আত্মত্যাগ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইস্পাহানে জন্ম লাভ করা এক মুসলিম বনিক পরিবারের সন্তান বাংলায় মুঘল মসনদের হাত শক্তিশালী করার জন্য আমৃত্যু নিজেকে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় নিয়োজিত রাখেন। তিনি ইতিহাসে মীর জুমলা নামে অধিক পরিচিত। তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর হতে বাংলার সার্বভৌম অধিকার স্থিতিশীল রাখার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন। তারই উত্তরসূরি একবিংশ শতকের বাংলাদেশের বীরযোদ্ধা শহীদ আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ফয়সাল, ওয়াশিমসহ অসংখ্য বীর শহীদদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে করেছে ঋণী। মীর জুমলার জীবন যেমন বাংলাকে করেছিল স্থিতিশীল অঞ্চল, তেমনি ২০২৪ সালের শত শত শহীদের রক্ত এবং হাজার হাজার আহত, পঙ্গু, চোখ হাত-পা হারা এবং জ্ঞান হারাদের অসীম ত্যাগে বাংলাদেশকে তৈরি করবে সাম্য, মানবিক এবং নৈতিক দেশে হিসেবে এবং এ দেশ স্থিতিশীল হিসেবে টিকে থাকবে ভবিতব্য ইতিহাসে।
•মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির পতনের কারণ
মুসলিম জাতি কোনো রাজনৈতিক শক্তির নাম নয়, যা আজ বিশ্বে বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। মুসলিম হলো এক মানবিকতার উম্মাহ বা জাতি, যা কোনো ধর্মের ছাঁচে বিবেচনা করা যায় না। একজন মুসলিম বিবেচনা করে সত্য, ন্যায়, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতাকে পুঁজি করে। প্রত্যেক মানবসন্তানের কষ্টই হলো মুসলিম শাসকের কষ্ট বা যাতনার কারণ। মানবতার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওহি জ্ঞান (ওহি মাতলু ও গায়রে মাতলু তথা কুরআন ও হাদীস), প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে মদিনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং বৈদেশিক সম্পর্কের নমুনা সৃষ্টি করেন, যার আলোকে তাঁর তিরোধানের পর খলিফাগণ দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। এমতাবস্থায় মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি একটি ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এবং অমুসলিম শাসকরা তাদের প্রভাব, শক্তি ও শিক্ষার আলোকে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে ব্যাখ্যা করে।
তখন যদি মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি নিজেদেরকে রাসূলের সঠিক অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ হয়, তবে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এবং মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির মৌলিকত্ব বলতে আর কিছু থাকে না; যা আজকের তথাকথিত বা প্রচলিত মুসলিম শক্তির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসূলের রাজনৈতিক জ্ঞানকে অবজ্ঞা এবং পরিত্যাগ করে অমুসলিম রাজনৈতিক শক্তির কৌশল, জ্ঞান, অভিজ্ঞতাকে মুসলিম রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নিজেদের পদ-পদবিকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বেচ্ছাচারীর ন্যায় প্রশাসন পরিচালনা করে এবং তা মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা বলে চালিয়ে দিতে থাকলে প্রকৃত মুসলিম আদর্শ বা রাসূলের রাজনৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়ে যায়। ফলে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আজকের সময়ের অনেক তথাকথিত মুসলিম যাদুঘরের ব্যবস্থাপনা বলে বর্ণনা করেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই মুসলিমদের রাজনীতির সঠিক পাঠ না থাকা এবং এ পঠনকে সঠিকভাবে অনুসরণ না করার ফলে মুসলিম বিশ্বে এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার পতন বা মৃত্যু ঘটেছে।
•মীর জুমলার জন্ম ও পরিচয়
তিনি ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের বিখ্যাত ইস্পাহান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সেখানকার এক দরিদ্র তৈল ব্যবসায়ী ছিলেন। ছোটো বয়সে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন। তদানিন্তন সময়ে হীরার খনিসমৃদ্ধ ভারতের গোলকুণ্ডা তথা হায়দারাবাদ রাজ্যে অন্যের ব্যবসায়িক কাজের সহযোগিতার করার নিমিত্তে ছোটো চাকুরীতে যোগদান করেন। সময়ের বিবর্তনে তিনি নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে কেরানির চাকুরী থেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মীর জুমলা ব্যবসা-বাণিজ্যে এত বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেন যে, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শুরাট (ভারতের গুজরাট), আরাকান, আয়ুথায়া (বর্তমানে দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড), বালাশোর (উড়িষ্যা প্রদেশে), আচেহ (ইন্দোনেশিয়া), মালাক্কা (মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া), যোহোর (মালয়েশিয়া), বান্তাম (ইন্দোনেশিয়া), মাকাস্সার (ইন্দোনেশিয়া), জেদ্দা, বন্দর আব্বাস (ইরান), সিলন (শ্রীলংকা), বসরা (ইরাক), এডেন (ইয়েমেন), মাস্কাট (ওমান), মালদ্বীপ এবং মুখা (ইয়েমেন) প্রভৃতি বন্দরে তাঁর নিজ ব্যবসায়ী কাজ পরিচালনা করার জন্য গমন করেন এবং তদানিন্তন সময়ে একজন সফল ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
•মীর জুমলার রাজনৈতিক জীবন
ব্যবসায়িক জীবনে সফলতার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি প্রথমে গোলকুণ্ডার কুতুবশাহী সুলতানকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে শাসকের নিকট নিজের অবস্থা সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা করেন। অতঃপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেখানকার সুলতানের দরবারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাজদরবারের প্রধান উজিরের দায়িত্ব পান। কিন্তু রাজদরবারের অন্য সদস্যদের কূটকৌশলের কারণে তাঁর ওপর শাসকের নেক নজর না থাকলে তিনি তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে যোগাযোগ করেন এবং কুতুবশাহী রাজার পরিবর্তে মুঘল সম্রাটের আনুকুল্য লাভের মাধ্যমে তাঁর ভবিষ্যৎ পথ বিনির্মাণ করেন।
তিনি মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময়ে গোলকুণ্ডা, বিজাপুরসহ দাক্ষ্যিনাত্যের আরও অনেক অঞ্চল মুঘলদের করদ-রাজ্য হিসেবে পদানত করতে সক্ষম হন। তিনি নিজ প্রতিভা বলে ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ির পুত্র ও কেরানি পদের ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠতম সমরনায়ক এবং সুবাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলার মুঘল সুবাদার হিসেবে ক্ষমতা লাভের পর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে আসামে অভিযান প্রেরণ করেন জুমলা। তিনি একজন সেনা ও নৌ বিদ্যায় পারদর্শী এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি হওয়ায় আসাম, কোচবিহার এবং কামরূপ দখল করেন।
•বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
মীর জুমলাকে মুঘল আমলে বাংলার সুবাদার করে ‘খাঁন ই খানান মুয়াজ্জাম খান’ উপাধী দেওয়া হয়। তিনি বাংলার অস্থির রাজনৈতিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। মীর জুমলা শুধ বাংলারই সুবাদার ছিলেন না; এর পূর্বাঞ্চলীয় গৌহাটি, কোচবিহার, কামরূপ (আসাম), অহম (আসাম) এলাকাকে সুবাহ বাংলার সাথে এতত্রিত করে মুঘল প্রশাসনের কর্তৃত্বে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চালান তিনি। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সুবাদারি আমলে এ সকল অঞ্চলে নিজের অবস্থান মজবুত রাখতে সক্ষম হন।
•মীর মুগ্ধের জন্ম ও শাহাদাত
তাঁর নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (১৯৯৮-২০২৪ খ্রি.)। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে অনার্স পাশ করে ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনাল্স থেকে এমবিএ করছিলেন। বাংলাদেশের জুলাই অভ্যূত্থানের সময় ছাত্রদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিতরণের সময় গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন মুগ্ধ। আজকের আলোচনায় মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের আত্মত্যাগ বাংলা, বাংলাদেশ এবং বিশ্ব মুসলিম প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য ও মিলের বিষয়টি ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা এ সময়ের দাবি।
•মীর জুমলার সময়ে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা
বাংলা ছিল তখন দিল্লির অধীনস্ত এক শক্তিশালী মুসলিম-প্রধান এলাকা। সে সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলোর মধ্যে শুধু আমেরিকা মহাদেশে মুসলিমদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ইতিহাস এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুসলিম শাসকের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় নিজেদেরকে তৎপর রাখত। তৎকালীন সময়ে উসমানীয় খলিফাদের আনুকূল্য লাভের জন্য ইউরোপের আজকের প্রভাশালী ফ্রান্স, বৃটিশ, ইতালি, রাশিয়াসহ অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধানরা সজাগ থাকত সর্বদা। অনুরূপভাবে এশিয়ার রাজাদের মধ্যে আজকের প্রভাবশালী চীন ও অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা ভারতের সুলতানী, মুঘল, সাফাবী এবং উসমানীয় শাসকদের সাথেও সদ্ভাব রেখে চলত তারা। অমুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা তাদের প্রয়োজনে মুসলিম সরকারপ্রধানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করত।
উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের মুঘল এবং উসমানীয় তুর্কিদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলত। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে উসমানীয়দের ক্ষমতা স্তিমিত হতে থাকলে মুসলিম অঞ্চলে তারা নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম অঞ্চল দখল করতে থাকে। বৃটিশ, ইতালি, পর্তুগিজ, ডাচসহ অন্যান্য কোম্পানি ও সরকার তাদের প্রয়োজনে মুসলিম এ সকল প্রভাবশালী সরকারের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখত। কিন্তু মুসলিম অনৈক্যের সুযোগ তৈরি এবং সেই সুযোগে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। সময়ের বাস্তবতায় অমুসলিম শক্তির কাছে মুসলিম শাসকগণ পরাজিত হন। আজ অবধি এ শক্তির পুনরুত্থান বা পুনরুদ্ধার হয়নি।
•মীর মুগ্ধের শাহাদাতকালে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা
আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে চলছে, মীর জুমলার সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তা থেকে ভিন্ন। মুসলিম শাসক ও নেতাদের অনৈক্যের সুযোগে বৃটিশসহ অন্যান্য ইহুদী-খ্রিস্টান শক্তির পরোক্ষ মদদে ১৮২৫ সালের পর সৌদ-উসমানী দ্বন্দ্ব প্রকট রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ১৮৫৭ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতে বৃটিশ শাসন শুরু হলে মুসলিম নেতা ও শাসকগণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। ১৯১৭ ও ১৯৩৯ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মুসলিম নেতৃত্ব ও দুর্বল প্রশাসন শতধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।
তখন সৃষ্টি হয় বিশ্ব নেতৃত্বের নতুন পঞ্চ শক্তির উত্থান; যেখানে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিশালী অবস্থায় ছিল না। ফলে মুসলিম রাজারা সম্পূর্ণভাবে একেক সময়ে একেক শক্তির পেছনে জোট করে ছুটতে থাকে। কিন্তু তারা ইউরোপীয় শক্তি বা অন্যান্য দিকে ঝুঁকলেও নিজেদের রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণ বিশ্বে কোনো শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তাই একসময়ের নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম শাসকগণ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, যা আজকের রাজনৈতিক ইতিহাসে লক্ষণীয়।
•অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাপনার ইতিহাস
মীর জুমলা হতে মীর মুগ্ধের সময়ের মুসলিম প্রতিবেশ পরিবর্তনের কারণ খোঁজ করা অতীব জরুরি। মুসলিম শাসকদের এ অবস্থা কেন হলো, কিসের অভাবে, কাদের জন্য, কিভাবে এ অবস্থা হতে আবার পূর্ব ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া সম্ভব; তা আজকের ভাবনার বিষয়।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে- ইস্পাহানের এক ছোট্টো তেল ব্যবসায়ির সন্তান অল্পকিছু শিক্ষা লাভের পরও নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় নিজের রাজনৈতিক ইতিহাসের আসন উজ্জল স্থানে নিতে সক্ষম হন। সে সময় ইস্পাহান হতে বাংলা পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রের প্রধান মুসলিম শাসক বা মুসলিম শাসকের আনুকূল্যে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে ছিল। তদানিন্তন সময়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তিনটি প্রধান শক্তি তথা উসমানীয়, সাফাবী এবং মুঘল রাজনৈতিক বলয়ে আবর্তিত হতো।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা দেশ, এমনকি অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম শক্তিও আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ই.ইউ, রাশিয়া, ভারত, চীনের নানা কৌশল ও পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ রাজনৈতিক গতি পরিবর্তনের ইতিহাস আজকের বাস্তবতায় গবেষণার দাবি রাখে। কেননা বর্তমান শাসকদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রশাসনের বাইরের রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। আশার দিক হলো- আজকের পৃথিবীর বাস্তবতায় মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রের শাসকদের স্থলে দেশপ্রেমিক সুসংগঠিত নকীবদের পদচারণা পৃথিবীব্যাপী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সেকেলে পুরাতন মানসিকতার শাসকশ্রেণির পরিবর্তন করা সম্ভব হলে নতুন মুসলিম বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। যার মাধ্যমে রাসূলের মানবিক, সাম্য এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হবে বিশ্বজুড়ে।
•বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা
১৯৭১ সালে এদেশের দামাল ছেলেদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা চুয়ান্ন বছরেও অধরা থেকে যাচ্ছে। এর কারণ খুঁজে বের করার এ মোক্ষম সময়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা থাকা একটি স্বাধীন দেশের জন্য খুবই জরুরি। কেননা এতদিন যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কাগজে কলমে ছিল, তা এত বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে এ দেশের জনসাধারণ দেখতে পায়নি। তাই বিভিন্ন সময়ে এ দেশের তরুণ দামাল সন্তানদের দিতে হয়েছে অনেক উচ্চমূল্য। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে এদেশ দেখেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনাঅভ্যূত্থান, দেখেছে একই বছরের ৩ ও ৭ নভেম্বরের অনেক লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস।
এদেশ আরও দেখেছে ১৯৮১ সালের আরেক পৈশাচিক রক্তাক্ত বাস্তবতা, এরশাদের স্বৈরশাসন এবং ১৯৯০ সালে গণঅভ্যূত্থান, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গণতন্ত্রের মডেলে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন। আরও সম্ভব হয়নি বিদেশী হায়েনাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে দেশী প্রশাসকদের পদ লেহনের কারণে। এ সুদীর্ঘ চুয়ান্ন বছরে দেশের মানুষ হয়েছে শতধাবিভক্ত। তাই এদেশকে গড়তে হলে নিতে হবে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সেটা সম্ভব হবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন করার মাধ্যমে। মানুষের আকাঙ্খাকে মর্যাদা দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে, যেন তারা একেকজন হয়ে ওঠে দেশমাতৃকার সেবক ও সাচ্চা প্রেমিক। তবেই এ দেশ সুসংগঠিত হবে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্থায়ীত্ব হবে অনেকদিন।
•রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের উপায়
মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের এই দেশে রাজনৈতিক সংকট যেভাবে চেপে বসেছে, তা দূর করতে হলে নিম্নোক্ত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি:
- বাংলাদেশের সকল শিক্ষিত ব্যক্তিকে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় ন্যূনতম মাত্রার শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশের সকল দলের নেতা, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ইসলামী শিক্ষা বা মানবিক ও নৈতিক মৌলিক পাঠ অবশ্যই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করবে।
- বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষের তাদের নিজ নিজ ধর্মের নৈতিক শিক্ষা লাভের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা থাকবে।
- শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত সকলকে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিদিনের দৈনন্দিন বা প্রাত্যহিক জীবনে যে সকল আরবি শ্লোক উচ্চারণ করে, তা জেনে ও বুঝে উচ্চারণের জন্য বাধতামূলক করতে হবে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে।
- সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন জীবনে উচ্চারিত আরবি শ্লোকগুলো অর্থসহ পঠন-পাঠনের জন্য সিলেবাসভুক্ত করতে হবে, যা মুসলিম ছাত্র অন্যান্য আবশ্যিক বিষয়ের ন্যায় পড়তে এবং অর্থসহ মুখস্ত করতে বাধ্য থাকবে। সরকারিভাবে এ ব্যবস্থা সকল মাদরাসা, প্রাইমারি হতে বিশ্বদ্যিালয়, মেডিকেল, প্রকৌশল, কারিগরিসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু থাকতে হবে।
- দেশ একটি পর্যায়ে এলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল মুসলিমের জন্য ইসলামকে জানা ও বোঝার সুপরিকল্পিত সিলেবাস তৈরি করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়- শিক্ষা মানুষকে যে পথ দেখায়, সেই পথে সে পরিচালিত হতে থাকে। আমাদের দেশে সমন্বিত এ শিক্ষাব্যবস্থা বৃটিশ ও বৃটিশ পরবর্তীকালে দেখা যায় না; যা ছিল একটি জাতি গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। তা না হয়ে চলছে এক অপরিকল্পিত শিক্ষামাধ্যম, যার মাধ্যমে জাতি হচ্ছে বহুধাবিভক্ত। যেমন একটি বাড়িতে দুইজন ছেলে রয়েছে। একজন সন্তান কওমী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা শেষ করলে তার শারীরিক, মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয় একভাবে। তেমনি অন্যজন আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া শেষে তার বিকাশ কেমন হয়? তারা দুই ভাই আর এক চিন্তার হয়? হয় না কেন? কারণ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের মানুষের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা নয়।
তেমনিভাবে আমাদের দেশে সরকারি প্রাইমারি, বেসরকারি প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম বা ভার্সন স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। যার ফলে আজকের বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে মানসিক ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য বেশি লক্ষণীয়। তাই মীর জুমলা ও শহীদ মীর মুগ্ধের এ বাংলাদেশে আজকের দাবি হলো- দেশকে সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে, কোনো বৈষম্যের স্থান এখানে থাকবে না। দেশে সুবিচার থাকবে, কোনো অবিচার মানুষ সহ্য করবে না। দেশের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, মানবিকতা। থাকবে না অসততা, অন্যায়, অনৈতিকতা, অমানবিকতা। দুই মীরের বাংলাদেশে আজ হোক এই শপথ।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
0 Comments:
Post a Comment