Close

Tuesday, January 21, 2025

মিডিয়াতে অপপ্রচার ও আমাদের দায়িত্ব - ইউনুছ আব্দুদ্দাইয়ান

আগেকার দিনে চিঠি বা দূত পাঠিয়ে সংবাদের আদান প্রদান হতো। আল্লাহর রাসূল (সা) মাঝে মধ্যে পাহাড়ের উপরে উঠে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করতেন যাতে করে দুরবর্তী লোকেরাও তাঁর কথা শুনতে পায় এবং তাঁকে দেখতে পান। রাসূলে কারীম (সা) মাঝে মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাটিতে লাঠি দ্বারা চিত্র অংকন করে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝাতেন। কালপরিক্রমায় প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক এই দুই ধরনের মিডিয়ার সাথে আমরা পরিচতি হই। বর্তমানে এর সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন ও সোশাল মিডিয়া। মূলত সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, লিফলেট, পোস্টার, ওয়েবসাইট প্রভৃতির মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবর জানা যায়। বিশেষভাবে অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে যেকোন সংবাদ বিশ্বের আনাচে কানাচে অতিদ্রুত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। এরফলে জনমত গড়ে উঠে। আরব বসন্তের কথা আমরা জানি। আরব বসসন্ত ও পরবর্তীতে পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সরকার পরিবর্তনে কিংবা সরকার বিরোধী বিক্ষোভে জনমত গঠনে সোশাল মিডিয়া তথা টুইটার, ফেইসবুক ও ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজকের তরুণ সমাজ অনলাইন মিডিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট। অডিও, ভিডিও, কার্টুন ইউটিউবই ইন্টারনেটে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ টেলিভিশন দেখে। অতএব, মিডিয়া বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। জিম মরিসন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, Whoever controles the media- controls the mind.

মিডিয়া কোনো একজন ব্যক্তি, বা সংগঠন কিংবা দেশের ইমেজ বৃদ্ধি বা নষ্ট করার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। একজন ভালো মানুষও মিডিয়ার অব্যাহত অপপ্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে খারাপ মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে পারে। আমরা দেখি অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে যায় মিডিয়া কভারেজের অভাবে। আর মিডিয়া কভারেজ পেয়ে অনেক নন ইস্যুও ইস্যুতে পরিণত হতে সময় লাগেনা। অখ্যাত যে কোনো ব্যক্তি মিডিয়ার কভারেজ পেয়ে বিশ্ব পরিচিতি লাভ করতে পারে। আফগানিস্তানের কিশোরী মালালা মিডিয়ার বদৌলতেই বিশ্বে এতো খ্যতি অর্জন করেছেন। অথচ মালালার মতো লাখো শিশু-কিশোর পৃথিবীর আনাচে কানাচে নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তার খবরও কেউ জানেনা। মিডিয়ার প্রচারণার ফলেই অল্প সময়ে মানুষের মধ্যে কোনো আদর্শ জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে। আবার কোনো আদর্শ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে বিশ্বজনমত গঠনে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

কিন্তু দু:খজনক বাস্তবতা এই যে বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংস্থাগুলো ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে। রয়টারের ৮০% কর্মকর্তা-কর্মচারী ইহুদী। এসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর ৯০% পুঁজিই ইহুদীদের। আমেরিকান ব্রড কাস্টিং কর্পরোরেশান (এবিসি), ন্যাশনাল ব্রড কাস্টিং সিস্টেম (এনবি এস), ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সি এন এন), ফ্রান্স নিউজ এজেন্সেী, বিবিসি প্রভৃতি সংবাদ সংস্থা ইহুদী নিয়ন্ত্রিত। অঅন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পত্রের মধ্যে লন্ডন টাইমস, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, অবজারভার প্রভৃতি পত্রপত্রিকাও ইহুদী নিয়ন্ত্রণাধীন। ইহুদীরা মুসলমানদের এক নম্বর শত্রু। তাই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে মুসলমানদেরকে মৌলবাদী (Fundamentalist), সাম্প্রদায়িক (Communal) বর্বর সন্ত্রাসী (Terrorist) হিসেবে চিত্রিত করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের নবজাগরণ ঠেকাতে চায়। মুসলিম দেশগুলোতেও তাদের দালালরা একই পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলাম, ইসলামী অন্দোলন ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে। পাশ্চাত্যের মিথ্যা প্রচারণায় মুসলমানরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েও উল্টো ‘টেরোরিস্ট’ হিসেবে চিহিৃত হচ্ছে।

মিডিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্তমানে কাউকে বুঝাতে হবে বলে আমার মনে হয়না। ইসলামের বিরোধিতা যেভাবেই করা হোকনা কেন তার মোকাবিলায় ভূমিকা পালন করা মুসলমানদের উপর অপরিহার্য। যদি মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের বিরোধিতা করা হয় তাহলে মিডিয়ার মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিরোধিতা হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। যদি বুদ্ধিবৃত্তিক কুট কৌশলে বিরোধিতা হয় বৃদ্ধিবৃত্তিক কুটকৌশলের মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। কলমের মাধ্যমে বিরোধিতা হলে কলমের মাধ্যমে জবাব দিতে হবে। মিডিয়া অপপ্রচারের জবাব মিডিয়ার মাধমে না দিয়ে অন্যভাবে দেয়া যায়না। এই প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “শত্রুর মোকাবিলার জন্য যত বেশি সম্ভব যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সদাপ্রস্তুত অশ্ব বাহিনী সংগ্রহ করে রাখো। এসব নিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রুদের এবং তারা ছাড়া আরও কিছু লোককে যাদের তোমরা চেননা, আল্লাহ চেনেন, ভীত ও সন্ত্রস্ত করে দিতে পারবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করো তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে। তোমাদের উপর কোনোক্রমেই যুলম করা হবেনা’ -আনফাল ৬০।

আল্লাহ তায়ালা এখানে কুওয়াত বা শক্তি অর্জনের কথা বলেছেন। বর্তমানে আধুনিক যে সমরাস্ত্র আছে তার শক্তি, জ্ঞানের শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রাসূলের যুগে তীর ও অশ্ব যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন ছিল তাই তিনি তা সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সময় বৈষয়িক প্রস্তুতি কাফেরদের তুলনায় কম থাকলেও এমনটি কখনও হয়নি যে, তিনি আদৌ কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। তাই ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচার মোকাবিলায় বিকল্প মিডিয়া করার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়নে চেষ্টা করা মিডিয়া জিহাদের অন্তর্ভুক্ত।

আফসোসের বিষয় হচ্ছে, অনেকেই মুসলমানদের শক্তিশালী মিডিয়া নাই কেন তার জন্য নানা ধরনের প্রশ্ন করছেন। অথচ তাঁদের সামনে যখন মিডিয়ার কোনো প্রজেক্ট প্রস্তাবনা দেয়া হয় তখন তাঁরা বলে বসেন, “টাকা মিডিয়াতে ইনভেস্ট করলে কি লাভ হবে”? অমুক ব্যবসাতে খাটালে এতো % লাভ হবে। আমি মনে করি শুধু নগদ জাগতিক লাভ নয় বরং মিডিয়া চ্যলেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন, প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করা ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া উদ্যোগসমূহকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড কিছু মিডিয়াতে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েতই কম। তবে ইউরোপে এখনও মূলধারার কোনো মিডিয়া মুসলমানদের নেই বললেই চলে। তাই মুসলমানদেরকে এই দিকে গুরুত্বের সাথে নজর দেয়া উচিত।

এছাড়া প্রতিনিয়ত মিডিয়াতে ইসলাম সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়। সে সম্পর্কে ভারসাম্যমূলক জবাব আসা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলমানদের তেমন কোনো স্পোকসম্যান নেই। তাই মিডিয়াতে ভারসাম্যমূলক বক্তব্য তুলে ধরার মতো যোগ্য লোক তৈরি করতে হবে। মিডিয়াতে নেতিবাচক প্রচারণার ফলে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত রূপ মিডিয়াতে তুলে ধরা। কিন্তু কারো কারো প্রবণতা হচ্ছে বসে বসে শুধু সমালোচনা করা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, সমালোচনা করা সহজ কিন্তু বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং উক্ত উদ্যোগকে সফল করা কঠিন। এছাড়া মিডিয়াতে ভূমিকা রাখার মতো যাদের যোগ্যতা আছে তারা প্রতিনিয়ত লেখা-লেখি করা এবং শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

মিডিয়া কর্মীদেরকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা দরকার। আর মুসলমানদেরকেও নিজস্ব মিডিয়া তৈরি করার প্রতি সিরিয়াস হতে হবে এবং মুসলিম মিডিয়া কর্মীদেরকে মেইনস্ট্রিম মিডয়াসমূহে কাজ করার প্রতি আগ্রহী হতে হবে। পাশ্চাত্যের মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা মিডিয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আসল পথ নয়। এর আসল জবাব হচ্ছে ‘বিকল্প শক্তিশালী মিডিয়া’।

মিডিয়াতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণার ইতিবাচক ফলও রয়েছে। পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তাশীল মিডিয়াতে ঢালাওভাবে ইসলাম সম্পর্কে বিষোদাগার করায় তারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং তাদের মনের নানা প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে সত্যের সন্ধ্যান খুঁজে পান। এছাড়া মুসলমানদের একটি অংশ যারা ইসলাম ভালোভাবে জানতোনা তারা সহকর্মী ও বন্ধুদের নানা প্রশ্নের সঠিক জবাব জানতে গিয়ে নিজেরা ভালোভাবে ইসলাম জানার চেষ্টা করছে। এরফলে যেসব মুসলমান আগে ইসলাম অনুশীলন করতেননা তাঁরা ইসলাম অনুশীলন শুরু করেন। যেসব মুসলিম মহিলা আগে হিজাব পরিধান করতেননা তাঁরা হিজাব পরিধান করা আরম্ভ করেন। তাঁদের মাঝে ইসলামের প্রতি মহব্বত ও আকর্ষণ অনেকগুণ বৃদ্বি পাচ্ছে।

ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার ফলে অমুসলিম চিন্তাশীলদের কেউ কেউ কুরআন অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রসংগে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে অংশ গ্রহণ করি; তুরুষ্কের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান উক্ত সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন। রাত দশটার দিকে সেমিনার শেষ হওয়ার পর লন্ডন ফেরার পথে অক্সফোর্ড বিশ্বদিল্যায়ের একজন ছাত্রী ও দুইজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হয়। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে জানলাম উক্ত ছাত্রীর নাম মারইয়াম এবং সে নও মুসলিমাহ। আমি তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাইলাম। প্রতি উত্তরে সে জানায় যে তার বাড়ি ফ্রান্সে। তার পিতা-মাতা ও পুরো পরিবার প্রচ-ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী ছিল। ৯/১১ এর পর তার পিতা একটি বই তাকে পড়ার জন্য দেয়। উক্ত বইতে মুসলমানদেরকে কুকুরের সাথে তুলনা করা প্রচ-ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়। মারইয়াম এই ধরনের মন্তব্য পাঠ করার পর চিন্তা করে “আসলেই মুসলমানরা কি এতো বেশি খারাপ? সে এই প্রশ্নের জবাব জানার জন্য তার মুসলিম বন্ধুদের সাথে মত-বিনিময় করতে আগ্রহী হয়। মুসলিম বন্ধুরা তাকে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে তার সকল প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার জন্য কুরআন অধ্যয়ন করার উপদেশ দেয়। সে তাদের উপদেশমতো কুরআন পাঠ করা শুরু করে। কিন্তু প্রথম তিন মাস কুরআন পাঠ করে কোনো মজা অনুভব করেনি। তার মতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কুরআন পাঠের চেষ্টা করায় প্রথম তিন মাস সে কোনো মজা পায়নি। তিন মাস পর উন্মুক্ত মন-মগজ নিয়ে কুরআন পাঠ শুরু করার পর তার মনে হয়েছে কুরআনের প্রতিটি আয়াত যেন তার মনের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। এইভাবে ছয়মাস তিলাওয়াত করে কুরআন পাঠ শেষ করে। কুরআন পাঠ করতে গিয়েই সে নিজেকে ‘কুরআনী’ বলে পরিচয় দেয়া শুরু করে এবং এক পর্যায়ে ইসলাম কবুল করেন। মারইয়াম আল-কুরআন অধ্যয়ন করেই ইসলাম কবুল করে। কিন্তু তার মতে কুরআন পাঠ করে ইসলাম জানার চেষ্টা না করলে তার পক্ষে ইসলাম কবুল করা হয়তো বা সম্ভব হতোনা। কেননা কুরআনে ইসলামের যেসব বিধান চমৎকারভাবে বিবৃত আছে তা খুব কম মুসলমানই অনুসরণ করে।

উপরের ঘটনা থেকে এই বাস্তব সত্য ফুটে উঠেছে যে, অনেক অমুসলিম ইসলাম সম্পর্কে পরিচালিত অপপ্রচারের জবাব খুঁজতে গিয়েই ইসলামের সুমহান আদর্শের সন্ধান পায়। এছাড়াও মুসলমানদের সাথে উঠা-বসা, লেন-দেন করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অমুসলিমদের কেউ কেউ ইসলাম কবুল করছে। অতি সম্প্রতি ইস্ট লন্ডন মসজিদে একটি যুবক ইসলাম কবুল করে। ইসলাম কবুল প্রসংগে সে জানায় যে, দীর্ঘদিন ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে আরো জানায় যে, তার মুসলিম বন্ধুদের চলাফেরা, কথা-বার্তা, উঠা-বসা, লেন-দেন প্রভৃতি তাকে বিমোহিত করে। এইভাবে অনেক মুসলমান সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদের জীবন গড়ার চেষ্টা করছেন এবং তাঁদেরকে দেখেই চিন্তাশীল অনেক অমুসলিম এই কথা অকপটে স্বীকার করছেন যে, “মুসলিমরা সন্ত্রাসী নয় বরং পরোপকারী’’। এই প্রসংগে একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যে একজন অমুসলিম তার ঘর বিক্রির সময় পার্শ্ববর্তী ঘরের চেয়ে তার ঘরের মুল্য ত্রিশ হাজার পাউন্ড বেশি দাবি করে। এজেন্ট বেশি মূল্য চাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জবাব দেন যে, “আমার পার্শ্বে একজন পরোপকারী মুসলিম ভালো প্রতিবেশী রয়েছেন। তিনি কাউকে কষ্ট দেননা বরং সব সময় প্রতিবেশীর প্রতি যত্নশীল থাকেন। যেকোন স্থানে ঘর কেনা সম্ভব কিন্তু ভালো প্রতিবেশী পাওয়া কঠিন’।

পাশ্চাত্যে ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে কিছু ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়াতে অব্যাহতভাবে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা পরিচালিত হচ্ছে। কিছু মিডয়াতে মুসলমানদেরকে টেরোরিস্ট হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে এবং ইসলামকে পাশ্চাত্যের জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউরোপে যে শতাব্দীকাল থেকে মুসলমানদের বসবাস রয়েছে সে কথা প্রকাশ না করে শুধু ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে এবং মুসলানরা ইউরোপের মুলস্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তারা মনে করে। তাদের প্রচারণা হচ্ছে, ইসলাম আজকের যুগে অচল এবং মুসলমানরা রক্ষণশীল, উগ্র ও টেরোরিস্ট। মিডিয়াতে মুসলমানদের বিরদ্ধে এই ধরনের প্রচারণার ফলে মুসলমানদের উপর বিশেষভাবে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের উপর গ্যাং এ্যটাক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই Q News এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফুয়াদ নাহদী পাশ্চাত্যের মিডিয়ার সমালোচনা করে বলেন, A western news agenda dominated by hostile, careless coverage of islam distors reality and destroys trust. Western reports, when positive, are seen as selective and partisan; when negative, hypocritical and insensitive (Diana Abdel- Maged, The British Media: Fair or biased )

একশ্রেণীর পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচারের কারণে বাস্তব অবস্থা খারাপভাবে চিহ্নিত হচ্ছে এবং আস্থা নষ্ট করছে। কোনো ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করা হলে তা হয় বাছাই করা এবং একপেশে। আর যখন কোনো নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরা হয় তা জয় মোনাফেকি সূলভ এবং অসংবেদনশীল। (ডায়ানা আবদেল মাজেদ. দি ব্রিটিশ মিডিয়া : ফেয়ার অর বায়াসড) কিছু মিডিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নীতি পোষণ করলেও যেকোন সন্ত্রাসী ঘঁটনার জন্য মুসলমানদেরকে অভিযুক্ত করার একটা প্রবণতা প্রায় সকল মিডিয়াতেই রয়েছে। যেকোন ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে সকল মুসলমানকে দায়ী করা যৌক্তিক নয়। ইতোপূর্বে সন্দেজনকভাবে বিভিন্ন ঘটনায় যাদেরকে আটক করা হয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন; তাঁদের কেহই কথিত ঘটঁনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলনা। তাই সন্ত্রাসের সাথে ইসলাম ও মুসলমানকে ঢালাওভাবে সম্পৃক্ত করার সুযোগ নেই। যেমনিভাবে খৃস্টান ও ইয়াহুদী কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করলে তার জন্য পুরো খৃস্টান বা ইয়াহুদী ধর্মাবলম্বীকে দায়ী করা যায়না। কতিপয় মিডিয়ার প্রবণতা হচ্ছে মুসলমান কেউ সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ত হবার সন্দেহের তালিকায় থাকলেও তা যেভাবে ফলাও করে ছাপা হয় অপরদিকে একই ধরনের ঘটনা কোনো নন-মুসলিম করলে তা মিডিয়াতে উপক্ষো করা হয়। এই সস্পর্কে বিগত ৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ ’ দি মুসলিম পোস্ট পত্রিকায় এইভাবে শিরোনাম করা হয়, Media Silent as non-Muslim bomb makers pleads guilt। উক্ত রিপোর্ট অনুসারে Terence Gavan নামক বৃটিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির জনৈক মেম্বার বোমা তৈরিসহ ২২ টি ঘটঁনায় অভিযুক্ত হয়। এর মাঝে ৬টি টেরোরিজম এ্যাক্টের অধীন ছিল। Woolwich Crown Court তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়। অথচ বোমা সন্ত্রাসের মত ঘটনায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও বৃটিশ মিডিয়া তা উপেক্ষা করে। কিন্তু শুধুমাত্র সন্দেহের তালিকায় থাকার কারণে অনেক মুসলমানের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। এধাধহ যদি মুসলমান হতো তাহলে প্রায় সকল পত্রিকাতেই সম্ভবত হেডলাইন করা হতো এভাবে ÒIslamic terrorist found guilty of possessibg bomb factory/Evil Muslim bomb maker admits guilty/Mastermind Muslim bomb expert Guilty ... বাংলাদেশে কিছু মিডিয়া আন্তর্জাতিক কতিপয় মিডিয়ার মতো জঙ্গি, টেরোরিস্ট, আল কায়েদা, তালেবানী রাষ্ট্র ইত্যাদি পরিভাষা একইভাবে ব্যবহার করে। ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের উপর নির্যাতনের কল্পিত কাহিণী প্রচার করে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। প্রকৃত সত্য প্রকাশ না করে তারা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে তারা দেশে-বিদেশে নেতিবাচক ধারণা দিতে চায়। তারা ইসলামী আন্দোলনন ও তার নেতৃত্ব সম্পর্কে মনগড়া রিপোর্ট প্রচার করছে অথচ তাঁদের বক্তব্য, স্টেমেন্ট পত্রিকায় ছাপায়না। তারা আওয়ামী-ছাত্রলীগ কর্তৃক মন্দির ভাংগা হলেও জামায়াত-শিবেরর উপর তার দায় বর্তায় অথচ জামাত শিবিরের কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় যে মন্দির পাহারা দেয় তার সংবাদ ও ছবি ছাপায়না। অপরাধ সংক্রান্ত সংবাদ ব্কিৃত করে প্রচার করছে যার ফলে সত্যিকার অপরাধীরা আরও অপরাধ করতে উতসাহীত হয়। যেমন নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার পর প্রথমেই জামায়াত-শিবিরের উপর দোষ চাপায়। অথচ ত্বকীর পিতা পরে স্পষ্ট করেই বলে দেয় যে, “এর সাথে জামাত শিবিরের কেউ সম্পৃক্ত নয়। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাই জড়িত‘। আভ্যন্তরীন রাজনীেিত বিদেশেী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরি করে। কিছু পত্রিকায় বিদেশেী কয়েকজন রাষ্ট্রদুতের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী-ও বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। কিছু মিডিয়াতে বাংলাদেশকে অকার্যকর জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। এমনকি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের জীবন ধারা মুল্যবোধ কটাক্ষ করা হয়। দাঁড়ি টুপী ধারীদেরকে রেডিও টিভিতে নাটক উপন্যাসে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে দর্শকের ঘৃণা জন্মে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া সাধারণত লোকাল মিডিয়াকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। এরফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে নেতিবাচক প্রচারণা চলে যার ফলে প্রকারন্তরে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ছে। অথচ দেশ গড়ার জন্য জাতীয় ঐক্য জরুরী। জঙ্গিবাদের উথ্যান হতে তা সহায়তা করছে। জনগনের মধ্যে দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ। আমাদের দেশের নদ-নদীতে মাছ আছে; বনে জংগলে কাঠ আছে। জমিতে হরেক রকমের ফসল ফলে। গ্যাস ও কয়লার খনি আছে। এই সকল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাবার জন্য আছে মানব সম্পদ। তাই মানব সমপদকে কাজে লাগানোর জন্য রাজনৈতিক স্থিতীশীলতার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। মেধাবীদেরকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগীতে না দেখে তাদেও মেধা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো প্রয়োজন। পর্ণোগ্রাফী যুব চরিত্র নষ্ট করছে। অথচ যুবকরাই হচ্ছে দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি।

মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তাদের অনেকই বিশ্বাস ও চেতনায় ইসলাম বিদ্বেষী। ভিনদেশীদের এজেন্ট হিসেবে কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করেন। এই জন্য তাঁরা মাসিক ভাতা পান। ব্যবসায়ী মিডিয়া মালিকরা নিজেদের স্বার্থের কারণে একজনের অপরাধ আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামা চাপা দিতে চায়।

হতাশা বা সমালোচনা নয় প্রয়োজন বাস্তব উদ্যোগ ও সহযোগিতার : আফসোস হচ্ছে মুসলমানদের হাতে প্রচুর সম্পদ আছে। আলজাজিরা বাদ দিলে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার মত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নেই। দি টাইমস, দি গার্ডিয়ান, দি ইন্ডেপেন্ডেন্স এর মত আন্তর্জাতিক মানের কোনো পত্রিকা নেই। তাই মুসলমানেরা পাশ্চাত্যে মিডিয়ার আক্রমন ও অপপ্রচারের শিকার। কেননা অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মত কোনো শক্তিশালী মাধ্যম মুসলমানদের হাতে নেই। এমতাবস্থায় মুসলিম তরূন সমাজের যাদের মিডিয়া স্টাডিজ পড়ার আগ্রহ আছে তাদেরকে মিডিয়া কর্মী হিসেবে ক্যারিয়ার গঠনের পরিকল্পনা নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। রেডিও, টিভি ও পত্রপত্রিকায় কাজ করা মুসলিম তরূন সমাজের একটি অংশের ক্যারিয়ার ফিল্ড হওয়া উচিত। যারা সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত তাদের প্রশিক্ষন কর্মসুচী থাকা দরকার। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। নিজেদের সাধ্যমত অনলাইন পত্রিকা, ব্লগও ওয়েবসাইট চালু করা যায়। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগ মিডিয়া হাউজ করা যেতে পারে। মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধি করে তাদের নানা লেখনীতে নিজেদের কিছু ইস্যু নিয়ে আসার চেষ্টা করা। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট করে সাংবাদিকদের বৃত্তি ও চিকিতসা সেবা করা দরকার। গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং টীম করা প্রয়োজন –তারা বিভিন্ন মিডিয়া মনিটরিং করবেন এবং অনলাইন আক্রাইভ রাখবেন। মিডিয়াতে স্পোকস পারসন হিসেবে বিভিন্ন ভাষায় পারদশী একটি গ্রুপ সৃষ্টি করতে হবে।

মিডিয়ার নাই নাই বলে হা হুতাশ করে যেমনি মিডিয়া অভাব পুরণ করা যাবেনা। তেমনিভাবে সফল মিডিয়া গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচের মানসিকতা না থাকলে মিডিয়া প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হবেনা। এই প্রসংগে অনেক দিন আগে শুনা একটি গল্প মনে পড়ছে। একজন লোক খাবার সহ কুকুরকে নিয়ে পথ চলছে। কিছু দুর যাওয়ার পর কুকুরটি ক্ষুধায় ছটফট কওে মারা যাওয়ার উপক্রম। লোকটি তা দেখে কাঁদছে। আরেকজন পথিক তার কান্নার কারণ জানতে চায়। তিিেন জবাবে বলেন, “ভাই আমার কুকুর ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে তাই কাঁদছি”। লোকটি আবার জানতে চায় “তোমার সাথে এগুলো কি”? তিনি জবাব দেন “এগুলো খাবার”। পথিক তাকে বলে, “তোমার খাবার থেকে কিছু খাবার দিলেইতো কুকুরটির ক্ষুধা নিবারন হয়”। লোকটি জবাব দেয় “ভাই কাঁদতে পয়সা লাগেনা কিন্তু খাবার দিলেতো পয়সা খরচ হয়”। আমাদেরকে মিডিয়ার জন্য শুধু কাঁদলে হবেনা প্রূেয়াজনের আলোকে অর্থ খরচ করতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও মিশনারী টাগেট নিয়ে কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালের পর ব্যবসায়ীদের ইনভেস্টমেন্ট কিছু পত্রিকা ও স্যটেলাইট চ্যানেল চালু করা হয়। বিদেশী সাহায্যেও কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই তাদের অর্থের অভাব হয়না। কিন্তু যারা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী তাদেরকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই মিডিয়া করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক কিছু ব্যক্তিকে অর্থ উপর্জনের মেধা দিয়েছেন আর কিছু ব্যক্তিকে মিডিয়া কর্মী হওয়ার যোগ্যতা দান করেছেন। মিডিয়া কর্মীদের অনেকর কাছে অনকে সুন্দর পরিকল্পনা আছে কিন্তু উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নাই। আর কিছু ব্যক্তির অর্থ আছে কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রজেক্ট নাই। যাদের অর্থ আছে তারা এমন জায়গায় ইনভেমস্ট করতে চান যেখান থেকে দ্রুত রিটার্ন আসবে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তা সঠিক। কিন্তু মুসলিম কিছু ব্যবসায়ী ও সামর্থবান বিত্তশালীরা যদি মিডিয়া, রিসার্চ, থিঙ্ক ট্যাঙ্কসহ জ্ঞান গবেষনার কাজে বিনিয়োগ না করেন তাহলে তাদের অধিক মুনাফার জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থ তাঁরা যে ভোগ করতে পারবেন তার কি কোনো নিশ্চিয়তা আছে? আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত অনেক ধনী ব্যক্তির কথা জানি যাঁরা দুনিয়ার মোড়লদের অনুমতি ছাড়া নিজের এ্যকাউন্ট থেকে নিজের খরচের জন্যও টাকা উত্তোলন করতে পারছেননা। তাই সময়ের অনিবার্য্য দাবি পুরণে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্টেড, অনলাইন ও সোশাল মিডিয়ায় কাংখিত ভূমিকা পালন করা জরুরী।

Saturday, January 11, 2025

ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৫২তম শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন || ০৪ আগস্ট ১৯৭১ - ১২ জানুয়ারি ১৯৯৩


শাহাদাতের ঘটনা:

ইসলামের জন্য যুগ যুগান্তরে সাহসী মুজাহিদ ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। দ্বীনের পথে তেমনি একজন সাহসী সৈনিক মোশাররফ হোসাইন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পিতার যোগ্যতম এক সন্তান। বাবা-চাচা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী দলের ছাত্রসংগঠনের ফ্যাসিবাদী আচরণের নির্মম শিকার হন শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন।

পারিবারিক পরিচয়:

শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার জয়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা কাজী সামছুল হুদা তার স্ত্রীকেসহ পরিবারকে সীমান্তের ওপারে ভারতের করিমাটিয়া রেখে দেশে চলে আসেন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে। স্ত্রী হোসনে আরা তার একমাত্র কন্যা কাজী দিলারা আকতারকে নিয়ে ভারতে বসবাস করতে লাগলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সামছুল হুদার পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, আদরের কন্যা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানো গেল না দিলার আকতারকে। মেয়ের শোকে ভেঙে পড়ে মা হোসেনে আরা। ঠিক সে মুহূর্তে অমবস্যার কালো আঁধারের মাঝে দেখা গেলো পূর্ণমিার চাঁদ। ৪ আগস্ট ১৯৭১। পৃথিবীতে আসলেন কাজী মোশাররফ হোসাইন। যাকে পেয়ে মা হোসনে আরা বেগম মেয়ের শোক কিছুটা কম অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু না; হোসনে আরা বেগমের সে আনন্দ বেশি স্থায়ী হতে দেয়নি মুজিববাদী ছাত্রলীগ। একদিন মোশাররফের মত নিষ্পাপ উদীয়মান তরুণকেও মুজিববাদী হায়েনাদের নির্মম ব্রাশফায়ারে শিকার হতে হয়েছে।

শিক্ষাজীবন:

শিক্ষার হাতে খড়ি পিতার কাছেই। ভর্তি করালেন শুভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। ভর্তি হলেন জয়পুর সরোজিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত মেধার সাক্ষ্য রাখলেন আগের মতই। এসএসসি পাস করলেন ১ম বিভাগে। ভর্তি হলেন ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে। শরিক হলেন শহীদী কাফেলায়। এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন মোশাররফ হোসাইন। তিনি শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না বরং সুবক্তা ছিলেন। তাইতো তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার জন্য নিয়ে যেতেন।

সাংগঠনিক জীবন:

কাজী মোশাররফ হোসাইন সংগঠনের কর্মী ছিলেন। ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে অধ্যায়নকালে সংগঠনে যোগ দেন। মেধাবী ছাত্র কাজী মোশাররফ হোসাইন পড়াশোনা ছাড়া অন্য সময়গুলো দাওয়াতি কাজে লাগাতেন। তার চরিত্র ছিল চুম্বকের মত আকর্ষণীয়। তিনি তার দাওয়াতি চরিত্র দিয়ে সহপাঠী বন্ধু বান্ধব সকলকে আকৃষ্ট করেছিলেন। শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতেন।

শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা:

১২ জানুয়ারি ১৯৯৩ এর সকালবেলা কাজী মোশাররফ হোসাইন তাঁর রুমমেটদের শোনালেন এক দুঃস্বপ্নের কথা। ছাত্রলীগের গুন্ডারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ হস্তান্তরে জন্য বিশ হাজার টাকা দাবি করে। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সারাদিন আনমনে কেটে যায় তার। বিকালে কখনও ফুটবল না খেললেও সেদিন ফুটবল খেলতে নামেন প্যারেড ময়দানে। অনেকের চেয়ে ভাল খেললেন তিনি। মনও কিছুটা হালাকা হয়েছে তার। মাগরিবের নামাজ পড়ে সরলেন পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো শিবির কর্মী জিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে মিছিল বের হল। মিছিলে যোগদান করলেন মোশাররফ। মিছিল চলছিল সিরাজউদদৌলা রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে। সামনের সারিতে দৃঢ়পদে চললেন কাজী মোশাররফ । মিছিল যখন দেওয়ান বাজার সাব এরিয়ায় পৌঁছল তখন গলির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে ব্রাশফায়ার শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হলো সামনে থাকা মোশাররফ, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পান করলেন শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা। আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি। অকালে ঝরে গেল একটি প্রাণ। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল একটি তাজা গোলাপ। ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের পথে অগ্র পথিক হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। শহীদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন সহপাঠী বন্ধু, শিক্ষক সবাই। তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. আব্দুস সবর প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শহীদের কফিন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে মা প্রশ্ন করেন কোন অপরাধে তার সন্তানকে জীবন দিতে হল। যদি তার ছেলে অপরাধ না করে তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে। মা সন্তানকে ফিরে পাবেন না, সে জন্য ব্যথিত হৃদয়ে আজীবন কাটাবেন। ছেলে কিন্তু ব্যথিত নয়। কারণ তার তিনি জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গল্প করছেন জান্নাতের সুবজ পাখিদের সাথে।
একনজরে শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন:

-নাম: কাজী মোশাররফ হোসাইন
-পিতার নাম : মাস্টার কাজী সামছুল হুদা
-মাতার নাম : হোসনে আরা বেগম।
-ভাইবোনদের সংখ্যা : ২ ভাই, ৩ বোন
-ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়।
-স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম- জয়পুর, পো: শুভপুর, -থানা: ছাগলনাইয়া, জেলা: ফেনী।
-জন্মতারিখ : ৪ আগস্ট ১৯৭১
-শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স ২য় বর্ষ, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ
-শহীদ হওয়ার তারিখ : ১২.০১.১৯৯৩ সাল (১১ তারিখ সন্ধ্যায় আহত)
-শহীদ হওয়ার স্থান : দেওয়ান বাজার সাব এরিয়া, চট্টগ্রাম
-কবরস্থান : নিজবাড়ির আঙিনা
-যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
-সাংগঠনিক মান : কর্মী
-যাদের হাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী।


•শহীদের চাচার বক্তব্য:

শহীদের চাচা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। আমরা কি জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিলাম সন্তান হারাবার জান্য? সন্ত্রাস মদদ দানের জন্য? হোসনে আরা আজো কাঁদেন পুত্রশোকে। কেউ তাকে দেখতে গেলে ছেলের মতই ভাববেন তাদেরকে। এক সন্তানকে হারিয়ে লক্ষ সন্তানের মাতা আর সামছুর হুদা লক্ষ ছেলের পিতা হলেন। শহীদ মোশাররফ তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জান্নাত থেকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। দায়িত্ব আমাদের এ জমিনে কালেমার পাতাকা উড়াবার। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কষ্ট পাবেন, অভিযোগ করবেন আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দাঁড়াতে হবে আখেরাতের কাঠগড়ায়।

Monday, January 6, 2025

২০২৫ সেশনের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সেটআপ সম্পন্ন

২০২৫ সেশনের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সেটআপ সম্পন্ন

সভাপতি : আবু হানিফ হেলাল
সেক্রেটারি : ইমাম হোসেন আরমান

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর একান্ত মেহেরবানিতে ২০২৫ সেশনের জন্য বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সভাপতি ও সেক্রেটারি মনোনয়ন সম্পন্ন হয়েছে।

আজ ০৩ জানুয়ারী ২০২৫ বাদ জুমআ ফেনী দারুল ইসলাম মিলনায়তনে ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সদস্যদের নিয়ে সদস্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমানের সঞ্চালনায় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রআন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলামের পরিচালনায় নতুন সেশনের সেটআপ ঘোষনা করা হয়।

সমাপনী সেশনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্রআন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলাম সদস্যদের উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন।

অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালী শহর শাখার সভাপতি আবু সাঈদ সুমন, ফেনী শহর শাখার সভাপতি শরীফুল ইসলাম ও ছাত্রশিবির ফেনী জেলা শাখার সাবেক সভাপতিবৃন্দ।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএম কামাল উদ্দিন, ফেনী জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাড. জামাল উদ্দিন, ফেনী জেলা জামায়াতের প্রচার সেক্রেটারি আ.ন.ম আবদুর রহিম।

পরিশেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা আমীর মুফতি আব্দুল হান্নান হুজুরের নসিহত ও মুনাজাত পরিচালনার মাধ্যমে প্রোগ্রামের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

Sunday, December 29, 2024

ইবনে আল-হাইসাম: জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা ও আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ


ইবনে আল-হাইসাম (৯৬৫–১০৪০): সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আবু আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাইসাম, যিনি আলহাজেন (Alhazen) নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন ইসলামের স্বর্ণযুগের একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। তার গবেষণায় অপটিক্স, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী এই বিজ্ঞানী তার গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য আজও সম্মানিত।

• ইবনে আল-হাইসামের বৈজ্ঞানিক অবদান

১. অপটিক্স ও আলোর গতি
ইবনে আল-হাইসামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ "কিতাব আল-মানাযির" (Book of Optics)। এতে তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করেন।

চোখের গঠন ও দৃষ্টির ব্যাখ্যা: তিনি প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে চোখ থেকে রশ্মি বের হয় না; বরং আলোর রশ্মি চোখে প্রবেশ করে চিত্র তৈরি করে।

পিনহোল ক্যামেরা আবিষ্কার: তার গবেষণা থেকেই আধুনিক ক্যামেরার ধারণা গড়ে ওঠে।

আলোর বক্রতা ও প্রতিবিম্ব: তিনি বক্র ও সমতল আয়নার মাধ্যমে আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিবিম্বের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন।

লেন্সের ধারণা: পরবর্তীতে এই গবেষণা থেকেই চশমা, টেলিস্কোপ ও মাইক্রোস্কোপের ভিত্তি তৈরি হয়।

২. গণিত ও জ্যামিতি:
পার্থিব জ্যামিতির ব্যবহার: ইবনে আল-হাইসাম পরিপ্রেক্ষিত ও আলোর গতি বোঝার জন্য জ্যামিতির ব্যবহার করেন।

অপরিবর্তনশীল রশ্মি: তার গবেষণাগুলো গণিতের ত্রিভুজ ও কোণের তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের ভিত্তি: গণিতের এই শাখায় তার কাজ আধুনিক গাণিতিক গবেষণার পথ দেখিয়েছে।

৩. জ্যোতির্বিদ্যা:
তিনি চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব ও গ্রহের গতি নিয়ে গবেষণা করেন।

তার আবিষ্কারগুলো ইউরোপের মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।

চাঁদের প্রকৃতি ও আলোক বিচ্ছুরণ নিয়ে তিনি পরীক্ষামূলক গবেষণা চালান।

৪. পদার্থবিজ্ঞান:
তরল পদার্থের চাপ ও গতিবিধি নিয়ে তিনি গবেষণা করেন।

তিনি পানির প্রবাহ বিশ্লেষণ করেন যা আধুনিক জলবিদ্যুৎ প্রকৌশলের ভিত্তি স্থাপন করে।

ভারসাম্য ও মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তার গবেষণাগুলো নিউটনের গতিসূত্রের ভিত্তি গড়ে তোলে।

৫. বিজ্ঞান পদ্ধতির জনক:
ইবনে আল-হাইসামই প্রথম বিজ্ঞানকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাইয়ের ধারায় নিয়ে আসেন।

তিনি পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ওপর জোর দেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক।

তার এই পদ্ধতি পরবর্তীতে গ্যালিলিও ও বেকনের 
গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


• ইবনে আল-হাইসাম ও ইসলামিক দর্শন:
ইবনে আল-হাইসাম কুরআনের জ্ঞান ও চিন্তার নির্দেশনাকে অনুসরণ করে গবেষণায় ব্রতী হন।

১. কুরআনের প্রেরণা:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"তারা কি দৃষ্টি দেয় না আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে?" (সূরা আল-আ’রাফ: ১৮৫)

এ আয়াত তাকে মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনে অনুপ্রাণিত করে।

২. জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ:
"তোমরা বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?" (সূরা যুমার: ৯)

এই আয়াত ইবনে আল-হাইসামকে সত্যের অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে।


• পশ্চিমা বিশ্বের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি:
ইউরোপে তার প্রভাব:
১২ শতাব্দীতে ইবনে আল-হাইসামের গ্রন্থগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়।

রজার বেকন, কেপলার, এবং গ্যালিলিও তার গবেষণা থেকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন।

তার "Book of Optics" ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়।

• আধুনিক সম্মাননা:
২০১৫ সালে ইউনেস্কো তার সম্মানে "International Year of Light" ঘোষণা করে।

নাসা তার নাম অনুসারে চাঁদে একটি গর্তের নাম রেখেছে—"Alhazen Crater"।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তাকে ‘আধুনিক অপটিক্সের জনক’ বলে অভিহিত করেন।

উপসংহার:
ইবনে আল-হাইসাম শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ এবং অনুসন্ধানী মননশীলতা ও কুরআনের নির্দেশনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার গবেষণা এবং অবদান আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়েছে।

কুরআনের আয়াত দিয়ে শেষ করি:
"তোমরা বল, হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।" (সূরা ত্বাহা: ১১৪)

ইবনে আল-হাইসাম আমাদের শিক্ষা দেন কীভাবে বিশ্বাস ও যুক্তির সমন্বয়ে আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়া যায়। তার গবেষণা ইসলামের বিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহ্য এবং আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপনের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।

Thursday, December 12, 2024

জান্নাতি পাখি || শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রহ.



মিথ্যার দেয়াল তুলে ধ্রুব সত্যকে কখনো আড়াল করা যায় না। সত্য উদ্ভাসিত হয় তার নিজস্ব আলোয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ফাঁসী দেয়া হয় জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিক নেতা শিক্ষাবিদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে। সরকার যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে ফাঁসী দিলেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা আজ স্মরণীয় শত কোটি প্রাণে; ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সত্যপ্রেমীদের হৃদয় থেকে কখনো মুছে যাবেন না, আলোর পথের যাত্রীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

১৯৪৮ সালের ২রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলাস্থ সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গী গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সানাউল্লাহ মোল্লা ও মাতার নাম বাহেরুন্নেসা বেগম। আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন নয় ভাইবোনের মাঝে ৪র্থ। তার জন্মের কিছুকাল পরে তার পিতা-মাতা সদরপুরেরই আমিরাবাদ গ্রামে এসে বাড়ি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।

প্রাথমিক শিক্ষাঃ 
তিনি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিষ্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সংকটের কারনে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। ফরিদপুরের শিব সুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছু কাল।

উচ্চশিক্ষাঃ 
১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি করার জন্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণকালে তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের কারনে ১৯৭১ সালে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি বাড়ি চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭২ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মত আবদুল কাদের মোল্লার লেখাপড়াতেও ছন্দ পতন ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইন্সিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রীতে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হন।

কর্মজীবনঃ 
আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এমএড পরীক্ষার রেজাল্টের পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ সংস্কৃতি কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে রিসার্চ স্কলার হিসাবে বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টারে যোগ দেন। গৌরব-সাফল্যের ধারাবহিকতায় উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, রাইফেল পাবলিক স্কুল এবং মানারাত স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় যে সত্যের পরশ পেয়েছিলেন, তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এ সময়ে তাঁর ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে। বীক্ষণ ছদ্মনামে তার লেখা আর্টিকেল গুলো সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বৈবাহিক জীবনঃ 
জনাব মোল্লা দিনাজপুর নিবাসী বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেগম সানোয়ার জাহান ইডেন কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনিও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মত বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ও ইডেন কলেজের ছাত্রী ইউনিয়নের জিএস ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বেগম সানোয়ার জাহান তার বাবার সাথে কুষ্টিয়াতে ছিলেন ও সক্রিয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন। বেগম সানোয়ার জাহানদের বাসা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাবার যেত। দুই পুত্র ও চার কন্যার সুখী সংসার তাদের। সব সন্তানই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেছেন। পরিবারের সকলেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত। বেগম সানোয়ার জাহান জামায়াতের রুকন ও দায়িত্বশীলা ।

সাংবাদিক কাদের মোল্লাঃ 
সেসময়েরই একজন নির্ভীক সাংবাদিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বর্ণাঢ্য জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে তিনি আমাদের কাছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল সময়টা অতিবাহিত করেছেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে।
সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে প্রত্রিকাগুলো তখন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে সর্বমহলের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিল তাদের মধ্যে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর এ পত্রিকাটিতে দক্ষ হাতে দায়িত্ব পালনের ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে। ফলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য মনোনীত হন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দু’বার তিনি ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্তরে দ্রোহ আর বিপ্লবের চেতনা লালন করেও সদা হাস্যোজ্জল এ মানুষটি ছিলেন সাংবাদিক আড্ডার প্রাণ-ভ্রমরা। তার রসময় গল্পকথার সজীবতায় ভরে উঠতো গনমানুষের চেতনার প্রতীক জাতীয় প্রেসক্লাব।

কিন্তু একজন সাংবাদিকের জীবন সাধারণভাবেই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। কখনো সমাজের বিপথগামী অংশ, কখনো কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল, আবার কখনওবা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির রোষানলে পড়তে হয় তাকে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দন্দ্বে উৎসর্গিত হয় সাংবাদিকের জীবন। চারপাশের চেনাজন, পরিচিত বন্ধুমহল একসময়ে পরিণত হয় তার শত্রুতে। হানে প্রাণঘাতি ছোবল। যে ছোবলের রূপ হয় নানারকম। মানসিক যন্ত্রণায় বিপন্নতা, শারিরিক আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ, প্রাণঘাতি হামলায় মৃত্যু, কারাবন্দিত্বের নিঃসঙ্গ যাতনা কিংবা প্রহসনের বিচারে জীবনাবসান। এসবই ছিল যুগে যুগে সাংবাদিক জীবনের অনিবার্য উপাদান। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় একসময় সাংবাদিকতার পেশাকে বিদায় জানাতে হয় তাঁকে। কিন্তু যে পেশা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এর মহত্বকে তিনি ধারণ করতেন সবসময়। তাইতো তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের প্রতিটি ধুলিকণা এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে কাদের মোল্লার স্মৃতি ।

রাজনৈতিক জীবনঃ 
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রয়েছে সংগ্রামী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়ন কালেই তিনি কম্যূনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পর তাফহীমুল কুরআনের হৃদয়স্পর্শী ছোঁয়ায় তিনি ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষিত হন এবং আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি ছাত্রসংঘের তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান শাখায় যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ সংগঠনের সদস্য হন। ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারী ও একই সাথে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের রুকন হন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যাক্তিগত সেক্রেটারি এবং ঢাকা মহানগরীর শূরা সদস্য ও কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনের ব্যাবধানেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশ-এ-শূরার সদস্য হন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারী ও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে ঢাকা মহানগরীর নায়েব-এ-আমীর, অতঃপর ১৯৮৭ সালে ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ১৯৮৮ সালের শেষ ভাগে তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন যা বাতিলের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়।

১৯৯১ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তিনি জামায়াতের প্রধান নির্বাচনী মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ২০০৪ সালের মার্চ মাসে স্বল্প সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত দায়িত্বের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি চারদলীয় জোটের লিয়াজো কমিটির গুরুত্বপূর্ন সদস্য হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশর প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। বিশেষ করে ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে লিয়াঁজো কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তখন কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এবং তা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। লিয়াঁজো কমিটিতে বিভিন্ন সময়ে নানা দায়িত্ব পালন করার কারনে বিএনপি দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ উভয় দলের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দের সাথে আন্দোলনের নীতি নির্ধারণী সভাতে মিলিত হতেন তিনি।

জনাব মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে চার চারবার জেলে যেতে হয়। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দায়ে ১৯৬৪ সালে প্রথম বারের মত তিনি বাম রাজনীতিক হিসেবে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু স্থানীয় জনতার বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কাস্টোডী থেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারনে আব্দুল কাদের মোল্লাকে আবারও আটক করে রাখা হয় ১৯৮৫ সালের ২২শে এপ্রিল থেকে ১৪ই অগাস্ট । প্রায় চারমাস আটক থাকার পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি মুক্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে গ্রেফতার হন। সাত দিন পরে তিনি মুক্ত হন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার কূটনীতিকদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জল ও রসময় কাদের মোল্লার কথা ছাড়া কোন প্রোগ্রাম জমজমাট হতো না। জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নানা কূটনীতিক প্রোগ্রামে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনাব মোল্লা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভারত সহ নানা দেশ সফর করেছেন।

জনাব মোল্লা সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে বাদশাহ ফয়সাল ইন্সটিটিউট, ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি ও এর স্কুল, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী, সদরপুর মাদরাসা ও এতিমখানা, ফরিদপুর জেলার হাজিডাঙ্গি খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা ও এতিমখানা, সদরপুর আল-আমিন অন্যতম। এছাড়াও তিনি ঢাকার গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন।

জনাব মোল্লা দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিষয়ের উপর একাধিক কলাম ও প্রবন্ধ লিখেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, পালাবদল, মাসিক পৃথিবী, কলম ইত্যাদি নানা জায়গায় তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রত্যাশিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে বিদেশে তিনি বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাওয়া যায়। তার লেখা কলাম ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ও বস্তুবাদ ও কম্যূনিজমের উপরে তার বৈজ্ঞানিক সমালোচনা শিক্ষিত মহলের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তিনি প্রথমে আব্দুল কাদের নামে লেখা শুরু করেন।পরবর্তীতে তিনি বীক্ষণ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন ও উনার লেখা গুলো খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সমসাময়িক সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার লেখা মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে ঢেউ তুলতে শুরু করে।

জনাব মোল্লা নিয়মিত কুরআন পড়তে ও কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পছন্দ করতেন। তিনি সাংগঠনিক ব্যস্ত সময় মধ্যেও তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত লেখক, কবি যেমন আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী, সাইয়্যেদ কুতুব ইত্যাদি নানা লোকের লেখা পড়তে পছন্দ করতেন।

শাহাদাতঃ 
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সরকার তাকে রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে এবং পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। ট্রাইবুনালের রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এরপর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চের দাবি অনুযায়ী সরকার আইন সংশোধন করে আপিল দায়ের করে। সংশোধিত আইনের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয়। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাননি। এমনকি রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই তড়িঘড়ি করে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁকে ফাসি দেয়ার প্রায় দেড় বছর পর তার রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বিচারের নামে কত বড় প্রহসনের শিকার হয়েছেন!

Sunday, December 8, 2024

বইনোট : ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় (ইসলামী বিপ্লবের পথ) || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রহ.



এটি ১৯৪০ সনের বক্তৃতা, জামায়াতে ইসলামী তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 
[বইয়ের মুল নাম: ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়]

• ভূমিকা:
ইসলামী বিপ্লবের পথ বইটির মূল কথা হল 'ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠা হবে' এই লক্ষ্যে বইটির লেখক মরহুম মাওলানা মওদুদী (র) ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচী হলে এ সম্পর্কে এক অনুপম বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল '
ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যাঁয়' এর অর্থ হল ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

• মূল আলোচনা:
বইটির মূল আলোচনাকে ৮টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা.
১. ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়
২. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন
৩. আদর্শিক রাষ্ট্র
৪. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র।
৫. ইসলামী বিপ্লবেরপদ্ধতি বা পন্থা
৬. অবাস্তব কল্পনা বা ধারনা
৭. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
৮. সংযোজন

 ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়:
১. বর্তমানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ নাম শিশুদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে।
২. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা এটা জানেন না কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং জানার চেষ্টাও করেন না।
৩. যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা যে প্রস্তাব দেয় মোটর সাইকেলে যেমন আমেরিকায় পৌঁছানো সম্ভব নয় তেমনি তাদের প্রস্তাবে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

• রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
“কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক উপায়ে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।”
১. একজায়গা থেকে তৈরি করে এনে অন্য জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
২. কোন একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্মপ্রক্রিয়ার ফলশ্রতিতে।
৩. সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্মলাভ করে ইসলামী রাষ্ট্র।
৪. সামাজিক উদ্যম, উদ্দীপনা, ঝোঁক-প্রবণতা প্রভৃতি নিবিড় সম্পর্ক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত।
৫. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন।
৬. সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৭. দীর্ঘ প্রানান্তকর চেষ্টা (যেমন বীজ হতে ফল)।

• আদর্শিক রাষ্ট্র:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

(i) ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শিক রাষ্ট্র।
(ii) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রভাবমুক্ত।

২. ফরাসী বিপ্লবের আদর্শিক রাষ্ট্রের ক্ষীণ রশ্মি দেখা গেলেও জাতীয়তাবাদের প্রভাবে চাপা পড়ে তা বিলুপ্ত হয়। 
(i) রাশিয়ার কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও অতিসত্ত্বর তা আদর্শচ্যুত হয়। 
(ii) মুসলিম দেশের কতৃত্বশীল লোকেরা জাতীয়তাবাদের আখড়ায় পড়ে ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা হারিয়ে ফেলেছে। 

৩. আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রয়োজন:
ক) ভিত্তি স্থাপন হতে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্তপ্রায় অস্তিত্ব রক্ষা করা। উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করা।
খ) জাতীয়তাবাদী চিন্তা-পদ্ধতি সংগঠন প্রণালী পরিহার করা।

৪. আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের লক্ষ্যে:
ক) জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে এর আদর্শ পেশ করা। 
খ) সেই আদর্শ অনুযায়ী সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করে কল্যাণ সাধন।

• আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
(ক) ইহার বৈশিষ্ট্যঃ
১. ইসলামী রাষ্ট্রের মূল বুনিয়াদ
২. নিখিল বিশ্ব জগৎ আল্লাহতাআলার রাজ্য। তিনি ইহার প্রভূ, শাসক ও বিধানদাতা।
৩. মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহরপ্রতিনিধি।
৪. খেলাফতের এই দায়িত্বের জন্য প্রত্যেককেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

(খ) ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপঃ
১. এটা ধর্মহীন রাষ্ট্র হতে সম্পূর্ণ আলাদা।
২. এটা পরিচালনার জন্য এক বিশেষ মনোবৃত্তি বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ ধরনের নির্ধারন আবশ্যক।
৩. ধর্মহীন রাষ্ট্রের জজ ও প্রধান বিচার প্রতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
৪. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের জন্য খোদাভীতি, নিজ কর্তব্য পালন ও সেজন্য আল্লাহরকাছে জবাব দিহির তীব্র অনুভূতি ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকের প্রয়োজন।

(গ) ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা কারীদের বৈশিষ্ট্যঃ
• পৃথিবীর বিপুল পরিমান সম্পত্তি হস্তগত থাকলেও তারা তার পূর্ন আমানতদার।
• রাজশক্তি করায়ত্ত হলেও সুখ নিদ্রা ত্যাগ করে জনস্বার্থে রক্ষণাবেক্ষণ।
• যুদ্ধে বিজয়ী দেশে হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হয়ে তাদের ইজ্জত আব্রর হেফাজতকারী।
• নিজেদের স্বার্থকে ধুলিস্যাৎ করে অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া।
• আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এমন মর্যাদার অধিকারী হবে যে, তাদের সততা, সত্যবাদীতা, ন্যায়পরয়নতা, নৈতিক ও চারিত্রিক, মূল নীতির অনুসরণ এবং প্রতিশ্রুতিও চুক্তি পালনের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব তাদের উপর আস্থাশীল হবে।

• ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি বা পন্থা:
১. ইসলামী রাষ্ট্রের অলৌকিক আবির্ভাব ঘটনা
• ইসলামী জীবন দর্শন চরিত্র ও প্রকৃতির বিশেষ মাপকাঠি অনুযায়ী গঠিত ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করা। নেতা ও কর্মীদের এই বিশিষ্ট আদর্শে আত্মগঠন করা।
• সমাজ জীবনে অনুরূপ মনোবৃত্ত ও নৈতিক উদ্দীপনা জাগ্রত করা।
• ইসলামী আদর্শে নাগরিকদের গড়ে তুলতে একটি অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা।
• জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা ও কাজ করতে সক্ষম এমন লোক গড়ে তোলা।
• ইসলামী আদর্শের চিন্তা-চেতনা ও কর্ম জীবনের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন।
• ইসলামী আন্দোলন চতুপার্শ্বে যাবতীয় অবাঞ্চিত জীবন-ধারার বিরূদ্ধে প্রকাশ্যে সংগ্রাম করবে।

২. ইহাতে নিম্নোক্ত ফল পাওয়া যাবে:
• পরীক্ষার অগ্নিদহনে উত্তীর্ণ ত্যাগী লোক তৈরি হবে।
• এ আন্দোলনে এমনসব লোক পর্যায়ক্রমে যোগদান করবে যাদের প্রকৃতিতে সত্য-ন্যায়ের উপাদান অন্তর্নিহিত রয়েছে।
• সর্বশেষে কাঙ্খিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

৩. যে কোন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন:
• একটি বিশেষ ধরনের আন্দোলন।
• বিশেষ ধরনের সামাজিক চেতনা সম্পন্ন নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃাষ্ট। উদাহরণ, রুশ বিপব, জার্মানির সমাজতন্ত্রের বিপব।

• অবাস্তবকল্পনা বা ধারনা:
১. কিছু লোকের ধারণা মুসলিম জাতিকে একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে একই পাটফর্মে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে পারলেই ইসলামী রাষ্ট্র আপনা আপনিই প্রতিষ্ঠিত হবে। 
২. মুসলমানদের বর্তমান নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার স্বরূপ যেমন- চরিত্রগত দিক থেকে দুনিয়ার মুসলিম ও অমুসলিম জাতিগুলোর সবগুলোর অবস্থা প্রায় একই। উদাহরণঃ আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতি, রোজার দিনে একই সাথে খাওয়া, সুদ, ঘুষ, জেনা ইত্যাদির সাথে লিপ্ত হওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা:
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কর্মপন্থাই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা। তার অনুসৃত বিশিষ্ট কর্মপন্থাগুলো নিম্নরূপ:

১. ইসলাম হলো সেই আন্দোলনের নাম যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মান করতে চায় এক আলাহর সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
২. ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়।
৩. মূল লক্ষ্য আলাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের দাওয়াত দেওয়া।

• ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতির চারটি দিক রয়েছেঃ
ক) আলাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান।
খ) অগ্নী পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমানিত হওয়া।
গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল।
ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপব।

ক) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার আহবান:
১. বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী হয়ে থাকা তবে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববাদীতার দাবী হলো সেই মহান সম্রাটের হুকুমের সম্মুখে মাথা নত করে দাও তার একান্ত আনুগত্য দাস হয়ে যাও।
২. গোটা জাতির একজনই সম্রাট মালিক এবং সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। অন্য কারো কতৃত্ব করার কোন অধিকার নাই।
৩. আলাহ ছাড়া আমি সকলের বিরূদ্ধে বিদ্রোহী এবং যারা আলাহকে মানে তারা ব্যতিত] ৪. এই ঘোষণা উচ্চারণ করার সাথে সাথে বিশ্ববাসী আপনার শত্রুহবে এবং চতুর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।

খ) অগ্নি পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমাণিত হওয়াঃ
১. লা ইলাহা ইলালাহ এই ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে পোপ (খৃস্টান) ঠাঁকুরদের সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলো এগুলো গঠন করে হলো ঐক্যজোট।
২. তাদের উপর নেমে আসে কঠিন অত্যাচার এবং এর ফলেই ইসলামী আন্দোলন মজবুত হয় এবং ক্রমবিকাশ ও প্রসার লাভ করে।
৩. এর ফলেই সমাজের মনি-মুক্তাগুলো আন্দোলনে শরিক হয়।
৪. একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরিক হচ্ছিল বাস্তবে ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ।
৫. কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে এ দেখে কিছু মানুষ উৎসাহী হয় এরা কি কারণে মার খাচ্ছে।

গ) নেতা ছিলেন আদর্শের মডেলঃ
১. বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের সেই মহান নেতার নেতৃত্ব আদর্শ, সহানুভূতি এবং সার্বিকভাবে তার মডেলকে অনুসরণ করা একান্ত দরকার।
২. এই নেতার স্ত্রী ছিলেন বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক।
৩. কালিমার দাওয়াত কবুল ও মানুষকে এ দাওয়াত দেওয়ার সাথে সাথে তাদের সম্পদ শেষ হয়ে যায়।
৪. নেতা ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহনশীল।
৫. সমকালীন সময়ে তাকে ইসলামী আন্দোলনের কাজ না করার প্রতিফল হিসাবে আরব জাহানের বাদশাহী এবং আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী দিতে চেয়ে ছিল। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন এবং তিরস্কার আর প্রস্তাব্যগত সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।
৬. অত্যন্ত গরমের সময় মরুভূমির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন সাথীদের সাথে নিয়ে।
৭. হাশেমী গোত্রের লোকেরা এই আন্দোলনের প্রতি অনীহা ছিল।

ঘ) আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লব:
ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একদল লোককে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছিল যারা ইসলামের পূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়ে এতটা যোগ্য হয়েছিল যে তারা যেকোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিল। উদাহরণ, মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র।

একথা সত্য যে, একাজের জন্য প্রযোজন ঈমান, ইসলামীক চেতনা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবুত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ, উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবাণী। 

 

একাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মত অটল হয়ে থাকবে। অন্যকোন দিকে তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুকনা কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না।

Tuesday, December 3, 2024

বইনোট : একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ ও তার থেকে বাঁচার উপায় || মরহুম আব্বাস আলী খান রহ.



লেখক পরিচিতি || মরহুম আব্বাস আলী খান রহ.

•জন্মঃ ১৩২১ সালের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে।
•স্থানঃ জয়পুরহাট।
•পড়ালেখাঃ প্রথমে নিজ ঘরে কোরআনের ছবক নেন। ১৯২১ সালে ২য় শ্রেনিতে ভতি হন। ৬ষ্ঠ শ্রেনির পর হুগলী মাদ্রাসায় পড়তে যান। রাজশাহী ও কারমাইকেল কলেজে পড়েন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাশ করেন।
•স্কলারশীপঃ ৬ষ্ঠ শ্রেনিতে ১ বছরের গভর্নমেন্ট বৃত্তি ও চারবার মেয়াদী বৃত্তি লাভ করেন।

•কর্মজীবনঃ ১৯৩৫ সালে তিনি চাকুরী গ্রহণ করেন। কিন্তু নামাযে বাধা দেয়ায় চাকুরীতে ইস্তফা দেন। ১৯৩৬ সালে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট যোগ দেন এবং শেরে বাংলার সেক্রেটারি হন। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের সার্কেল অফিসার হন। ১৯৫২ সালে জয়পুরহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন।

•রাজনীতি ও আন্দোলনঃ
১৯৫৫ সালে তিনি মুত্তাফিক ফরম পূরন করেন।
১৯৫৬ সালে জামায়াতের রুকন হন।
১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিভাগীয় আমীর হন।
১৯৭৯ সালে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সিনিয়র নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ থেকে ৯২ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ থেকে ৯২ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। আইয়ুব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্য আন্দোলন করেন।
১৯৭১ সালের মন্ত্রী পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হন।
১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিপ্লবের ৭ দফা গণদাবী ঘোষণা করেন।

ষাটের দশকের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিভ মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন। গণ আন্দোলন কর্মসূচী ও কেয়ারটেকার সরকারের জন্য আন্দোলন করেন।
১৯৭৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যান।
১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে বৃটেন যান।

•সাহিত্য চর্চাঃ অনুবাদ ও মৌলিক রচনা ৩৫টি। মৌলিক গ্রন্থ মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ

১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
২. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক
৩. মুসলিম উম্মাহ
৪. ইসলামী আন্দোলন ও তার দাবী এবং অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম
৫. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং
৬. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
৭. ইসলামী অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য
৮. পর্দা ও ইসলাম

ইন্তেকালঃ ৩ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে ১:২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।


১. যে আদর্শের হাতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষমতা নেই জগতের কোথাও তার জন্য একটুও স্থান নেই। বিজয়ী সভ্যতার সমূহ কর্ম জগত থেকে দূরে সরে পরে। তার ব্যাপারে দুর দৃষ্টি ভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তিদের মনেও এ পদ্ধতি দুনিয়ায় চলতে পারে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগে।

২. কাজেই হুকুমতে এলাহিয়া কায়েম করে খোদার তরফ থেকে নবীগন যে ব্যবস্থা নিয়ে এসে ছিলেন তাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করাই ছিল নবীদের মিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

৩. জাহেলিয়াত পন্থিদের তারা এতটুকু অধিকার দিতে প্রস্তুত ছিলেন যে, ইচ্ছা করলে তারা জাহেলি আকিদা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। কিন্তু কর্তৃত্বের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না।

৪. এ জন্যই প্রত্যেক নবী রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

নবীদের কাজঃ
১. সাধারণ মানুষের মাঝে চিন্তার বিপ্লব সৃষ্টি করা।
২. নির্ভেজাল ইসলামী শিক্ষায় প্রভাবিত একটি শক্তিশালী দল গঠন।
৩. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করে তমুদ্দুনের সমস্ত বিভাগকে নির্ভেজাল ইসলামের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা।

খেলাফতে রাশেদাঃ
১. হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তেইশ বছর নবুয়াতী জিন্দেগীতে যে সমস্ত কাজ পূর্ণরূপে সম্পাদন করেন।
২. আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও ওমর ফারুক (রা.) এর নেতৃত্ব।
৩. উসমান (রা.) এর শাসনামলের ১ম দিককার সময়।


১। একটি আদর্শবাদী দলের পরিচয়:

উত্তর: প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা সমুলে উৎপাটিত করে তার স্থলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একটি আদর্শ বেছে নিতে হয়। এর সাথে পৃথক চিন্তাধারাও থাকে। এ চিন্তা ও আদর্শের সাথে যারা সকল দিক দিয়ে একমত পোষণ করে তারা একটি দল গঠন করে। একে বলা হয় আদর্শবাদী দল।

২। আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ বইয়ে উন্মাদ ও দেওয়ানা বলতে কি বোঝানো হয়েছে?

