Close
বিশেষ রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বিশেষ রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)


দারসুল হাদিস || পরকালের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস

• আরবি ইবারত:
عَنِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ حَتَّى يَسْئَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَ عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ (ترمذ ی)

• বাংলা অনুবাদ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (সা) হতে বর্ণনা করেছেনঃ কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও (স্ব-স্থান হতে) নড়তে দেয়া হবে না। (১) তাঁরজীবনকাল কিতাবে অতিবাহিত করেছে। (২) যৌবনের সময়টাকে কিভাবে ব্যয় করেছে। (৩) ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে। (৪) তা কোনপথে ব্যয় করেছে। এবং (৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞানার্জন করেছে সে অনুযায়ী আমল করেছে কিনা। (তিরমিযি)

• শব্দার্থ:
لاتزلُ - নাড়াতে পারবে না। পদদ্বয়। ابن ادم - আদম সন্তান। حَتَّى - যতক্ষণ। يَسْتَلُ - জিজ্ঞাসা করবে। عَنْ خَمْسٍ - পাঁচটি বিষয়ে। عمره -তার জীবন। أَقْنَاهُ ধ্বংস করেছে, ব্যয় করেছে। شبابه তার যৌবনকাল। آبده (এখানে) সে কিভাবে কাটিয়েছে। এ তার ধন-সম্পদ। اَيْن -কোথায়। اكتسبه সে উপার্জন করেছে। اين কোনখানে। انفقه সে ব্যয় করেছে। عمل আমল করেছে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। علم - সে শিখেছে।

• রাবীর পরিচয়:
"ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবী করীম (সা) এর মদীনায় হিজরতের পর মদীনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন এবং ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতেন। আবু মুসা আশায়ারী (রা) বলেন, "আমার ইয়েমেন হতে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদ (রা) কে নবী পরিবারের লোক বলে ধারণা করতাম।"

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কুরআন, হাদীস, ফেকাহ ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে কজন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। নবী করীম (সা) বলেনঃ "কুরআন শরীফ যেভাবে নাযিল হয়েছে হুবুহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেনো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর নিকট যায়।"

এই জনের বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৮৪৮টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২১৫টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
আলোচ্য হাদীসে মানুষের নৈতিক চরিত্রের সংশোধনকল্পে আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালে জাবাদিহির অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের সংশোধনের আশা করা বৃথা। কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্তকালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পূর্নরূপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্মফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সূক্ষ্মভাবে বিচার -বিশ্লেষণ করা হবে। একমাত্র এ অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।

তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার-আচরণ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদীসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদীসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

• ব্যাখ্যা:
★১.
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ 
"আমি মানুষ আর জ্বীনকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।"
(সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬)

ইবাদাত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ "ইয়াবুদুন" শব্দটি "আবদুন হতে নির্গত। আর "আবদুন" শব্দের অর্থ হল গোলাম দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহূর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবনব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَ أَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ . (المؤمنون)
"তোমরা কি মনে করেছো যে, আমরা তোমাদেরকে অকারণেই সৃষ্টি করেছি, আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না? (সূরা আল মু'মিনুন-১১৫)

তাই দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর চাকচিক্যময় প্রতিটি বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি, ছোট্ট একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবনব্যাপী বিস্তৃত।

★২. প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে তার যৌবনকাল। নিম্নোক্ত চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এ যৌবকালেই। যথা-

(ক) চিন্তাশক্তি (Thinking Power)
(খ) ইচ্ছাশক্তি (Will Power)
(গ) মনন শক্তি (Power of soul)
(ঘ) কর্মশক্তি (Physical strength for working capacity)

অতএব দেখা যাচ্ছে ভালো অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবনই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারণ মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার, ব্যাভিচার ইত্যাদি সবকিছুই করে যৌবনকালে। দেখা যায় যৌবনে দুর্ধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গো-বেচারায় রূপান্তরিত হয়। কারণ বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ অসহায় করে দেয়। তাই বার্ধক্যে যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ হয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং চেষ্টাই থাক না কেন বার্থক্য আসার পর কোন একটি ভালো কাজও সুচারুভাবে সমাপ্ত করা যায় না। এখানেও বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবনের এতো গুরুত্ব।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
اغْتَنِمْ خَمْسًا شَبَابِكَ قَبْلَ هَرَمِكَ 
পাঁচটি বস্তুকে গনীমতের মালের মতোই মনে করো। তার একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনের। (মিশকাত)

অনেকেই মনে করে যৌবনে যা কিছু মনে চায় করে বার্ধক্য পর আল্লাহ্র নিকট তওবা করে সৎ কাজে মনোনিবেশ করবো। এ ধারণাই মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। তাই হাদীসে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এইজন্যই পরকালের প্রশ্নবলীর মধ্যে যৌবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি তার অন্যতম।

★৩. মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগলপারা। তার একটা লক্ষ্য ধন- সম্পদের স্তূপে সুখের সন্ধান করা। এজন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ, অথবা ধোকাবাজী যা কিছুই হোক না কেন তাতে কোন পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্বপ্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন, যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার নষ্ট না হয় এবং সকলেই সমভাবে সম্পদ ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ উপার্জনের মৌলিক বিধি-নিষেধ সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

(১) কারো অধিকার নষ্ট করে সম্পদ উপার্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মোহরের প্রাপ্য টাকা না দিয়ে নিজে ভোগ করা। এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
(২) ব্যাভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(৩), চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকার্জন বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৪) কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৫) গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবিকার পেশা নির্ধারণ করা যাবে না।
(৬) হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে। এমন কি হালাল পশু পাখীর মৃতদেহও এর অন্তর্ভুক্ত।
(৭) হালাল মালের ব্যবসা করলেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মূল্য বৃদ্ধির নিয়তে ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফালব্ধ টাকার মাধ্যমে।
(৮) সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ বা বর্ধিত করা যাবে না।
(৯) জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(১০) কোন পশু পাখীর দ্বারা খেলা দেখিয়ে।
(১১) মূর্তি অথবা প্রাণীর ছবির ব্যবসায়ের মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা না জায়েজ।
(১২) ওজনে কম দেয়া। ইত্যাদি।


★৪. উপরের বিধি নিধেগুলো সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। 

ব্যয়ের মৌলিক খাতসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
(১) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় করা যাবে না।
(২) নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
(৩) ছদকাহ্।
(৪) 'নিকটাত্মীয়ের হক।
(৫) ইয়াতিমের হক।
(৬) মিসকিন, ভিক্ষুকের হক।
(৭) আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যয় "জিহাদ ফি ছাবিলিল্লাহ"।
(৮) বিভিন্ন ধরনের কাফফারা আদায়কল্পে।
(৯) পথিক বা পর্যটকদের হক।

বস্তুতঃ প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে, উপরোক্ত শর্তবলী পালন করেই সে সম্পদ আয় এবং ব্যয় করেছে কিনা?

★৫. বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে রাসূলে আকরাম (সা) এর মাধ্যমে আল্লাহ'রাব্বুল আলামীনের প্রথম ফরমান- হলো:

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (علق) -
"পড় তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আলাকঃ১)

আয়াতে কারীমার তাৎপর্য হলো রবকে জানা বা বুঝার উদ্দেশ্যে পড়তে হবে। অন্য কথায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহানবী (সা) বলেছেনঃ
طلب العلمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ -
"মুসলমান প্রতিটি নর-নারীর উপর (দ্বীনের) জ্ঞানার্জন অবশ্য কর্তব্য-ফরজ (মুসলিম)।

স্রষ্টা-সৃষ্টি ও বিশ্বজাহান সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই প্রতিটি লোক তার নিজের এবং স্রষ্টা সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে আরও বুঝতে পারে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি আর তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি। এমনিভাবে যখন মানুষ তার স্রষ্টাকে জানতে ও বুঝতে পারে তখন স্রষ্টার দেয়া দায়িত্ব-কর্তব্য পালনও তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ইরশাদ করেনঃ
তবে আল্লাহর উপর ঈমান "তাগুদ"কে অস্বীকার করেই আনতে হবে। সূরা বাকারায় অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَة
(البقرة) الْوُسْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا 
"যে তাগুত (খোদাদ্রোহী শক্তি) কে অস্বীকার করে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো সে এমন একটি মজবুত রশি ধারণ করলো যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। (সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬)"

এখানে রশি বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা হতে বুঝা যায়, পৃথিবীতে দুটো শক্তি আছে। একটি তাগুদী বা শয়তানী শক্তি অপরটি আল্লাহর শক্তি। আর যে কান এক শক্তির আনুগত্য অপর শক্তিকে অস্বীকার করেই করতে হবে। এখানেও দেখা যাচ্ছে হক ও বাতিল চেনার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ইল্ম বা জ্ঞান। তাই দ্বীনি ইলম শিখতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।

অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ
النَّاسُ كُلُّهُمْ مَلْكَاءُ إِلَّا الْعَالِمُوْنَ وَالْعَالِمُونَ كُلُّهُمْ هَلْكَاء إِلَّا الْعَامِلُونَ .
সমস্ত মানুষই জাহান্নামী একমাত্র আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া, আর সমস্ত আলেমই জাহান্নামী হবে একমাত্র আমলদায় আলেম ছাড়া। (বুখারী) অর্থাৎ শুধু জ্ঞানার্জন করাই মুক্তির পথ নয় সাথে জ্ঞানানুযায়ী আমলের ও প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারে অবশ্যই রাব্বুল আলমীনের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। এখানে আলেম বলতে মাদ্রাসা থেকে সনদপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিতদেরকে বুঝানো হয়নি। ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে যারা মৌলিক জ্ঞান রাখেন তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।

• শিক্ষাবলী:
১। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে।
২। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌবন। তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
৩। ধন সম্পদ আয় এবং ব্যয় আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে হতে হবে এবং আল্লাহর সন্তোষ অর্জন হবে একমাত্র লক্ষ্য।
৪। দ্বীনের যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এবং
৫। জ্ঞানানুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে।

• তথ্যসূত্র:
১। জামেউত তিরমিযি
২। সহীহ আল বুখারী
৩। সাহাবা চরিত-ইসলামিক ফাউন্ডেশন
৪। সুপ্ত শক্তিও ঘুমস্ত প্রতিভা-ডেল কার্ণেগী
৫। সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং-সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৬। তাফহীমুল কুরআন-ঐ 
৭। মিশকাত শরীফ-

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

মাহে রমজানে রোজার প্রয়োজনীয় যাবতীয় মাসআলা || একজন রোজাদারের যে সকল করণীয় ও বর্জনীয় কাজ


“রমজানে রোজার যাবতীয় মাসআলা”

‘একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ’


রমযানুল মুবারক মাস সেসব নেয়ামাতসমূহের মধ্যে একটি নেয়ামাত যা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন। এ মাসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স.-এর মত নেয়ামাত আমরা পেয়েছি। এ মাসেই কুরআন মাজীদ দেয়া হয়েছে, যা হেদায়াত, ফুরকান, রহমত, নূর ও শেফা। মুসলিম উম্মাহর প্রাণস্পন্দন ও উন্নতির নিগূঢ় রহস্য ফী সাবিলিল্লাহর মাঝেই পাওয়া যায় প্রথম মানুষের বা মানবতার হৃদয় জয় করার জন্য জিহাদ, পরে সাংস্কৃতিক বিজয়ের জন্য জিহাদ-আর এ সকল জিহাদের সাথে সাথে চূড়ান্ত কামিয়াবীর জন্য আপন নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে জিহাদ। যাতে করে অর্জিত হয় তাকওয়া, ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং সাথে সাথে সমষ্টির তাকওয়া; রাতে জাগরণে শীতের রাতে ইশকের সাথে ওযু করা, লাইফে সাদাকাত (দান-খয়রাত) দিয়ানত, আমানত, আদালত (সুবিচার করা), শুজাআত (নির্ভীকতা, উথুয়াত (ভ্রাতৃত্ব) ও মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান। পবিত্র মাহে রমজানে একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ আলোকপাত করা হলো।

রোজা অবস্থায় যখন কাফফারা ওয়াজিব হয়:

১. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কোনো খাদ্য আহার করলে অথবা ওষুধ খেলে অথবা সিঙ্গা কিংবা সুরমা লাগানোর পর অথবা গীবত করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত আহার বা পান করলে।
২. প্রিয়জনের প্রিয় থুতু ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি খেলে।
৪. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী মিলন করলে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্ত থাকলে তার ওপরও কাজা-কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর স্ত্রী রাজি না থাকলে বরং তার সঙ্গে জোরপূর্বক করা হলে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।
৫. কামভাবের সঙ্গে স্ত্রীকে স্পর্শ করল অথবা চুম্বল করল বা আলিঙ্গন করল, তবে বীর্যপাত হয়নি, কিন্তু সে মনে করল, রোজা ভেঙে গেছে। ফলে ইচ্ছাকৃত পানাহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা এবং কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। (বাদায়িউস সানায়ে ২/৫৫৮)
৬. কেউ গোঁফে তেল লাগালো আর মনে করল রোজা ভেঙে গেছে, অতঃপর ইচ্ছাকৃত আহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে। (বাদায়িস সানায়ে ২/২৫৮)
৭. বিনা ওজরে একই রমজানে এক বা একাধিক রোজা রাখার পর ভেঙ্গে ফেললে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর রোজাগুলো একাধিক রমজানের হলে প্রত্যেক রমজানের জন্য এক একটি করে কাফফারা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুখতার: ৩/৩)


রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ:

১. ইচ্ছা করে বমি করা
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে
৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
৯. মুখ ভরে বমি করলে
১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে
১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে
১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।


যেসব কারনে রোজা কাজা করতে হয়:
১. ইচ্ছা করে বমি করা,
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা,
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব,
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে,
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে,
৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে,
৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে,
৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে,
৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে,
১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে,
১১. মুখ ভরে বমি করলে,
১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে,
১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে,
১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে,
১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে,
১৬. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে,
১৭. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে।


যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।


যে সব কারণে রোজা ভাঙ্গে না/রোজার ক্ষতি হয় না:
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলা-বালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস “ওরা চারজন” || কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ

ওরা চারজন
মেছবাহ উদ্দিন মারুফ 

 মারুফ, আব্দুল্লাহ, তৌহিদ ও আরমান। ওরা চারজন ছোটকাল থেকে খুব ভালো বন্ধু। ওরা যেনো চারজন একই মায়ের সন্তান। গ্রামে নতুন কেউ এলে তারা বুঝতো না এরা বন্ধু নাকি সহোদর, কারণ তাদের চলাফেরা অন্যান্য বন্ধুর মতো না। এরা ছোটকাল থেকে একসাথে খেতো, একসাথে থাকতো। তাদের এই বন্ধনটা যেন চারটি খুঁটি দিয়ে তৈরিকৃত দালান। যার একপাশ ভেঙে গেলে অপর তিনটি পাশ ধ্বসে পড়ার সম্ভবনা আছে। তাদের মাঝেও প্রচুর ঝগড়া হতো, এমনকি মারামারি ও হতো। কিন্তু সকালে ঝগড়া হলে বিকালে আবার তাদের একসাথে খেলার মাঠে দেখা যেত, তাই তাদের মাঝে ঝগড়াঝাটি হলে কেউ তা সমাধান করতে আসতো না, সবাই জানে এরা একটু পর ঠিক হয়ে যাবে, অযথা ওদের কাছে গিয়ে নিজের সময় অপচয় করে লাভ কি! বরং ওদের ঝগড়াঝাটি সবাই উপভোগ করে, ওরা সকালে ঝগড়া করে যখন বিকালে চা খেতে যেতো তখন মানুষ তাদের ব্যাঙ্গ করে বলতো 

-কিরে তোরা না ঝগড়া করলি,ফের একসাথ হয়ে গেলি!

তখন ওরা চারজন বলতো, 

-আমরা একসাথ হলে তোমাদের কি? দেখাও তো আমাদের মতো এমন বন্ধু কোথাও?


 তারা চারজন একই বিদ্যালয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ে ও তাদের একই দশা! এক টেবিলে বসা, একসাথে স্কুলে আসা, স্কুল চুরিসহ তাদের সব কাজ একসাথে হতো। স্যার একদিন ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, তখন এক-এক করে সবার শেষে আসলো চারজন বন্ধুর পালা, এক জনকে ডাকার সাথে সাথে  চারজনই উঠে দাড়ালো, স্যার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো 

-ডাকলাম একজনকে চারজন উঠলি কেন?

তখন চারজন সমস্বরে বলে উঠলো 

-আমাদের চারজনের লক্ষ্য একটাই!

স্যার বললেন, 

-বলতো দেখি তোদের চারজনের লক্ষ্যটা কি?

ওরা আবার সমস্বরে বললো, 

-আমরা চারজনই দেশের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হবো।

তখন স্যার হো হো করে হাসতে লাগলো, স্যারের সাথে ক্লাসের সবাই ও হাসতে থাকলো কিছুক্ষণ। হাসি থামিয়ে স্যার বললো, 

-তোরা দেশের সেরা গোয়েন্দা হবি, আরে বেটা তোরা গ্রামের সেরা গোয়েন্দাও হতে পারবিনা। 

চারবন্ধু খুবই অপমান বোধ করলো, বাকী ক্লাস না করে স্যার যাওয়ার সাথে সাথে ওরা বাড়ির পথ ধরলো। পথেই তারা সিন্ধান্ত নেয়, তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে দেশের সেরা গোয়েন্দা হওয়া। 


এর মধ্যে তারা প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে গেলো, দিনের বেলায় আড্ডা দেওয়া রাতে পড়াশোনা করেই তাদের সময় যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলো আরমান। কোনো কথা শুনলে চটপট উত্তর দিতো না, অনেক ভেবে চিন্তে সঠিক উত্তরটি দিতো। এলাকায় এবং স্কুলে তার সম্মান ছিলো মেধাবী ছাত্র হিসেবে, স্কুলের বাবুল স্যার তো তাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে ডাকতো। আর বাকী তিন বন্ধু মোটামুটি মেধাবী ছিলো, তাঁর মধ্যে কিছুটা হাবলা প্রকৃতির ছিলো মারুফ। 

সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা, তাই স্কুলের স্যারেরা চায় তাদের নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে। যেনো ছাত্রদের মন প্রফুল্ল থাকে, পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে পারে। বাবুল স্যার ক্লাসে আসলেন এবং এক-এক করে সবার মতামত নিলেন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। যে যার মতো করে মতামত দিলো। স্যারের মতামত গুলো মনপুত হলো না। স্যার তখন বলে উঠলেন

-আমার আইনস্টাইন কোথায়? তাকে দেখছি না যে? আজ আসেনি? 

ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে আরমানের কন্ঠস্বর শোনা গেলো, 

-স্যার আসতে পারি? 

তখন স্যার 'অবশ্যই' বলে অনুমতি দিলেন। আরমান শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলো এবং বসে পড়লো। তখন স্যার আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার এতো দেরি হলো কেন বলোতো? 

-স্যার রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো, তাই আসতে দেরি হলো।

আবারো স্যার বললো, 

-তোমায় ছাড়া একটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারছি না। আমরা স্কুল থেকে ঘুরতে যাবো তোমাদের নিয়ে, বলোতো কোথায় যাওয়া যায়? 

তখন আরমান বিনয়ের সাথে বললো, 

-স্যার আমায় একটু সময় দেওয়া যায়?

স্যার বললেন, 

-অবশ্যই, তুমি ভেবে আমাকে বলো। ছুটির সময় আমি আবার আসবো তোমার মতামত জানতে, কারণ আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। 

এই বলে স্যার চলে গেলেন। 


আরমান অনেকক্ষণ ভেবে সিন্ধান্ত নিলো এবার তারা জঙ্গলে যাবে। স্যার এলেন ছুটির সময় আবার আরমানের মতামত জানতে, এসে বললেন, 

-বাবা তোমার মতামত জানাও। 

তখন আরমান বললো 

-স্যার আমরা জঙ্গলে যেতে চাই। 

তখন স্যার মুখে প্রফুল্লতা এনে বললেন, 

-আমি জানতাম, আমার আইনস্টাইন ছাড়া কেউ এই সমাধান দিতে পারবে না!


স্কুল থেকে যাওয়ার তারিখ ঠিক হলো, তারিখ অনুযায়ী সবাই তৈরি হয়ে নিলো। কে জানতো? আরমানের দেওয়া মতামতটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

স্কুল থেকে গাড়ি ছাড়লো ছয়টা নাগাদ, তারা জঙ্গলে পৌঁছায় দশটার দিকে। স্যার আরমানকে দায়িত্ব দিলো সবাইকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। আরমান বাস থেকে নেমে সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করালো এবং সকলের উদ্দেশ্য বললো, 

-প্রিয় বন্ধুরা, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছি। আজ আমাদের আনন্দের দিন, তবে জঙ্গলে চলার পথটা অত্যন্ত দুর্গম তা  আমাদের সকলের জানা। তাই সবাইকে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে চলাফেরা করতে হবে এবং দলবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করবে। 

তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

-অবশ্যই। 

এরপর আরমান সবাইকে সাত দলে ভাগ করে দিলো এবং প্রত্যেক দলের সাথে দিলো একজন করে শিক্ষক। আর ওরা চারজনে মিলে করলো একদল, তারা সবার পিছনে থাকবে। 


খুব সুন্দরভাবে চলতে থাকলো ওদের জমকালো আয়োজন। এরমধ্যে তারা চলতে লাগতো জঙ্গলের ভেতর। পথিমধ্যে হঠাৎ আরমান চলে যায় প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তিন বন্ধু দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আরমানের জন্য, কিন্তু আরমানের আসার কোনো খবর নাই। এইদিকে তিন বন্ধু দাড়িয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে তারা আরমানকে খুঁজতে লাগলো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধা ছুঁইছুঁই। এখনো আরমানের কোনো হদিস মেলেনি।ঘোরাঘুরি পর্ব শেষে সবাই আগের জায়গায় একত্রিত হলো, কিন্তু এই চার বন্ধু কোথায় গেলো? এখনো আসছে না কেন? সবাইকে একরাশ চিন্তায় ঘিরে ধরলো। সবাইকে এক জায়গায় রেখে বাবুল স্যার একাই গেল তাদের খুঁজতে, কিছু দুর যাওয়ার পরে আরমানকে ছাড়া বাকি তিনজনকে পেল খুবই বিমর্ষ অবস্থায়! স্যার তাদের কারণ  জিজ্ঞেস করলে তারা ঘটনার বিস্তারিত জানায়, স্যারসহ আরমানকে খুজতে থাকে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হঠাৎ একটি কর্কশ আওয়াজ শুনতে পায়, 

-হে পথচারীরা তোমরা এই নিষিদ্ধ জঙ্গলে কেন এলে? দ্রুত তোমরা পালাও না-হয় সবাই মরবে!

এই বলে কন্ঠটি মিশে গেলো, এরপর একটু দুরে তীব্রবেগে  আগুন জ্বলে উঠলো। তারা ভয় পেয়ে সেই জায়গাটি ত্যাগ করলো। মনের ভিতর একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। গাড়ির মধ্যে কারো কোনো কথা নেই, ড্রাইভার যেন কতগুলো লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন নিজ গন্তব্যে এলো, যে যার মতো করে বাড়ির পথ ধরলো আনন্দের দিনটা তাদের বিষাদে পরিণত হলো। বহু পত্রিকায় ছাপানো হলো আরমানের নিখোঁজ সংবাদ, কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারেনি। 


বাকি তিন বন্ধুর বেহাল দশা! খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, বয়সের চাপে তাদের দেহ যেন নুয়ে পড়েছে! সবাই বুঝাচ্ছে আরমান একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ওরা কিছুই মানতে চায়না আরমান কে ছাড়া। 

এভাবে কিছুটা দিন পেরিয়ে গেলো হঠাৎ করে একদিন মারুফের মোবাইলে একটা কল আসলো। কলটি রিসিভ করতে পারেনি বাইরে ছিলো বিধায়। এসেই কল দিলো, ওপার থেকে ভেসে আসলো চিরচেনা কন্ঠ! তা হলো তার বন্ধু আরমানের। তাদের কথা শেষ হলো তিন চার বাক্যে। তা হলো, 

-দোস্ত আমি এখনো বেঁচে আছি, যেখান থেকে হারিয়ে গেছি ঠিক ঐখানে চলে আস আজ রাত দুটোর মধ্যে। রঙ মাখানো ইটের নিচে একটা কাগজ পাবি, ঐ অনুযায়ী কাজ করিস, বিদায়! 

বলে কলটা কেটে দিলো। মারুফ আব্দুল্লাহ এবং তৌহিদকে ব্যাপারটি জানালো। তারা কেউ বিশ্বাস করছে না, বললো

-বন্ধু মজা করা ঠিক না কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। 

তারা মানতে চাইছে না কোনো কিছুতেই, একটা পর্যায়ে মারুফ রেগেমেগে বললো তোরা থাক আমি একাই যাচ্ছি ওর উদ্ধারকাজে, এখন চলি এই বলে সে হাঁটা ধরলো। ওরা তখন চিন্তা করলো, মারুফ তেমন একটা রাগ করেনা, যখন ওর হৃদয়ে লাগে ঠিক তখনই রাগ করে। তাই তারা মারুফের পিছু নিলো। দেখলো কিছুদূর যাওয়ার পরে মারুফ চোখ মুছতেছে। তখন তারা ভাবলো, মারুফের কথাটি সত্য, না-হয় কান্না করতো না। কারণ অতি অল্পে কখনো মারুফ কাঁদেনা, তারা ছোটকাল থেকে তাকে চেনে। তারা সামনে গিয়ে বললো, 

-দোস্ত চল আমরাও যাবো। 

মারুফ তখন বললো, 

-তোরা গেলেও আমি নেবো না। গেলে নিজেদের মতো যা, আমি আমার মতো গেলাম। 

ওরা ভালোভাবে জানে মারুফকে যতই রিকুয়েষ্ট করুক, আর লাভ হবেনা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাকে ফলো করবে যখন সে বের হবে তখন তার পিছু নেবে।যেই কথা সেই অনুযায়ী কাজ। ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো কতক্ষণে বাহির হয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে রাত বারোটা, তার বাহির হওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। তৌহিদ বললো, 

-দোস্ত, মারুফ আমাদের সেইরকম ভাবে বোকা বানালো! বুঝলি? চল বাড়ি চলে যাই

-আব্দুল্লাহ বললো, না বোকা বানায়নি। তার চোখের জল মিথ্যা না। মন চাইলে চলে যা, আমি যাবো না। প্রয়োজনে সারারাত এখানে বসে থাকবো। 

তৌহিদও আর কিছু না বলে বসে রইলো।ঠিক বারোটা ত্রিশ মিনিটে  মারুফের দরজার আওয়াজ হলো, তখন আবদুল্লাহ বললো, 

-ঐ দেখ মারুফ বাহির হচ্ছে। 

তখন তারা কিছুটা দুরত্ব নিয়ে পথ চলতে থাকলো। মারুফ যখন বাইকে উঠলো তখন ওরা বললো, 

-কিরে আমাদের নিবি না? 

মারুফ বললো, 

-নিজের মতো করে যা।

মারুফ বাইক স্টার্ট দিলো, তৌহিদও  আবদুল্লাহ কে সাথে নিয়ে আরেকটা বাইক স্টার্ট করে রওয়ানা দিলো।


দেড়টার মধ্যে সেই স্থানে পৌঁছে যায় ওরা, বাইক দুটোকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসলো এবং সেই জায়গায় গেলো যেইখান থেকে আরমান হারিয়ে গিয়েছিল। ওখানে আরমানের কথা অনুযায়ী রঙ মাখা ইট থাকার কথা, কিন্তু তা পেলোনা! হঠাৎ তৌহিদ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো এবং মৃদু চিৎকার করলো। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো একটা রঙিন ইট, তখন মারুফ কে  বললো, 

-এইতো রঙিন ইট পেয়ে গেছি। 

মারুফ বললো, 

-ধাক্কা খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোকে। 

তখন ইটটি উল্টালো, আরমানের কথা অনুযায়ী একটা কাগজ ফেলো।আব্দুল্লাহকে পড়তে দিলো, আবদুল্লাহ চিঠি খানা পড়তে লাগলো:

"প্রিয় বন্ধুরা,

প্রথমে আমার সালাম নিস, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি যখন প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই, ঠিক তখন মৃদু আওয়াজে একটি মেয়েলি গলা শুনতে পাই, বাঁচাও বাঁচাও! একবার দুইবার নয় অনেকবার শুনতে পাই, তাই আমি আগ্রহী হয়ে সেদিকে যাই। তখন যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলামনা! দেখলাম, একটি মেয়েকে বস্তাবন্দি করা হচ্ছে। তখন আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, তোমরা কারা? কাপুরুষের মতো কেনো একটা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও ওকে। তারা বললো, তুই কেরে? আর নিষিদ্ধ জঙ্গলে কি করিস? আমি কিছু বলতে যাবো তখন শক্ত কিছু একটার বাড়ি অনুভব করলাম। আমি অজ্ঞান হইনি, কিন্তু ওরা ভেবেছিলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। এই সুযোগে আমি ওদের কিছু কথোপকথন শুনে নিয়েছি। একজন বলতেছে মেরে রেখে যাই। আরেকজন বলতেছে তুই জানিসনা এইখানকার কিছুই, বসের হুকুম কেউ অমান্য করেনা। চল একে বসের কাছে নিয়ে যাই। আমাকে তারা কিছু সবুজ ঘাসের সামনে রাখলো। এরপর একটি লোহার ধাতু নিলো বট গাছের নিচ থেকে। সেটা দিয়ে বৃত্তাকারে মাটি খনন করলো এবং দুজনে ধরাধরি করে একটি গামলা উঠালো। তখন দেখলাম একটি সুড়ঙ্গ পথ, যেখানে আছে দুটো সিড়ি একটা লাল অপরটি সবুজ তারা সবুজটি দিয়ে নামলো এবং ভয়ংকর আওয়াজে সাইরেন বেজে উঠলো। এরপর আমাকে এবং মেয়েটিকে ধপাস করে নিচে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করিনি ভয়ে। কারণ তারা জানে আমি অজ্ঞান। তাদের বস লোকটি বললো কিরে রাহুল শিকার আনতে গেলি একটা, এখন নিয়ে এলি দু'টো ব্যাপারটা কি খুলে বলতো দেখি, তখন রাহুল পুরো ঘটনা বললো। মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো এবং বস লোকটা বললো মালটাকে স্পে কর। আমাকে কি দিয়ে স্পে করলো জানিনা, তবে প্রথম স্পেতে আমি পচন্ড রকম কেশে উঠলাম। তখন বস লোকটা চিৎকার মেরে বলে উঠলো, রাহুল মালটা এনে ভালো কাজ করছিস, এর নার্ভ অনেক ভালো। যেখানে পাঁচ ছয়বার স্পে করার পরেও জ্ঞান ফিরানো কষ্ট হয়ে যায়। আর সেখানে একবারে ওর জ্ঞান ফিরে এলো। একে আমাদের কাজে ব্যবহার করবো। বস লোকটা রাহুলকে বললো এর মুখে আর স্পে করিস না, শুধু পানি ছিটা, রাহুল আমার মুখে পানি ছিটাতে লাগলো। আমি চিৎকার মেরে উঠে দাড়াই বলতে থাকি আমি এখন কোথায়? বস লোকটা বললো, দেখো যুবক আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো তার যদি ঠিকঠাক উত্তর দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো, না-হয় এখানে পঁচে মরতে হবে তোমায়। বলো, এখানে কেনো এসেছো? আমি শিক্ষা সফরে এসেছি  বলেছি এবং নানাবিধ কথা জিজ্ঞেস করার পরে এবার জিজ্ঞেস করলো পড়াশোনার ব্যাপারে কোথায় পড়ি কোন শ্রেণীতে পড়ি, আমি যখন বলেছি এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন ওর চোখ গুলো রসের গোল্লার মতো করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো কোন বিভাগ? আমি যখন বললাম বিজ্ঞান, তখন সে রাহুলকে বললো ঠিক লোককে নিয়ে এসেছিস। এবার সামান্য একে স্মৃতি হারানোর ইনজেকশনটা পুশড করে দে। আমি তার দিকে ভয়ার্ত চেহারায় তাকালে সে বাছাধন ভয় পেয়োনা অল্প কিছুক্ষণ কষ্ট হবে। এরপর তুমি আমাদেরই একজন হয়ে যাবে। এই বলে বস লোকটা চলে গেলো, রাহুল আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো একটা রুমে। যে রুমটা গ্লাস দিয়ে তৈরি, সেখানে অনেক গুলো মানুষ দেখতে পেলাম তারা আমায় দেখে বলে উঠলো রাহুল আমাদের নতুন অতিথি এলো বুঝি। রাহুল তাদের থেকে দুজনকে ডাকলো ইশারায় এবং বললো আমাকে শক্ত করে ধরতে। রাহুল আমার দিকে আগাচ্ছে  একটা ইনজেকশন নিয়ে পুশড করবে এইসময় আমি আমাকে ধরে রাখা দুজনকে সজোরে লাথি মারলাম, তখন তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাহুল কোনো দিকে না তাকিয়ে আমায় শক্ত করে ধরে ইনজেকশনটা পুশড করে, আমার নড়াচড়ার কারণে ইনজেকশনটা তোশকে পুশড হয়ে যায়, মনে হয় এখনো তোশকটি স্মৃতি হারিয়ে আছে। ইনজেকশন যে আমার শরীরে পুশড হয়নি তা রাহুল জানতো না। আমিও আমার স্মৃতি হারিয়ে ফেলছি ঐরকম অভিনয় করি। তাদের সকল কথা মেনে চলি, যা করতে বলা হয় তাই ঠিকঠাক ভাবে করে দিই। এখন তারা জানে আমি তাদের আওতাধীন। আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাহির হয়। চাইলে তখনই পালিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমি আসিনি তাদের পরিকল্পনা আমি জেনে গেছি তাই। আসি নাই কারণ তারা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র। যারা বিশ্ব দখল করতে চায়। তাই তারা বিশ্বের জ্ঞানী লোকদের নিয়ে এসে ইনজেকশন পুশড করে নিজেরদের অধীনে  নিয়ে আসে।আমি চাচ্ছি তাদের ঘৃণ্য স্বপ্ন প্রাসাদ ভেঙে দিতে। কারণ ওদের সকল ডকুমেন্ট আমার হাতে। এই যাত্রায় তোদের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই আজ সকালে মারুফকে কল করি, এরা এখানকার সকল দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেছে। আর তিনজন প্রহরী রেখে গেছে, তোরা চাইলে রাত দুটোয় আঘাত হানা সম্ভব, তোরা যেখানে আছিস, সেখান থেকে দুইশো হাত সামনে হেটে আয়। এরপর একটা বটগাছ পাবি, তার নিচে পাবি লোহার একটা ধাতু সেটা দিয়ে সবুজ ঘাসের চারদিকে বৃত্তাকারে খুঁড়ে ফেল ভালোভাবে। একটা গামলা পাবি দু'জনে শক্তকরে গামলাটি উঠা। এরপর লাল সিড়ি দিয়ে নামবি কারণ লাল সিড়ি শুধু তাদের বসের ব্যবহারের অনুমতি আছে অন্য কারো না, তাহলে শুরুতে বিপদ মুক্ত ভাবে আসতে পারবি। নেমেই দুজন প্রহরী দেখতে পাবি তারা তোদের কুর্নিশ করতে আসবে বস ভেবে। তখনই তাদের মোকাবিলা করবি সুন্দর ভাবে। চিৎকার মেরে বলতে থাকবি, শুভ কোথায় তোরা? এই অবস্থা কেনো আস্তানার? তখন শুভ আসলে মুখ চেপে বেধে অজ্ঞান করে দিবি। বাকি যা করার আমি করবো। আজ এই পর্যন্ত রাখি।"

আবদুল্লাহ পড়া শেষ করলে সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সবাই একসাথে বলে উঠলো, 

-বাবুল স্যার ঠিকই বলতো, আরমান হলো আমাদের আইনস্টাইন। 

এরমধ্যে মারুফের মনে পড়লো তার দুলাভাইয়ের কথা। তার দুলাভাই শীর্ষ পর্যায়ের সিআইডি অফিসার, সে দেরি না করে দুলাভাইকে ফোন দিলো এবং তাদের লোকেশন জানিয়ে রাখলো। বললো, আগামী দুই ঘন্টার ভিতরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এই বলে কল কেটে দিয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। 

তারা অভিযানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আরমানের দেওয়া চিত্র অনুযায়ী তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছলো। প্রহরী তিনজনকে অজ্ঞান করে বেঁধে রাখলো। এরপর ওরা আরমান কে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে এবং যাবতীয় ডকুমেন্ট নিয়ে নিলো এবং প্রাসাদের তালা মেরে উপরের দিকে চলে আসলো। কিছুদুর যাওয়ার পরে মারফের দুলাভাই কে দেখলো একটা জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বললো, 

-এতো রাতে না আসলে ও পারতেন। 

তখন তিনি বললেন, 

-সিআইডির কোনো রাতদিন নেই। তাদের জন্য সর্বক্ষণই হলো দিন। 

মারুফের দুলাভাই আরমানের সাথে কথা বললো এবং বিস্তারিত জেনে নিলো। সাথে সাথে পুলিশ হের্ডকোয়াটারে ফোন দিয়ে জানালো এবং বললো একটি কম্পিউটার সহ পুলিশ পাঠানোর জন্য। পুলিশ আসলো কম্পিউটার নিয়ে। কম্পিউটার আরমানের নিয়ে আসা হার্ডডিক্সটি সেট করা হলো, তাতে যা দেখলো পুলিশ রীতিমতো হয়ে গেলো। এতো সহজে সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। সাথ সাথে হার্ডডিক্সটির কপি পাঠানো হলো পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি তা পেয়ে রীতিমতোই বিস্মিত! চাকরির বয়সে তিনি অনেক সন্ত্রাসী ধরেছেন কখনো এতো খুশি হননি। হার্ডডিক্স কপি পাওয়ার পরে, তিনি সারাদেশে একযোগে অভিজান চালিয়ে পুরো সন্ত্রাসী চক্রকে ধরে ফেললেন এবং তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করেন। সেই সাথে চার বন্ধুকেও নিয়ে যান। এই বিষয়টি সরকারকে যখন জানানো হয় তখন তিনি সরেজমিনে চলে আসেন চার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। 


এইদিকে মারুফ, আবদুল্লাহ, তৌহিদের মা-বাবা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তিনটা ছেলে কোথায় গেলো? মারুফের দাদা যখন টিভি চালু করলো তখন দেখলো তার নাতিসহ চারজন বন্ধুর ছবি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে। আর সব সংবাদ মাধ্যম গুলো বারবার প্রচার করতে লাগলো আজকের টপ নিউজ, "বিশ্ব পেলো চারজন সাহসী যুবক, যাদের হাতে ধরা পড়লো শীর্ষ সন্ত্রাসী চক্র। যাদের সাক্ষাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত।" তখন মারুফের দাদা তার ছেলে ও বউকে বললো আমার নাতি কোথাও যায়নি ঐ দেখো টিভিতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মারুফের বাবা বললো, 

-বাবা কি আজেবাজে বকছো, তুমি ঠিক আছো তো? 

তখন মারুফের দাদা গরম হয়ে বললো,

 -আমি ঠিক আছি, যা ঐ দেখ টিভিতে।

একরকম বিরক্তি নিয়ে মারুফের বাবা টিভির সামনে এলো তিনি যা দেখলেন তারজন্য প্রস্তুত ছিলেননা! দেখলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছেলেসহ বাকি তিনজনকে ফুলের মালা পড়াচ্ছেন। নিজের চোখ যেনো বিশ্বাস করতে চাইছে না। চোখ কচলিয়ে আবার দেখলো ঠিকতো সব চ্যানেলে এক যোগে তাই দেখাচ্ছে। এরমধ্যে মারুফের দুলাভাই ফোন করলো, তিনি সব বুঝিয়ে বললেন। তাদের কাজে সারাবিশ্বে হৈচৈ পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের গোয়েন্দা হিসেবে নেওয়ার জন্য একের পর অফার আসতে থাকে, কিন্তু তারা কোনোটিকে গ্রহণ করেনি।তাদের একটাই কথা যা করবে তারা দেশের জন্যই করবে। তাদের জন্য একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যেখানে অতিথি হিসেবে থাকবেন আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ। জমকালো আয়োজন করা হলো এবং সেইদিন তাদের দেশের শীর্ষ পর্যায়ে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। এরমধ্যে তারা কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে, মা-বাবার সাথে দেখা করবে বলে। সে খবর শুনে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া জন্য এলাকার মানুষেরা অনুষ্ঠান করে বসে আছে। তারা আসা মাত্র সংবর্ধনা দিয়ে চমকে দেবে। আর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সেই স্যারটি।

তারা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই ফুল দিয়ে বরণ করলো বাবুল স্যার। তখনও তিনি বললেন, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি? 

এই বলে তিনি হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। আরমান বললো,

 -স্যার, আমি এসেছি। আজ আপনার কাঁদার দিন নয়, হাসবার দিন। তখন স্যার বললেন, 

-বাছা, এ আমার সুখের কান্না। এ আমার বিজয়ের কান্না।

কথাগুলো বলে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। প্রাইমারি স্কুলের স্যারটিকে তারা চার বন্ধু পা ছুঁয়ে সালাম করলো এবং তাদের সবার মা-বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। স্যারকে ওরা বললো, 

-স্যার, আমরা তো সার্টিফিকেট বিহীন গোয়েন্দা হয়ে গেলাম। তখন স্যার একটা কথাই বললেন,

-সবাইকে তোদের মতোই দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত!



লেখক:
কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ
সোনাগাজী, ফেনী
প্রথম প্রকাশকাল: ২০১৯ ইং, মাসিক কিশোরপাতা।

মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়? -মাওলানা ইমাম হোসাইন


দ্বীন বিজয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিহত হয় ইসলামের পরিভাষাগত তাদেরকে শহীদ বলা হয়।

"শহীদ" এই পরিভাষাকে রাসুল (স) আরো ব্যাপকতা অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন: জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে, আগুনে পুড়ে নিহত হওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে,পানিতে ডুবে মারা যাওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুকেও শহীদি মৃত্যু বলে। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রেখে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকেও শহীদি মৃত্যু বলে।

কিন্তু সম্মুখ সমরে দ্বীনের জন্যে লড়াই করে শাহাদাত আর উল্লেখিত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, আগুন এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের মর্যাদা এক নয়। বস্তুত এই দুই অবস্থার মৃত্যুকে তখনই শহীদি মৃত্যু বলা যাবে যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়। অর্থাৎ শাহাদাতের সাথে ঈমান বা বিশ্বাসের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর সকল ন্যায় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তি কি শহীদ?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অধিকার, সাম্য সমতা, মানবিক মর্যাদা, দেশ জাতির জন্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মানুষ অসংখ্য আন্দোলনে মারা গিয়েছে। এদের সবাইকে শরীয়াহর মানদন্ডে শহীদ বলা যাবেনা। শহীদ বলতে হলে ঐ ন্যায্য আন্দোলনের সাথে ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, দেশ ও জাতির দ্বীন এবং ঈমানের অপরিহার্যতার সম্পর্ক লাগবে। এইজন্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের শহীদ বলা গেলেও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নিহতদেরকে ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ডে কি শহীদ বলা যাবে? শহীদ হতে হলে ইসলামের বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। কারণ শহীদ মর্যাদাটি ইসলামী পরিভাষা। মোটকথা কাউকে শহীদ বলতে হলে তার ইমানের অপরিহার্য সম্পৃক্ততা লাগবেই।

বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীদের শহীদ বলা হলেও কথিত মুলধারার জাতিয়তাবাদি, সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী কর্মীদেরকে কি শহীদ বলা যাবে?

[এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার পুর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটগত এবং ব্যবহারগত শহীদ শব্দটির ২টি ধারা বিদ্যমান। যেমন: বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় মর্যাদাগত উপাধিতে দেশের আন্দোলনের যেকোন ব্যক্তিকে শহীদ বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক হিন্দু, নাস্তিক বামদেরকেও শহীদ উপাধি দিয়ে থাকে রাস্ট্র। যা ইসলামের মুলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাইকে মানতে হয়।

দ্বিতীয়ত, দ্বীন আর ইসলামী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিকে ইসলামী দলসমূহ শহীদ বলে থাকে।ফিকহী উসুলের দিক থেকে ইসলামে এটাকেই শাহাদাত বলা হয়ে থাকে যা সকল যুগেরই প্রারম্ভনা আজ পর্যন্ত। ]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো স্বৈরাচার জুলুমকে প্রতিহত করতে সকল দলমতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিহত সবাইকে শহীদ বলতে হলে তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে বলতে হবে। উদাহরণগত জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রবাদি, সেকুলারদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ন্যায্য হলেও পরক্ষণে তাদের বিশ্বাস যে তারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের মানব রচিত বিশ্বাসকে তারা প্রতিষ্ঠিত করবে। সুতরাং তাদের ন্যায্যত আন্দোলন সত্বেও বিশ্বাসের বিচ্যুতকারনে ইসলামী মুলনীতিতে শহীদ হবেনা। বিপরীতে ইসলামি দলগুলো স্বৈরাচার বিরোধী ন্যায্যত আন্দোলনে জুলুমের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামকেই প্রতিষ্ঠারই কর্মপ্রয়াস চালাবে। ফলশ্রুতি তাদের ন্যায্যত আন্দোলনে মাকাসাদ শরীয়াহ থাকার কারণে তাদের কোন কর্মী নিহত হলে শরীয়াহর মূলনীতিতে তাদেরকে শহীদ বলা যাবে।

মৌলিক জিজ্ঞাসা হলো স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামি দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়?

সাধারণত ইসলামি দলগুলো সামগ্রিক গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে না। মুলত গনতন্ত্র হলো আজকের বিশ্বের একটা নিয়মাতান্ত্রিক রাস্ট্রিয় পরিচালনা প্রক্রিয়া। যেখানে গনতন্ত্রের সকল মুলনীতির মাঝে কিছু আছে ইসলামের মূলনীতি সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে আর কিছু আছে যা ইসলামের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামস্টিক দিক ইসলামের সমর্থন যোগ্য।তাই ইসলামি দলগুলো রাস্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে গনতন্ত্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাহন হিসেবে দেখে। যা একালের সকল ইসলামী রাস্ট্রচিন্তাবিদ্বের সর্বসম্মত মত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনমত তৈরীর একটি বাহন হিসেবে গনতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীকে শহীদ বলা যাবে। বাহনগত দিক থেকে তা গনতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও মাকাসাদে শরিয়াহ তথা উদ্দ্যেশ্যগত দিক থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

[এছাড়াও বাংলাদেশের এখনকার আন্দোলন মুলত নিয়মাতান্ত্রিক জুলুম তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ জাতি এবং সামগ্রিক ইসলামকে অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলন। শুধুমাত্র একটা গনতন্ত্র শব্দ দিয়ে এই ন্যায্য আন্দোলনকে হালাল হারাম ফতোয়ার প্যাঁচে ফেলানো নিতান্তই চাটুলতা। ]

সুতরাং সকল আন্দোলনে যে কাউকে শহীদ বলতে হলে তার বিশ্বাস এবং মাকাসাদ তথা উদ্দ্যেশ্যে হতে হবে ইসলাম এবং শরীয়াহ। আর সকল ইসলামী দল তাদের সকল আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের মাকাসাদ থাকে মূলত হুকুমতে শরিয়াহ এবং ইকামাতে দ্বীন।

[বি: দ্র: শাহাদাতের কবুলিয়াত আল্লাহর দিকেই নিসবত। কাউকে আমাদের শহীদ বলা না বলার মধ্যে শহীদি মর্যাদা নির্ভর করে না। মূলত এটি আখেরাতের অর্জন। দুনিয়াতে আপনি যাকে শহীদ বলতেছেন পরকালে সে হয়তো আল্লাহর নিকট শহীদ না। আবার আমরা যাকে শহীদ মনে করতেছিনা হয়তো সে আল্লাহর নিকট শহীদ। এইজন্য মুমিন সবসময় তার ভাইয়ের শাহাদাতের দোয়া করবে।]


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।

বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩

যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান | প্রেমরোগের চিকিৎসা | আবদুল হামীদ ফাইযী


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ১

১- প্রেম আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য এক বড় নেয়ামত। তা যথাস্থানে প্রয়োগ করা এক ইবাদত। আর তা অপপ্রয়োগ করা হল গোনাহর কাজ। অর্থাৎ অবৈধ প্রেম হল সচ্চরিত্রতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিবাহের পূর্বে হৃদয়ের আদান-প্রদান বা পছন্দ অথবা ভালোবাসার নামে যুবক-যুবতীর একত্রে ভ্রমণ-বিহার, নির্জনে খোশালাপ, অবাধ মিলামিশা ও দেখা-সাক্ষাৎ, গোপনে চিত্তবিনোদন প্রভৃতি আদর্শ ধর্ম ইসলামে বৈধ নয়। বর্তমান পরিবেশে কেবল সেই যুবকই অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে পারে, যার হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহর ভয় বুকে থাকলে শত বাধা ও বিপত্তির মাঝে চলার পথ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে -এই ভয়ে যে নিজের প্রবৃত্তি দমন করবে, তার ঠিকানা হবে বেহেশ্যে। বরং তার জন্য রয়েছে দুটি বেহেশ্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে থাকলে আল্লাহ বান্দাকে এমন নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে নেন। ঈমানে আল্লাহর প্রতি ইখলাস থাকলে তিনি বান্দাকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) ও যুলাইখার ব্যাপারে তিনি বলেন, “সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন। প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন।” (সূরা ইউসুফ ২৪ আয়াত)

সুতরাং মনের সন্দেহ ও কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হল ঈমান। ঈমান সুদৃঢ় রাখ, কারো অবৈধ ভালোবাসায় ফাসবে না এবং অবৈধ উপায়ে কেউ তোমার মন চুরি করতে পারবে না।

২- প্রেমরোগের সবচেয়ে বড় অব্যর্থ ও আসল ঔষধ হল ধৈর্য ও মনের দৃঢ়-সংকল্পতা এবং সুপুরুষের মত মনের স্থিরতা। ইচ্ছা পাকা থাকলে উপায়ের পথ বড় সহজ। ধৈর্য কঠিন হলেও তার পরিণাম বড় শুভ; যেমন গাছের ছাল তেঁতো হলেও তার ফল ভারি মিষ্টি।মনের খেয়াল-খুশীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়-সংকল্প হও যে, তুমি ঐ শয়তানী কুমন্ত্রণায় সায় দেবে না। শয়তান হল তোমার প্রধান শত্রু এবং এই প্রণয়ের প্রধান দূত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়---।” (সূরা নুর ২১ আয়াত)

অতএব ধৈর্যের সাথে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।

৩- নজর পড়ার সাথে সাথে মনের মানসপটে কোন রূপসীর ছবি অঙ্কিত হয়ে গেলে তার মন্দ দিকটা মনে করো। ভেবো, সে হয়তো আচমকা সুন্দরী, আসলে সুন্দরী নয়। নতুবা বোরকার ভিতরে হয়তো অসুন্দরী। নতুবা ওর হয়তো কোন অসুখ আছে। নতুবা ওর হয়তো বংশ ভালো নয়। নতুবা ওর হয়তো ঘর-বাড়ি ভালো নয়। নতুবা হয়তো ওর সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। নতুবা ও হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না। নতুবা ওর অতীত হয়তো কলঙ্কিত, ইত্যাদি। আঙ্গুর ফল নাগালের মধ্যে না পেলে টক মনে করলে মনে সবুর হয়।

তাছাড়া বেল পাকলে কাকের কি? দেখছ কি ভ্যাভ্যা? যার সরষে তার তেল! তাতে তোমার কাজও নেই, লাভও নেই।

৪- জীবনের প্রথম চাওয়াতে ভালো বলে যাকে তুমি ভালোবেসে মনের কাছে পেয়েছ, সেই তোমাকে ভালোবাসবে এবং সে ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, বা আর কেউ তোমার কদর করবে না এমন ধারণা ভুল। ভালো কে? যার মনে লাগে যে তোমার ঐ লায়লার চেয়ে আরো ভালো লায়লা পেতে পার। সুতরাং বিবাহের মাধ্যমেও প্রেমময়ী ও গুণবতী সঙ্গিনী পাবে। তবে অবৈধভাবে ওর পেছনে কেন?

৫- প্রেম-পাগলা মজনু বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসছ, যে তোমাকে তার চোখের ইশারায় প্রেমের জালে আবদ্ধ করেছে, আজ যাকে তুমি তোমার জানের জান মনে করছ, কাল হয়তো সে তোমার অভাব দেখে, কোন অসুখ দেখে, কোন ব্যবহার দেখে অথবা তোমার চাইতে ভালো আর কোন নাগরের ইশারা দেখে, তোমাকে টা-টা’ দিতে পারে। যে তোমার ইশারায় তার নিজের মা-বাপ, বংশ, মান-সম্ভ্রম প্রভৃতি অমান্য ও পদদলিত করে তোমার কাছে এসে যেতে পারে, সে যে তোমার ও তোমার মা-বাপের মান রাখবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কথাও জেনে রেখো যে, আজ তুমি মারা গেলে কাল সে আবার অন্যকে বিয়ে করে নতুন সংসারের নতুন বউ হবে। সুতরাং এমন প্রেমের প্রতিমার জন্য এত বলিদান কিসের?

প্রেমিক বন্ধু! পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্যময় জিনিস আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বেশী আশ্চর্যময় জিনিস হল মেয়ে মানুষের মন। সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। তাকে জয় করতে বড় পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকেও হিমসিম খেয়ে যায়। সুতরাং তুমি কে? তুমিও হয়তো। একদিন বলতে বাধ্য হবে যে,

এ তুমি আজ সে - তুমি তো নহ, আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী?
কিছু মেরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
---প্রাণ নিয়ে এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দলে অলক্তক পরে এরা পায়!

এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন প্রীতি।
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্থন,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি!
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন,
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন!

বন্ধু আমার যদি তুমি ভাব যে, সব নারী তো আর এক রকম নয়। আমার লায়লা আমাকে ধোকা দেবে না। কিন্তু এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় বন্ধু? তার কি কোন বন্ধনী বা বেষ্টনী আছে? আর একান্তই যদি তোমার ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবৈধ প্রেম খেলে কেন, লুকোচুরি করে ফিসফিসিয়ে কেন, গোপন প্রেম-পত্র লিখে কেন? বরং বৈধ উপায়ে পয়গাম পাঠিয়ে তাকে তোমার প্রণয়-সুত্রে গেঁথে নাও। হালাল উপায়ে তুমি তাকে তোমার জীবনে নিয়ে এস এবং আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করো না।

৬- কোন তরুণীর রূপ দেখেই ধোকা খেয়ো না বন্ধু! প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাই হল একমাত্র বিশ্বসুন্দরী। কিন্তু সে তো আবেগের খেয়াল, বাস্তব নয়। তাছাড়া দ্বীন ও চরিত্র না দেখে কেবল রূপে মজে গেলে সংসার যে সুখের হবে, তা ভেবো না। কারণ, চকচক করলেই সোনা হয় না। কাচ না কাঞ্চন তা যাচাই-বাছাই করা জ্ঞানী মানুষের কাজ। পরন্তু ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব ক’দিনের জন্য? তাই অন্তরের সৌন্দর্য দেখা উচিত। আর সত্যিকারের সে সৌন্দর্য কপালের দুটি চোখ দিয়ে নয়, বরং মন ও জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি দিয়েই দেখা সম্ভব। অতএব সেই মন যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পার তাহলে তুমি ‘ইন্না লিল্লাহ-- পড়। আর জেনে রেখো যে, এমন সৌন্দর্য ও দ্বীন ও গুণের অধিকারিণী রমণী কোন দিন লুকোচুরি করে তোমার সাথে প্রেম করতে আসবে না।

৭- স্ত্রী হল জীবনের চিরসঙ্গিনী। সংসারে যত রকমের সম্পদ ও ধন মানুষ পায়, তার মধ্যে পুণ্যময়ী স্ত্রীই হল সব চাইতে বড় ও শ্রেষ্ঠ ধন। সুখ ও দুঃখের সময় সাথের সাথী এই স্ত্রী। এই স্ত্রী ও সাথী নির্বাচন করতে হলে মনের আবেগ ও উপচীয়মান যৌবনের প্রেম ও কামনা দ্বারা নয়; বরং বিবেক ও মন দ্বারা দ্বীন ও চরিত্র দেখে ভেবে-চিন্তে নির্বাচন করতে হয়। তাহলেই পরিশেষে ঠকতে ও পস্তাতে হয় না।

৮- কারো চোখের অশ্রুর কথা বলছ? তবে জেনে রেখো যে, মেয়েদের চোখ থেকে দু’ রকমের অশ্রু ঝরে থাকে; একটি দুঃখের, অন্যটি ছলনার। আর এটাও তোমার মন ও প্রেমের আবেগ দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞার বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে।

প্রেম-বিহুল বন্ধু আমার পূর্বেই বলেছি, সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। নারীকে ছোট ও দুর্বল ভেবো না। সমুদ্র-উপকূলে দাঁড়িয়ে মহাসমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, ঠিক কোন নারীর ততটুকুই অংশ দেখা সম্ভব হয়। নারী দুয়ে, অজেয় নারীর মন। আর আমার মনে হয় যে, তুমি নিশ্চয়ই দিগবিজয়ী বীর নও।

৯- তুমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, সে ধনীর মেয়ে নয় তো? অর্থাৎ, কোন প্রকারে সে তোমার জীবনে এসে গেলে, তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বাসনা পূর্ণ করে চলতে পারবে তো? যদি তা না হয় তাহলে শোন, দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং প্রেমের নামে নিজের জীবনে বঞ্চনা ও অভিশাপ ডেকে এনো না।

আবার কাউকে শুধু ভালো লাগলেই হয় না। তুমি তার বা তাদের পরিবেশ ও বাড়ির উপযুক্ত কি না, তাও ভেবে দেখ। নচেৎ বাওনের চাদ চাওয়ার মত ব্যাপার হলে শুধু শুধু মনে কষ্ট এনে লাভ কি? তাছাড়া তুমি যদি তোমার শিক্ষা, চরিত্র, ব্যবহার ও সাংসারিক যোগ্যতায় তাদেরকে মুগ্ধ করতে পার, তাহলে গরীব হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। আর তুমিই হবে তাদের যোগ্য জামাই। পক্ষান্তরে লুকোচুরিতে চরিত্র নষ্ট করে থাকলে তুমি তাদের চোখে খারাপ হয়ে যাবে। শেষে আর জামাইও হতে পারবে না।

১০- প্রেম-ভিখারী বন্ধু আমার! প্রেম যদি করতেই চাও তাহলে ক্ষণস্থায়ী এ ঢলন্ত-যৌবনা ফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কেন? অসৎচরিত্রা অসতীদের সাথে কেন? হ্যা, সে অসতী বৈকি? যে তোমার সাথে অবৈধভাবে প্রেম করতে আসে, অবাধ মিলামিশ, দেখা-সাক্ষাৎ, চোখাচোখি, হাসাহাসি করে সে অসতী বৈকি?

সুতরাং প্রেম যদি করতেই হয় তাহলে চিরকুমারী অনন্ত-যৌবনা, অফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কর। কাঞ্চন-বদনা, সুনয়না, আয়তলোচনা, লজ্জা-বিনম্র, প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ, উদ্ভিন্ন-যৌবনা ষােড়শীদের সাথে কর। যে তরুণীরা হবে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা, যারা তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি নজর তুলেও দেখবে না। যে সুরভিতা রূপসীদের কেউ যদি পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি মারে, তাহলে তার ঝলমলে রূপালোকে ও সৌরভে সারা বিশ্বজগৎ আলোকিত ও সুরভিত হয়ে উঠবে। যে সুরমার কেবলমাত্র মাথার ওড়না খানিকে পৃথিবী ও তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও ক্রয় করা সম্ভব হবে না। (বুখারী ৬৫৬৮ নং)।

সুতরাং হালাল উপায়ে বিবাহ কর এবং তার সাথেই প্রেম কর। আর উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে ঐ রূপসীদেরকে বিবাহ করার জন্য দেন-মোহর সংগ্রহ করতে লেগে যাও।

১১- অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে নির্জনতা ত্যাগ কর। কারণ, নির্জনতায় ঐ শ্রেণীর কুবাসনা মনে স্থান পায় বেশী। অতএব সকল অসৎ-চরিত্রের বন্ধু থেকে দুরে থেকে সৎ-বন্ধু গ্রহণ করে বিভিন্ন সৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হও। আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দাও। বিভিন্ন ফলপ্রসু বইপুস্তক পাঠ কর। সম্ভব হলে সে জায়গা একেবারে বর্জন কর, যে জায়গায় পা রাখলে তার সহিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যে তোমার মন চুরি করে রেখেছে। টেলিফোন এলে তার কথার উত্তর দিও না। পত্র এলে জবাব দিও না। তোমার প্রণয়ের ব্যাপারে তাকে আশকারা দিও না। এমন ব্যবহার তাকে প্রদর্শন করো না, যার ফলে সে তোমার প্রতি আশা ও ভরসা করে ফেলতে পারে। বরং পারলে তাকে নসীহত করো এবং এমন অসৎ উপায় বর্জন করতে উপদেশ দিও। তাতে ফল না হলে পরিশেষে ধমক দিয়েও তাকে বিদায় দিও। আর বেকার বসে থেকো না। কোন না কোন কাজে, নিজের কাজ না থাকলে কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা কর।

একা না ঘুমিয়ে কোন আত্মীয়, ভাই বা হিতাকাঙ্খী সৎ-বন্ধুর কাছে ঘুমাবার চেষ্টা কর। রাত্রে ঘুম না এলে যত কুরআন ও শয়নকালের দুআ মুখস্থ আছে শুয়ে শুয়ে সব পড়ে শেষ। করার চেষ্টা কর। 'সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার, আহামদু লিল্লাহ’ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার” ৩৪ বার পাঠ কর। তার পরেও ঘুম না এলে, ঘুম না হলে তোমার কোন ক্ষতি হবে -এমন ভেবো না। অথবা রাত পার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে মনে আক্ষেপ করো না। এমন ভাবলে ও করলে আরো ঘুম আসতে চাইবে না। অতঃপর একান্ত ঘুম যদি নাই আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে নামায পড়তে শুরু কর। এর মাঝে ঘুমের আবেশ পেলে শুয়ে পড়। ঘুম না এলে বিছানায় উল্টাপাল্টা করলে অন্যান্য দুআ পড়ার পর এই দুআ পড়, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্দুস সামাওয়াতি অআরযি অমা বাইনাহুমাল আযীযুল গাফফার।

১২- গান-বাজনা শোনা থেকে দূরে থাক। কারণ, পুর্বেই জেনেছ যে, গানে যুব-মন প্রশান্তি পায় না; বরং মনের আগুনকে দ্বিগুণ করে জ্বালিয়ে তোলে। সুতরাং প্রেমময় মনের দুর্বলতা দূর করতে অধিকাধিক কবর যিয়ারত কর, জানাযায় শরীক হও, মরণকে স্মরণ কর। উলামাদের ওয়ায-মাহফিলে উপস্থিত হও, তাদের বক্তৃতার ক্যাসেট শোন।

১৩- অভিনয় দেখা পরিহার কর। কারণ, ফি-যাত্রা-নাটক-থিয়েটার ইত্যাদি তো প্রেমের আগুনে পেট্রোল ঢালে। আর এ সব এমন জিনিস যে, তাতে থাকে অতিরঞ্জিত প্রেম। অবাস্তব কাল্পনিক প্রেম-কাহিনী ও রোমান্টিক ঘটনাবলী। অতএব সে অভিনয় দেখে তুমি ভাবতে পার যে, তুমিও ঐ হিরোর মত প্রেমিক হতে পারবে, অথবা ঐ হিরোইনের মত তুমিও একজন প্রেমিকা পাবে, অথবা ঐ অভিনীত প্রেম তোমার বাস্তব-জীবনেও ঘটবে। অথচ সে ধারণা তোমার ভুল। পক্ষান্তরে ঐ সকল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গমঞ্চের ধারে-পাশে উপস্থিত হয়ে চিত্তবিনোদন করার মত গুণ আল্লাহর বান্দাদের নয়; বরং প্রবৃত্তির গোলামদের।

১৪- যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাকে কখনো একা নির্জনে কাছে পাওয়ার আশা ও চেষ্টা করো না। ব্যভিচার থেকে দুরে থাকলেও দর্শন ও আলাপনকে ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করো না। জেনে রেখো বন্ধু! যারা মহা অগ্নিকান্ডকে ভয় করে তাদের উচিত, আগুনের ছোট্ট অঙ্গার টুকরাকেও ভয় করা। উচিত নয় ছোট্ট এমন কিছুকে অবজ্ঞা করা, যা হল বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভূমিকা। ছোট্ট মশা নমরুদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছোট ছোট পাখীদল। হস্তিবাহিনী সহ আবরাহাকে ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ছিদ্র একটি বিশাল পানি-জাহাজকে সমুদ্র-তলে ডুবিয়ে দিতে পারে। বিছার কামড়ে সাপ মারা যেতে পারে। সামান্য বিষে মানুষ মারা যায়। ক্ষুদ্র হুদহুদ পাখী বিলকীস রাণীর রাজত্ব ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ইদুর কত শত শহর ভাসিয়ে দিতে পারে বন্যা এনে। আর এ কথাও শুনে থাকবে যে, হাতির কানে নগণ্য পিঁপড়া প্রবেশ করলে অনেক সময় হাতি তার কারণেই মারা যায়।


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ২

১৫- প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চোখ, কান, জিভ, হাত, পা এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের ব্যভিচার সংঘটিত করে অবৈধ পিরীত। প্রিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়া হল পায়ের ব্যভিচার। অতএব প্রেয়সীর প্রতি যে পথে ও পায়ে তুমি চলতে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত নও, সেই পথের উপর তোমার পায়ের নিশানা ও দাগকে কোন দিন ভয় করেছ কি?

ভেবেছ কি যে, তোমার ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক নিশানা সযত্নে হিফাযত করে রাখা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “আমিই মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা ওরা অগ্রে পাঠায় ও পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিসই স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসীন ১২) প্রিয়তমার সাথে খোশালাপ হল জিভের ব্যভিচার। গোপন প্রিয়ার সাথে প্রেম-জীবনের সুমিষ্ট কথার রসালাপ তথা মিলনের স্বাদ বড় তৃপ্তিকর। কিন্তু বন্ধু! এমন সুখ তো ক্ষণিকের জন্য। তাছাড়া এমন সুখ ও স্বাদের কি মূল্য থাকতে পারে, যার পরবর্তীকালে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। যে জিভ নিয়ে তুমি তোমার প্রণয়িণীর সাথে কথা বল, সে জিভের সকল কথা রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে, তা তুমি ভেবে দেখেছ কি? মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের নিকটই আছে।” (সূরা ক্বাফ ৫০ আয়াত)

রসিক নাগর বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে তুমি প্রেমিকার সাথে মিলে যে পাপ করছ, সে পাপ কি ছোট ভেবেছ? ভেবে দেখ, হয়তো তোমাদের মাঝে এমন পাপও ঘটে যেতে পারে, যার। পার্থিব শাস্তি হল একশত কশাঘাত, নচেৎ প্রস্তরাঘাতে খুন। কিন্তু দুনিয়াতে এ শাস্তি থেকে কোন রকমে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আছে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লী। অতএব যে পুকুরের জল খাব না, সে পুকুরের পাড় দিয়ে যাব না’ -এটাই সুপুরুষের দৃঢ়সংকল্প হওয়া উচিত নয় কি? ভেবেছ কি যে, তুমি তোমার ভালোবাসার সাথে যে অবৈধ প্রেমকেলি, প্রমোদ-বিহার করছ, তা ভিডিও-রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রীতির স্মৃতি রাখতে গিয়ে অনেক সময় যে ছবি তোমরা অবৈধ ও অশ্লীলভাবে তুলে রাখছ, তা একদিন ফাস হয়ে যাবে।

এ সব কিছুই মানুষের চোখে ফাকি দিয়ে করলেও কাল কিয়ামতে তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে। “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত) এবং তার যথার্থ প্রতিদানও পাবে। প্রেম-সুখী বন্ধু আমার! যে মাটির উপর তুমি ঐ অশ্লীলতা প্রেমের নামে করছ, সেই মাটি তোমার গোপন ভেদ গ্রামোফোন রেকর্ডের মত রেকর্ড করে রাখছে। কাল কিয়ামতে সে তা প্রকাশ করে দেবে। পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (ঐ ৪ আয়াত)

বন্ধু আমার। তুমি হয়তো তোমার ঐ প্রেমকেলিতে মানুষকে ভয় করছ, মা-বাপকে লজ্জা করছ। কিন্তু সদাজাগ্রত সেই সর্বস্রষ্টাকে লজ্জা ও ভয় করেছ কি? যে স্রষ্টা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ তোমার দেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার তৈরী দেহকে তারই অবাধ্যাচরণে ব্যবহার করছ। এ কথা তো তুমি বিশ্বাস কর যে, আমাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দান। আমাদের ব্যবহারের জন্য তিনি আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথাস্থানে স্থাপন করে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিয়ামতে যখন আমরা আমাদের স্বকৃত পাপের কথা ভয়ে অস্বীকার করে বসব, তখন ঐ অঙ্গসমূহ কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাক্ষি দেবে। (সূরা ইয়াসীন ৬৫ আয়াত)

সুতরাং এ দেহ আল্লাহর মালিকানায়, আমাদের মালিকানায় নয়। এ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যদি তার অবাধ্যাচরণ ও বিরোধিতায় প্রয়োগ করি তাহলে তার চেয়ে বড় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে তার ইবাদত করার জন্য পাঠালেন দুনিয়াতে এবং তার মহা প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন আখেরাতে। কিন্তু বান্দা যদি সেই প্রতিশ্রুতির কথা, আখেরাত ও মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াই সর্বশেষ মনে করে, তবে নিশ্চয়ই তা লজ্জার কথা। এ জন্যই মহানবী %ি বলেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা তো -আলহামদু লিল্লাহ- আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি। তিনি বললেন, “না ঐরূপ নয়।

আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান)কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (লিঙ্গ, হাত, পা ও হৃদয়)কে (তার অবাধ্যাচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সব কিছু করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” (সহীহ তিরমিযী ২০০০ নং)

ভেবেছ কি বন্ধু! তোমার চোখ, কান, হাত, পা এবং শরীরের চামড়া পর্যন্ত কাল কিয়ামত কোর্টে আল্লাহর সামনে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে? কুরআন বলে, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকট পৌছবে, তখন ওদের চোখ, কান ও ত্বক ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে---” (সূরা ফুসিলাত ২০ আয়াত) “যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিভ, তাদের হাত ও তাদের পা, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (সূর নুর ২৪ আয়াত)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে ভয়ে নতজান হতে দেখবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার । আমলনামা (কর্মলিপি) দেখতে আহ্বান করা হবে। আর বলা হবে, তোমরা যা করতে আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। আমার নিকট সংরক্ষিত এই আমলনামা, যা সত্যভাবে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম।” (সূরা জাসিয়াহ ২৭-২৯ আয়াত) “ওরা কি মনে করে যে, আমি ওদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশ্তাগণ তো ওদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৮০ আয়াত)

গোপন-প্রেমিক বন্ধু আমার! ভালোবাসার নামে একজন উদাসীনা তরুণীকে গোপনে তার পিত্রালয় থেকে বের করে এনে কোন জায়গায় কোন মুন্সীকে ৫০/ ১০০ টাকা দিয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘরের বউ করে তুলে আনলে, সে যে তোমার জন্য হালাল হবে না, তা তুমি জান কি? মহানবী ৪ বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই নিজে নিজে বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ৩১৩১নং)।

অর্থাৎ, ঐ বউ নিয়ে সংসার করলে চির জীবন ব্যভিচার করা হবে। যেমন ব্যভিচার হবে স্ত্রী থাকতে আপন শালীর প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে তাকেও বউ করে ঘরে আনলে। যেমন দারুণ স্পর্শকাতর ঢাকঢাক গুড়গুড়’ পরিস্থিতিতে প্রিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করা অবস্থায় গোপনে চটপট লজ্জা ঢাকার জন্য বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হলেও তাকে নিয়ে সংসার বৈধ নয়। কারণ, বিবাহের পূর্বে বর-কনেকে ‘কোর্টশীপ বা হৃদয়ের আদান-প্রদানের কোন সুযোগ ইসলাম দেয়নি। আর সেক্সী কোন টেস্ট-পরীক্ষা তো নয়ই। অবশ্য উভয়ের জন্য একে অপরকে কেবল দেখে নেওয়ার অনুমতি আছে। তাছাড়া মহিলার গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ হয় না। সন্তান-প্রসবের পরই বিবাহ সম্ভব; যদিও সন্তান ঐ প্রেমিকেরই, যার সহিত প্রেমিকার বিবাহ হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে বিবাহ ও তালাককে এক প্রকার খেলা’ মনে করা হলেও, আসলে তা কিন্তু ঐ ধরনের কোন খেলা’ নয়।

সুতরাং নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োগ করতে চাইলে আল্লাহর বিধানে তা বাতিল গণ্য হবে। জেনে রাখা ভালো যে, জোরপূর্বক কোন তরুণীকে বিবাহ করলে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। যেমন কারো বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবেসে তুলে এনে তার সম্মতিক্রমে হলেও পূর্ব স্বামী তালাক না। দেওয়া পর্যন্ত এবং তার অভিভাবক সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত বিবাহ শুদ্ধ হয় না। তাকে নিয়ে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এ ছাড়া ভাইঝি, বোনঝি, সৎ মা, শাশুড়ী প্রভৃতি এগানা নারীর সাথে প্রেম ও ব্যভিচার করা সবচেয়ে বড় পশুত্ব! ১৬- কুলকুল-তান যৌবনের যুবক বন্ধু আমার! যদি কাউকে ভালো লেগেই যায়, তাহলে হালাল ও বিধেয় উপায়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা কর। আর ভেবো না যে, প্রেম করে বিয়ে বেশী সুখময়। বরং বিয়ে করলেই দায়িত্ববোধের সাথে প্রেমের চেতনা অধিক বাড়ে। এ পবিত্র প্রেমে কোন প্রকার ধোকা থাকে না, থাকে না কোন প্রকার অভিনয় ও কপটতা। যে নির্মল প্রেমে থাকে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। আর এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী # বলেন, “প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য বিবাহের মত অন্য কিছু (বিকল্প) নেই।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫২০০ নং)

অতএব প্রেম প্রকাশ ও বৃদ্ধি করা জন্য, প্রেমের ডালি খালি করার জন্য, প্রেম অনির্বাণ রাখার জন্য, প্রেম-রোগ উপশম করার জন্য, পবিত্র বিবাহ-বন্ধনের মত আর অন্য কোন বিকল্প গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহর কাছে দুআ করে গোপনে তোমার মানুষটিকে চেয়ে নাও এবং তাঁর নিকট হারামকারিতা থেকে শতবার পানাহ চাও। আর উপযুক্ত লোক লাগিয়ে বৈধ উপায়ে তাকে তোমার জীবন-সঙ্গিনী করে নাও। যে রতি হয়ে তোমার মনে এসেছিল, তাকে সতী হয়ে তোমার ঘরে আসতে দাও। যে প্রিয়া হয়ে প্রেমে ছিল, সে বধু হয়ে তোমার অধরে আসুক। যে তোমার দ্রাক্ষা-বুকে শিরীন-শারাব’ হয়ে এতদিন গোপনে লুকিয়ে ছিল, সে এবার প্রকাশ্যে তোমার পেয়ালায় এসে যাক।

কিন্তু একান্তই তোমার আশা যদি দুরাশা হয়ে থাকে, তুমি যেমন পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতে বড় যদি চাওয়া হয়ে থাকে, অথবা অন্য কোন কারণে যদি তুমি তোমার গোপন প্রিয়াকে তোমার জীবন-তরীতে না-ই পেয়ে থাক, তাহলে দুঃখ করো না। নিশ্চয়ই তাতে তোমার কোন মঙ্গল আছেই আছে, তাই তুমি তাকে পাওনি৷ অতএব এ ক্ষেত্রে তাকে মনে চাপা দেওয়ার জন্য খোজ করে তার চেয়ে বা তারই মত একজন (দ্বীনদার) সুন্দরীকে তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে ফেল। এটাই তোমার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য উত্তম। এতে তোমার পূর্ব নেশা কেটে যাবে, মন স্থির হয়ে সংসার সুখের হবে এবং ফাটা ও কাটা মনে

প্রলেপ পড়বে। আর বিবাহ যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে অবৈধ প্রণয় ও যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করতে আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর। ইনশাআল্লাহ, তোমার মনের সকল অঅসা’ দুর হয়ে যাবে, কারণ, রোযা হল তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির কারখানা।

নারী-পাগলা বন্ধু আমার! পুরুষের পক্ষে নারীর ফিতনার মত বড় ফিতনা আর অন্য কিছু নেই। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।” (আহমাদ, বুখারী ৫০ ৯৬, মুসলিম ২৭৪০ নৎ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) নারী-ঘটিত ফিতনা অথবা নারীকে কেন্দ্র করে ঘটিত ফিতনার হার এ জগতে কম নয়। আর এই ফিতনায় পুরুষের ধন যায়, জ্ঞান হারায়, মান হারায়, দ্বীন হারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণও হারায়। তাই তো মহানবী (সা.) পুরুষকে সাবধান করে বলেন, “অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।” (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০ নং)

শয়তানের যেমন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে, পুরুষের ব্যাপারে নারীরও বিভিন্ন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উভয়ের চক্রান্তের কথা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিতাড়িত শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশলের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, “নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা ৭৬ আয়াত) পক্ষান্তরে নারীর কৌশল ও ছলনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তোমাদের ছলনা ভীষণ!” (সূরা ইউসুফ ২৮ আয়াত)

সুতরাং জ্ঞানী বন্ধু! সাবধান থেকো। শয়তান ও নারীর চক্রান্ত-জালে ফেঁসে গিয়ে নিজের দ্বীনদুনিয়া বরবাদ করে দিও না। কেউ যদি তোমার কাছে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়, তবে সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার ছলনায় সাড়া দিও না। আর মনে রেখো যে, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,) ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।

সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম ১০৩১নং) ছলনাময়ী নারীর চক্রান্তে যাতে না পড়, তার জন্য বাংলা প্রবাদেও সতর্কবাণী এসেছে, তা মনে রেখো, কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো ঢেমনের বোলে। ঠিকই তো বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি। আর তাছাড়া জলের রেখা, খলের পিরীত’ থাকেও না বেশীক্ষণ। এ ধরনের চক্রান্তময় প্রেমে থাকে এক প্রকার সুড়সুড়ি, এক ধরনের স্বার্থ। যা শেষ হলে সব শেষ। সুতরাং মনে রেখো বন্ধু আমার! ‘জল-জঙ্গলনারী, এ তিনে বিশ্বাস নাই, বড়ই মন্দকারী।

নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এবং অনেকে নারীকে সামান্য জ্ঞান করলেও আসলে মনের দিক দিয়ে নারী বিশাল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হল নারীর মন। সুবিস্তৃত মেঘমালা এবং ক্ষিপ্রপামী বাতাসের গতিবেগ হয়তো নির্ণয় করা সহজ; কিন্তু নারীর মনের গতিবেগ নির্ণয় করা মোটেই সহজ নয়। তা মাপা বা অনুমান করা আদৌ আসান নয়। আর এ জন্যই অনেকে সরল মনে নারীর ছলনার গরল পান করে ধোকা খায়।

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া।

অতএব বন্ধু আমার! এমন নারীর ছলনা থেকে বাঁচার জন্য, এমন নারীর ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য তুমি হযরত ইউসুফ নবী (আঃ) এর মত দুআ কর,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ

অর্থাৎ, হে পরোয়ারদেগার! ওরা আমাকে যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করছে, তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি আমাকে ওদের ছলনা হতে রক্ষা না কর, তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা ইউসুফ ৩৩)।

মানুষের মন হল ফাকা ময়দানে পড়ে থাকা এক টুকরা হাল্কা পালকের মত। বাতাসের সামান্য দোলায় সে মন দুলতে থাকে, হিলতে থাকে, ছুটতে থাকে। মন হল পরিবর্তনশীল। সে মন থাকে আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে। তিনি মানুষের মন ঘুরিয়ে ও ফিরিয়ে থাকেন। অতএব এ বলেও দুআ করো তার কাছে,

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
অর্থাৎ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।

-কপিরাইট: আবদুল হামীদ ফাইযী 

শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩

সন্তানসমূহ হীরার খন্ড না হয়ে পাথরের নুড়ি হচ্ছে : মাওলানা ইমাম হোসাইন

কারণ: আমাদের সমাজের অধিকাংশ পিতামাতা গুলো সন্তানাদির ব্যাপারে অনেকটা ভরসা করে যে তারা আমাদের বৃদ্ধ বয়সের খুঁটি হবে, আর্থিক নিশ্চয়তার বাহন হবে। যারপরনাই তারা সন্তানাদিকে ছোট বয়স থেকে অনেকটা সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পিতামাতা সন্তানাদির সত্যিকার উন্নতি শিক্ষা, মেধা, নৈতিক উৎকর্ষতাকে যতটা না গুরুত্ব দিচ্ছে তার চেয়ে বেশী সন্তানের আর্থিক সচ্ছল হওয়াটাকে বেশী সাপোর্ট দিচ্ছে। 

যে সন্তানাদিগুলো শিক্ষাদীক্ষা বা নৈতিক উৎকর্ষতার দিকে যাচ্ছে কিন্তু আর্থিক সাপোর্ট আশানুরূপ করতে পারছে না তখন তার প্রতি পিতামাতা, পরিবার এবং এই সমাজের মানুষগুলো তুচ্ছ অবজ্ঞা দৃস্টিতে তাকাচ্ছে যে এই সন্তানগুলো তাদের বোঝা। ফলে একটা সময় এরা তাদের পড়াশোনা বা নৈতিক উৎকর্ষতা থেকে বের হয়ে  আর্থিক সচ্ছলতার জন্য তাদের সারাজীবনের আদর্শিক শিক্ষাটা কে ঘুষ, দুর্নীতির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মুলত এই সমাজ পরিবার তাদেরকে অনেকটাই বাধ্য করছে। কারণ জাহল সমাজ তাকে মুল্যায়ন বা তুলনা করছে সমাজের ঐ শ্রেনীটার সাথে যে সমাজে নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, শিক্ষা দীক্ষার নিম্নস্তরে জাহল কিন্তু ধনবান। পরিবারে তুলনামুলক তাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে যে আর্থিক সাপোর্ট বেশী দেয় পরিবার মনে করছে আমার সেই সন্তান যেমন হোক তার আর্থিক সাপোর্টই মুল। তখন সমাজের শিক্ষিত সেই শ্রেনীটা হতাশার জায়গা থেকে বিচ্যুত পথ বেচে নেয়।

আজকে যদি আমাদের সকল পিতামাতাগুলো নিজেদের জীবনের সকল পর্যায়ে ভরসা করতো আল্লাহর উপর তাহলে তাদের বৃদ্ব বয়সে আর্থিক সাপোর্ট নিরাপত্তা আল্লাহ নিজ কুদরতে করতেন। কিন্তু যখনই তারা সন্তানাদির উপর ভরসা করে, তখনি তারা বৃদ্ধ বয়সে ঐ সন্তানাদি দ্বারা লাঞ্চিত হচ্ছে। মুলত পিতামাতা সমুহ যদি সন্তানাদি গুলোকে সত্যিকারার্থে আল্লাহর জন্য এবং উম্মাহর কল্যানের জন্য ওয়াকফ করতে পারতো দেখা যেত আল্লাহ তায়ালা এই সন্তানগুলো তাদের চক্ষু শীতলকারী এবং নিরাপত্তার বাহন হিসেবে তৈরী করে দিতো।

পিতামাতাসমুহের আরো একটি হিপোক্রেসি চিন্তা এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য করে তাহলো সন্তানাদির ভবিষ্যৎ জীবনের আর্থিক, বাস্তুসংস্থানিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ফলে তারা যেকোন পর্যায়ে হালাল-হারাম বিবাচনা না করে সন্তানদের জন্য টাকা আয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের হালাল অর্থের সাথে হারাম অর্থ মিশ্রিত হয়ে আয়কৃত সকল অর্থই হারামে রূপান্তরিত হয়। আর এই হারাম উপার্জিত টাকাগুলো যে সন্তানাদির ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবনের জন্য সঞ্চয় হয়েছিলো তখন ঐ সন্তানাদি গুলো এই টাকা দিয়ে মদ, জুয়া, ব্যাভিচারসহ নৈতিক পদস্থলের নিম্নে গিয়ে পৌছে যাচ্ছে। এবং সুন্দর জীবনের পরিবর্তে তাদের কুৎসিৎ জীবন হচ্ছে।

মুলত পিতামাতা যদি সন্তানাদির রিযিকের ব্যাপারে আল্লাহর তাকদীরের উপর বিশ্বাস করতো এবং নিজেরা অল্প তুস্টে হালাল ইনকামের মধ্যে থাকতো দিনশেষে দেখা যেতো তাদের সন্তানাদিগুলো হালাল উপার্জন ভক্ষনের মাধ্যমে এরা যুগের গাজ্জালি, তাইমিয়াহ, ইবনে কাসিরের মতো তৈরী হতো। হাজারবর্ষ পরেও মানুষ ঐ পিতামাতাগুলোকে পড়তো আর সম্মান করতো। কিন্তু আমাদের পিতামাতাগুলো নগদ লাভের আসায় তাদের হিরার খন্ড সন্তানগুলোকে পাথরের নুড়িতে পরিণত করছে।

আল্লাহ আমাদের সকল পিতামাতা সমূহকে তাদের সন্তানের ব্যাপারে সঠিক চিন্তা করার তাওফিক দান করুক, আমীন।


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।