Close

মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান - একটি ফুটন্ত গোলাপের অকালে ঝরে পড়া : কিছু বেদনা-বিধুর স্মৃতি || জাহেদ হোসাইন

শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান
একটি ফুটন্ত গোলাপের অকালে ঝরে পড়া : কিছু বেদনা-বিধুর স্মৃতি
-জাহেদ হোসাইন

একদিন পর দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের প্রচারাভিযান প্রায় শেষের দিকে। তবে বাড়ছে টান টান উত্তেজনা। মাগরিবের নামাজ জামায়াতে আদায় করে কুমিল্লা বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন শুভাকাংখীসহ কথা বলছিলাম। পকেটে রাখা মোবাইল বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি পরিচিত নাম্বার। নাম্বারটা মোবাইলের কল লিষ্টে সেইভ করা আছে। রিসিভ করতেই অপরিচিত কন্ঠস্বর। একটু ঘাবড়ে গেলাম। প্রথমে ওপাশ থেকে আসা কথাগুলো অস্পষ্ট মনে হলো। কিন্তু বুঝতে দেরী হলো না। খবরটা শুনার সাথে সাথে কলিজার ভিতরটায় কেউ যেন খামছে ধরলো। মুহুর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো। আমার পাশে দাঁড়ানো ভাইটি জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার, কি হলো?”
-সোনাগাজী সাথী শাখার সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান ভাই মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করেছেন।
-তো এখন?
-পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছে। তারাই আমাকে ফোন করেছে। 

এদিকে আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে খবর নিতে লাগলাম দূর্ঘটনা কতটুকু মারাত্মক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার যথার্থ চিকিৎসা হবে কিনা ইত্যাদি। অবশেষে সিদ্ধান্ত দিলাম ফেনী নিয়ে আসতে। কিছুক্ষনের মধ্যে ভাইকে ফেনীর প্রাইভেট হাসপাতাল কসমোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। সি এন জি থেকে ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ঢুকানো হল। দেখলাম ভাইয়ের বাম পায়ের উরুর অংশে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছেন। ধারনা করলাম সেটির হাড় ভেঙ্গে গেছে। নাকে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন এবং প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। ডাক্তার জানালেন, যেহেতু মাথায় কোন আঘাত পাননি এবং বমি করেননি এমতাবস্থায় আমরা আজকে রাত এখানে পর্যবেক্ষনে রাখতে পারি। আমি সায় দিলাম। এক্স-রে করার পর যখন দেখলাম ভাইয়ের উরুর হাড় ভেঙ্গে গেছে এবং নাকের নরম হাড় ভেঙ্গে প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে, আমি চিন্তা করলাম আজকে রাত এখানে থাকলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠিয়ে দিবো।

এদিকে উন্নত চিকিৎসা করার জন্য ঢাকা নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করলে ডাক্তার আমাকে জানালেন, “উনার পা অপারেশনের পূর্বে আপাতত আমরা এখানে সাধারন প্লাষ্টার করে দিই। পরে আপনারা কাল বিলম্ব না করে এখনই ঢাকায় নিয়ে যান সমস্যা নেই”। দায়িত্বশীলদেরকে খবরটা দিলাম এবং যত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভাইকে অপারেশন তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরন হচ্ছে দেখে ডাক্তার বললেন এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করতে। মুহুর্তেই কয়েক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হলো। আমি ছিলাম অপারেশন থিয়াটারের বাহিরে। কে একজন খবর দিলেন ভাই আপনাকে ডাক্তার খোঁজ করেছেন। দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখি ভাই বমি করেছেন। ডাক্তার গালিব ভাই ও কিছুটা উদ্বিগ্ন। আমাকে বললেন, “ভাই আমার মনে হয় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না”। আমি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম ভাইকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়ার। তখন রাত প্রায় ১টা। জেলা সেক্রেটারী মোজাম্মেল হোসেন ভাইকে ফোন দিলাম, ভাই তাড়াতাড়ি কিছু টাকাসহ ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালের দিকে আসুন। ইতিমধ্যে ঢাকা যাওয়ার জন্য ১টা এ্যম্বুলেন্স ভাড়া করলাম। ঢাকা পাঠিয়ে দেয়ার কথা শুনে মুস্তাফিজ ভাইয়ের বোন, ভগ্নিপতি ও চাচা সবাই তাকে এক নজর দেখতে আসলো। উনারা কি জানতেন এটাই তাঁর সাথে শেষ দেখা? রাত প্রায় ২টার দিকে এ্যাম্বুলেন্স ছাড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। সাথে জেলা সেক্রেটারী ছাড়াও মুস্তাফিজ ভাইয়ের বোন, ভগ্নিপতি ছিলেন। কিছুটা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করছিলাম এ ভেবে যে, ভাইকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠাতে পারলাম। জেলা সাহিত্য সম্পাদক ওসমান গনি আরিফ ভাই ও জেলা স্কুল সম্পাদক ওমর ফারুক ভাই সহ বাসায় ফিরলাম। ভাইয়ের আশু সুস্থতার জন্য আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করলাম । ফজরের পর যখন মোজাম্মেল ভাইকে ফোন দিলাম তখন তিনি বললেন, “আমরা সবে মাত্র হাসপাতালে ঢুকছি । সকাল ৮টায় আবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম উনার মাথার সি.টি স্ক্যান করা হয়েছে। কিন্তু কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। এ কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম ।

এ দিকে ফাঁকে ফাঁকে মোজাম্মেল ভাইকে ফোন দিয়ে বার বার মুস্তাফিজ ভাইয়ের চিকিৎসার খোজ খবর নিচ্ছি। মোজাম্মেল ভাই জানালেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের অবস্থা ভাল আছে এবং মাঝে মাঝে মুস্তাফিজ ভাই তাদের সাথে কথাও বলছেন। বেলা ৩.০০ টার দিকে মোজাম্মেল ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন মুস্তাফিজ ভাই আপনার সাথে কথা বলতে চান। আমি বললাম উনি অসুস্থ কথা বলার দরকার কি? মোজাম্মেল ভাই বললেন আমিও নিষেধ করেছি। কিন্তু উনি বার বার চাচ্ছেন আপনার সাথে কথা বলতে, আমি বললাম ঠিক আছে, উনাকে দিন। মুস্তাফিজ ভাই প্রথমে আমাকে সালাম দিয়ে জানতে চাইলেন আমি কেমন আছি? আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভাই আমি ভাল আছি। আপনি অসুস্থ তাই আপনাকে আমি ফোন করছিনা। মোজাম্মেল ভাইকে ফোন করে আপনার খোঁজ খবর নিচ্ছি।

এরপর মুস্তাফিজ ভাই যা বললেন তা আজও আমার কানে বাজে .... : ভাই আমার শাখাটার খোঁজ খবর নিয়েন।
- কি বলেন ভাই, আপনার শাখার খোঁজ খবর সব সময় আমি নিচ্ছি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
: ভাই আমার হেদায়েত ভাইকে (শাখা সেক্রেটারী) একটু ফোন দিয়েন, তার খোঁজ খবর নিয়েন ।
: আপনি এতো চিন্তা করবেন না ভাই, আমি সার্বক্ষনিক তাদের খোঁজ খবর রাখছি। আজকে দিনে হেদায়েত ভাইর সাথে অন্তত তিন-চার বার কথা হয়েছে। আপনার সাথে আর বেশী কথা বলবোনা। আপনি আগে সুস্থ হোন তারপর আপনার সাথে সব কথা বলা যাবে। এই বলে আমি ফোন রেখে দিলাম। নিয়তির নির্মম পরিহাস, কে জানতো এটাই আমার করলাম ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা।

সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ, তাদের পেটুয়া বাহিনী ও পুলিশলীগ দিয়ে সাধারন ভোটারদের হয়রানি, আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভোট ডাকাতির মোকাবেলায় বিএনপির দূর্বলতা ও নমনীয়তা, সার্বিক বিষয়ে সাধারন ভোটারদের মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলতে বলতে রাত প্রায় ১২ টা। রাতের খাবার শেষ করে রাশেদুল হাসান রানা ভাইকে বিদায় দিয়ে প্রায় ১টার দিকে যখন বাসায় যাচ্ছি তখনো স্মৃতিতে মুস্তাফিজ ভাইয়ের কথা ভেসে উঠছে। ভাইয়ের কষ্টের বিষয়টা চিন্তা করছি। কারণ ইতিপূর্বে নিজেও একাধিক বার মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করার কারনে এটার কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমার মনে আছে।

রাতে ঘুমানোর আগে মোজাম্মেল ভাইকে ফোন দিয়ে আবার খোঁজ নিলাম। মোজাম্মেল ভাই আমাকে জানালেন রাতে মুস্তাফিজ ভাইয়ের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আমি উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাস করলাম
: কি ব্যাপার, জ্বর কেন আসলো? ডাক্তার দেখাননি? ডাক্তার কি বলেছেন?
: ডাক্তার দেখে গিয়েছেন এবং জ্বর কমার ঔষধ দিয়েছেন।

