Close

Thursday, May 22, 2025

দারসুল কুরআন || সুরা আন নাবা (৩৮-৪০নং আয়াত) || শেষ বিচার দিবসের ভয়াবহ চিত্র

দারসুল কুরআন || সুরা আন নাবা (৩৮-৪০নং আয়াত) || শেষ বিচার দিবসের ভয়াবহ চিত্র
আরবী ইবারত:

يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفࣰّاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ  ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابࣰا 

ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَآبًا 

إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابࣰا قَرِيبࣰا يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ وَيَقُولُ   ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا

সরল অনুবাদ:

(৩৮) সেদিন রূহ (জিবরাঈল) আর ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, কেউ কোন কথা বলতে পারবে না, সে ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন, আর সে যথার্থ কথাই বলবে।

(৩৯) এ দিনটি সত্য, সুনিশ্চিত, অতএব যার ইচ্ছে সে তার প্রতিপালকের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করুক।

(৪০) আমি তোমাদেরকে নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি, যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাতগুলো আগেই কী (‘আমাল) পাঠিয়েছে আর কাফির বলবে- ‘হায়! আমি যদি মাটি হতাম (তাহলে আমাকে আজকের এ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হত না)।

•সূরাটির নামকরণ: অত্র সূরার ২য় আয়াত عَنِ النَّبَلِ الْعَظِيمِ থেকে (النَّبَأ) শব্দটিকে এই সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। النَّبَأ শব্দের অর্থ সংবাদ বা খবর। অর্থাৎ কেয়ামত ও পরকালের মহা খবরকে বোঝানো হয়েছে। অন্যান্য সূরার মতো এই সূরার নামকরণ কেবলমাত্র পরিচিতি বা চেনার জন্যই নয় বরং এই সূরার আলোচ্য বিষয়ের শিরোনামও বটে। কেননা এই সূরার সমস্ত আলোচনাই কেয়ামত ও পরকাল সম্পর্কিত।

•সূরাটি নাযিল হবার সময়কালঃ সূরা কেয়ামাহ্ থেকে সূরা নাযিয়াত পর্যন্ত সব কয়টি সূরার বিষয়বস্তু প্রায় একই রকমের। আর এই সব কয়টি সূরা-ই রাসূলে করীম (সাঃ) এর মক্কী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছে বলে মনে হয়। সুতরাং এই সূরাটিও নবুয়াত লাভের প্রথম দিকের 'মাক্কী সূরা'।

•সূরাটির মূল বিষয়বস্তুঃ আলোচ্য সূরাটির মূল বিষয়বস্তু হলো কেয়ামত ও পরকালের প্রমাণ এবং তা মানা না মানার পরিণতি সম্পর্কে লোকদেরকে অবহিত করা।

শানে নূযুলঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আল-কুরআন নাযিল শুরু হলে মক্কার কাফেরেরা তাদের বৈঠকে বসে এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতো যে, কুরআনে কেয়ামত অর্থাৎ আখেরাতের আলোচনাকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ এটা তাদের মতে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। তাই এ সম্পর্কে খুব বেশী বেশী আলোচনা-পর্যালোচনা চলতো। কেউ কেউ একে সত্য মনে করতো, আর কেউ একে অস্বীকার করতো। তাই আল্লাহ্ পাক হাশরের দিবস ও ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আলোচ্য আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। 


আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা:

আয়াত : ৩৮

يَوْمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلْمَلَٰٓئِكَةُ صَفࣰّاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَٰنُ وَقَالَ صَوَابًا

বাংলা অনুবাদ:

“সেদিন ‘রূহ’ (জিবরাঈল) ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। কেউ কথা বলতে পারবে না, কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দেবেন এবং সে সঠিক কথাই বলবে।”

ব্যাখ্যা:

1. ‘রূহ’ ও ‘মালায়েকাহ্‌ – এখানে “রূহ” বলতে অধিকাংশ মুফাসসির (যেমন, ইবন কাসীর, কুরতুবী) জিবরাঈল (আ.)-কে বুঝিয়েছেন। তার মর্যাদা ও গুরুত্বের কারণে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআনে জিবরাঈলকে “روح الأمين” (বিশ্বস্ত রূহ) বলা হয়েছে (সূরা আশ-শু'আরা, ২৬:১৯৩)।

2. সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো – ফেরেশতারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, যা তাঁর জাঁকজমক ও মহিমা প্রদর্শন করে (সূরা ফজর ৮৯:২২-২৩)।

3. কথা বলার অনুমতি – কিয়ামতের দিন কাউকে কথা বলার অনুমতি থাকবে না, একমাত্র আল্লাহ যাকে দিবেন।

যেমন বলা হয়েছে, "يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَيْئًا" (সূরা ইনফিতার, ৮২:১৯)।

আর সে অনুমতি পাওয়া লোকটি সঠিক কথা বলবে – অর্থাৎ সাক্ষ্য দিবে ন্যায়ের পক্ষে, যেমন নবী, সিদ্দিক, শহীদ, বা নেক বান্দারা।

4. হাদীস রেফারেন্স:

হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন মানুষ বলবে: "نَفْسِي نَفْسِي" (আমার জান, আমার জান)। কেবল রাসূল (সা.) বলবেন: "أُمَّتِي أُمَّتِي" (আমার উম্মত, আমার উম্মত)। (সহীহ মুসলিম)


আয়াত : ৩৯

ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَـَٔابًا

বাংলা অনুবাদ:

“এ দিনটি সত্য ও সুনিশ্চিত। অতএব, যার ইচ্ছে সে তার প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাওয়ার পথ অবলম্বন করুক।”

ব্যাখ্যা:

1. يَوْمُ الحَقّ – কিয়ামতের দিন কোনো কল্পনা বা অনুমান নয়, বরং একেবারে নিশ্চিত বাস্তবতা। কুরআনে একে "يَوْمُ الْوُعُودِ" (প্রতিশ্রুত দিবস) হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে (সূরা ক্বাফ, ৫০:২০)।

2. মা’আব গ্রহণ – “মা’আব” অর্থ: ফিরে যাওয়ার স্থান বা আশ্রয়। এখানে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন থেকে রক্ষা পেতে চাইলে এখনই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও (তাওবা, ইবাদত, সৎকর্ম)।

3. হাদীস রেফারেন্স:

রাসূল (সা.) বলেন: “দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।” (শু‘আবুল ঈমান, বাইহাকি)

যার ইচ্ছা সে এখনই আমল করে জান্নাতের আশ্রয় লাভ করতে পারে।


আয়াত : ৪০

إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابࣰا قَرِيبࣰا يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا

বাংলা অনুবাদ:

“আমি তোমাদেরকে এক নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি। যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাত কী প্রেরণ করেছে, আর কাফির বলবে: হায়, আমি যদি মাটি হতাম!”

ব্যাখ্যা:

1. নিকটবর্তী শাস্তি – এটি দুনিয়ার শাস্তি, মৃত্যু, কবর অথবা কিয়ামতের সূচনা – সবই ঘনিয়ে আসছে।

কুরআনেও বলা হয়েছে: "اقتربت الساعة" – “সময় ঘনিয়ে এসেছে” (সূরা ক্বামার, ৫৪:১)।

2. নিজ আমল দেখবে – প্রত্যেক মানুষ তার নিজের হাত দ্বারা প্রেরিত (আমলনামা) দেখতে পাবে।

সূরা যিলযাল ৯৯:৭-৮ – “যে অণু পরিমাণ ভাল কাজ করেছে, তা সে দেখতে পাবে…”

3. কাফিরদের অনুশোচনা – তারা এত ভয়ানক শাস্তি দেখে বলবে: “হায়, আমি যদি শুধু মাটিই হতাম!”

ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, কাফির তখন পশুদের মতো নিস্তব্ধ অস্তিত্ব কামনা করবে, যারা হাশরে উঠলেও শাস্তি পাবে না।

4. হাদীস রেফারেন্স: হাদীসে আছে: কিয়ামতের দিন পশুরাও বিচার পাবে, তারপর মাটিতে পরিণত হবে। তখন কাফির বলবে: "হায়! আমি যদি পশু হতাম!" (মুসলিম: ৪/২১৯৭)


দারসের শিক্ষা:

1. কিয়ামতের দিন একটি সুনিশ্চিত বাস্তবতা – সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এটি আসবেই।
2. আল্লাহর সামনে জবাবদিহির দিন হবে খুবই ভয়াবহ – এমনকি ফেরেশতারাও বিনা অনুমতিতে কিছু বলবে না।
3. কেয়ামতের দিনে কেবল আল্লাহর অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কথা বলবে – এবং তারা কেবল ন্যায়ের কথা বলবে।
4. জবাবদিহির জন্য প্রতিটি আমল সংরক্ষিত হচ্ছে – মানুষ তার জীবনে যা করেছে, কিয়ামতের দিন তা তার সামনে পেশ করা হবে।
5. আল্লাহর দিকে ফিরে আসার এখনই সময় – কিয়ামতের আগেই তাওবা, ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে "মা'আব" (আশ্রয়স্থল) গ্রহণ করতে হবে।
6. আফসোসে কোনো লাভ হবে না – কাফিররা কিয়ামতের দিনে বলবে, “হায়, আমি যদি মাটি হতাম!” কিন্তু তখন তা কোনো কাজে আসবে না।
7. বিশ্বাস ও সৎকর্মই চূড়ান্ত পরিত্রাণের পথ – দুনিয়ার মোহে বিভ্রান্ত না হয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
8. আল্লাহর সতর্কবার্তা অবহেলা নয়, গ্রহণের যোগ্য – এই আয়াতগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আগাম সতর্কবার্তা।

0 Comments: