Close

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)

দারসুল হাদিস || হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস (তিরমিজি : ইফা-২৪১৯)


দারসুল হাদিস || পরকালের জবাবদিহি সংক্রান্ত হাদিস

• আরবি ইবারত:
عَنِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ حَتَّى يَسْئَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَ عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ (ترمذ ی)

• বাংলা অনুবাদ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (সা) হতে বর্ণনা করেছেনঃ কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও (স্ব-স্থান হতে) নড়তে দেয়া হবে না। (১) তাঁরজীবনকাল কিতাবে অতিবাহিত করেছে। (২) যৌবনের সময়টাকে কিভাবে ব্যয় করেছে। (৩) ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে। (৪) তা কোনপথে ব্যয় করেছে। এবং (৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞানার্জন করেছে সে অনুযায়ী আমল করেছে কিনা। (তিরমিযি)

• শব্দার্থ:
لاتزلُ - নাড়াতে পারবে না। পদদ্বয়। ابن ادم - আদম সন্তান। حَتَّى - যতক্ষণ। يَسْتَلُ - জিজ্ঞাসা করবে। عَنْ خَمْسٍ - পাঁচটি বিষয়ে। عمره -তার জীবন। أَقْنَاهُ ধ্বংস করেছে, ব্যয় করেছে। شبابه তার যৌবনকাল। آبده (এখানে) সে কিভাবে কাটিয়েছে। এ তার ধন-সম্পদ। اَيْن -কোথায়। اكتسبه সে উপার্জন করেছে। اين কোনখানে। انفقه সে ব্যয় করেছে। عمل আমল করেছে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। علم - সে শিখেছে।

• রাবীর পরিচয়:
"ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবী করীম (সা) এর মদীনায় হিজরতের পর মদীনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন এবং ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতেন। আবু মুসা আশায়ারী (রা) বলেন, "আমার ইয়েমেন হতে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদ (রা) কে নবী পরিবারের লোক বলে ধারণা করতাম।"

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কুরআন, হাদীস, ফেকাহ ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে কজন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। নবী করীম (সা) বলেনঃ "কুরআন শরীফ যেভাবে নাযিল হয়েছে হুবুহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেনো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর নিকট যায়।"

এই জনের বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৮৪৮টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২১৫টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
আলোচ্য হাদীসে মানুষের নৈতিক চরিত্রের সংশোধনকল্পে আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালে জাবাদিহির অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের সংশোধনের আশা করা বৃথা। কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্তকালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পূর্নরূপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্মফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সূক্ষ্মভাবে বিচার -বিশ্লেষণ করা হবে। একমাত্র এ অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।

তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার-আচরণ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদীসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদীসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

• ব্যাখ্যা:
★১.
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ 
"আমি মানুষ আর জ্বীনকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।"
(সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬)

ইবাদাত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ "ইয়াবুদুন" শব্দটি "আবদুন হতে নির্গত। আর "আবদুন" শব্দের অর্থ হল গোলাম দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহূর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবনব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَ أَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ . (المؤمنون)
"তোমরা কি মনে করেছো যে, আমরা তোমাদেরকে অকারণেই সৃষ্টি করেছি, আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না? (সূরা আল মু'মিনুন-১১৫)

তাই দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর চাকচিক্যময় প্রতিটি বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি, ছোট্ট একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবনব্যাপী বিস্তৃত।

★২. প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে তার যৌবনকাল। নিম্নোক্ত চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এ যৌবকালেই। যথা-

(ক) চিন্তাশক্তি (Thinking Power)
(খ) ইচ্ছাশক্তি (Will Power)
(গ) মনন শক্তি (Power of soul)
(ঘ) কর্মশক্তি (Physical strength for working capacity)

অতএব দেখা যাচ্ছে ভালো অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবনই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারণ মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার, ব্যাভিচার ইত্যাদি সবকিছুই করে যৌবনকালে। দেখা যায় যৌবনে দুর্ধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গো-বেচারায় রূপান্তরিত হয়। কারণ বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ অসহায় করে দেয়। তাই বার্ধক্যে যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ হয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং চেষ্টাই থাক না কেন বার্থক্য আসার পর কোন একটি ভালো কাজও সুচারুভাবে সমাপ্ত করা যায় না। এখানেও বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবনের এতো গুরুত্ব।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
اغْتَنِمْ خَمْسًا شَبَابِكَ قَبْلَ هَرَمِكَ 
পাঁচটি বস্তুকে গনীমতের মালের মতোই মনে করো। তার একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনের। (মিশকাত)

অনেকেই মনে করে যৌবনে যা কিছু মনে চায় করে বার্ধক্য পর আল্লাহ্র নিকট তওবা করে সৎ কাজে মনোনিবেশ করবো। এ ধারণাই মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। তাই হাদীসে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এইজন্যই পরকালের প্রশ্নবলীর মধ্যে যৌবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি তার অন্যতম।

★৩. মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগলপারা। তার একটা লক্ষ্য ধন- সম্পদের স্তূপে সুখের সন্ধান করা। এজন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ, অথবা ধোকাবাজী যা কিছুই হোক না কেন তাতে কোন পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্বপ্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন, যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার নষ্ট না হয় এবং সকলেই সমভাবে সম্পদ ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ উপার্জনের মৌলিক বিধি-নিষেধ সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

(১) কারো অধিকার নষ্ট করে সম্পদ উপার্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মোহরের প্রাপ্য টাকা না দিয়ে নিজে ভোগ করা। এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
(২) ব্যাভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(৩), চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকার্জন বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৪) কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
(৫) গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবিকার পেশা নির্ধারণ করা যাবে না।
(৬) হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে। এমন কি হালাল পশু পাখীর মৃতদেহও এর অন্তর্ভুক্ত।
(৭) হালাল মালের ব্যবসা করলেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মূল্য বৃদ্ধির নিয়তে ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফালব্ধ টাকার মাধ্যমে।
(৮) সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ বা বর্ধিত করা যাবে না।
(৯) জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ উপার্জন করা যাবেনা।
(১০) কোন পশু পাখীর দ্বারা খেলা দেখিয়ে।
(১১) মূর্তি অথবা প্রাণীর ছবির ব্যবসায়ের মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা না জায়েজ।
(১২) ওজনে কম দেয়া। ইত্যাদি।


★৪. উপরের বিধি নিধেগুলো সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। 

ব্যয়ের মৌলিক খাতসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
(১) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় করা যাবে না।
(২) নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
(৩) ছদকাহ্।
(৪) 'নিকটাত্মীয়ের হক।
(৫) ইয়াতিমের হক।
(৬) মিসকিন, ভিক্ষুকের হক।
(৭) আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যয় "জিহাদ ফি ছাবিলিল্লাহ"।
(৮) বিভিন্ন ধরনের কাফফারা আদায়কল্পে।
(৯) পথিক বা পর্যটকদের হক।

বস্তুতঃ প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে, উপরোক্ত শর্তবলী পালন করেই সে সম্পদ আয় এবং ব্যয় করেছে কিনা?

★৫. বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে রাসূলে আকরাম (সা) এর মাধ্যমে আল্লাহ'রাব্বুল আলামীনের প্রথম ফরমান- হলো:

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (علق) -
"পড় তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আলাকঃ১)

আয়াতে কারীমার তাৎপর্য হলো রবকে জানা বা বুঝার উদ্দেশ্যে পড়তে হবে। অন্য কথায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহানবী (সা) বলেছেনঃ
طلب العلمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ -
"মুসলমান প্রতিটি নর-নারীর উপর (দ্বীনের) জ্ঞানার্জন অবশ্য কর্তব্য-ফরজ (মুসলিম)।

স্রষ্টা-সৃষ্টি ও বিশ্বজাহান সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই প্রতিটি লোক তার নিজের এবং স্রষ্টা সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে আরও বুঝতে পারে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি আর তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি। এমনিভাবে যখন মানুষ তার স্রষ্টাকে জানতে ও বুঝতে পারে তখন স্রষ্টার দেয়া দায়িত্ব-কর্তব্য পালনও তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ইরশাদ করেনঃ
তবে আল্লাহর উপর ঈমান "তাগুদ"কে অস্বীকার করেই আনতে হবে। সূরা বাকারায় অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَة
(البقرة) الْوُسْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا 
"যে তাগুত (খোদাদ্রোহী শক্তি) কে অস্বীকার করে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো সে এমন একটি মজবুত রশি ধারণ করলো যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। (সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬)"

এখানে রশি বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা হতে বুঝা যায়, পৃথিবীতে দুটো শক্তি আছে। একটি তাগুদী বা শয়তানী শক্তি অপরটি আল্লাহর শক্তি। আর যে কান এক শক্তির আনুগত্য অপর শক্তিকে অস্বীকার করেই করতে হবে। এখানেও দেখা যাচ্ছে হক ও বাতিল চেনার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ইল্ম বা জ্ঞান। তাই দ্বীনি ইলম শিখতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।

অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ
النَّاسُ كُلُّهُمْ مَلْكَاءُ إِلَّا الْعَالِمُوْنَ وَالْعَالِمُونَ كُلُّهُمْ هَلْكَاء إِلَّا الْعَامِلُونَ .
সমস্ত মানুষই জাহান্নামী একমাত্র আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া, আর সমস্ত আলেমই জাহান্নামী হবে একমাত্র আমলদায় আলেম ছাড়া। (বুখারী) অর্থাৎ শুধু জ্ঞানার্জন করাই মুক্তির পথ নয় সাথে জ্ঞানানুযায়ী আমলের ও প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারে অবশ্যই রাব্বুল আলমীনের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। এখানে আলেম বলতে মাদ্রাসা থেকে সনদপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিতদেরকে বুঝানো হয়নি। ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে যারা মৌলিক জ্ঞান রাখেন তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।

• শিক্ষাবলী:
১। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে।
২। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌবন। তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
৩। ধন সম্পদ আয় এবং ব্যয় আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে হতে হবে এবং আল্লাহর সন্তোষ অর্জন হবে একমাত্র লক্ষ্য।
৪। দ্বীনের যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এবং
৫। জ্ঞানানুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে।

• তথ্যসূত্র:
১। জামেউত তিরমিযি
২। সহীহ আল বুখারী
৩। সাহাবা চরিত-ইসলামিক ফাউন্ডেশন
৪। সুপ্ত শক্তিও ঘুমস্ত প্রতিভা-ডেল কার্ণেগী
৫। সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং-সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৬। তাফহীমুল কুরআন-ঐ 
৭। মিশকাত শরীফ-

বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব || হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত বাইয়াতের দাবি সংক্রান্ত হাদিস

দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


দারসুল হাদিস || ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব


• আরবী ইবারত:
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ أَخْبَرَنَا يَعْقُوْبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَخِي ابْنِ شِهَابٍ عَنْ عَمِّهِ قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُوْ إِدْرِيسَ عَابِدُ اللَّهِ أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ مِنْ الَّذِينَ شَهِدُوا بَدْرًا مَعَ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم وَمِنْ أَصْحَابِهِ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةُ مِنْ أَصْحَابِهِ تَعَالَوْا بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُوْنَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلَا تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ لَهُ كَفَّارَةٌ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ   وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ قَالَ فَبَايَعْتُهُ عَلَى ذَلِكَ

• বাংলা অনুবাদ:

"হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা) হ'তে বর্ণিত- তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এবং আকাবা রাত্রিতে নিযুক্ত নেতাদের অন্যতম-তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন-তখন তাঁর চারদিকে একদল সাহাবী উপস্থিত ছিলেন- তোমরা আমার নিকট এ কথার উপর 'বাইয়াত' করো যে, 'তোমরা আল্লাহর সাথে কোন জিনিসের শরীক করবে না। চুরি করবে না, যেনা-ব্যাভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তোমরা পরস্পর পরস্পরের উপর অপবাদ দিবে না এবং ভালো কাজের ব্যাপারে কখনো নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই 'বাইয়াত' যথাযথভাবে পালন করবে তার বিনিময় ও পুরষ্কার স্বয়ং আল্লাহ্ দিবেন। আর যে ব্যক্তি নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে কোন একটি কাজও করবে এবং এজন্য পৃথিবীতে কোন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হবে, তবে তা তার গুনাহর কাফ্ফারা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর যদি কোন নিষিদ্ধ কাজ কেউ করে ফেলে এবং আল্লাহ্ তা ঢেকে রাখেন, তবে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর বর্তাবে। তিনি ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করে দিবেন অথবা ইচ্ছে করলে তাকে শাস্তি দিবেন। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আমরা কথাগুলো মেনে নবী করীম (সা) এর 'বাইয়াত' গ্রহণ করলাম।" (বুখারী)। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬০৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৬১০)

• শব্দার্থ:
شَهِدَ -উপস্থিত ছিলো। التَّقَبَاءُ -প্রতিনিধিবর্গ। ليلة -রাত্রি। العقبة - আকাবা )মিনা নামক স্থানে অবস্থিত একটি পাহাড়। حول -তাঁর চতুর্দিকে। بايِعُونِي -আমার নিকট 'বাইয়াত' করো। لتشرِكُوا শরীক করোনা। খায় -আল্লাহর সাথে لاتسرقوا -তোমরা চুরি করো না। لا تزنُوا ব্যাভিচার করোন لا تقتلُوا -হত্যা করোনা। اَولادكم তোমাদের সন্তান। এর্দা -তোমরা আরোপ করে না। بهتان -মিথ্যা بين أيديكم وأرجلكم -সামনা-সামনি। لاتعصوا -সীমা লংঘন করোনা। أجره তার বিনিময়। عَلَى اللهِ -আল্লাহর উপর। أَصَابَ সম্পাদন করা। تفعُوقب অতঃপর হদ্ )নির্দিষ্ট শাস্তি) জারী করা হয়। سَتَرَهُ اللهُ -আল্লাহ্ তাকে গোপন রাখলেন। اثنشاء - যদি চান। عَقَاعَنهُতা মাফ করবেন। তাকে শাস্তি দিবেন।

• রাবীর পরিচয়:
নাম উবাদা। ডাক নাম আবুল ওয়ালিদ। পিতা সামেত ইবনে কায়েস। মাতা কুররাতুল আইন। মদীনার খাজরাজ বংশের সালেম গোত্রের লোক। তিনি ছিলেন আনসার সাহাবী।

তিনি সাহাবাদের মধ্যে দু'টি বিষয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। একটি হচ্ছে, আকাবার প্রথম শপথে অংশগ্রহণ সহ মদীনা হতে ক্রমাগত তিন বৎসরে মক্কায় আগত প্রত্যেকটি প্রতিনিধি দলের সংগে তিনি শামিল ছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী। তাছাড়া তিনি নবী করীম (সা) এর সাথে সবগুলো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন এবং 'বাইয়াতে রিদওয়ান' এর সময়ও তিনি রাসুলে করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। হযরত উবাদা (রা) উচু স্তরের একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি শুদ্ধরূপে কুরআন পাঠ করতেন এবং পবিত্র কুরআনের হাফিজ ছিলেন। আহলে সুফফাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তিনি ছিলেন তার তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষক। মহানবী (সা) তাঁকে যাকাত আদায়ের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া তিনি হযরত উমর (রা) এর সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পলন করেন। সিরিয়া ও হোমসের শাসনকর্তা এবং ফিলিস্তিনের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। হিজরী ৩৪ সনে ৭২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১টি। তারমধ্যে ৬টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন।

• হাদীসটির গুরুত্ব:
বুখারী শরীফে হাদীসটি পাঁচ জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া মুসলিম, তিরমিযি ও নাসায়ী শরীফেও সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের পূর্বে কি ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করা প্রয়োজন এবং তাদের নৈতিক ও তাকওয়ার মান কিরূপ হওয়া উচিত তা অত্র হাদীসে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। আরও তুলে ধরা হয়েছে একটি ইসলামী সমাজ কিভাবে ধ্বংস হয় সেই চোরা পথগুলো। যেহেতু আল্লাহর রাসূল (সা) একটি ইসলামী রাষ্টের স্বপ্ন দেখছিলেন সেহেতু নিষিদ্ধ রাস্তাগুলোর প্রবেশ দ্বারে অর্গল এঁটে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজ দেহে কোন ক্রমেই পঁচন না ধরে।

• ব্যাখ্যা:
বাইয়াতঃ 'বাইয়াত' শব্দটি আরবী بَيْعَةُ শব্দ থেকে গঠিত। অর্থ বিক্রি করা, ক্রয় করা, চুক্তি, শপথ, অংগীকার, শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার করা ইত্যাদি।

প্রতিটি মু'মিন স্বেচ্ছায় এবং সন্তুষ্টির সাথে নিজের জান এবং মালকে আল্লাহ্ নিকট বিক্রি করে দেয়; তাঁর সন্তোষ ও জান্নাতের বিনিময়ে। আর আল্লাহ্ শুধুমাত্র মু'মিনদের নিকট হতে জান-মাল খরিদ করেন। আল্লাহ্ মুমিন ছাড়া আর কারো সাথে ক্রয়-বিক্রয় করেন না। করা সম্ভবও নয়। কেননা বিক্রিত বস্তু ক্রেতার নিকট চাহিবা মাত্র হস্তান্তর করতে বিক্রেতা বাধ্য। এ মূলনীতি অনুসরণ করা একমাত্র মু'মিনদের পক্ষে সম্ভব। কারণ প্রতিটি মু'মিনের অন্তরে এ অনুভূতি সর্বদা জাগ্রত থাকে যে "আমার জান এবং মালের মালিক আমি নই। আল্লাহ্ মেহেরবানী করে তা আমার নিকট আমানত রেখেছেন মাত্র। কাজেই তিনি যেভাবে চান সেভাবেই এর ব্যবহার করতে হবে। পক্ষান্তরে একজন মুনাফিক, কাফের কিংবা মুশরিক তা মনে করে না। এজন্য আল্লাহ্ তাদের সাথে কেনা বেচাও করেন না। এটা তো একটি সাধারণ কথা যে, যে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট হতে মূল্য আদায় করতে চায় কিন্তু তাকে বিক্রিত মাল হস্তান্তর করতে চায় না তার সাথে কোন বুদ্ধিমানই ক্রয়-বিক্রয় করবে না। সূরা তওবায় বলা হয়েছে-

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِاتٌ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ مَن وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَ الْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ

নিশ্চয় আল্লাহ্ মুমিনদের জান মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে। তাহা আল্লাহ্ পথে লড়াই করে, (দুশমনকে) হত্যা করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তাদের জন্য (জান্নাত দেবার এ ওয়াদা) আল্লাহ্ দায়িত্বে একটি পাকা ওয়াদা বটে। (তাওবাঃ ১১১) কাফেরদের সাথে এ বেচা-কেনা এজন্য সম্ভব নয় যে তারা পরকালকেই অস্বীকার করে। আর মুশরিক এবং মুনাফিকেরা যদিও পরকালকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না তবুও তারা অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করে না। এরা দুনিয়ার জীবন এবং ভোগ বিলাসকে সব কিছুর উপর প্রাধান্য দেয়। পক্ষান্তরে একজন মুমিন দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের জীবনকে প্রাধান্য দেয়। এজন্য পৃথিবীর লোভ-লালসা, মায়া-মোহ, কোন কিছুই তাকে পিছনে টানতে পারে না। প্রয়োজনে সর্বাধিক প্রিয়বস্তু জীবনটাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে দেয়।

বিক্রিত জান-মাল আল্লাহ্ নিজে এসে গ্রহণ করেন না। আবার নিজে নিজেও তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। এজন্য আল্লাহ্ কর্তৃক ক্রয়কৃত জান- মাল তাঁর আদিষ্ট পথে ব্যয় করার জন্য একজন প্রতিনিধির প্রয়োজন। আর সেই প্রতিনিধি হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। কিন্তু যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পরে আর কোন নবী ও রাসূল নেই তাই মুমিনদের নির্বাচিত খলিফা বা নেতাই হচ্ছেন সেই প্রতিনিধি। তাঁর নিকট বাইয়াত করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। তবে নবী করীম (সা) এর হাতে বাইয়াত এবং অন্য ইমাম বা নেতার হাতে বাইয়াতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। নবী করীম (সা) এর আনুগত্য হচ্ছে বিনা শর্তে কিন্তু অন্য নেতাদের আনুগত্য হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে কিন্তু রাসূল (সা) ছাড়া আর কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা যাবে না। সে আনুগত্য হতে হবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা) অধীন। বাইয়াতের মাধ্যমে যে দাবীগুলো পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়, সেগুলো হচ্ছেঃ

(১) জান-মাল আল্লাহর নিকট যে বিক্রি করা হয়েছে তা বাইয়াতের মাধ্যমে তাঁর নিকট সোপর্দ করা, যেন তিনি জান ও মাল আল্লাহ্ ও রাসূল প্রদত্ত নিয়মে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে পারেন।

(২) বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির পক্ষ হতে তাকে সে নির্দেশ দেয়া হবে তা যদি কুরআন সুন্নাহ্ বিরোধী না হয় তবে বিনা দ্বিধায় তা মানতে হবে। এ ব্যাপারে পার্থিব কোন ক্ষয় ক্ষতির পরওয়া করা যাবে না।

(৩) যদি বাইয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির কোন নির্দেশ সঠিক নয় বলে মনে হয় তবে এ ব্যাপারে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশ না মানা কোনক্রমেই ঠিক নয়।

(৪) কোন বিশেষ কারণে যদি নির্দেশ পালন করা সম্ভব না হয় তবে তাঁকে অবহিত করতে হবে এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত মনে করতে হবে।

ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করতে গেলেই প্রথমে প্রয়োজন একটি সুসংঘবদ্ধ জামায়াতের। দীন কায়েম করা যেমন ফরজ ঠিক তেমনি জামায়াত বদ্ধ হওয়াও ফরজ। কেননা জামায়াতদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন ক্রমেই আল্লাহ্ দীন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আবার জামায়াতবদ্ধ হবার বন্ধনসূত্রই হচ্ছে বাইয়াত।

এজন্যেই ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব এত বেশী।

আকাবার ১ম, ২য়, ৩য় বাইয়াত এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যে বাইয়াত সংঘটিত হয়েছিল যাকে "বাইয়াতে রিদওয়ান" বলা হয়, এ সমস্ত বাইয়াত ছাড়াও নবী করীম (সা) বিভিন্ন সময় পুরুষ ও মহিলা সাহাবীদের নিকট হতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ বাইয়াতকে ঈমানের রুহ্ মনে করতেন। তাই দেখা যায় কোন পুরুষ অথবা মহিলা সাহাবী যদি কখনো কোন ভুল করে ফেলতেন সাথে সাথে নবী করীম (সা) এর নিকট এসে পুণরায় বাইয়াত করানোর অনুরোধ করতেন। যদি আল্লাহর রাসূলের (সা) নিকট কালেমা পড়াই যথেষ্ট হতো তবে বাইয়াতের ব্যাপারে এমন পেরেশানী তাদের মধ্যে থাকতো না। এ সমস্ত ঘটনা থেকেও বুঝা যায় যে, ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব কতটুকু।

শিরক না করাঃ শিরক হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কাউকে এমন মনে করা যা একমাত্র আল্লাহরই হওয়া বা করা সম্ভব। এ রকম ধারণা বা কর্ম করা যাবে না। অর্থাৎ কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ যাই হোক না কেন আল্লাহ্ ছাড়া কেউই তা করতে সক্ষম নয়। প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ মোচনকারী, প্রার্থনা শ্রবণকারী, রিজিক প্রদানকারী, বিপদাপদে আশ্রয়স্থল একমাত্র আল্লাহ্। তাছাড়া কাউকে এ রকম প্রভাবশালী মনে না করা যার সুপারিশে আল্লাহ্ ফায়সালা পরিবর্তন হতে পারে। বৈষয়িক, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক যে কোন বিষয়েই হোকনা কেন আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আইন- কানুন মানা যাবে না। চাই, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক অথবা অর্থনৈতিক যাই হোকনা কেন। এসব সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে গ্রহণ করে তার উপর অবিচল থাকাই হচ্ছে তৌহিদের দাবী বা শির্কমুক্ত জীবন-যাপন।

চুরি না করাঃ চুরি হচ্ছে কোন বস্তু তার মালিকের অগোচরে ও অসম্মতিতে নিজে ভোগ করা বা এর মালিক হয়ে যাওয়া। ইসলামী বিধানে এটা একটি গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। শরীয়তের পরিভাষায় কবিরা গুনাহ্। তবে মানুষ যাতে খেতে পরতে না পেয়ে চুরি করতে বাধ্য না হয় সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের। যদি কোন চোর ধরার পর প্রমাণিত হয় যে জীবন বাঁচানোর জন্য চুরি ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা তার ছিলো না; তবে তাকে শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা সরকারের প্রতিটি ব্যক্তিই উল্টা তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

ব্যাভিচার না করাঃ আল্লাহ্ জাল্লাহ ইরশাদ করেনঃ (اسری) ولا تقربوا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا.

তোমরা ব্যাভিচারের ধারে কাছেও যেও না কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জ কাজ ও অতীব নিকৃষ্ট পথ। (সূরা বনী ইসরাইলঃ৩২)

উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্যাভিচার করা তো দূরের কথা এমন কাজ বা আচরণ করাও হারাম যা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ব্যাভিচারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যে সব কাজ মানুষকে যৌন সুড়সুড়ি দেয় সেগুলোও উপরোক্ত আয়াতের আদেশের আওতাভুক্ত। যেমন অশ্লীল যৌন আবেদনমূলক পত্র-পত্রিকা, যৌন সুড়সুড়িমূলক সাহিত্য, নারী দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গির অশ্লীল চিত্র, নগ্ন ও অর্ধনগ্ন চিত্র ইত্যাদি। এ সমস্ত কাজে যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে অংশগহণ করবে তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةَ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابُ .
اليم في الدنيا والآخرة

যারা চায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার প্রচার হোক, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।

সন্তান হত্যা না করাঃ মানুষ প্রধানত দুই কারণে সন্তান হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
এক- বেশী সন্তান হলে তাদেরকে ঠিকমত খাওয়ানো পরানো যাবে না এবং তাদেরকে মানুষ করা যাবে না। অভাব অনটনে নিমজ্জিত হওয়ার আশংকা। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
ولا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ
অভাব অনটনের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। (বনী ইসরাইল)

দুই- কন্যা সন্তান হলে সমাজে তাদের নিরাপত্তা নেই। বয়োঃসন্ধিকালে উপযুক্ত পাত্র ক্রয়ের অসামর্থ্যতা। মেয়ে সন্তানের জনক জননীকে সমাজে হেয় মনে করা এবং তাদেরকে মানসিক পীড়া দেয়া।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যার আওতাভুক্ত কিনা? হ্যাঁ। অবশ্যই ভ্রুণ হত্যা সন্তান হত্যারই শামিল। কেননা ভ্রুণ হত্যা করা হয় সন্তানের জন্মকে ঠেকানোর জন্যেই। এ প্রবণতা অত্যন্ত মারাত্মক। আমি বাসে উঠছি আর কউকে উঠতে দেবো না, এ রকমই যেন এক স্বার্থপর মনোভাব একাজে উদ্বুদ্ধ করে। স্বার্থপরতা নামক বিষবৃক্ষ হতেই এর অংকুরোদগম হয়।

কাউকে দোষারোপ না করাঃ কাউকে দোষারোপ করার প্রবণতা একটি নৈতিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যখন মাহামারীর আকার ধারন করে তখন সমাজ তিক্ততায় জর্জরিত হয়ে যায়। তখন সমাজ হতে ভালোবাসা, সম্প্রীতি, স্নেহ- মমতা ইত্যাদি নির্বাসিত হয়। ইসলামী সমাজ এটাকে কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজী নয়। তাই শরীয়ত এটাকে শাস্তি মূলক অপরাধ বলে গণ্য করেছে।

ভালো কাজের নাফরমানী না করাঃ এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছেঃ
وه تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الإثم والعدوان - তোমরা একে অপরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করো ন্যায়নীতি ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। (সাবধান) যা গুনাহ ও সীমা লংঘনের কাজ তাতে কারও এক বিন্দু সাহায্য ও সহযোগিতা করো না। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেনঃ (সূরা আল মায়েদাঃ ২)
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَاءِ الْمُسْلِمِ فِي مَا أَحَبُّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرُ
بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أَمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ .
'মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের সামাজিক ও সামগ্রীক দায়িত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি (উলিল আমর) দের কথা শোনা ও মানা। তা পছন্দ হোক বা না হোক।

যতোক্ষণ না অন্যায় কাজের আদেশ দিবে। আর যখন কোন অন্যায় বা পাপ কাজের আদেশ দিবে তখন তা শোনা কিংবা মানা মুসলমানদের কর্তব্য নয়।'
(বুখারী, মুসলিম)

পরিশেষে বলা হয়েছে, এর পরও যদি কেউ উল্লিখিত অপরাধসমূহের কোন একটি করে এবং ধৃত হয় তবে অবশ্যই তাকে শরীয়তের দন্ড ভোগ করতে বাধ্য করা হবে।

বিভিন্ন হাদীস ও আসার হতে একথা প্রমাণিত যে কোন অপরাধীকে শরীয়তের দন্ড প্রদানের পর তার অপরাধকৃত পাপের কাফফারা হয়ে যায়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাকে ঐ অপরাধের জন্য পুনরায় শাস্তি দিবেন না। যেমন হযরত আলী (রা) হ'তে বর্ণিত হয়েছে যে-
الدُّنْيَا فَاللَّهُ أَكْرَمُ مِنْ أَن يَثْنِي بِالعقوبة وَ مَنْ أَصَابَ ذَنْبًا فَعُوقِبَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَاللهُ أَكْرَمُ .
على عبده في الآخرة .

কোন অপরাধীকে যদি পৃথিবীতে তার কৃত অপরাধের জন্য দন্ডিত করা হয় তবে পরকালেও তাকে আল্লাহ্ দ্বিতীয় বার শাস্তি দিবেন-আল্লাহ্ এ সবের উর্ধে।

আর যদি অপরাধ করে ধৃত না হয় এবং আল্লাহ্ তা গোপন রাখেন তবে সে অপরাধের দায়-দায়িত্ব কোন ইসলামী সরকাররের নয়। আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তাকে মা'ফ করবেন অথবা শাস্তি দিবেন। অথবা তাকে প্রথমে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নির্ধারিত শাস্তি দিয়ে পরে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইখতিয়ারভূক্ত।

গ্রন্থসূত্র:
১। তাফহীমুল কুরআন-সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ)
২। 
হাদীস শরীফ ১ম খন্ড- মাওঃ আবদুর রহীম (রহ) 
৩। বাইয়াতের হাকীকাত-অধ্যাপক গোলাম আযম
৪। সাহাবা চরিত-৫ম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা
৫। মাসিক পৃথিবী-বিভিন্ন সংখ্যা।

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান || ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ || প্রবন্ধ সংকলন-আইসিএস পাবলিকেশন্স
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে 'আশরাফুল মাখলুকাত' এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য তাকে 'জ্ঞান' 'বিবেক' ও ইচছার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন এবং জ্ঞানের আকর বিজ্ঞানময় আল-কুরআনকে চূড়ান্ত 'হেদায়াত' এর উৎস হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও নবী, জ্ঞানী ও শাসক, শিক্ষক ও ত্রাণকর্তা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নবুওয়ত প্রদানের সংবাদ স্বরূপ অহি মারফত আল্লাহ যে ঘোষণা দেন তা হলো:
"পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা নাপাক বীর্য থেকে। পড়; আর তোমার প্রভু সবচেয়ে সম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে লিখতে শিখিয়েছেন। আর মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না।"
মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন- "জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ",- দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান তালাশ করো।" নবী করীম (সাঃ) এর সময়কালে চীন ছিল বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে অগ্রসর। হয়ত তাই তিনি উম্মতকে বলেছেন - "জ্ঞান অর্জন করো যদি সুদূর চীনেও যেতে হয়।"
বিখ্যাত তাফসীরকার মালিক আকবর আলী কোরআনে জ্ঞান ও হিকমাহর (প্রযুক্তি) সহাবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি/তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান পরস্পর সংযুক্ত।
আল্লার নবী (সাঃ) বলেছেন- 'প্রযুক্তি বিশ্বাসীদের হারানো সম্পদ, যেখানে সে তা পাবে সেখান থেকেই সে তা কুড়িয়ে নেবে। আল-কুরআনে ৯২টি আয়াতে 'ইলম,' ৩০টি আয়াতে 'হিকমাত্র; কথা এসেছে এবং ৩২টি আয়াতে জ্ঞানীদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ও জ্ঞানহীনদের 'অন্ধ' বলা হয়েছে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে ৭ম শতাব্দীর প্রথম পদে নবুওয়ত লাভ করে ২৩ বছরের অক্লান্ত সাধনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামকে একটি বিজয়ী জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। তিনি ও তার পরবর্তী খলিফাগণ ইসলামের একটি অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে জ্ঞানচর্চা, নয়া নয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার ও মানবতার কল্যাণের জন্য সে সবের ব্যবহারের উপর জোর দেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের যে অধ্যায়টি গির্জা ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের ফলে 'অন্ধকার যুগ' বলে চিহ্নিত সেই যুগে ইসলামের বিজ্ঞান মনস্কতার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কলা ও প্রযুক্তির সৃষ্টিশীলতায় একটি 'রেনেসার' জন্ম লাভ করে।

হিজরি প্রথম শতকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটে পশ্চিমে আফ্রিকার আটলান্টির অববাহিকা থেকে পূর্বে চীনের গ্রেট ওয়াল পর্যন্ত, আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি থেকে সাহারা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ইতোমধ্যে তা আন্দালুসিয়া হয়ে পিরিনিজ পর্বতমালা এমনকি পরিব্রাজকের বেশে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সম্পূর্ণ জাজিরাতুল আরব, ইরান, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব হয়ে কয়েক শতকের মাঝে তা গোবি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মধ্য এশিয়ায়।

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের সোনালি সময় হচ্ছে ৭ম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। যদিও সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কিছু কিছু মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদান নজরে পড়ে। আজ বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে এক অত্যাশ্চর্য উচচতায় এগিয়ে গেছে, বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান চোখে পড়ছে না বরং শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞানে তাদের পশ্চাদপদতা অন্যদের হাসির খোরাকে পরিণত করেছে একথা সত্য কিন্তু আবার পৃথিবীকে কল্যাণময়তায় ভরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা মুসলমানরাই রাখে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে বিপুল অবদান তা ইতিহাস বিকৃতির পাল্লায় পড়ে সবাই ভুলে আছে অথচ ঐসব অবদানই আজকের বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।
এ প্রবন্ধে বিজ্ঞানে মুসলিম অবদানের একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস থাকলো যাতে আগামী প্রজন্ম এর বিস্তৃত জানার উৎসাহ লাভ করে এবং এসব উৎসাহী পাঠকদের মাঝ থেকে নতুন সময়ের ইমাম জাফর সাদিক, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল বেরুনী, ইবনে সিনা, আর খাওয়ারিজিমী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ দিকপাল বিজ্ঞানীর জন্ম হয়।
•বিজ্ঞানের মৌল উপাদান সমূহ: মুসলিম বিজ্ঞানীরা যার সূচনা করেন
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ, সংস্কারক বিজ্ঞানী রজার বেকন (Regerbecon) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Opus Majus' এ 'Scientiac Experimentalis' বা 'Experimental Science' অর্থাৎ 'পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানসমূহ' অনুজ্ঞাটি প্রথম ব্যবহার করেন। এটি নিঃসন্দেহে বিখ্যাত আরবি পরিভাষা Al-Ulum at- Tajribiyan এর অনুবাদ। তাঁর Scientiac ব্যবহৃত হয় Ulum এর স্থলে এবং Experimentalis ব্যবহৃত হয় Tajribiyah এর স্থলে। আধুনিক বিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (Experiment) ব্যতিরেকে কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় না অর্থাৎ পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানই আধুনিক বিজ্ঞান। ইসলামের ৪র্থ খলিফা, মহান জ্ঞানী হযরত আলী (রাঃ) রসায়ন সূত্রের প্রথম প্রণেতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর নাতি ইমাম জাফর সাদিক (৬৯৯ ৭৬৫ খ্রিঃ) ছিলেন এক্ষেত্রে তার সার্থক উত্তরাধিকারী। ইমাম জাফরের সাগরেদ জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৭৭৭ খ্রিঃ) রসায়নের মায়া শাস্ত্রকে (Magic Art) কার্যকর বিজ্ঞানে রূপ দেন। জাবির তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন নিজ হাতে কোন কিছুকে পরীক্ষাপূর্বক সত্য হিসাবে না পেলে তাকে সত্য বলে গ্রহণ না করতে। সম্ভবতঃ এজন্য তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তাজরিবা বা পরীক্ষা-গবেষণা পদ্ধতি চালু করেন।

প্রথাগত পদ্ধতিতে আল ফারাবী তাঁর 'ইহসা আল উলুম' 'ইখওয়ান আল সাফা রিসালাত আল সানাই আল ইলমিয়াহ' এবং ইবনে সিনা তাঁর 'রিসালাহ ফি আকসাম আল উলুম আল আকলিয়া' গ্রন্থে বিজ্ঞানকে কতিপয় ভাগে শ্রেণীকরণ করেন। ইখওয়ান আল সাফা ও আল ফারাবী বলেছেন তিন শ্রেণীর বিজ্ঞানের কথা যেমন: অঙ্কশাস্ত্রীয় (Mathematical), মানব রচিত বিধানসমূহ (Man made laws) এবং প্রকৃত দার্শনিক (Real Philosophical), অপরদিকে ইবনে সিনা সাধারণ মানবিক জ্ঞানের আওতায় তাঁর সময়কার ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে (Islamic Sciences) আনেননি। অপর একদল, যাদের মাঝে ইবনে আল নাদিম তার বই 'ফিহরিস্ত' (ক্যাটালগ, তালিকা)-এ তাঁর সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিজ্ঞানকে ১০ ভাগে শ্রেণীকরণ করেন, ইবনে হাজাম দুইভাগে ভাগ করেন, প্রথম ভাগ ছিল ইসলামী আইন (কোরআন, হাদিস, জুরিসপ্রুডেন্স, ব্যাকরণ, ভাষা ও ইতিহাস) এবং বিভিন্ন জাতির জন্য সাধারণ বিজ্ঞান। (অঙ্ক, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কবিত্ব, বাগ্মিতা ও ন্যায়শাস্ত্র) দ্বিতীয় ভাগে ছিল-যাদুবিদ্যা, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি। ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দমায় বিজ্ঞানকে ২ ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে ঐ সমস্ত বিষয় যা ব্যক্তি নিজের মন ও ক্ষমতা দ্বারা বুঝতে পারে। এতে ৪টি অত্যাবশ্যকীয় বিজ্ঞান থাকে- বুদ্ধি ও দর্শনের বিজ্ঞান, যেমন- যুক্তিবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যেমন-চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি, নভো-বিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি; প্রত্যাদিষ্ট বিজ্ঞান; এবং সংখ্যাবিজ্ঞান, যেমন-সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও সঙ্গীত। অপর অংশে রয়েছে কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি কুরআন পাঠ ইত্যাদি। তাসকুবরাহ জাদাহকে বলা হয় বিজ্ঞান শ্রেণীকরণে শ্রেষ্ঠ মুসলিম পণ্ডিত। তিনি বিজ্ঞানকে ৭ ভাগে ভাগ করেন।

ইসলামের প্রথম দিকের বিজ্ঞানীরা অনেকেই উপরোল্লিখিত বিজ্ঞান শাস্ত্রের একাধিক শাস্ত্র নিয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান মূলতঃ রসায়নশাস্ত্রের জনক বিবেচিত হলেও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষা, দর্শন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, লজিক ও কবিতা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ যিনি ইবনে সিনা নামে সমধিক পরিচিত, মূলতঃ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের অন্য ৯৮ শাখা নিয়েও কাজ করেছেন। প্রফেসর সাকাও এর মতে আল বিরুনী পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি (Al beruni was the greatest intellect that ever lived on this earth.)। গণিত, জ্যোতিষ, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, ন্যায়, সভ্যতার ইতিহাস, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের নিদর্শন বর্তমান। প্রায় সব বিষয়েই তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।

একথা অনস্বীকার্য যে এসব মুসলিম বিজ্ঞানীরা যখন এতসব বিষয়ে দিকদর্শন দিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান চর্চা নিষিদ্ধ এবং বিজ্ঞানের পক্ষ নেয়ার গ্যালিলিও'র মতো বিজ্ঞানীও তার কয়েকশত বছর পর চার্চের কাছে আনত মস্তক হয়ে বলতে হয়েছে "আমি আমার দাবির জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী বরং ঘোষণা করছি পৃথিবী ঘুরছে না।"

•ইসলামী সরকারসমূহের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা :
বদর যুদ্ধে ইসলামের প্রথম বিজয় ও ৭০ জন কাফিরের গ্রেফতারের পর নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করেন যে, যে মুশরিক ১০ জন মুসলিমকে পড়তে ও লিখতে শিখাবে সে আজাদ হতে পারবে। এভাবেই শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ পায়। পরবর্তী খলিফাগণও জ্ঞান চর্চার এ ধারা অব্যাহত রাখেন।

হিজরি ২১৫ সালে আব্বাসীয় খলিফা মামুন ২০০,০০০ দিনার (প্রায় ৭ মি. ডলার) ব্যয়ে বাগদাদে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র গড়ে তোলেন যার নাম দেন 'বায়তুল হিকমাহ' এর সাথে ছিল একটি জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দির ও গণ-পাঠাগার। তিনি সেখানে বহুসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, গণিত ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করেন, যার পরিমাণ প্রায় ১০০ উটের বোঝা।

গুস্তাব লি বোঁ (gustab le bou) তাঁর 'ইসলাম ও আরবী সভ্যতার ইতিহাস' বইতে লিখেছেন- 'ইউরোপে যখন বই ও পাঠাগার ছিল। সত্যিকার অর্থে বাগদাদের 'বায়তুল হিকমায়' চল্লিশ লক্ষ, কায়রোর সুলতানের পাঠাগারে দশ লক্ষ, সিরিয়ার ত্রিপোলী পাঠাগারে তিরিশ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। অপরদিকে মুসলমানদের সময় কেবল স্পেনে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হতো।"

ডঃ ম্যাক্স মেয়রহোফ লিখেন-" ইস্তাম্বুলের মসজিদগুলোর জন্য ৮০টি পাঠাগার ছিল। প্রতিটি লাইব্রেরিতে দশ হাজার বই ও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ছিল। দামেস্ক, মসুল, বাগদাদ, ইরান ও ভারতের শহরসমূহে অনুরূপ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে।"

ড. ওস্তাব তাঁর বইতে আরও অগ্রসর হয়ে বলেন, "মুসলমানরা কোন শহর অধিকারে নিলে প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করতো একটি মসজিদ ও একটি কলেজ। বাগদাদ, কায়রো, this কর্ডোভা ও অন্যান্য স্থানে পরীক্ষাগার, মানমন্দির, বিরাট পাঠাগার ও জ্ঞান সাধনার অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কেবল আন্দালুসিয়ায় তত্ত্ব ছিল ৭০টি গণপাঠাগার। কর্ডোভার আল হাজাম পাঠাগারে ৬০০,০০০ বই ছিল। অথচ চার শতাব্দী পরে চার্লস দি জাস্ট বিবলিওথিক ন্যাশনাল অব প্যারিস শুরু করেন ৯০০ বই দিয়ে যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল ধর্মের উপর রচিত।"

পণ্ডিত নেহেরু তার 'A Glimpse at World History' তে লিখেন "কর্ডোভায় ১০ লক্ষের বেশি লোক বাস করতো, যেখানে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাবলিক পার্ক ছিলো, ৪০ কিলোমিটারব্যাপী তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬০০০ প্রাসাদ ও বড় বড় বাড়িঘর; ২০০,০০০ সুন্দর আবাস বাড়ি, দোকানপাট, ৩০০ মসজিদ, ৭০০ হাম্মামখানা (ঠাণ্ডা ও গরম পানির সরবরাহ) ছিল। অসংখ্য পাঠাগার ছিল যার মাঝে রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় বিখ্যাত ছিল কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি সকল দরিদ্রের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।"

ড. মরিস বুকাইলি তাঁর গ্রন্থ "The Bible, The Quran and Science"এ উল্লেখ করেন ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলাম জ্ঞান বিজ্ঞানকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। যখন খ্রিস্টীয় জগতে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা চলছিল তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালসমূহে বহু সংখ্যক গবেষণা ও আবিষ্কার সাধিত হয়। কর্ডোভার রাজকীয় পাঠাগারে ৪০০,০০০ বই ছিল। ইবনে রুশদ তখন সেখানে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য দেশীয় বিজ্ঞানে পাঠদান করতেন। যার কারণে সারা ইউরোপ থেকে পণ্ডিতেরা কর্ডোভায় পড়তে যেতেন যেমন আজকের দুনিয়ার মানুষ তাদের শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য আমেরিকায় যায়। আমরা আরব সংস্কৃতির কাছে বহুলভাবে ঋণী, গণিত (বীজগণিত একটি আরব আবিষ্কার), জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি এর জন্য। মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দান করে। এ সময় মানুষ অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ ছিলো কিন্তু ইসলামী দুনিয়ায় মানুষকে একই সাথে বিশ্বাসী ও বিজ্ঞানী হতে বাধা দেয়নি। বরং বিজ্ঞান ছিল ধর্মের যমজ ভাই।"

•চিকিৎসা বিজ্ঞান
Dr. Mayerhof তাঁর বই "The Legacy of Islam" এ লিখেন মুসলিম ডাক্তারগণ ক্রুসেড যুদ্ধে আগত মেডিক্যাল এটেনডেন্টদের অগোছালো ও প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা দেখে হাসতেন। ইউরোপীয়গণ সে সময়ে ইবনে সিনা, জাবির, হাসান বিন হাইসাম বা রাজির বইসমূহের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। অবশ্য পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় তাদের বইগুলো অনূদিত হয়। এসব অনুবাদ এখনও বর্তমান কিন্তু কোথাও অনুবাদকের নাম নেই। ষোড়শ শতাব্দীতে ইবনে রুশদ (Averroes) ও ইবনে সিনার (Avicenna) বইসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে ইটালি ও ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠদানের মৌলিক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।"

একই গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় তিনি আরও লিখেন "রাজির মৃত্যুর পর ইবনে সিনা রাজিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। চিন্তা, দর্শন ও সাধারণ বিজ্ঞানে তার প্রভাব ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান (সমরকন্দের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত গ্যালনের রচনাবলির আরবি অনুবাদ এর ভিত্তিতে গড়ে উঠা) ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মাঝে ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কায়েস, ইবনে যাহর, ইরানের আব্বাস, মিসরের আলী ইবনে রেজভান, বাগদাদের ইবনে ইসাউ, মসুলের আম্মার, আন্দালুসিয়ার আবু রুশদ। এদের বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল।

মুসলমানগণ যখন স্পেন জয় করে ইউরোপ তখন কলেরার ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতো না। লোকেরা মনে করতো এ রোগটি হচেছ পাপের প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ একটি আসমানী আজাব। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে কেবল কলেরা নয় এমনকি প্লেগও একটি সংক্রামক ব্যাধি বই কিছু নয়।"

বলা হয়ে থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যখন অস্তিত্ব ছিল না হিপোক্রিটিস তাকে অস্তিত্বে জানেন; যখন তা হারিয়ে যায় গ্যানে তা পুনঃপ্রবর্তন করেন; যখন এ শাস্ত্রটি হযবরল ও এলোমেলো হয়ে যায় আল-রাজি তা পুনর্বিন্যাস করেন এবং এরপরও যখন তা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ইবনে সিনার মহান প্রয়াস তাকে সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন করে। Dr. Maverhof এ বিষয়ে লিখেন "ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুন (The Canoon) চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাস্টারপিস হিসাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করে যে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে এর ১৬টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়, যার ১৫টি ল্যাটিন ও ১টি আরবি। বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থ হিসাবে ষোড়শ শতাব্দীতে এর শত শত মুদ্রণ হয়। ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে এটিই ছিল সর্বাধিক পরিচিত চিকিৎসাগ্রন্থ। এখনও চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক বিষয়ে এ গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়।" ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছর এ বইটি ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানে একমাত্র মূল টেক্সট।

উইল ডুরান্ট (Will Durant) লিখেন যে মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া রাজি মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মাঝে অগ্রসর ছিলেন। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা যা আজও ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। তার বিশেষ অবদান হচ্ছে:

১। "শুটি বসন্ত ও হাম" (Smallpox and Measles): এটি ১৪৯৭ থেকে ১৮৬৬ সালের মাঝে ল্যাটিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ৪০ বার মুদ্রিত হয়। ২। "মহান বিশ্বকোষ" (The Great Encyclopedia): এটি ২০ খণ্ডের বিশাল বিশ্বকোষ যা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। এই বিশ্বকোষের ৫ খণ্ড ছিলো চক্ষু বিজ্ঞানের উপর। ১২৭৯ সালে এটির ল্যাটিন অনুবাদ হয় এবং কেবলমাত্র ১৫৪২ সালে এর ৫টি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। শত বছর ধরে চোখ, চোখের রোগ ও তার চিকিৎসাক্ষেত্রে এ গ্রন্থগুলো প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচিত হতো। ১৩৯৪ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তার চিকিৎসাবিজ্ঞান কোর্সের ৯টির ১টি হিসাবে এটিকে গ্রহণ করে। মুসলিম ডাক্তারগণ সার্জারিতেও অনেক দূর এগিয়ে যান। তারা এনেসথেসিয়ার প্রয়োগও করতেন যদিও ধারণা করা হয় এটি সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার। রাজির অন্যান্য আবিষ্কারের মাঝে ছিলো- জ্বর রোগে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, ক্ষত সারানোর ব্যাপারে পারদ ও পশুর ব্যবহার ইত্যাদি।

মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণই প্রথম আঙ্গুলের নখ দেখে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়, জন্ডিস রোগের সুচিকিৎসা, ক্ষরণ বন্ধ করার ব্যাপারে ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার, কিডনি ও ব্লাডারের পাথর সরানোর জন্য তা ভাঙ্গা, হার্নিয়া রোগের শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় আবিষ্কার করেন। বিখ্যাত ইসলামী শল্যচিকিৎসক ছিলেন আন্দালুসিয়ার আবুল কাসেম। তিনি বহু সংখ্যক শল্য-যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক ও এ বিষয়ের গ্রন্থকার। তাঁর এসব বই ১৮১৬ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন ভাষার ব্যাপক সংস্করণে মুদ্রিত হয়।

•ঔষধশাস্ত্র (Pharmacology)
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অন্যতম শাখায় মুসলমানদের অবদান অসামান্য। গুস্তাব লি বোঁ লিখেন" টাইফয়েড রোগের চিকিৎসার জন্য ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার ইউরোপ যা একবার মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করে ফেলে দিয়েছিলো এবং আবার যা তারা কয়েক শতাব্দী পর সাগ্রহে গ্রহণ করছে- এছাড়াও মুসলমানদের অনেক উদ্ভাবনের কাছে তারা ঋণী। মুসলমানরাই প্রথম রাসায়নিক ঔষধসমূহকে পিল ও মিকশ্চার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে যা বর্তমানেও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। এসবের অনেকগুলোকেই বর্তমান সময়ের রসায়নবিদগণ নতুন আবিষ্কার বলে চালিয়ে দিতে চান; এর কারণ অবশ্য এসবের ইতিহাস সম্বন্ধে তাদের অজ্ঞতা। মুসলমানদের ডিসপেন্সারিগুলোতে রোগীরা চিকিৎসাপত্র নিয়ে গেলে পর্যাপ্ত ঔষধ পেতো, যেখানে কোন হাসপাতাল সুবিধা ছিল না ডাক্তারগণ তাদের যন্ত্রপাতিসহ রোগীর সেবায় ছুটে যেতেন।" জর্জি যাইদেন (Georgi Zeidan) লিখেন "ইউরোপের আধুনিক ঔষধ বিজ্ঞানীগণ তাদের পেশায় ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখেছেন শতবর্ষ আগে মুসলিম ডাক্তারগণ আধুনিক ও কার্যকর উপায় উপাদান ব্যবহার করেছেন: তারা একটি ফার্মাকোলজি বা ঔষধশাস্ত্র গড়ে তোলেন ও জটিল রোগের চিকিৎসা করতে সমর্থ হন এবং আধুনিক মডেলের ফার্মেসি গড়ে তোলেন।

কেবল বাগদাদ শহরে ৬০টি ঔষধালয় থেকে খলিফার খরচে বিনে পয়সায় ঔষধ দেয়া হতো। ইউরোপেও অনেক ঔষধের নামে আরবি, ভারতীয় ও ফার্সী মূলের প্রয়োগ দেখা যায় যেমন- এলকোহল, এলকালি, এলকানের, এপ্রিকোট, আরসেনিক ইত্যাদি।

•হাসপাতাল (Hospital)
জর্জি যাইদেন বর্ণনা করেন "রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর দুইশত বছরের আগেই মক্কা, মদীনাসহ সকল বড় বড় মুসলিম শহরে হাসপাতাল গড়ে ওঠে, আব্বাসীয় গভর্নরগণ তাদের নিজ নিজ এলাকায় শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। কেবল বাগদাদেই ছিল ৪টি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল। তৃতীয় হিজরিতেই গভর্নর আব্দুদ্দৌলা দেই লামী আদুদী হাসপাতাল গড়ে তোলেন, যেখানে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন। তখনকার দিনে এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতাল কিন্তু অল্প সময়ের মাঝেই তার চেয়ে ভাল হাসপাতাল তৈরি হয়।

এসব হাসপাতালে রোগীরা ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিচারে সমান যত্ন ও সেবা লাভ করতো। বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ড ছিলো। এসব হাসপাতালে ছাত্ররা তত্ত্বের পাশাপাশি রোগী পর্যবেক্ষণ করতো। তাছাড়া কতিপয় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যেসবের ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেলজুকি সুলতান মাহমুদ এর সাথে এমন একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল যা বহন করে নিতে ৪০টি উট লাগতো। ডঃ গুস্তাবলি বোঁ লিখেন "মুসলিম হাসপাতালসমূহে প্রতিষেধক ঔষধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার এমন উন্নত ব্যবস্থা ছিলো যে সেখানে মৃতদের ছাড়া সবারই রোগ আরোগ্য হতো। সেখানে আলো বাতাসের প্রাচুর্য ও প্রবহমান পানির সুব্যবস্থা থাকতো। সুলতান মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া রাজিকে বাগদাদের উপকণ্ঠে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলে তিনি বহু পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত স্থান বাছাই করেন। এসব হাসপাতালে বড় সাধারণ ওয়ার্ড এবং ব্যক্তিদের জন্য পাইভেট ওয়ার্ডের ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররা এখানে রোগ নির্ণয়, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতো। এছাড়া ছিল বিশেষ ধরনের মানসিক হাসপাতাল এবং বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের জন্য ঔষধালয়।"

মার্ক ক্যাপ (Mark Kapp) লিখছেন, "কায়রোতে একটি বড় হাসপাতাল ছিল যেখানে জীবন্ত ঝর্না ছিল, বিশাল ফুলের বাগান ছিল এবং ৪০টির বেশি উঠোন ছিলো। সেখানে রোগীদের সাদরে গ্রহণ করা হতো ও সুস্থ হয়ে গেলে ৫টি স্বর্ণমুদ্রাসহ তাকে ফেরত পাঠানো হতো তার ঘরে। সে সময়ে কর্ডোভা নগরীতে ৬০০ মসজিদ, ৯০০ গণশৌচাগার (হাম্মাম) এর পাশাপাশি ৫০টি হাসপাতাল ছিল।"

মুসলমানরা যখন এসব সুউচচ ও প্রসারিত হাম্মামখানায় সাবান ও সুগন্ধি ব্যবহার করতো, প্রবহমান পানিতে গোসল করতো আধুনিক আমেরিকা তখন জঙ্গল আর গুহা থেকে বেরোয়নি, শিখেনি কিভাবে গোসল করতে হয়। ইউরোপ তখন সভ্যতা, সংস্কৃতির জন্য অক্সফোর্ড ছেড়ে কার্ডোভার দিকে ছুটছিলো।

•রসায়নশাস্ত্র
ইমাম জাফর সাদিকের শিষ্য জাবির ইবনে হাইয়্যান 'রসায়নশাস্ত্রের জনক' হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আরব রসায়নশাস্ত্রের জনক। পশ্চিমা রসায়নশাস্ত্র ও আলেকেমির উপর তার প্রভাব হিলো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। তাঁর কয়েকশত অবদান সর্বজন স্বীকৃত এবং এখনও টিকে আছে। সাবেক ইরাকী শিক্ষামন্ত্রী মরহুম সৈয়দ হেবাতউদ্দিন শাহরিস্তানী লিখেন, "আমি জাবিরের ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র দেখতে পাই যা তার শিক্ষক ইমাম জাফরকে উৎসর্গ করা। তাঁর ৫০০টি গবেষণাকর্ম মুদ্রিত অবস্থায় প্যারিস ও বার্লিনের জাতীয় পাঠাগারে পাওয়া যায়। ইউরোপের জ্ঞানীরা তাঁকে আদর করে ডাকে 'বুদ্ধিমত্তার অধ্যাপক' (Wisdoms Professor) এবং তারা স্বীকার করে যে তিনি ১৯টি মৌলিক পদার্থের আবিষ্কারক। জাবের বলেন যে কোন বস্তুকে আলো ও আগুনের সাহায্যে এমন অণুতে পরিণত করা সম্ভব যা বস্তুর অদৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম ইউনিট। জাবের এর এ তত্ত্বটি আধুনিক পারমাণবিক বিজ্ঞানের অতি নিকটবর্তী।" নাদিম রচিত ফিহরিস্ত ও অন্যান্য তালিকায় জাবির রচিত রসায়ন গ্রন্থের পরিমাণ ২৭৭ খানা যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৭০। তার গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২ থেকে ১০০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুই বা দেড় পৃষ্ঠার এসব বই এক একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত বই ৫০০, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ১, দার্শনিকের যুক্তি খণ্ডনের বই ৫০০ ইত্যাদি।

জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নের শুদ্ধতম ভিত্তি রচনা করেন। তিনি হাতে কলমে পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর জোর দেন। কিতাবুত তাজ, কিতাবুল মাওয়াজিন, কিতাবুর রাহমাস্স্সাগির, কিতাবুল খাওয়াস ও কিতাবুল হুদুদে তিনি এ বিষয়ে তাঁর মত ব্যক্ত করেন।

রসায়নশাস্ত্রের যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা চালাতে হয় তিনি সেসব রপ্ত করেন ও নিজের আবিষ্কৃত পরীক্ষা প্রক্রিয়াসমূহের সাথে মিলিয়ে এসবের উন্নয়ন করেন। তিনি পাতন, ঊর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভষ্মীকরণ, গলান, বাষ্পীভবন প্রভৃতি রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর বিশদ লেখালেখি করেন। এসব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাঁর বর্ণনা ছিল বৈজ্ঞানিকভাবে বিশুদ্ধ ত্রুটিমুক্ত।

জাবির টিন, সীসা, তামা, লৌহ, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি তৈরির পন্থা আবিষ্কার করেন। তার ব্যবহারিক ও ফলিত রসায়নের মাঝে ইস্পাত তৈরি করার পন্থা, কাপড় ও চামড়া রং করার প্রণালী, লোহা এবং ওয়াটার প্রুফ কাপড়ের বার্নিস করার উপায়, কাচ তৈরি করার জন্য ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার, সোনার জলে নাম লিখাবার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বস্তুর রং করা, খনিজ দ্রব্য ও ধাতব পদার্থের উৎপাদন ইস্পাত প্রস্তুতি ট্যানিং ইত্যাদি কারখানা কৌশল মুসলমানরাই প্রথম আবিষ্কার করে। তারাই নাইট্রিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রো গ্লিসারিন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, পটাশিয়াম, একুয়া নাইট্রেট, এলকোহল, এলকালি অরপিমেন্ট, অরপিসেন্ট ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। বোরাক্সও তাদের আবিষ্কার।

আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে পাতন, বাষ্পীকরণ, পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া এবং সোডিয়াম, কার্বন, পটাসিয়াম কারবোনেট, ক্লোরাইড ও এমোনিয়ার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

•পদার্থ বিজ্ঞান
ইবন আল হাইসাম (আল হাজেন, ৯৬৫-১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে) ছিলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে উন্নত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক অবদান রাখেন। প্রফেসর আব্দুস সালামের মতে, "তিনিই প্রথম বলেন যে আলোক রশ্মি কোন মাধ্যম অতিক্রম করার সময় সহজ ও দ্রুততর পথ বেছে নেয়। এভাবে তিনি বহু শতাব্দী আগেই ফারমেটস্ এর সর্বনিম্ন সময় তত্ত্ব (Principle of Least time) অনুরূপ তত্ত্ব প্রদান করেন।

তিনি সর্বপ্রথম জড়তা তত্ত্ব (Law of Inertia) প্রদান করেন যা পরবর্তীতে Newton এর 'ল অব মোশন' হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তিনিই প্রথম আলোর প্রতিসরণের তত্ত্ব প্রদান করেন যা পরবর্তীতে নিউটনের হাতে পুনরাবিষ্কৃত ও বিস্তৃতি লাভ করে।"

পশ্চিমা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশাল, বিরাট। তাঁর সমসাময়িক আল বেরুনীর সহযোগিতায় তিনি বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। আধুনিক ইউরোপের শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অবিসংবাদিত পথিকৃৎ রজার বেকন এর আকাশচুম্বী সৃষ্টি (Opus Majus এর পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবিক অর্থে ইবনে আল হাইসামের আল মানাজির (Optics) এর নকলমাত্র। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব তা স্বীকার করে না।

আল বিরুনী (৯৭৩ - ১০৪৮ খ্রিঃ) ভারত ও আফগানিস্তানে অনেক কাজ করেন। বহু পূর্বেই তিনি প্রকৃতির আইন আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, পদার্থবিদ্যার যে বিধান পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল। আকাশের কক্ষপথসমূহেও ক্রিয়াশীল। মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানী আবুল হাসান সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, গ্যালিলিও তার উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন মাত্র। অথচ বর্তমান বিশ্ব জানে গ্যালিলিওই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক। ইবনুল হাইসাম তাঁর গ্রন্থ মাকালাতু ফি মারাকাজুল আস্কাল' গ্রন্থে বস্তুর পরস্পরের আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি ও দার্শনিক মাওলানা রুমি কবিতায় মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের ধারণা দেন। সম্ভবতঃ সেই পথ ধরে পরবর্তীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন এ বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব দাঁড় করান।

•শিল্প কারখানা
আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদ এইক্সের চারলেম্যানের কাছে বাগদাদ থেকে একটা ঘড়ি পাঠান উপঢৌকন হিসেবে যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেজে উঠতো। এটি দেখে সদ্য সিংহাসনে আসীন রোমান শাসক ও তার সভাসদগণ চমৎকৃত ও আনন্দিত হলেন। আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টানদের ধ্বংসলীলার ফলে মুসলিম শাকসকদের সময়কার বড় বড় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা, কৃষ্টি ও সভ্যতার অন্যান্য উপাদানে স্থবিরতা নেমে আসে। দক্ষ রাজমিস্ত্রিদের অভাবে শহরের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। মাদ্রিদের জনসংখ্যা ৪ লাখ থেকে ২ লাখে নেমে এলো। যে সেভাইলে ১৬০০ শিল্পকারখানা ছিল সেখানে ৩০০ কারখানা টিকলো এবং ১,৩০,০০০ শ্রমিক চাকরি হারালো অথচ জনসংখ্যা তখন ৭৫% কমে গেছে। মুসলমানরাই প্রাচীন চর্ম-কাগজের পরিবর্তে তুলার তৈরি কাগজের প্রচলন করে এবং এতে করেই ইউরোপে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ হলো। অবশ্য মুদ্রণ পদ্ধতি আসে প্রাচীন চীন থেকে। এ থেকেই বই পুস্তুক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁর সূচনা হয়। কাগজ আবিষ্কারের ফলেই প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থরাজির পুনর্লেখন সম্ভব হলো।

ফিলিপ হিট্টি (Philop Hitti) তাঁর History of the Arabs এ লিখেন 'সড়ক তৈরির প্রযুক্তি মুসলমানদের হাতে এতটা উন্নত হয় যে কর্ডোভায় মাইলের পর মাইল পাকা সড়ক ছিল যার দুপাশে রাতে বাতি জ্বলতো যাতে লোকেরা নিরাপদে পথ চলতে পারে, অথচ সেই একই সময়ে লন্ডন বা প্যারিসের পথে বৃষ্টিস্নাত রাতে বের হলে হাঁটু পর্যন্ত জলমগ্ন ও কর্দমাক্ত হতে হতো। এ অবস্থা কর্ডোভায় পাকা রাস্তা আসার সাতশত বছর পরও ছিলো। অক্সফোর্ডের লোকেরা তখন মনে করতো গোসল করা একটা অপকর্ম যখন কর্ডোভার ছাত্রগণ বিলাস-বহুল হাম্মামখানা ব্যবহার করতো।

•অঙ্কশাস্ত্র
আধুনিক বিজ্ঞানে অঙ্ককে বলা হয় মা। কম্পিউটার এর আবিষ্কার ও এর উন্নতি কেবলই অঙ্কনির্ভর। Legacy of Islam গ্রন্থের 'Astronomy and Mathematics অধ্যায়ে Baron Carra de Vaus বলেন, "এলজেবরা হচেছ আরবি আলজবর কথাটির ল্যাটিনরূপ। আল জবর অর্থ শক্তি, ভাগ্য বা অসংগতি। এটিকে এক কথায় সংক্ষিপ্তকরণ বলা যায়। এটি বর্ণের পরিবর্তে সংখ্যা বা সংখ্যার পরিবর্তে বর্ণের ব্যবহার। কুরআনে ব্যবহৃত হরুফে 'মুকাত্তায়াতি' এর মতো এর প্রয়োগ। অংকের ভাষায় এটি ভগ্নাংশকে পূর্ণসংখ্যায় রূপান্তর করা; জটিল সংখ্যাকে সহজতর ভাষা বা সংকেতে উপস্থাপন করা। বিজ্ঞান আজ যেসব সংখ্যা ব্যবহার করছে তা আরবি সংখ্যা। বর্তমানে ব্যবহৃত কম্পিউটার প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হচেছ হিন্দু প্রতীক থেকে '৩' বা শূন্যের যে মূল্যমান আরবরা গ্রহণ করেছে তা। '০' বা Zero এর নিকটতম শব্দ Chiper যা কিনা আরবি ka sefr এর প্রতিলিপিকরণ বই নয়।" De vaux আরো লিখেন: Chiper ব্যবহার করে আরবগণ নিত্যব্যবহার্য গণিতের পথপ্রদর্শক হন। তারা বীজগণিতকে একটি প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দেন ও উন্নয়ন ঘটান, তারাই বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির ভিত্তি রচনা করেন, তারাই ত্রিকোণমিতির একমাত্র স্থপতি। এলগোরিদম কথাটি আসে এর আবিষ্কারক খিত্ এর বাসিন্দা আল খারেজমির নাম থেকে। আরবগণ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার চরম পর্যায়ে যখন, তখন ইউরোপ চরম বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল। "আল খারেজমী প্রথম আলজাবর ওয়াল মোকাবিলা পদ্ধতির ব্যবহার করতে থাকেন। বস্তুর সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ ও কঠিন বস্তুর এবস্ট্রাকট ফরমুলেশানের নিয়ম (হাদ্দ বা তাহদিদ) তিনি প্রণয়ন করেন। খারেজমী মনে করতেন বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল শক্তি হচেছ গণিত। সূক্ষ ও বিশুদ্ধ গণনার জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত প্রক্ষেপণ নীতি The formula of interpolation কে নিউটনের আবিষ্কার বলে চালালেও তাঁর জন্মের বহু পূর্বে আলবেরুনী শুধু একে আবিষ্কারই করেননি তিনি একে ব্যবহার করে সাইন (Sine) তালিকা প্রণয়ন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর আকার, পরিধি ইত্যাদি বিষয়ে যে আলোচনার অবতারণা হয় তাতে সর্বশেষ অবদান রাখেন মুসলিম বিজ্ঞানী বনি মুসা ভ্রাতৃদ্বয় এবং আলবেরুনী। আলবেরুনীর কানুনে মাসউদীর ৪র্থ খণ্ডে প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। তিনি দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দিক নির্ণয়, গ্রহ-নক্ষত্রাদির অবস্থানজ্ঞাপক সংজ্ঞা নির্দেশ করার সহজ বিজ্ঞানসম্মত উপায় নির্ধারণ করেন। জ্যোতির্বিদগণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক আল বাত্তানীও একজন মুসলিম। স্থানাঙ্কের যেকোন ২টি বিষয়ে জানতে পারলে অন্যগুলি নির্ধারণের যে সহজ ফর্মুলা আলবেরুনী দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।

আবু রায়হান বিরনী তাঁর কিতাবুত তাফহিম ফি সানয়াতে তানজিম গ্রন্থে লিখেছেন, "যে ব্যক্তি ৪টি বিজ্ঞানে পারদর্শিতা লাভ না করেছে তাকে জ্যোতিষী বলা যেতে পারে না। এ ৪টি বিজ্ঞান হলো- অঙ্কশাস্ত্র (Mathematics), গণিত (Arithmetic), বিশ্ব গঠনতন্ত্র (Cosmography), বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষী (Judicial Astrology)। আলবিরুনী ছিলেন সর্ববিচারে একজন সার্থক জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।"

নভোমণ্ডলী, নভোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থানের অবস্থান, শহর নগরের আয়তন ইত্যাদি সম্বন্ধীয় সাধারণ গণনা সম্পর্কীয় গ্রন্থ: আলোর গতি সম্পর্কীয় গ্রন্থ: এস্ট্রোল্যাব সহযন্ত্রাদি ও সে সবের ব্যবহার সম্পর্কিত গ্রন্থ, কাল ও সময় সম্পর্কিত গ্রন্থ; উল্কা ও কুজঝটিকা বিষয়ক, জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ শিরোনামে তাঁর ৭৯টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাদি রয়েছে।

আমরা যাকে কেবল রুবাইয়াতের কবি হিসেবে চিনি সেই ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত। নিউটনের বহু আগে তিনি আবিষ্কার করেন "বাইনোমিয়াল থিউরাম।" এ পদ্ধতিতে তিনি সূর্যের চারিদিকের পৃথিবীর সময় মান ঠিক করে জালালি ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন।

•ভূগোল
প্রথম কয়েক শতাব্দীর মাঝেই আরব মুসলিমগণ ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেন মরক্কো থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত। আরব্য রজনীর সিন্দাবাদকে আমরা দেখি চীন, জাপান আর ইন্দোনেশিয়ান দারুচিনি দ্বীপের দেশে ঘুরতে। তাতেই মনে হচেছ আরবরা আগে থেকেই ভূগোল, ভূবিদ্যা ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলো।

কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি আরব নাবিকগণ আফ্রিকার পূর্বতীর থেকে রাশিয়ার দূরবর্তী এলাকা পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান। আফ্রিকান মুসলমানগণ কলম্বাসের বহু আগেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছায়। ভারতে আসার সমুদ্র পথও প্রথম আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ্যা, জাহাজ পরিচালনা বিজ্ঞান, মহাসাগরের বৈজ্ঞানিক বর্ণনাকারী এবং সাগরের প্রাণী সম্পর্কে বহু গ্রন্থের প্রণেতা মুসলিম বিজ্ঞানী আহমদ বিন মজীদ।

বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে হক্কাল (৯৭৫ খ্রিঃ) তার গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, "আমি এই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের দ্রাঘিমা, অক্ষরেখা ও অক্ষাংশ সম্বন্ধে লিখেছি, এর সকল দেশ, সকল সীমানা এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে লিখেছি। আমি এসবের মানচিত্র এঁকেছি সযত্ন প্রয়াসে এবং সেখানে শহরসমূহ, নদীসমূহ, হ্রদ, ফসলাদি, কৃষ্টির ধরন, রাস্তাঘাট, একস্থান থেকে অন্যস্থানের দূরত্ব, বাণিজ্যিক দ্রব্যসমূহ এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় যা রাজন্যবর্গ ও তাদের সহযোগী ও সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে পারে তা নির্দেশ করেছি। সম্ভবতঃ এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মানচিত্র। মুসলিম পরিব্রাজক আবু রায়হান আল বিরুনী, ইবনে বতুতা ও আবুল হোসাইন ঐসব লোকদের মাঝে অনন্য যারা ভূবিদ্যার ইতিহাস রচনার জন্য কষ্টকর অভিযাত্রা আর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্যাদি রেখে গেছেন। বিজ্ঞানের দ্বিগ্বিদিক জয়যাত্রায় তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

••হায় অতীত! সোনালি অতীত!
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা যেকোন মুসলিম তরুণের হৃদয়ে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। কি সুন্দর, গৌরবময় ঐতিহ্যশালী আমাদের অতীত। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ইতিহাসে কি স্বর্ণোজ্জ্বল আমাদের অবদান! কিন্তু এ যে কেবলই অতীত। বিগত কয়েকশত বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান আমাদের নেই। আমরা কি কেবলই অতীতের স্মৃতিচারণ করে জাবর কাটবো? না; কক্ষণোই নয়।
আজ প্রতিটি মুসলিম তরুণকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মুসলিম ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেলতে হবে। পাশ্চাত্য অরিয়েন্টালিস্ট পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আমাদের ইতিহাস ও পণ্ডিতবর্গের নামের যে বিপুল বিকৃতি ঘটেছে তার হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে প্রকৃত সত্য। আর তা ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র।
আফসোস আর হতাশার কৃষ্ণ-পর্বতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াবার কোন অবকাশ আমাদের নেই। এখন সময় সিদ্ধান্তের। নতুন যুগের আলবেরুনী, খারেজমী, জাবির ইবনে হাইয়ানদের এগিয়ে আসার দিন।

উঠুন, জেগে উঠুন, অন্ততঃ রজার বেকনের মতো জেগে উঠুন। অক্সফোর্ডের ছাত্র রজার বেকন কর্ডোভায় গিয়ে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনীষার সংস্পর্শে থেকে সব উপকরণ বগলদাবা করে যদি নব্য ইউরোপের রেনেসাঁর জন্ম দিতে পারে, বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমানের মাঝে কি এমন একজনও নেই যে আবার ফিরিয়ে আনবে আমাদের সোনালি অতীত?

লেখক:
ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 


•গ্রন্থ নির্দেশনা :
1. Western Civilisation through Muslim Eyes; Sayid Mujtaba Rukni Musawilari, 1978 Iran.
2. Origin And Development of Experimental science; Dr. Muin-Ud-Din Ahmad Khan; BIIT, 1998.
3. Classification of Sciences in Islamic Thought; Al Najjar; AJISS; volume 13, Number-1 Washington DC. 1996. (প্রবন্ধ)
4. আলবেরুনী; এম আকবর আলী ই. ফা. বা প্রকাশনা; ১৯৮২.
5. জাবির ইবনে হাইয়ান; এম. আকবর আলী ই, ফা, বা প্রকাশনা; ১৯৮২।

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

 বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ
লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
(১৯৮৫ সালে রাজশাহী মহানগরীর দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ে শব্বেদারীতে প্রদত্ত বক্তব্য পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন রাজশাহী মহানগরী আমীর ছিলেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।)

লেখক পরিচিতি:
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী(রহ.)।
১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা লুৎফুর রহমান। মাতা মোমেনা খাতুন। তিনি ১৯৭০-৭১ দুই সেশন নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ১৯৮৮-২০০০ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্ব-পদে বহাল ছিলেন। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে ২য় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ২২মে পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা নিজামীর ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। তিনি ২০১০ সালের জুন মাসে গ্রেফতার হন এবং ২০১৬ সালের ১১ মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে আওয়ামী ট্রাইবুনালের ভিত্তিহীন অভিযোগে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করেন।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ

ইনফাকের অর্থ:
ইনফাকের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ: ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু (نفق) যার অর্থ সুড়ঙ্গ। যার একদিক দিয়ে প্রবেশ করে আর একদিন দিয়ে বের হওয়া যায়।
মুনাফিক এবং নিফাক শব্দদ্বয়ও এই একই ধাতু থেকে গঠিত। অর্থের দিক দিয়ে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য আছে। নাফাকুন থেকে ইনফাক গঠিত হয়েছে। 
শাব্দিক অর্থের আলোচনায় আমরা ইনফাকের দুটো দিক পেয়ে থাকি। 
এক. এ পরিমাণ খরচ করতে হবে যাতে অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ না আসে। বা দাতার মনে সঞ্চয়ের ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার সুযোগ না আসে।
দুই. ভরণ-পোষণ বা খোরপোষের অর্থের তাৎপর্য হল দাতা যার জন্যে দান বা খরচ করবে তার প্রয়োজন পূরণ করার মত অর্থ অবশ্যই ব্যয় করবে।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ:

ইনফাকের অর্থ এবং ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ একত্রে মিলালে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ দাঁড়ায়: জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রয়োজন পূরণ, এর উপায়-উপকরণ যোগাড় ও এই মহান কাজটি পরিচালনার জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যে অর্থসম্পদ খরচ করা। চাঁদার মনোভাব নিয়ে অর্থ দান করার মাধ্যমে এর হক আদায় হতে পারে না। তাই ইসলামী আন্দোলনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে চাঁদার পরিভাষা ব্যবহার না করে 'এয়ানাত'-এই আরবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ সহযোগিতা দান।

ইনফাকের তাৎপর্য:
আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার খাতে আমাদেরকে মাল সম্পদ খরচ করতে হবে কেন?
আল্লাহর তাআলা তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর পথে জিহাদের যে আহবান দিয়েছেন তার মধ্যেই উপরিউক্ত প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণাঃ "তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে মাল দিয়ে এবং জান দিয়ে।" অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই জিহাদে বা সংগ্রামে মালের কোরবানী এবং জানের কোরবানীর প্রয়োজন আছে। এই দুটো জিনিসের কোরবানী দেয়ার মত একদল মর্দে মুমিন, মর্দে মুজাহিদ তৈরি হলেই আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম বিজয় হবে যেমন বিজয়ী হয়েছিল রাসূলে পাক (সা.)-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) মালের কোরবানী ও জানের কোরবানীর বিনিময়ে। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের এই মহান সংগ্রাম দাবী করে যে এ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের কাছে তাদের নিজের জান ও মালের তুলনায় তথা ইহ জাগতিক যাবতীয় স্বার্থ ও লোভ-লালসার তুলনায় আল্লাহর রহমত ও সন্তোষই হতে হবে অধিকতর প্রিয়।


ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর ভূমিকা:

আমরা জানি, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.) আরবের একজন অন্যতম ধনী ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী খাদিজাতুল কুবরার (রা.) ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তিনি এ অবস্থায় উন্নীত হন। তাছাড়া হযরত খাদিজার সম্পদ ব্যবহারের তাঁর সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পর থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাঁর সম্পদ আর বিন্দু পরিমাণও বৃদ্ধি পায়নি। বরং তিলে তিলে সব আল্লাহর পথে নিঃশেষ হয়েছে।

ইনফাকের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের ভূমিকা:

আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের (রা.) ভূমিকা দুনিয়ার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা আল্লাহর রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়ে মালের ও জানের কোরবানী পেশের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁদের এই ভূমিকার জন্যে স্বয়ং আল্লাহ্ সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, "তাদের প্রতি আল্লাহ্ খুশি হয়েছেন আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি খুশি হয়েছে।"

  • হযরত খাদিজাতুল কুবরার (রা.)
  • হযরত আবু বকর (রা.)
  • হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)
  • হযরত উসমান (রা.)
  • আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)
  • মুহাজির ও আনসারগণ।

যে সকল সাহাবায়ে কেরাম রা: ভূমিকা রেখেছেন:

বর্তমান যুগে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ও তাদের প্রস্তুতি:

ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ প্রস্তুতি নিতে হলে বর্তমান যুগ-সন্ধিক্ষণে এ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রস্তুতিরও যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বর্তমান বিশ্বে যে দেশেই পরিচালিত হোকনা কেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ দুই পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিপক্ষ হল তাদের প্রভাব বলয়াধীন রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। বাংলাদেশের জন্যে ঐ দুই প্রধান প্রতিপক্ষের সাথে আর একটি বাড়তি প্রতিপক্ষ হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে আমাদের নিকট প্রতিবেশী একটি পাতি বৃহৎ শক্তি। এই প্রতিপক্ষ সার্বিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামের পুনর্জাগরণ ঠেকানোর জন্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের পারস্পরিক স্বার্থের, দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও ইসলামের ইস্যুতে প্রায় সর্বত্র তারা এক ও অভিন্ন ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির কারণে কোথাও কোথাও কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পরিলক্ষিত হলেও সেটা বাহ্যিক ব্যাপার মাত্র। মূলে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও আন্দোলনকে ঠেকানোর ব্যাপারে তাদের কোন শৈথিল্য নেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে তাঁরা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমসমূহ ইহুদীদের সহায়তায় ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে চিন্তার বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে রীতিমত Intelectual and cultural Agression চালাচ্ছে। (বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন) বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে প্রশাসনকে পর্যন্ত ব্যবহার করছে। এনজিওদের জাল বিস্তার করে সামাজিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পাশাপাশি আমাদের স্বকীয় মূল্যবোধ ধ্বংসের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সেই জালে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তুগত সহযোগিতা দিয়ে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের উপর সরাসরি আঘাত হানার ব্যবস্থা করছে।

ইসলামের অর্থ ব্যয়ের বিভিন্ন দিক:

ইসলাম ও ঈমানের মূল দাবীই যেহেতু আল্লাহর কাছে জান ও মাল সোপর্দ করার। ইসলামের বাস্তব কাজ যেহেতু আল্লাহর এবাদত এবং বান্দাদের সেবা করা, সেহেতু মুসলিম সমাজের বিভিন্ন দিকে ও বিভাগে অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা ঐতিহ্যগতভাবেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। 'নদী মরে গেলেও রেখা থাকে' এই প্রবাদ বাক্যের মতই মুসলিম সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ প্রায় হারিয়ে ফেললেও তাদের অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা বা ঐতিহ্য একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

ইসলাম অর্থ-সম্পদের কোরবানীর দু'ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। একটা বাধ্যতামূলক যেমন- যাকাত। অপরটি স্বেচ্ছামূলক। যেমন- গরীব, নিকট আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে দুঃস্থ অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা। কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি কায়েমের কাজে অর্থ ব্যয় করা। স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে অর্থ ব্যয়ের মন-মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্য বাধ্যতামূলক দান যাকাতের একটা ভূমিকা আছে। বরং সত্যি বলতে কি, প্রতিদানের আশা ছাড়া, কোন বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়া মানুষ অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত হোক এটা যাকাতের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।

যাই হোক, বাধ্যতামূলক দান অর্থাৎ যাকাতের যে আটটি খাত আছে তার মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর একটা খাত আল্লাহ্ রেখেছেন। মানুষ স্বেচ্ছামূলকভাবে যে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে, তার-মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর খাতে বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ আছে। শুধু সুযোগ আছে তাই নয় বরং আল্লাহর কোরআন এবং রাসূলের হাদীসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, আল্লাহর পথে জিহাদ হলো সর্বোত্তম আমল। অতএব এই সর্বোত্তম আমলের জন্যে অর্থ ব্যয় হবে সর্বোত্তম খাতে অর্থ ব্যয়- এটাই স্বাভাবিক।

যেই দেশে আল্লাহর দ্বীন কায়েম নেই সেখানে যাকাতের আটটি খাতের মধ্য থেকেও ফি সাবিলিল্লাহর খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হলে যাকাতের উদ্দেশ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দানের সকল দিক ও বিভাগের তুলনায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে দান করাই সর্বোত্তম দান। যে কোন দানের তুলনায় এ কাজের দানে সওয়াব হবে সবচেয়ে বেশি। ইসলামের এই শিক্ষাটা আমরা ভুলতে বসেছি বলেই আজ ইসলামী আন্দোলনের কাজে পয়সা দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক দলে চাঁদা দেয়ার শামিল মনে করে। সর্বোত্তম সওয়াবের কাজতো দূরের কথা, আদৌ সওয়াব হয় কিনা এ সম্পর্কেই সন্দেহ-সংশয় পোষণ করেন। 

ইনফাকের ক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের ঐতিহ্য:

ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্নমুখী ঐতিহ্য সৃষ্টিতে প্রধানতঃ অবদান রেখেছেন আম্বিয়ায়ে কেরামগণ (আ.)। এরপর আল্লাহর সেইসব বান্দাদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য যাদেরকে আল কোরআনে সিদ্দিকীন, সালেহীন এবং শোহাদা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁদের ভূমিকা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হওয়া সত্ত্বেও মনের কোণে প্রশ্ন জাগতে পারে। নবীদের ব্যাপার তো আলাদা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর ব্যাপার তো আরো ব্যতিক্রম। নবীদের সাথী-সঙ্গীদের ব্যাপারও আলাদা। কাজেই দূর অতীতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিকট অতীতের বা আজকের সমসাময়িক বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস-ঐতিহ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।

নিকট অতীতে আমাদের উপমহাদেশে হযরত সৈয়দ আহাম্মদ শহীদ ব্রেলভী পরিচালিত মুজাহিদ আন্দোলনের কথা আমাদের মোটামুটি জানা থাকার কথা। এই আন্দোলনে বাংলার তৌহিদী জনতা যেমন পায়ে হেঁটে যোগদানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অকাতরে এই আন্দোলনের জন্যে আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে মুজাহিদ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বসবাস ছিল সেইসব অঞ্চলের লোকদের মধ্যে এখনও ওশর দান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বীনি খেদমতে স্বতস্ফূর্তভাবে দানের রীতি চালু দেখা যায়। আজকের বিশ্বের দু'টি আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াতে ইখওয়ানুল মুসলেমিনের প্রতিষ্ঠাতা ও এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সাহাবায়ে কেরামগণের জানের কোরবানী ও মালের কোরবানীর ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। সাহাবায়ে কেরামগণ ঈমানের ঘোষণা দিয়ে যেভাবে জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, ইসলামী আন্দোলনে শরীক লোকেরা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুরূপ জুলুম ও নির্যাতনেরই সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁরা যেভাবে অর্থ-সম্পদ এ পথে ব্যয় করতেন আজকের যুগের ইসলামী আন্দোলনের লোকেরাও অনুরূপ ত্যাগ, কোরবানীর প্রয়াস পাওয়ার চেষ্টা করছে। 
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র.) তাঁর অসংখ্য বই-পুস্তকের আয় থেকে কোটিপতি হতে পারতেন কিন্তু তাঁর মধ্য থেকে মাত্র ২/৩টি বইয়ের আয় পরিবারের জন্যে রেখে বাদবাকী সমস্ত বইয়ের (যার অসংখ্য সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। অসংখ্য ভাষায় যার অনুবাদ ও প্রকাশ হয়েছে) ইসলামী আন্দোলনকে ওয়াকফ করেছেন। তাঁর সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাঁরা অনেকেই জীবনের ক্যারিয়ার এই আন্দোলনের জন্যে কোরবানী দিয়েছেন। 

নোট সংকলনে- আরমানের খেরোখাতা 

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

মাহে রমজানে রোজার প্রয়োজনীয় যাবতীয় মাসআলা || একজন রোজাদারের যে সকল করণীয় ও বর্জনীয় কাজ


“রমজানে রোজার যাবতীয় মাসআলা”

‘একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ’


রমযানুল মুবারক মাস সেসব নেয়ামাতসমূহের মধ্যে একটি নেয়ামাত যা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন। এ মাসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স.-এর মত নেয়ামাত আমরা পেয়েছি। এ মাসেই কুরআন মাজীদ দেয়া হয়েছে, যা হেদায়াত, ফুরকান, রহমত, নূর ও শেফা। মুসলিম উম্মাহর প্রাণস্পন্দন ও উন্নতির নিগূঢ় রহস্য ফী সাবিলিল্লাহর মাঝেই পাওয়া যায় প্রথম মানুষের বা মানবতার হৃদয় জয় করার জন্য জিহাদ, পরে সাংস্কৃতিক বিজয়ের জন্য জিহাদ-আর এ সকল জিহাদের সাথে সাথে চূড়ান্ত কামিয়াবীর জন্য আপন নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে জিহাদ। যাতে করে অর্জিত হয় তাকওয়া, ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং সাথে সাথে সমষ্টির তাকওয়া; রাতে জাগরণে শীতের রাতে ইশকের সাথে ওযু করা, লাইফে সাদাকাত (দান-খয়রাত) দিয়ানত, আমানত, আদালত (সুবিচার করা), শুজাআত (নির্ভীকতা, উথুয়াত (ভ্রাতৃত্ব) ও মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান। পবিত্র মাহে রমজানে একজন রোজাদারের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ সমূহ আলোকপাত করা হলো।

রোজা অবস্থায় যখন কাফফারা ওয়াজিব হয়:

১. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কোনো খাদ্য আহার করলে অথবা ওষুধ খেলে অথবা সিঙ্গা কিংবা সুরমা লাগানোর পর অথবা গীবত করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত আহার বা পান করলে।
২. প্রিয়জনের প্রিয় থুতু ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি খেলে।
৪. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী মিলন করলে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্ত থাকলে তার ওপরও কাজা-কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর স্ত্রী রাজি না থাকলে বরং তার সঙ্গে জোরপূর্বক করা হলে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।
৫. কামভাবের সঙ্গে স্ত্রীকে স্পর্শ করল অথবা চুম্বল করল বা আলিঙ্গন করল, তবে বীর্যপাত হয়নি, কিন্তু সে মনে করল, রোজা ভেঙে গেছে। ফলে ইচ্ছাকৃত পানাহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা এবং কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। (বাদায়িউস সানায়ে ২/৫৫৮)
৬. কেউ গোঁফে তেল লাগালো আর মনে করল রোজা ভেঙে গেছে, অতঃপর ইচ্ছাকৃত আহার করল, তা হলে তার ওপর কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে। (বাদায়িস সানায়ে ২/২৫৮)
৭. বিনা ওজরে একই রমজানে এক বা একাধিক রোজা রাখার পর ভেঙ্গে ফেললে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। আর রোজাগুলো একাধিক রমজানের হলে প্রত্যেক রমজানের জন্য এক একটি করে কাফফারা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুখতার: ৩/৩)


রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ:

১. ইচ্ছা করে বমি করা
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে
৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
৯. মুখ ভরে বমি করলে
১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে
১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে
১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।


যেসব কারনে রোজা কাজা করতে হয়:
১. ইচ্ছা করে বমি করা,
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা,
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব,
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে,
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে,
৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে,
৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে,
৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে,
৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে,
১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে,
১১. মুখ ভরে বমি করলে,
১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে,
১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে,
১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে,
১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে,
১৬. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে,
১৭. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে।


যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।


যে সব কারণে রোজা ভাঙ্গে না/রোজার ক্ষতি হয় না:
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলা-বালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।