Close

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২২

দারসুল কোরআন: সুরা হা-মীম আস্-সাজদাহ ৩০-৩৬ নং আয়াত

দারসুল কোরআন, সুরা হা-মীম আস-সাজদাহ ৩০-৩৬ নং আয়াত


৪১. সূরা হামীম আস্-সাজদাহ
মক্কায় অবতীর্ণ । আয়াত-৫৪, রুকু-৬
আলোচ্য: ৩০-৩৬ নং আয়াত ৷

بسم الله الرحمن الرحيم

إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَبْشِرُوا۟ بِٱلْجَنَّةِ ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ ٣٠ نَحْنُ أَوْلِيَآؤُكُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَفِى ٱلْـَٔاخِرَةِ ۖ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِىٓ أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ ٣١ نُزُلًۭا مِّنْ غَفُورٍۢ رَّحِيمٍۢ ٣٢ وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًۭا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَـٰلِحًۭا وَقَالَ إِنَّنِى مِنَ ٱلْمُسْلِمِينَ ٣٣ وَلَا تَسْتَوِى ٱلْحَسَنَةُ وَلَا ٱلسَّيِّئَةُ ۚ ٱدْفَعْ بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِى بَيْنَكَ وَبَيْنَهُۥ عَدَٰوَةٌۭ كَأَنَّهُۥ وَلِىٌّ حَمِيمٌۭ ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُوا۟ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍۢ ٣٥ وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ٱلشَّيْطَـٰنِ نَزْغٌۭ فَٱسْتَعِذْ بِٱللَّهِ ۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ ٣٦

সরল অনুবাদ : (৩০) “যারা ঘোষণা দিয়েছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতঃপর দৃঢ়ভাবে স্থির থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল হয় এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশী হও, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (৩১) আমরা এ দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাইবে তাই পাবে আর যে জিনিসের ফরমায়েশ করবে তাই লাভ করবে। (৩২) এটা মেহমানদারি ক্ষমাশীল ও দয়াবান আল্লাহর পক্ষ থেকে। (৩৩) সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎকাজ করলো এবং ঘোষণা দিল, আমি মুসলমান। (৩৪) উত্তম কাজ ও মন্দ কাজ সমান নয়। মন্দ প্রতিহত করো সবচেয়ে উত্তম দ্বারা। তাহলে দেখবে, যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। (৩৫) ধৈর্যশীল ব্যতীত এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ব্যতীত এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না। (৩৬) যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পার তাহলে আল্লাহর আশ্রয় কামনা কর। তিনি সবকিছু শোনেন এবং জানেন।”

নামকরণ: দু'টি শব্দযোগে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। একটি (হা-মীম) অপরটি (আস সাজদাহ। অর্থাৎ (হা-মীম) শব্দ দিয়ে এ সূরা শুরু হয়েছে এবং এ সূরার ৩৭ নং আয়াতে এক স্থানে সিজদার আয়াত আছে । এই সুরার আরো একটি নাম হলো ’ফুসসিলাত‘।

নাযিল হওয়ার সময়কাল : নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত অনুসারে এ সূরা নাযিল হওয়ার সময়কাল হচ্ছে, হযরত হামযা (রা)-র ঈমান আনার পর এবং হযরত উমর (রা)-এর ঈমান আনার পূর্বে। নবী (সা)-এর প্রাচীনতম জীবনীকার মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইবনে কা'ব আল-কুরাযীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, একদা কুরাইশ নেতারা মসজিদে হারামে একত্র হয়ে আসর জমিয়ে বসেছিল এবং মসজিদের অন্য এক কোণে রাসূলুল্লাহ (সা) একাকী বসেছিলেন। এটা এমন এক সময়ের ঘটনা যখন হযরত হামযা (রা) ঈমান গ্রহণ করেছিলেন। কুরাইশরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের সাংগঠনিক উন্নতি দেখে অস্থির হয়ে উঠছিল। এ সময় উতবা ইবনে রাবিয়া (আবু সুফিয়ানের শ্বশুর) কুরাইশ নেতাদের বললেন : ভাইসব! আপনারা যদি মত দেন তাহলে আমি মুহাম্মাদ (সা)-এর সাথে আলাপ করে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করতে পারি। সে যদি কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেয় তবে আমাদের নিকটও তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আর এভাবে সে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে । উপস্থিত সবাই তার সাথে একমত হলো। উতবা উঠে নবী (সা)-এর কাছে গিয়ে বসলো। নবী (সা) তার দিকে ফিরে বসলে সে বললো, ভাজিতা! বংশ ও গোত্রের বিচারে তোমার কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা তা তুমি অবগত আছ। কিন্তু তুমি তোমার কওমকে এক মসিবতের মধ্যে ফেলেছ। তুমি কওমের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছ। গোটা কওমকে নির্বোধ প্ৰতিপন্ন করেছ। কওমের ধর্ম ও তাদের উপাস্যদের সমালোচনা করছ এবং এমন কথা বলতে শুরু করেছ যে আমাদের বাপ-দাদারা নাকি কাফের ছিল । এখন আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। আমি তোমার কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখছি, তা তুমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ। হয়তো তার কোনটি তুমি গ্রহণ করতে পার কিনা?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে আবুল ওয়ালিদ, আপনি বলুন, আমি শুনবো ।
সে বললো:
১। ভাতিজা! তুমি যে কাজ শুরু করেছ তা দিয়ে সম্পদ অর্জন যদি তোমার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে এতো সম্পদ দেব যে, তুমি আমাদের মধ্যে সবার চেয়ে সম্পদশালী হয়ে যাবে ।
২। তুমি যদি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করে থাকো তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দিচ্ছি, তোমাকে ব্যতীত কোন বিষয়ে ফায়সালা করবো না ।
৩। যদি তুমি বাদশাহী চাও তাহলে আমরা তোমাকে বাদশা বানিয়ে দেবো ৷
৪ । আর যদি তোমাকে কোন জিনে আছর করে থাকে তাহলে আমরা ভাল ভাল চিকিৎসক ডেকে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি
৫। যদি তোমার কোন সুন্দরী নারীর প্রয়োজন মনে কর তাহলে আমরা তোমাকে দেশের সেরা সুন্দরী জোগাড় করে দেবো ।