ভোর পাচঁটার দিকে মোজাম্মেল ভাই আবার ফোন দিয়ে জানালেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের জ্বর আরও বেড়ে গিয়েছে এবং নিঃশ্বাস ঘন ঘন নিচ্ছেন আর মুস্তাফিজ ভাইকে আইসিইউতে নেয়া হচ্ছে। এ কথা শুনে মনের মধ্যে একটা তীব্র চাপ অনুভব করলাম। মনে হল ঘাড়ের রগটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটা মানসিক ব্যাকুলতার মধ্যে মোজাম্মেল ভাইর ফোন পাওয়ার জন্য সময় অতিবাহিত করতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর মোজাম্মেল ভাই ফোন দিলেন । ফোনে যা জানালেন সে অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত ও দুঃখজনক সংবাদ শুনার জন্য আমার কান মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। ওপাশ থেকে মোজাম্মেল ভাই ভাঙ্গা গলায় জানালেন,
: নেই, তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি...
: কি বলছেন মোজাম্মেল ভাই, এটা কিভাবে সম্ভব! ঐদিক থেকে মোজাম্মেল ভাই আর কথা বলতে পারছেন না।
আমারও নীরবে অশ্রু কপোল গড়িয়ে পড়ার টেবিলে পড়ল। নিজের মনকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে আমার মুস্তাফিজ ভাই আর নেই । তাঁর স্মৃতি গুলো মনে করে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কতো সহজ ভাবে ভাইটা আমার সাথে মিশেছিল। দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হলে কতো বকা-ঝকা করেছি। কাজ আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছি। একটা সংকটপূর্ণ ময়দানে তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু কখনো এতটুকু নালিশ করেননি । প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আমাকে একবার করে ফোন দিতেন। কোন দিন ফোন দিতে না পারলে পরদিন আবার ফোন করে অনুযোগের সুরে বলতেন “ভাই আপনি বোধ হয় আমাকে ভুলে গেছেন”। আমি সান্তনা দিতাম। নিজের ব্যস্ততার অজুহাত দেখাতাম। নিজের কানে শুনা কথা নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। প্রতিদিন একবার করে ফোন করে ভাই | বলে কে খোঁজ নিবে? একথা গুলো ভাবতে ভাবতে নোনা জলের দরিয়া যেন আমার দু-চোখে আছড়ে পড়লো । আবেগ সংবরণ করে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম।

কেন্দ্রীয় সংগঠন, এখানকার জামায়াতে ইসলামী ও সাবেক ভাইদের কে খবরটা জানালাম। স্থানীয় সংগঠন জেলা জামায়াতের সাথে পরামর্শ করে জানাযার স্থান নির্ধারন করা হল মুস্তাফিজ ভাইদের বাড়ির দরজা। সে দিন ছিল জু'মা বার। আমি, জেলা দপ্তর সম্পাদক কফিল উদ্দিন ভাই ও জেলা সাংস্কৃতিক সম্পাদক জানে আলম ভাই সহ বেলা প্রায় ১১.৩০টার দিকে যখন মুস্তাফিজ ভাইয়ের বাড়ির দরজায় গিয়ে নামলাম তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য অবলোকন করলাম। নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যাকে দেখেছি তার চোখেই পানি। শোকের বিহবলতায় অনেকটা আনমনা হয়ে যখন মুস্তাফিজ ভাইদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম তখন তার বড় দুলা ভাই বেলায়েত হোসেন ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন বললেন,

: “ভাই আমার ছোট ভাইকে কোথায় রেখে এসেছেন। আমার ছোট ভাই কই”?

বাধঁ ভাঙ্গা জোয়ারের মত চোখের পানি আর আটকাতে পারলাম না। কতক্ষন এভাবে অশ্রু গড়িয়েছে জানিনা। আবার বেলায়েত ভাইয়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়েছি। জু'মার নামাযের সময় হচ্ছে। এ দিকে কেন্দ্ৰীয় মাদ্রাসা সম্পাদক জনাব মু. মহি উদ্দিন ভাই জানাযায় অংশ গ্রহণ করার জন্য ঢাকা থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বাদ আসর তথা বিকাল ৫টা। মুস্তাফিজ ভাইয়ের মরদেহ ঢাকা থেকে তার বাড়িতে আনা হচ্ছে। মুস্তাফিজ ভাইয়ের ইন্তেকালের খবর শুনে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত শোকাহত সাথীদের তাদের পুরাতন বাড়ীতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জু'মার আগে ওনারা খাবার গ্রহনের জন্য তাড়া দিলেন। আমি দেখলাম শোকে মুহ্যমান এ ভাইয়েরা খাবার গ্রহন করার জন্য একজনও এগুচ্ছেনা। তখন কষ্ট বুকের বুকে চাপায়ে রেখে আমিই আগে গেলাম এবং বাকী ভাইয়েরা আমাকে অনুসরণ করলেন। খাবার টেবিলে বসেও চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম এবং খাচ্ছি এরকম অভিনয় করলাম। খাবারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন জু'মার নামায পড়ার নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। মুস্তাফিজ ভাইর বাড়ির দরজায় চিরচেনা মসজিদে প্রবেশ করলাম। মুস্তাফিজ ভাই কতদিন এ মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে জু'মার খুৎবাহ পড়েছেন। মুস্তাফিজ ভাই জু'মার দিন যখনি ঐ মসজিদে উপস্থিত হতেন মসজিদের বয়োবৃদ্ধ ইমাম সাহেব খুৎবাহ এবং নামাযের দায়িত্ব মুস্তাফিজ ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিতেন ।

খুৎবাহ শেষে কাতার সোজা করে নামাযের জন্য যখন দাড়ালাম এ্যম্বুলেন্স এর হর্ন শুনে বুঝতে পারলাম মুস্তাফিজ ভাইয়ের মরদেহ বাড়ীতে পৌঁছেছে।

নামায শেষ করে ইমাম সাহেব যখন দোয়ার জন্য হাত তুললেন তখন পিনপতন নীরবতার মধ্যে উপস্থিত মুসল্লিদের হু হু করে কান্নার চিৎকার শুনে বুঝতে পারলাম আমার মুস্তাফিজ ভাই দলমত নির্বিশেষে সমাজের এ সাধারন মানুষগুলোর নিকট কত প্রিয়ভাজন ছিলেন। নামায শেষ করে ভগ্ন হৃদয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যখন মুস্তাফিজ ভাইদের ঘরের সামনে গেলাম তখন দেখলাম ঘরের সামনে রাখা মুস্তাফিজ ভাই'র মৃতদেহ ঘিরে মানুষের ভীড়। সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার শব্দে পরিবেশটা ভারি হয়ে উঠলো। এ করুণ দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে রাখা টিস্যু নিয়ে বার বার চোখ মুছে আবেগের গভীরতা লুকিয়ে জনশক্তিদের বুঝানোর চেষ্টা করছি আমি খুব বেশী আবেগ আপ্লুত হইনি। কিন্তু মুস্তাফিজ ভাইর চেহারাটা একবার দেখার জন্য তার মরদেহের সামনে যেতে পারছিনা।

গতকাল ও যার সাথে কথা হয়েছে, ভেবেছি সুস্থ হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। আন্দোলনের কাজে আবারও সদা চঞ্চল ও প্রাণসঞ্চারী ভূমিকা পালন করবেন। সে মুস্তাফিজ ভাইয়ের নিথর দেহের সামনে - - যে হাসি মাখা মুখে এক চিলতে হাসি উপহার দিয়ে বলতেন ভাইয়া কেমন আছেন? আজ কিভাবে আমি স্থির হয়ে দাঁড়াবো।

মুস্তাফিজ ভাইকে এক নজর দেখার জন্য, তার জানযায় অংশ গ্রহণ করার জন্য আগত লোকের সংখ্যা ততই বাড়ছে। আসরের নামাযের পূর্বেই জানাযার নির্ধারিত স্থান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো। আগত মুসল্লীদের সংখ্যাধিক্যের কারনে মুস্তাফিজ ভাইদের বাড়ির সামনের জামে মসজিদে চার দফায় আসর নামায আদায় করতে হয়েছে। সালাতুল আসর আদায়ের পর যথারীতি জানাযা পূর্ব সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সমাবেশ পরিচালনা করেছেন জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ফখরুদ্দীন। জানাযায় উপস্থিত হয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা সম্পাদক মু. মহি উদ্দিন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিনের সভাপতি রাশেদুল হাসান রানা, জেলা জামায়াতের আমীর এ কে এম নাযেম ওসমানী ও সেক্রেটারী এ কে এম শামছুদ্দীন সহ সাবেক জেলা সভাপতিদের অনেকে। মাইকে আমার নাম ঘোষণা করে মুস্তাফিজ ভাইয়ের জীবনের উপর কিছু বলার জন্য বলা হলো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন দেখলাম জানাযায় যেন মানুষের ঢল নেমেছে। কয়েক হাজার শোকাহত মানুষের করুণ চাহনির দিকে তাকিয়ে মনে হলো তারা যেন আর্তনাদ করছে, হে আল্লাহ তুমি আমাদের মাঝ থেকে মুস্তাফিজ ভাইকে কেন এত তাড়াতাড়ি নিয়ে গেলে। শত সহস্র সাথীদের চোখের পানি আর কান্নার গোঙানীর শব্দ এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করলো। ভাঙ্গা গলায় কিছু কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করলাম। এরপর শহর সভাপতি তারেক মাহমুদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিনের সভাপতি রাশেদুল হাসান রানা ভাই'র বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা সম্পাদক মু. মহি উদ্দিন ভাই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ মৃত্যু হলো শাহাদাতে মৃত্যু”। তিনি আল্লাহর রাসূলের একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “শাহাদাতের তামান্না যদি কেউ লালন করেন আর এমতাবস্থায় তিনি বিছানায় শুয়ে ইন্তেকাল করেন তবুও তাকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে”। তিনি আরো বলেন, “মুস্তাফিজুর রহমান ভাই সড়ক দূর্ঘটনায় ইন্তেকাল করলেও তিনি শহীদ হয়েছেন। কারণ তিনি মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত শাহাদাতের তামান্না বুকে ধারণ করে ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আনুগত্যের যে শপথ গ্রহণ করেছেন সে শপথের উপর আমৃত্যু টিকে ছিলেন। জানাযার নামাযের ইমামতি করেন জেলা জামায়াতের আমীর এ কে এম নাযেম ওসমানী। জানাযা শেষে মুস্তাফিজ ভাইয়ের বাড়ীর সামনে জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁর আব্বার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

জানাযা শেষ করে যখন ফেনী আসার উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠলাম তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলামনা। চোখের পানি যেন কোন বাধা মানছেনা। নিজেকে কিছুটা সামলে নেয়ার চেষ্টা করলাম। মুহুর্তেই যেন হারিয়ে গেলাম মুস্তাফিজ ভাইয়ের মাঝে । ভাবলাম আমার এত ভাল দায়িত্বশীলটাকে আল্লাহ কেন এত তাড়াতাড়ি তার কাছে নিয়ে গেল? একটি ফুটন্ত গোলাপ কেন এত তাড়াতাড়ি ঝরে গেল? আসলে বাগানের ঐ ফুলটাকে মালিক বেশি পছন্দ করেন, যার সুগন্ধ একটু বেশি। শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান ভাইকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জান্নাতের ফুল হিসেবে কবুল করেছেন বিধায় তার মাঝে অনেকগুলো অনুকরণীয় গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তার জীবনীর উপর স্মৃতি চারণ করে একটা লেখা লিখার জন্য বার বার চেষ্টা করেও যেন শেষ করতে পারছিলাম না। এত অল্প বয়সে মুস্তাফিজ ভাই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন যেন আজও বিশ্বাস হয় না। মাঝে মধ্যে মনে হয় যেন ভাই আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করবেন ভাইয়া কেমন আছেন? কিন্তু না, পৃথিবীর অমোঘ নিয়মের কাছে, জীবন মৃত্যুর দূর্গেয় রহস্যের কাছে আমাদের সে আবেগ শুধু অর্থহীন নয় বরং উপহাস তুল্য। তার স্মৃতির উপর লিখতে গিয়ে একাধিকবার চোখের পানিতে কাগজ ভিজিয়েছি। এখনো তার শূন্যতা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। মনে হয় সোনাগাজীর ইসলামী আন্দোলন একজন যোগ্য দায়িত্বশীলকে হারালো । জানিনা কবে এ শূন্যতা পূরণ হবে। মুস্তাফিজ ভাই'র ইন্তেকালের পর অসংখ্যবার তার বৃদ্ধ মাকে দেখতে গিয়েছি। বুঝেছি সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দু'চোখের পানি সব শুকিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন আমাকে ফোন করেন। ফোন করেই বলেন, বাবা আমার মানিক (মুস্তাফিজ) কই? এ কথা শুনার পর নিজের আবেগ সংবরণ করতে আজও কষ্ট হয়। উনাকে সান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাইনা। মুস্তাফিজ ভাই'র ২০/২২ বছরের মধ্যে অল্প ক'টা দিন তাকে কাছ থেকে উপলব্দি করার সুযোগ পেয়েছি, তার দায়িত্বশীল থাকার সুবাদে । তাকে যেমন দেখেছি তার পুরোটা এই স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তার জীবনী থেকে যা লিখতে পেরেছি তার তুলনায় যা লিখতে পারিনি তার পরিমান বেশী। পিতামাতার কাছে যেমন তার সন্তানের দূর্বলতা সাধারণত গোপন থাকেনা তেমনি দায়িত্বশীলের নিকট তার জনশক্তির দূর্বলতা গোপন থাকেনা। কিন্তু মুস্তাফিজ ভাইর ব্যাপারটা ভিন্ন। যে কয়টা দিন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি তার কাছে ভাল ছাড়া খারাপ কিছু দেখিনি ।

সত্যবাদিতা, তাকওয়া, আমানতদারীতা ইত্যাদি ছিল তার চরিত্রের ভূষন। সর্বোপরি সকল মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারা, সকলকে মূল্যায়ণ করতে জানা, মানুষের হক আদায়ের প্রতি সচেতন থাকা, মানুষকে খাইয়ে নিজে তৃপ্তি পাওয়া এগুলো ছিল তার জীবনের অংশ। এতগুলো সদগুণাবলীর পাশাপাশি যে আল্লাহর এই জমিনে তার দেয়া বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতে পারে আল্লাহর জান্নাত তো তার জন্যই অপেক্ষমান। হে আল্লাহ তুমি আমাদের মুস্তাফিজ ভাই'র জীবনের সকল ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু হিসেবে কবুল কর। তাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান কর । (আমিন)

★যেমন দেখেছি শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান ভাইকে :-

প্রথম দেখা ও পরিচয়ঃ
২০১২ সাল। আমি তখন ফেনী শহর শাখার সেক্রেটারী। সে বছরের মাঝামাঝিতে কোন একদিন সোনাগাজী যাওয়ার পথে ডাকবাংলা নামক স্থানে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গেলে দেখলাম কয়েকজন মাঝারি বয়সের তরুণ একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আমাকে দেখে একজন এগিয়ে এসে মুচকি হেসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাইয়া কেমন আছেন”? ইতিপূর্বে তাকে আর কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়নি। তবে ধারণা করলাম উনি এখানকার দায়িত্বশীল। সালামের উত্তর দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে বললেন তিনি সোনাগাজী পশ্চিম সাথী শাখার সভাপতি । এরপর আর সেদিন বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি। তারপর আর দীর্ঘ দিন দেখা হয়নি।

মতের কোরবানীর ক্ষেত্রে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনঃ-

২০১৩ সালের ২২শে জানুয়ারী আমার উপর জেলা সভাপতির দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। শপথ গ্রহণের পরেই থানা ও সাথী শাখাগুলোর সেটআপ এর বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সদস্য বৈঠক ডাকা হয়। সদস্য বৈঠকে সোনাগাজী পশ্চিম সাথী শাখার সভাপতি হিসেবে মুস্তাফিজুর রহমান ভাইর নাম পাশ হয়।

কিন্তু সোনাগাজী সাথী শাখার সভাপতি হিসেবে সদস্য বৈঠকে যাকে চিন্তা করা হয়েছিল একটা বিশেষ কারণে উনাকে ওখানে সেটআপ করা যায়নি। এ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে জরুরী সেক্রেটারীয়েট বৈঠক আহবান করলাম। সেক্রেটারীয়েট বৈঠকে পরামর্শ হলো মুস্তাফিজ ভাইকে সোনাগাজী সাথী শাখার সভাপতি করার। যথারীতি সাথী শাখার সেটআপ প্রোগ্রামে গিয়ে তাকে আল হেলাল একাডেমীর মসজিদে নিয়ে গিয়ে যখন বিষয়টা খুলে বললাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের চিন্তার কথা জানালাম, তিনি কোন প্রতিবাদ করেননি। ছলছল করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। তার অবস্থা দেখে আমি নিজেও সে দিন অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। সংগঠনের একটি সংকট মুহুর্তে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে মতের কোরবানীর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, নিজের মতের উপর সংগঠনের সিদ্ধান্তকে যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, সে দিন থেকে তার উপর আমার আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি অনেক মজবুত হয়ে যায়।

দায়িত্ব পালনে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শন :

সোনাগাজী সাথী শাখায় দীর্ঘ দিন যাবত আমরা অনেকগুলো সংকট মোকাবেলা করছিলাম। বিশেষ করে ময়দান থেকে যোগ্য নেতৃত্বের ধারাবাহিক রিক্রুটমেন্ট না থাকা। ময়দানের বিশাল ভৌগলিক এলাকার তুলনায় মানের জনশক্তি কম থাকা। শাখার আভ্যন্তরীন জান্নাতি পরিবেশ কাক্ষিত মানের চেয়ে কম থাকা। উপরোক্ত সমস্যা ও সংকট মোকাবেলা করার পাশাপাশি জেলার যে কোন দাবী এবং চাহিদা পূরণে মুস্তাফিজ ভাই'র ভূমিকা মাঝে মধ্যে আমাকে অভিভূত করতো। যে কোন দায়িত্ব বা কাজ দিতাম তা পালনে অনীহা তো দূরের কথা টু শব্দটি পর্যন্ত করেছেন আমার মনে পড়েনা। মাঝে মাঝে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতাম, আমার এই ভাইটা এত ভাল কেন?

অনাড়ম্বর জীবন যাপনঃ

রাসূল (সাঃ) বলেন “দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের হাতে যা আছে তার প্রতিও অনাসক্ত হও তাহলে মানুষও তোমাকে ভালবাসবে”। অনাড়ম্বর জীবন যাপনের মূর্ত প্রতীক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান ভাই। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদে গর্ব-অহংকারের লেশ মাত্র ছিলনা ।

সকল কষ্ট নিজের ভিতর রাখতেনঃ

২০১৩ সাল ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে তীব্র আন্দোলনের বছর। কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়তই হরতাল, অবরোধ, মিছিল আর বিক্ষোভের কর্মসূচী ছিল ধারাবাহিকভাবে। আর এ সমস্ত কর্মসূচী যথার্থভাবে পালনের ক্ষেত্রে স্থানীয় মুরুব্বী সংগঠন কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করতেন। একদিকে জেলা সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য চাপ অন্যদিকে স্থানীয় মুরুব্বী সংগঠনের সীমাবদ্ধতা আরোপের প্রেক্ষাপটে যে মানসিক কষ্ট পেতেন তার অভিযোগ কখনো করতেন না। সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে উভয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।

একদিন সোনাগাজী সাথী শাখা সফর করে ফেরার মুহুর্তে শাখা সেক্রেটারী হেদায়েত উল্লাহ ভাই আমাকে বললেন ভাইয়ের (মুস্তাফিজ ভাই) শরীরের কি অবস্থা হয়েছে একটু দেখবেন কিনা?

আমি বললাম কেন কি হয়েছে? মুস্তাফিজ ভাইর নিকট প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলাম। তিনি কিছুতেই আমাকে ঘটনা খুলে বললেন না। পরে আমি জানতে পারলাম রাতে বাসায় পুলিশ এসেছিল মুস্তাফিজ ভাইকে গ্রেপ্তার করতে। মুস্তাফিজ ভাই যে বাসায় থাকতেন সেটি ইটে তৈরী টিনশেড ঘর। নিরাপদে সরার জন্য ঐ বাসার পিছনে কোন দরজা ছিলনা। তাই পুলিশ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিনি বাসার ছাদ সংলগ্ন যে বেড়া (দমদমা) ছিল তার ফাঁক দিয়ে বহু কষ্টে পাশের একটি হিন্দু বাসায় আশ্রয় নেন। ঐ বেড়ার ফাঁক দিয়ে যাওয়ার সময় পিঠে এবং বুকে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছেন। কিন্তু কষ্ট নিজের ভিতর রেখেছেন, কখনো আমাদেরকে জানতে দেননি।

অনুপম সামাজিক গুনাবলীঃ

সব ধরনের মানুষের সাথে মুস্তাফিজ ভাই'র সু-সম্পর্ক ছিল। তিনি রাজনৈতিক মত পার্থক্যের উর্ধ্বে উঠে শত্রু-বন্ধু সকলের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতেন। এ পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) এর একটি হাদিস মনে পড়লো, হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, “হে আয়েশা! আল্লাহ তা'য়ালার নিকট নিকৃষ্ট হল সে ব্যক্তি যার অভদ্র ও অশোভন আচরণ হতে বাঁচার জন্য মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে।  (বুখারী)

দায়িত্ব পালনে পেরেশানীঃ

এ গুনটি মুস্তাফিজ ভাইয়ের মাঝে ছিল চোখে পড়ার মতো। কিসে আন্দোলনের উন্নতি হবে, সংগঠনের সমৃদ্ধি আসবে সে চিন্তার বাইরে দুনিয়াবী কোন চিন্তা তার ভিতর দেখা যায়নি। যে দিন সন্ধ্যায় তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন সে দিন ও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এদিকে তার আম্মা খুব অসুস্থ। শাখার কাজ শেষ করে মাগরিবের নামায আদায় করে আম্মাকে দেখার জন্য বাড়ীতে যাওয়ার পথে সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হন। মাকে তো আর এক নজর দেখতে পারলেন না। এই জনম দুঃখীনি মাকে আজ কে সান্তনা দিবে আমরা জানি না ।

মৃত্য যন্ত্রনা ছিলনাঃ

আপন মালিককে সন্তুষ্ট করার জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দয়াময় মালিক তাদের শাহাদাতের আঘাতকে ব্যথাহীন করে দেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, শাহাদাত লাভ কারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করেনা। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে কেবল তারা ততটুকুই অনুভব করে। (তিরমিযী)

মুস্তাফিজ ভাই'র ক্ষেত্রে এ হাদীসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখেছি। সড়ক দূর্ঘটনার পর তাকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখনো তার নিত্য দিনের মতোই হাস্যজ্জল চেহারা ছিল। আঘাতের স্থান নির্ধারণের জন্য তাঁর হাত পা বার বার নাড়া চড়া করে দেখা হচ্ছে। এক্স-রে করার জন্য তাকে এপিঠ-ওপিঠ, চিৎ করে কা‍ করে শোয়ানো হচ্ছে তারপরও মনো হলো ওনার কিছুই হয়নি। ব্যথার কোন অনুভূতি তার চেহারায় পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু এক্সরের ফিল্মে যখন দেখলাম তার পায়ের হাড় ভেঙ্গে পরস্পর স্থানচ্যুত হয়ে গেলো, তখন অবাক লাগলো আমার কাছে। এত বড় মারাত্মক আঘাত পাওয়ার পরও ভাইয়ের ব্যথার অনুভূতি কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। জরুরী বিভাগের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে যখন তাকে হাসপাতালের বেডে আনা হলো মারাত্মক জখম নিয়েও সবার সাথে কথা বলছেন। রাত তখন প্রায় ১০:৩০ টা। মুস্তাফিজ ভাইর এক্সিডেন্টের খবর শুনে যারা তাকে দেখতে এসেছিলো তারা প্রায় সকলে ততক্ষণে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। আমি জরুরী বিভাগের কাজ শেষ করে বিভিন্ন ডাক্তারের সাথে তার চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শ করে মুস্তাফিজ ভাই যে বেডে আছেন তার অদুরে চেয়ার টেনে বসলাম। নিজেও একদিকে চিন্তিত অন্যদিকে ক্লান্ত। দেখলাম মুস্তাফিজ ভাই'র চোখ দুটি বন্ধ। ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন। নাকে তার প্লাষ্টার করা, ঠোট এবং মুখ কিছুটা ফুলে গেছে। সম্ভবত আমার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ভাইয়া কেমন আছেন? আমি অবাক হলাম। এত কষ্টের মাঝেও ভাই নিত্যদিনের মতই আমার খোঁজ নিচ্ছেন। এ স্মৃতি গুলো মনে পড়লে আজও অশ্রুতে দু'চোখের কোণ ভিজে যায়।

পরিবারের অনুভূতি
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
শহীদ মোস্তাফিজুর রহমানের বড় দুলা ভাই

“আমার প্রিয় ছোট ভাই (শ্যালক) দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক। সোনাগাজী সাথী শাখার সংগ্রামী সভাপতি শহীদ মোস্তাফিজুর রহমান। আজ আর দুনিয়াতে নেই। এই কথা যখন মনে পড়ে তখর যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সকলের অতি আদরের মোস্তাফিজ লেখা পড়ায় যেমন ছিল মনযোগী সংগঠনের ক্ষেত্রে ছিল আরো বেশি ত্যাগী । দুনিয়ার কোন রক্ত চক্ষু তাকে এক মূহুর্তের জন্যেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ময়দান থেকে পিছু হঠাতে পারেনি। সে ছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল ও ধৈর্য্যশীল। ২৫ই ফেব্রুয়ারী’১৪ মাগরিবের নামাযের পর প্রোগ্রাম শেষ করে আসার পথে মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগে আমি হাসপাতালে পৌঁছি। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে তখন থেকে দুই দিন তার সাথে সার্বক্ষণিক ছিলাম। সে বুঝে ছিল যদিও বেঁচে থাকি পা হারাতে হবে। কিন্তু কোন কষ্ট তার চেহারায় আমি দেখিনি, সে ছিল স্বাভাবিক হাস্যোজ্জ্বল। হাসপাতালে দেখতে আশা সকলের সাথে সে কথা বলতো। মৃত্যুর পূর্বে হঠাৎ সুস্থ মানুষের মত উঠে, বসে তার বোনকে বলতেছে, “আপু কিসের ঘুম যাচ্ছেন, উঠুন নামাজ পড়ুন, আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি” । এই ঘুম যে আর কখনো ভাঙবেনা তার আপু হয়তো বুঝতে পারেনি। আমি মহান আল্লাহ তা'য়ালার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন মুস্তাফিজকে শহীদ হিসাবে কবুল করেন এবং জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করেন।”


লেখক
মোঃ জাহিদ হোসাইন
সাবেক সভাপতি,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
ফেনী জেলা

মূল লিখা: রক্তাক্ত ফেনী