Close

বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব || হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত বাইয়াতের দাবি সংক্রান্ত হাদিস

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


• আরবী ইবারত:
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ أَخْبَرَنَا يَعْقُوْبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَخِي ابْنِ شِهَابٍ عَنْ عَمِّهِ قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُوْ إِدْرِيسَ عَابِدُ اللَّهِ أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ مِنْ الَّذِينَ شَهِدُوا بَدْرًا مَعَ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم وَمِنْ أَصْحَابِهِ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةُ مِنْ أَصْحَابِهِ تَعَالَوْا بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُوْنَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلَا تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ لَهُ كَفَّارَةٌ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ   وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ قَالَ فَبَايَعْتُهُ عَلَى ذَلِكَ

• বাংলা অনুবাদ:

"হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা) হ'তে বর্ণিত- তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এবং আকাবা রাত্রিতে নিযুক্ত নেতাদের অন্যতম-তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন-তখন তাঁর চারদিকে একদল সাহাবী উপস্থিত ছিলেন- তোমরা আমার নিকট এ কথার উপর 'বাইয়াত' করো যে, 'তোমরা আল্লাহর সাথে কোন জিনিসের শরীক করবে না। চুরি করবে না, যেনা-ব্যাভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তোমরা পরস্পর পরস্পরের উপর অপবাদ দিবে না এবং ভালো কাজের ব্যাপারে কখনো নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই 'বাইয়াত' যথাযথভাবে পালন করবে তার বিনিময় ও পুরষ্কার স্বয়ং আল্লাহ্ দিবেন। আর যে ব্যক্তি নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে কোন একটি কাজও করবে এবং এজন্য পৃথিবীতে কোন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হবে, তবে তা তার গুনাহর কাফ্ফারা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর যদি কোন নিষিদ্ধ কাজ কেউ করে ফেলে এবং আল্লাহ্ তা ঢেকে রাখেন, তবে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর বর্তাবে। তিনি ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করে দিবেন অথবা ইচ্ছে করলে তাকে শাস্তি দিবেন। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আমরা কথাগুলো মেনে নবী করীম (সা) এর 'বাইয়াত' গ্রহণ করলাম।" (বুখারী)। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬০৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৬১০)

• শব্দার্থ:
شَهِدَ -উপস্থিত ছিলো। التَّقَبَاءُ -প্রতিনিধিবর্গ। ليلة -রাত্রি। العقبة - আকাবা )মিনা নামক স্থানে অবস্থিত একটি পাহাড়। حول -তাঁর চতুর্দিকে। بايِعُونِي -আমার নিকট 'বাইয়াত' করো। لتشرِكُوا শরীক করোনা। খায় -আল্লাহর সাথে لاتسرقوا -তোমরা চুরি করো না। لا تزنُوا ব্যাভিচার করোন لا تقتلُوا -হত্যা করোনা। اَولادكم তোমাদের সন্তান। এর্দা -তোমরা আরোপ করে না। بهتان -মিথ্যা بين أيديكم وأرجلكم -সামনা-সামনি। لاتعصوا -সীমা লংঘন করোনা। أجره তার বিনিময়। عَلَى اللهِ -আল্লাহর উপর। أَصَابَ সম্পাদন করা। تفعُوقب অতঃপর হদ্ )নির্দিষ্ট শাস্তি) জারী করা হয়। سَتَرَهُ اللهُ -আল্লাহ্ তাকে গোপন রাখলেন। اثنشاء - যদি চান। عَقَاعَنهُতা মাফ করবেন। তাকে শাস্তি দিবেন।

• রাবীর পরিচয়:
নাম উবাদা। ডাক নাম আবুল ওয়ালিদ। পিতা সামেত ইবনে কায়েস। মাতা কুররাতুল আইন। মদীনার খাজরাজ বংশের সালেম গোত্রের লোক। তিনি ছিলেন আনসার সাহাবী।

