বক ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে---” (সূরা ফুসিলাত ২০ আয়াত) “যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিভ, তাদের হাত ও তাদের পা, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (সূর নুর ২৪ আয়াত)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে ভয়ে নতজান হতে দেখবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার । আমলনামা (কর্মলিপি) দেখতে আহ্বান করা হবে। আর বলা হবে, তোমরা যা করতে আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। আমার নিকট সংরক্ষিত এই আমলনামা, যা সত্যভাবে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম।” (সূরা জাসিয়াহ ২৭-২৯ আয়াত) “ওরা কি মনে করে যে, আমি ওদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশ্তাগণ তো ওদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৮০ আয়াত)

গোপন-প্রেমিক বন্ধু আমার! ভালোবাসার নামে একজন উদাসীনা তরুণীকে গোপনে তার পিত্রালয় থেকে বের করে এনে কোন জায়গায় কোন মুন্সীকে ৫০/ ১০০ টাকা দিয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘরের বউ করে তুলে আনলে, সে যে তোমার জন্য হালাল হবে না, তা তুমি জান কি? মহানবী ৪ বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই নিজে নিজে বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ৩১৩১নং)।

অর্থাৎ, ঐ বউ নিয়ে সংসার করলে চির জীবন ব্যভিচার করা হবে। যেমন ব্যভিচার হবে স্ত্রী থাকতে আপন শালীর প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে তাকেও বউ করে ঘরে আনলে। যেমন দারুণ স্পর্শকাতর ঢাকঢাক গুড়গুড়’ পরিস্থিতিতে প্রিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করা অবস্থায় গোপনে চটপট লজ্জা ঢাকার জন্য বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হলেও তাকে নিয়ে সংসার বৈধ নয়। কারণ, বিবাহের পূর্বে বর-কনেকে ‘কোর্টশীপ বা হৃদয়ের আদান-প্রদানের কোন সুযোগ ইসলাম দেয়নি। আর সেক্সী কোন টেস্ট-পরীক্ষা তো নয়ই। অবশ্য উভয়ের জন্য একে অপরকে কেবল দেখে নেওয়ার অনুমতি আছে। তাছাড়া মহিলার গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ হয় না। সন্তান-প্রসবের পরই বিবাহ সম্ভব; যদিও সন্তান ঐ প্রেমিকেরই, যার সহিত প্রেমিকার বিবাহ হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে বিবাহ ও তালাককে এক প্রকার খেলা’ মনে করা হলেও, আসলে তা কিন্তু ঐ ধরনের কোন খেলা’ নয়।

সুতরাং নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োগ করতে চাইলে আল্লাহর বিধানে তা বাতিল গণ্য হবে। জেনে রাখা ভালো যে, জোরপূর্বক কোন তরুণীকে বিবাহ করলে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। যেমন কারো বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবেসে তুলে এনে তার সম্মতিক্রমে হলেও পূর্ব স্বামী তালাক না। দেওয়া পর্যন্ত এবং তার অভিভাবক সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত বিবাহ শুদ্ধ হয় না। তাকে নিয়ে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এ ছাড়া ভাইঝি, বোনঝি, সৎ মা, শাশুড়ী প্রভৃতি এগানা নারীর সাথে প্রেম ও ব্যভিচার করা সবচেয়ে বড় পশুত্ব! ১৬- কুলকুল-তান যৌবনের যুবক বন্ধু আমার! যদি কাউকে ভালো লেগেই যায়, তাহলে হালাল ও বিধেয় উপায়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা কর। আর ভেবো না যে, প্রেম করে বিয়ে বেশী সুখময়। বরং বিয়ে করলেই দায়িত্ববোধের সাথে প্রেমের চেতনা অধিক বাড়ে। এ পবিত্র প্রেমে কোন প্রকার ধোকা থাকে না, থাকে না কোন প্রকার অভিনয় ও কপটতা। যে নির্মল প্রেমে থাকে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। আর এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী # বলেন, “প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য বিবাহের মত অন্য কিছু (বিকল্প) নেই।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫২০০ নং)

