Close

মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪

দারসুল কুরআন : সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭



【 দারসুল কুরআন : সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭ 】
বিষয় : মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় আমাদের তৎপরতা
- প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলাম
---------------------------------------------------
يَآ أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১) قُمْ فَأَنْذِرْ (২) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (৩) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (৪) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (৫) وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِر (৬) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ. (৭)
✦ সরল অনুবাদ
১. হে কম্বল মুড়ি দিয়ে শায়িত ব্যক্তি ২. উঠুন এবং সতর্ক করুন ৩. এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব ঘোষণা করুন ৪. আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন ৫. প্রতিমা থেকে দূরে থাকুন ৬. অধিক প্রাপ্তির আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করবেন না ৭. এবং আপনার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন। (সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৭)

✦ নামকরণ
প্রথম আয়াতের ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) অর্থ বস্ত্র বা কম্বল আচ্ছাদনকারী। এখানে ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করা হয়েছে।

✦ নাযিল হওয়ার সময়কাল

সূরা আল-মুদ্দাসসির দু’টি অংশে নাযিল হয়। প্রথম অংশে সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয়। এটি সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরাহ আলাকের পর নাযিল হয়। অর্থাৎ সম্ভবত এ আয়াতগুলো ৬১০ খ্রি. শাওয়াল মাসে নাযিল হয়।
দ্বিতীয় অংশে অষ্টম আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল হয়। এটি প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথমবার মক্কায় হজের মওসুম সমাগত হলে নাযিল হয়।

✦ সূরার বিষয়বস্তু

- সূরার প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মহান রবের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা তাওহিদের প্রতি আহ্বান এবং আহ্বানের ক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৮-৫৩ আয়াতে সত্য দ্বীন অমান্যকারীদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে কিয়ামতের দিবসে তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৫৪-৫৬ আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশ। কিন্তু এ উপদেশ কবুল করার জন্য আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন না। যে গ্রহণ করবে সে-ই উপকৃত হবে; আর যে গ্রহণ করবে না সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

✦ নির্বাচিত আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয়

সূরাহ আল-মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি সংক্রান্ত ছয়টি নির্দেশনা প্রদান হয়েছে।
প্রথম নির্দেশ : قُمْ فَأَنْذِر অর্থাৎ উঠুন এবং বিশ্ববাসীকে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপনের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
দ্বিতীয় নির্দেশ : وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ অর্থাৎ মহান রবের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করুন ও প্রতিষ্ঠা করুন।
তৃতীয় নির্দেশ : وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ অর্থাৎ পোশাক, দেহ, অন্তর ও মনকে পবিত্র করুন।
চতুর্থ নির্দেশ : وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ অর্থাৎ প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকুন।
পঞ্চম নির্দেশ : وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ অর্থাৎ পার্থিব প্রতিদানের আশায় কাউকে দান ও অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থাকুন।
ষষ্ঠ নির্দেশ : وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ অর্থাৎ সর্বাবস্থায় রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন।

✦ নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ

» প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা
: يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ “ওহে বস্ত্র আচ্ছাদিত ব্যক্তি।”
আরবীতে কাউকে ডাকার জন্য ‘হরফে নিদা’ (حرف ندا) ব্যবহার করা হয়। এখানে ‘ইয়া আইয়ুহা’ (يَا أَيُّهَا) ‘হরফে নিদা’। আর যাকে ডাকা হয় বা সম্বোধন করা হয় সেটি মুনাদা। এ আয়াতে মুহাম্মাদ সা.-কে ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) তথা ‘ওহে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এটি প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন। মহান আল্লাহ অন্য সকল নবীকে আহ্বান করার সময় নাম ধরেই সম্বোধন করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ সা.-কে কখনও ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বলেননি, বরং তাঁকে অতি আদর করে সম্বোধন করেছেন। এটি রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি বিশেষ সম্মান।
সূরাহ আলাক নাযিলের পর কিছুকাল পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপর অহি নাযিল বন্ধ থাকে। এ সময়কে ‘ফাতরাতুল অহি’ বলে। সে সময় রাসূলুল্লাহ সা. এতো কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। অহি নাযিলের বিরতির শেষভাগে একদিন রাসূল সা. পবিত্র মক্কায় পথ চলাকালে ওপর দিক থেকে কিছু আওয়াজ শুনতে পান। তিনি ওপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পান যে, ফেরেশতা জিবরিল (আ) আকাশে একটি ঝুলন্ত আসনে উপবিষ্ট আছেন। ফেরেশতাকে এমতাবস্থায় দেখে তিনি ভীত-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরে বললেন- زمِّلونى زمِّلونى (আমাকে চাদরাবৃত কর, আমাকে চাদরাবৃত কর।) অতঃপর তিনি চাদরাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন।
সে অবস্থায় রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে ডেকে বলা হচ্ছে, হে আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ সা.! আপনি চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছেন কেন? আপনার ওপরে তো একটি বিরাট মহৎ কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য আপনাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে। অতঃপর তাঁকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ছয়টি কাজের নির্দেশ দেয়া হয়। (ইবনে জারির)

» দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা : قُمْ فَأَنْذِر “উঠুন অতঃপর সতর্ক করুন।”
এখানে ‘কুম’ (قُمْ) এবং ‘আনযির’ (أَنْذِر) দু’টি শব্দে একটি আয়াত। দু’টি শব্দই ‘আমর’ বা আদেশ সূচক। ‘কুম’ (قُمْ) অর্থ উঠুন, দ-ায়মান হোন, কর্মে তৎপর হোন ইত্যাদি। আর ‘আনযির’ (أَنْذِر) অর্থ সতর্ক করুন, ভয় দেখান ইত্যাদি।
এ আয়াতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দেন, হে কম্বলজড়ানো ব্যক্তি! আপনার কম্বল জড়িয়ে শয্যা গ্রহণের অবকাশ কোথায়। আপনার প্রতি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার এক বিরাট দায়িত্ব চাপানো হয়েছে, আপনি উঠুন। আমার একত্ববাদ প্রচার করুন এবং যারা আমার সত্তায়, গুণে ও ক্ষমতায় আমার সাথে অন্যান্য বস্তুকে শরিক করে তাদেরকে এটার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি এ নির্দেশ এমন এক সময় ও পরিবেশে অবতীর্ণ হয়, যখন মক্কাসহ সমগ্র আরবের লোক ও জনপদগুলো শিরকে নিমজ্জিত ছিল আর তিনি ছিলেন একাকী। তাঁর সঙ্গী-সাথী কেউই ছিল না। এহেন পরিবেশে সর্বজন বিরোধী একটি মতাদর্শ নিয়ে দ-ায়মান হওয়া এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা কত বড় বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার ছিল তা একটু চিন্তা করলেই বোধগম্য হয়। এহেন পরিবেশের মধ্যেই আল্লাহ বললেন, আপনি তৌহিদের পতাকা নিয়ে দ-ায়মান হোন এবং মানুষকে তৌহিদের পরিপন্থী আকিদা-বিশ^াসের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকুন। এটাই আপনার প্রথম কাজ। এ যেন মহা স্রােতের বিপরীতে চলার এক কঠিন নির্দেশ।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলকে সা. ‘নাযির’ তথা সতর্ককারীর দায়িত্বসহ প্রেরণের কথা বলা হয়েছে।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا.
“হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে।” (সূরাহ আহযাব : ৪৫)
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ.
“আমি তোমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী বানিয়ে। আর এমন কোন সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যার মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।” (সূরাহ ফাতির : ২৪)
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (১) قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ.
“আমি নূহকে তার কওমের কাছে পাঠিয়েছিলাম, যেন তিনি তার কওমের লোকদের ওপর এক ভীষণ কষ্টদায়ক আযাব আসার পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করে দেন। তিনি বলেছিলেন, হে আমার দেশবাসী! আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সাবধানকারী।” (সূরা নূহ : ১-২)

» তৃতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা : وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ “আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।”
সূরাহ আল-মুদ্দাসসিরে দ্বিতীয় নির্দেশনায় মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী! মানুষ আমার মহানত্ব, বিরাটত্ব ও অসীমত্বের কথা ভুলে আমার জমিনে শয়তানের কথামত রাজত্ব পরিচালনা করছে। আমার জমিনে এখন বাতিলের রাজত্ব চলছে। লাত, মানতের পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে। অথচ জমিনের মালিক হলাম আমি আল্লাহ। আমার জমিনে শয়তানের রাজত্ব চলতে পারে না। মানবরচিত মতবাদ চলতে পারে না। আপনি উঠুন এবং আল্লাহর তাকবির ঘোষণা করুন। ‘ওয়া রাব্বাকা ফাকাব্বির’ (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ সব জায়গায় ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر) ধ্বনিত হবে। জগতের সর্বত্রই থাকবে আমার শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। মানুষের আকিদা-বিশ^াস হতে শুরু করে তাদের কর্মময় জীবনের প্রতিটি স্তরে থাকবে আমারই শ্রেষ্ঠত্বের ফলিতরূপ। একজন মু’মিন ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر)-এর তাকবির বা স্লোগান ছাড়া কোনো মানুষের তাকবির বা স্লোগান দিতে পারে না। এটি কুফরি স্লোগান। আল্লাহ বলেন, জমিনের মালিক আমি আল্লাহ। এ জমিন এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমার হুকুমে তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ জমিনে আইন চলবে একমাত্র আল্লাহর। এ সম্পর্কে সূরাহ আরাফের ৫৪তম আয়াতে বলা হয়েছে,
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“সাবধান! সৃষ্টি যার, আইন চলবে একমাত্র তার। বরকতময় আল্লাহই বিশ^ জগতের মালিক।”
পৃথিবীতে যতজন নবী ও রাসূল আগমন করেছেন, এটিই ছিলো তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। এ ব্যাপারে সূরাহ আন-নাহলের ৩৬তম আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ.
“প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রাসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, “আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাগুতের বন্দেগি পরিহার করো।”
সকল নবীরই প্রধান কাজ ছিলো মহান রবের একত্ববাদের দিকে আহ্বান করা। সূরাহ আরাফের ৫৯, ৬৫, ৭৩ ও ৮৫তম আয়াতে হযরত নূহ, হুদ, সালেহ, শুয়াইব (আ) এর দাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে,
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ.
“হে আমার দেশবাসী! আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।”
তাই একজন নবীর প্রথম কাজই হলো, অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ পৃথিবীতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ মেনে চলছে তাদের সবাইকে অস্বীকার করবে এবং গোটা পৃথিবীর সামনে উচ্চকণ্ঠে এ কথা ঘোষণা করবে যে, এ বিশ্বজাহানে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ নেই।
ইসলামে ‘আল্লাহু আকবার’ (الله اكبر) তথা ‘আল্লাহই শ্রেষ্ঠ’ কথাটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘আল্লাহু আকবার’ ঘোষণার মাধ্যমেই আযান শুরু হয়। ‘আল্লাহু আকবার’ এ কথাটি বলে মানুষ সালাত শুরু করে এবং বারবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠে ও বসে। কোন পশুকে জবাই করার সময়ও ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করে। জন্মের সময় শিশুর কানে দেয়া হয় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আবার মৃত্যুর পর সালাতু যানাজার মাধ্যমেও দেয়া হয় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। তাকবির ধ্বনি বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সর্বাধিক স্পষ্ট ও পার্থক্যসূচক প্রতীক। কারণ, মহানবী সা. আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব¡ ঘোষণার মাধ্যমেই রিসালাতের কাজ শুরু করেছিলেন। অতএব একজন মুমিনের ‘আল্লাহু আকবার’ ছাড়া অন্য কোনো স্লোগান হতে পারে না।
» চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যা : وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ “আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন।”
এ আয়াতে ‘সিয়াব’ (ثِيَابْ) ও ‘তাহির’ (طَهِّرْ) দু’টি শব্দ রয়েছে। ‘সিয়াব’ (ثِيَابْ) শব্দটি ‘সাওবুন’ (ثَوْبً) এর বহুবচন। একে ‘লিবাস’ (لباس)ও বলা হয়। এর আসল অর্থ কাপড় বা পোশাক। এর রূপক অর্থ অন্তর, মন, দেহ, কর্ম ইত্যাদি।
অতএব, এ আয়াতে নবীকে সা. নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, হে নবী! আপনি স্বীয় পোশাক ও দেহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখুন, পোশাকের নৈতিক দোষত্রুটি হতে মুক্ত রাখুন। অর্থাৎ পোশাকে অহংকার, গৌরব, রিয়া বা লৌকিকতা থেকে মুক্ত রাখুন। অনুরূপভাবে অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং অসৎচরিত্রতা থেকে মুক্ত রাখুন।
ইসলাম মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হতে শিক্ষা দেয়। হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। তাই মুমিনগণকে সর্বাবস্থায় দেহ, স্থান ও পোশাক বাহ্যিক অপবিত্রতা থেকে এবং অন্তরকে অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখার প্রতি সচেষ্ট হতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা., ইবরাহিম নাখয়ী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ, কাতাদাহ, সায়ীদ ইবন যুবাইর, হাসান বসরী (রহ.) ও অন্যান্য বড় বড় মুফাসসির এ আয়াতের তাৎপর্যে বলেছেন, আপনার চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখুন ও সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজেকে মুক্ত রাখুন।
রাসূলুল্লাহ সা. যে সমাজে ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন তা শুধু আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক আবিলতার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল না বরং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রাথমিক ধারণা স¤পর্কে পর্যন্ত সে সমাজের লোক অজ্ঞ ছিল। এসব লোককে সব রকমের পবিত্রতা শিক্ষা দেয়া ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাজ। তাই তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জীবনের সকল পবিত্রতার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখেন।
নবী করীম সা. স্বভাবগতভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতেন। তাই তিনি যেন সচেতনতার সাথে পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখেন তারই শিক্ষা রয়েছে এই আয়াতে। নৈতিক দিক দিয়ে পোশাক পবিত্রতার অর্থ হচ্ছে- পোশাক এমন হতে হবে যাতে অহংকার প্রকাশ পাবে না, তাতে কুরুচির ছাপও থাকবে না।
মহান আল্লাহ পবিত্রতাকে পছন্দ করেন। যেমন- পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “অবশ্যই মহান আল্লাহ অধিক হারে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা আল-বাকারাহ : ২২২)
পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব স¤পর্কে রাসূল সা. বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন।” (তিরমিজি)
অনুরূপভাবে সূরাহ মায়িদার ষষ্ঠ আয়াতে সালাতের পূর্বে পবিত্রতা তথা অজুর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এক কথায় বলা যেতে পারে, এই আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে-
১. পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
২. পোশাক পরিচ্ছদ নৈতিক দোষত্রুটি থেকে পবিত্র রাখা।
৩. সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজ চরিত্রকে পবিত্র রাখা।
অতএব দায়ী হিসেবে আমাদের সকলকে পবিত্রতার ক্ষেত্রে এ তিনটি দিকেই সতর্ক থাকতে হবে।

» পঞ্চম আয়াতের ব্যাখ্যা : وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ “প্রতিমা থেকে দূরে থাকুন।”
অত্র আয়াতে ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ।
- প্রসিদ্ধ তাবিঈ মুজাহিদ, ইকরামা, কাতাদাহ, যুহরী, ইবন যায়েদ, আবূ সালামা (রহ.) প্রমুখ বলেছেন, ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) অর্থ মূর্তি। অর্থাৎ মূর্তিগুলোকে বর্জন করো, এগুলোর কাছেও যেয়ো না।
- ইবন আব্বাস রা. বলেছেন, এর অর্থ হলো পাপাচার।
- আবু আলিয়া এবং রবী (রহ.) বলেছেন, এর অর্থ অপবিত্রতা এবং গুনাহ।
- ইমাম যাহহাক বলেছেন, এর অর্থ শিরক।
- কালবী বলেছেন, এর অর্থ আজব।
- আল্লামা সাবুনি বলেছেন, এর দ্বারা সর্বপ্রকার খারাপ জিনিস উদ্দেশ্য হতে পারে।
অতএব আয়াতের অর্থ হলো, হে নবী! আপনি প্রতিমা পূজা এবং যাবতীয় গুনাহ ও অপবিত্রতা পরিত্যাগ করুন।
এখানে অপবিত্রতা বলতে, আকিদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার অপবিত্রতা হতে পারে, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্মের অপবিত্রতা হতে পারে আবার শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ এবং ওঠা-বসা চলাফেরার অপবিত্রতাও হতে পারে। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনা, আচার- ব্যবহার, ও দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজকর্ম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের সামান্যতমও যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য মুহাম্মাদ সা.-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং কুচরিত্র থেকে মুক্ত রাখুন।
এ বিষয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করে, রাসূলুল্লাহ সা. তো আগে থেকেই প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত ছিলেন, তার ধারে কাছেও ছিলেন না। তাহলে তাঁকে এ আদেশ দেয়ার অর্থ কী? এর উত্তরে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সা.-কে নির্দেশের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য।

» ষষ্ঠ আয়াতের ব্যাখ্যা : وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ “অধিক প্রতিদানের আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না।”
এ আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে কয়েকটি মেসেজ দেয়া হয়েছে।
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া পার্থিব বিনিময়ের আশায় সকল প্রকার দান-খয়রাত এবং মানব কল্যাণমূলক কাজ করতে এখানে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে কোনো কাজ যদিও ভালো মনে হয়, আর সে কাজের মধ্যে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য না থাকে, তবে সে কাজ আল্লাহর কাছে ভালো বলে গণ্য হবে না।
২. আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করছি, এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর একটি বড় হুকুম পালন করছি। তবে এ কাজটি যদি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য হয় বা নিজের কোনো উপকার হাসিলের জন্য হয়, তাহলে এ আন্দোলন করার মাধ্যমে নাজাত পাওয়া যাবে না।
৩. আমরা যারা সার্বক্ষণিকভাবে দ্বীনের পথে বা দ্বীনি আন্দোলনের পথে কাজ করছি তাদের এ কথা ভাবার বা মনে করার সুযোগ নেই যে, আমি দ্বীনের অনেক উপকার করলাম। বরং মনে রাখতে হবে যে, কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার বা কল্যাণ হয়।
এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার হবে।
১.قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।” (সূরা আনআম : ১৬২)
২.إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ.
“আমি একমুখী হয়ে ¯¦ীয় লক্ষ্য ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের মধ্যে শামিল নই।” (সূরা আনআম, ৬ : ৭৯)
৩. يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (১৭)
“তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ্ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক।”
. ৪وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“(নূহ, হুদ, সালেহ, লূত, শুআইব (আ) জাতির উদ্দেশ্যে বলেন) এ কাজে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদানের প্রত্যাশী নই। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব তো রাব্বুল আলামিনের।” (শুআ’রা : ১০৯; ১২৭; ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)
৫.عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না। তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও ‘আমলসমূহের দিকে। (সহীহ মুসলিম; সুনানু ইবন মাজাহ)
৬.أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.
নুমান ইবন বাশীর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জেনে রাখ, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে- তা বিশুদ্ধ থাকলে গোটা শরীর সুস্থ থাকে। আর তা বিনষ্ট হলে গোটা শরীরই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখো ঐ গোশতের টুকরাটি হলো মানুষের কলব বা আত্মা। (সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম)
৭. عَنِ الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: ্রذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا.
আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূল সা. বলেছেন, সে ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করেছে, যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সা.-কে নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে। (জামি তিরমিজি; সহীহ মুসলিম)
৮.عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
আবু উমামা আল-বাহলি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সে-ই পূর্ণ ঈমানদার। (সুনানু আবি দাউদ)