তিনি সাহাবাদের মধ্যে দু'টি বিষয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। একটি হচ্ছে, আকাবার প্রথম শপথে অংশগ্রহণ সহ মদীনা হতে ক্রমাগত তিন বৎসরে মক্কায় আগত প্রত্যেকটি প্রতিনিধি দলের সংগে তিনি শামিল ছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী। তাছাড়া তিনি নবী করীম (সা) এর সাথে সবগুলো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন এবং 'বাইয়াতে রিদওয়ান' এর সময়ও তিনি রাসুলে করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। হযরত উবাদা (রা) উচু স্তরের একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি শুদ্ধরূপে কুরআন পাঠ করতেন এবং পবিত্র কুরআনের হাফিজ ছিলেন। আহলে সুফফাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তিনি ছিলেন তার তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষক। মহানবী (সা) তাঁকে যাকাত আদায়ের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া তিনি হযরত উমর (রা) এর সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পলন করেন। সিরিয়া ও হোমসের শাসনকর্তা এবং ফিলিস্তিনের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। হিজরী ৩৪ সনে ৭২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১টি। তারমধ্যে ৬টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
বুখারী শরীফে হাদীসটি পাঁচ জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া মুসলিম, তিরমিযি ও নাসায়ী শরীফেও সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের পূর্বে কি ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করা প্রয়োজন এবং তাদের নৈতিক ও তাকওয়ার মান কিরূপ হওয়া উচিত তা অত্র হাদীসে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। আরও তুলে ধরা হয়েছে একটি ইসলামী সমাজ কিভাবে ধ্বংস হয় সেই চোরা পথগুলো। যেহেতু আল্লাহর রাসূল (সা) একটি ইসলামী রাষ্টের স্বপ্ন দেখছিলেন সেহেতু নিষিদ্ধ রাস্তাগুলোর প্রবেশ দ্বারে অর্গল এঁটে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজ দেহে কোন ক্রমেই পঁচন না ধরে।

• ব্যাখ্যা:
বাইয়াতঃ 'বাইয়াত' শব্দটি আরবী بَيْعَةُ শব্দ থেকে গঠিত। অর্থ বিক্রি করা, ক্রয় করা, চুক্তি, শপথ, অংগীকার, শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার করা ইত্যাদি।

প্রতিটি মু'মিন স্বেচ্ছায় এবং সন্তুষ্টির সাথে নিজের জান এবং মালকে আল্লাহ্ নিকট বিক্রি করে দেয়; তাঁর সন্তোষ ও জান্নাতের বিনিময়ে। আর আল্লাহ্ শুধুমাত্র মু'মিনদের নিকট হতে জান-মাল খরিদ করেন। আল্লাহ্ মুমিন ছাড়া আর কারো সাথে ক্রয়-বিক্রয় করেন না। করা সম্ভবও নয়। কেননা বিক্রিত বস্তু ক্রেতার নিকট চাহিবা মাত্র হস্তান্তর করতে বিক্রেতা বাধ্য। এ মূলনীতি অনুসরণ করা একমাত্র মু'মিনদের পক্ষে সম্ভব। কারণ প্রতিটি মু'মিনের অন্তরে এ অনুভূতি সর্বদা জাগ্রত থাকে যে "আমার জান এবং মালের মালিক আমি নই। আল্লাহ্ মেহেরবানী করে তা আমার নিকট আমানত রেখেছেন মাত্র। কাজেই তিনি যেভাবে চান সেভাবেই এর ব্যবহার করতে হবে। পক্ষান্তরে একজন মুনাফিক, কাফের কিংবা মুশরিক তা মনে করে না। এজন্য আল্লাহ্ তাদের সাথে কেনা বেচাও করেন না। এটা তো একটি সাধারণ কথা যে, যে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট হতে মূল্য আদায় করতে চায় কিন্তু তাকে বিক্রিত মাল হস্তান্তর করতে চায় না তার সাথে কোন বুদ্ধিমানই ক্রয়-বিক্রয় করবে না। সূরা তওবায় বলা হয়েছে-

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِاتٌ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ مَن وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَ الْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ

নিশ্চয় আল্লাহ্ মুমিনদের জান মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে। তাহা আল্লাহ্ পথে লড়াই করে, (দুশমনকে) হত্যা করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তাদের জন্য (জান্নাত দেবার এ ওয়াদা) আল্লাহ্ দায়িত্বে একটি পাকা ওয়াদা বটে। (তাওবাঃ ১১১) কাফেরদের সাথে এ বেচা-কেনা এজন্য সম্ভব নয় যে তারা পরকালকেই অস্বীকার করে। আর মুশরিক এবং মুনাফিকেরা যদিও পরকালকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না তবুও তারা অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করে না। এরা দুনিয়ার জীবন এবং ভোগ বিলাসকে সব কিছুর উপর প্রাধান্য দেয়। পক্ষান্তরে একজন মুমিন দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের জীবনকে প্রাধান্য দেয়। এজন্য পৃথিবীর লোভ-লালসা, মায়া-মোহ, কোন কিছুই তাকে পিছনে টানতে পারে না। প্রয়োজনে সর্বাধিক প্রিয়বস্তু জীবনটাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে দেয়।

বিক্রিত জান-মাল আল্লাহ্ নিজে এসে গ্রহণ করেন না। আবার নিজে নিজেও তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। এজন্য আল্লাহ্ কর্তৃক ক্রয়কৃত জান- মাল তাঁর আদিষ্ট পথে ব্যয় করার জন্য একজন প্রতিনিধির প্রয়োজন। আর সেই প্রতিনিধি হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। কিন্তু যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পরে আর কোন নবী ও রাসূল নেই তাই মুমিনদের নির্বাচিত খলিফা বা নেতাই হচ্ছেন সেই প্রতিনিধি। তাঁর নিকট বাইয়াত করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। তবে নবী করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত এবং অন্য ইমাম বা নেতার হাতে বাইয়াতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। নবী করীম (সা) এর আনুগত্য হচ্ছে বিনা শর্তে কিন্তু অন্য নেতাদের আনুগত্য হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে কিন্তু রাসূল (সা) ছাড়া আর কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা যাবে না। সে আনুগত্য হতে হবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা) অধীন। বাইয়াতের মাধ্যমে যে দাবীগুলো পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়, সেগুলো হচ্ছেঃ

(১) জান-মাল আল্লাহর নিকট যে বিক্রি করা হয়েছে তা বাইয়াতের মাধ্যমে তাঁর নিকট সোপর্দ করা, যেন তিনি জান ও মাল আল্লাহ্ ও রাসূল প্রদত্ত নিয়মে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে পারেন।

(২) বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির পক্ষ হতে তাকে সে নির্দেশ দেয়া হবে তা যদি কুরআন সুন্নাহ্ বিরোধী না হয় তবে বিনা দ্বিধায় তা মানতে হবে। এ ব্যাপারে পার্থিব কোন ক্ষয় ক্ষতির পরওয়া করা যাবে না।

(৩) যদি বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির কোন নির্দেশ সঠিক নয় বলে মনে হয় তবে এ ব্যাপারে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশ না মানা কোনক্রমেই ঠিক নয়।

(৪) কোন বিশেষ কারণে যদি নির্দেশ পালন করা সম্ভব না হয় তবে তাঁকে অবহিত করতে হবে এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত মনে করতে হবে।

ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করতে গেলেই প্রথমে প্রয়োজন একটি সুসংঘবদ্ধ জামায়াতের। দীন কায়েম করা যেমন ফরজ ঠিক তেমনি জামায়াত বদ্ধ হওয়াও ফরজ। কেননা জামায়াতদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন ক্রমেই আল্লাহ্ দীন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আবার জামায়াতবদ্ধ হবার বন্ধনসূত্রই হচ্ছে বাইয়াত।

এজন্যেই ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব এত বেশী।

আকাবার ১ম, ২য়, ৩য় বাইয়াত এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যে বাইয়াত সংঘটিত হয়েছিল যাকে "বাইয়াতে রিদওয়ান" বলা হয়, এ সমস্ত বাইয়াত ছাড়াও নবী করীম (সা) বিভিন্ন সময় পুরুষ ও মহিলা সাহাবীদের নিকট হতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ বাইয়াতকে ঈমানের রুহ্ মনে করতেন। তাই দেখা যায় কোন পুরুষ অথবা মহিলা সাহাবী যদি কখনো কোন ভুল করে ফেলতেন সাথে সাথে নবী করীম (সা) এর নিকট এসে পুণরায় বাইয়াত করানোর অনুরোধ করতেন। যদি আল্লাহর রাসূলের (সা) নিকট কালেমা পড়াই যথেষ্ট হতো তবে বাইয়াতের ব্যাপারে এমন পেরেশানী তাদের মধ্যে থাকতো না। এ সমস্ত ঘটনা থেকেও বুঝা যায় যে, ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব কতটুকু।

শিরক না করাঃ শিরক হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কাউকে এমন মনে করা যা একমাত্র আল্লাহরই হওয়া বা করা সম্ভব। এ রকম ধারণা বা কর্ম করা যাবে না। অর্থাৎ কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ যাই হোক না কেন আল্লাহ্ ছাড়া কেউই তা করতে সক্ষম নয়। প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ মোচনকারী, প্রার্থনা শ্রবণকারী, রিজিক প্রদানকারী, বিপদাপদে আশ্রয়স্থল একমাত্র আল্লাহ্। তাছাড়া কাউকে এ রকম প্রভাবশালী মনে না করা যার সুপারিশে আল্লাহ্ ফায়সালা পরিবর্তন হতে পারে। বৈষয়িক, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক যে কোন বিষয়েই হোকনা কেন আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আইন- কানুন মানা যাবে না। চাই, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক অথবা অর্থনৈতিক যাই হোকনা কেন। এসব সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে গ্রহণ করে তার উপর অবিচল থাকাই হচ্ছে তৌহিদের দাবী বা শির্কমুক্ত জীবন-যাপন।

চুরি না করাঃ চুরি হচ্ছে কোন বস্তু তার মালিকের অগোচরে ও অসম্মতিতে নিজে ভোগ করা বা এর মালিক হয়ে যাওয়া। ইসলামী বিধানে এটা একটি গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। শরীয়তের পরিভাষায় কবিরা গুনাহ্। তবে মানুষ যাতে খেতে পরতে না পেয়ে চুরি করতে বাধ্য না হয় সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের। যদি কোন চোর ধরার পর প্রমাণিত হয় যে জীবন বাঁচানোর জন্য চুরি ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা তার ছিলো না; তবে তাকে শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা সরকারের প্রতিটি ব্যক্তিই উল্টা তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

ব্যাভিচার না করাঃ আল্লাহ্ জাল্লাহ ইরশাদ করেনঃ (اسری) ولا تقربوا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا.

তোমরা ব্যাভিচারের ধারে কাছেও যেও না কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জ কাজ ও অতীব নিকৃষ্ট পথ। (সূরা বনী ইসরাইলঃ৩২)

উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্যাভিচার করা তো দূরের কথা এমন কাজ বা আচরণ করাও হারাম যা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ব্যাভিচারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যে সব কাজ মানুষকে যৌন সুড়সুড়ি দেয় সেগুলোও উপরোক্ত আয়াতের আদেশের আওতাভুক্ত। যেমন অশ্লীল যৌন আবেদনমূলক পত্র-পত্রিকা, যৌন সুড়সুড়িমূলক সাহিত্য, নারী দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গির অশ্লীল চিত্র, নগ্ন ও অর্ধনগ্ন চিত্র ইত্যাদি। এ সমস্ত কাজে যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে অংশগহণ করবে তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةَ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابُ .
اليم في الدنيا والآخرة

যারা চায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার প্রচার হোক, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।

সন্তান হত্যা না করাঃ মানুষ প্রধানত দুই কারণে সন্তান হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
এক- বেশী সন্তান হলে তাদেরকে ঠিকমত খাওয়ানো পরানো যাবে না এবং তাদেরকে মানুষ করা যাবে না। অভাব অনটনে নিমজ্জিত হওয়ার আশংকা। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
ولا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ
অভাব অনটনের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। (বনী ইসরাইল)