অতএব প্রেম প্রকাশ ও বৃদ্ধি করা জন্য, প্রেমের ডালি খালি করার জন্য, প্রেম অনির্বাণ রাখার জন্য, প্রেম-রোগ উপশম করার জন্য, পবিত্র বিবাহ-বন্ধনের মত আর অন্য কোন বিকল্প গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহর কাছে দুআ করে গোপনে তোমার মানুষটিকে চেয়ে নাও এবং তাঁর নিকট হারামকারিতা থেকে শতবার পানাহ চাও। আর উপযুক্ত লোক লাগিয়ে বৈধ উপায়ে তাকে তোমার জীবন-সঙ্গিনী করে নাও। যে রতি হয়ে তোমার মনে এসেছিল, তাকে সতী হয়ে তোমার ঘরে আসতে দাও। যে প্রিয়া হয়ে প্রেমে ছিল, সে বধু হয়ে তোমার অধরে আসুক। যে তোমার দ্রাক্ষা-বুকে শিরীন-শারাব’ হয়ে এতদিন গোপনে লুকিয়ে ছিল, সে এবার প্রকাশ্যে তোমার পেয়ালায় এসে যাক।

কিন্তু একান্তই তোমার আশা যদি দুরাশা হয়ে থাকে, তুমি যেমন পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতে বড় যদি চাওয়া হয়ে থাকে, অথবা অন্য কোন কারণে যদি তুমি তোমার গোপন প্রিয়াকে তোমার জীবন-তরীতে না-ই পেয়ে থাক, তাহলে দুঃখ করো না। নিশ্চয়ই তাতে তোমার কোন মঙ্গল আছেই আছে, তাই তুমি তাকে পাওনি৷ অতএব এ ক্ষেত্রে তাকে মনে চাপা দেওয়ার জন্য খোজ করে তার চেয়ে বা তারই মত একজন (দ্বীনদার) সুন্দরীকে তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে ফেল। এটাই তোমার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য উত্তম। এতে তোমার পূর্ব নেশা কেটে যাবে, মন স্থির হয়ে সংসার সুখের হবে এবং ফাটা ও কাটা মনে

প্রলেপ পড়বে। আর বিবাহ যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে অবৈধ প্রণয় ও যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করতে আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর। ইনশাআল্লাহ, তোমার মনের সকল অঅসা’ দুর হয়ে যাবে, কারণ, রোযা হল তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির কারখানা।

নারী-পাগলা বন্ধু আমার! পুরুষের পক্ষে নারীর ফিতনার মত বড় ফিতনা আর অন্য কিছু নেই। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।” (আহমাদ, বুখারী ৫০ ৯৬, মুসলিম ২৭৪০ নৎ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) নারী-ঘটিত ফিতনা অথবা নারীকে কেন্দ্র করে ঘটিত ফিতনার হার এ জগতে কম নয়। আর এই ফিতনায় পুরুষের ধন যায়, জ্ঞান হারায়, মান হারায়, দ্বীন হারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণও হারায়। তাই তো মহানবী (সা.) পুরুষকে সাবধান করে বলেন, “অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।” (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০ নং)

শয়তানের যেমন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে, পুরুষের ব্যাপারে নারীরও বিভিন্ন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উভয়ের চক্রান্তের কথা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিতাড়িত শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশলের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, “নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা ৭৬ আয়াত) পক্ষান্তরে নারীর কৌশল ও ছলনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তোমাদের ছলনা ভীষণ!” (সূরা ইউসুফ ২৮ আয়াত)

সুতরাং জ্ঞানী বন্ধু! সাবধান থেকো। শয়তান ও নারীর চক্রান্ত-জালে ফেঁসে গিয়ে নিজের দ্বীনদুনিয়া বরবাদ করে দিও না। কেউ যদি তোমার কাছে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়, তবে সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার ছলনায় সাড়া দিও না। আর মনে রেখো যে, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,) ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।

সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম ১০৩১নং) ছলনাময়ী নারীর চক্রান্তে যাতে না পড়, তার জন্য বাংলা প্রবাদেও সতর্কবাণী এসেছে, তা মনে রেখো, কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো ঢেমনের বোলে। ঠিকই তো বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি। আর তাছাড়া জলের রেখা, খলের পিরীত’ থাকেও না বেশীক্ষণ। এ ধরনের চক্রান্তময় প্রেমে থাকে এক প্রকার সুড়সুড়ি, এক ধরনের স্বার্থ। যা শেষ হলে সব শেষ। সুতরাং মনে রেখো বন্ধু আমার! ‘জল-জঙ্গলনারী, এ তিনে বিশ্বাস নাই, বড়ই মন্দকারী।

নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এবং অনেকে নারীকে সামান্য জ্ঞান করলেও আসলে মনের দিক দিয়ে নারী বিশাল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হল নারীর মন। সুবিস্তৃত মেঘমালা এবং ক্ষিপ্রপামী বাতাসের গতিবেগ হয়তো নির্ণয় করা সহজ; কিন্তু নারীর মনের গতিবেগ নির্ণয় করা মোটেই সহজ নয়। তা মাপা বা অনুমান করা আদৌ আসান নয়। আর এ জন্যই অনেকে সরল মনে নারীর ছলনার গরল পান করে ধোকা খায়।

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া।

অতএব বন্ধু আমার! এমন নারীর ছলনা থেকে বাঁচার জন্য, এমন নারীর ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য তুমি হযরত ইউসুফ নবী (আঃ) এর মত দুআ কর,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ

অর্থাৎ, হে পরোয়ারদেগার! ওরা আমাকে যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করছে, তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি আমাকে ওদের ছলনা হতে রক্ষা না কর, তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা ইউসুফ ৩৩)।

মানুষের মন হল ফাকা ময়দানে পড়ে থাকা এক টুকরা হাল্কা পালকের মত। বাতাসের সামান্য দোলায় সে মন দুলতে থাকে, হিলতে থাকে, ছুটতে থাকে। মন হল পরিবর্তনশীল। সে মন থাকে আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে। তিনি মানুষের মন ঘুরিয়ে ও ফিরিয়ে থাকেন। অতএব এ বলেও দুআ করো তার কাছে,

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
অর্থাৎ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।

-কপিরাইট: আবদুল হামীদ ফাইযী 

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দারসুল হাদীস: হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

দারসুল হাদীস: 
হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. বর্ণিত নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত হাদীস

আরবী ইবারতঃ

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ابْن سَمُرَةَ (رض) قَالَ قَالَ لِي رَسُوْلُ اللَّهِ (صلعم) لَا تَسْئل الْإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا عَنْ مُسْئَلَةٍ وكُلَتْ إِلَيْهَا وَإِنْ أَعْطِيتَهَا عَنْ غَيْر مَسْئَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا. (بخاری، مسلم)

বাংলা অনুবাদঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) আমাকে বললেন : তুমি নেতৃত্বের পদপ্রার্থী হবে না । কারণ, তুমি যদি তা চেয়ে নাও তবে তোমাকে ঐ পদের বোঝা দেয়া হবে (দায়িত্ব পালনে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না)। আর যদি প্ৰাৰ্থনা ছাড়াই তোমাকে ঐ পদ দেয়া হয়, তবে তুমি ঐ পদের দায়িত্ব পালনে (আল্লাহর) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারী, মুসলিম)


