Close

Wednesday, March 13, 2024

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে 'আশরাফুল মাখলুকাত' এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য তাকে 'জ্ঞান' 'বিবেক' ও ইচছার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন এবং জ্ঞানের আকর বিজ্ঞানময় আল-কুরআনকে চূড়ান্ত 'হেদায়াত' এর উৎস হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও নবী, জ্ঞানী ও শাসক, শিক্ষক ও ত্রাণকর্তা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নবুওয়ত প্রদানের সংবাদ স্বরূপ অহি মারফত আল্লাহ যে ঘোষণা দেন তা হলো:
"পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা নাপাক বীর্য থেকে। পড়; আর তোমার প্রভু সবচেয়ে সম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে লিখতে শিখিয়েছেন। আর মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না।"
মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন- "জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ",- দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান তালাশ করো।" নবী করীম (সাঃ) এর সময়কালে চীন ছিল বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে অগ্রসর। হয়ত তাই তিনি উম্মতকে বলেছেন - "জ্ঞান অর্জন করো যদি সুদূর চীনেও যেতে হয়।"
বিখ্যাত তাফসীরকার মালিক আকবর আলী কোরআনে জ্ঞান ও হিকমাহর (প্রযুক্তি) সহাবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি/তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান পরস্পর সংযুক্ত।
আল্লার নবী (সাঃ) বলেছেন- 'প্রযুক্তি বিশ্বাসীদের হারানো সম্পদ, যেখানে সে তা পাবে সেখান থেকেই সে তা কুড়িয়ে নেবে। আল-কুরআনে ৯২টি আয়াতে 'ইলম,' ৩০টি আয়াতে 'হিকমাত্র; কথা এসেছে এবং ৩২টি আয়াতে জ্ঞানীদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ও জ্ঞানহীনদের 'অন্ধ' বলা হয়েছে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে ৭ম শতাব্দীর প্রথম পদে নবুওয়ত লাভ করে ২৩ বছরের অক্লান্ত সাধনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামকে একটি বিজয়ী জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। তিনি ও তার পরবর্তী খলিফাগণ ইসলামের একটি অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে জ্ঞানচর্চা, নয়া নয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার ও মানবতার কল্যাণের জন্য সে সবের ব্যবহারের উপর জোর দেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের যে অধ্যায়টি গির্জা ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের ফলে 'অন্ধকার যুগ' বলে চিহ্নিত সেই যুগে ইসলামের বিজ্ঞান মনস্কতার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কলা ও প্রযুক্তির সৃষ্টিশীলতায় একটি 'রেনেসার' জন্ম লাভ করে।

হিজরি প্রথম শতকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটে পশ্চিমে আফ্রিকার আটলান্টির অববাহিকা থেকে পূর্বে চীনের গ্রেট ওয়াল পর্যন্ত, আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি থেকে সাহারা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সম্পূর্ণ জাজিরাতুল আরব, ইরান, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব হয়ে কয়েক শতকের মাঝে তা গোবি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মধ্য এশিয়ায়।

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের সোনালি সময় হচ্ছে ৭ম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। যদিও সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কিছু কিছু মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদান নজরে পড়ে। আজ বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে এক অত্যাশ্চর্য উচচতায় এগিয়ে গেছে, বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান চোখে পড়ছে না বরং শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞানে তাদের পশ্চাদপদতা অন্যদের হাসির খোরাকে পরিণত করেছে একথা সত্য কিন্তু আবার পৃথিবীকে কল্যাণময়তায় ভরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা মুসলমানরাই রাখে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে বিপুল অবদান তা ইতিহাস বিকৃতির পাল্লায় পড়ে সবাই ভুলে আছে অথচ ঐসব অবদানই আজকের বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।
এ প্রবন্ধে বিজ্ঞানে মুসলিম অবদানের একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস থাকলো যাতে আগামী প্রজন্ম এর বিস্তৃত জানার উৎসাহ লাভ করে এবং এসব উৎসাহী পাঠকদের মাঝ থেকে নতুন সময়ের ইমাম জাফর সাদিক, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল বেরুনী, ইবনে সিনা, আর খাওয়ারিজিমী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ দিকপাল বিজ্ঞানীর জন্ম হয়।
•বিজ্ঞানের মৌল উপাদান সমূহ: মুসলিম বিজ্ঞানীরা যার সূচনা করেন
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ, সংস্কারক বিজ্ঞানী রজার বেকন (Regerbecon) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Opus Majus' এ 'Scientiac Experimentalis' বা 'Experimental Science' অর্থাৎ 'পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানসমূহ' অনুজ্ঞাটি প্রথম ব্যবহার করেন। এটি নিঃসন্দেহে বিখ্যাত আরবি পরিভাষা Al-Ulum at- Tajribiyan এর অনুবাদ। তাঁর Scientiac ব্যবহৃত হয় Ulum এর স্থলে এবং Experimentalis ব্যবহৃত হয় Tajribiyah এর স্থলে। আধুনিক বিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (Experiment) ব্যতিরেকে কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় না অর্থাৎ পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানই আধুনিক বিজ্ঞান। ইসলামের ৪র্থ খলিফা, মহান জ্ঞানী হযরত আলী (রাঃ) রসায়ন সূত্রের প্রথম প্রণেতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর নাতি ইমাম জাফর সাদিক (৬৯৯ ৭৬৫ খ্রিঃ) ছিলেন এক্ষেত্রে তার সার্থক উত্তরাধিকারী। ইমাম জাফরের সাগরেদ জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৭৭৭ খ্রিঃ) রসায়নের মায়া শাস্ত্রকে (Magic Art) কার্যকর বিজ্ঞানে রূপ দেন। জাবির তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন নিজ হাতে কোন কিছুকে পরীক্ষাপূর্বক সত্য হিসাবে না পেলে তাকে সত্য বলে গ্রহণ না করতে। সম্ভবতঃ এজন্য তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তাজরিবা বা পরীক্ষা-গবেষণা পদ্ধতি চালু করেন।

প্রথাগত পদ্ধতিতে আল ফারাবী তাঁর 'ইহসা আল উলুম' 'ইখওয়ান আল সাফা রিসালাত আল সানাই আল ইলমিয়াহ' এবং ইবনে সিনা তাঁর 'রিসালাহ ফি আকসাম আল উলুম আল আকলিয়া' গ্রন্থে বিজ্ঞানকে কতিপয় ভাগে শ্রেণীকরণ করেন। ইখওয়ান আল সাফা ও আল ফারাবী বলেছেন তিন শ্রেণীর বিজ্ঞানের কথা যেমন: অঙ্কশাস্ত্রীয় (Mathematical), মানব রচিত বিধানসমূহ (Man made laws) এবং প্রকৃত দার্শনিক (Real Philosophical), অপরদিকে ইবনে সিনা সাধারণ মানবিক জ্ঞানের আওতায় তাঁর সময়কার ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে (Islamic Sciences) আনেননি। অপর একদল, যাদের মাঝে ইবনে আল নাদিম তার বই 'ফিহরিস্ত' (ক্যাটালগ, তালিকা)-এ তাঁর সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিজ্ঞানকে ১০ ভাগে শ্রেণীকরণ করেন, ইবনে হাজাম দুইভাগে ভাগ করেন, প্রথম ভাগ ছিল ইসলামী আইন (কোরআন, হাদিস, জুরিসপ্রুডেন্স, ব্যাকরণ, ভাষা ও ইতিহাস) এবং বিভিন্ন জাতির জন্য সাধারণ বিজ্ঞান। (অঙ্ক, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কবিত্ব, বাগ্মিতা ও ন্যায়শাস্ত্র) দ্বিতীয় ভাগে ছিল-যাদুবিদ্যা, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি। ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দমায় বিজ্ঞানকে ২ ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে ঐ সমস্ত বিষয় যা ব্যক্তি নিজের মন ও ক্ষমতা দ্বারা বুঝতে পারে। এতে ৪টি অত্যাবশ্যকীয় বিজ্ঞান থাকে- বুদ্ধি ও দর্শনের বিজ্ঞান, যেমন- যুক্তিবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যেমন-চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি, নভো-বিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি; প্রত্যাদিষ্ট বিজ্ঞান; এবং সংখ্যাবিজ্ঞান, যেমন-সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও সঙ্গীত। অপর অংশে রয়েছে কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি কুরআন পাঠ ইত্যাদি। তাসকুবরাহ জাদাহকে বলা হয় বিজ্ঞান শ্রেণীকরণে শ্রেষ্ঠ মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বিজ্ঞানকে ৭ ভাগে ভাগ করেন।

ইসলামের প্রথম দিকের বিজ্ঞানীরা অনেকেই উপরোল্লিখিত বিজ্ঞান শাস্ত্রের একাধিক শাস্ত্র নিয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান মূলতঃ রসায়নশাস্ত্রের জনক বিবেচিত হলেও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষা, দর্শন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, লজিক ও কবিতা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ যিনি ইবনে সিনা নামে সমধিক পরিচিত, মূলতঃ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের অন্য ৯৮ শাখা নিয়েও কাজ করেছেন। প্রফেসর সাকাও এর মতে আল বিরুনী পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি (Al beruni was the greatest intellect that ever lived on this earth.)। গণিত, জ্যোতিষ, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, ন্যায়, সভ্যতার ইতিহাস, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের নিদর্শন বর্তমান। প্রায় সব বিষয়েই তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।

একথা অনস্বীকার্য যে এসব মুসলিম বিজ্ঞানীরা যখন এতসব বিষয়ে দিকদর্শন দিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান চর্চা নিষিদ্ধ এবং বিজ্ঞানের পক্ষ নেয়ার গ্যালিলিও'র মতো বিজ্ঞানীও তার কয়েকশত বছর পর চার্চের কাছে আনত মস্তক হয়ে বলতে হয়েছে "আমি আমার দাবির জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী বরং ঘোষণা করছি পৃথিবী ঘুরছে না।"

•ইসলামী সরকারসমূহের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা :
বদর যুদ্ধে ইসলামের প্রথম বিজয় ও ৭০ জন কাফিরের গ্রেফতারের পর নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করেন যে, যে মুশরিক ১০ জন মুসলিমকে পড়তে ও লিখতে শিখাবে সে আজাদ হতে পারবে। এভাবেই শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ পায়। পরবর্তী খলিফাগণও জ্ঞান চর্চার এ ধারা অব্যাহত রাখেন।

হিজরি ২১৫ সালে আব্বাসীয় খলিফা মামুন ২০০,০০০ দিনার (প্রায় ৭ মি. ডলার) ব্যয়ে বাগদাদে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র গড়ে তোলেন যার নাম দেন 'বায়তুল হিকমাহ' এর সাথে ছিল একটি জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দির ও গণ-পাঠাগার। তিনি সেখানে বহুসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, গণিত ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করেন, যার পরিমাণ প্রায় ১০০ উটের বোঝা।

গুস্তাব লি বোঁ (gustab le bou) তাঁর 'ইসলাম ও আরবী সভ্যতার ইতিহাস' বইতে লিখেছেন- 'ইউরোপে যখন বই ও পাঠাগার ছিল। সত্যিকার অর্থে বাগদাদের 'বায়তুল হিকমায়' চল্লিশ লক্ষ, কায়রোর সুলতানের পাঠাগারে দশ লক্ষ, সিরিয়ার ত্রিপোলী পাঠাগারে তিরিশ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। অপরদিকে মুসলমানদের সময় কেবল স্পেনে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হতো।"

