Close

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪

দারসুল কুরআন: সুরাতুল বাক্বারাহ || ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত || মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি


মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি

দারসুল কুরআন | সুরা আল বাক্বারাহ | ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত
•আরবি ইবারত:
১৮৩:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ
১৮৪:
اَیَّامًا مَّعْدُوْدٰتٍ١ؕ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِیْضًا اَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ١ؕ وَ عَلَى الَّذِیْنَ یُطِیْقُوْنَهٗ فِدْیَةٌ طَعَامُ مِسْكِیْنٍ١ؕ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَیْرًا فَهُوَ خَیْرٌ لَّهٗ١ؕ وَ اَنْ تَصُوْمُوْا خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
১৮৫:
شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَـٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ‌ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ‌ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ‌ۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَٮٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
১৮৬:
 فَإِنِّى قَرِيبٌ‌ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِ‌ۖ فَلْيَسْتَجِيبُواْ لِى وَلْيُؤْمِنُواْ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ


•সরল বাংলা অনুবাদ:
১৮৩:
 হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।
১৮৪:
এ কতিপয় নির্দিষ্ট দিনের রোযা। যদি তোমাদের কেউ হয়ে থাকে রোগগ্রস্ত অথবা মুসাফির তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এই সংখ্যা পূর্ণ করে। আর যাদের রোযা রাখার সামর্থ আছে (এরপরও রাখে না) তারা যেন ফিদিয়া দেয়। একটি রোযার ফিদিয়া একজন মিসকিনকে খাওয়ানো। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে কিছু বেশী সৎকাজ করে, তা তার জন্য ভালো। তবে যদি তোমরা সঠিক বিষয় অনুধাবন করে থাকো তাহলে তোমাদের জন্য রোযা রাখাই ভালো।
১৮৫:
রমযানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাত পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোযা রাখা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় বা সফরে থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোযার সংখ্যা পূর্ণ করে। আল্লাহ তোমাদের সাথে নরম নীতি অবলম্বন করতে চান, কঠোর নীতি অবলম্বন করতে চান না। তাই তোমাদেরকে এই পদ্ধতি জানানো হচ্ছে, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূর্ণ করতে পারো এবং আল্লাহ‌ তোমাদের যে হিদায়াত দান করেছেন সেজন্য যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে ও তার স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
১৮৬:
আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে। 

নামকরণ:
সূরায়ে বাকারায় অষ্টম রুকুতে বণী ইসরাইলদের প্রতি- إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً - নির্দেশ দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সূরার নামকরণ করা হয়।
 

শানে নুযূল: 
হযরত সালমা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বর্ণনা করেন যে-
 وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطَيْقُونَهُ فَدْيَةٌ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল, যার ইচ্ছা হয় সে রোযা রাখতে পারে আর যে রোযা রাখতে না চায় ফিদিয়া দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ নাযিল হলো, তখন ফিদিয়া দেয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ সামর্থ্যবান লোকদের ওপর শুধুমাত্র রোযা রাখাই জরুরী সাব্যস্ত হয়ে গেল এবং বলা হলো যে, রোযা শুধুমাত্র তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি বরং পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও ফরয ছিলো। অতএব তোমাদের যার জীবনেই এটা পাবে অবশ্যই তাকে রোযা রাখতে হবে।

এ সূরাটি নাযিল হওয়ার আরো উল্লেখযোগ্য কারণ হল প্রথমতঃ ইহুদীদের ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের সামনে ইসলামের মূলনীতি উপস্থাপন। 
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষণা। 
তৃতীয়তঃ কাফেরদের সর্বাত্মক বিরোধীতার মোকাবিলার পদ্ধতি। 
চতুর্থঃ মুনাফিকদের চরিত্র বিশ্লেষণ।

আলোচ্য বিষয়:
১. 'সাওম' ইসলামের মৌলিক ইবাদত, এ অংশে তার গুরুত্ব ও বিধি বিধান শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
২ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে 'তাকওয়া' অর্জন করে কুরআন বুঝার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন।
৩. কুরআন নাজিলের কারণেই যে রমযান মাসের এত গুরুত্ব সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।

•শাব্দিক অর্থ ও তার ব্যাখ্যা:
كتب (কুতিবা) ফরয করে দেয়া হয়েছে। লিখে দেয়া হয়েছে। আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

الصَّيَامُ এটা صَوْمٌ সাওম শব্দের বহুবচন। আর সাওম শব্দের অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় 'সুবহেসাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা-সাথে সাথে সকল প্রকার রিপু বন্ধ রেখে আল্লাহ্ ও রাসূলের যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা।

قلكُمْ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের, অতীত জমানার লোকদের, পূর্বেকার যুগের লোকদের। এখানে অন্যান্য নবীগণের উম্মতদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

تَتَّقُوْن (তাত্তাকুন) তাওয়া অর্জন করবে, খোদাভীরু হবে, পরহেজগারী অবলম্বন করবে, আল্লাহভীতি অর্জন করবে, সংযমশীল হবে।

أَيَّامًا مَّعْدُودَات গনা কয়েকদিন, কতেক দিন, নির্দিষ্ট দিন, সুনির্ধারিত দিন। এখানে 'আইয়ামাম মা'দুদাত' বলে রমযান মাসের নির্ধারিত দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে।

مريضًا (মারিদান) রুগ্নাবস্থা, অসুস্থ, এমন অসুস্থতা যাতে সাওম পালন করার কারণে তার রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। ডাক্তার সাওম না রাখার পরামর্শ দিতে পারে।

سفر (সাফারিন) সফর অবস্থা, ভ্রমণ অবস্থায়, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুসাফির ঐ ব্যক্তিকে বলে, যিনি ৪৮ মাইল বা ৭৩ কিঃ মিঃ (প্রায়) পথ অতিক্রম করেন।

فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخْرَ উপরোক্ত দু'অবস্থা তার যতদিন থাকবে, আল্লাহর নির্দেশ হলো সে অন্য মাসে ততদিন রোযা রাখবে।

فدْيّة বদলা, পরিবর্তে যা দেয়া হয়। এখানে রোজা না রাখলে তার' বদলা তথা ফিদিয়া দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهُ থেকে আয়াতের শেষাংশটুকু ইসলামের প্রাথমিক যুগে লোকজনের রোযায় অভ্যস্ত করানোর উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে এর পরের আয়াত (১৮৫ নং আয়াত) অবতীর্ণ করে উপরোক্ত হুকুম রহিত করা হয়।
الزل নাযিল করা হয়েছে। অবতীর্ণ করা হয়েছে, এখানে انزل বলতে এক সাথে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ করার কথা বুঝানো হচ্ছে।
بینت (বাইয়েনাত) দলিল প্রমাণসমূহ, বিস্তারিত, বিশ্লেষণ, হিদায়াতের নির্দেশিকা বা নীতিমালা।

الْفَرْقَانِ (আলফুরক্বান) পার্থক্য সূচনাকারী গ্রন্থ, যে গ্রন্থ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এখানে মহাগ্রন্থ আলকুরআনকে বুঝানো হচ্ছে। এটা কুরআন এর একটি নামও বটে।

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ (ফামানশাহেদা মিনকুম) অতঃপর তোমাদের মধ্য হতে যে কেউ এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে। এ মাসে উপস্থিত থাকবে। রমযান মাস পাবে।

ٱلْيُسْرَ (ইউসরা) মূল ধাতু হচ্ছে 'ইউসরুন', অর্থ-সহজ আরামদায়ক, সহনশীল, ভারসাম্যপূর্ণ, সরল ইত্যাদি।

ٱلْعُسْرَ (উসুরুন) কাঠিন্যতা, এর বিপরীত শব্দ অর্থ সহজ-সরল নয় বরং কঠিন, সাধ্যের বাইরে।

لِتُكْمِلُوا الْعَدَّةَ যাতে তোমরা কাজা রোযার দিন পরবর্তীতে পুরো করে নিতে পারো। এজন্য কাজা করার সিস্টেম করা হয়েছে।

وَتُتُكْبَرُوا اللَّهُ যাতে করে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা করতে পারো। আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে পারো।

•রমজান (রোজা) সম্পর্কিত আলোচনা:

১. সাউম সংক্রান্ত শরয়ী বিধান:
ক) সাউম কাকে বলে: রোযাকে আরবী ভাষায় 'সাউম' বহুবচনে সিয়াম বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ হলো কোন কিছু থেকে বিরত থাকা বা কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা।
ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষায় সাউম হলো সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থেকে আল্লাহ্ ও রাসূলের নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।

খ) সাউম এর প্রকারভেদ: ইসলামী শরীয়াতের নিয়মানুযায়ী প্রাথমিকভাবে সাউম দুই প্রকার-

এক. ইতিবাচক (Positive)
দুই. নেতিবাচক (Nagative)

এক. ইতিবাচক সাউম আবার চার প্রকার-
ক) ফরয, খ) ওয়াজিব, গ) সুন্নাত, ঘ) নফল,

ক. ফরয : যা পবিত্র মাহে রমযানের (চন্দ্রমাস) একমাস আদায় করা হয়।
খ. ওয়াজিব: মান্নত বা কাফফারার সাউম।
গ. সুন্নাত: নবীকরীম (সাঃ) যা নিজে করতেন এবং উম্মাতের প্রতি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন যেমন আশুরার, আরাফার দিনে ও আইয়ামে বীযের ইত্যাদি।
ঘ. নফল: উল্লেখিত তিন প্রকার ব্যতীত সকল ইতিবাচক সাউমই নফল। যেমন শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা।

দুই. নেতিবাচক সাউম দুই প্রকার:
ক) মাকরুহ, খ) হারাম,

ক. মাকরুহ: যে কোন একদিন নির্দিষ্ট করে সাউম পালন করা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল সাউমও মাকরুহ।
খ. হারাম: বছরের পাঁচ দিন সাউম পালন করা হারাম। দুই ঈদের দুই দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। আইয়ামে তাশরীক হলো ১১, ১২, ও ১৩ই জিলহাজ্ব।

গ. সাওম ফরয হওয়ার সময়-কাল: হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় উপনীত হলেন তখন তিনি আশুরার রোযা পালন করেন এবং সাহাবীগণকে তা পালন করার নির্দেশ দেন। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রমযানের রোযা ফরয হয়। রমযানের রোয়া ফরয হওয়ার পূর্বে 'আশুরার' রোযা ফরয ছিল। হিজরতের পর 'আইয়ামুল বিয' এর রোযা ফরয করা হয়েছে। এরপর রমযান মাসের রোযা ফরয হওয়ায় 'আশুরার' ও 'আইয়ামুল বিযের' রোযা মানসুখ হয়ে গিয়েছে। উহা এখন সুন্নাতরূপে পরিগণিত।

. সাউম কেন ফরয করা হলো: সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি দুই কারণে সাউম ফরয করা হয়েছে।

প্রথমত: অতীতের সকল নবীর উম্মতের উপর সাউম এর ইবাদত ফরয ছিল তাই।
দ্বিতীয়ত: তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে সাউম ফরয হয়েছে।
সাওমের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও মর্যাদা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।

এই স্বল্প পরিসরে সাউমের ফজিলত বা গুরুত্ব আলোচনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি হাদীসের অনুবাদ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই।
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أمْثَالِهَا إلى سبع مائة ضعف قَالَ اللهُ تَعَالى الا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِى به .
(بخاری ، مسلم)
রাসূল (সা) বলেছেন- বনী আদমের সকল আমলের বিনিময় দশ থেকে সাতশতগুণ পর্যন্ত দেয়া হবে। (কিন্তু সাওম ব্যতিক্রম)
আল্লাহ্ বলেন- (বনী আদমের সকল আমল তার নিজের) কিন্তু সাউম আমার জন্য তাই আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেবো। (বোখারী ও মুসলিম)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . (بخاری ، مسلم)
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা করবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বোখারী ও মুসলিম)

قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّيَامُ جُنَّةٌ . (بخاری) 
সাউম ঈমানদারদের জন্য ঢাল স্বরূপ। (বোখারী)

এ ধরনের অসংখ্য হাদীসে রাসূলের মাধ্যমে সাওমের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা সাউমের কল্যাণ লাভ করতে পারবো। ইন্‌শাআল্লাহ্।

২. মাহে রমযানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ

ক) তাকওয়া অর্জনই মাহে রমযানের উদ্দেশ্য: আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে (সাউম ফরয হওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে) ঘোষণা করেছেন-
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (উম্মতদের) উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া, খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জন করতে পারো।

তাই নামায যেমনিভাবে মুমিনদেরকে দৈনিক পাঁচবার আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত হয়ে দাসত্বের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে চরিত্র গঠন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে শারীরিক ইবাদত সাউম একমাস পূর্ণ ঈমান ও ইহতেসাবের সহিত পালন করলে অবশ্যই খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জিত হবে। এই জন্য আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন- 'সাউম আমার জন্যই, যার প্রতিদানও আমি নিজেই' অর্থাৎ ইবাদাত লোক দেখানোর জন্য হতে পারে; কিন্তু সাউম এমন কি ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ্র ভয়ে আল্লাহর জন্যেই হয়ে থাকে।

খ) রমযানের সাথে কোরআনের সম্পর্ক: আমরা সাধারণত: প্রত্যেক বছর রমযান মাস এলেই ঈমাম, আলেমেদ্বীন ও জুময়ার খোতবার মাধ্যমে রমযান মাসের বিশেষ ফাজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে শুনে থাকি। এজন্য মুসলিম মিল্লাত রমযান মাসের বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, রমযান মাসের এত গুরুত্ব ও মর্যাদা কেন হয়েছে? আসুন আমরা রমযানের সাথে কোরআনের আলোচনা করে উক্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর গ্রহণ করি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَتِ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

মাহে রমযান তো সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের চলার পথের দিক নির্দেশক হিসেবে, যার মাঝে হেদায়াতের দলিল প্রমাণাদি সহ বিস্ত ারিত বিবরণ রয়েছে। আরো রয়েছে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের বিষয়সমূহ। সূরায়ে কদরে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন-
إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ -
"নিশ্চয় আমি এই কুরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি।"

সুতরাং উল্লেখিত দু'টি আয়াতের মর্মানুযায়ী আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি, কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের এত কদর এত গুরুত্ব হয়েছে। আর কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের সিয়াম সাধনা ফরয করা হয়েছে। অতএব রমযানের সাথে কুরআনের সম্পর্ক আমাদের কাছে এখন সুস্পষ্ট।

গ) তাকওয়া কাকে বলে: তাকওয়া শব্দটি ধাতুগত উৎপত্তির দিক থেকে চিন্তা করলে আরবী ভাষায় এর অর্থ শুধু খোদাভীতি বা খোদাপ্রেম হবে না। আল- কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে যেভাবে তাকওয়ার আলোচনা হয়েছে তাতে মূল উদ্দেশ্য এক হলেও দু'ধরনের অর্থ করতে হবে। যেমন সূরা তাহরীম- এর দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُوْ انْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا.
(হে ঈমানদারগণ) তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।

অতএব তাকওয়ার এক অর্থ যেমন খোদাভীতি অর্জন, মুত্তাকী হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্র নির্দেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকাই খোদাভীতি। আরেক অর্থ বাঁচা, মুক্তি লাভ করা, নিষ্কৃতি পাওয়া, বিজয় লাভ করা।

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে দু'অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং একটি অন্যটির সম্পূরক। সাউমের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যাতে করে তোমরা খোদাভীতি বা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তোমরা প্রকৃতপক্ষে পরিত্রাণ পাবে বা মুক্তি লাভ করবে।

ঘ) তাকওয়ার বাস্তব অবস্থা: এখানে তাকওয়ার বাস্তব অবস্থাটা বা তাকওয়ার সুফল আল-কুরআন থেকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন- وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ لَيَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقُهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

যারা আল্লাহ্ ভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করে, আল্লাহ্ তাদের চলার পথ খুলে দেন। আর তাদেরকে এমন জায়গা থেকে রিঙ্ক এর ব্যবস্থা করে দেন, যা তারা কোনদিন চিন্তাও করতে পারে না। (তালাক-২-৩)

সূরা আলে-ইমরানের ১২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং খোদাভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করো তাহলে তোমাদের শত্রুদের কোন ষড়যন্ত্র বা কলাকৌশল তোমাদের কোনই ক্ষতিসাধন করতে পারবে
وَانْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوْا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا . -
অতএব তাওয়ার অর্থ বুঝে তার আলোকে একজন মুমিন যদি তার সঠিক চরিত্র গঠন করে এবং জীবনকে তাওয়া ভিত্তিতে পরিচালনার শপথ গ্রহণ করে তাহলে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি সামষ্টিকভাবে ইহ ও পরকালে সুবিধার কথা উল্লেখিত আয়াতসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমাদের বাস্তব জীবনে তাওয়ার সুফল বয়ে আনবো, এটাই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।

ঙ) তাকওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছয়টি। যথা:
১। সত্যের সন্ধান;
২। সত্য গ্রহণ;
৩। সত্যের উপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা;
৪। আল্লাহভীতি;
৫। দায়িত্বানুভূতি;
৬। আল্লাহর নির্দেশ পালন।
এ বৈশিষ্ট্য আমাদের সকলের অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই কেবল তাকওয়াবান হওয়া যাবে।

৩. রমযানের সাথে কুরআন ও তাকওয়ার সম্পর্ক:
ইতিপূর্বে আমরা তাওয়ার অর্থ পরিচিতি ও বাস্তব দিক আলোচনা করেছি। এখন রমযান ও কুরআন তাওয়া অর্জনে কি ভূমিকা রাখে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

সূরা ফাতিহা আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করেছি এই বলে যে, হে রব, আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর পরিচালিত কর। এর উত্তরে রাব্বুল আলামীন সূরা বাকারার প্রথমেই সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর চলার শর্ত উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন-
ذلك الْكِتَابُ لأَرَيْبَ فِيهِ - هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ .
ইহা এমন এক কিতাব, যার মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যারা মুত্তাকী তাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিবে।

অতএব বুঝা যাচ্ছে, কুরআন থেকে হিদায়াত পেতে হলে মুত্তাকী হওয়। শর্ত। সাউম ফরয করা হয়েছে- তাকওয়া অর্জন করার জন্য এবং কুরআন নাযিলের কারণেই রমযান মাসের এতো গুরুত্ব হয়েছে।

সুতরাং আল-কুরআন মানব জাতির জন্য একমাত্র নির্ভুল জীবন বিধান। আল- কুরআন বুঝতে হলে তাওয়া অর্জন করতে হবে আর তাকওয়ার প্রশিক্ষণের জন্যই একমাত্র সিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই রমযানের প্রশিক্ষণ কুরআন বুঝে তা বাস্তবায়নের জন্য এক বিশেষ প্রশিক্ষণ।
অতএব আল-কুরআন, মাহে রমযান ও তাওয়ার পূর্ণতা অর্জন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নাম নয়, বরং পরিপূরক।

•শিক্ষাঃ 
আলোচ্য দারসের শিক্ষাগুলো নিম্নে দেয়া হচ্ছে:
১. পবিত্র রমযান মাসের সিয়াম সাধনা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয। রোয়া ফরয করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। 

২. অসুস্থ অবস্থায়, মুসাফির, মহিলাদের শরয়ী ওযর ও অক্ষম বৃদ্ধদের জন্য এ মাসে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। (এ ব্যাপারে শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গী ও নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে)

৩. মাহে রমযানের যথাযথ দায়িত্ব পালন বা মর্যাদা দিতে হলে আল- কুরআনকে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাঁর বিধানকে সহজ করেছেন; কঠিন করেন নাই।

৪. কুরআন যে মানব জাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে নাযিল করছেন তা যথাযথ উপলব্ধি করে সে মোতাবেক জীবন চলার শপথ নিতে হবে।

৫. 'রমযান, কুরআন, হিদায়াত ও লায়লাতুল কদর' বিষয়গুলো মজবুত ঈমানের সাথে বুঝে শুনে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৬. উল্লেখিত শিক্ষাগুলো পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে ই'তেকাফের গুরুত্বও কম নয়। তাই যথাসাধ্য আত্মগঠন ও তাকওয়া অর্জনের জন্য ই'তেকাফে অংশ গ্রহণের চেষ্টা থাকতে হবে।

দারস সংকলনে:
www.ArmansDiary.com