শব্দার্থঃ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ ابْنِ سَمُرَةَ (رض) : হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। قَالَ : সে বলল। لِي : আমাকে । لَا تَسْئل : তুমি চেয়ে নেবে না। الْإِمَارَةَ : নেতৃত্ব। فَإِنَّكَ إِنْ أَعْطِيْتَهَا : নিশ্চয়ই তোমাকে উহা দেয়া হবে। عَنْ مَّسْئَلَةٍ : তুমি চাওয়ার কারণে । وَكَلَتْ إِلَيْهَا : তোমাকে ঐ পদের বোঝা চাপানো হবে। غَيْر مَسْئَلَةٍ : প্রার্থনা ব্যতীত। ُعِنْتَ عَلَيْهَا : তাতে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে ।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদ' আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত সিহাহ সিত্তা' বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয় । এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহ্ আল-বুখারী'।
☆সহীহ্ আল-বুখারী: 
ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু’ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন । তিনি নিজেই বলেন : “তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী ।
☆সহীহ্ আল-মুসলিম:
সহীহ্ আল-মুসলিম গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ইমাম মুসলিম (র), যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুরে ২০৪ হিজরী ২৪শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ২১৮ হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি হিজায, ইরাক, মিশর, বাগদাদ, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম জাহানের ইলম শিক্ষার কেন্দ্রভূমিসমূহে ভ্রমণ করেন। তিনি সে কালের জ্ঞানসাগর ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ইমাম মুসলিম (র) সরাসরি ওস্তাদগণের থেকে শ্রুত তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে (তাহযীবুল আসমা ১০ম খণ্ড) দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা ও গবেষণা করে এ শ্রেষ্ঠ গ্রন্থখানি সংকলন করেন । এতে তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০ । তাকরার বাদে হাদীস সংখ্যা ৪,০০০ মাত্র। (তাদরীবুর রাবী) সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থকে বিশুদ্ধ ও অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ প্রায় বার শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সহীহ্ মুসলিমের সমমানের কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি।
বুখারী ও মুসলিম শরীফকে একত্রে ‘সহীহাইন’ বলা হয়।

রাবী পরিচিতিঃ

হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা)। নাম : আবদুর রহমান । পিতার নাম : সামুরা। নসবনামা : আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীব ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কুসাই । কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল আবদুল কাবা । ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা) তার নাম রাখেন আবদুর রহমান । তিনি ছিলেন একজন আরব সেনাপতি । ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। খলীফা উসমানের (রা) খিলাফতকালের পরবর্তী বছরগুলোতে সিজিস্তানে সর্বপ্রথম সেনাপতিরূপে নিযুক্ত হন। তিনি দক্ষতার সাথে যারাজ ও যামীন-ই দাওয়ার জয় করেন এবং কিরমান এর শাসনকর্তার সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁকে সিজিস্তানের শাসনভার অর্পণ করা হয় । আমীর মুয়াবিয়া (রা) যিয়াদকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করার পর আবদুর রহমান ইবনে সামুরাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করেন। তিনি ফিরে আসেন এবং ৬৭০ সালে বসরায় ইনতিকাল করেন । পরবর্তীকালে তার বংশধরগণ বসরায় একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গোত্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । (আল-বালাযুরী ফুতহুল বুলদান )