উতবা বলছিল আর নবী করীম (সা) চুপচাপ তার কথা শুনছিলেন । অতঃপর তিনি বললেন : তাহলে এখন আমার কথা শুনুন। এরপর তিনি বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম পড়ে এই সূরা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। উতবা তার দুই হাত পেছনের দিকে মাটিতে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে থাকলো। সিজদার ৩৮ নং আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করে তিনি সিজদা করলেন এবং মাথা তুলে বললেন : “হে আবুল ওয়ালীদ! আমার জবাবও আপনি পেয়ে গেলেন। এখন যা ইচ্ছা করুন।”

উতবা উঠে কুরাইশ নেতাদের আসরের দিকে অগ্রসর হলে লোকজন দূর থেকে তাকে দেখেই বললো, আল্লাহর শপথ! উতবার চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে । যে চেহারা নিয়ে সে গিয়েছিল এটা সেই চেহারা নয়। সে এসে বসলে লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, কি শুনে এলে? সে বলোল, “আল্লাহর কসম! আমি এমন কথা শুনেছি যা এর আগে কখনও শুনিনি । আল্লাহর কসম! এটা না কবিতা, না যাদু, না গণনা বিদ্যা। হে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ! আমার কথা শোন এবং তাকে তার কাজ করতে দাও। আমার বিশ্বাস এ বাণী সফল হবেই । মনে কর যদি আরবের লোকেরা তার বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তাহলে নিজের ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা থেকে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে এবং অন্যরাই তাকে পরাভূত করবে। আর সে যদি আরবদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয় তাহলে তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব এবং তাঁর সম্মান ও মর্যাদা তোমাদের সম্মান ও মর্যাদা হবে।” তার কথা শুনামাত্র কুরাইশ নেতারা বলে উঠলো, ওয়ালীদের বাপ! শেষ পর্যন্ত তোমার উপর তার যাদুর প্রভাব পড়লো? উতবা বললো, “আমি আমার মত তোমাদের সামনে পেশ করলাম । এখন তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পারো।”

কোন কোন তাফসীরকারের বর্ণনায় একথাও আছে যে, নবী (সা) তিলাওয়াত করতে করতে فَإِنْ أَعْرَضُوا۟ فَقُلْ أَنذَرْتُكُمْ صَـٰعِقَةًۭ مِّثْلَ صَـٰعِقَةِ عَادٍۢ وَثَمُودَ (এখন যদি এসব লোক মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এদেরকে বলে দাও, আমি তোমাদেরকে আদ ও ছামূদ জাতির আযাবের মত অকস্মাৎ আগমনকারী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি)। আয়াতে পৌঁছলে উতবা আপনা থেকেই তাঁর মুখের উপর হাত চেপে ধরে বললো, “আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের কওমের প্রতি সদয় হও।”পরে সে কুরাইশ নেতাদের নিকট তার এ কাজের কারণ বর্ণনা করেছে এই বলে যে, আপনারা জানেন, মুহাম্মদের (সা) মুখ থেকে যে কথা বের হয় তা সত্যে পরিণত হয়। তাই আমি আমাদের উপর আযাব নাযিল না হয় এই ভেবে আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম ।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : উতবার এ কথার জওয়াবে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে যে কালামে পাকের ভাষণ নাযিল হয়, তাতে উতবার কথাগুলোর প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি, বরং কাফেরদের মূল বিরোধিতাকেই আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাফেররা কুরআন মজীদের দাওয়াতকে প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অত্যন্ত হঠকারিতা ও অনৈতিকতা সহকারে চেষ্টা করছিল। তারা নবী করীম (সা)-কে বলছিল, আপনি যাই করুন না কেন আমরা আপনার কোন কথাই শুনব না । আমরা আমাদের দিলের উপর পর্দা, কানে তালা ও আমাদের ও আপনার মাঝে একটা প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, তা উভয়কে একত্র হতে দেবে না ।

তারা পরিষ্কার ভাষায় নবী করীম (সা)কে জানিয়ে দিয়ে ছিল যে, আপনি আপনার দাওয়াতী কাজ করে যান, আমরা যথাসাধ্য আপনার বিরোধিতা করে যাব। তারা নবী করীম (সা)-কে প্রতিরোধ করার জন্য একটা পরিকল্পনা তৈরী করে ফেললো। নবী করীম (সা) ও তাঁর পক্ষের কোন লোক সাধারণ মানুষকে কুরআন মজীদ পড়ে শুনাতে চেষ্টা করলে তারা আকস্মিকভাবে এত উচ্চকণ্ঠে হাঙ্গামা ও চিৎকার করতো যে কানে তালা লেগে যেতো। কুরআনের আয়াতসমূহের উল্টো অর্থ করে জনগণের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি করতো। কুরআনের আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে, কিছু অংশ বাদ দিয়ে তদস্থলে নিজেদের মনগড়া কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিয়ে একটা নূতন কথা দাঁড় করাতো, যেন কুরআন ও রাসূল সম্পর্কে লোকদের ধারণা খারাপ হয় ৷

আশ্চর্য ধরনের সব প্রশ্ন ও আপত্তি করতো তারা। তার একটা নমুনা এ সূরায় পেশ করা হয়েছে। একজন আরব যদি আরবী ভাষায় কোন কালাম শুনায়, তবে তাতে মুজিযার কি আছে? আরবী তো তার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় যার ইচ্ছা সেই কোন না কোন কালাম রচনা করতে পারে, তা আল্লাহর নিকট থেকে নাযিল হয়েছে বলে দাবী করার কি আছে? তবে তিনি যে ভাষা জানেন না সেই ভাষায় উচ্চ মানের কোন কালাম যদি সহসা শুনাতে পারতেন তবে না হয় বুঝা যেতো, এটা তাঁর নিজস্ব রচিত নয়, এটা উপর হতে নাযিল হয়েছে। এ অন্ধ বিরোধিতার জবাবে যা কিছু বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো এই :

“মহান আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন আরবী ভাষায়ই নাযিল হয়েছে। এতে স্পষ্ট ভাষায় যে তত্ত্বকথা প্রকাশ করা হয়েছে মূর্খ লোকেরা তাতে কোন জ্ঞানের সন্ধান পায়নি বটে; কিন্তু সমঝদার লোকেরা তা হতে জ্ঞানের আলোর সাথে ফায়দাও পেতে পারেন। আর যারা তা হতে বিমুখ হয়, তাদের পরিণাম সম্পর্কে তাদের ভয় করা উচিত। তোমাদের হিদায়াতের জন্য এ কুরআন যদি কোন অনারব ভাষায় নাযিল করা হতো তাহলে তোমরাই তখন বলতে, আরববাসীদের হিদায়াতের জন্য অনারব ভাষায় কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা কেউ বুঝে না। আসলে তোমরা হিদায়াত পেতেই চাও না । তা না মানার জন্য নিত্য নূতন বাহানা তালাশ করছো ।

তোমরা নিজেদের চোখ কান যতই বন্ধ করে রাখ না কেন, নিজেদের দিলের উপর যত পর্দাই লাগাও না কেন, আসল সত্য কথা এই যে, তোমাদের আল্লাহ আর আমাদের আল্লাহ একই আল্লাহ । আল্লাহ ছাড়া তোমরা আর কারও বান্দা নও। তোমরা জিদ করলেই এ সত্য বদলে যাবে না। তোমরা যদি ইলম ও আমল ঠিক করে নাও, তবে তাতে তোমাদেরই কল্যাণ হবে। আর যদি নাই মানো তবে নিজেরাই ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

তোমরা এ শিরক ও কুফরী কার সঙ্গে করছ, সে বিষয়ে কোন অনুভূতি আছে কি? সেই আল্লাহর সাথে যিনি নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, যিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা, যিনি মৃত যমীন থেকে ফসল উৎপন্ন করে তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করছেন। তাঁরই নিকৃষ্ট সৃষ্টিকে তাঁর সাথে শরীক করছ। তোমাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করা হলে জিদের বশবর্তী হলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ। তোমরা যদি হিদায়াতের মধ্যে না আস তবে জেনে রেখো, তোমাদের উপর তেমনি আযাব সহসাই ভেঙ্গে পড়ার জন্য তৈরী হয়ে রয়েছে যেমন আদ ও ছামূদ জাতির উপর ভেঙ্গে পড়েছিল। আর সে আযাবও তোমাদের অপরাধের শেষ শাস্তি নয়, পরে হাশরের ময়দানে তোমাদের হিসাব নেয়া হবে এবং জাহান্নামের আগুন তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।

তোমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছ, কুরআন যদি সত্যিই আল্লাহর কালাম হয়ে থাকে তাহলে তা অমান্য করে এমনভাবে তার বিরোধিতা করলে তোমাদের পরিণতি কতখানি মর্মান্তিক হবে?

সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যখন নিজেদের চোখেই তোমরা দেখতে পাবে যে, এ কুরআনের দাওয়াত দিগ-দিগন্তে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, আর তোমরা তার প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছ। একথা প্রচার হওয়ার পর প্রচণ্ড বিরোধিতার পরিবেশে ঈমানদারগণ ও স্বয়ং নবী করীম (সা) যে পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেদিকেও বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করা হয়েছে। দ্বীনের তাবলীগ করা তো দূরের কথা, তখন ঈমানের পথে দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। দুশমনদের ভয়াবহ ঐক্যজোট ও চারদিকে সমাচ্ছন্ন শক্তির মুকাবিলায় তারা নিজেদেরকে নিতান্ত অসহায় ও বন্ধু-বান্ধবহীন মনে করছিলেন। এ অবস্থায় প্রথমত তাদেরকে একথা বলে সাহস দেয়া হয়েছে যে, আসলে তোমরা অসহায় ও বন্ধু-বান্ধবহীন নও । বরং যে ব্যক্তি আল্লাহকে একবার নিজের রব মেনে এ আকীদায় অটল ও মযবুত হয়ে থাকে, তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা নাযিল হয় এবং দুনিয়া হতে পারলোক পর্যন্ত তাকে সাহচর্য দান করে। পরে তাদের মনে অভয় দান করা হয়েছে একথা বলে যে, যারা নেক আমল করে, অন্য লোককে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানায় এবং শক্ত হয়ে বলে, আমরা “মুসলমান,” প্রকৃতপক্ষে তারাই উত্তম মানুষ।

নবী করীম (সা)-এর সন্মুখে একটি প্রশ্ন কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করছিল । প্রশ্নটা হলো, দ্বীনের এ দাওয়াতের পথে যখন এ কঠিন দুর্লংঘ্য পাহাড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে তখন এর মধ্য হতে ইসলাম প্রচারের পথ উন্মুক্ত হবে কেমন করে? জওয়াবে বলে দেয়া হয়েছে যে, এসব প্রদর্শনীমূলক প্রতিবন্ধকতার পাহাড় বাহ্যত খুবই কঠিন ও দুর্লংঘ্য মনে হয় বটে, কিন্তু উত্তম উন্নত মানের চরিত্রই হলো এমন হাতিয়ার যা তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। অতীব ধৈর্যের সাথে কাজ করে যাও এবং আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও ।“

ব্যাখ্যা :
(ক) - إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ .....ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ-কাফেরদের ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করার পর এখন ঈমানদার ও নবী করীম (সা)-কে সম্বোধন করা হচ্ছে। যারা আল্লাহকে রব বলে ঘোষণা করার পর অন্য কোন আকীদা গ্রহণ করেননি এবং নিজেদের কর্মজীবনে তাওহীদের আকীদার দাবীসমূহও পূরণ করেছেন । তাওহীদের উপর দৃঢ় থাকার অর্থ কি নবী (সা) ও প্রধান সাহাবাগণ তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, নবী (সা) বলেছেন : “বহু মানুষ আল্লাহকে তার রব বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ‍ই আবার কাফের হয়ে গিয়েছে। দৃঢ়পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।” (ইবনে জারীর, নাসাঈ, ইবনে আবু হাতেম) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

لم يشركوا بالله ولم يلتفتوا الى اله غيره -
“এরপর আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেননি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্টও হননি।” (ইবনে জারীর)
একবার হযরত উমর (রা) মিম্বরে উঠে এ আয়াত পাঠ করে বললেন : “আল্লাহর শপথ! নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, শিয়ালের মত এদিক থেকে সেদিকে এবং সেদিক থেকে এদিকে ছুটে বেড়ায়নি।” (ইবনে জারীর
হযরত উছমান (রা) বলেন : “নিজের আমলকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” (কাশশাফ )
হযরত আলী (রা) বলেন : “আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধিবদ্ধ করা ফরযসমূহ আনুগত্যের সাথে আদায় করেছে।” (কাশশাফ)
যে পরিস্থিতিতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে এই পৃথিবীতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য যারা জীবনপাত করছে তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতরণের কথা বর্ণনা করাই যে এখানে মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারে, মনোবল ফিরে পায় এবং এই অনুভূতিতে তাদের হৃয়দমন পরিতৃপ্ত হয় যে, তারা সহযোগী ও বন্ধুহীন নয়, বরং আল্লাহর ফেরেশতা তাদের সাথে আছে। মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা ঈমানদারদের স্বাগত জানাতে আসে, কবরেও তারা তাদের স্বাগত জানায় এবং যেদিন কিয়ামত হবে সেদিনও হাশরের শুরু থেকে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত সব সময় তারা তাদের সাথে থাকবে। তাদের এই সাহচর্য সেই জগতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এ পৃথিবীতেও চলছে। কথার ধারাবাহিকতা বলছে হক ও বাতিলের সংঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে, তেমনি ঈমানদারদের সাথে ফেরেশতারা থাকে ৷ শয়তান বাতিলপন্থীদের কর্তৃকর্মসমূহকে তাদের সঙ্গী-সাথীদের সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে যুলুম-অত্যাচার ও বেঈমানী করছো সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। আর হকপন্থীদের কাছে আল্লাহর ফেরেশতারা এসে যে সুখবরটি পেশ করে তা পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হচ্ছে :

(খ) : نَحْنُ أَوْلِيَآؤُكُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ .... وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ ٣١ এটা একটা ব্যাপক অর্থবোধক কথা বা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে । পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিলের শক্তি যতই পরাক্রান্ত হোক না কেন তাদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সহইতে হোক সেজন্য দুঃখ করবে না। কেননা ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তুচ্ছ। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছো সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমান। আর দুনিয়াতে যা কিছু তুমি ছেড়ে যাচ্ছ সেজন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা এখানে আমি তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু । আলমে বারযাখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা একথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে, এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছ, সেজন্য দুঃখ করো না এবং আখেরাতে যা কিছু সামনে আসবে সেজন্য ভয় পাবে না। কারণ আমরা তোমাদেরকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছি যার প্রতিশ্রুতি আগেই তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে ।

(গ) - وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًۭا .... إِنَّنِى مِنَ ٱلْمُسْلِمِينَ - "সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি মুসলিম!”
তোমরা নিজেরা নেক কাজ কর, অন্যদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে ডাক এবং ইসলামের ঘোষণা দেয়াই যেখানে নিজেদের জন্য বিপদজনক এবং দুঃখ-মুসিবতকে আহ্বান জানানোর শামিল, এমন কঠিন পরিবেশেও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করো, আমি মুসলমান। মানুষের এর চেয়ে উচ্চস্তর ঘোষণা আর কিছু নেই। এ কথার গুরুত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করার জন্য যে পরিস্থিতিতে তা বলা হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সে সময় অবস্থা এই ছিল যে, যে ব্যক্তিই মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করতো সে হঠাৎ করেই অনুভব করতো যেন হিংস্র শ্বাপদ ভরা জংগলে পা দিয়েছে, যেখানে সবাই তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য ছুটে আসছে। যে ব্যক্তি আরও একটু অগ্রসর হয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য মুখ খুলছে, সে যেন তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য হিংস্র পশুকুলকে আহ্বান জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে সোজা পথ গ্রহণ করা এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া নিঃসন্দেহে দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ।

নিজে মুসলমান বলে ঘোষণা দেয়া, সৃষ্টিকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহ্বান জানানো এবং কেউ যেন ইসলাম ও তার ঝাণ্ডাবাহীদের দোষারোপ ও নিন্দাবাদ করার সুযোগ না পায় এরূপ কাজ করতে গিয়ে নিজের তৎপরতাকে সেভাবে পবিত্র রাখা হচ্ছে পূর্ণ মাত্রার ঈমানদারি ।

(ঘ) - وَلَا تَسْتَوِى ٱلْحَسَنَةُ وَلَا ....ۥ عَدَٰوَةٌۭ كَأَنَّهُۥ وَلِىٌّ حَمِيمٌۭ - হে নবী, সৎ কাজ আর অসৎ কাজ সমান হতে পারে না। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা আবৃত কর যা সবচেয়ে ভাল । তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।
তখন অবস্থা ছিল এই যে, চরম হঠকারিতা এবং আক্রমণাত্মক বিরোধিতার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের মুকাবিলা করা হচ্ছিল। নৈতিকতা, মানবতা ও ভদ্রতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছিল। নবী (সা) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে সব রকমের মিথ্যা আরোপ করা হচ্ছিল। তাঁর বদনাম করা এবং তাঁর সম্পর্কে লোকদের মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য সব রকমের দুষ্টবুদ্ধি ও কূটকৌশল কাজে লাগানো হচ্ছিল । তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছিল এবং শত্রুতামূলক প্ররোচনার জন্য পুরো একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। তাঁকে, তাঁর সঙ্গীদেরকে সর্বপ্রকারে কষ্ট দেয়া হচ্ছিল । তাতে অতিষ্ঠ হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাঁর ইসলাম প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পরিকল্পনা মাফিক হৈ চৈ ও হট্টগোল করার জন্য একদল লোককে সবসময় তৈরী রাখা হতো। যখনই তিনি ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত দেয়ার জন্য কথা বলতে শুরু করতেন তখনই তারা শোরগোল করতো কেউ তাঁর কথা শুনতে না পায়। এটা এমন একটা নিরুৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি ছিল যে, বাহিক্যভাবে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ বলে মনে হচ্ছিল। বিরোধিতা নস্যাৎ করার জন্য সেই সময় নবী (সা)-কে পন্থা বলে দেয়া হয়েছিল । প্রথমে বলা হয়েছে, সৎ কর্ম ও দুষ্কর্ম সমান নয়। তোমাদের বিরোধীরা যত ভয়ানক তুফানই সৃষ্টি করুক না কেন এবং তার মুকাবিলায় নেকীকে যত অক্ষম ও অসহায়ই মনে হোক না কেন দুষ্কর্মের নিজের মধ্যেই এমন দুর্বলতা আছে যা শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্বভাব প্রকৃতি দুষ্কর্মকে ঘৃণা না করে পারে না। দুষ্কর্মের সহযোগীই শুধু নয়, তার ধ্বজাধারী পর্যন্ত মনে মনে জানে, সে মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী এবং সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটি অন্যদের মনে তার প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করা তো দূরের কথা, নিজের কাছেই তাকে খাটো করে দেয়। এভাবে তার নিজের মনের মধ্যেই এক চোর জন্ম নেয়। শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এ চোর ভিতর থেকেই তার সংকল্প ও মনোবলের উপর সংগোপনে হানা দিতে থাকে । এই দুষ্কর্মের মুকাবিলায় যে সৎকর্মকে সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় বলে মনে হয়, তার প্রচারের তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকলে শেষ পর্যন্ত সেই বিজয়ী হবে। কারণ প্রথমত সৎকর্ম নিজেই একটি শক্তি যা হৃদয়-মনকে জয় করে এবং ব্যক্তি যতই শত্রুতাভাবাপন্ন হোক না কেন সে নিজের মনে তার জন্য সম্মানবোধ না করে পারে না। তাছাড়া নেকী ও দুষ্কর্ম যখন সামনাসামনি সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং উভয়ের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয় এমন পরিস্থিতিতে কিছুকাল সংঘাতে লিপ্ত থাকার পর খুব কম লোকই এমন থাকতে পারে যারা দুষ্কর্ম ঘৃণা করবে না এবং সৎ কর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে না ।

দ্বিতীয়ত, দুষ্কর্মের মুকাবিলায় শুধু মাত্র সৎকর্ম দিয়ে নয়, অনেক উচ্চ মানের সৎকর্ম দিয়ে মুকাবিলা কর । অর্থাৎ কেউ যদি তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে আর তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও তাহলে শুধু সৎ কর্ম হলো । উন্নত পর্যায়ের সৎকর্ম হচ্ছে, যে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবে সুযোগ পেলে তুমি তার প্রতি অনুগ্রহ কর, তার উপকার কর ।

এর সুফল এই যে, জঘন্যতম শত্রুও এভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে। কারণ এটিই মানুষের প্রকৃতি । আপনি যদি গালির জবাব না দিয়ে চুপ থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি নেকী বা সৎ কর্ম । অবশ্য তা গালিদাতার মুখ বন্ধ করতে পারবে না। কিন্তু গালির জবাবে আপনি যদি তার কল্যাণ কামনা করেন তাহলে চরম নির্লজ্জ শত্রুও লজ্জিত হবে এবং আর কখনও আপনার বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলার জন্য মুখ খোলা তার পক্ষে কঠিন হবে। একজন লোক আপনার ক্ষতি করার কোন সুযোগই হাতছাড়া হতে দেয় না। আপনি যদি তার অত্যাচার বরদাশত করে যেতে থাকেন তাহলে সে হয়তো তার দুষ্কর্মের ব্যাপারে আরও সাহসী হয়ে উঠবে । কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেখে যদি আপনি তাকে রক্ষা করেন তাহলে সে আপনার একান্ত অনুগত হয়ে যাবে। কারণ ঐ সুকৃতির মুকাবিলায় কোন দুষ্কৃতিই টিকে থাকতে পারে না। তা সত্ত্বেও এই সাধারণ নিয়মকে এ অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, উন্নত পর্যায়ের সৎকর্মের মাধ্যমে সব রকমের শত্রু অনিবার্যরূপে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন জঘন্য মনের মানুষও আছে যে তার অত্যাচার ক্ষমা করা ও দুষ্কৃতির জবাব অনুকম্পা ও সুকৃতির মাধ্যমে দেয়ার ব্যাপারে আপনি যতই তৎপর হোন না কেন তার বিচ্ছুর ন্যায় বিষাক্ত হুলের দংশনে কখনো ভাটা পড়বে না। তবে এ ধরনের খারাপ মানুষ ততটাই বিরল যতটা বিরল উন্নত পর্যায়ের ভাল মানুষ ৷

(ঙ) - ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ .... إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍۢ - ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না ।

এটা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হলেও এজন্য দরকার দৃঢ়সংকল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা । এটা কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই এসব গুণের বাহক হওয়া সম্ভব যে বুঝেশুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানবুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকী ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামী তাকে তার উচ্চাসন থেকে নীচে নামিয়ে আনতে সক্ষম নয় ।
এটা প্রকৃতির বিধান। অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার মানুষই কেবল এই গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে । আর যে ব্যক্তি এই গুণাবলীর অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনজিলে মকসুদে পৌছা থেকে বিরত রাখতে পারে না । কেউ নীচ আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনভাবেই সম্ভব নয় ।

(চ) وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ....هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ - যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পার তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন ।

শয়তান যখন দেখে, হক ও বাতিলের লড়াইয়ে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দ্বারা হীনতার এবং সুকৃতি দ্বারা দুষ্কৃতির মুকাবিলা করা হচ্ছে, তখন সে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। সে চায় কোনভাবে একবারের জন্য হলেও হকের পক্ষে সংগ্রামকারী, বিশেষ করে তাদের বিশিষ্ট লোকজন ও তাদের নেতৃবৃন্দের দ্বারা এমন কোন ত্রুটি সংঘটিত করিয়ে দেয়া যায় কিনা যাতে সাধারণ মানুষকে বলা যায়, দেখুন খারাপ কাজ এক তরফা হচ্ছে না। একপক্ষ থেকে নীচ ও জঘন্য কাজ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু অপর পক্ষের লোকেরাও খুব একটা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ নয়, তারাও তো অমুক হীন আচরণ করেছে। এক পক্ষের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষের জবাবী তৎপরতার মধ্যে ইনসাফের সাথে তুলনামূলক বিচারের যোগ্যতা সাধারণ মানুষের থাকে না ।

যতক্ষণ তারা দেখে বিরোধীরা সব রকমের জঘন্য আচরণ করছে, কিন্তু এই লোকগুলো ভদ্রতা ও শিষ্টাচার এবং মর্যাদা, নেকী ও সত্যবাদিতার পথ থেকে বিন্দুমাত্রও দূরে সরে যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর তার গভীর প্রভাব পড়তে থাকে। কিন্তু যদি কোথাও তাদের পক্ষ থেকে কোন অযৌক্তিক বা তাদের মর্যাদার পরিপন্থী আচরণ হয়ে যায়, তা কোন বড় যুলুমের প্রতিবাদে হলেও তাদের দৃষ্টিতে তারা উভয়েই সমান হয়ে যায় এবং বিরোধীরাও একটি শক্ত কথার জবাব হঠকারিতার সাহায্যে দেয়ার অজুহাত পেয়ে যায়। এ করণে বলা হয়েছে, শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে তোমরা সাবধান থাকো। সে অত্যন্ত দরদী ও মঙ্গলকামী সেজে এই বলে তোমাদেরকে উত্তেজিত করবে যে, অমুক অত্যাচার কখনো বরদাশত করা উচিত নয়, অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এই আক্রমণের জবাবে লড়াই করা উচিত। অন্যথা তোমাদেরকে কাপুরুষ মনে করা হবে এবং তোমাদের আদৌ কোন প্রভাব থাকবে না ।

এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমরা যখন নিজেদের মধ্যে কোন অযথা উত্তেজনা অনুভব করবে তখন সাবধান হয়ে যাও। কারণ তা শয়তানের প্ররোচনা। সে তোমাদের উত্তেজিত করে কোন ভুল সংঘটিত করাতে চায় ৷ সাবধান হয়ে যাওয়ার পর মনে করো না, আমি আমার মেজাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি, শয়তান আমাকে দিয়ে কোন ত্রুটি করাতে পারবে না। নিজের এই মনে করাটা হবে শয়তানের আরেকটি বেশী ভয়ংকর হাতিয়ার এর চেয়ে বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত । কারণ তিনি যদি তাওফীক দান করেন ও রক্ষা করেন তবেই মানুষ ভুলত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে পারে। ইমাম আহমাদ (রা) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেন, নবী (সা)-এর সামনে একদা এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে অকথ্য গালিগালাজ করতে লাগলো। হযরত আবু বকর (রা) চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী (সা) মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর (রা) ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটা কঠোর কথা বলে ফেললেন । তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবী (সা)-এর উপর চরম বিরক্তি ভাব ছেয়ে গেল এবং ক্রমে তা তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুটে উঠতে লাগলো। তিনি তখনই উঠে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরও উঠে তাঁর অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিল তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? নবী (সা) বললেন : আপনি যতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন ততক্ষণ একজন ফেরেশতা আপনার সাথে থেকে আপনার পক্ষ হয়ে জবাব দিচ্ছিল। যখন আপনি জবাব দিলেন তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল । শয়তান যেখানে আছে আমি তো সেখানে থাকতে পারি না ।

বিরোধিতার তুফানের মুখে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার পর যে জিনিসটি মুমিনের হৃদয়ে ধৈর্য, গভীর প্রশান্তি ও পরম তৃপ্তির সৃষ্টি করে তাতে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার মাথা নত হয়ে আসবে। আমাদের ও আমাদের বিরোধীদের সব কথাই তিনি শুনছেন এবং উভয়ের কর্মনীতি যা কিছুই হোক না কেন তা তিনি দেখছেন। এই অবস্থার কারণেই মুমিন বান্দা নিজের ব্যাপারটি এবং ন্যায় ও সত্যের দুশমনের ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হয়ে যান ।

কুরআন মজীদে এই পঞ্চমবার নবী (সা)-কে ও তাঁর মাধ্যমে ঈমানদারদেরকে দীন ইসলামের দাওয়াত এবং সমাজ সংস্কারের এ কৌশল শেখানো হয়েছে। এর পূর্বে আরও চার বার চার স্থানে এ কৌশল শেখানো হয়েছে ।

সে সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আ'রাফ : ১১০-১১১ আয়াত, সূরা আন-নাহল : ১২৫-১২৭ আয়াত, সূরা আল-মুমিনূন : ৯৬ আয়াত ও সূরা আনকাবূত : ৪৮ আয়াত ৷



শিক্ষা :

১। আমরা আল্লাহকে আমাদের রব বলে ঘোষণা দেবো, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি রহমতের ফেরেশতা নেমে এসে আমাদেরকে অভয় দান করবে এবং বেহেশতের সুসংবাদ দেবে। সেই ফেরেশতা দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে প্রত্যেক কাজে আমাদেরকে সহায়তা দেবে ।

২। আমরা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবো, সৎ কাজ করবো এবং নিজকে আত্মসমর্পণকারী হিসেবে ঘোষণা দেবো ।

৩। সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। সৎ কাজ দ্বারা অসৎ কাজের মুকাবিলা করবো, তাহলে প্রাণের দুশমনও অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে ।

৪ । শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । ঈমানদারগণ নিজেদের মধ্যে শয়তানের প্ররোচনা টের পেলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে ।





বাস্তবায়ন : আমরা যারা আল্লাহকে রব বলে স্বীকৃতি দেয়ার পর অবিচল থেকে রহমতের ফেরেশতার সহায়তা নিয়ে আল্লাহ ঘোষিত সর্বোত্তম কথা- আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান ও সৎ কাজ করবো এবং নিজেদেরকে আত্মসমর্পণকারী হিসেবে ঘোষণা দেবো। অসৎ কাজকে সৎ কাজ দ্বারা সংশোধনের চেষ্টা করতে গিয়ে শয়তানের প্ররোচনা টের পেলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবো। এভাবে আল্লাহর দ্বীনের সর্বোত্তম বৈশিষ্টগুলোর সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলন ঘটিয়ে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে । ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ ।




Tag: Darsul Quran-Sura Hamim As Sajdah দারসুল কোরআন-সূরা হামিম আস সাজদাহ

3 Comments:

আরমানের খেরোখাতা বলেছেন...
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
নামহীন বলেছেন...

উপকৃত হলাম।

উসমানী বলেছেন...

আপনার পোস্ট গুলো অনেক উপকারী কিন্ত কপি করা যায়না।