উন্মাদ: ময়দান নিশ্চিত হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ময়দানে নেমে পড়া আর জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া সমান। উম্মাদেরাই শুধু এটা সম্ভব করতে পারে।

দেওয়ানা: দুর্দান্ত কুফরী শক্তির কর্তৃত্ব দেখার পরও যে ব্যক্তি দারুল ইসলাম কায়েমের জন্য ময়দানে নেমে পড়বে সে অবশ্যই দেওয়ানী।


৩। একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ:

১. দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করা।
২. কুরআন হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন না করা।
৩. সময় ও আর্থিক কোরবানীর প্রতি অবহেলা করা।
৪. দলীয় মূলনীতি মেনে না চলা।
৫. ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করা।
৬. ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব।
৭. জনশক্তির মধ্যেনৈরাশ্য ও হতাশা সৃষ্টি হওয়া।
৮. নেতৃত্বের অভিলাষ।
৯. অর্থ - সম্পদের প্রতি লালসা।
১০. জীবনমান উন্নত করার প্রবণতা।
১১. সহজ সরল জীবন যাপন না করা।
১২. মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করতে না পারা।
১৩. নেতৃত্বের দুর্বলতা
১৪. নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা আন্দোলনের পতন ডেকে আনে।
১৫. বায়তুলমাল সম্পর্কে আমানতদারীর অভাব এবং আর্থিক লেনদেনে সততার অভাব।
১৬. সহজ সরল জীবনযাপন না করা।


৪। তার থেকে বাচাঁর উপায়:

১. নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা।
২. অতিরিক্ত যিকির আযকার করা
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
৪. আত্মসমালোচনা করা
৫. ক্রোধ দমন করা
৬. মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করা।
৭. বিরোধী পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া।
৮. ত্যাগ ও কোরবানী করা
৯. সমস্যার ত্বরিত ও সঠিক সমাধান না করা।

৫। পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ঠ হওয়ার কারন:

১. পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ।
২. গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা।
৩. পরশ্রীকাতরতা।
৪. একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখা।
৫. কারো বিপদে আপদে তার খোঁজ খবর না নেয়া।
৬. পরস্পরবৈষয়িক স্বার্থে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া।
৭. অযথা কারো প্রতি কু-ধারনা পোষণকরা।
৮. এসব কারণে শুধু একটি দলই নয়, বরং মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তি ও ন্নড়ে হয়ে পড়ে।

৬। দারুল ইসলাম ট্রাষ্ট গঠনের পটভূমি:-

১৯৩৭ সালে আল্লামা ইকবাল হায়দ্রাবাদ থেকে পাঞ্জাবে হিজরত করার জন্য মাওলানা মওদূদীকে আহ্বান জানান। আল্লামা ইকবাল তরজুমানুল কোরআনের মাধ্যমে মাওলানার গুনমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি কখনো সাইয়্যেদ নাযির নিয়াযী এবং কখনো মিয়া মুহাম্মদ শফিকে দিয়ে তরজমানুল কোরআন পড়াতেন এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ঠিক এই সময়ে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এস.ডিও চৌধুরী নিয়ায আলী তার ৬০/৭০ একর জমি ইসলামের খেদমতের জন্য ওয়াক্ত করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাকা ঘর বাড়ি তৈরি করে বিশেষ পরিকল্পনার অধীনে দ্বীনের বৃহত্তর খেদমতের অভিলাষী ছিলেন। এ ব্যপারে তিনি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ চাইলে তিনি একমাত্র মাওলানা মওদূদীকে এ কাজের জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। মাওলানা মওদূদী ড. ইকবালের অনুরোধে তার সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর এ কাজের দায়িত্ব গ্রহন করতে রাজি হন এবং চিরদিনের জন্য হায়দ্রাবাদ পরিত্যাগ করে ১৯৩৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোর্ট নামক স্থানে হিজরত করেন। অতপর দারুল ইসলাম নামে একটা ট্রাষ্ট গঠন করে তার মহান কাজের সূচনা করেন।

Tuesday, October 29, 2024

আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার || আবুল আসাদ || একুশ শতকের এজেন্ডা


সেই ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম শুনি যে, ধর্ম-জ্ঞান, গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী। তারপর এই কথা নানাভাবে আরও অনেকের কাছে শুনেছি। লেখা-পড়া যাদের মূর্খ বানিয়েছে, তারা এখনও এসব কথা বলে থাকেন সুযোগ পেলেই। এদের রাগ ইসলামের উপরই বেশি। খ্রিস্টান ধর্ম প্রধানত পাশ্চাত্যের এবং হিন্দুধর্ম ভারতের, তাই এসব ধর্ম ওদের কাছে প্রগতিশীল। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র বলে ইসলামকেও ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ ও অনুন্নয়নের প্রতীক বলে চলছে। অথচ ইসলাম সবচেয়ে বিজ্ঞানমুখী ও সবচেয়ে প্রগতিশীল ধর্ম। ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই। Prof. Joseph Hell বলেন, "মানব জাতির ইতিহাসে স্বীয় ছাপ মুদ্রিত করা সব ধর্মেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ইসলাম যতটা দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্ব মানবের হৃদয় স্পর্শকারী মহা পরিবর্তন সাধন করেছে, জগতের অন্যকোন ধর্ম তা পারেনি।" এই কথাই আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ঐতিহাসিক O. J. Thatcher Ph. D এবং F. Schwill Ph. D তাদের ইতিহাস গ্রন্থে, "পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশ' বছর তার অনুগামিরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।" আর Meyrs তার Mediaeval and Modern History' তে বলেন, "সেখানে এমন এক সভ্যতার উত্থান ঘটে, দুনিয়া যা দেখেছে এমন সবকিছুকেই তা অতিক্রম করে যায়।"


সত্যই ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া-আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামণ্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন সবদিক থেকেই মানব জাতিকে ইসলাম এক অন্যান্য সভ্যতা দান করে।

পাশ্চাত্যের ওরা এখন গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সাংঘাতিক প্রবক্তা সেজেছেন। আর ইসলামকে বলা হচ্ছে মানবতা বিরোধী, অসহিষ্ণু ইত্যাদি। এসব কথা বলার সময় তারা অতিতের দিকে তাকায় না এবং নিজের চেহারার উপর একবারও নজর ফেলেনা। যে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সে সভ্যতায় গণতন্ত্রতো দূরের কথা কোনপ্রকার সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের কোন স্থান নেই। আভ্যন্তরীণভাবে তাদের নীতি ছিল 'সারভাইভেল অব দা ফিটেস্ট/ এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা অনুসারী ছিল 'মাইট ইজ রাইট'। গ্রীকরা বলতো 'যারা গ্রীক নয় তারা গ্রীকদের কৃতদাস হবে এটা প্রকৃতির ইচ্ছা।' আর রোমানরা মনে করতো, তারাই পৃথিবীর মালিক, পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের জন্যই। ইউরোপের এই অন্ধকার যুগে মানবাধিকার বলতে কোন ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। পরাজিত ও ভাগ্যাহতদের নিহত হওয়া অথবা চিরতরে দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হওয়াই ছিল ভবিতব্য। নারীদের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ অধিকার থাকা দূরের কথা তারা পূর্ণ মানুষ কিনা তা নিয়েই ছিল বিতর্ক। শত্রু ও বাদী জাতীয় লোকদের কোন মানবিক অধিকার স্বীকৃত ছিলনা।

এই দুঃসহ অন্ধকারের হাত থেকে ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে, পৃথিবীকে নিয়ে আসে আইনী শাসনের আলোকে। চৌদ্দশ' বছর আগে ইসলাম ঘোষণা করে, বংশ, বর্ণ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এই নীতি হিসেবে ইসলাম সব মানুষকেই আইনের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে রক্ষা করেছে যথেচ্ছচার থেকে। শত্রু ও পরাজিত বন্দীদেরকেও ইসলাম মানুষ হিসাবে দেখতে বলে। কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের স্থানে মানবসুলভ, মেহমানসুলভ ব্যবহার করতে বলেছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বন্দীদের সুখাদ্য দিতে হবে, বন্দীদের উত্তাপ ও শৈত্য থেকে রক্ষা করতে হবে, কোন কষ্ট অনুভব করলে দ্রুত তা দূর করতে হবে, বন্দীদের মধ্যে কোন মাতাকে তার সন্তান থেকে, কোন আত্মীয়কে অন্য আত্মীয় থেকে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান-মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের কাছ থেকে জবরদস্তী কোন কাজ নেয়া যাবে না। যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এ নীতিমালা ইসলাম দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে, পাশ্চাত্য এই শিক্ষা, আংশিকভাবে, গ্রহণ করে মাত্র ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব আকারে। ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে বিধান দেয় যে, চিকিৎসা পুরাপুরি মানবীয় সেবা। চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কোন অনিষ্ট করা যাবে না। ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করেই পাশ্চাত্য মাত্র ১৮৬৪ সালে রেডক্রস গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সুযোগকে শত্রু-মিত্র বিবেচনার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মানবতা বিরোধী দাস প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা করে ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ইসলামে পুরুষের মতই নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ইসলামের এই শিক্ষার পরও ১১শ' বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য নারীদের শিক্ষার উপযুক্ত ভাবেনি। অবশেষে ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা প্রথম স্কুলে যাবার সুযোগ পায়। আর নিজ নামে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় ১৮৪৮ সালে। অথচ ইসলাম নারীদের এ অধিকার দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে। পাশ্চাত্য যেখানে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের আগ পর্যন্ত বিজিত দেশের মানুষকে দাস মনে করতো এবং এখনও লুটতরাজের যোগ্য মনে করে, সেখানে ইসলাম বিজিত দেশের মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দেখে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোন নতুন ভূখণ্ড মুসলমানদের দখলে এলে সেখানকার মানুষকে আর শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হতোনা। মুক্ত মানুষ হিসাবে তাদের এ অধিকার দেয়া হতো যে, তারা একবছর সময়কালের মধ্যে যেন সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা পছন্দের কোন দেশে চলে যাবে, না মুসলিম দেশের নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে।

মানবতাকে ইসলাম সম্মান করে বলেই ইসলাম ও মুসলমানরা সহিষ্ণুতার প্রতীক। একটা উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে, তখন তারা ৭০ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। আর মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করে, তখন একজন খ্রিস্টানের গায়েও হাত দেয়া হয়নি। চৌদ্দশ' বছর ইসলাম যে বিচার ব্যবস্থা পত্তন করে, বিশ্ব সভ্যতায় তা অন্যান্য সংযোজন। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুরু থেকেই ইসলাম শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন, কিন্তু বিচারপতিরা শাসন-কর্তৃত্বের অধীন হতেন না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে তারা সাধারণ আসামিদের মতই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখিন হতেন। অনেক মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাবে খলিফারা হেরেছেন। এবং এই হেরে যাওয়াকে তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।

মানবাধিকারের মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম বিশ্ব সভ্যতায় অনন্য এক কল্যাণ ধারার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিস্বার্থ সমূহের পদতলে সামষ্টিক স্বার্থ নিক্ষেপ হতো। ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থ ও সামষ্টিক স্বার্থ উভয়কেই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করে এবং উভয়ের মধ্যে কল্যাণকর এক ভারসাম্য বিধান করে। সমাজের একক ইউনিট হিসেবে ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারপর পরিচয় ও সহযোগিতার জন্য বংশ ও সামাজিকতাকে এবং শাসন ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করেছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিতরণধর্মীতা ও পুঁজিগঠন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ইসলামে ম্যাক্রো অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো অর্থনীতি। ব্যক্তিগত বৈধ সম্পত্তির ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ ইসলাম করেনি, কিন্তু শর্ত দিয়েছে প্রতিবেশী কেউ যেন না খেয়ে না থাকে এবং সঞ্চয়ের বদলে সম্পদ যেন বিনিয়োগমুখী হয়। চৌদ্দশত বছর আগের ইসলামের এই অর্থনীতি আজকের আধুনিক অর্থনীতির চেয়েও আধুনিক ও কল্যাণকর।

সবশেষে আগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের কথা।

ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর ধর্ম বলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে নতুন সাজে সজ্জিত করেছে। খ্রিস্টায় এগার শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে পাশ্চাত্য যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে অষ্টম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত কাল ছিল মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মার্টন তার পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে ইসলামের অবদানকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। ৪ তাঁর এই ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ- নিরবচ্ছিন্ন এই ৩৫০ বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের চূড়ান্ত আধিপত্যের যুগ। এই সময় যেসব 
মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জারীর, খাওয়ারিজাম, রাজী, মাসুদী, ওয়াফা, বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইয়াম এবং ওমর খৈয়াম। এই বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীতে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সে আলোকে স্নাত হচ্ছিল অন্ধকার ও ঘুমন্ত ইউরোপ। ইউরোপীয় ছাত্ররা তখন স্পেন ও বাগদাদের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের পদতলে বসে জ্ঞান আহরণ করছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই ইউরোপীয় ছাত্ররাই জ্ঞানের আলোক নিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফল হিসেবে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে ক্রিমোনোর জেরার্ড, রজার বেকন- এর মত বিজ্ঞানীদের নাম সামনে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মাটনের মতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু'শ পঞ্চাশ বছরের এ সময়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার সম্মানটা মুসলমানরা ও ইউরোপ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন নাসিরউদ্দিন তুসী, ইবনে রুশদ এবং ইবনে নাফিসের মত বিজ্ঞানীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় গৌরবপূর্ণ সূর্য অস্তমিত হয় এবং পাশ্চাত্যের কাছে হারতে শুরু করে মুসলমানরা। অবশ্য এর পরেও মুসলমানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চমক কখনও কখনও দেখা গেলেও (যেমন ১৪৩৭ সালে সমরখন্দে আমির তাইমুর পৌত্র উলুগ বেগের দরবার এবং ১৭২০ সালে মোগল সম্রাটের দরবারে জীজ মোহাম্মদ শাহীর সংকলন) তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

তবে বিজ্ঞানে ছয়'শ বছরের যে মুসলিম অবদান তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং বিজ্ঞান-রেনেসাঁর জনক। মুসলমানরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থারও জনক। 'ইউরোপ যখন গির্জা ও মঠ ব্যতীত অপর সকল শিক্ষালয়ের কথা কল্পনাও করেনি, তার শত শত বছর আগে মুসলমানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, যেখানে হাজারো ছাত্র উন্নত পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতো। গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নও ইসলামি সভ্যতার অবদান। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল লাখো গ্রন্থে ঠাসা। ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর তখন ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক Dosy-এর মতে স্পেনের আলমেরিয়ার ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অসংখ্য পুস্তিকা ছাড়া শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ। এসব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারটি ছিল বিজ্ঞান-

চর্চা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির সুতিকাগৃহ। বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের গৌরবজনক বিচরণ। গণিত শাস্ত্রে রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। আমরা যে ৯ পর্যন্ত নয়টি সংখ্যা ব্যবহার করি, তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। কিন্তু 'শূন্য' (Zero)-এর বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা সর্বপ্রথম 'শূন্য' আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে ইনিই সর্বপ্রথম 'দশমিক বিন্দু' (decimal notation) ব্যবহার করেন। সংখ্যার স্থানীয় মান' (value of position) তারই আবিষ্কার। বীজগণিত বা 'এলজেব্রা' মুসলমানদের সৃষ্টি। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল জাবের-এর নাম অনুসারে'এলজেব্রা' নামকরণ হয়। শিঞ্জিনী (sine), সার্শ-জ্যা (tangent) ও প্রতি স্পর্শ-ক্যক (co-tangent) প্রভৃতি আবিষ্কার করে বর্তুলাকার ক্রিকোণমিতির উন্নতি করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আলোক বিজ্ঞানে focus' নির্ণয়, চশমা আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজানের কীর্তি। কিন্তু রজার বেকন এই আবিষ্কার পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কারক সেজেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে 'মানমন্দির' (observatory) ব্যবহার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। এর আগে 'মানমন্দির' সম্পর্কে কোন ধারণা কারও ছিল না। গণনা দ্বারা রাশি- চক্রের কোণ (angle of the ecliptic), সমরাত্রি দিনের প্রাগয়ন (pre- cission of the equinoxes), Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মন্ত্রকোর্দ্ধ নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু), প্রভৃতির উদ্ভাবন মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চিকিৎসার বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দান করেন।
ইউরোপ যখন খ্রিস্টান গির্জা ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা রোগের ব্যবস্থা দিতেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান মুসলমানদের হাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীয় আল রাজীর চিকিৎসা বিষয়ক 'বিশ্বকোষ' দশখণ্ডে সমাপ্ত। এই চিকিৎসা বিশ্ব-কোষ ও ইবনে সিনা'র ব্যবস্থা' ইউরোপী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল। বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা কেমিস্ট্রির নামকরণই হয় মুসলিম বিজ্ঞানী 'আল কেমী'র নাম অনুসারে। কেমিস্ট্রি'-এর সুবাসার (Alcohol), কাঠ ভষ্ম-ক্ষারের ধাতার্বকমূল (patassium), পারদ বিশেষ (corrosive sublimate), কার্ষকি (Nitrate of silver, যবক্ষার দ্রাবক (Nitric Acid) গন্ধক দ্রাবক (Sulphuric Acid), জুলাপ (Julep), অন্তসার (Elixer), কপূর (Caurphar), এবং সোমামুখী (senna), প্রভৃতি। মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইউরোপ যখন মনে করতো পৃথিবী সমতল, তখন বাগদাদে গোলাকার পৃথিবীর পরিধী নির্ণিত হয়েছিল। চন্দ্র যে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, একথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা জানতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের কক্ষ নির্ধারিত করেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ কম্পাস যন্ত্র মুসলিম বিজ্ঞানির আবিষ্কার। মুসলমানরা নকশার বৈচিত্র ও সৌন্দর্য এবং শিল্প কৌশলের পূর্ণতা বিধানে ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বি। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, লৌহ, ইস্পাত, প্রভৃতির কাজে তারা ছিলো দক্ষ। বস্ত্র শিল্পে এখনও মুসলমানদের কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। উত্তম কাচ, কালী, মাটির পাত্র, নানা প্রকার উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুত করাসহ রং পাকা করার কৌশল ও চর্ম-সংস্কারের বহুবিধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম কুশলীরা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। তাদের এসব কাজ ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল। সিরাপ ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে মুসলমানদের ছিল একাধিপত্য। মুসলমানদের কৃষি পদ্ধতি ছিল খুবই উন্নত। তারা স্পেনে যে কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করেন, ইউরোপের জন্য তা তখনও বিস্ময়। পানি সেচ পদ্ধতি তাদের উৎকৃষ্ট ছিল। মাটির গুণাগুণ বিচার করে তারা ফসল বপন করতেন। সারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা জানতেন। 'কলম' করা ও নানা প্রকার ফল-ফুলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে তারা ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ।

বহু শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বাণিজ্য-জগতের ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। নৌ যুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ছিলেন অতুলনীয় সমুদ্রচারী। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত সাগর ও চীন সাগরে এককভাবে চষে ফিরত। মুসলিম নাবিকদের ছাত্র হিসাবেই ইউরোপীয়রা গভীর সমুদ্রে প্রথম পদচারণা করে। ভন ক্রেমার বলেন, আরব নৌবহর ছিল বহু বিষয়ে খ্রিস্টানদের আদর্শ।' মুসলমানদের যুদ্ধ-পদ্ধতি ও যুদ্ধ বিদ্যাও ইউরোপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ইউরোপের Chivalry স্পেনীয় মুসলিম বাহিনীর অনুকরণ।


মোট কথা, বলা যায়, মুসলমান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার যে অবদান রাখেন, তা এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, বিশ্ব সভ্যতাকে করে নতুন এক রূপে রূপময় যা চিন্তা, চেতনা, আচার-আচরণ, জীবন-যাপন, জীবনাপোকরণ সবদিক দিয়েই আধুনিক। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে সভ্যতার এই নতুন-উত্থান- যাত্রা থেমে না গেলে আরও কয়েকশ' বছর অগেই বিশ্ব আধুনিক বিজ্ঞান যুগে প্রবেশ করতো। কিন্তু তা হয়নি। না হলেও তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকশ' বছর পরে হলেও মুসলমানদের কাজ সম্পন্ন করেছে। ইসলামি সভ্যতাকে বাদ দিলে বা মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আর থাকে না, তার সভ্যতাও অন্ধকারে তলিয়ে যায়।


লিওনার্দো এজন্যই লিখেছেন, "আরবদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও মানসিক সমৃদ্ধি এবং অভ্রান্ত শিক্ষা-প্রথা বিদ্যমান না থাকলে ইউরোপকে আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকতে হতো।


রেফারেন্স:
১। S. Khuda Bakhsh, M. A. BCL. Bar-at Law, প্রণীত 'Arab civilization গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৬
২। 'A general History of Europe, Vol-1 Page-172 ৩। Mayers, 'Mediaeval and Modern History' Page-54
৪। নোবেল বিজ্ঞানী আবদুস সালাম' এর 'Ideas and Realities' গ্রন্থে উদ্ধৃত
(বাংলা অনুবাদঃ 'আদর্শ ও বাস্তবতা,' পৃষ্ঠা, ২৬৮ ৫। Mayers, "Mediaeval and Modern History, Page, 56
৬। Dozy, Spanish Islam'. Page 610
৭। Thateher Ph. D and F. Schwill Ph. D. 'A general History Europe', vol-1 page, 173
৮। Von Kremar এই উক্তি S. khuda Bakhsh এর 'Arab civilization' এর উদ্বৃত, Page, 72
৯। Thatcher and F. Schwill, 'A general History of Europe, Vol-1 pages, 174-188