» সপ্তম আয়াতের ব্যাখ্যা : وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ “এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।”
অত্র আয়াতে সবর সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার।
১. ‘আস-সাবরু আলাল মা‘আসী’ তথা অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ধৈর্য।
২. ‘আস-সাবরু আলাত ত্বাওয়া’ তথা আনুগত্যে ওপর ধৈর্য।
৩. ‘আস-সাবরু আলাল মাসিবাহ’ তথা বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ। অতএব সকল অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক।
এ আয়াতটি নবুয়তের একেবারে প্রথম দিকের আয়াত এবং মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব¡ ও বড়ত্ব ঘোষণা নিয়ে মুহাম্মাদ সা. এখনো ময়দানে নামেননি। তাই তিনি এই ঘোষণা নিয়ে ময়দানে নামলে তার সাথে কী কী নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা.-কে আগেই সবরের শিক্ষা দিয়েছেন।
এ পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদ-মুসিবতই আসুক না কেন প্রভুর উদ্দেশ্যে সেসব বিপদের মুখে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে এবং অত্যন্ত অটল ও দৃঢ়চিত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গেলেই খোদাদ্রোহী শক্তির সাথে বিরোধ হবেই। এ জন্যই সকল নবী বা রাসূলের সাথে সমসাময়িক শাসকদের বিরোধ হয়েছে। আজও যারা বলে আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই। তাদের ওপরও জুলুম নির্যাতন চলে। অতএব এ বাধা, নির্যানত ছিল, আছে এবং থাকবে। এ অবস্থায় ধৈর্যের সাথে সামনে অগ্রসর হতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সা. প্রথম অহি প্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে খাদিজা রা.-কে ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি তাঁকে ওয়ারাকা ইবন নওফিলের কাছে নিয়ে গেলে ওয়ারাকা সব কথা শুনেই রাসূল সা.-কে বলেছিলেন, ইনি সে দূত (النَّامُوسُ) যাঁকে আল্লাহ মূসা (আ) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রা. ইন্তেকাল করেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও আল-হাদিসে সবরের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। আমরা এ আয়াতের ব্যাখ্যার জন্য এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস অধ্যয়ন করতে পারি। (যেমন- সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৩; আলে ইমরান : ২০০; আনফাল : ৪৬; সোয়াদ : ১৭; কাফ : ৩৯)

✦ আয়াতসমূহের শিক্ষা
১. আল্লাহর দ্বীনি দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি কিংবা মনের কষ্টের কারণে ঘরে শুয়ে বসে থাকা যাবে না।
২. রাসূল সা.-এর অনুকরণে আমাদেরকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে হবে এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
৩. আয়াতে পবিত্রতার শিক্ষা আমাদের পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মুমিন ও দায়ী হিসেবে বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি সকল প্রকার শিরক, কুফর, ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে অন্তর ও চরিত্রকে পবিত্র রাখতে হবে।
৪. আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। বৈষয়িক কোন উদ্দেশ্য এখানে থাকবে না।
৫. পার্থিব বিনিময় পাওয়ার আশায় অন্যকে দান করা যাবে না। কারো কোনো উপকার করলে তার বিনিময়ের আশা করা যাবে না। হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় পাওয়ার আশায় দেয়া যাবে না। এমনকি আল্লাহর কোনো বন্দেগি বা নেক কাজ করে কিংবা দ্বীনের কাজ করে মনে করা যাবে না যে, আল্লাহর মহা উপকার করলাম। কেননা কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার বা কল্যাণ হয় মনে করতে হবে।
৬. এ কাজ করতে গিয়ে বাতিলের আক্রমণ ও বাধার সম্মুখীন হলে চুপ থাকা যাবে না; বরং দৃঢ়পদে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে সবর অবলম্বনের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে আমরা সবাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, হে আল্লাহ! আমাদেরকে সকল প্রকার বাহ্যিক ও আত্মিক পাপাচার ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

দারসুল কুরআনঃ সূরা আল ইমরান | ১৩৩নং থেকে ১৪৮নং আয়াত

দারসুল কুরআন | সূরা আল ইমরান | ১৩৩-১৪৮ নং আয়াত 

মূল আয়াত ও বাংলা অনুবাদ:

আয়াত: ১৩৩

وَ سَارِعُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَ الْاَرْضُ١ۙ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِیْنَۙ

দৌঁড়াও তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী ও আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের দিকে চলে গেছে, যা এমন সব আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরী করা হয়েছে।


আয়াত: ১৩৪

الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الْكٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَ الْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَۚ

যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ–ত্রুটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ‌ অত্যন্ত ভালোবাসেন।


আয়াত: ১৩৫

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللّٰهَ فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ١۪ وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللّٰهُ١۪۫ وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰى مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ

আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য মাফ চায় – কারণ আল্লাহ‌ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন – এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না,

আয়াত: ১৩৬

اُولٰٓئِكَ جَزَآؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا١ؕ وَ نِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِیْنَؕ

এ ধরনের লোকদের যে প্রতিদান তাদের রবের কাছে আছে তা হচ্ছে এই যে, তিনি তাদের মাফ করে দেবেন এবং এমন বাগীচায় তাদের প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সৎকাজ যারা করে তাদের জন্য কেমন চমৎকার প্রতিদান!


আয়াত: ১৩৭

قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ١ۙ فَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَانْظُرُوْا كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِیْنَ

তোমাদের আগে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে দেখে নাও যারা (আল্লাহর বিধান ও হিদায়াতকে) মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কি হয়েছে।


আয়াত: ১৩৮

هٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَ هُدًى وَّ مَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِیْنَ

এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ।


আয়াত: ১৩৯

وَ لَا تَهِنُوْا وَ لَا تَحْزَنُوْا وَ اَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ

মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।


আয়াত: ১৪০

اِنْ یَّمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهٗ١ؕ وَ تِلْكَ الْاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیْنَ النَّاسِ١ۚ وَ لِیَعْلَمَ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ یَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَآءَ١ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَۙ

এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও। এ–তো কালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি। এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ (সত্য ও ন্যায়ের) সাক্ষী হবে -কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ‌ পছন্দ করেন না


আয়াত: ১৪১

وَ لِیُمَحِّصَ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ یَمْحَقَ الْكٰفِرِیْنَ

– এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা মুমিনদের বাছাই করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে চাইছিলেন।


আয়াত: ১৪২

اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَ لَمَّا یَعْلَمِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ جٰهَدُوْا مِنْكُمْ وَ یَعْلَمَ الصّٰبِرِیْنَ

তোমরা কি মনে করে রেখেছো তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনো আল্লাহ‌ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী।


আয়াত: ১৪৩

وَ لَقَدْ كُنْتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِنْ قَبْلِ اَنْ تَلْقَوْهُ١۪ فَقَدْ رَاَیْتُمُوْهُ وَ اَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ۠

তোমরা তো মৃত্যুর আকাংখা করছিলে! কিন্তু এটা ছিল তখনকার কথা যখন মৃত্যু সামনে আসেনি। তবে এখন তা তোমাদের সামনে এসে গেছে এবং তোমরা স্বচক্ষে তা দেখছো। 

আয়াত: ১৪৪

وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوْلٌ١ۚ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ١ؕ اَفَاۡئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰۤى اَعْقَابِكُمْ١ؕ وَ مَنْ یَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَیْهِ فَلَنْ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیْئًا١ؕ وَ سَیَجْزِی اللّٰهُ الشّٰكِرِیْن

মুহাম্মাদ একজন রসূল বৈ তো আর কিছুই নয়। তার আগে আরো অনেক রসূলও চলে গেছে। যদি সে মারা যায় বা নিহত হয়, তাহলে তোমরা কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? মনে রেখো, যে পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করবে না, তবে যারা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।