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কারণ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার মত খারাপ প্রবণতা লোভ থেকে সৃষ্টি হয়। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যেই রাসূল (সা) বলেছেন, নেতৃত্ব চেয়ে নিলে তাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়া যায় না। আর আল্লাহর রহমত ও সাহায্য ছাড়া কোন কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । সাধারণ কাজের চেয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব বেশী কঠিন। প্রার্থনা ব্যতীত যে নেতৃত্ব লাভ হয়, তাতে আল্লাহর রহমত থাকে । সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালা এই নেতাকে সাহায্য করেন, ফলে সহজেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (সা) পদপ্রার্থীদেরকে কোন পদের উপযুক্ত মনে করতেন না এবং তাদেরকে সে পদে অধিষ্ঠিত করতেন না। এ সত্যতা আমরা নাসায়ী শরীফের একটি হাদীসে দেখতে পাই যা হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-এর নিকট আগমন করি, আমার সাথে আশয়ারী গোত্রের দু'ব্যক্তি ছিলেন। তারা রাসূলের (সা)-এর নিকট রাষ্ট্রীয় পদে চাকুরী প্রার্থনা করেন, কিন্তু রাসূল (সা) তাদেরকে বলে দেন, যারা নিজেরা রাষ্ট্রীয় পদের নেতৃত্ব চায় তাদেরকে আমরা নেতৃত্ব দেই না বা নেতৃত্ব লাভে সাহায্যও করি না । অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে ইয়ামেনে গভর্নর করে পাঠালেন অপর আর একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেন :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) تَجِدُونَ مِنْ خَيْرٍ النَّاسِ أَشَدُّهُمْ كَرَاهِيَةً لِهَذَا الْأمْر حَتَّى يَقَعَ فِيْهِ. (بخاری، مسلم)
“হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন : “যারা পদকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে । অতঃপর যখন তাতে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তোমরা তাদেরকে সর্বোত্তম লোক হিসেবে পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)

ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের পরিবর্তনঃ

প্রত্যেক মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর তাদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা ফরয। এ প্রসঙ্গে ইমাম জুরযানী বলেন :
أَنْ نَصَبَ الْإِمَامِ مِنْ آتِمِّ مَصَالِحِ الْمُسْلِمِينَ وَاعْظَمِ مَقَاصِدِ الدِّينِ. “ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের পূর্ণতম ব্যবস্থা এবং দীন ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে সর্বাধিক মাত্রায় বাস্তবায়ন।”

আকাইদে নাসাফী গ্রন্থকার বলেন :
“মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য একজন ইমাম অবশ্যই থাকতে হবে। ইহা অপরিহার্য। তিনি আইন কানুনসমূহ কার্যকর করবেন, শরীয়ত নির্দিষ্ট হৃদ জারি করবেন, বিপদ-আপদের সকল দিক বন্ধ করবেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বন্ধের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত ও সদা প্রস্তুত করে রাখবেন। যাকাত গ্রহণ ও বণ্টন করবেন, বিদ্রোহী, দুষ্কৃতিকারী, চোর, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের কঠিন শাসন ও দমন করবেন। জুম'আ ও ঈদের সালাতসমূহ কায়েম করবেন, লোকদের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করবেন। মানুষের অধিকার প্রমাণের জন্য (বিচার ব্যবস্থা চালু করবেন সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন দুর্বল, অক্ষম বালক- বালিকাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। (আকাঈদে নাসাফীঃ ৩৩৮ পৃঃ)

অসৎ নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা ।
هِيَ خِلافَةُ الرَّسُوْل فِي إِقَامَةِ الدِّيْنِ.
“নেতৃত্ব হলো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারিত্ব।” (কিতাবুল মাওয়াকিফ)
আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা, উহার প্রচার ও প্রসার এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাই সমাজের লোকদেরকে সুসংগঠিত হয়ে অসৎ ও খোদা বিমুখ লোকদের নেতৃত্বকে উৎখাত করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে ঈমানদার, খোদাভীরু ও যোগ্য লোকদের হাতে সে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। যখন সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তখন তোমাদেরকে আল্লাহর দীনের উপর অটল থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী :
فَاصْبِرْ لِحُكُم رَبِّكَ وَلاَ تُطِعْ مِنْهُمْ اثِمًا أَوْكَفُورًا. 
“অতঃপর তোমার প্রভুর হুকুম, নির্দেশ ও কর্তৃত্বের উপর অটল, অবিচল হয়ে থাকো, আর তাদের কোন এক একজন পাপিষ্ঠ অবিশ্বাসীর আনুগত্য ও করো না । (সূরা-আদ্-দাহার : ২৪)

اِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْآمَنَتِ إِلَى أَهْلِهَا.
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সূরা-আন্ নিসা : ৫৮)

এ আয়াতের তাফসীরে মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) বলেন : রাষ্ট্রীয় যত পদ ও মর্যাদা আছে, সবই আল্লাহর আমানত । এসব পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা আমানতদার। রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের জন্যে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করা অবশ্য কর্তব্য। রাষ্টীয় পদের সাথে জনগণের অধিকার জড়িত, তাই সেটাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। এসব আমানতের অধিকারী সেসব লোক যারা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সমর্থনের দিক থেকে সর্বোত্তম, আর বিশ্বস্ততা ও রাষ্ট্রীয় আমানত রক্ষার দিক থেকে অগ্রগণ্য । এদের ছাড়া কাউকে রাষ্ট্রীয় আমানত অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।” (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট)

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র) বলেন : “বনি ঈসরাঈল সম্প্রদায়ের একটি বড় অপরাধ ছিল তারা তাদের পতনের যুগে দায়িত্বপূর্ণ পদ অযোগ্য, অসৎ, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খিয়ানতকারী ও ব্যভিচারী লোকদের হাতে অর্পণ করেছিল। আর এসব অসৎ নেতৃত্বের কারণে গোটা জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল । (সংক্ষিপ্ত)

অথচ আল্লাহর আদেশ হচ্ছে, “এমন লোকের (নেতৃত্ব) আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে এবং যার কার্যক্রম উগ্র ও উদাসীন।” (সূরা আল-কাহাফ ২৮)

এ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যোগ্য লোকদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা ফরয। আর এ জন্যই অসৎ নেতৃত্ব উৎখাত করে, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়া অপরিহার্য।

অনৈসলামিক রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচনঃ

যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কোন ইসলামী দল দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ভোট প্রার্থনা করলে তা জায়েয ৷ কারণ, ইহা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অংশ বিশেষ । আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য যখন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে করলে তাতে কোন দোষ নেই । তাছাড়া জনগণের সামনে না আসলে কি করে সৎ ও অসৎ নেতৃত্বের পার্থক্য বুঝতে পারবে । আল্লাহর বাণী : “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে শক্ত হয়ে দাড়াও, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে দাড়াও।” (সূরা-নিসা : ১৩৫) “হযরত ইউসুফ (আ) বললেন, আমাকে দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল বানিয়ে দাও, আমি অধিক সংরক্ষণকারী ও বিষয়টি সম্পর্কে আমি অধিক অবহিত। (সূরা ইউসুফ : ৫৫)

ইহা এক প্রকার জিহাদ যাকে ভোটের জিহাদ বা ভোট যুদ্ধ বলে । এ জিহাদে প্রার্থী হয়ে এবং ভোট দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে । যার উদ্দেশ্য হবে- !
مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةَ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيْلِ اللهِ.
“যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে।” (বুখারী)
কুরআন হাদীসের এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া একান্ত জরুরী। রাসূল (সা) মদীনায় রাষ্ট্র প্রধান হওয়ায় এবং দেশের সকল কর্তৃত্ব তাঁর হাতে থাকায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। আর খুলাফায়ে রাশেদা ও তাঁর পদাংক অনুসরণ করেন ।

নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাঃ

যে কোন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দেশ পরিচালনা কিংবা আইন প্রবর্তনের জন্যে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা হলে আল্লাহ তা'য়ালার আইন বাস্তবায়ন ও রাসূল (সা)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু ও আমানতদার লোকদেরকে নির্বাচিত করার জন্য ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। যদিও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় তথাপি মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতিকে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট, মুফতী মুহাম্মদ শফী র.)

ইসলামী দলে নেতা নির্বাচনঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজেকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার কারো নেই। সেভাবেই ইসলামী দলেও কোন পদের জন্য প্রার্থী হওয়া যায় না। কিন্তু পদের জন্য অন্য কোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা জায়েয। তাতে নিজের লোভের কোন প্রকাশ থাকে না। ব্যক্তির নিজের প্রার্থী হওয়ার অর্থ হলো নিজেকে বড় মনে করা, যা ইসলামে না জায়েয। কিন্তু দলের পক্ষ হতে ইসলামী সংগঠনের নেতাকে ঐ গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের কর্মীগণ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সে দায়িত্ব পালন করা ফরয। ইসলামী দল কোন ব্যক্তিকে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন অথবা মনোনীত করলে সে ক্ষেত্রে তার আপত্তি করার কোন সুযোগ থাকবে না এবং দুর্বলতাও প্রদর্শন করা যাবে না । তখন দলের দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য ।

ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদের নাম নয়, ইহা দায়িত্বের নাম। কাজেই দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ববান লোক নিয়োগ করা জরুরী । এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন : “লোকদের ইমাম বা নেতা হবেন সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান সবচেয়ে বেশী রাখেন, এ ব্যাপারে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম হবেন, যদি এ বিষয়েও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সকলের আগে হিজরত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সমান হলে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি ইমামতি করবেন। কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির প্রভাবাধীন এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

বুঝা গেল রাষ্ট্র প্রধানকে
১ । নামাযের ইমামতি করার যোগ্যতা থাকতে হবে ।
২। কুরআনের জ্ঞান থাকতে হবে।
৩। সুন্নাহ তথা ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে ।
৪ । হিজরতে অগ্রগামী অর্থাৎ নির্দেশ পালনে অগ্রসর হতে হবে ।
৫। বয়সে প্রবীণ হতে হবে ।

শরীয়তে নামায ও রাষ্ট্রীয় ইমামতিতে একই গুণাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। নামাযের ইমামতি রাষ্ট্রীয় ইমামতির প্রশিক্ষণ দেয়। এ কারণেই ইসলামী সংগঠন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের জন্যে নিম্নের গুণাবলীকে প্রাধান্য দেয় ।
১. দীনি ইলম অর্থাৎ সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। যার ইসলামী সংগঠন পরিচালনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে ।
২. খোদাভীরু অর্থাৎ তাকওয়াবান । যিনি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেন।
৩. রাসূলের আনুগত্য অর্থাৎ সুন্নাহ মোতাবেক সার্বিক কাজ পরিচালনা করবেন ।
৪. আমানতদার অর্থাৎ যিনি হবেন সকল কাজের ও সম্পদের আমানত রক্ষায় সচেষ্ট ব্যক্তি
৫. উন্নত আমল অর্থাৎ তাঁর আমল-আখলাক হবে সবচেয়ে উন্নত ও অনুসরণীয় ।
৬. অনড় মনোবল অর্থাৎ কাপুরুষ, ভীরু নয়; অনড় মনোবলের অধিকারী।
৭. কর্মে দৃঢ়তা অর্থাৎ যার কর্মে দৃঢ়তা আছে, যিনি অস্থিরতা ও হীনমন্যতায় ভোগেন না ।
তাছাড়া যিনি সাহসী, পরিশ্রমী, ইনসাফগার, ধৈর্যশীল, পরামর্শ গ্রহণের ও জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিশ্লেষণ শক্তি, উদ্ভাবন শক্তি, প্রশস্ত চিত্ততা, সুন্দর ব্যবহার, মেজাজের ভারসাম্য, সাংগঠনিক প্ৰজ্ঞা ও সাংগঠনিক শৃংখলা বিধানের যোগ্যতা রাখেন ।

দারসের শিক্ষাঃ

১। ইসলামী রাষ্ট্র বা দলে পদ প্রার্থী হওয়া যায় না ।
২। কোন পদের জন্য লালায়িত হওয়া উক্ত পদের জন্য অযোগ্যতার শামিল ।
৩। কোন পদ জবর দখল করলে তাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে না ।
৪। জনগণের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে তা পালন করা কর্তব্য।
৫। না চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে।