Close

শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩

মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী

“আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী”   জন্ম ও বাল্যকাল: পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজান, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জনাব আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ ১৯৪৪ সালের ২রা ডিসেম্বর ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলাধীন ৩নং মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের অন্তর্গত সমপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মো: মুসলিম মিয়া, মাতার নাম হাফেজা খাতুন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।   ছাত্রজীবন ও পড়াশোনা: ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দাখিল শেষ করেন ১৯৫৭ সালে ছাগলনাইয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে। বারৈয়ারহাট সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬১ সালে আলিম ও ১৯৬৪ সালে ফাজিল শেষ করেন। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করে ছাত্রজীবন শেষ করেন। বক্তারমুন্সী ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম হুজুর দাদার ক্লাসমেট ছিলেন। দাদার হাতের লিখা ছিলো খুবই চমৎকার।   কর্মজীবন ও অবসর: পাকিস্তান আমলে দাদা সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসিবে। শিক্ষকতা করাকালীন সময়ে লজিং ছিলেন মানিকছড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেখানকার ছোট-বড় সকলেরই প্রিয়ভাজন ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। দীর্ঘ প্রায় এত বছর পরেও দাদার ছাত্র-ছাত্রীরা দাদাকে কখনো ভুলেননি। বিশেষ করে দাদার দুই ছাত্রী শাহনাজ আন্টি ও রোকেয়া আন্টি দাদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সুদুর খাগড়াছড়ি থেকে উনাদের পিতৃতুল্য প্রিয় স্যারকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। অসুস্থ থাকাকালীনও এসে দাদাকে দেখে গিয়েছিলেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। কর্মজীবন শেষ করে অবসর সময়ে দাদা বাড়িতে নিয়মিত কৃষি কাজে সময় দিতেন ও গরু পালন করতেন। অলস সময় কাটাতেন না, অবসরে কুরআন তিলাওয়াত ও বিভিন্ন বইপুস্তকে মনোনিবেশ করতেন।   অনাড়ম্বর জীবন যাপন: ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। মার্জিত ব্যবহার এবং হাসিমাখা মুখখানি দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি চলে আসে। সদা-সর্বদা সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার আশ্চর্য এক অনুপম গুণাবলির সমাহার ছিলেন। ছোট-বড় সবাইকে তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। লজ্জাশীলতা ও সহনশীলতা ছিলো অতুলনীয়! দাদা সবসময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পাগড়ী পরিধান করতেন, জামাকাপড় ছিলো সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। ৭৫+ বছর বয়সে এসেও দাদা নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন চশমা ছাড়া। সুস্থ সাবলীল ভাবেই চলাফেরা করতেন। এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি ছিলেন দাদা। এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই দাদাকে সমীহ করতেন। রাস্তায় সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। নিজের কাজ সবসময় নিজেই করার চেষ্টা করতেন। আমাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত টিভি চলা তো দূরের কথা, কোনদিন গানের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। দাদা সবসময় জাঁকজমকপূর্ণতা পরিহার করে চলতেন। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে লাইটিং করা বা অতিরিক্ত সাজসজ্জা পছন্দ করতেন না। এসবের বিষয়ে তিনি বলতেন, 'এরকম কিছু করার চেষ্টা করলে আমি থাকবো না, বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাবো।' দাদার সামনে আব্বু-কাকাদেরকে কখনো উঁচু আওয়াজে কথা বলতে দেখিনি।   পরহেজগারিতা: দাদা খুবই মুখলিস, পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পরই ২০০২ সালে হজ্জ করেন। দাদাকে জীবদ্দশায় কোনদিনও নামাজ ক্বাজা করতে দেখিনি। সবসময় চেষ্টা করতেন জামায়াতে তাকবীরে উলার সাথে নামাজ আদায় করার। আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদ একটু দূরে হওয়ায় শেষ বয়সে এসে নিয়মিত মসজিদে যেতে দাদার কষ্ট হয়ে যেতো। সেজন্য বাড়ির দরজায় দাদার দান করা জমিতে ২০১৯ সালে দাদার নামে পাঞ্জেগানা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রেইন স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কখনো সজ্ঞানে নামাজ ক্বাজা করেননি। শেষ সময়ে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও তিনি অসংখ্যবার নামাজ পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। হাসপাতালে থাকাবস্থায় প্রায়ই বলতেন, 'আরমান আমাকে অজু করিয়ে দাও, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।' অথচ তখন তিনি নিজের শক্তিতে এপাশ-ওপাশ হওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিলেন না।   সুস্থ থাকাবস্থায় তিনি প্রতি রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। জুম'আর দিন নামাজের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। হাঁটতে-চলতে, কাজে-কর্মে সবসময়ই মুখে জিকির লেগে থাকতো। মৃত্যুশয্যায় তিনি প্রায়ই সশব্দে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়তেন, এবং বলতেন 'সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার হচ্ছে গুনাহ মাফের সর্দার, তোমরা এটা সবসময় পড়বে।' দাদার খাওয়া-দাওয়া ছিল পরিমিত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতেন না। তিনি বলতেন, ‘বেশী খেলে এগুলোর হিসাব ‍দিবো কিভবে?’ দাদা কখনো দাঁড়িয়ে পানি পান করতেন না। যে কোন খাবার শুরুর পূর্বে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে তারপর খেতেন। খাওয়ার শেষেও সশব্দে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়তেন। দাদা কখনো ছবি তুলতেন না। হায়াতের শেষ দিকে এসে সামান্য কিছু ছবি ছাড়া দাদার আর খুব বেশী ছবি নেই।   পারিবারিক জীবন: পারিবারিক জীবনে দাদা ছিলেন সফল একজন অভিভাবক, তিনি ছিলেন পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা। ছেলে ও মেয়ের ঘরের প্রায় ২৬ জন নাতি-নাতনী রেখে গেছেন। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে তিনি ইসলাম শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইসলামী জীবনধারায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেছেন। দাদা ইসলাম পালনের বিষয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। সবাইকে ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতেন এবং সর্বদা দ্বীনি আন্দোলনে শামিল থাকতে উৎসাহিত করতেন। দাদা নিজেও ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। যখনই বাড়িতে যেতাম, তিনি আগে সাংগঠনিক কাজকর্ম কেমন চলছে খোঁজখবর নিতেন। জানাযায় আগত মুসল্লী বৃন্দ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, দাদার প্রত্যেক সন্তানকে তিনি মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বড় নাতি হিসেবে দাদাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও দাদার সান্নিধ্যে থেকে অনেক কিছু শিখার সুযোগ হয়েছে, যা জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে আমরণ কাজে লাগবে।   সমাজসেবা: দাদা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে দেখিনি, যতটুকু পারতেন সামর্থ্যের আলোকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আত্মীয়-প্রতিবেশী সবার খোঁজখবর রাখতেন এবং সবার জন্য দু’আ করতেন। কারো মৃত্যুর সংবাদ পেলে জানাযায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন।   অসুস্থতা: দাদা ছিলেন অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী। দীর্ঘদিন যাবৎ কাশি সমস্যায় ভুগছিলেন, অনেক চিকিৎসার পরও তা সমাধান করা যায়নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দাদার ডান চোখের ছানি অপারেশন করে লেন্স বসানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে দাদার চিকিৎসার কাজে দাদার সাথেই অনেক জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে, দাদাকে কখনোই অধৈর্য্য বা পেরেশান হতে দেখিনি। ব্রেইন ষ্ট্রোক: ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ইং দুপুর ১২টায় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পাই, দাদা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। ডাক্তার জানালেন ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ফেনীতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা নিয়ে যাওয়ার। রাতে দাদাকে নিয়ে ভর্তি করালাম ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। পাঁচদিনের চিকিৎসা শেষে অবস্থা উন্নতি হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে শিফট করি।   ১৭ মার্চ পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে। দ্রুত ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসলে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডাক্তার তাৎক্ষনিক সিসিইউতে ভর্তি করে। তিনদিন সিসিইউতে থাকার পর অবস্থা একটু উন্নতি হলে কেবিনে শিফট করা হয়। ২২ তারিখ বিকেলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেদিন নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আলাউদ্দিন স্যারের সিরিয়াল দিয়েও অল্প সময়ের জন্য না দেখাতে পারার আফসোফটা থেকে যাবে!  "ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালের সিসিইউতে শয্যাশায়ী অবস্থায় দাদা"   রমজানের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় ফেনীতে নিউরোমেডিসিন ডাক্তার দেখানো হয়। সেটাই ছিলো শেষ ডাক্তার দেখানো। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।   দাদার অসুস্থতার খবর শুনে দেশ-বিদেশ থেকে দাদার অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী/শুভানুধ্যায়ীরা নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দাদাকে দেখতে আসেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি, দাগনভূঞা-সোনাগাজী উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব ডাঃ ফখরুদ্দিন মানিক ভাই।   দাদার সাথে আমার শেষ কথোপকথন: আমি: দাদা! সকালে প্রোগ্রাম আছে, আমি ফেনী চলে যাচ্ছি। দাদা: আল্লাহর হাওলা, ফি আমানিল্লাহ। সাবধানে থাকিও, আমার জন্য দোয়া করিও। আমি: ঠিক আছে দাদা! আমার জন্যও দোয়া করবেন, ফি আমানিল্লাহ।   শেষ বিদায়: দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস শয্যাশায়ী থাকার পর ০৮ই এপ্রিল ২০২৩ইং রোজ সোমবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে দাদা দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান রবের দরবারে পাড়ি জমান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে দাদার বয়স ছিলো প্রায় ৮০ বছর।   "দাদার জানাযায় উপস্থিতির একাংশ" জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি ও চোখের পানিই প্রমাণ করে, দল-মত নির্বিশেষে দাদা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা সেক্রেটারী, ফেনী আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসার সম্মানিত ফকীহ জনাব মুফতী আবদুল হান্নান হুজুর।   দুনিয়ার জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য শুভাকাংক্ষী, শুভানুধ্যায়ী ও গভীর রজনীতে সিজদাবনত চিত্তে উনার নাম ধরে দু’আ করার মতো একঝাঁক পরিবার-পরিজন, নাতি-নাতনী ও অগণিত আত্মীয়-স্বজন।   আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজানের জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন, উনার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরন করে আমাদেরকে বাকি জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দিন, দুনিয়ার জীবনের সকল ভালো কাজ ও নেক আমলকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে পরকালীন জীবনে নাজাতের উছিলা হিসেবে কবুল করে নিন, আমীন।   দু'আ কামনায়- ইমাম হোসেন আরমান, দাদার বড় নাতি(ছেলের ঘরের)।

“আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী”

•জন্ম ও বাল্যকাল:
পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজান, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জনাব আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ ১৯৪৪ সালের ২রা ডিসেম্বর ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলাধীন ৩নং মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের অন্তর্গত সমপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মো: মুসলিম মিয়া, মাতার নাম হাফেজা খাতুন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

•ছাত্রজীবন ও পড়াশোনা:
ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দাখিল শেষ করেন ১৯৫৭ সালে ছাগলনাইয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে। বারৈয়ারহাট সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬১ সালে আলিম ও ১৯৬৪ সালে ফাজিল শেষ করেন। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করে ছাত্রজীবন শেষ করেন। বক্তারমুন্সী ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম হুজুর দাদার ক্লাসমেট ছিলেন। দাদার হাতের লিখা ছিলো খুবই চমৎকার। 

•কর্মজীবন ও অবসর:

পাকিস্তান আমলে দাদা সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসিবে। শিক্ষকতা করাকালীন সময়ে লজিং ছিলেন মানিকছড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেখানকার ছোট-বড় সকলেরই প্রিয়ভাজন ছিলেন।
২০০১ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। দীর্ঘ প্রায় এত বছর পরেও দাদার ছাত্র-ছাত্রীরা দাদাকে কখনো ভুলেননি। বিশেষ করে দাদার দুই ছাত্রী শাহনাজ আন্টি ও রোকেয়া আন্টি দাদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সুদুর খাগড়াছড়ি থেকে উনাদের পিতৃতুল্য প্রিয় স্যারকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। অসুস্থ থাকাকালীনও এসে দাদাকে দেখে গিয়েছিলেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন।
কর্মজীবন শেষ করে অবসর সময়ে দাদা বাড়িতে নিয়মিত কৃষি কাজে সময় দিতেন ও গরু পালন করতেন। অলস সময় কাটাতেন না, অবসরে কুরআন তিলাওয়াত ও বিভিন্ন বইপুস্তকে মনোনিবেশ করতেন। 

•অনাড়ম্বর জীবন যাপন:
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। মার্জিত ব্যবহার এবং হাসিমাখা মুখখানি দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি চলে আসে। সদা-সর্বদা সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার আশ্চর্য এক অনুপম গুণাবলির সমাহার ছিলেন। ছোট-বড় সবাইকে তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। লজ্জাশীলতা ও সহনশীলতা ছিলো অতুলনীয়! দাদা সবসময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পাগড়ী পরিধান করতেন, জামাকাপড় ছিলো সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।
৭৫+ বছর বয়সে এসেও দাদা নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন চশমা ছাড়া। সুস্থ সাবলীল ভাবেই চলাফেরা করতেন। এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি ছিলেন দাদা। এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই দাদাকে সমীহ করতেন।
রাস্তায় সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। নিজের কাজ সবসময় নিজেই করার চেষ্টা করতেন।
আমাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত টিভি চলা তো দূরের কথা, কোনদিন গানের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। দাদা সবসময় জাঁকজমকপূর্ণতা পরিহার করে চলতেন। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে লাইটিং করা বা অতিরিক্ত সাজসজ্জা পছন্দ করতেন না। এসবের বিষয়ে তিনি বলতেন, 'এরকম কিছু করার চেষ্টা করলে আমি থাকবো না, বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাবো।'
দাদার সামনে আব্বু-কাকাদেরকে কখনো উঁচু আওয়াজে কথা বলতে দেখিনি।

•পরহেজগারিতা
দাদা খুবই মুখলিস, পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পরই ২০০২ সালে হজ্জ করেন। দাদাকে জীবদ্দশায় কোনদিনও নামাজ ক্বাজা করতে দেখিনি। সবসময় চেষ্টা করতেন জামায়াতে তাকবীরে উলার সাথে নামাজ আদায় করার।
আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদ একটু দূরে হওয়ায় শেষ বয়সে এসে নিয়মিত মসজিদে যেতে দাদার কষ্ট হয়ে যেতো। সেজন্য বাড়ির দরজায় দাদার দান করা জমিতে ২০১৯ সালে দাদার নামে পাঞ্জেগানা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ব্রেইন স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কখনো সজ্ঞানে নামাজ ক্বাজা করেননি। শেষ সময়ে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও তিনি অসংখ্যবার নামাজ পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। হাসপাতালে থাকাবস্থায় প্রায়ই বলতেন, 'আরমান আমাকে অজু করিয়ে দাও, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।' অথচ তখন তিনি নিজের শক্তিতে এপাশ-ওপাশ হওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিলেন না।

সুস্থ থাকাবস্থায় তিনি প্রতি রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। জুম'আর দিন নামাজের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। হাঁটতে-চলতে, কাজে-কর্মে সবসময়ই মুখে জিকির লেগে থাকতো। মৃত্যুশয্যায় তিনি প্রায়ই সশব্দে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়তেন, এবং বলতেন 'সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার হচ্ছে গুনাহ মাফের সর্দার, তোমরা এটা সবসময় পড়বে।'
দাদার খাওয়া-দাওয়া ছিল পরিমিত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতেন না। তিনি বলতেন, ‘বেশী খেলে এগুলোর হিসাব ‍দিবো কিভবে?’ দাদা কখনো দাঁড়িয়ে পানি পান করতেন না। যে কোন খাবার শুরুর পূর্বে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে তারপর খেতেন। খাওয়ার শেষেও সশব্দে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়তেন।
দাদা কখনো ছবি তুলতেন না। হায়াতের শেষ দিকে এসে সামান্য কিছু ছবি ছাড়া দাদার আর খুব বেশী ছবি নেই।

•পারিবারিক জীবন:
পারিবারিক জীবনে দাদা ছিলেন সফল একজন অভিভাবক, তিনি ছিলেন পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা। ছেলে ও মেয়ের ঘরের প্রায় ২৬ জন নাতি-নাতনী রেখে গেছেন।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে তিনি ইসলাম শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইসলামী জীবনধারায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেছেন। দাদা ইসলাম পালনের বিষয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। সবাইকে ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতেন এবং সর্বদা দ্বীনি আন্দোলনে শামিল থাকতে উৎসাহিত করতেন।
দাদা নিজেও ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। যখনই বাড়িতে যেতাম, তিনি আগে সাংগঠনিক কাজকর্ম কেমন চলছে খোঁজখবর নিতেন।
জানাযায় আগত মুসল্লী বৃন্দ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, দাদার প্রত্যেক সন্তানকে তিনি মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
বড় নাতি হিসেবে দাদাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও দাদার সান্নিধ্যে থেকে অনেক কিছু শিখার সুযোগ হয়েছে, যা জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে আমরণ কাজে লাগবে।

•সমাজসেবা:
দাদা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে দেখিনি, যতটুকু পারতেন সামর্থ্যের আলোকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আত্মীয়-প্রতিবেশী সবার খোঁজখবর রাখতেন এবং সবার জন্য দু’আ করতেন। কারো মৃত্যুর সংবাদ পেলে জানাযায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন।

•অসুস্থতা:
দাদা ছিলেন অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী। দীর্ঘদিন যাবৎ কাশি সমস্যায় ভুগছিলেন, অনেক চিকিৎসার পরও তা সমাধান করা যায়নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দাদার ডান চোখের ছানি অপারেশন করে লেন্স বসানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে দাদার চিকিৎসার কাজে দাদার সাথেই অনেক জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে, দাদাকে কখনোই অধৈর্য্য বা পেরেশান হতে দেখিনি।
ব্রেইন ষ্ট্রোক: ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ইং দুপুর ১২টায় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পাই, দাদা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। ডাক্তার জানালেন ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ফেনীতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা নিয়ে যাওয়ার। রাতে দাদাকে নিয়ে ভর্তি করালাম ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। পাঁচদিনের চিকিৎসা শেষে অবস্থা উন্নতি হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে শিফট করি।

১৭ মার্চ পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে। দ্রুত ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসলে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডাক্তার তাৎক্ষনিক সিসিইউতে ভর্তি করে। তিনদিন সিসিইউতে থাকার পর অবস্থা একটু উন্নতি হলে কেবিনে শিফট করা হয়। ২২ তারিখ বিকেলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেদিন নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আলাউদ্দিন স্যারের সিরিয়াল দিয়েও অল্প সময়ের জন্য না দেখাতে পারার আফসোফটা থেকে যাবে!


"ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালের সিসিইউতে শয্যাশায়ী অবস্থায় দাদা"

রমজানের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় ফেনীতে নিউরোমেডিসিন ডাক্তার দেখানো হয়। সেটাই ছিলো শেষ ডাক্তার দেখানো। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

দাদার অসুস্থতার খবর শুনে দেশ-বিদেশ থেকে দাদার অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী/শুভানুধ্যায়ীরা নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দাদাকে দেখতে আসেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব ডাঃ ফখরুদ্দিন মানিক ভাই।

•দাদার সাথে আমার শেষ কথোপকথন:
আমি: দাদা! সকালে প্রোগ্রাম আছে, আমি ফেনী চলে যাচ্ছি।
দাদা: আল্লাহর হাওলা, ফি আমানিল্লাহ। সাবধানে থাকিও, আমার জন্য দোয়া করিও।
আমি: ঠিক আছে দাদা! আমার জন্যও দোয়া করবেন, ফি আমানিল্লাহ।

•শেষ বিদায়:
দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস শয্যাশায়ী থাকার পর ০৮ই এপ্রিল ২০২৩ইং রোজ সোমবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে দাদা দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান রবের দরবারে পাড়ি জমান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন।
মৃত্যুকালে দাদার বয়স ছিলো প্রায় ৮০ বছর।

"দাদার জানাযায় উপস্থিতির একাংশ"

জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি ও চোখের পানিই প্রমাণ করে, দল-মত নির্বিশেষে দাদা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা সেক্রেটারী, ফেনী আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসার সম্মানিত ফকীহ জনাব মুফতী আবদুল হান্নান হুজুর।

দুনিয়ার জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য শুভাকাংক্ষী, শুভানুধ্যায়ী ও গভীর রজনীতে সিজদাবনত চিত্তে উনার নাম ধরে দু’আ করার মতো একঝাঁক পরিবার-পরিজন, নাতি-নাতনী ও অগণিত আত্মীয়-স্বজন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজানের জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন, উনার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরন করে আমাদেরকে বাকি জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দিন, দুনিয়ার জীবনের সকল ভালো কাজ ও নেক আমলকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে পরকালীন জীবনে নাজাতের উছিলা হিসেবে কবুল করে নিন, আমীন।

দু'আ কামনায়-
ইমাম হোসেন আরমান,
দাদার বড় নাতি(ছেলের ঘরের)

4 Comments:

Unknown বলেছেন...

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উনার জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন, আমীন।

ROBI ZONE বলেছেন...

হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রিয়জন (নানা)কে জান্নাতের সুউচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত রেখো,আমীন।

Bibi Julaikha বলেছেন...

আল্লাহ নানার সমস্ত নেক আমল কবুল করে নিয়ে,নানাকে জান্নাতবাসী করুক।����

Imran Hossain বলেছেন...

আল্লাহ তুমি আমার দাদাভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে দিন আমিন