আয়াত: ১৪৫

وَ مَا كَانَ لِنَفْسٍ اَنْ تَمُوْتَ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ كِتٰبًا مُّؤَجَّلًا١ؕ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الدُّنْیَا نُؤْتِهٖ مِنْهَا١ۚ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الْاٰخِرَةِ نُؤْتِهٖ مِنْهَا١ؕ وَ سَنَجْزِی الشّٰكِرِیْنَ

কোন প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না। মৃত্যুর সময় তো লেখা আছে। যে ব্যক্তি দুনিয়াবী পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো। আর যে ব্যক্তি পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে সে পরকালের পুরস্কার পাবে এবং শোকরকারীদেরকে আমি অবশ্যি প্রতিদান দেবো।


আয়াত: ১৪৬

وَ كَاَیِّنْ مِّنْ نَّبِیٍّ قٰتَلَ١ۙ مَعَهٗ رِبِّیُّوْنَ كَثِیْرٌ١ۚ فَمَا وَ هَنُوْا لِمَاۤ اَصَابَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ مَا ضَعُفُوْا وَ مَا اسْتَكَانُوْا١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الصّٰبِرِیْنَ

এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ‌ ওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ‌ ভালবাসেন।


আয়াত: ১৪৭

وَ مَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ اِسْرَافَنَا فِیْۤ اَمْرِنَا وَ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ

তাদের দোয়া কেবল এতটুকুই ছিলঃ “হে আমাদের রব! আমাদের ভুল –ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দাও। আমাদের কাজের ব্যাপারে যেখানে তোমার সীমালংঘিত হয়েছে, তা তুমি মাফ করে দাও। আমাদের পা মজবুত করে দাও এবং কাফেরদের মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করো।”


আয়াত: ১৪৮

فَاٰتٰىهُمُ اللّٰهُ ثَوَابَ الدُّنْیَا وَ حُسْنَ ثَوَابِ الْاٰخِرَةِ١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ۠

শেষ পর্যন্ত আল্লাহ‌ তাদেরকে দুনিয়ার পুরস্কারও দিয়েছেন এবং তার চেয়ে ভালো আখেরাতের পুরস্কারও দান করেছেন। এ ধরনের সৎকর্মশীলদেরকে আল্লাহ‌ পছন্দ করেন।


সুরার পরিচয়:

নাম: আলে ইমরান। আয়াত সংখ্যা: ২০০। রুকু: ২০। আল কুরআনের সুরা ধারাবাহিকতায় ৩য় সুরা এটি।


আলোচ্য সূরার নামকরণ:

এই সূরার ৩৩ নং আয়াতে উল্লেখিত وَآلِ عِمْرَانَ "ইমরানের বংশধর” বাক্যটিকেই পরিচিতির জন্য চিহ্ন হিসেবে এই সূরার নামকরণ "আলে ইমরান" করা হয়েছে। কেননা, আল কুরআনে ১১৪ টি সূরার অধিকাংশ সূরাই শিরোনাম হিসেবে নয় বরং প্রতীকী বা চিহ্ন হিসেবেই নামকরণ করা হয়েছে। আর এই নামকরণ আল্লাহর নবী (সঃ) নিজে করেননি বরং আল্লাহই করেছেন যা অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।


এছাড়াও এ সূরাকে সূরা তাইবাহ, আল-কানুয, আল-আমান, আল-মুজাদালাহ, আল-ইস্তেগফার, আল-মানিয়াহ ইত্যাদি নাম দেয়া হয়েছে।

সূরা নাযিলের সময়কাল: আলোচ্য সূরাটি সর্বসম্মত মতে মাদানী। তবে একই সময় সম্পূর্ণ সূরাটি অবতীর্ণ হয়নি। চারটি ভাষণে সূরাটি সমাপ্ত হয়েছে।


প্রথম ভাষণ : প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু করে চতুর্থ রুকুর দ্বিতীয় আয়াত পর্যন্ত চলেছে। ১নং আয়াত থেকে ৩২নং আয়াত পর্যন্ত। এই ভাষণটি সম্ভবত বদর যুদ্ধের সমসাময়িক সময় নাযিল হয়।


দ্বিতীয় ভাষণ : এই ভাষণটি সূরার চতুর্থ রুকুর তৃতীয় আয়াত থেকে শুরু হয়ে ষষ্ঠ রুকুর শেষ পর্যন্ত চলেছে। ৩২নং আয়াত থেকে ৬৩নং আয়াত পর্যন্ত। নবম হিজরীতে আল্লাহর নবীর নিকট নাজরানের প্রতিনিধি দলের আগমনের সময় এটি নাযিল হয়।


তৃতীয় ভাষণ : এই ভাষণটি সূরার সপ্তম থেকে শুরু করে দ্বাদশ রুকুর শেষ পর্যন্ত চলেছে। ৬৪নং আয়াত থেকে ১২০নং আয়াত পর্যন্ত। বিষয় অনুযায়ী প্রথম ভাষণের সাথে সাথেই এটি নাযিল হয় বলে মনে হয়।


চতুর্থ ভাষণ : এই ভাষণটি সূরার ত্রৈদশ রুকু থেকে শুরু করে সূরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। ১২১নং আয়াত থেকে ২০০নং আয়াত পর্যন্ত। ওহুদ যুদ্ধের পর এটি নাযিল হয় বলে মনে হয়। (আল্লাহই বেশী ভাল জানেন)।

আজকের দারসের অংশটি চতুর্থ ভাষনে নাজিল হয়েছে।

সূরাটির বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয়ঃ এই সূরায় দু'টি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি দল হলো 'আহলি কিতাব' তথা ইহুদী ও নাসারা (খৃষ্টান) এবং অপর দলটি হলো স্বয়ং রাসূল (সাঃ) এর অনুসারী মুসলমান। সূরার প্রথমে 'আহলি কিতাব' তথা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে জোরাল ভাষায় তাদের আকীদাগত বিভ্রান্তি এবং চারিত্রীক দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে রাসূল (সঃ) এবং আল কুরআনকে মেনে নেয়ার আহবান জানানো হয়েছে।


অপর পক্ষে দ্বিতীয় দল আর্থাৎ রাসূল (সঃ) এর অনুসারী মুসলমানদেরকে শ্রেষ্ঠতম দলের মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের মহান দায়-দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যের পতাকা বহন এবং বিশ্ব মানবতার সংস্কার ও সংশোধনের জন্য পূর্ববর্তী উম্মতদের ধর্মীয় ও চারিত্রীক অধঃপতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে তাদের পদাঙ্কনুসরণ না করে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

একটি সংস্কারবাদী দল হিসেবে তারা কিভাবে তাদের দায়-দায়িত্ব পালন করবে এবং যেসব আহলি কিতাব ও মুনাফিক নামধারী মুসলমানেরা আল্লাহর দ্বীনের পথে নানা প্রকারের বাধা সৃষ্টি করছে তাদের সাথে কি ধরণের আচরণ করতে হবে, তাদেরকে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমান দলটির মধ্যে যেসব দূর্বলতা দেখা দিয়েছিলো তার পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে বিরাজমান দূর্বলতাকে দূর করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।


আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যা:

আয়াত: ১৩৩

وَ سَارِعُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَ الْاَرْضُ١ۙ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِیْنَۙ

দৌঁড়াও তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী ও আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের দিকে চলে গেছে, যা এমন সব আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরী করা হয়েছে।


আয়াত: ১৩৪

الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الْكٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَ الْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَۚ

যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ–ত্রুটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ‌ অত্যন্ত ভালোবাসেন।

আয়াত: ১৩৫

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللّٰهَ فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ١۪ وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللّٰهُ١۪۫ وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰى مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ

আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য মাফ চায় – কারণ আল্লাহ‌ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন – এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না,


আয়াত: ১৩৬

اُولٰٓئِكَ جَزَآؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا١ؕ وَ نِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِیْنَؕ

এ ধরনের লোকদের যে প্রতিদান তাদের রবের কাছে আছে তা হচ্ছে এই যে, তিনি তাদের মাফ করে দেবেন এবং এমন বাগীচায় তাদের প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সৎকাজ যারা করে তাদের জন্য কেমন চমৎকার প্রতিদান।

আয়াত: ১৩৭

قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ١ۙ فَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَانْظُرُوْا كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِیْنَ

তোমাদের আগে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে দেখে নাও যারা (আল্লাহর বিধান ও হিদায়াতকে) মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কি হয়েছে।


আয়াত: ১৩৮

هٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَ هُدًى وَّ مَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِیْنَ

এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ।


আয়াত: ১৩৯

وَ لَا تَهِنُوْا وَ لَا تَحْزَنُوْا وَ اَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ

মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।

আয়াত: ১৪০

اِنْ یَّمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهٗ١ؕ وَ تِلْكَ الْاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیْنَ النَّاسِ١ۚ وَ لِیَعْلَمَ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ یَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَآءَ١ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَۙ

এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও। এ–তো কালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি। এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ (সত্য ও ন্যায়ের) সাক্ষী হবে -কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ‌ পছন্দ করেন না।


আয়াত: ১৪১

وَ لِیُمَحِّصَ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ یَمْحَقَ الْكٰفِرِیْنَ

– এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা মুমিনদের বাছাই করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে চাইছিলেন।


আয়াত: ১৪২

اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَ لَمَّا یَعْلَمِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ جٰهَدُوْا مِنْكُمْ وَ یَعْلَمَ الصّٰبِرِیْنَ

তোমরা কি মনে করে রেখেছো তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনো আল্লাহ‌ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী।


আয়াত: ১৪৩

وَ لَقَدْ كُنْتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِنْ قَبْلِ اَنْ تَلْقَوْهُ١۪ فَقَدْ رَاَیْتُمُوْهُ وَ اَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ۠

তোমরা তো মৃত্যুর আকাংখা করছিলে! কিন্তু এটা ছিল তখনকার কথা যখন মৃত্যু সামনে আসেনি। তবে এখন তা তোমাদের সামনে এসে গেছে এবং তোমরা স্বচক্ষে তা দেখছো। 

আয়াত: ১৪৪

وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوْلٌ١ۚ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ١ؕ اَفَاۡئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰۤى اَعْقَابِكُمْ١ؕ وَ مَنْ یَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَیْهِ فَلَنْ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیْئًا١ؕ وَ سَیَجْزِی اللّٰهُ الشّٰكِرِیْن

মুহাম্মাদ একজন রসূল বৈ তো আর কিছুই নয়। তার আগে আরো অনেক রসূলও চলে গেছে। যদি সে মারা যায় বা নিহত হয়, তাহলে তোমরা কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? মনে রেখো, যে পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করবে না, তবে যারা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।


আয়াত: ১৪৫

وَ مَا كَانَ لِنَفْسٍ اَنْ تَمُوْتَ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ كِتٰبًا مُّؤَجَّلًا١ؕ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الدُّنْیَا نُؤْتِهٖ مِنْهَا١ۚ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الْاٰخِرَةِ نُؤْتِهٖ مِنْهَا١ؕ وَ سَنَجْزِی الشّٰكِرِیْنَ

কোন প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না। মৃত্যুর সময় তো লেখা আছে। যে ব্যক্তি দুনিয়াবী পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো। আর যে ব্যক্তি পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে সে পরকালের পুরস্কার পাবে এবং শোকরকারীদেরকে আমি অবশ্যি প্রতিদান দেবো।


আয়াত: ১৪৬

وَ كَاَیِّنْ مِّنْ نَّبِیٍّ قٰتَلَ١ۙ مَعَهٗ رِبِّیُّوْنَ كَثِیْرٌ١ۚ فَمَا وَ هَنُوْا لِمَاۤ اَصَابَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ مَا ضَعُفُوْا وَ مَا اسْتَكَانُوْا١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الصّٰبِرِیْنَ

এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ‌ ওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ‌ ভালবাসেন।


আয়াত: ১৪৭

وَ مَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ اِسْرَافَنَا فِیْۤ اَمْرِنَا وَ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ

তাদের দোয়া কেবল এতটুকুই ছিলঃ “হে আমাদের রব! আমাদের ভুল –ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দাও। আমাদের কাজের ব্যাপারে যেখানে তোমার সীমালংঘিত হয়েছে, তা তুমি মাফ করে দাও। আমাদের পা মজবুত করে দাও এবং কাফেরদের মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করো।”


আয়াত: ১৪৮

فَاٰتٰىهُمُ اللّٰهُ ثَوَابَ الدُّنْیَا وَ حُسْنَ ثَوَابِ الْاٰخِرَةِ١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ۠

শেষ পর্যন্ত আল্লাহ‌ তাদেরকে দুনিয়ার পুরস্কারও দিয়েছেন এবং তার চেয়ে ভালো আখেরাতের পুরস্কারও দান করেছেন। এ ধরনের সৎকর্মশীলদেরকে আল্লাহ‌ পছন্দ করেন।


শিক্ষা:
১. 
২. 
৩. 
৪. 
৫. 
৬. 

বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩

যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান | প্রেমরোগের চিকিৎসা | আবদুল হামীদ ফাইযী


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ১

১- প্রেম আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য এক বড় নেয়ামত। তা যথাস্থানে প্রয়োগ করা এক ইবাদত। আর তা অপপ্রয়োগ করা হল গোনাহর কাজ। অর্থাৎ অবৈধ প্রেম হল সচ্চরিত্রতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিবাহের পূর্বে হৃদয়ের আদান-প্রদান বা পছন্দ অথবা ভালোবাসার নামে যুবক-যুবতীর একত্রে ভ্রমণ-বিহার, নির্জনে খোশালাপ, অবাধ মিলামিশা ও দেখা-সাক্ষাৎ, গোপনে চিত্তবিনোদন প্রভৃতি আদর্শ ধর্ম ইসলামে বৈধ নয়। বর্তমান পরিবেশে কেবল সেই যুবকই অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে পারে, যার হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহর ভয় বুকে থাকলে শত বাধা ও বিপত্তির মাঝে চলার পথ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে -এই ভয়ে যে নিজের প্রবৃত্তি দমন করবে, তার ঠিকানা হবে বেহেশ্যে। বরং তার জন্য রয়েছে দুটি বেহেশ্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে থাকলে আল্লাহ বান্দাকে এমন নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে নেন। ঈমানে আল্লাহর প্রতি ইখলাস থাকলে তিনি বান্দাকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) ও যুলাইখার ব্যাপারে তিনি বলেন, “সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন। প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন।” (সূরা ইউসুফ ২৪ আয়াত)

সুতরাং মনের সন্দেহ ও কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হল ঈমান। ঈমান সুদৃঢ় রাখ, কারো অবৈধ ভালোবাসায় ফাসবে না এবং অবৈধ উপায়ে কেউ তোমার মন চুরি করতে পারবে না।

২- প্রেমরোগের সবচেয়ে বড় অব্যর্থ ও আসল ঔষধ হল ধৈর্য ও মনের দৃঢ়-সংকল্পতা এবং সুপুরুষের মত মনের স্থিরতা। ইচ্ছা পাকা থাকলে উপায়ের পথ বড় সহজ। ধৈর্য কঠিন হলেও তার পরিণাম বড় শুভ; যেমন গাছের ছাল তেঁতো হলেও তার ফল ভারি মিষ্টি।মনের খেয়াল-খুশীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়-সংকল্প হও যে, তুমি ঐ শয়তানী কুমন্ত্রণায় সায় দেবে না। শয়তান হল তোমার প্রধান শত্রু এবং এই প্রণয়ের প্রধান দূত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়---।” (সূরা নুর ২১ আয়াত)

অতএব ধৈর্যের সাথে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।

৩- নজর পড়ার সাথে সাথে মনের মানসপটে কোন রূপসীর ছবি অঙ্কিত হয়ে গেলে তার মন্দ দিকটা মনে করো। ভেবো, সে হয়তো আচমকা সুন্দরী, আসলে সুন্দরী নয়। নতুবা বোরকার ভিতরে হয়তো অসুন্দরী। নতুবা ওর হয়তো কোন অসুখ আছে। নতুবা ওর হয়তো বংশ ভালো নয়। নতুবা ওর হয়তো ঘর-বাড়ি ভালো নয়। নতুবা হয়তো ওর সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। নতুবা ও হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না। নতুবা ওর অতীত হয়তো কলঙ্কিত, ইত্যাদি। আঙ্গুর ফল নাগালের মধ্যে না পেলে টক মনে করলে মনে সবুর হয়।

তাছাড়া বেল পাকলে কাকের কি? দেখছ কি ভ্যাভ্যা? যার সরষে তার তেল! তাতে তোমার কাজও নেই, লাভও নেই।

৪- জীবনের প্রথম চাওয়াতে ভালো বলে যাকে তুমি ভালোবেসে মনের কাছে পেয়েছ, সেই তোমাকে ভালোবাসবে এবং সে ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, বা আর কেউ তোমার কদর করবে না এমন ধারণা ভুল। ভালো কে? যার মনে লাগে যে তোমার ঐ লায়লার চেয়ে আরো ভালো লায়লা পেতে পার। সুতরাং বিবাহের মাধ্যমেও প্রেমময়ী ও গুণবতী সঙ্গিনী পাবে। তবে অবৈধভাবে ওর পেছনে কেন?

৫- প্রেম-পাগলা মজনু বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসছ, যে তোমাকে তার চোখের ইশারায় প্রেমের জালে আবদ্ধ করেছে, আজ যাকে তুমি তোমার জানের জান মনে করছ, কাল হয়তো সে তোমার অভাব দেখে, কোন অসুখ দেখে, কোন ব্যবহার দেখে অথবা তোমার চাইতে ভালো আর কোন নাগরের ইশারা দেখে, তোমাকে টা-টা’ দিতে পারে। যে তোমার ইশারায় তার নিজের মা-বাপ, বংশ, মান-সম্ভ্রম প্রভৃতি অমান্য ও পদদলিত করে তোমার কাছে এসে যেতে পারে, সে যে তোমার ও তোমার মা-বাপের মান রাখবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কথাও জেনে রেখো যে, আজ তুমি মারা গেলে কাল সে আবার অন্যকে বিয়ে করে নতুন সংসারের নতুন বউ হবে। সুতরাং এমন প্রেমের প্রতিমার জন্য এত বলিদান কিসের?

প্রেমিক বন্ধু! পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্যময় জিনিস আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বেশী আশ্চর্যময় জিনিস হল মেয়ে মানুষের মন। সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। তাকে জয় করতে বড় পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকেও হিমসিম খেয়ে যায়। সুতরাং তুমি কে? তুমিও হয়তো। একদিন বলতে বাধ্য হবে যে,

এ তুমি আজ সে - তুমি তো নহ, আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী?
কিছু মেরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
---প্রাণ নিয়ে এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দলে অলক্তক পরে এরা পায়!

এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন প্রীতি।
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্থন,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি!
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন,
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন!

বন্ধু আমার যদি তুমি ভাব যে, সব নারী তো আর এক রকম নয়। আমার লায়লা আমাকে ধোকা দেবে না। কিন্তু এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় বন্ধু? তার কি কোন বন্ধনী বা বেষ্টনী আছে? আর একান্তই যদি তোমার ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবৈধ প্রেম খেলে কেন, লুকোচুরি করে ফিসফিসিয়ে কেন, গোপন প্রেম-পত্র লিখে কেন? বরং বৈধ উপায়ে পয়গাম পাঠিয়ে তাকে তোমার প্রণয়-সুত্রে গেঁথে নাও। হালাল উপায়ে তুমি তাকে তোমার জীবনে নিয়ে এস এবং আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করো না।

৬- কোন তরুণীর রূপ দেখেই ধোকা খেয়ো না বন্ধু! প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাই হল একমাত্র বিশ্বসুন্দরী। কিন্তু সে তো আবেগের খেয়াল, বাস্তব নয়। তাছাড়া দ্বীন ও চরিত্র না দেখে কেবল রূপে মজে গেলে সংসার যে সুখের হবে, তা ভেবো না। কারণ, চকচক করলেই সোনা হয় না। কাচ না কাঞ্চন তা যাচাই-বাছাই করা জ্ঞানী মানুষের কাজ। পরন্তু ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব ক’দিনের জন্য? তাই অন্তরের সৌন্দর্য দেখা উচিত। আর সত্যিকারের সে সৌন্দর্য কপালের দুটি চোখ দিয়ে নয়, বরং মন ও জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি দিয়েই দেখা সম্ভব। অতএব সেই মন যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পার তাহলে তুমি ‘ইন্না লিল্লাহ-- পড়। আর জেনে রেখো যে, এমন সৌন্দর্য ও দ্বীন ও গুণের অধিকারিণী রমণী কোন দিন লুকোচুরি করে তোমার সাথে প্রেম করতে আসবে না।

৭- স্ত্রী হল জীবনের চিরসঙ্গিনী। সংসারে যত রকমের সম্পদ ও ধন মানুষ পায়, তার মধ্যে পুণ্যময়ী স্ত্রীই হল সব চাইতে বড় ও শ্রেষ্ঠ ধন। সুখ ও দুঃখের সময় সাথের সাথী এই স্ত্রী। এই স্ত্রী ও সাথী নির্বাচন করতে হলে মনের আবেগ ও উপচীয়মান যৌবনের প্রেম ও কামনা দ্বারা নয়; বরং বিবেক ও মন দ্বারা দ্বীন ও চরিত্র দেখে ভেবে-চিন্তে নির্বাচন করতে হয়। তাহলেই পরিশেষে ঠকতে ও পস্তাতে হয় না।

৮- কারো চোখের অশ্রুর কথা বলছ? তবে জেনে রেখো যে, মেয়েদের চোখ থেকে দু’ রকমের অশ্রু ঝরে থাকে; একটি দুঃখের, অন্যটি ছলনার। আর এটাও তোমার মন ও প্রেমের আবেগ দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞার বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে।

প্রেম-বিহুল বন্ধু আমার পূর্বেই বলেছি, সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। নারীকে ছোট ও দুর্বল ভেবো না। সমুদ্র-উপকূলে দাঁড়িয়ে মহাসমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, ঠিক কোন নারীর ততটুকুই অংশ দেখা সম্ভব হয়। নারী দুয়ে, অজেয় নারীর মন। আর আমার মনে হয় যে, তুমি নিশ্চয়ই দিগবিজয়ী বীর নও।

৯- তুমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, সে ধনীর মেয়ে নয় তো? অর্থাৎ, কোন প্রকারে সে তোমার জীবনে এসে গেলে, তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বাসনা পূর্ণ করে চলতে পারবে তো? যদি তা না হয় তাহলে শোন, দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং প্রেমের নামে নিজের জীবনে বঞ্চনা ও অভিশাপ ডেকে এনো না।

আবার কাউকে শুধু ভালো লাগলেই হয় না। তুমি তার বা তাদের পরিবেশ ও বাড়ির উপযুক্ত কি না, তাও ভেবে দেখ। নচেৎ বাওনের চাদ চাওয়ার মত ব্যাপার হলে শুধু শুধু মনে কষ্ট এনে লাভ কি? তাছাড়া তুমি যদি তোমার শিক্ষা, চরিত্র, ব্যবহার ও সাংসারিক যোগ্যতায় তাদেরকে মুগ্ধ করতে পার, তাহলে গরীব হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। আর তুমিই হবে তাদের যোগ্য জামাই। পক্ষান্তরে লুকোচুরিতে চরিত্র নষ্ট করে থাকলে তুমি তাদের চোখে খারাপ হয়ে যাবে। শেষে আর জামাইও হতে পারবে না।

১০- প্রেম-ভিখারী বন্ধু আমার! প্রেম যদি করতেই চাও তাহলে ক্ষণস্থায়ী এ ঢলন্ত-যৌবনা ফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কেন? অসৎচরিত্রা অসতীদের সাথে কেন? হ্যা, সে অসতী বৈকি? যে তোমার সাথে অবৈধভাবে প্রেম করতে আসে, অবাধ মিলামিশ, দেখা-সাক্ষাৎ, চোখাচোখি, হাসাহাসি করে সে অসতী বৈকি?

সুতরাং প্রেম যদি করতেই হয় তাহলে চিরকুমারী অনন্ত-যৌবনা, অফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কর। কাঞ্চন-বদনা, সুনয়না, আয়তলোচনা, লজ্জা-বিনম্র, প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ, উদ্ভিন্ন-যৌবনা ষােড়শীদের সাথে কর। যে তরুণীরা হবে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা, যারা তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি নজর তুলেও দেখবে না। যে সুরভিতা রূপসীদের কেউ যদি পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি মারে, তাহলে তার ঝলমলে রূপালোকে ও সৌরভে সারা বিশ্বজগৎ আলোকিত ও সুরভিত হয়ে উঠবে। যে সুরমার কেবলমাত্র মাথার ওড়না খানিকে পৃথিবী ও তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও ক্রয় করা সম্ভব হবে না। (বুখারী ৬৫৬৮ নং)।

সুতরাং হালাল উপায়ে বিবাহ কর এবং তার সাথেই প্রেম কর। আর উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে ঐ রূপসীদেরকে বিবাহ করার জন্য দেন-মোহর সংগ্রহ করতে লেগে যাও।

১১- অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে নির্জনতা ত্যাগ কর। কারণ, নির্জনতায় ঐ শ্রেণীর কুবাসনা মনে স্থান পায় বেশী। অতএব সকল অসৎ-চরিত্রের বন্ধু থেকে দুরে থেকে সৎ-বন্ধু গ্রহণ করে বিভিন্ন সৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হও। আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দাও। বিভিন্ন ফলপ্রসু বইপুস্তক পাঠ কর। সম্ভব হলে সে জায়গা একেবারে বর্জন কর, যে জায়গায় পা রাখলে তার সহিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যে তোমার মন চুরি করে রেখেছে। টেলিফোন এলে তার কথার উত্তর দিও না। পত্র এলে জবাব দিও না। তোমার প্রণয়ের ব্যাপারে তাকে আশকারা দিও না। এমন ব্যবহার তাকে প্রদর্শন করো না, যার ফলে সে তোমার প্রতি আশা ও ভরসা করে ফেলতে পারে। বরং পারলে তাকে নসীহত করো এবং এমন অসৎ উপায় বর্জন করতে উপদেশ দিও। তাতে ফল না হলে পরিশেষে ধমক দিয়েও তাকে বিদায় দিও। আর বেকার বসে থেকো না। কোন না কোন কাজে, নিজের কাজ না থাকলে কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা কর।

একা না ঘুমিয়ে কোন আত্মীয়, ভাই বা হিতাকাঙ্খী সৎ-বন্ধুর কাছে ঘুমাবার চেষ্টা কর। রাত্রে ঘুম না এলে যত কুরআন ও শয়নকালের দুআ মুখস্থ আছে শুয়ে শুয়ে সব পড়ে শেষ। করার চেষ্টা কর। 'সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার, আহামদু লিল্লাহ’ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার” ৩৪ বার পাঠ কর। তার পরেও ঘুম না এলে, ঘুম না হলে তোমার কোন ক্ষতি হবে -এমন ভেবো না। অথবা রাত পার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে মনে আক্ষেপ করো না। এমন ভাবলে ও করলে আরো ঘুম আসতে চাইবে না। অতঃপর একান্ত ঘুম যদি নাই আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে নামায পড়তে শুরু কর। এর মাঝে ঘুমের আবেশ পেলে শুয়ে পড়। ঘুম না এলে বিছানায় উল্টাপাল্টা করলে অন্যান্য দুআ পড়ার পর এই দুআ পড়, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্দুস সামাওয়াতি অআরযি অমা বাইনাহুমাল আযীযুল গাফফার।

১২- গান-বাজনা শোনা থেকে দূরে থাক। কারণ, পুর্বেই জেনেছ যে, গানে যুব-মন প্রশান্তি পায় না; বরং মনের আগুনকে দ্বিগুণ করে জ্বালিয়ে তোলে। সুতরাং প্রেমময় মনের দুর্বলতা দূর করতে অধিকাধিক কবর যিয়ারত কর, জানাযায় শরীক হও, মরণকে স্মরণ কর। উলামাদের ওয়ায-মাহফিলে উপস্থিত হও, তাদের বক্তৃতার ক্যাসেট শোন।

১৩- অভিনয় দেখা পরিহার কর। কারণ, ফি-যাত্রা-নাটক-থিয়েটার ইত্যাদি তো প্রেমের আগুনে পেট্রোল ঢালে। আর এ সব এমন জিনিস যে, তাতে থাকে অতিরঞ্জিত প্রেম। অবাস্তব কাল্পনিক প্রেম-কাহিনী ও রোমান্টিক ঘটনাবলী। অতএব সে অভিনয় দেখে তুমি ভাবতে পার যে, তুমিও ঐ হিরোর মত প্রেমিক হতে পারবে, অথবা ঐ হিরোইনের মত তুমিও একজন প্রেমিকা পাবে, অথবা ঐ অভিনীত প্রেম তোমার বাস্তব-জীবনেও ঘটবে। অথচ সে ধারণা তোমার ভুল। পক্ষান্তরে ঐ সকল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গমঞ্চের ধারে-পাশে উপস্থিত হয়ে চিত্তবিনোদন করার মত গুণ আল্লাহর বান্দাদের নয়; বরং প্রবৃত্তির গোলামদের।

১৪- যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাকে কখনো একা নির্জনে কাছে পাওয়ার আশা ও চেষ্টা করো না। ব্যভিচার থেকে দুরে থাকলেও দর্শন ও আলাপনকে ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করো না। জেনে রেখো বন্ধু! যারা মহা অগ্নিকান্ডকে ভয় করে তাদের উচিত, আগুনের ছোট্ট অঙ্গার টুকরাকেও ভয় করা। উচিত নয় ছোট্ট এমন কিছুকে অবজ্ঞা করা, যা হল বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভূমিকা। ছোট্ট মশা নমরুদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছোট ছোট পাখীদল। হস্তিবাহিনী সহ আবরাহাকে ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ছিদ্র একটি বিশাল পানি-জাহাজকে সমুদ্র-তলে ডুবিয়ে দিতে পারে। বিছার কামড়ে সাপ মারা যেতে পারে। সামান্য বিষে মানুষ মারা যায়। ক্ষুদ্র হুদহুদ পাখী বিলকীস রাণীর রাজত্ব ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ইদুর কত শত শহর ভাসিয়ে দিতে পারে বন্যা এনে। আর এ কথাও শুনে থাকবে যে, হাতির কানে নগণ্য পিঁপড়া প্রবেশ করলে অনেক সময় হাতি তার কারণেই মারা যায়।


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ২

১৫- প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চোখ, কান, জিভ, হাত, পা এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের ব্যভিচার সংঘটিত করে অবৈধ পিরীত। প্রিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়া হল পায়ের ব্যভিচার। অতএব প্রেয়সীর প্রতি যে পথে ও পায়ে তুমি চলতে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত নও, সেই পথের উপর তোমার পায়ের নিশানা ও দাগকে কোন দিন ভয় করেছ কি?

ভেবেছ কি যে, তোমার ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক নিশানা সযত্নে হিফাযত করে রাখা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “আমিই মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা ওরা অগ্রে পাঠায় ও পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিসই স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসীন ১২) প্রিয়তমার সাথে খোশালাপ হল জিভের ব্যভিচার। গোপন প্রিয়ার সাথে প্রেম-জীবনের সুমিষ্ট কথার রসালাপ তথা মিলনের স্বাদ বড় তৃপ্তিকর। কিন্তু বন্ধু! এমন সুখ তো ক্ষণিকের জন্য। তাছাড়া এমন সুখ ও স্বাদের কি মূল্য থাকতে পারে, যার পরবর্তীকালে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। যে জিভ নিয়ে তুমি তোমার প্রণয়িণীর সাথে কথা বল, সে জিভের সকল কথা রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে, তা তুমি ভেবে দেখেছ কি? মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের নিকটই আছে।” (সূরা ক্বাফ ৫০ আয়াত)

রসিক নাগর বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে তুমি প্রেমিকার সাথে মিলে যে পাপ করছ, সে পাপ কি ছোট ভেবেছ? ভেবে দেখ, হয়তো তোমাদের মাঝে এমন পাপও ঘটে যেতে পারে, যার। পার্থিব শাস্তি হল একশত কশাঘাত, নচেৎ প্রস্তরাঘাতে খুন। কিন্তু দুনিয়াতে এ শাস্তি থেকে কোন রকমে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আছে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লী। অতএব যে পুকুরের জল খাব না, সে পুকুরের পাড় দিয়ে যাব না’ -এটাই সুপুরুষের দৃঢ়সংকল্প হওয়া উচিত নয় কি? ভেবেছ কি যে, তুমি তোমার ভালোবাসার সাথে যে অবৈধ প্রেমকেলি, প্রমোদ-বিহার করছ, তা ভিডিও-রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রীতির স্মৃতি রাখতে গিয়ে অনেক সময় যে ছবি তোমরা অবৈধ ও অশ্লীলভাবে তুলে রাখছ, তা একদিন ফাস হয়ে যাবে।

এ সব কিছুই মানুষের চোখে ফাকি দিয়ে করলেও কাল কিয়ামতে তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে। “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত) এবং তার যথার্থ প্রতিদানও পাবে। প্রেম-সুখী বন্ধু আমার! যে মাটির উপর তুমি ঐ অশ্লীলতা প্রেমের নামে করছ, সেই মাটি তোমার গোপন ভেদ গ্রামোফোন রেকর্ডের মত রেকর্ড করে রাখছে। কাল কিয়ামতে সে তা প্রকাশ করে দেবে। পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (ঐ ৪ আয়াত)

বন্ধু আমার। তুমি হয়তো তোমার ঐ প্রেমকেলিতে মানুষকে ভয় করছ, মা-বাপকে লজ্জা করছ। কিন্তু সদাজাগ্রত সেই সর্বস্রষ্টাকে লজ্জা ও ভয় করেছ কি? যে স্রষ্টা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ তোমার দেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার তৈরী দেহকে তারই অবাধ্যাচরণে ব্যবহার করছ। এ কথা তো তুমি বিশ্বাস কর যে, আমাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দান। আমাদের ব্যবহারের জন্য তিনি আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথাস্থানে স্থাপন করে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিয়ামতে যখন আমরা আমাদের স্বকৃত পাপের কথা ভয়ে অস্বীকার করে বসব, তখন ঐ অঙ্গসমূহ কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাক্ষি দেবে। (সূরা ইয়াসীন ৬৫ আয়াত)

সুতরাং এ দেহ আল্লাহর মালিকানায়, আমাদের মালিকানায় নয়। এ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যদি তার অবাধ্যাচরণ ও বিরোধিতায় প্রয়োগ করি তাহলে তার চেয়ে বড় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে তার ইবাদত করার জন্য পাঠালেন দুনিয়াতে এবং তার মহা প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন আখেরাতে। কিন্তু বান্দা যদি সেই প্রতিশ্রুতির কথা, আখেরাত ও মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াই সর্বশেষ মনে করে, তবে নিশ্চয়ই তা লজ্জার কথা। এ জন্যই মহানবী %ি বলেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা তো -আলহামদু লিল্লাহ- আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি। তিনি বললেন, “না ঐরূপ নয়।

আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান)কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (লিঙ্গ, হাত, পা ও হৃদয়)কে (তার অবাধ্যাচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সব কিছু করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” (সহীহ তিরমিযী ২০০০ নং)

ভেবেছ কি বন্ধু! তোমার চোখ, কান, হাত, পা এবং শরীরের চামড়া পর্যন্ত কাল কিয়ামত কোর্টে আল্লাহর সামনে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে? কুরআন বলে, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকট পৌছবে, তখন ওদের চোখ, কান ও ত্বক ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে---” (সূরা ফুসিলাত ২০ আয়াত) “যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিভ, তাদের হাত ও তাদের পা, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (সূর নুর ২৪ আয়াত)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে ভয়ে নতজান হতে দেখবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার । আমলনামা (কর্মলিপি) দেখতে আহ্বান করা হবে। আর বলা হবে, তোমরা যা করতে আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। আমার নিকট সংরক্ষিত এই আমলনামা, যা সত্যভাবে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম।” (সূরা জাসিয়াহ ২৭-২৯ আয়াত) “ওরা কি মনে করে যে, আমি ওদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশ্তাগণ তো ওদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৮০ আয়াত)

গোপন-প্রেমিক বন্ধু আমার! ভালোবাসার নামে একজন উদাসীনা তরুণীকে গোপনে তার পিত্রালয় থেকে বের করে এনে কোন জায়গায় কোন মুন্সীকে ৫০/ ১০০ টাকা দিয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘরের বউ করে তুলে আনলে, সে যে তোমার জন্য হালাল হবে না, তা তুমি জান কি? মহানবী ৪ বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই নিজে নিজে বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ৩১৩১নং)।

অর্থাৎ, ঐ বউ নিয়ে সংসার করলে চির জীবন ব্যভিচার করা হবে। যেমন ব্যভিচার হবে স্ত্রী থাকতে আপন শালীর প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে তাকেও বউ করে ঘরে আনলে। যেমন দারুণ স্পর্শকাতর ঢাকঢাক গুড়গুড়’ পরিস্থিতিতে প্রিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করা অবস্থায় গোপনে চটপট লজ্জা ঢাকার জন্য বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হলেও তাকে নিয়ে সংসার বৈধ নয়। কারণ, বিবাহের পূর্বে বর-কনেকে ‘কোর্টশীপ বা হৃদয়ের আদান-প্রদানের কোন সুযোগ ইসলাম দেয়নি। আর সেক্সী কোন টেস্ট-পরীক্ষা তো নয়ই। অবশ্য উভয়ের জন্য একে অপরকে কেবল দেখে নেওয়ার অনুমতি আছে। তাছাড়া মহিলার গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ হয় না। সন্তান-প্রসবের পরই বিবাহ সম্ভব; যদিও সন্তান ঐ প্রেমিকেরই, যার সহিত প্রেমিকার বিবাহ হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে বিবাহ ও তালাককে এক প্রকার খেলা’ মনে করা হলেও, আসলে তা কিন্তু ঐ ধরনের কোন খেলা’ নয়।

সুতরাং নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োগ করতে চাইলে আল্লাহর বিধানে তা বাতিল গণ্য হবে। জেনে রাখা ভালো যে, জোরপূর্বক কোন তরুণীকে বিবাহ করলে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। যেমন কারো বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবেসে তুলে এনে তার সম্মতিক্রমে হলেও পূর্ব স্বামী তালাক না। দেওয়া পর্যন্ত এবং তার অভিভাবক সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত বিবাহ শুদ্ধ হয় না। তাকে নিয়ে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এ ছাড়া ভাইঝি, বোনঝি, সৎ মা, শাশুড়ী প্রভৃতি এগানা নারীর সাথে প্রেম ও ব্যভিচার করা সবচেয়ে বড় পশুত্ব! ১৬- কুলকুল-তান যৌবনের যুবক বন্ধু আমার! যদি কাউকে ভালো লেগেই যায়, তাহলে হালাল ও বিধেয় উপায়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা কর। আর ভেবো না যে, প্রেম করে বিয়ে বেশী সুখময়। বরং বিয়ে করলেই দায়িত্ববোধের সাথে প্রেমের চেতনা অধিক বাড়ে। এ পবিত্র প্রেমে কোন প্রকার ধোকা থাকে না, থাকে না কোন প্রকার অভিনয় ও কপটতা। যে নির্মল প্রেমে থাকে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। আর এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী # বলেন, “প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য বিবাহের মত অন্য কিছু (বিকল্প) নেই।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫২০০ নং)

অতএব প্রেম প্রকাশ ও বৃদ্ধি করা জন্য, প্রেমের ডালি খালি করার জন্য, প্রেম অনির্বাণ রাখার জন্য, প্রেম-রোগ উপশম করার জন্য, পবিত্র বিবাহ-বন্ধনের মত আর অন্য কোন বিকল্প গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহর কাছে দুআ করে গোপনে তোমার মানুষটিকে চেয়ে নাও এবং তাঁর নিকট হারামকারিতা থেকে শতবার পানাহ চাও। আর উপযুক্ত লোক লাগিয়ে বৈধ উপায়ে তাকে তোমার জীবন-সঙ্গিনী করে নাও। যে রতি হয়ে তোমার মনে এসেছিল, তাকে সতী হয়ে তোমার ঘরে আসতে দাও। যে প্রিয়া হয়ে প্রেমে ছিল, সে বধু হয়ে তোমার অধরে আসুক। যে তোমার দ্রাক্ষা-বুকে শিরীন-শারাব’ হয়ে এতদিন গোপনে লুকিয়ে ছিল, সে এবার প্রকাশ্যে তোমার পেয়ালায় এসে যাক।

কিন্তু একান্তই তোমার আশা যদি দুরাশা হয়ে থাকে, তুমি যেমন পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতে বড় যদি চাওয়া হয়ে থাকে, অথবা অন্য কোন কারণে যদি তুমি তোমার গোপন প্রিয়াকে তোমার জীবন-তরীতে না-ই পেয়ে থাক, তাহলে দুঃখ করো না। নিশ্চয়ই তাতে তোমার কোন মঙ্গল আছেই আছে, তাই তুমি তাকে পাওনি৷ অতএব এ ক্ষেত্রে তাকে মনে চাপা দেওয়ার জন্য খোজ করে তার চেয়ে বা তারই মত একজন (দ্বীনদার) সুন্দরীকে তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে ফেল। এটাই তোমার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য উত্তম। এতে তোমার পূর্ব নেশা কেটে যাবে, মন স্থির হয়ে সংসার সুখের হবে এবং ফাটা ও কাটা মনে

প্রলেপ পড়বে। আর বিবাহ যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে অবৈধ প্রণয় ও যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করতে আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর। ইনশাআল্লাহ, তোমার মনের সকল অঅসা’ দুর হয়ে যাবে, কারণ, রোযা হল তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির কারখানা।

নারী-পাগলা বন্ধু আমার! পুরুষের পক্ষে নারীর ফিতনার মত বড় ফিতনা আর অন্য কিছু নেই। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।” (আহমাদ, বুখারী ৫০ ৯৬, মুসলিম ২৭৪০ নৎ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) নারী-ঘটিত ফিতনা অথবা নারীকে কেন্দ্র করে ঘটিত ফিতনার হার এ জগতে কম নয়। আর এই ফিতনায় পুরুষের ধন যায়, জ্ঞান হারায়, মান হারায়, দ্বীন হারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণও হারায়। তাই তো মহানবী (সা.) পুরুষকে সাবধান করে বলেন, “অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।” (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০ নং)

শয়তানের যেমন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে, পুরুষের ব্যাপারে নারীরও বিভিন্ন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উভয়ের চক্রান্তের কথা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিতাড়িত শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশলের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, “নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা ৭৬ আয়াত) পক্ষান্তরে নারীর কৌশল ও ছলনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তোমাদের ছলনা ভীষণ!” (সূরা ইউসুফ ২৮ আয়াত)

সুতরাং জ্ঞানী বন্ধু! সাবধান থেকো। শয়তান ও নারীর চক্রান্ত-জালে ফেঁসে গিয়ে নিজের দ্বীনদুনিয়া বরবাদ করে দিও না। কেউ যদি তোমার কাছে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়, তবে সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার ছলনায় সাড়া দিও না। আর মনে রেখো যে, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,) ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।

সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম ১০৩১নং) ছলনাময়ী নারীর চক্রান্তে যাতে না পড়, তার জন্য বাংলা প্রবাদেও সতর্কবাণী এসেছে, তা মনে রেখো, কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো ঢেমনের বোলে। ঠিকই তো বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি। আর তাছাড়া জলের রেখা, খলের পিরীত’ থাকেও না বেশীক্ষণ। এ ধরনের চক্রান্তময় প্রেমে থাকে এক প্রকার সুড়সুড়ি, এক ধরনের স্বার্থ। যা শেষ হলে সব শেষ। সুতরাং মনে রেখো বন্ধু আমার! ‘জল-জঙ্গলনারী, এ তিনে বিশ্বাস নাই, বড়ই মন্দকারী।

নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এবং অনেকে নারীকে সামান্য জ্ঞান করলেও আসলে মনের দিক দিয়ে নারী বিশাল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হল নারীর মন। সুবিস্তৃত মেঘমালা এবং ক্ষিপ্রপামী বাতাসের গতিবেগ হয়তো নির্ণয় করা সহজ; কিন্তু নারীর মনের গতিবেগ নির্ণয় করা মোটেই সহজ নয়। তা মাপা বা অনুমান করা আদৌ আসান নয়। আর এ জন্যই অনেকে সরল মনে নারীর ছলনার গরল পান করে ধোকা খায়।

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া।

অতএব বন্ধু আমার! এমন নারীর ছলনা থেকে বাঁচার জন্য, এমন নারীর ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য তুমি হযরত ইউসুফ নবী (আঃ) এর মত দুআ কর,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ

অর্থাৎ, হে পরোয়ারদেগার! ওরা আমাকে যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করছে, তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি আমাকে ওদের ছলনা হতে রক্ষা না কর, তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা ইউসুফ ৩৩)।

মানুষের মন হল ফাকা ময়দানে পড়ে থাকা এক টুকরা হাল্কা পালকের মত। বাতাসের সামান্য দোলায় সে মন দুলতে থাকে, হিলতে থাকে, ছুটতে থাকে। মন হল পরিবর্তনশীল। সে মন থাকে আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে। তিনি মানুষের মন ঘুরিয়ে ও ফিরিয়ে থাকেন। অতএব এ বলেও দুআ করো তার কাছে,

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
অর্থাৎ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।

-কপিরাইট: আবদুল হামীদ ফাইযী