Close
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে 'আশরাফুল মাখলুকাত' এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য তাকে 'জ্ঞান' 'বিবেক' ও ইচছার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন এবং জ্ঞানের আকর বিজ্ঞানময় আল-কুরআনকে চূড়ান্ত 'হেদায়াত' এর উৎস হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও নবী, জ্ঞানী ও শাসক, শিক্ষক ও ত্রাণকর্তা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নবুওয়ত প্রদানের সংবাদ স্বরূপ অহি মারফত আল্লাহ যে ঘোষণা দেন তা হলো:
"পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা নাপাক বীর্য থেকে। পড়; আর তোমার প্রভু সবচেয়ে সম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে লিখতে শিখিয়েছেন। আর মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না।"
মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন- "জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ",- দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান তালাশ করো।" নবী করীম (সাঃ) এর সময়কালে চীন ছিল বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে অগ্রসর। হয়ত তাই তিনি উম্মতকে বলেছেন - "জ্ঞান অর্জন করো যদি সুদূর চীনেও যেতে হয়।"
বিখ্যাত তাফসীরকার মালিক আকবর আলী কোরআনে জ্ঞান ও হিকমাহর (প্রযুক্তি) সহাবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি/তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান পরস্পর সংযুক্ত।
আল্লার নবী (সাঃ) বলেছেন- 'প্রযুক্তি বিশ্বাসীদের হারানো সম্পদ, যেখানে সে তা পাবে সেখান থেকেই সে তা কুড়িয়ে নেবে। আল-কুরআনে ৯২টি আয়াতে 'ইলম,' ৩০টি আয়াতে 'হিকমাত্র; কথা এসেছে এবং ৩২টি আয়াতে জ্ঞানীদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ও জ্ঞানহীনদের 'অন্ধ' বলা হয়েছে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে ৭ম শতাব্দীর প্রথম পদে নবুওয়ত লাভ করে ২৩ বছরের অক্লান্ত সাধনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামকে একটি বিজয়ী জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। তিনি ও তার পরবর্তী খলিফাগণ ইসলামের একটি অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে জ্ঞানচর্চা, নয়া নয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার ও মানবতার কল্যাণের জন্য সে সবের ব্যবহারের উপর জোর দেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের যে অধ্যায়টি গির্জা ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের ফলে 'অন্ধকার যুগ' বলে চিহ্নিত সেই যুগে ইসলামের বিজ্ঞান মনস্কতার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কলা ও প্রযুক্তির সৃষ্টিশীলতায় একটি 'রেনেসার' জন্ম লাভ করে।

হিজরি প্রথম শতকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটে পশ্চিমে আফ্রিকার আটলান্টির অববাহিকা থেকে পূর্বে চীনের গ্রেট ওয়াল পর্যন্ত, আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি থেকে সাহারা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সম্পূর্ণ জাজিরাতুল আরব, ইরান, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব হয়ে কয়েক শতকের মাঝে তা গোবি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মধ্য এশিয়ায়।

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের সোনালি সময় হচ্ছে ৭ম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। যদিও সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কিছু কিছু মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদান নজরে পড়ে। আজ বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে এক অত্যাশ্চর্য উচচতায় এগিয়ে গেছে, বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান চোখে পড়ছে না বরং শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞানে তাদের পশ্চাদপদতা অন্যদের হাসির খোরাকে পরিণত করেছে একথা সত্য কিন্তু আবার পৃথিবীকে কল্যাণময়তায় ভরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা মুসলমানরাই রাখে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে বিপুল অবদান তা ইতিহাস বিকৃতির পাল্লায় পড়ে সবাই ভুলে আছে অথচ ঐসব অবদানই আজকের বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।
এ প্রবন্ধে বিজ্ঞানে মুসলিম অবদানের একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস থাকলো যাতে আগামী প্রজন্ম এর বিস্তৃত জানার উৎসাহ লাভ করে এবং এসব উৎসাহী পাঠকদের মাঝ থেকে নতুন সময়ের ইমাম জাফর সাদিক, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল বেরুনী, ইবনে সিনা, আর খাওয়ারিজিমী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ দিকপাল বিজ্ঞানীর জন্ম হয়।
•বিজ্ঞানের মৌল উপাদান সমূহ: মুসলিম বিজ্ঞানীরা যার সূচনা করেন
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ, সংস্কারক বিজ্ঞানী রজার বেকন (Regerbecon) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Opus Majus' এ 'Scientiac Experimentalis' বা 'Experimental Science' অর্থাৎ 'পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানসমূহ' অনুজ্ঞাটি প্রথম ব্যবহার করেন। এটি নিঃসন্দেহে বিখ্যাত আরবি পরিভাষা Al-Ulum at- Tajribiyan এর অনুবাদ। তাঁর Scientiac ব্যবহৃত হয় Ulum এর স্থলে এবং Experimentalis ব্যবহৃত হয় Tajribiyah এর স্থলে। আধুনিক বিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (Experiment) ব্যতিরেকে কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় না অর্থাৎ পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানই আধুনিক বিজ্ঞান। ইসলামের ৪র্থ খলিফা, মহান জ্ঞানী হযরত আলী (রাঃ) রসায়ন সূত্রের প্রথম প্রণেতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর নাতি ইমাম জাফর সাদিক (৬৯৯ ৭৬৫ খ্রিঃ) ছিলেন এক্ষেত্রে তার সার্থক উত্তরাধিকারী। ইমাম জাফরের সাগরেদ জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৭৭৭ খ্রিঃ) রসায়নের মায়া শাস্ত্রকে (Magic Art) কার্যকর বিজ্ঞানে রূপ দেন। জাবির তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন নিজ হাতে কোন কিছুকে পরীক্ষাপূর্বক সত্য হিসাবে না পেলে তাকে সত্য বলে গ্রহণ না করতে। সম্ভবতঃ এজন্য তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তাজরিবা বা পরীক্ষা-গবেষণা পদ্ধতি চালু করেন।

প্রথাগত পদ্ধতিতে আল ফারাবী তাঁর 'ইহসা আল উলুম' 'ইখওয়ান আল সাফা রিসালাত আল সানাই আল ইলমিয়াহ' এবং ইবনে সিনা তাঁর 'রিসালাহ ফি আকসাম আল উলুম আল আকলিয়া' গ্রন্থে বিজ্ঞানকে কতিপয় ভাগে শ্রেণীকরণ করেন। ইখওয়ান আল সাফা ও আল ফারাবী বলেছেন তিন শ্রেণীর বিজ্ঞানের কথা যেমন: অঙ্কশাস্ত্রীয় (Mathematical), মানব রচিত বিধানসমূহ (Man made laws) এবং প্রকৃত দার্শনিক (Real Philosophical), অপরদিকে ইবনে সিনা সাধারণ মানবিক জ্ঞানের আওতায় তাঁর সময়কার ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে (Islamic Sciences) আনেননি। অপর একদল, যাদের মাঝে ইবনে আল নাদিম তার বই 'ফিহরিস্ত' (ক্যাটালগ, তালিকা)-এ তাঁর সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিজ্ঞানকে ১০ ভাগে শ্রেণীকরণ করেন, ইবনে হাজাম দুইভাগে ভাগ করেন, প্রথম ভাগ ছিল ইসলামী আইন (কোরআন, হাদিস, জুরিসপ্রুডেন্স, ব্যাকরণ, ভাষা ও ইতিহাস) এবং বিভিন্ন জাতির জন্য সাধারণ বিজ্ঞান। (অঙ্ক, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কবিত্ব, বাগ্মিতা ও ন্যায়শাস্ত্র) দ্বিতীয় ভাগে ছিল-যাদুবিদ্যা, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি। ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দমায় বিজ্ঞানকে ২ ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে ঐ সমস্ত বিষয় যা ব্যক্তি নিজের মন ও ক্ষমতা দ্বারা বুঝতে পারে। এতে ৪টি অত্যাবশ্যকীয় বিজ্ঞান থাকে- বুদ্ধি ও দর্শনের বিজ্ঞান, যেমন- যুক্তিবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যেমন-চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি, নভো-বিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি; প্রত্যাদিষ্ট বিজ্ঞান; এবং সংখ্যাবিজ্ঞান, যেমন-সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও সঙ্গীত। অপর অংশে রয়েছে কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি কুরআন পাঠ ইত্যাদি। তাসকুবরাহ জাদাহকে বলা হয় বিজ্ঞান শ্রেণীকরণে শ্রেষ্ঠ মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বিজ্ঞানকে ৭ ভাগে ভাগ করেন।

ইসলামের প্রথম দিকের বিজ্ঞানীরা অনেকেই উপরোল্লিখিত বিজ্ঞান শাস্ত্রের একাধিক শাস্ত্র নিয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান মূলতঃ রসায়নশাস্ত্রের জনক বিবেচিত হলেও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষা, দর্শন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, লজিক ও কবিতা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ যিনি ইবনে সিনা নামে সমধিক পরিচিত, মূলতঃ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের অন্য ৯৮ শাখা নিয়েও কাজ করেছেন। প্রফেসর সাকাও এর মতে আল বিরুনী পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি (Al beruni was the greatest intellect that ever lived on this earth.)। গণিত, জ্যোতিষ, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, ন্যায়, সভ্যতার ইতিহাস, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের নিদর্শন বর্তমান। প্রায় সব বিষয়েই তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।

একথা অনস্বীকার্য যে এসব মুসলিম বিজ্ঞানীরা যখন এতসব বিষয়ে দিকদর্শন দিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান চর্চা নিষিদ্ধ এবং বিজ্ঞানের পক্ষ নেয়ার গ্যালিলিও'র মতো বিজ্ঞানীও তার কয়েকশত বছর পর চার্চের কাছে আনত মস্তক হয়ে বলতে হয়েছে "আমি আমার দাবির জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী বরং ঘোষণা করছি পৃথিবী ঘুরছে না।"

•ইসলামী সরকারসমূহের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা :
বদর যুদ্ধে ইসলামের প্রথম বিজয় ও ৭০ জন কাফিরের গ্রেফতারের পর নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করেন যে, যে মুশরিক ১০ জন মুসলিমকে পড়তে ও লিখতে শিখাবে সে আজাদ হতে পারবে। এভাবেই শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ পায়। পরবর্তী খলিফাগণও জ্ঞান চর্চার এ ধারা অব্যাহত রাখেন।

হিজরি ২১৫ সালে আব্বাসীয় খলিফা মামুন ২০০,০০০ দিনার (প্রায় ৭ মি. ডলার) ব্যয়ে বাগদাদে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র গড়ে তোলেন যার নাম দেন 'বায়তুল হিকমাহ' এর সাথে ছিল একটি জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দির ও গণ-পাঠাগার। তিনি সেখানে বহুসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, গণিত ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করেন, যার পরিমাণ প্রায় ১০০ উটের বোঝা।

গুস্তাব লি বোঁ (gustab le bou) তাঁর 'ইসলাম ও আরবী সভ্যতার ইতিহাস' বইতে লিখেছেন- 'ইউরোপে যখন বই ও পাঠাগার ছিল। সত্যিকার অর্থে বাগদাদের 'বায়তুল হিকমায়' চল্লিশ লক্ষ, কায়রোর সুলতানের পাঠাগারে দশ লক্ষ, সিরিয়ার ত্রিপোলী পাঠাগারে তিরিশ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। অপরদিকে মুসলমানদের সময় কেবল স্পেনে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হতো।"

ডঃ ম্যাক্স মেয়রহোফ লিখেন-" ইস্তাম্বুলের মসজিদগুলোর জন্য ৮০টি পাঠাগার ছিল। প্রতিটি লাইব্রেরিতে দশ হাজার বই ও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ছিল। দামেস্ক, মসুল, বাগদাদ, ইরান ও ভারতের শহরসমূহে অনুরূপ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে।"

ড. ওস্তাব তাঁর বইতে আরও অগ্রসর হয়ে বলেন, "মুসলমানরা কোন শহর অধিকারে নিলে প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করতো একটি মসজিদ ও একটি কলেজ। বাগদাদ, কায়রো, this কর্ডোভা ও অন্যান্য স্থানে পরীক্ষাগার, মানমন্দির, বিরাট পাঠাগার ও জ্ঞান সাধনার অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কেবল আন্দালুসিয়ায় তত্ত্ব ছিল ৭০টি গণপাঠাগার। কর্ডোভার আল হাজাম পাঠাগারে ৬০০,০০০ বই ছিল। অথচ চার শতাব্দী পরে চার্লস দি জাস্ট বিবলিওথিক ন্যাশনাল অব প্যারিস শুরু করেন ৯০০ বই দিয়ে যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল ধর্মের উপর রচিত।"

পণ্ডিত নেহেরু তার 'A Glimpse at World History' তে লিখেন "কর্ডোভায় ১০ লক্ষের বেশি লোক বাস করতো, যেখানে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাবলিক পার্ক ছিলো, ৪০ কিলোমিটারব্যাপী তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬০০০ প্রাসাদ ও বড় বড় বাড়িঘর; ২০০,০০০ সুন্দর আবাস বাড়ি, দোকানপাট, ৩০০ মসজিদ, ৭০০ হাম্মামখানা (ঠাণ্ডা ও গরম পানির সরবরাহ) ছিল। অসংখ্য পাঠাগার ছিল যার মাঝে রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় বিখ্যাত ছিল কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি সকল দরিদ্রের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।"

ড. মরিস বুকাইলি তাঁর গ্রন্থ "The Bible, The Quran and Science"এ উল্লেখ করেন ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলাম জ্ঞান বিজ্ঞানকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। যখন খ্রিস্টীয় জগতে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা চলছিল তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালসমূহে বহু সংখ্যক গবেষণা ও আবিষ্কার সাধিত হয়। কর্ডোভার রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইবনে রুশদ তখন সেখানে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য দেশীয় বিজ্ঞানে পাঠদান করতেন। যার কারণে সারা ইউরোপ থেকে পণ্ডিতেরা কর্ডোভায় পড়তে যেতেন যেমন আজকের দুনিয়ার মানুষ তাদের শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য আমেরিকায় যায়। আমরা আরব সংস্কৃতির কাছে বহুলভাবে ঋণী, গণিত (বীজগণিত একটি আরব আবিষ্কার), জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি এর জন্য। মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দান করে। এ সময় মানুষ অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ ছিলো কিন্তু ইসলামী দুনিয়ায় মানুষকে একই সাথে বিশ্বাসী ও বিজ্ঞানী হতে বাধা দেয়নি। বরং বিজ্ঞান ছিল ধর্মের যমজ ভাই।"

•চিকিৎসা বিজ্ঞান
Dr. Mayerhof তাঁর বই "The Legacy of Islam" এ লিখেন মুসলিম ডাক্তারগণ ক্রুসেড যুদ্ধে আগত মেডিক্যাল এটেনডেন্টদের অগোছালো ও প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা দেখে হাসতেন। ইউরোপীয়গণ সে সময়ে ইবনে সিনা, জাবির, হাসান বিন হাইসাম বা রাজির বইসমূহের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। অবশ্য পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় তাদের বইগুলো অনূদিত হয়। এসব অনুবাদ এখনও বর্তমান কিন্তু কোথাও অনুবাদকের নাম নেই। ষোড়শ শতাব্দীতে ইবনে রুশদ (Averroes) ও ইবনে সিনার (Avicenna) বইসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে ইটালি ও ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠদানের মৌলিক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।"

একই গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় তিনি আরও লিখেন "রাজির মৃত্যুর পর ইবনে সিনা রাজিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। চিন্তা, দর্শন ও সাধারণ বিজ্ঞানে তার প্রভাব ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান (সমরকন্দের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত গ্যালনের রচনাবলির আরবি অনুবাদ এর ভিত্তিতে গড়ে উঠা) ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মাঝে ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কায়েস, ইবনে যাহর, ইরানের আব্বাস, মিসরের আলী ইবনে রেজভান, বাগদাদের ইবনে ইসাউ, মসুলের আম্মার, আন্দালুসিয়ার আবু রুশদ। এদের বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল।

মুসলমানগণ যখন স্পেন জয় করে ইউরোপ তখন কলেরার ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতো না। লোকেরা মনে করতো এ রোগটি হচেছ পাপের প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ একটি আসমানী আজাব। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে কেবল কলেরা নয় এমনকি প্লেগও একটি সংক্রামক ব্যাধি বই কিছু নয়।"

বলা হয়ে থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যখন অস্তিত্ব ছিল না হিপোক্রিটিস তাকে অস্তিত্বে জানেন; যখন তা হারিয়ে যায় গ্যানে তা পুনঃপ্রবর্তন করেন; যখন এ শাস্ত্রটি হযবরল ও এলোমেলো হয়ে যায় আল-রাজি তা পুনর্বিন্যাস করেন এবং এরপরও যখন তা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ইবনে সিনার মহান প্রয়াস তাকে সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন করে। Dr. Maverhof এ বিষয়ে লিখেন "ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুন (The Canoon) চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাস্টারপিস হিসাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করে যে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে এর ১৬টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়, যার ১৫টি ল্যাটিন ও ১টি আরবি। বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থ হিসাবে ষোড়শ শতাব্দীতে এর শত শত মুদ্রণ হয়। ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে এটিই ছিল সর্বাধিক পরিচিত চিকিৎসাগ্রন্থ। এখনও চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক বিষয়ে এ গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়।" ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছর এ বইটি ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানে একমাত্র মূল টেক্সট।

উইল ডুরান্ট (Will Durant) লিখেন যে মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া রাজি মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মাঝে অগ্রসর ছিলেন। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা যা আজও ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। তার বিশেষ অবদান হচ্ছে:

১। "শুটি বসন্ত ও হাম" (Smallpox and Measles): এটি ১৪৯৭ থেকে ১৮৬৬ সালের মাঝে ল্যাটিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ৪০ বার মুদ্রিত হয়। ২। "মহান বিশ্বকোষ" (The Great Encyclopedia): এটি ২০ খণ্ডের বিশাল বিশ্বকোষ যা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। এই বিশ্বকোষের ৫ খণ্ড ছিলো চক্ষু বিজ্ঞানের উপর। ১২৭৯ সালে এটির ল্যাটিন অনুবাদ হয় এবং কেবলমাত্র ১৫৪২ সালে এর ৫টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। শত বছর ধরে চোখ, চোখের রোগ ও তার চিকিৎসাক্ষেত্রে এ গ্রন্থগুলো প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচিত হতো। ১৩৯৪ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তার চিকিৎসাবিজ্ঞান কোর্সের ৯টির ১টি হিসাবে এটিকে গ্রহণ করে। মুসলিম ডাক্তারগণ সার্জারিতেও অনেক দূর এগিয়ে যান। তারা এনেসথেসিয়ার প্রয়োগও করতেন যদিও ধারণা করা হয় এটি সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার। রাজির অন্যান্য আবিষ্কারের মাঝে ছিলো- জ্বর রোগে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, ক্ষত সারানোর ব্যাপারে পারদ ও পশুর ব্যবহার ইত্যাদি।

মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণই প্রথম আঙ্গুলের নখ দেখে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়, জন্ডিস রোগের সুচিকিৎসা, ক্ষরণ বন্ধ করার ব্যাপারে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, কিডনি ও ব্লাডারের পাথর সরানোর জন্য তা ভাঙ্গা, হার্নিয়া রোগের শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় আবিষ্কার করেন। বিখ্যাত ইসলামী শল্যচিকিৎসক ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কাসেম। তিনি বহু সংখ্যক শল্য-যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক ও এ বিষয়ের গ্রন্থকার। তাঁর এসব বই ১৮১৬ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন ভাষার ব্যাপক সংস্করণে মুদ্রিত হয়।

•ঔষধশাস্ত্র (Pharmacology)
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অন্যতম শাখায় মুসলমানদের অবদান অসামান্য। গুস্তাব লি বোঁ লিখেন" টাইফয়েড রোগের চিকিৎসার জন্য ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার ইউরোপ যা একবার মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করে ফেলে দিয়েছিলো এবং আবার যা তারা কয়েক শতাব্দী পর সাগ্রহে গ্রহণ করছে- এছাড়াও মুসলমানদের অনেক উদ্ভাবনের কাছে তারা ঋণী। মুসলমানরাই প্রথম রাসায়নিক ঔষধসমূহকে পিল ও মিকশ্চার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে যা বর্তমানেও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। এসবের অনেকগুলোকেই বর্তমান সময়ের রসায়নবিদগণ নতুন আবিষ্কার বলে চালিয়ে দিতে চান; এর কারণ অবশ্য এসবের ইতিহাস সম্বন্ধে তাদের অজ্ঞতা। মুসলমানদের ডিসপেন্সারিগুলোতে রোগীরা চিকিৎসাপত্র নিয়ে গেলে পর্যাপ্ত ঔষধ পেতো, যেখানে কোন হাসপাতাল সুবিধা ছিল না ডাক্তারগণ তাদের যন্ত্রপাতিসহ রোগীর সেবায় ছুটে যেতেন।" জর্জি যাইদেন (Georgi Zeidan) লিখেন "ইউরোপের আধুনিক ঔষধ বিজ্ঞানীগণ তাদের পেশায় ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখেছেন শতবর্ষ আগে মুসলিম ডাক্তারগণ আধুনিক ও কার্যকর উপায় উপাদান ব্যবহার করেছেন: তারা একটি ফার্মাকোলজি বা ঔষধশাস্ত্র গড়ে তোলেন ও জটিল রোগের চিকিৎসা করতে সমর্থ হন এবং আধুনিক মডেলের ফার্মেসি গড়ে তোলেন।

কেবল বাগদাদ শহরে ৬০টি ঔষধালয় থেকে খলিফার খরচে বিনে পয়সায় ঔষধ দেয়া হতো। ইউরোপেও অনেক ঔষধের নামে আরবি, ভারতীয় ও ফার্সী মূলের প্রয়োগ দেখা যায় যেমন- এলকোহল, এলকালি, এলকানের, এপ্রিকোট, আরসেনিক ইত্যাদি।

•হাসপাতাল (Hospital)
জর্জি যাইদেন বর্ণনা করেন "রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর দুইশত বছরের আগেই মক্কা, মদীনাসহ সকল বড় বড় মুসলিম শহরে হাসপাতাল গড়ে ওঠে, আব্বাসীয় গভর্নরগণ তাদের নিজ নিজ এলাকায় শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। কেবল বাগদাদেই ছিল ৪টি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল। তৃতীয় হিজরিতেই গভর্নর আব্দুদ্দৌলা দেই লামী আদুদী হাসপাতাল গড়ে তোলেন, যেখানে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন। তখনকার দিনে এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতাল কিন্তু অল্প সময়ের মাঝেই তার চেয়ে ভাল হাসপাতাল তৈরি হয়।

এসব হাসপাতালে রোগীরা ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিচারে সমান যত্ন ও সেবা লাভ করতো। বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ড ছিলো। এসব হাসপাতালে ছাত্ররা তত্ত্বের পাশাপাশি রোগী পর্যবেক্ষণ করতো। তাছাড়া কতিপয় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যেসবের ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেলজুকি সুলতান মাহমুদ এর সাথে এমন একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যা বহন করে নিতে ৪০টি উট লাগতো। ডঃ গুস্তাবলি বোঁ লিখেন "মুসলিম হাসপাতালসমূহে প্রতিষেধক ঔষধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার এমন উন্নত ব্যবস্থা ছিলো যে সেখানে মৃতদের ছাড়া সবারই রোগ আরোগ্য হতো। সেখানে আলো বাতাসের প্রাচুর্য ও প্রবহমান পানির সুব্যবস্থা থাকতো। সুলতান মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া রাজিকে বাগদাদের উপকণ্ঠে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলে তিনি বহু পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত স্থান বাছাই করেন। এসব হাসপাতালে বড় সাধারণ ওয়ার্ড এবং ব্যক্তিদের জন্য পাইভেট ওয়ার্ডের ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররা এখানে রোগ নির্ণয়, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতো। এছাড়া ছিল বিশেষ ধরনের মানসিক হাসপাতাল এবং বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের জন্য ঔষধালয়।"

মার্ক ক্যাপ (Mark Kapp) লিখছেন, "কায়রোতে একটি বড় হাসপাতাল ছিল যেখানে জীবন্ত ঝর্না ছিল, বিশাল ফুলের বাগান ছিল এবং ৪০টির বেশি উঠোন ছিলো। সেখানে রোগীদের সাদরে গ্রহণ করা হতো ও সুস্থ হয়ে গেলে ৫টি স্বর্ণমুদ্রাসহ তাকে ফেরত পাঠানো হতো তার ঘরে। সে সময়ে কর্ডোভা নগরীতে ৬০০ মসজিদ, ৯০০ গণশৌচাগার (হাম্মাম) এর পাশাপাশি ৫০টি হাসপাতাল ছিল।"

মুসলমানরা যখন এসব সুউচচ ও প্রসারিত হাম্মামখানায় সাবান ও সুগন্ধি ব্যবহার করতো, প্রবহমান পানিতে গোসল করতো আধুনিক আমেরিকা তখন জঙ্গল আর গুহা থেকে বেরোয়নি, শিখেনি কিভাবে গোসল করতে হয়। ইউরোপ তখন সভ্যতা, সংস্কৃতির জন্য অক্সফোর্ড ছেড়ে কার্ডোভার দিকে ছুটছিলো।

•রসায়নশাস্ত্র
ইমাম জাফর সাদিকের শিষ্য জাবির ইবনে হাইয়্যান 'রসায়নশাস্ত্রের জনক' হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আরব রসায়নশাস্ত্রের জনক। পশ্চিমা রসায়নশাস্ত্র ও আলেকেমির উপর তার প্রভাব হিলো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। তাঁর কয়েকশত অবদান সর্বজন স্বীকৃত এবং এখনও টিকে আছে। সাবেক ইরাকী শিক্ষামন্ত্রী মরহুম সৈয়দ হেবাতউদ্দিন শাহরিস্তানী লিখেন, "আমি জাবিরের ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র দেখতে পাই যা তার শিক্ষক ইমাম জাফরকে উৎসর্গ করা। তাঁর ৫০০টি গবেষণাকর্ম মুদ্রিত অবস্থায় প্যারিস ও বার্লিনের জাতীয় পাঠাগারে পাওয়া যায়। ইউরোপের জ্ঞানীরা তাঁকে আদর করে ডাকে 'বুদ্ধিমত্তার অধ্যাপক' (Wisdoms Professor) এবং তারা স্বীকার করে যে তিনি ১৯টি মৌলিক পদার্থের আবিষ্কারক। জাবের বলেন যে কোন বস্তুকে আলো ও আগুনের সাহায্যে এমন অণুতে পরিণত করা সম্ভব যা বস্তুর অদৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম ইউনিট। জাবের এর এ তত্ত্বটি আধুনিক পারমাণবিক বিজ্ঞানের অতি নিকটবর্তী।" নাদিম রচিত ফিহরিস্ত ও অন্যান্য তালিকায় জাবির রচিত রসায়ন গ্রন্থের পরিমাণ ২৭৭ খানা যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৭০। তার গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২ থেকে ১০০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুই বা দেড় পৃষ্ঠার এসব বই এক একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত বই ৫০০, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ১, দার্শনিকের যুক্তি খণ্ডনের বই ৫০০ ইত্যাদি।

জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নের শুদ্ধতম ভিত্তি রচনা করেন। তিনি হাতে কলমে পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর জোর দেন। কিতাবুত তাজ, কিতাবুল মাওয়াজিন, কিতাবুর রাহমাস্স্সাগির, কিতাবুল খাওয়াস ও কিতাবুল হুদুদে তিনি এ বিষয়ে তাঁর মত ব্যক্ত করেন।

রসায়নশাস্ত্রের যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা চালাতে হয় তিনি সেসব রপ্ত করেন ও নিজের আবিষ্কৃত পরীক্ষা প্রক্রিয়াসমূহের সাথে মিলিয়ে এসবের উন্নয়ন করেন। তিনি পাতন, ঊর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভষ্মীকরণ, গলান, বাষ্পীভবন প্রভৃতি রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর বিশদ লেখালেখি করেন। এসব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাঁর বর্ণনা ছিল বৈজ্ঞানিকভাবে বিশুদ্ধ ত্রুটিমুক্ত।

জাবির টিন, সীসা, তামা, লৌহ, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি তৈরির পন্থা আবিষ্কার করেন। তার ব্যবহারিক ও ফলিত রসায়নের মাঝে ইস্পাত তৈরি করার পন্থা, কাপড় ও চামড়া রং করার প্রণালী, লোহা এবং ওয়াটার প্রুফ কাপড়ের বার্নিস করার উপায়, কাচ তৈরি করার জন্য ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার, সোনার জলে নাম লিখাবার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বস্তুর রং করা, খনিজ দ্রব্য ও ধাতব পদার্থের উৎপাদন ইস্পাত প্রস্তুতি ট্যানিং ইত্যাদি কারখানা কৌশল মুসলমানরাই প্রথম আবিষ্কার করে। তারাই নাইট্রিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রো গ্লিসারিন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, পটাশিয়াম, একুয়া নাইট্রেট, এলকোহল, এলকালি অরপিমেন্ট, অরপিসেন্ট ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। বোরাক্সও তাদের আবিষ্কার।

আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে পাতন, বাষ্পীকরণ, পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া এবং সোডিয়াম, কার্বন, পটাসিয়াম কারবোনেট, ক্লোরাইড ও এমোনিয়ার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

•পদার্থ বিজ্ঞান
ইবন আল হাইসাম (আল হাজেন, ৯৬৫-১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে) ছিলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে উন্নত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক অবদান রাখেন। প্রফেসর আব্দুস সালামের মতে, "তিনিই প্রথম বলেন যে আলোক রশ্মি কোন মাধ্যম অতিক্রম করার সময় সহজ ও দ্রুততর পথ বেছে নেয়। এভাবে তিনি বহু শতাব্দী আগেই ফারমেটস্ এর সর্বনিম্ন সময় তত্ত্ব (Principle of Least time) অনুরূপ তত্ত্ব প্রদান করেন।

তিনি সর্বপ্রথম জড়তা তত্ত্ব (Law of Inertia) প্রদান করেন যা পরবর্তীতে Newton এর 'ল অব মোশন' হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তিনিই প্রথম আলোর প্রতিসরণের তত্ত্ব প্রদান করেন যা পরবর্তীতে নিউটনের হাতে পুনরাবিষ্কৃত ও বিস্তৃতি লাভ করে।"

পশ্চিমা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশাল, বিরাট। তাঁর সমসাময়িক আল বেরুনীর সহযোগিতায় তিনি বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। আধুনিক ইউরোপের শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অবিসংবাদিত পথিকৃৎ রজার বেকন এর আকাশচুম্বী সৃষ্টি (Opus Majus এর পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবিক অর্থে ইবনে আল হাইসামের আল মানাজির (Optics) এর নকলমাত্র। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব তা স্বীকার করে না।

আল বিরুনী (৯৭৩ - ১০৪৮ খ্রিঃ) ভারত ও আফগানিস্তানে অনেক কাজ করেন। বহু পূর্বেই তিনি প্রকৃতির আইন আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, পদার্থবিদ্যার যে বিধান পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল। আকাশের কক্ষপথসমূহেও ক্রিয়াশীল। মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানী আবুল হাসান সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, গ্যালিলিও তার উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন মাত্র। অথচ বর্তমান বিশ্ব জানে গ্যালিলিওই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক। ইবনুল হাইসাম তাঁর গ্রন্থ মাকালাতু ফি মারাকাজুল আস্কাল' গ্রন্থে বস্তুর পরস্পরের আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি ও দার্শনিক মাওলানা রুমি কবিতায় মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের ধারণা দেন। সম্ভবতঃ সেই পথ ধরে পরবর্তীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন এ বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব দাঁড় করান।