দুই- কন্যা সন্তান হলে সমাজে তাদের নিরাপত্তা নেই। বয়োঃসন্ধিকালে উপযুক্ত পাত্র ক্রয়ের অসামর্থ্যতা। মেয়ে সন্তানের জনক জননীকে সমাজে হেয় মনে করা এবং তাদেরকে মানসিক পীড়া দেয়া।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যার আওতাভুক্ত কিনা? হ্যাঁ। অবশ্যই ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যারই শামিল। কেননা ভ্রুণ হত্যা করা হয় সন্তানের জন্মকে ঠেকানোর জন্যেই। এ প্রবণতা অত্যন্ত মারাত্মক। আমি বাসে উঠছি আর কউকে উঠতে দেবো না, এ রকমই যেন এক স্বার্থপর মনোভাব একাজে উদ্বুদ্ধ করে। স্বার্থপরতা নামক বিষবৃক্ষ হতেই এর অংকুরোদগম হয়।

কাউকে দোষারোপ না করাঃ কাউকে দোষারোপ করার প্রবণতা একটি নৈতিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যখন মাহামারীর আকার ধারন করে তখন সমাজ তিক্ততায় জর্জরিত হয়ে যায়। তখন সমাজ হতে ভালোবাসা, সম্প্রীতি, স্নেহ- মমতা ইত্যাদি নির্বাসিত হয়। ইসলামী সমাজ এটাকে কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজী নয়। তাই শরীয়ত এটাকে শাস্তি মূলক অপরাধ বলে গণ্য করেছে।

ভালো কাজের নাফরমানী না করাঃ এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছেঃ
وه تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الإثم والعدوان - তোমরা একে অপরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করো ন্যায়নীতি ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। (সাবধান) যা গুনাহ ও সীমা লংঘনের কাজ তাতে কারও এক বিন্দু সাহায্য ও সহযোগিতা করো না। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেনঃ (সূরা আল মায়েদাঃ ২)
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَاءِ الْمُسْلِمِ فِي مَا أَحَبُّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرُ
بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أَمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ .
'মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের সামাজিক ও সামগ্রীক দায়িত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি (উলিল আমর) দের কথা শোনা ও মানা। তা পছন্দ হোক বা না হোক।

যতোক্ষণ না অন্যায় কাজের আদেশ দিবে। আর যখন কোন অন্যায় বা পাপ কাজের আদেশ দিবে তখন তা শোনা কিংবা মানা মুসলমানদের কর্তব্য নয়।'
(বুখারী, মুসলিম)

পরিশেষে বলা হয়েছে, এর পরও যদি কেউ উল্লিখিত অপরাধসমূহের কোন একটি করে এবং ধৃত হয় তবে অবশ্যই তাকে শরীয়তের দন্ড ভোগ করতে বাধ্য করা হবে।

বিভিন্ন হাদীস ও আসার হতে একথা প্রমাণিত যে কোন অপরাধীকে শরীয়তের দন্ড প্রদানের পর তার অপরাধকৃত পাপের কাফফারা হয়ে যায়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাকে ঐ অপরাধের জন্য পুনরায় শাস্তি দিবেন না। যেমন হযরত আলী (রা) হ'তে বর্ণিত হয়েছে যে-
الدُّنْيَا فَاللَّهُ أَكْرَمُ مِنْ أَن يَثْنِي بِالعقوبة وَ مَنْ أَصَابَ ذَنْبًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَاللهُ أَكْرَمُ .
على عبده في الآخرة .

কোন অপরাধীকে যদি পৃথিবীতে তার কৃত অপরাধের জন্য দন্ডিত করা হয় তবে পরকালেও তাকে আল্লাহ্ দ্বিতীয় বার শাস্তি দিবেন-আল্লাহ্ এ সবের উর্ধে।

আর যদি অপরাধ করে ধৃত না হয় এবং আল্লাহ্ তা গোপন রাখেন তবে সে অপরাধের দায়-দায়িত্ব কোন ইসলামী সরকাররের নয়। আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করবেন অথবা শাস্তি দিবেন। অথবা তাকে প্রথমে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নির্ধারিত শাস্তি দিয়ে পরে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইখতিয়ারভূক্ত।

গ্রন্থসূত্র:
১। তাফহীমুল কুরআন-সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ)
২। 
হাদীস শরীফ ১ম খন্ড- মাওঃ আবদুর রহীম (রহ) 
৩। বাইয়াতের হাকীকাত-অধ্যাপক গোলাম আযম
৪। সাহাবা চরিত-৫ম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা
৫। মাসিক পৃথিবী-বিভিন্ন সংখ্যা।