ডঃ ম্যাক্স মেয়রহোফ লিখেন-" ইস্তাম্বুলের মসজিদগুলোর জন্য ৮০টি পাঠাগার ছিল। প্রতিটি লাইব্রেরিতে দশ হাজার বই ও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ছিল। দামেস্ক, মসুল, বাগদাদ, ইরান ও ভারতের শহরসমূহে অনুরূপ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে।"

ড. ওস্তাব তাঁর বইতে আরও অগ্রসর হয়ে বলেন, "মুসলমানরা কোন শহর অধিকারে নিলে প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করতো একটি মসজিদ ও একটি কলেজ। বাগদাদ, কায়রো, this কর্ডোভা ও অন্যান্য স্থানে পরীক্ষাগার, মানমন্দির, বিরাট পাঠাগার ও জ্ঞান সাধনার অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কেবল আন্দালুসিয়ায় তত্ত্ব ছিল ৭০টি গণপাঠাগার। কর্ডোভার আল হাজাম পাঠাগারে ৬০০,০০০ বই ছিল। অথচ চার শতাব্দী পরে চার্লস দি জাস্ট বিবলিওথিক ন্যাশনাল অব প্যারিস শুরু করেন ৯০০ বই দিয়ে যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল ধর্মের উপর রচিত।"

পণ্ডিত নেহেরু তার 'A Glimpse at World History' তে লিখেন "কর্ডোভায় ১০ লক্ষের বেশি লোক বাস করতো, যেখানে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাবলিক পার্ক ছিলো, ৪০ কিলোমিটারব্যাপী তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬০০০ প্রাসাদ ও বড় বড় বাড়িঘর; ২০০,০০০ সুন্দর আবাস বাড়ি, দোকানপাট, ৩০০ মসজিদ, ৭০০ হাম্মামখানা (ঠাণ্ডা ও গরম পানির সরবরাহ) ছিল। অসংখ্য পাঠাগার ছিল যার মাঝে রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় বিখ্যাত ছিল কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি সকল দরিদ্রের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।"

ড. মরিস বুকাইলি তাঁর গ্রন্থ "The Bible, The Quran and Science"এ উল্লেখ করেন ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলাম জ্ঞান বিজ্ঞানকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। যখন খ্রিস্টীয় জগতে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা চলছিল তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালসমূহে বহু সংখ্যক গবেষণা ও আবিষ্কার সাধিত হয়। কর্ডোভার রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইবনে রুশদ তখন সেখানে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য দেশীয় বিজ্ঞানে পাঠদান করতেন। যার কারণে সারা ইউরোপ থেকে পণ্ডিতেরা কর্ডোভায় পড়তে যেতেন যেমন আজকের দুনিয়ার মানুষ তাদের শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য আমেরিকায় যায়। আমরা আরব সংস্কৃতির কাছে বহুলভাবে ঋণী, গণিত (বীজগণিত একটি আরব আবিষ্কার), জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি এর জন্য। মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দান করে। এ সময় মানুষ অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ ছিলো কিন্তু ইসলামী দুনিয়ায় মানুষকে একই সাথে বিশ্বাসী ও বিজ্ঞানী হতে বাধা দেয়নি। বরং বিজ্ঞান ছিল ধর্মের যমজ ভাই।"

•চিকিৎসা বিজ্ঞান
Dr. Mayerhof তাঁর বই "The Legacy of Islam" এ লিখেন মুসলিম ডাক্তারগণ ক্রুসেড যুদ্ধে আগত মেডিক্যাল এটেনডেন্টদের অগোছালো ও প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা দেখে হাসতেন। ইউরোপীয়গণ সে সময়ে ইবনে সিনা, জাবির, হাসান বিন হাইসাম বা রাজির বইসমূহের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। অবশ্য পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় তাদের বইগুলো অনূদিত হয়। এসব অনুবাদ এখনও বর্তমান কিন্তু কোথাও অনুবাদকের নাম নেই। ষোড়শ শতাব্দীতে ইবনে রুশদ (Averroes) ও ইবনে সিনার (Avicenna) বইসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে ইটালি ও ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠদানের মৌলিক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।"

একই গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় তিনি আরও লিখেন "রাজির মৃত্যুর পর ইবনে সিনা রাজিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। চিন্তা, দর্শন ও সাধারণ বিজ্ঞানে তার প্রভাব ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান (সমরকন্দের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত গ্যালনের রচনাবলির আরবি অনুবাদ এর ভিত্তিতে গড়ে উঠা) ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মাঝে ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কায়েস, ইবনে যাহর, ইরানের আব্বাস, মিসরের আলী ইবনে রেজভান, বাগদাদের ইবনে ইসাউ, মসুলের আম্মার, আন্দালুসিয়ার আবু রুশদ। এদের বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল।

মুসলমানগণ যখন স্পেন জয় করে ইউরোপ তখন কলেরার ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতো না। লোকেরা মনে করতো এ রোগটি হচেছ পাপের প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ একটি আসমানী আজাব। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে কেবল কলেরা নয় এমনকি প্লেগও একটি সংক্রামক ব্যাধি বই কিছু নয়।"