•শিল্প কারখানা
আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদ এইক্সের চারলেম্যানের কাছে বাগদাদ থেকে একটা ঘড়ি পাঠান উপঢৌকন হিসেবে যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেজে উঠতো। এটি দেখে সদ্য সিংহাসনে আসীন রোমান শাসক ও তার সভাসদগণ চমৎকৃত ও আনন্দিত হলেন। আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টানদের ধ্বংসলীলার ফলে মুসলিম শাকসকদের সময়কার বড় বড় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা, কৃষ্টি ও সভ্যতার অন্যান্য উপাদানে স্থবিরতা নেমে আসে। দক্ষ রাজমিস্ত্রিদের অভাবে শহরের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। মাদ্রিদের জনসংখ্যা ৪ লাখ থেকে ২ লাখে নেমে এলো। যে সেভাইলে ১৬০০ শিল্পকারখানা ছিল সেখানে ৩০০ কারখানা টিকলো এবং ১,৩০,০০০ শ্রমিক চাকরি হারালো অথচ জনসংখ্যা তখন ৭৫% কমে গেছে। মুসলমানরাই প্রাচীন চর্ম-কাগজের পরিবর্তে তুলার তৈরি কাগজের প্রচলন করে এবং এতে করেই ইউরোপে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ হলো। অবশ্য মুদ্রণ পদ্ধতি আসে প্রাচীন চীন থেকে। এ থেকেই বই পুস্তুক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁর সূচনা হয়। কাগজ আবিষ্কারের ফলেই প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থরাজির পুনর্লেখন সম্ভব হলো।

ফিলিপ হিট্টি (Philop Hitti) তাঁর History of the Arabs এ লিখেন 'সড়ক তৈরির প্রযুক্তি মুসলমানদের হাতে এতটা উন্নত হয় যে কর্ডোভায় মাইলের পর মাইল পাকা সড়ক ছিল যার দুপাশে রাতে বাতি জ্বলতো যাতে লোকেরা নিরাপদে পথ চলতে পারে, অথচ সেই একই সময়ে লন্ডন বা প্যারিসের পথে বৃষ্টিস্নাত রাতে বের হলে হাঁটু পর্যন্ত জলমগ্ন ও কর্দমাক্ত হতে হতো। এ অবস্থা কর্ডোভায় পাকা রাস্তা আসার সাতশত বছর পরও ছিলো। অক্সফোর্ডের লোকেরা তখন মনে করতো গোসল করা একটা অপকর্ম যখন কর্ডোভার ছাত্রগণ বিলাস-বহুল হাম্মামখানা ব্যবহার করতো।

•অঙ্কশাস্ত্র
আধুনিক বিজ্ঞানে অঙ্ককে বলা হয় মা। কম্পিউটার এর আবিষ্কার ও এর উন্নতি কেবলই অঙ্কনির্ভর। Legacy of Islam গ্রন্থের 'Astronomy and Mathematics অধ্যায়ে Baron Carra de Vaus বলেন, "এলজেবরা হচেছ আরবি আলজবর কথাটির ল্যাটিনরূপ। আল জবর অর্থ শক্তি, ভাগ্য বা অসংগতি। এটিকে এক কথায় সংক্ষিপ্তকরণ বলা যায়। এটি বর্ণের পরিবর্তে সংখ্যা বা সংখ্যার পরিবর্তে বর্ণের ব্যবহার। কুরআনে ব্যবহৃত হরুফে 'মুকাত্তায়াতি' এর মতো এর প্রয়োগ। অংকের ভাষায় এটি ভগ্নাংশকে পূর্ণসংখ্যায় রূপান্তর করা; জটিল সংখ্যাকে সহজতর ভাষা বা সংকেতে উপস্থাপন করা। বিজ্ঞান আজ যেসব সংখ্যা ব্যবহার করছে তা আরবি সংখ্যা। বর্তমানে ব্যবহৃত কম্পিউটার প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হচেছ হিন্দু প্রতীক থেকে '৩' বা শূন্যের যে মূল্যমান আরবরা গ্রহণ করেছে তা। '০' বা Zero এর নিকটতম শব্দ Chiper যা কিনা আরবি ka sefr এর প্রতিলিপিকরণ বই নয়।" De vaux আরো লিখেন: Chiper ব্যবহার করে আরবগণ নিত্যব্যবহার্য গণিতের পথপ্রদর্শক হন। তারা বীজগণিতকে একটি প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দেন ও উন্নয়ন ঘটান, তারাই বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির ভিত্তি রচনা করেন, তারাই ত্রিকোণমিতির একমাত্র স্থপতি। এলগোরিদম কথাটি আসে এর আবিষ্কারক খিত্ এর বাসিন্দা আল খারেজমির নাম থেকে। আরবগণ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার চরম পর্যায়ে যখন, তখন ইউরোপ চরম বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল। "আল খারেজমী প্রথম আলজাবর ওয়াল মোকাবিলা পদ্ধতির ব্যবহার করতে থাকেন। বস্তুর সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ ও কঠিন বস্তুর এবস্ট্রাকট ফরমুলেশানের নিয়ম (হাদ্দ বা তাহদিদ) তিনি প্রণয়ন করেন। খারেজমী মনে করতেন বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল শক্তি হচেছ গণিত। সূক্ষ ও বিশুদ্ধ গণনার জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত প্রক্ষেপণ নীতি The formula of interpolation কে নিউটনের আবিষ্কার বলে চালালেও তাঁর জন্মের বহু পূর্বে আলবেরুনী শুধু একে আবিষ্কারই করেননি তিনি একে ব্যবহার করে সাইন (Sine) তালিকা প্রণয়ন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর আকার, পরিধি ইত্যাদি বিষয়ে যে আলোচনার অবতারণা হয় তাতে সর্বশেষ অবদান রাখেন মুসলিম বিজ্ঞানী বনি মুসা ভ্রাতৃদ্বয় এবং আলবেরুনী। আলবেরুনীর কানুনে মাসউদীর ৪র্থ খণ্ডে প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। তিনি দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দিক নির্ণয়, গ্রহ-নক্ষত্রাদির অবস্থানজ্ঞাপক সংজ্ঞা নির্দেশ করার সহজ বিজ্ঞানসম্মত উপায় নির্ধারণ করেন। জ্যোতির্বিদগণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক আল বাত্তানীও একজন মুসলিম। স্থানাঙ্কের যেকোন ২টি বিষয়ে জানতে পারলে অন্যগুলি নির্ধারণের যে সহজ ফর্মুলা আলবেরুনী দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।

আবু রায়হান বিরনী তাঁর কিতাবুত তাফহিম ফি সানয়াতে তানজিম গ্রন্থে লিখেছেন, "যে ব্যক্তি ৪টি বিজ্ঞানে পারদর্শিতা লাভ না করেছে তাকে জ্যোতিষী বলা যেতে পারে না। এ ৪টি বিজ্ঞান হলো- অঙ্কশাস্ত্র (Mathematics), গণিত (Arithmetic), বিশ্ব গঠনতন্ত্র (Cosmography), বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষী (Judicial Astrology)। আলবিরুনী ছিলেন সর্ববিচারে একজন সার্থক জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।"

নভোমণ্ডলী, নভোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থানের অবস্থান, শহর নগরের আয়তন ইত্যাদি সম্বন্ধীয় সাধারণ গণনা সম্পর্কীয় গ্রন্থ: আলোর গতি সম্পর্কীয় গ্রন্থ: এস্ট্রোল্যাব সহযন্ত্রাদি ও সে সবের ব্যবহার সম্পর্কিত গ্রন্থ, কাল ও সময় সম্পর্কিত গ্রন্থ; উল্কা ও কুজঝটিকা বিষয়ক, জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ শিরোনামে তাঁর ৭৯টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাদি রয়েছে।

আমরা যাকে কেবল রুবাইয়াতের কবি হিসেবে চিনি সেই ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত। নিউটনের বহু আগে তিনি আবিষ্কার করেন "বাইনোমিয়াল থিউরাম।" এ পদ্ধতিতে তিনি সূর্যের চারিদিকের পৃথিবীর সময় মান ঠিক করে জালালি ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন।

•ভূগোল
প্রথম কয়েক শতাব্দীর মাঝেই আরব মুসলিমগণ ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেন মরক্কো থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত। আরব্য রজনীর সিন্দাবাদকে আমরা দেখি চীন, জাপান আর ইন্দোনেশিয়ান দারুচিনি দ্বীপের দেশে ঘুরতে। তাতেই মনে হচেছ আরবরা আগে থেকেই ভূগোল, ভূবিদ্যা ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলো।

কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি আরব নাবিকগণ আফ্রিকার পূর্বতীর থেকে রাশিয়ার দূরবর্তী এলাকা পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান। আফ্রিকান মুসলমানগণ কলম্বাসের বহু আগেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছায়। ভারতে আসার সমুদ্র পথও প্রথম আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ্যা, জাহাজ পরিচালনা বিজ্ঞান, মহাসাগরের বৈজ্ঞানিক বর্ণনাকারী এবং সাগরের প্রাণী সম্পর্কে বহু গ্রন্থের প্রণেতা মুসলিম বিজ্ঞানী আহমদ বিন মজীদ।

বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে হক্কাল (৯৭৫ খ্রিঃ) তার গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, "আমি এই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা ও অক্ষাংশ সম্বন্ধে লিখেছি, এর সকল দেশ, সকল সীমানা এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে লিখেছি। আমি এসবের মানচিত্র এঁকেছি সযত্ন প্রয়াসে এবং সেখানে শহরসমূহ, নদীসমূহ, হ্রদ, ফসলাদি, কৃষ্টির ধরন, রাস্তাঘাট, একস্থান থেকে অন্যস্থানের দূরত্ব, বাণিজ্যিক দ্রব্যসমূহ এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় যা রাজন্যবর্গ ও তাদের সহযোগী ও সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে পারে তা নির্দেশ করেছি। সম্ভবতঃ এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মানচিত্র। মুসলিম পরিব্রাজক আবু রায়হান আল বিরুনী, ইবনে বতুতা ও আবুল হোসাইন ঐসব লোকদের মাঝে অনন্য যারা ভূবিদ্যার ইতিহাস রচনার জন্য কষ্টকর অভিযাত্রা আর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্যাদি রেখে গেছেন। বিজ্ঞানের দ্বিগ্বিদিক জয়যাত্রায় তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

••হায় অতীত! সোনালি অতীত!
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা যেকোন মুসলিম তরুণের হৃদয়ে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। কি সুন্দর, গৌরবময় ঐতিহ্যশালী আমাদের অতীত। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ইতিহাসে কি স্বর্ণোজ্জ্বল আমাদের অবদান! কিন্তু এ যে কেবলই অতীত। বিগত কয়েকশত বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান আমাদের নেই। আমরা কি কেবলই অতীতের স্মৃতিচারণ করে জাবর কাটবো? না; কক্ষণোই নয়।
আজ প্রতিটি মুসলিম তরুণকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মুসলিম ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেলতে হবে। পাশ্চাত্য অরিয়েন্টালিস্ট পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আমাদের ইতিহাস ও পণ্ডিতবর্গের নামের যে বিপুল বিকৃতি ঘটেছে তার হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে প্রকৃত সত্য। আর তা ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র।
আফসোস আর হতাশার কৃষ্ণ-পর্বতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াবার কোন অবকাশ আমাদের নেই। এখন সময় সিদ্ধান্তের। নতুন যুগের আলবেরুনী, খারেজমী, জাবির ইবনে হাইয়ানদের এগিয়ে আসার দিন।

উঠুন, জেগে উঠুন, অন্ততঃ রজার বেকনের মতো জেগে উঠুন। অক্সফোর্ডের ছাত্র রজার বেকন কর্ডোভায় গিয়ে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনীষার সংস্পর্শে থেকে সব উপকরণ বগলদাবা করে যদি নব্য ইউরোপের রেনেসাঁর জন্ম দিতে পারে, বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমানের মাঝে কি এমন একজনও নেই যে আবার ফিরিয়ে আনবে আমাদের সোনালি অতীত?

লেখক:
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 


•গ্রন্থ নির্দেশনা :
1. Western Civilisation through Muslim Eyes; Sayid Mujtaba Rukni Musawilari, 1978 Iran.
2. Origin And Development of Experimental science; Dr. Muin-Ud-Din Ahmad Khan; BIIT, 1998.
3. Classification of Sciences in Islamic Thought; Al Najjar; AJISS; volume 13, Number-1 Washington DC. 1996. (প্রবন্ধ)
4. আলবেরুনী; এম আকবর আলী ই. ফা. বা প্রকাশনা; ১৯৮২.
5. জাবির ইবনে হাইয়ান; এম. আকবর আলী ই, ফা, বা প্রকাশনা; ১৯৮২।

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

মাহে রমজানে রোজার প্রয়োজনীয় যাবতীয় মাসআলা || একজন রোজাদারের যে সকল করণীয় ও বর্জনীয় কাজ


“রমজানে রোজার যাবতীয় মাসআলা”

‘একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ’


রমযানুল মুবারক মাস সেসব নেয়ামাতসমূহের মধ্যে একটি নেয়ামাত যা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন। এ মাসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স.-এর মত নেয়ামাত আমরা পেয়েছি। এ মাসেই কুরআন মাজীদ দেয়া হয়েছে, যা হেদায়াত, ফুরকান, রহমত, নূর ও শেফা। মুসলিম উম্মাহর প্রাণস্পন্দন ও উন্নতির নিগূঢ় রহস্য ফী সাবিলিল্লাহর মাঝেই পাওয়া যায় প্রথম মানুষের বা মানবতার হৃদয় জয় করার জন্য জিহাদ, পরে সাংস্কৃতিক বিজয়ের জন্য জিহাদ-আর এ সকল জিহাদের সাথে সাথে চূড়ান্ত কামিয়াবীর জন্য আপন নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে জিহাদ। যাতে করে অর্জিত হয় তাকওয়া, ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং সাথে সাথে সমষ্টির তাকওয়া; রাতে জাগরণে শীতের রাতে ইশকের সাথে ওযু করা, লাইফে সাদাকাত (দান-খয়রাত) দিয়ানত, আমানত, আদালত (সুবিচার করা), শুজাআত (নির্ভীকতা, উথুয়াত (ভ্রাতৃত্ব) ও মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান। পবিত্র মাহে রমজানে একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ আলোকপাত করা হলো।

রোজা অবস্থায় যখন কাফফারা ওয়াজিব হয়:

১. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কোনো খাদ্য আহার করলে অথবা ওষুধ খেলে অথবা সিঙ্গা কিংবা সুরমা লাগানোর পর অথবা গীবত করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত আহার বা পান করলে।
২. প্রিয়জনের প্রিয় থুতু ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি খেলে।
৪. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী মিলন করলে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্ত থাকলে তার ওপরও কাজা-কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর স্ত্রী রাজি না থাকলে বরং তার সঙ্গে জোরপূর্বক করা হলে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।
৫. কামভাবের সঙ্গে স্ত্রীকে স্পর্শ করল অথবা চুম্বল করল বা আলিঙ্গন করল, তবে বীর্যপাত হয়নি, কিন্তু সে মনে করল, রোজা ভেঙে গেছে। ফলে ইচ্ছাকৃত পানাহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা এবং কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। (বাদায়িউস সানায়ে ২/৫৫৮)
৬. কেউ গোঁফে তেল লাগালো আর মনে করল রোজা ভেঙে গেছে, অতঃপর ইচ্ছাকৃত আহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে। (বাদায়িস সানায়ে ২/২৫৮)
৭. বিনা ওজরে একই রমজানে এক বা একাধিক রোজা রাখার পর ভেঙ্গে ফেললে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর রোজাগুলো একাধিক রমজানের হলে প্রত্যেক রমজানের জন্য এক একটি করে কাফফারা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুখতার: ৩/৩)


রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ:

১. ইচ্ছা করে বমি করা
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে
৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
৯. মুখ ভরে বমি করলে
১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে
১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে
১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।


যেসব কারনে রোজা কাজা করতে হয়:
১. ইচ্ছা করে বমি করা,
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা,
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব,
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে,
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে,
৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে,
৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে,
৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে,
৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে,
১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে,
১১. মুখ ভরে বমি করলে,
১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে,
১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে,
১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে,
১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে,
১৬. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে,
১৭. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে।


যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।


যে সব কারণে রোজা ভাঙ্গে না/রোজার ক্ষতি হয় না:
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলা-বালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।

বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি


ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন

জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি 

জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বারংবার নামাজ কায়েমের পরই জাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিনের নির্দেশেই জাকাত আদায়ের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) সাহাবীগণকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এজন্যে একটা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। কেন জাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টন তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই জাকাত গণ্য হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্যে জাকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। জাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সব ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু সাধারণ করের ক্ষেত্রে কোন নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নেই।

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে পার্থক্য:

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে অন্তত চারটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যথা:


প্রথমত: নির্দিষ্ট আয়ের বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে নির্ধারিত হারে কর প্রদান করতে হয়। এ জন্য করদাতা কোন প্রত্যক্ষ উপকার প্রত্যাশা করতে পারে না। সরকার করের মাধ্যমে অর্জিত এই অর্থ দরিদ্র ও অভাবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যয়ের জন্যে বাধ্য থাকেন না। পক্ষান্তরে জাকাত হিসেবে আদায়কৃত অর্থ অবশ্যই আল-কুরআনে নির্দেশিত লোকদের মধ্যেই বন্টন করতে বা তাদের জন্যেই ব্যবহৃত হবে।


দ্বিতীয়ত: জাকাতের অর্থ রাষ্ট্রীয় সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু করের অর্থ যেকোন কাজে ব্যয়ের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা সরকারের রয়েছে।


তৃতীয়ত: জাকাত প্রদান শুধুমাত্র বিত্তশালী বা সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্যেই বাধ্যতামূলক। কিন্তু কর বিশেষত পরোক্ষ কর, সর্বসাধারণের উপর আরোপিত হয়ে থাকে। অধিকন্তু প্রত্যক্ষ করেরও বিরাট অংশ জনসাধারণের উপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।


চতুর্থত: জাকাতের হার পূর্বনির্ধারিত এবং স্থির। কিন্তু করের হার স্থির নয়। যে কোন সময়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী করের হার ও করযোগ্য বস্তু বা সামগ্রীর পরিবর্তন হয়ে থাকে।


সুতরাং, জাকাতকে কোনক্রমেই প্রচলিত অর্থে সাধারণ কর হিসেবে গণ্য করা যায় না বা তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।

যে সব বস্তুর উপর যাকাত ধার্য:

ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর উপর জাকাত ধার্য হয়েছে সেগুলি হলো-


১. ব্যাংকে/ হাতে সঞ্চিত/ জমাকৃত অর্থ;

২. সোনা, রূপা, এবং সোনা-রূপা দ্বারা তৈরি অলংকার;

৩. ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী:

৪. জমির ফসল;

৫. খনিজ উৎপাদন; এবং

৬. সব ধরনের গবাদি পশু।


উপরোক্ত দ্রব্যসামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যখন কোন মুসলমান অর্জন করে তখন তাকে জাকাত দিতে হয়। এই পরিমাণকে নিসাব বলে। নিসাবের সীমা বা পরিমাণ দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। একইভাবে জাকাতের হারও দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। জাকাতের সর্বনিম্ন হার শতকরা ২.৫%।

•জাকাতের খাত ও বন্টন নীতি:

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে জাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-


"দান-খয়রাত তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন (সত্যের প্রতি) সম্প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরজ এবং আল্লাহ সব জানেন ও বুঝেন।" (সূরা আত-তাওবা: ৬০ আয়াত)


উপরের আয়াত হতে আট শ্রেণীর লোকদের মধ্যে জাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়। সেগুলি হচ্ছে:


১. দরিদ্র জনসাধারণ;

২. অভাবী ব্যক্তি;

৩. যে সকল কর্মচারী জাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছে;

৪. নও-মুসলিম;

৫. ক্রীতদাস মুক্তি;

৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি;

৭. আল্লাহর পথে, এবং

৮. মুসাফির।


এই আটটি খাতের মধ্যে ছয়টিই দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দুটি খাতও (৩ ও ৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনা একটি কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ কাজ। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এটাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। সুতরাং, তাদের বেতন এই উৎস হতেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া যেসব ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে লিপ্ত তারাও অন্য কোনভাবে জীবিকা অর্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত। সুতরাং, উপরে বর্ণিত আটটি খাতেই যদি জাকাতের অর্থ ব্যয় হয় তাহলে দরিদ্রতা দূর হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার নিরসন হবে।

সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ে রাসুল সাঃ এর ভূমিকা:

রাসূলে করীম (সা) নিশ্চিতভাবেই জানতেন, ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাকাতের প্রতিষ্ঠা হলে বহুবিধ কল্যাণ সাধিত হবে। তাই তিনি জাকাত যথাযথ আদায় ও তার সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে কঠোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ের জন্যে রাসূলে করীম (সা) নবম ও দশম হিজরিতে আরব ভূখন্ডের বারোটি এলাকায় বারোজন প্রখ্যাত সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন।

অনুরূপভাবে পনেরোটি প্রধান গোত্র হতে জাকাত আদায়ের দায়িত্ব তিনি বারোজন খ্যাতনামা সাহাবীর উপর অর্পণ করেছিলেন।

রাসুল সাঃ এর বিলি বন্টন যারা করতেন:

জাকাত যথাযথ বিলি বন্টনের জন্যেও নবীজীর (সা) উদ্যোগেই বলিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল যা আজকের যেকোন উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে তুলনীয়। এ থেকেই বোঝা যায় জাকাত বায়তুলমালের কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে নিচে বর্ণিত আট শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। এরা হচ্ছে-


১. সায়ী = গবাদি পশুর জাকাত সংগ্রাহক;

২. কাতিব = করণিক;

৩. কাসাম = বন্টনকারী;

৪. আশির = জাকাত প্রদানকারী ও জাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী;

৫. আরিফ = জাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী;

৬. হাসিব = হিসাব রক্ষক;

৭. হাফিজ = জাকাতের বস্তু ও অর্থ সংরক্ষক; এবং

৮. কায়াল = জাকাতের পরিমাণ নির্ণয় ও ওজনকারী।

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য:

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বহুবিধ। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান এবং মুখ্য হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেওয়া। ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু নিন্দাই করে না, বরং তা দূরীভূত করার পদক্ষেপও অবলম্বন করতে বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাঁদের সম্পদের একটা অংশ ব্যয় করা উচিত। এর ফলে শুধু অসহায় ও দুস্থ মানবতার কল্যাণ হবে তাই নয়, আয়-বন্টনের বৈষম্যও হ্রাস পাবে। জাকাত প্রদানের ফলে সম্পদশালী মুসলিমের মন হতে ধন-সম্পদের লালসা দূরীভূত হবে। দরিদ্রদের অভাব মোচনের জন্যে নিজেদের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে তারা সচেতন হবে। বিত্তবান মুসলমানদের আল্লাহ সৎপথে তাদের সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বার্ষিক উদ্বৃত্ত অর্থ হতে নির্দিষ্ট হারে একটা অংশ দরিদ্র এবং দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের মধ্যে তারা বিতরণ করবেন। এর ফলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবেন।


জাকাত মজুতদারি বন্ধ করারও এক প্রধান ও বলিষ্ঠ উপায়। মজুতকৃত সম্পদের উপরই জাকাত হিসেব করা হয়ে থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এবং মজুত সম্পদ যেকোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়ে তাকে। অবৈধভাবে অর্থ মজুত করার ফলে নানারকম সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা এর প্রকৃষ্ট নজির। অল্প কিছু লোকের হাতে বিপুল অবৈধ ও কালো টাকা জমেছিল। সরকারের এমন কোন কৌশল বা পদ্ধতি ছিল না যার দ্বারা এই অবৈধ অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব ছিল। ফলে এসবের ব্যয় ও ব্যবহারের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়নি। পরিণামে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির ও সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যের।


কোন পদ্ধতিই সার্থকভাবে উপরোক্ত সমস্যার মুকাবিলা করতে সক্ষম নয়। একমাত্র ইসলামেই তার সমাধান রয়েছে। কারণ বিত্তবানদের জন্যে তাদের মজুতকৃত অর্থ বা সম্পদের একটা অংশ নিছক বিলিয়ে দেবার মতো কোন পার্থিব কারণ নেই। কিন্তু একজন মুসলমানের আল্লাহ ও আখিরাতের ভয় রয়েছে। উপরন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তিত আইনে সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতাও রয়েছে মজুত সম্পদকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যয়, বিতরণ বা সরকারের কাছে সমর্পণে বাধ্য করতে। এর ফলে বিত্তবানদের সামনে দু'টি মাত্র পথ খোলা থাকবে-


১. শিল্প বা ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করা, অথবা

২. ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী তা ব্যয় করা।


জাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দারিদ্র্য দূর করা। দারিদ্র্য মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্রবিশেষে তা কুফরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতির সৃষ্টি হয় দরিদ্রতার ফলে। পরিণামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দরিদ্রতার জন্যে। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে জাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে। জাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।


একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের লোকদের মধ্যে যখন জাকাতের অর্থসামগ্রী বন্টন করে দেওয়া হয় তখন শুধু যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নয়, বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। দরিদ্র ও দুর্গত লোকদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। বেকারত্ব তাদের নিত্যসঙ্গী। জাকাত প্রাপ্তির ফলে তাদের হাতে অর্থাগম হলে বাজারে কার্যকর চাহিদার সৃষ্টি হয়। এরই ফলে দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নির্মাণ ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অনুকূল পরিবেশ। ফলশ্রুতিতে প্রচলিত সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে আয়গত পার্থক্যও হ্রাস পেতে থাকে।

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস “ওরা চারজন” || কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ

ওরা চারজন
মেছবাহ উদ্দিন মারুফ 

 মারুফ, আব্দুল্লাহ, তৌহিদ ও আরমান। ওরা চারজন ছোটকাল থেকে খুব ভালো বন্ধু। ওরা যেনো চারজন একই মায়ের সন্তান। গ্রামে নতুন কেউ এলে তারা বুঝতো না এরা বন্ধু নাকি সহোদর, কারণ তাদের চলাফেরা অন্যান্য বন্ধুর মতো না। এরা ছোটকাল থেকে একসাথে খেতো, একসাথে থাকতো। তাদের এই বন্ধনটা যেন চারটি খুঁটি দিয়ে তৈরিকৃত দালান। যার একপাশ ভেঙে গেলে অপর তিনটি পাশ ধ্বসে পড়ার সম্ভবনা আছে। তাদের মাঝেও প্রচুর ঝগড়া হতো, এমনকি মারামারি ও হতো। কিন্তু সকালে ঝগড়া হলে বিকালে আবার তাদের একসাথে খেলার মাঠে দেখা যেত, তাই তাদের মাঝে ঝগড়াঝাটি হলে কেউ তা সমাধান করতে আসতো না, সবাই জানে এরা একটু পর ঠিক হয়ে যাবে, অযথা ওদের কাছে গিয়ে নিজের সময় অপচয় করে লাভ কি! বরং ওদের ঝগড়াঝাটি সবাই উপভোগ করে, ওরা সকালে ঝগড়া করে যখন বিকালে চা খেতে যেতো তখন মানুষ তাদের ব্যাঙ্গ করে বলতো 

-কিরে তোরা না ঝগড়া করলি,ফের একসাথ হয়ে গেলি!

তখন ওরা চারজন বলতো, 

-আমরা একসাথ হলে তোমাদের কি? দেখাও তো আমাদের মতো এমন বন্ধু কোথাও?


 তারা চারজন একই বিদ্যালয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ে ও তাদের একই দশা! এক টেবিলে বসা, একসাথে স্কুলে আসা, স্কুল চুরিসহ তাদের সব কাজ একসাথে হতো। স্যার একদিন ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, তখন এক-এক করে সবার শেষে আসলো চারজন বন্ধুর পালা, এক জনকে ডাকার সাথে সাথে  চারজনই উঠে দাড়ালো, স্যার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো 

-ডাকলাম একজনকে চারজন উঠলি কেন?

তখন চারজন সমস্বরে বলে উঠলো 

-আমাদের চারজনের লক্ষ্য একটাই!

স্যার বললেন, 

-বলতো দেখি তোদের চারজনের লক্ষ্যটা কি?

ওরা আবার সমস্বরে বললো, 

-আমরা চারজনই দেশের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হবো।

তখন স্যার হো হো করে হাসতে লাগলো, স্যারের সাথে ক্লাসের সবাই ও হাসতে থাকলো কিছুক্ষণ। হাসি থামিয়ে স্যার বললো, 

-তোরা দেশের সেরা গোয়েন্দা হবি, আরে বেটা তোরা গ্রামের সেরা গোয়েন্দাও হতে পারবিনা। 

চারবন্ধু খুবই অপমান বোধ করলো, বাকী ক্লাস না করে স্যার যাওয়ার সাথে সাথে ওরা বাড়ির পথ ধরলো। পথেই তারা সিন্ধান্ত নেয়, তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে দেশের সেরা গোয়েন্দা হওয়া। 


এর মধ্যে তারা প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে গেলো, দিনের বেলায় আড্ডা দেওয়া রাতে পড়াশোনা করেই তাদের সময় যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলো আরমান। কোনো কথা শুনলে চটপট উত্তর দিতো না, অনেক ভেবে চিন্তে সঠিক উত্তরটি দিতো। এলাকায় এবং স্কুলে তার সম্মান ছিলো মেধাবী ছাত্র হিসেবে, স্কুলের বাবুল স্যার তো তাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে ডাকতো। আর বাকী তিন বন্ধু মোটামুটি মেধাবী ছিলো, তাঁর মধ্যে কিছুটা হাবলা প্রকৃতির ছিলো মারুফ। 

সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা, তাই স্কুলের স্যারেরা চায় তাদের নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে। যেনো ছাত্রদের মন প্রফুল্ল থাকে, পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে পারে। বাবুল স্যার ক্লাসে আসলেন এবং এক-এক করে সবার মতামত নিলেন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। যে যার মতো করে মতামত দিলো। স্যারের মতামত গুলো মনপুত হলো না। স্যার তখন বলে উঠলেন

-আমার আইনস্টাইন কোথায়? তাকে দেখছি না যে? আজ আসেনি? 

ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে আরমানের কন্ঠস্বর শোনা গেলো, 

-স্যার আসতে পারি? 

তখন স্যার 'অবশ্যই' বলে অনুমতি দিলেন। আরমান শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলো এবং বসে পড়লো। তখন স্যার আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার এতো দেরি হলো কেন বলোতো? 

-স্যার রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো, তাই আসতে দেরি হলো।

আবারো স্যার বললো, 

-তোমায় ছাড়া একটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারছি না। আমরা স্কুল থেকে ঘুরতে যাবো তোমাদের নিয়ে, বলোতো কোথায় যাওয়া যায়? 

তখন আরমান বিনয়ের সাথে বললো, 

-স্যার আমায় একটু সময় দেওয়া যায়?

স্যার বললেন, 

-অবশ্যই, তুমি ভেবে আমাকে বলো। ছুটির সময় আমি আবার আসবো তোমার মতামত জানতে, কারণ আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। 

এই বলে স্যার চলে গেলেন। 


আরমান অনেকক্ষণ ভেবে সিন্ধান্ত নিলো এবার তারা জঙ্গলে যাবে। স্যার এলেন ছুটির সময় আবার আরমানের মতামত জানতে, এসে বললেন, 

-বাবা তোমার মতামত জানাও। 

তখন আরমান বললো 

-স্যার আমরা জঙ্গলে যেতে চাই। 

তখন স্যার মুখে প্রফুল্লতা এনে বললেন, 

-আমি জানতাম, আমার আইনস্টাইন ছাড়া কেউ এই সমাধান দিতে পারবে না!


স্কুল থেকে যাওয়ার তারিখ ঠিক হলো, তারিখ অনুযায়ী সবাই তৈরি হয়ে নিলো। কে জানতো? আরমানের দেওয়া মতামতটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

স্কুল থেকে গাড়ি ছাড়লো ছয়টা নাগাদ, তারা জঙ্গলে পৌঁছায় দশটার দিকে। স্যার আরমানকে দায়িত্ব দিলো সবাইকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। আরমান বাস থেকে নেমে সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করালো এবং সকলের উদ্দেশ্য বললো, 

-প্রিয় বন্ধুরা, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছি। আজ আমাদের আনন্দের দিন, তবে জঙ্গলে চলার পথটা অত্যন্ত দুর্গম তা  আমাদের সকলের জানা। তাই সবাইকে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে চলাফেরা করতে হবে এবং দলবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করবে। 

তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

-অবশ্যই। 

এরপর আরমান সবাইকে সাত দলে ভাগ করে দিলো এবং প্রত্যেক দলের সাথে দিলো একজন করে শিক্ষক। আর ওরা চারজনে মিলে করলো একদল, তারা সবার পিছনে থাকবে। 


খুব সুন্দরভাবে চলতে থাকলো ওদের জমকালো আয়োজন। এরমধ্যে তারা চলতে লাগতো জঙ্গলের ভেতর। পথিমধ্যে হঠাৎ আরমান চলে যায় প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তিন বন্ধু দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আরমানের জন্য, কিন্তু আরমানের আসার কোনো খবর নাই। এইদিকে তিন বন্ধু দাড়িয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে তারা আরমানকে খুঁজতে লাগলো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধা ছুঁইছুঁই। এখনো আরমানের কোনো হদিস মেলেনি।ঘোরাঘুরি পর্ব শেষে সবাই আগের জায়গায় একত্রিত হলো, কিন্তু এই চার বন্ধু কোথায় গেলো? এখনো আসছে না কেন? সবাইকে একরাশ চিন্তায় ঘিরে ধরলো। সবাইকে এক জায়গায় রেখে বাবুল স্যার একাই গেল তাদের খুঁজতে, কিছু দুর যাওয়ার পরে আরমানকে ছাড়া বাকি তিনজনকে পেল খুবই বিমর্ষ অবস্থায়! স্যার তাদের কারণ  জিজ্ঞেস করলে তারা ঘটনার বিস্তারিত জানায়, স্যারসহ আরমানকে খুজতে থাকে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হঠাৎ একটি কর্কশ আওয়াজ শুনতে পায়, 

-হে পথচারীরা তোমরা এই নিষিদ্ধ জঙ্গলে কেন এলে? দ্রুত তোমরা পালাও না-হয় সবাই মরবে!

এই বলে কন্ঠটি মিশে গেলো, এরপর একটু দুরে তীব্রবেগে  আগুন জ্বলে উঠলো। তারা ভয় পেয়ে সেই জায়গাটি ত্যাগ করলো। মনের ভিতর একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। গাড়ির মধ্যে কারো কোনো কথা নেই, ড্রাইভার যেন কতগুলো লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন নিজ গন্তব্যে এলো, যে যার মতো করে বাড়ির পথ ধরলো আনন্দের দিনটা তাদের বিষাদে পরিণত হলো। বহু পত্রিকায় ছাপানো হলো আরমানের নিখোঁজ সংবাদ, কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারেনি। 


বাকি তিন বন্ধুর বেহাল দশা! খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, বয়সের চাপে তাদের দেহ যেন নুয়ে পড়েছে! সবাই বুঝাচ্ছে আরমান একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ওরা কিছুই মানতে চায়না আরমান কে ছাড়া। 

এভাবে কিছুটা দিন পেরিয়ে গেলো হঠাৎ করে একদিন মারুফের মোবাইলে একটা কল আসলো। কলটি রিসিভ করতে পারেনি বাইরে ছিলো বিধায়। এসেই কল দিলো, ওপার থেকে ভেসে আসলো চিরচেনা কন্ঠ! তা হলো তার বন্ধু আরমানের। তাদের কথা শেষ হলো তিন চার বাক্যে। তা হলো, 

-দোস্ত আমি এখনো বেঁচে আছি, যেখান থেকে হারিয়ে গেছি ঠিক ঐখানে চলে আস আজ রাত দুটোর মধ্যে। রঙ মাখানো ইটের নিচে একটা কাগজ পাবি, ঐ অনুযায়ী কাজ করিস, বিদায়! 

বলে কলটা কেটে দিলো। মারুফ আব্দুল্লাহ এবং তৌহিদকে ব্যাপারটি জানালো। তারা কেউ বিশ্বাস করছে না, বললো

-বন্ধু মজা করা ঠিক না কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। 

তারা মানতে চাইছে না কোনো কিছুতেই, একটা পর্যায়ে মারুফ রেগেমেগে বললো তোরা থাক আমি একাই যাচ্ছি ওর উদ্ধারকাজে, এখন চলি এই বলে সে হাঁটা ধরলো। ওরা তখন চিন্তা করলো, মারুফ তেমন একটা রাগ করেনা, যখন ওর হৃদয়ে লাগে ঠিক তখনই রাগ করে। তাই তারা মারুফের পিছু নিলো। দেখলো কিছুদূর যাওয়ার পরে মারুফ চোখ মুছতেছে। তখন তারা ভাবলো, মারুফের কথাটি সত্য, না-হয় কান্না করতো না। কারণ অতি অল্পে কখনো মারুফ কাঁদেনা, তারা ছোটকাল থেকে তাকে চেনে। তারা সামনে গিয়ে বললো, 

-দোস্ত চল আমরাও যাবো। 

মারুফ তখন বললো, 

-তোরা গেলেও আমি নেবো না। গেলে নিজেদের মতো যা, আমি আমার মতো গেলাম। 

ওরা ভালোভাবে জানে মারুফকে যতই রিকুয়েষ্ট করুক, আর লাভ হবেনা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাকে ফলো করবে যখন সে বের হবে তখন তার পিছু নেবে।যেই কথা সেই অনুযায়ী কাজ। ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো কতক্ষণে বাহির হয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে রাত বারোটা, তার বাহির হওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। তৌহিদ বললো, 

-দোস্ত, মারুফ আমাদের সেইরকম ভাবে বোকা বানালো! বুঝলি? চল বাড়ি চলে যাই

-আব্দুল্লাহ বললো, না বোকা বানায়নি। তার চোখের জল মিথ্যা না। মন চাইলে চলে যা, আমি যাবো না। প্রয়োজনে সারারাত এখানে বসে থাকবো। 

তৌহিদও আর কিছু না বলে বসে রইলো।ঠিক বারোটা ত্রিশ মিনিটে  মারুফের দরজার আওয়াজ হলো, তখন আবদুল্লাহ বললো, 

-ঐ দেখ মারুফ বাহির হচ্ছে। 

তখন তারা কিছুটা দুরত্ব নিয়ে পথ চলতে থাকলো। মারুফ যখন বাইকে উঠলো তখন ওরা বললো, 

-কিরে আমাদের নিবি না? 

মারুফ বললো, 

-নিজের মতো করে যা।

মারুফ বাইক স্টার্ট দিলো, তৌহিদও  আবদুল্লাহ কে সাথে নিয়ে আরেকটা বাইক স্টার্ট করে রওয়ানা দিলো।


দেড়টার মধ্যে সেই স্থানে পৌঁছে যায় ওরা, বাইক দুটোকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসলো এবং সেই জায়গায় গেলো যেইখান থেকে আরমান হারিয়ে গিয়েছিল। ওখানে আরমানের কথা অনুযায়ী রঙ মাখা ইট থাকার কথা, কিন্তু তা পেলোনা! হঠাৎ তৌহিদ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো এবং মৃদু চিৎকার করলো। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো একটা রঙিন ইট, তখন মারুফ কে  বললো, 

-এইতো রঙিন ইট পেয়ে গেছি। 

মারুফ বললো, 

-ধাক্কা খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোকে। 

তখন ইটটি উল্টালো, আরমানের কথা অনুযায়ী একটা কাগজ ফেলো।আব্দুল্লাহকে পড়তে দিলো, আবদুল্লাহ চিঠি খানা পড়তে লাগলো:

"প্রিয় বন্ধুরা,

প্রথমে আমার সালাম নিস, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি যখন প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই, ঠিক তখন মৃদু আওয়াজে একটি মেয়েলি গলা শুনতে পাই, বাঁচাও বাঁচাও! একবার দুইবার নয় অনেকবার শুনতে পাই, তাই আমি আগ্রহী হয়ে সেদিকে যাই। তখন যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলামনা! দেখলাম, একটি মেয়েকে বস্তাবন্দি করা হচ্ছে। তখন আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, তোমরা কারা? কাপুরুষের মতো কেনো একটা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও ওকে। তারা বললো, তুই কেরে? আর নিষিদ্ধ জঙ্গলে কি করিস? আমি কিছু বলতে যাবো তখন শক্ত কিছু একটার বাড়ি অনুভব করলাম। আমি অজ্ঞান হইনি, কিন্তু ওরা ভেবেছিলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। এই সুযোগে আমি ওদের কিছু কথোপকথন শুনে নিয়েছি। একজন বলতেছে মেরে রেখে যাই। আরেকজন বলতেছে তুই জানিসনা এইখানকার কিছুই, বসের হুকুম কেউ অমান্য করেনা। চল একে বসের কাছে নিয়ে যাই। আমাকে তারা কিছু সবুজ ঘাসের সামনে রাখলো। এরপর একটি লোহার ধাতু নিলো বট গাছের নিচ থেকে। সেটা দিয়ে বৃত্তাকারে মাটি খনন করলো এবং দুজনে ধরাধরি করে একটি গামলা উঠালো। তখন দেখলাম একটি সুড়ঙ্গ পথ, যেখানে আছে দুটো সিড়ি একটা লাল অপরটি সবুজ তারা সবুজটি দিয়ে নামলো এবং ভয়ংকর আওয়াজে সাইরেন বেজে উঠলো। এরপর আমাকে এবং মেয়েটিকে ধপাস করে নিচে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করিনি ভয়ে। কারণ তারা জানে আমি অজ্ঞান। তাদের বস লোকটি বললো কিরে রাহুল শিকার আনতে গেলি একটা, এখন নিয়ে এলি দু'টো ব্যাপারটা কি খুলে বলতো দেখি, তখন রাহুল পুরো ঘটনা বললো। মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো এবং বস লোকটা বললো মালটাকে স্পে কর। আমাকে কি দিয়ে স্পে করলো জানিনা, তবে প্রথম স্পেতে আমি পচন্ড রকম কেশে উঠলাম। তখন বস লোকটা চিৎকার মেরে বলে উঠলো, রাহুল মালটা এনে ভালো কাজ করছিস, এর নার্ভ অনেক ভালো। যেখানে পাঁচ ছয়বার স্পে করার পরেও জ্ঞান ফিরানো কষ্ট হয়ে যায়। আর সেখানে একবারে ওর জ্ঞান ফিরে এলো। একে আমাদের কাজে ব্যবহার করবো। বস লোকটা রাহুলকে বললো এর মুখে আর স্পে করিস না, শুধু পানি ছিটা, রাহুল আমার মুখে পানি ছিটাতে লাগলো। আমি চিৎকার মেরে উঠে দাড়াই বলতে থাকি আমি এখন কোথায়? বস লোকটা বললো, দেখো যুবক আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো তার যদি ঠিকঠাক উত্তর দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো, না-হয় এখানে পঁচে মরতে হবে তোমায়। বলো, এখানে কেনো এসেছো? আমি শিক্ষা সফরে এসেছি  বলেছি এবং নানাবিধ কথা জিজ্ঞেস করার পরে এবার জিজ্ঞেস করলো পড়াশোনার ব্যাপারে কোথায় পড়ি কোন শ্রেণীতে পড়ি, আমি যখন বলেছি এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন ওর চোখ গুলো রসের গোল্লার মতো করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো কোন বিভাগ? আমি যখন বললাম বিজ্ঞান, তখন সে রাহুলকে বললো ঠিক লোককে নিয়ে এসেছিস। এবার সামান্য একে স্মৃতি হারানোর ইনজেকশনটা পুশড করে দে। আমি তার দিকে ভয়ার্ত চেহারায় তাকালে সে বাছাধন ভয় পেয়োনা অল্প কিছুক্ষণ কষ্ট হবে। এরপর তুমি আমাদেরই একজন হয়ে যাবে। এই বলে বস লোকটা চলে গেলো, রাহুল আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো একটা রুমে। যে রুমটা গ্লাস দিয়ে তৈরি, সেখানে অনেক গুলো মানুষ দেখতে পেলাম তারা আমায় দেখে বলে উঠলো রাহুল আমাদের নতুন অতিথি এলো বুঝি। রাহুল তাদের থেকে দুজনকে ডাকলো ইশারায় এবং বললো আমাকে শক্ত করে ধরতে। রাহুল আমার দিকে আগাচ্ছে  একটা ইনজেকশন নিয়ে পুশড করবে এইসময় আমি আমাকে ধরে রাখা দুজনকে সজোরে লাথি মারলাম, তখন তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাহুল কোনো দিকে না তাকিয়ে আমায় শক্ত করে ধরে ইনজেকশনটা পুশড করে, আমার নড়াচড়ার কারণে ইনজেকশনটা তোশকে পুশড হয়ে যায়, মনে হয় এখনো তোশকটি স্মৃতি হারিয়ে আছে। ইনজেকশন যে আমার শরীরে পুশড হয়নি তা রাহুল জানতো না। আমিও আমার স্মৃতি হারিয়ে ফেলছি ঐরকম অভিনয় করি। তাদের সকল কথা মেনে চলি, যা করতে বলা হয় তাই ঠিকঠাক ভাবে করে দিই। এখন তারা জানে আমি তাদের আওতাধীন। আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাহির হয়। চাইলে তখনই পালিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমি আসিনি তাদের পরিকল্পনা আমি জেনে গেছি তাই। আসি নাই কারণ তারা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র। যারা বিশ্ব দখল করতে চায়। তাই তারা বিশ্বের জ্ঞানী লোকদের নিয়ে এসে ইনজেকশন পুশড করে নিজেরদের অধীনে  নিয়ে আসে।আমি চাচ্ছি তাদের ঘৃণ্য স্বপ্ন প্রাসাদ ভেঙে দিতে। কারণ ওদের সকল ডকুমেন্ট আমার হাতে। এই যাত্রায় তোদের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই আজ সকালে মারুফকে কল করি, এরা এখানকার সকল দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেছে। আর তিনজন প্রহরী রেখে গেছে, তোরা চাইলে রাত দুটোয় আঘাত হানা সম্ভব, তোরা যেখানে আছিস, সেখান থেকে দুইশো হাত সামনে হেটে আয়। এরপর একটা বটগাছ পাবি, তার নিচে পাবি লোহার একটা ধাতু সেটা দিয়ে সবুজ ঘাসের চারদিকে বৃত্তাকারে খুঁড়ে ফেল ভালোভাবে। একটা গামলা পাবি দু'জনে শক্তকরে গামলাটি উঠা। এরপর লাল সিড়ি দিয়ে নামবি কারণ লাল সিড়ি শুধু তাদের বসের ব্যবহারের অনুমতি আছে অন্য কারো না, তাহলে শুরুতে বিপদ মুক্ত ভাবে আসতে পারবি। নেমেই দুজন প্রহরী দেখতে পাবি তারা তোদের কুর্নিশ করতে আসবে বস ভেবে। তখনই তাদের মোকাবিলা করবি সুন্দর ভাবে। চিৎকার মেরে বলতে থাকবি, শুভ কোথায় তোরা? এই অবস্থা কেনো আস্তানার? তখন শুভ আসলে মুখ চেপে বেধে অজ্ঞান করে দিবি। বাকি যা করার আমি করবো। আজ এই পর্যন্ত রাখি।"

আবদুল্লাহ পড়া শেষ করলে সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সবাই একসাথে বলে উঠলো, 

-বাবুল স্যার ঠিকই বলতো, আরমান হলো আমাদের আইনস্টাইন। 

এরমধ্যে মারুফের মনে পড়লো তার দুলাভাইয়ের কথা। তার দুলাভাই শীর্ষ পর্যায়ের সিআইডি অফিসার, সে দেরি না করে দুলাভাইকে ফোন দিলো এবং তাদের লোকেশন জানিয়ে রাখলো। বললো, আগামী দুই ঘন্টার ভিতরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এই বলে কল কেটে দিয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। 

তারা অভিযানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আরমানের দেওয়া চিত্র অনুযায়ী তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছলো। প্রহরী তিনজনকে অজ্ঞান করে বেঁধে রাখলো। এরপর ওরা আরমান কে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে এবং যাবতীয় ডকুমেন্ট নিয়ে নিলো এবং প্রাসাদের তালা মেরে উপরের দিকে চলে আসলো। কিছুদুর যাওয়ার পরে মারফের দুলাভাই কে দেখলো একটা জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বললো, 

-এতো রাতে না আসলে ও পারতেন। 

তখন তিনি বললেন, 

-সিআইডির কোনো রাতদিন নেই। তাদের জন্য সর্বক্ষণই হলো দিন। 

মারুফের দুলাভাই আরমানের সাথে কথা বললো এবং বিস্তারিত জেনে নিলো। সাথে সাথে পুলিশ হের্ডকোয়াটারে ফোন দিয়ে জানালো এবং বললো একটি কম্পিউটার সহ পুলিশ পাঠানোর জন্য। পুলিশ আসলো কম্পিউটার নিয়ে। কম্পিউটার আরমানের নিয়ে আসা হার্ডডিক্সটি সেট করা হলো, তাতে যা দেখলো পুলিশ রীতিমতো হয়ে গেলো। এতো সহজে সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। সাথ সাথে হার্ডডিক্সটির কপি পাঠানো হলো পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি তা পেয়ে রীতিমতোই বিস্মিত! চাকরির বয়সে তিনি অনেক সন্ত্রাসী ধরেছেন কখনো এতো খুশি হননি। হার্ডডিক্স কপি পাওয়ার পরে, তিনি সারাদেশে একযোগে অভিজান চালিয়ে পুরো সন্ত্রাসী চক্রকে ধরে ফেললেন এবং তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করেন। সেই সাথে চার বন্ধুকেও নিয়ে যান। এই বিষয়টি সরকারকে যখন জানানো হয় তখন তিনি সরেজমিনে চলে আসেন চার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। 


এইদিকে মারুফ, আবদুল্লাহ, তৌহিদের মা-বাবা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তিনটা ছেলে কোথায় গেলো? মারুফের দাদা যখন টিভি চালু করলো তখন দেখলো তার নাতিসহ চারজন বন্ধুর ছবি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে। আর সব সংবাদ মাধ্যম গুলো বারবার প্রচার করতে লাগলো আজকের টপ নিউজ, "বিশ্ব পেলো চারজন সাহসী যুবক, যাদের হাতে ধরা পড়লো শীর্ষ সন্ত্রাসী চক্র। যাদের সাক্ষাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত।" তখন মারুফের দাদা তার ছেলে ও বউকে বললো আমার নাতি কোথাও যায়নি ঐ দেখো টিভিতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মারুফের বাবা বললো, 

-বাবা কি আজেবাজে বকছো, তুমি ঠিক আছো তো? 

তখন মারুফের দাদা গরম হয়ে বললো,

 -আমি ঠিক আছি, যা ঐ দেখ টিভিতে।

একরকম বিরক্তি নিয়ে মারুফের বাবা টিভির সামনে এলো তিনি যা দেখলেন তারজন্য প্রস্তুত ছিলেননা! দেখলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছেলেসহ বাকি তিনজনকে ফুলের মালা পড়াচ্ছেন। নিজের চোখ যেনো বিশ্বাস করতে চাইছে না। চোখ কচলিয়ে আবার দেখলো ঠিকতো সব চ্যানেলে এক যোগে তাই দেখাচ্ছে। এরমধ্যে মারুফের দুলাভাই ফোন করলো, তিনি সব বুঝিয়ে বললেন। তাদের কাজে সারাবিশ্বে হৈচৈ পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের গোয়েন্দা হিসেবে নেওয়ার জন্য একের পর অফার আসতে থাকে, কিন্তু তারা কোনোটিকে গ্রহণ করেনি।তাদের একটাই কথা যা করবে তারা দেশের জন্যই করবে। তাদের জন্য একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যেখানে অতিথি হিসেবে থাকবেন আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ। জমকালো আয়োজন করা হলো এবং সেইদিন তাদের দেশের শীর্ষ পর্যায়ে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। এরমধ্যে তারা কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে, মা-বাবার সাথে দেখা করবে বলে। সে খবর শুনে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া জন্য এলাকার মানুষেরা অনুষ্ঠান করে বসে আছে। তারা আসা মাত্র সংবর্ধনা দিয়ে চমকে দেবে। আর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সেই স্যারটি।

তারা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই ফুল দিয়ে বরণ করলো বাবুল স্যার। তখনও তিনি বললেন, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি? 

এই বলে তিনি হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। আরমান বললো,

 -স্যার, আমি এসেছি। আজ আপনার কাঁদার দিন নয়, হাসবার দিন। তখন স্যার বললেন, 

-বাছা, এ আমার সুখের কান্না। এ আমার বিজয়ের কান্না।

কথাগুলো বলে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। প্রাইমারি স্কুলের স্যারটিকে তারা চার বন্ধু পা ছুঁয়ে সালাম করলো এবং তাদের সবার মা-বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। স্যারকে ওরা বললো, 

-স্যার, আমরা তো সার্টিফিকেট বিহীন গোয়েন্দা হয়ে গেলাম। তখন স্যার একটা কথাই বললেন,

-সবাইকে তোদের মতোই দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত!



লেখক:
কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ
সোনাগাজী, ফেনী
প্রথম প্রকাশকাল: ২০১৯ ইং, মাসিক কিশোরপাতা।