বলা হয়ে থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যখন অস্তিত্ব ছিল না হিপোক্রিটিস তাকে অস্তিত্বে জানেন; যখন তা হারিয়ে যায় গ্যানে তা পুনঃপ্রবর্তন করেন; যখন এ শাস্ত্রটি হযবরল ও এলোমেলো হয়ে যায় আল-রাজি তা পুনর্বিন্যাস করেন এবং এরপরও যখন তা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ইবনে সিনার মহান প্রয়াস তাকে সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন করে। Dr. Maverhof এ বিষয়ে লিখেন "ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুন (The Canoon) চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাস্টারপিস হিসাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করে যে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে এর ১৬টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়, যার ১৫টি ল্যাটিন ও ১টি আরবি। বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থ হিসাবে ষোড়শ শতাব্দীতে এর শত শত মুদ্রণ হয়। ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে এটিই ছিল সর্বাধিক পরিচিত চিকিৎসাগ্রন্থ। এখনও চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক বিষয়ে এ গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়।" ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছর এ বইটি ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানে একমাত্র মূল টেক্সট।

উইল ডুরান্ট (Will Durant) লিখেন যে মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া রাজি মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মাঝে অগ্রসর ছিলেন। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা যা আজও ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। তার বিশেষ অবদান হচ্ছে:

১। "শুটি বসন্ত ও হাম" (Smallpox and Measles): এটি ১৪৯৭ থেকে ১৮৬৬ সালের মাঝে ল্যাটিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ৪০ বার মুদ্রিত হয়। ২। "মহান বিশ্বকোষ" (The Great Encyclopedia): এটি ২০ খণ্ডের বিশাল বিশ্বকোষ যা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। এই বিশ্বকোষের ৫ খণ্ড ছিলো চক্ষু বিজ্ঞানের উপর। ১২৭৯ সালে এটির ল্যাটিন অনুবাদ হয় এবং কেবলমাত্র ১৫৪২ সালে এর ৫টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। শত বছর ধরে চোখ, চোখের রোগ ও তার চিকিৎসাক্ষেত্রে এ গ্রন্থগুলো প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচিত হতো। ১৩৯৪ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তার চিকিৎসাবিজ্ঞান কোর্সের ৯টির ১টি হিসাবে এটিকে গ্রহণ করে। মুসলিম ডাক্তারগণ সার্জারিতেও অনেক দূর এগিয়ে যান। তারা এনেসথেসিয়ার প্রয়োগও করতেন যদিও ধারণা করা হয় এটি সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার। রাজির অন্যান্য আবিষ্কারের মাঝে ছিলো- জ্বর রোগে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, ক্ষত সারানোর ব্যাপারে পারদ ও পশুর ব্যবহার ইত্যাদি।

মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণই প্রথম আঙ্গুলের নখ দেখে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়, জন্ডিস রোগের সুচিকিৎসা, ক্ষরণ বন্ধ করার ব্যাপারে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, কিডনি ও ব্লাডারের পাথর সরানোর জন্য তা ভাঙ্গা, হার্নিয়া রোগের শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় আবিষ্কার করেন। বিখ্যাত ইসলামী শল্যচিকিৎসক ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কাসেম। তিনি বহু সংখ্যক শল্য-যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক ও এ বিষয়ের গ্রন্থকার। তাঁর এসব বই ১৮১৬ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন ভাষার ব্যাপক সংস্করণে মুদ্রিত হয়।

•ঔষধশাস্ত্র (Pharmacology)
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অন্যতম শাখায় মুসলমানদের অবদান অসামান্য। গুস্তাব লি বোঁ লিখেন" টাইফয়েড রোগের চিকিৎসার জন্য ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার ইউরোপ যা একবার মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করে ফেলে দিয়েছিলো এবং আবার যা তারা কয়েক শতাব্দী পর সাগ্রহে গ্রহণ করছে- এছাড়াও মুসলমানদের অনেক উদ্ভাবনের কাছে তারা ঋণী। মুসলমানরাই প্রথম রাসায়নিক ঔষধসমূহকে পিল ও মিকশ্চার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে যা বর্তমানেও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। এসবের অনেকগুলোকেই বর্তমান সময়ের রসায়নবিদগণ নতুন আবিষ্কার বলে চালিয়ে দিতে চান; এর কারণ অবশ্য এসবের ইতিহাস সম্বন্ধে তাদের অজ্ঞতা। মুসলমানদের ডিসপেন্সারিগুলোতে রোগীরা চিকিৎসাপত্র নিয়ে গেলে পর্যাপ্ত ঔষধ পেতো, যেখানে কোন হাসপাতাল সুবিধা ছিল না ডাক্তারগণ তাদের যন্ত্রপাতিসহ রোগীর সেবায় ছুটে যেতেন।" জর্জি যাইদেন (Georgi Zeidan) লিখেন "ইউরোপের আধুনিক ঔষধ বিজ্ঞানীগণ তাদের পেশায় ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখেছেন শতবর্ষ আগে মুসলিম ডাক্তারগণ আধুনিক ও কার্যকর উপায় উপাদান ব্যবহার করেছেন: তারা একটি ফার্মাকোলজি বা ঔষধশাস্ত্র গড়ে তোলেন ও জটিল রোগের চিকিৎসা করতে সমর্থ হন এবং আধুনিক মডেলের ফার্মেসি গড়ে তোলেন।

কেবল বাগদাদ শহরে ৬০টি ঔষধালয় থেকে খলিফার খরচে বিনে পয়সায় ঔষধ দেয়া হতো। ইউরোপেও অনেক ঔষধের নামে আরবি, ভারতীয় ও ফার্সী মূলের প্রয়োগ দেখা যায় যেমন- এলকোহল, এলকালি, এলকানের, এপ্রিকোট, আরসেনিক ইত্যাদি।

•হাসপাতাল (Hospital)
জর্জি যাইদেন বর্ণনা করেন "রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর দুইশত বছরের আগেই মক্কা, মদীনাসহ সকল বড় বড় মুসলিম শহরে হাসপাতাল গড়ে ওঠে, আব্বাসীয় গভর্নরগণ তাদের নিজ নিজ এলাকায় শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। কেবল বাগদাদেই ছিল ৪টি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল। তৃতীয় হিজরিতেই গভর্নর আব্দুদ্দৌলা দেই লামী আদুদী হাসপাতাল গড়ে তোলেন, যেখানে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন। তখনকার দিনে এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতাল কিন্তু অল্প সময়ের মাঝেই তার চেয়ে ভাল হাসপাতাল তৈরি হয়।

এসব হাসপাতালে রোগীরা ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিচারে সমান যত্ন ও সেবা লাভ করতো। বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ড ছিলো। এসব হাসপাতালে ছাত্ররা তত্ত্বের পাশাপাশি রোগী পর্যবেক্ষণ করতো। তাছাড়া কতিপয় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যেসবের ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেলজুকি সুলতান মাহমুদ এর সাথে এমন একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যা বহন করে নিতে ৪০টি উট লাগতো। ডঃ গুস্তাবলি বোঁ লিখেন "মুসলিম হাসপাতালসমূহে প্রতিষেধক ঔষধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার এমন উন্নত ব্যবস্থা ছিলো যে সেখানে মৃতদের ছাড়া সবারই রোগ আরোগ্য হতো। সেখানে আলো বাতাসের প্রাচুর্য ও প্রবহমান পানির সুব্যবস্থা থাকতো। সুলতান মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া রাজিকে বাগদাদের উপকণ্ঠে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলে তিনি বহু পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত স্থান বাছাই করেন। এসব হাসপাতালে বড় সাধারণ ওয়ার্ড এবং ব্যক্তিদের জন্য পাইভেট ওয়ার্ডের ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররা এখানে রোগ নির্ণয়, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতো। এছাড়া ছিল বিশেষ ধরনের মানসিক হাসপাতাল এবং বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের জন্য ঔষধালয়।"

মার্ক ক্যাপ (Mark Kapp) লিখছেন, "কায়রোতে একটি বড় হাসপাতাল ছিল যেখানে জীবন্ত ঝর্না ছিল, বিশাল ফুলের বাগান ছিল এবং ৪০টির বেশি উঠোন ছিলো। সেখানে রোগীদের সাদরে গ্রহণ করা হতো ও সুস্থ হয়ে গেলে ৫টি স্বর্ণমুদ্রাসহ তাকে ফেরত পাঠানো হতো তার ঘরে। সে সময়ে কর্ডোভা নগরীতে ৬০০ মসজিদ, ৯০০ গণশৌচাগার (হাম্মাম) এর পাশাপাশি ৫০টি হাসপাতাল ছিল।"

মুসলমানরা যখন এসব সুউচচ ও প্রসারিত হাম্মামখানায় সাবান ও সুগন্ধি ব্যবহার করতো, প্রবহমান পানিতে গোসল করতো আধুনিক আমেরিকা তখন জঙ্গল আর গুহা থেকে বেরোয়নি, শিখেনি কিভাবে গোসল করতে হয়। ইউরোপ তখন সভ্যতা, সংস্কৃতির জন্য অক্সফোর্ড ছেড়ে কার্ডোভার দিকে ছুটছিলো।

•রসায়নশাস্ত্র
ইমাম জাফর সাদিকের শিষ্য জাবির ইবনে হাইয়্যান 'রসায়নশাস্ত্রের জনক' হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আরব রসায়নশাস্ত্রের জনক। পশ্চিমা রসায়নশাস্ত্র ও আলেকেমির উপর তার প্রভাব হিলো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। তাঁর কয়েকশত অবদান সর্বজন স্বীকৃত এবং এখনও টিকে আছে। সাবেক ইরাকী শিক্ষামন্ত্রী মরহুম সৈয়দ হেবাতউদ্দিন শাহরিস্তানী লিখেন, "আমি জাবিরের ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র দেখতে পাই যা তার শিক্ষক ইমাম জাফরকে উৎসর্গ করা। তাঁর ৫০০টি গবেষণাকর্ম মুদ্রিত অবস্থায় প্যারিস ও বার্লিনের জাতীয় পাঠাগারে পাওয়া যায়। ইউরোপের জ্ঞানীরা তাঁকে আদর করে ডাকে 'বুদ্ধিমত্তার অধ্যাপক' (Wisdoms Professor) এবং তারা স্বীকার করে যে তিনি ১৯টি মৌলিক পদার্থের আবিষ্কারক। জাবের বলেন যে কোন বস্তুকে আলো ও আগুনের সাহায্যে এমন অণুতে পরিণত করা সম্ভব যা বস্তুর অদৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম ইউনিট। জাবের এর এ তত্ত্বটি আধুনিক পারমাণবিক বিজ্ঞানের অতি নিকটবর্তী।" নাদিম রচিত ফিহরিস্ত ও অন্যান্য তালিকায় জাবির রচিত রসায়ন গ্রন্থের পরিমাণ ২৭৭ খানা যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৭০। তার গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২ থেকে ১০০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুই বা দেড় পৃষ্ঠার এসব বই এক একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত বই ৫০০, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ১, দার্শনিকের যুক্তি খণ্ডনের বই ৫০০ ইত্যাদি।

জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নের শুদ্ধতম ভিত্তি রচনা করেন। তিনি হাতে কলমে পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর জোর দেন। কিতাবুত তাজ, কিতাবুল মাওয়াজিন, কিতাবুর রাহমাস্স্সাগির, কিতাবুল খাওয়াস ও কিতাবুল হুদুদে তিনি এ বিষয়ে তাঁর মত ব্যক্ত করেন।

রসায়নশাস্ত্রের যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা চালাতে হয় তিনি সেসব রপ্ত করেন ও নিজের আবিষ্কৃত পরীক্ষা প্রক্রিয়াসমূহের সাথে মিলিয়ে এসবের উন্নয়ন করেন। তিনি পাতন, ঊর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভষ্মীকরণ, গলান, বাষ্পীভবন প্রভৃতি রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর বিশদ লেখালেখি করেন। এসব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাঁর বর্ণনা ছিল বৈজ্ঞানিকভাবে বিশুদ্ধ ত্রুটিমুক্ত।

জাবির টিন, সীসা, তামা, লৌহ, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি তৈরির পন্থা আবিষ্কার করেন। তার ব্যবহারিক ও ফলিত রসায়নের মাঝে ইস্পাত তৈরি করার পন্থা, কাপড় ও চামড়া রং করার প্রণালী, লোহা এবং ওয়াটার প্রুফ কাপড়ের বার্নিস করার উপায়, কাচ তৈরি করার জন্য ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার, সোনার জলে নাম লিখাবার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বস্তুর রং করা, খনিজ দ্রব্য ও ধাতব পদার্থের উৎপাদন ইস্পাত প্রস্তুতি ট্যানিং ইত্যাদি কারখানা কৌশল মুসলমানরাই প্রথম আবিষ্কার করে। তারাই নাইট্রিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রো গ্লিসারিন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, পটাশিয়াম, একুয়া নাইট্রেট, এলকোহল, এলকালি অরপিমেন্ট, অরপিসেন্ট ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। বোরাক্সও তাদের আবিষ্কার।

আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে পাতন, বাষ্পীকরণ, পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া এবং সোডিয়াম, কার্বন, পটাসিয়াম কারবোনেট, ক্লোরাইড ও এমোনিয়ার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

•পদার্থ বিজ্ঞান
ইবন আল হাইসাম (আল হাজেন, ৯৬৫-১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে) ছিলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে উন্নত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক অবদান রাখেন। প্রফেসর আব্দুস সালামের মতে, "তিনিই প্রথম বলেন যে আলোক রশ্মি কোন মাধ্যম অতিক্রম করার সময় সহজ ও দ্রুততর পথ বেছে নেয়। এভাবে তিনি বহু শতাব্দী আগেই ফারমেটস্ এর সর্বনিম্ন সময় তত্ত্ব (Principle of Least time) অনুরূপ তত্ত্ব প্রদান করেন।

তিনি সর্বপ্রথম জড়তা তত্ত্ব (Law of Inertia) প্রদান করেন যা পরবর্তীতে Newton এর 'ল অব মোশন' হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তিনিই প্রথম আলোর প্রতিসরণের তত্ত্ব প্রদান করেন যা পরবর্তীতে নিউটনের হাতে পুনরাবিষ্কৃত ও বিস্তৃতি লাভ করে।"

পশ্চিমা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশাল, বিরাট। তাঁর সমসাময়িক আল বেরুনীর সহযোগিতায় তিনি বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। আধুনিক ইউরোপের শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অবিসংবাদিত পথিকৃৎ রজার বেকন এর আকাশচুম্বী সৃষ্টি (Opus Majus এর পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবিক অর্থে ইবনে আল হাইসামের আল মানাজির (Optics) এর নকলমাত্র। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব তা স্বীকার করে না।

আল বিরুনী (৯৭৩ - ১০৪৮ খ্রিঃ) ভারত ও আফগানিস্তানে অনেক কাজ করেন। বহু পূর্বেই তিনি প্রকৃতির আইন আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, পদার্থবিদ্যার যে বিধান পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল। আকাশের কক্ষপথসমূহেও ক্রিয়াশীল। মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানী আবুল হাসান সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, গ্যালিলিও তার উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন মাত্র। অথচ বর্তমান বিশ্ব জানে গ্যালিলিওই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক। ইবনুল হাইসাম তাঁর গ্রন্থ মাকালাতু ফি মারাকাজুল আস্কাল' গ্রন্থে বস্তুর পরস্পরের আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি ও দার্শনিক মাওলানা রুমি কবিতায় মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের ধারণা দেন। সম্ভবতঃ সেই পথ ধরে পরবর্তীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন এ বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব দাঁড় করান।

•শিল্প কারখানা
আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদ এইক্সের চারলেম্যানের কাছে বাগদাদ থেকে একটা ঘড়ি পাঠান উপঢৌকন হিসেবে যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেজে উঠতো। এটি দেখে সদ্য সিংহাসনে আসীন রোমান শাসক ও তার সভাসদগণ চমৎকৃত ও আনন্দিত হলেন। আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টানদের ধ্বংসলীলার ফলে মুসলিম শাকসকদের সময়কার বড় বড় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা, কৃষ্টি ও সভ্যতার অন্যান্য উপাদানে স্থবিরতা নেমে আসে। দক্ষ রাজমিস্ত্রিদের অভাবে শহরের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। মাদ্রিদের জনসংখ্যা ৪ লাখ থেকে ২ লাখে নেমে এলো। যে সেভাইলে ১৬০০ শিল্পকারখানা ছিল সেখানে ৩০০ কারখানা টিকলো এবং ১,৩০,০০০ শ্রমিক চাকরি হারালো অথচ জনসংখ্যা তখন ৭৫% কমে গেছে। মুসলমানরাই প্রাচীন চর্ম-কাগজের পরিবর্তে তুলার তৈরি কাগজের প্রচলন করে এবং এতে করেই ইউরোপে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ হলো। অবশ্য মুদ্রণ পদ্ধতি আসে প্রাচীন চীন থেকে। এ থেকেই বই পুস্তুক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁর সূচনা হয়। কাগজ আবিষ্কারের ফলেই প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থরাজির পুনর্লেখন সম্ভব হলো।

ফিলিপ হিট্টি (Philop Hitti) তাঁর History of the Arabs এ লিখেন 'সড়ক তৈরির প্রযুক্তি মুসলমানদের হাতে এতটা উন্নত হয় যে কর্ডোভায় মাইলের পর মাইল পাকা সড়ক ছিল যার দুপাশে রাতে বাতি জ্বলতো যাতে লোকেরা নিরাপদে পথ চলতে পারে, অথচ সেই একই সময়ে লন্ডন বা প্যারিসের পথে বৃষ্টিস্নাত রাতে বের হলে হাঁটু পর্যন্ত জলমগ্ন ও কর্দমাক্ত হতে হতো। এ অবস্থা কর্ডোভায় পাকা রাস্তা আসার সাতশত বছর পরও ছিলো। অক্সফোর্ডের লোকেরা তখন মনে করতো গোসল করা একটা অপকর্ম যখন কর্ডোভার ছাত্রগণ বিলাস-বহুল হাম্মামখানা ব্যবহার করতো।

•অঙ্কশাস্ত্র
আধুনিক বিজ্ঞানে অঙ্ককে বলা হয় মা। কম্পিউটার এর আবিষ্কার ও এর উন্নতি কেবলই অঙ্কনির্ভর। Legacy of Islam গ্রন্থের 'Astronomy and Mathematics অধ্যায়ে Baron Carra de Vaus বলেন, "এলজেবরা হচেছ আরবি আলজবর কথাটির ল্যাটিনরূপ। আল জবর অর্থ শক্তি, ভাগ্য বা অসংগতি। এটিকে এক কথায় সংক্ষিপ্তকরণ বলা যায়। এটি বর্ণের পরিবর্তে সংখ্যা বা সংখ্যার পরিবর্তে বর্ণের ব্যবহার। কুরআনে ব্যবহৃত হরুফে 'মুকাত্তায়াতি' এর মতো এর প্রয়োগ। অংকের ভাষায় এটি ভগ্নাংশকে পূর্ণসংখ্যায় রূপান্তর করা; জটিল সংখ্যাকে সহজতর ভাষা বা সংকেতে উপস্থাপন করা। বিজ্ঞান আজ যেসব সংখ্যা ব্যবহার করছে তা আরবি সংখ্যা। বর্তমানে ব্যবহৃত কম্পিউটার প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হচেছ হিন্দু প্রতীক থেকে '৩' বা শূন্যের যে মূল্যমান আরবরা গ্রহণ করেছে তা। '০' বা Zero এর নিকটতম শব্দ Chiper যা কিনা আরবি ka sefr এর প্রতিলিপিকরণ বই নয়।" De vaux আরো লিখেন: Chiper ব্যবহার করে আরবগণ নিত্যব্যবহার্য গণিতের পথপ্রদর্শক হন। তারা বীজগণিতকে একটি প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দেন ও উন্নয়ন ঘটান, তারাই বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির ভিত্তি রচনা করেন, তারাই ত্রিকোণমিতির একমাত্র স্থপতি। এলগোরিদম কথাটি আসে এর আবিষ্কারক খিত্ এর বাসিন্দা আল খারেজমির নাম থেকে। আরবগণ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার চরম পর্যায়ে যখন, তখন ইউরোপ চরম বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল। "আল খারেজমী প্রথম আলজাবর ওয়াল মোকাবিলা পদ্ধতির ব্যবহার করতে থাকেন। বস্তুর সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ ও কঠিন বস্তুর এবস্ট্রাকট ফরমুলেশানের নিয়ম (হাদ্দ বা তাহদিদ) তিনি প্রণয়ন করেন। খারেজমী মনে করতেন বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল শক্তি হচেছ গণিত। সূক্ষ ও বিশুদ্ধ গণনার জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত প্রক্ষেপণ নীতি The formula of interpolation কে নিউটনের আবিষ্কার বলে চালালেও তাঁর জন্মের বহু পূর্বে আলবেরুনী শুধু একে আবিষ্কারই করেননি তিনি একে ব্যবহার করে সাইন (Sine) তালিকা প্রণয়ন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর আকার, পরিধি ইত্যাদি বিষয়ে যে আলোচনার অবতারণা হয় তাতে সর্বশেষ অবদান রাখেন মুসলিম বিজ্ঞানী বনি মুসা ভ্রাতৃদ্বয় এবং আলবেরুনী। আলবেরুনীর কানুনে মাসউদীর ৪র্থ খণ্ডে প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। তিনি দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দিক নির্ণয়, গ্রহ-নক্ষত্রাদির অবস্থানজ্ঞাপক সংজ্ঞা নির্দেশ করার সহজ বিজ্ঞানসম্মত উপায় নির্ধারণ করেন। জ্যোতির্বিদগণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক আল বাত্তানীও একজন মুসলিম। স্থানাঙ্কের যেকোন ২টি বিষয়ে জানতে পারলে অন্যগুলি নির্ধারণের যে সহজ ফর্মুলা আলবেরুনী দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।

আবু রায়হান বিরনী তাঁর কিতাবুত তাফহিম ফি সানয়াতে তানজিম গ্রন্থে লিখেছেন, "যে ব্যক্তি ৪টি বিজ্ঞানে পারদর্শিতা লাভ না করেছে তাকে জ্যোতিষী বলা যেতে পারে না। এ ৪টি বিজ্ঞান হলো- অঙ্কশাস্ত্র (Mathematics), গণিত (Arithmetic), বিশ্ব গঠনতন্ত্র (Cosmography), বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষী (Judicial Astrology)। আলবিরুনী ছিলেন সর্ববিচারে একজন সার্থক জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।"

নভোমণ্ডলী, নভোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থানের অবস্থান, শহর নগরের আয়তন ইত্যাদি সম্বন্ধীয় সাধারণ গণনা সম্পর্কীয় গ্রন্থ: আলোর গতি সম্পর্কীয় গ্রন্থ: এস্ট্রোল্যাব সহযন্ত্রাদি ও সে সবের ব্যবহার সম্পর্কিত গ্রন্থ, কাল ও সময় সম্পর্কিত গ্রন্থ; উল্কা ও কুজঝটিকা বিষয়ক, জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ শিরোনামে তাঁর ৭৯টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাদি রয়েছে।

আমরা যাকে কেবল রুবাইয়াতের কবি হিসেবে চিনি সেই ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত। নিউটনের বহু আগে তিনি আবিষ্কার করেন "বাইনোমিয়াল থিউরাম।" এ পদ্ধতিতে তিনি সূর্যের চারিদিকের পৃথিবীর সময় মান ঠিক করে জালালি ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন।

•ভূগোল
প্রথম কয়েক শতাব্দীর মাঝেই আরব মুসলিমগণ ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেন মরক্কো থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত। আরব্য রজনীর সিন্দাবাদকে আমরা দেখি চীন, জাপান আর ইন্দোনেশিয়ান দারুচিনি দ্বীপের দেশে ঘুরতে। তাতেই মনে হচেছ আরবরা আগে থেকেই ভূগোল, ভূবিদ্যা ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলো।

কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি আরব নাবিকগণ আফ্রিকার পূর্বতীর থেকে রাশিয়ার দূরবর্তী এলাকা পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান। আফ্রিকান মুসলমানগণ কলম্বাসের বহু আগেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছায়। ভারতে আসার সমুদ্র পথও প্রথম আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ্যা, জাহাজ পরিচালনা বিজ্ঞান, মহাসাগরের বৈজ্ঞানিক বর্ণনাকারী এবং সাগরের প্রাণী সম্পর্কে বহু গ্রন্থের প্রণেতা মুসলিম বিজ্ঞানী আহমদ বিন মজীদ।

বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে হক্কাল (৯৭৫ খ্রিঃ) তার গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, "আমি এই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা ও অক্ষাংশ সম্বন্ধে লিখেছি, এর সকল দেশ, সকল সীমানা এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে লিখেছি। আমি এসবের মানচিত্র এঁকেছি সযত্ন প্রয়াসে এবং সেখানে শহরসমূহ, নদীসমূহ, হ্রদ, ফসলাদি, কৃষ্টির ধরন, রাস্তাঘাট, একস্থান থেকে অন্যস্থানের দূরত্ব, বাণিজ্যিক দ্রব্যসমূহ এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় যা রাজন্যবর্গ ও তাদের সহযোগী ও সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে পারে তা নির্দেশ করেছি। সম্ভবতঃ এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মানচিত্র। মুসলিম পরিব্রাজক আবু রায়হান আল বিরুনী, ইবনে বতুতা ও আবুল হোসাইন ঐসব লোকদের মাঝে অনন্য যারা ভূবিদ্যার ইতিহাস রচনার জন্য কষ্টকর অভিযাত্রা আর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্যাদি রেখে গেছেন। বিজ্ঞানের দ্বিগ্বিদিক জয়যাত্রায় তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

••হায় অতীত! সোনালি অতীত!
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা যেকোন মুসলিম তরুণের হৃদয়ে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। কি সুন্দর, গৌরবময় ঐতিহ্যশালী আমাদের অতীত। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ইতিহাসে কি স্বর্ণোজ্জ্বল আমাদের অবদান! কিন্তু এ যে কেবলই অতীত। বিগত কয়েকশত বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান আমাদের নেই। আমরা কি কেবলই অতীতের স্মৃতিচারণ করে জাবর কাটবো? না; কক্ষণোই নয়।
আজ প্রতিটি মুসলিম তরুণকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মুসলিম ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেলতে হবে। পাশ্চাত্য অরিয়েন্টালিস্ট পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আমাদের ইতিহাস ও পণ্ডিতবর্গের নামের যে বিপুল বিকৃতি ঘটেছে তার হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে প্রকৃত সত্য। আর তা ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র।
আফসোস আর হতাশার কৃষ্ণ-পর্বতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াবার কোন অবকাশ আমাদের নেই। এখন সময় সিদ্ধান্তের। নতুন যুগের আলবেরুনী, খারেজমী, জাবির ইবনে হাইয়ানদের এগিয়ে আসার দিন।

উঠুন, জেগে উঠুন, অন্ততঃ রজার বেকনের মতো জেগে উঠুন। অক্সফোর্ডের ছাত্র রজার বেকন কর্ডোভায় গিয়ে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনীষার সংস্পর্শে থেকে সব উপকরণ বগলদাবা করে যদি নব্য ইউরোপের রেনেসাঁর জন্ম দিতে পারে, বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমানের মাঝে কি এমন একজনও নেই যে আবার ফিরিয়ে আনবে আমাদের সোনালি অতীত?

লেখক:
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 


•গ্রন্থ নির্দেশনা :
1. Western Civilisation through Muslim Eyes; Sayid Mujtaba Rukni Musawilari, 1978 Iran.
2. Origin And Development of Experimental science; Dr. Muin-Ud-Din Ahmad Khan; BIIT, 1998.
3. Classification of Sciences in Islamic Thought; Al Najjar; AJISS; volume 13, Number-1 Washington DC. 1996. (প্রবন্ধ)
4. আলবেরুনী; এম আকবর আলী ই. ফা. বা প্রকাশনা; ১৯৮২.
5. জাবির ইবনে হাইয়ান; এম. আকবর আলী ই, ফা, বা প্রকাশনা; ১৯৮২।
*সংকলনে: প্রবন্ধ সংকলন, আইসিএস পাবলিকেশন্স

0 Comments: