Close

Monday, May 5, 2025

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

•ভূমিকা: 
ইতিহাসের পাতাজুড়ে সত্য ও স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের বহু গৌরবগাথা রচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধ বদর থেকে শুরু করে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ রক্তস্নাত সংগ্রামের উদাহরণ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বালাকোটের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনা একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। এই অসমযুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রেরণাদায়ী নেতা শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সাহসী সহযোদ্ধাদের নিয়ে যে শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপী ৬ মে দিনটিকে "বালাকোট দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন করে থাকে। বালাকোটের শহীদদের সেই ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ ভারতীয় মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা একটি স্বাধীন আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

•বালাকোটের ঐতিহাসিক পটভূমি:

উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর বালাকোট, যা আজকের পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার মেনশেহরা জেলার কাগান উপত্যকার প্রবেশপথে অবস্থিত। আঠারো শতকের শেষ দিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আফগান দুররানি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে, শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৮ সালে শিখ বাহিনী পেশোয়ার দখল করে নেয়, যার ফলে সেই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী শিখ শাসনের অধীনে চলে আসে। শিখ শাসকদের অধীনে মুসলমানরা তখন জুমার নামাজ, আজান, কুরবানি, এমনকি ধর্মীয় পোশাক পরিধানেও বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। এই অবমাননাকর অবস্থা মুসলমানদের মনে তীব্র কষ্ট ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার অনেক মুসলিম সরদার ও খান নিজেদের জীবন ও ধর্ম রক্ষার জন্য দিল্লির একজন প্রখ্যাত ইসলামী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শরণাপন্ন হন। একই সময় ভারতজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদও তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী পরিচয় বজায় রাখা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার তাগিদ তীব্র হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় একটি অখণ্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজাদী আন্দোলন। এই ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী (১৭৮৬-১৮৩১) - ভারতের এক খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও সামরিক নেতা।

•সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর জীবন ও আন্দোলনের বিস্তৃত পটভূমি:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ১৭৮৬ সালে এলাহাবাদের রায়বেরেলভী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলমুল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিল্লি যান এবং বিখ্যাত আলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একসময় টঙ্কের নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যখন আমীর খান ইংরেজদের সাথে আপস করেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী সেই আপসের বিরোধিতা করে সৈন্যদল ত্যাগ করেন এবং স্বাধীন ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। ১৮১৮ সালে দিল্লি ফিরে এসে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে রোহিলখণ্ড, আগ্রা, মিরাট, মুজাফফরনগর, সাহারানপুর, লক্ষ্ণৌ, বেনারসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংস্কার ও ইসলামী জাগরণমূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা এমন ছিল যে, বহু বিখ্যাত আলেম তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

১৮২১ সালে তিনি প্রায় ৪০০ ভক্তসহ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন, যেখানে উপমহাদেশের বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। এ সময় বাংলার সাহসী নেতা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর তাঁর সান্নিধ্যে আসেন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে সৈয়দ আহমদের প্রভাব উপমহাদেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন এবং তিতুমীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমান্তরালে চলছিল, যা মুসলমানদের একসাথে জাগরণের পরিচায়ক।

হজ থেকে ফিরে এসে সৈয়দ আহমদ দুই দিক দিয়ে তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যান:
সমাজ থেকে কুসংস্কার, শিরক, বিদআত ও জুলুম নির্যাতন দূর করে মুসলমানদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করা;

এবং ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর আন্দোলনে সুফি তরিকার আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট।

১৮২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হিজরত করেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ারে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় এক থেকে দুই হাজার মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এই অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রতি গভীর প্রেম ও স্বাধীনতার দৃঢ়সংকল্পের প্রতিফলন।

পেশোয়ারে পৌঁছে স্থানীয় মুসলমানরা তাঁকে "আমীরুল মুমিনিন" (মুমিনদের নেতা) হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি সেখানে একটি ইসলামী শাসন কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেন এবং স্থানীয় পাঠান গোত্রগুলোর সহায়তায় শিখ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নেন।

প্রথমেই আকোড়া নামক স্থানে এক অতর্কিত রাতের যুদ্ধে তাঁর মুজাহিদ বাহিনী প্রায় ৭০০ শিখ সৈন্যকে পরাজিত করে, যদিও এতে প্রায় ৮০ জন মুসলিম মুজাহিদ শহীদ হন। এই বিজয় মুজাহিদদের মনোবলে নতুন উদ্দীপনা আনে এবং জিহাদের ময়দানে তাদের অটুট বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

মহারাজা রঞ্জিত সিং গোপনে পাঠান গোত্রপতিদের ঘুষ দিয়ে সৈয়দ আহমদের বিপক্ষে দাঁড় করান। ১৮৩০ সালের শেষ দিকে স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে তাঁর বহু সেনা হতাহত হয় এবং তিনি বাধ্য হন পেশোয়ার ত্যাগ করে পাহাড়ি অঞ্চল বালাকোটে আশ্রয় নিতে। তবুও তিনি হার মানেননি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা কৌশলে শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে, তিনি মানসেহরা জেলার দুর্গম পার্বত্য এলাকা বালাকোটকে জিহাদের শেষ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেন, যা পরিণত হয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে।

•বালাকোটের চূড়ান্ত যুদ্ধ: আত্মত্যাগের অমরগাথা:


একদিকে সীমান্ত এলাকার সর্দারদের অর্থলোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে শিখদের বিশাল সুসজ্জিত বাহিনী-এই অসম পরিস্থিতিতেও বীর মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) হাল ছাড়েননি। পাহাড়ঘেরা দুর্গম উপত্যকায় থেকেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দৃঢ়সংকল্পে অটল ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যাচারী শিখ ও ইংরেজ শাসকদের বিতাড়ন করে ভারতবর্ষে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।

বালাকোট-চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ উপত্যকা, সৈয়দ আহমদের ইসলামী আন্দোলনের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে, শুক্রবার ভোরবেলা, এই উপত্যকায় শেষ লড়াই শুরু হয়। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধা শাহ ইসমাঈল দেহলভী প্রায় ৬০০-৭০০ মুজাহিদ নিয়ে বালাকোটে অবস্থান নেন। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল শিখ সাম্রাজ্যের প্রায় ১০,০০০ সৈন্য, যাদের নেতৃত্বে ছিল কনওয়ার শের সিং, মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সেনাপতি।

ভোর হওয়ার আগেই মুজাহিদরা মসজিদে বালার কাছে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হঠাৎ করে শিখ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিক আক্রমণে তারা সাফল্যও পায়-শিখদের একটি দলকে আশ্চর্যজনকভাবে ঘায়েল করা সম্ভব হয়। কিন্তু শিখদের সংখ্যাগত ও অস্ত্রশক্তির আধিক্যের কারণে পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শের সিং পুরো উপত্যকাকে ঘিরে ফেলে এবং মেটিকোট পাহাড়ের ওপর থেকে অসংখ্য শিখ সৈন্য নিচে নেমে চারদিক থেকে মুজাহিদদের আক্রমণ করে।

সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং আত্মত্যাগের এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে সৈয়দ আহমদ শহীদ হন মেটিকোট পাহাড়ের একটি ঝরনার পাশে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহ ইসমাঈল দেহলভীও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। তাঁদের শাহাদাতের খবর মুজাহিদদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে না পৌঁছানোয় অনেকে ইমামকে খুঁজতে খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়ে শত্রুর হাতে নিহত হন। এদিকে কিছু সাহসী মুজাহিদ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সংখ্যার ভারে দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় গুজর গোত্রের কিছু ব্যক্তি প্রচার করে, "সৈয়দ সাহেব নিরাপদে পাহাড়ের ওপরে আছেন, সবাই দ্রুত সেদিকে চলে যান।" এই ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক মুজাহিদ পিছনে সরে যান এবং সেই সুযোগে শিখ বাহিনী পুরোপুরি জয়লাভ করে। এই দিনের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ৩০০ মুজাহিদ শহীদ হন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের (তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের) মুজাহিদরাও ছিলেন। শিখ সৈন্যরা সৈয়দ আহমদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে শিরশ্ছেদ করে এবং বহু অনুসারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষে বালাকোটের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তারা মুসলমানদের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।

তবুও এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মাত্র ৭০০ মুজাহিদের বাহিনী প্রায় ১,০০০ শিখ সৈন্যকে হতভম্ব করে অসীম সাহসিকতার যে উদাহরণ স্থাপন করেছিল, তা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় অধ্যায়। এত বড় আত্মত্যাগের ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৩১ সালের ১৮ মে, অর্থাৎ ১১ দিন পর বাংলায় বঙ্গবীর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ কামানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদের "তরীকা-এ-মুহাম্মদী" আন্দোলন তাঁর শাহাদাতের পরও থেমে যায়নি-বরং তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এই আন্দোলনই পরবর্তী মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করে।

•আন্দোলনের আদর্শিক ও আধ্যাত্মিক দিক:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে বালাকোটের আন্দোলন "তরীক-এ-মুহাম্মদী" নামে পরিচালনা করেন, যার মূলমন্ত্র ছিল-হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা। শাহ ইসমাঈল দেহলভী-সহ বিশিষ্ট আলেমরা তাঁর সহযোগী ছিলেন। তিনি খিলাফতের আদলে একটি শরিয়াহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলে তিনি অল্প সময়ের জন্য হলেও শরিয়তের আলোকে শাসন চালু করেন। তিনি:
পণপ্রথা ও জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ করেন,
জাকাত ও উশর আদায় করে বায়তুলমাল গঠন করেন,
এবং গোত্রীয় রীতি না মেনে শরিয়তের বিধান মানার নির্দেশ দেন।

এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমে কিছু গোত্র ও নেতা অসন্তুষ্ট হলেও এটি ছিল ন্যায়ভিত্তিক ইসল, সাহসী প্রয়াস। সৈয়দ আহমদের এই আন্দোলনের আদর্শিক ধারা আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহ।, ভারতের হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তিতুমীর-এর আন্দোলনের সঙ্গেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধোত্তর পরিণতি ও আন্দোলনের উত্তরাধিকার:


বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধাদের শাহাদাত আন্দোলনটির তাৎক্ষণিক সামরিক পরাজয় নিশ্চিত করেছিল। তবে এই পরাজয়ের মধ্যেও তাঁদের আত্মত্যাগ ও আদর্শিক দৃঢ়তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। যুদ্ধের পর শিখ বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৈয়দ আহমদের পরিবারের কিছু সদস্য ভারতে টঙ্কে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরও আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি।

ইমাম মাহমুদ, যিনি সৈয়দ আহমদের খলিফা ছিলেন, কিছুদিন আন্দোলনের হাল ধরার চেষ্টা করেন। এরপর উইলায়ত আলী ও এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ১৮৫০'র দশক পর্যন্ত ছোট পরিসরে আন্দোলনের কার্যক্রম চলমান ছিল। তবুও ব্রিটিশরা সংগঠিতভাবে এই অবশিষ্ট অনুসারীদেরও দমন করে। সংখ্যায় ও অস্ত্র-সরঞ্জামে দুর্বলতা একটি কারণ হলেও অধিকাংশ গবেষক স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখেন।

শুরুর দিকে যেসব স্থানীয় মুসলিম নেতা সৈয়দ আহমদকে আহ্বান জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় তারা অনেকেই পাশে ছিলেন না। বরং কেউ কেউ শিখদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন। এমনকি মুজাহিদ বাহিনীতে গুপ্তচর হিসেবে প্রবেশ করে শিখদের গোপন পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দেয়, যা তাদের আক্রমণ সফল করে তোলে। হাজারা এলাকার এক গোত্রপ্রধান শিখদের বালাকোট ঘিরে ধরার গোপন রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আবার পেশোয়ারে সৈয়দ আহমদ যাকে শাসক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই সুলতান মুহাম্মদ খান বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক শীর্ষ মুজাহিদকে হত্যা করেন এবং শত্রুপক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দেন।

সৈয়দ আহমদ শহীদ উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে "শাহাদাত" ও "ইসলামী রাষ্ট্র" চেতনার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে বহু আন্দোলনে অঙ্কুরিত হয়। পশ্চিমা গবেষক এডওয়ার্ড মোর্টিমার বলেছেন, “সৈয়দ আহমদ ছিলেন আধুনিক ইসলামপন্থিদের একজন প্রথমদিকের চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রামকে একত্রিত করে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।" তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মুজাহিদ বাহিনী মুসলমানদের মধ্যে যে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল, এই আদর্শ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে-
দেওবন্দি উলামাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে,
তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহে,
আধুনিক কালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলের ইসলামী সংগঠনগুলোর মাঝেও।
সর্বসম্মতিক্রমে বলা যায়- সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের প্রথমদিককার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন, যাঁর আদর্শ, সংগ্রাম, জীবন ও মৃত্যু একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় ইসলামী জাগরণের উজ্জ্বল প্রতীক।

•বালাকোটের শিক্ষা ও আমাদের প্রেরণা:


বালাকোটের যুদ্ধ এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) যেমন মুসলমানরা ইসলামী আদর্শ ও স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আজও ঠিক তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা একই সংগ্রামে লিপ্ত। আজ কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইহুদিদের, চীনের জিনজিয়াংয়ে বৌদ্ধ-চিনপন্থি শাসকদের, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নির্যাতন-এসবই দেখায় যে মুসলিম জাতি এখনো চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামও এই একই ঐতিহাসিক ধারার অংশ, যা বালাকোটের চেতনা থেকেই অনুপ্রাণিত।

প্রথমত, ঐক্যের শিক্ষা
সৈয়দ আহমদের আন্দোলন স্থানীয় মুসলমানদের বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বিজয়ী হয়েছে। আজকের তরুণদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে-মতপার্থক্য ভুলে ন্যায়ের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

দ্বিতীয়ত, আদর্শের প্রতি অবিচলতা ও আত্মত্যাগ
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তাঁর সাথীরা ঈমান, ন্যায় ও স্বাধীনতার আদর্শে অটল ছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে,
সত্য ও ইসলামী চেতনার পক্ষে দৃঢ় থাকা এবং প্রয়োজনে প্রাণ দেওয়াড়এই গুণটি মুসলমানদের শক্তির মূলভিত্তি। তারা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি-আমাদেরও সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে।

তৃতীয়ত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির গুরুত্ব
ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা-এই তিনটি গুণই দুর্বলকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আজকের তরুণদের জীবনের যেকোনো সংগ্রামে-হোক তা সামাজিক ন্যায়, নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জাতির উন্নয়ন-নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সততাই তাদের সফলতার প্রধান হাতিয়ার।

চতুর্থত, সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) সীমিত সম্পদ নিয়েও একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন-যার নিজস্ব অর্থসংগ্রহ, কাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বব্যবস্থা ছিল। আজকের বাংলাদেশে কিংবা মুসলিম সমাজে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নয়, দরকার সৎ নেতৃত্ব ও সংগঠিত কর্মপন্থা।

পঞ্চমত, চেতনার উত্তরাধিকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ইতিহাস ও বালাকোটের ইতিহাসের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাকে এক জায়গায় মিলিত করে। স্বাধীনতা মুখের কথা নয়-এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। তাই আমরা যেন কখনো আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ভুলে না যাই।

•উপসংহার:

বদর থেকে বালাকোট-এই দীর্ঘ সময়সীমায় মুসলিম উম্মাহ বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা ঈমান, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতি অটল থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত বালাকোট আন্দোলন সেই ধারাবাহিক সংগ্রামের ধর্মীয় আদর্শ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একসূত্রে মিলিত হয়ে গড়েছিল এক অনন্য ইতিহাস।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরি ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখান থেকে আমরা ঐক্য, আত্মত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা সম্পর্কে শিক্ষা পাই। সত্য ও স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্মৃতি আমাদের সাহস জোগায়। তাদের আত্মত্যাগের মূল্যেই আজ আমরা স্বাধীন সেই শিক্ষা আমাদের জাতি গঠনের দায়িত্বে আরও সচেতন করে। বালাকোটের শহীদগণ আমাদের প্রেরণা জোগান। আসুন, আমরা নিজ নিজ আদর্শে অটল থেকে জাতির কল্যাণ ও ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করি। আমরা যদি অতীতের সেই মহান শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আগামীর সুন্দর ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।


তথ্যসূত্র:
১. বদর থেকে বালাকোট, বদরুজ্জামান, দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ, ২০২১
২. চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমিন দুলাল, প্রফেসর'স পাবলিকেশন্স, ৬ষ্ঠ প্রকাশ, ২০১২
৩. কারবালা থেকে বালাকোট, মুহাম্মদ সোলায়মান ফররুখ আবাদী, প্রতীতি প্রকাশন
৪. শহীদে বালাকোট (শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. (১২৪৬-১৮৩১), আল্লামা খালেদ মাহমূদ, মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরী
(অনুবাদক), নূরুল কুরআন প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ, ২০১৮
৫. বালাকোটের প্রান্তর, আরীফুর রহমান, আবরণ প্রকাশন, ১ম প্রকাশ, ২০২১

[ বুকলেট প্রকাশনায়: বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ]

Tuesday, March 11, 2025

১১ মার্চ: ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঐতিহাসিক শহীদ দিবস || শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা

১১ মার্চ: ঐতিহাসিক শহীদ দিবস— শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিরোধী শক্তির আঘাতে প্রাণ হারান আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার।

• ঘটনার সূত্রপাত:
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীরা ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীনবরণের প্রচার কার্য চালানোর সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, এতে কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হন। শিবির তাদের শত উসকানি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে।

• ১১ মার্চের রক্তাক্ত সকাল:
১১ মার্চ সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহ্বানে নবাগত ছাত্রসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবিরকর্মী গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পাশের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র।

শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। শিবির নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল শিবিরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তথাকথিত বামপন্থার কেন্দ্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে।

একপর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চতুর্দিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবিরকর্মীরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাকভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দেয়।

সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় নিরস্ত্র ছাত্রশিবির কর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও তারা সন্ত্রাসীদের নৃশংস আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

সন্ত্রাসীরা পাশবিক কায়দায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহীদ শাব্বির আহম্মেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে মাথায় লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ আব্দুল হামিদকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আরেকটি ইট দিয়ে তার মাথায় একের পর এক আঘাত করে। এতে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান।

শহীদ আইয়ুব ভাই ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহাদাত বরণ করেন। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই।

সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাকাণ্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবিরবিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।

১১ মার্চের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শিবিরকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মরণকামড় দিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। তারাই তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়ে। তারা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি, বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর, শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত।

মতিহারের সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করেছে—এ সত্য আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন: 

Monday, March 3, 2025

লক্ষ্য অর্জনে বার্ষিক পরিকল্পনা ২০২৫ -মু. আসাদুজ্জামান || মাসিক ছাত্রসংবাদ

লক্ষ্য অর্জনে বার্ষিক পরিকল্পনা-২০২৫ -মু. আসাদুজ্জামান
প্রত্যেক সফল আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং সুদৃঢ় লক্ষ্য। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের জনশক্তিদের জন্য ২০২৫ সালকে একটি নতুন অধ্যায়ে রূপান্তর করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত রূপরেখা প্রয়োজন। এটি কেবল ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সংগঠনের অগ্রগতির জন্য নয়, বরং ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পরিকল্পনা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার মূল ভিত্তি। বলা হয়ে থাকে Well-planned is half done. তাই পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে SMART কৌশল অনুসরণ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, বাস্তবসম্মত ও সময়সীমার মধ্যে বাঁধা পরিকল্পনা বা SMART পরিকল্পনা (Specific, Measurable, Achievable, Realistic, Time-bound) মানুষকে সুসংগঠিত ও লক্ষ্যভেদী করে তোলে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, “তোমরা ভালোভাবে লক্ষ্য করো, তোমরা নিজেদের জন্য আগে থেকে কী প্রেরণ করছো আগামী দিনের জন্য।” (সূরা হাশর : ১৮)

এটি আমাদের জীবন পরিচালনায় সুস্পষ্ট পরিকল্পনার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের শিখিয়েছেন পরিকল্পিত কাজের গুরুত্ব। তিনি বলেন, “মহান আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, যে কোনো কাজ করলে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে।” (বায়হাকি : শুয়াবুল ঈমান)


SMART পরিকল্পনার উপাদানসমূহ:


Specific (সুনির্দিষ্ট): পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। যেমন, “আমি বছরে ৫টি ভালো বই পড়ব।”
উপকারিতা: লক্ষ্য নির্ধারণ সহজ হয়।

Measurable (পরিমাপযোগ্য): পরিকল্পনাটি এমন হতে হবে যা মাপা যায়। যেমন, “প্রতি মাসে একটি বই পড়ব।”
উপকারিতা: উন্নতি পর্যবেক্ষণ সম্ভব।

Achievable (অর্জনযোগ্য): লক্ষ্য এমন হতে হবে যা বাস্তবায়নযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, “দিনে ৩০ মিনিট সময় সাহিত্য অধ্যয়নে ব্যয় করব।”
উপকারিতা: অহেতুক চাপ এড়ানো যায়।

Realistic (বাস্তবসম্মত): পরিকল্পনা হওয়া উচিত বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, “আমি প্রতিদিন ৮-১০ পৃষ্ঠা পড়ব।”
উপকারিতা : লক্ষ্য অর্জনে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা সহজ হয়।

Time-bound (সময়সীমাবদ্ধ): পরিকল্পনার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন। যেমন, “এক বছরের মধ্যে পুরো কুরআন তাফসির পড়া শেষ করব।”
উপকারিতা: সময়মতো কাজ সম্পন্ন হয়।

•SMART পরিকল্পনার গুরুত্ব:

-ইসলামের দৃষ্টিকোণ: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি দুই দিনের আমল সমান রাখে, সে ক্ষতিগ্রস্ত (বায়হাকি)।” এটি প্রমাণ করে যে পরিকল্পনা ছাড়া উন্নতি অসম্ভব।

-মানব জীবনে প্রভাব: ইবনে খালদুন বলেন, “পরিকল্পনা মানুষকে লক্ষ্য অর্জনের সঠিক পথে নিয়ে যায়।” পরিকল্পিত কাজের মাধ্যমে আমরা সময়, দক্ষতা ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি।

SMART পরিকল্পনা আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সফলতা অর্জনে সহায়তা করে। কুরআন, হাদিস এবং ইতিহাসের শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে আমরা জ্ঞানী ও সংগঠিত জীবন গড়ে তুলতে পারি। আল্লাহর সাহায্য এবং একাগ্রতার সঙ্গে পরিকল্পিত জীবনযাপনই দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্যের চাবিকাঠি।

অধ্যয়ন, সাংগঠনিক দক্ষতা, দাওয়াতি কাজ, পেশাগত প্রস্তুতি এবং ইবাদতের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
একটি আদর্শিক ও সুসংগঠিত জীবন গড়ার জন্য প্রয়োজন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আত্মোন্নয়ন, অ্যাকাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব, সফ্ট স্কিল ও হার্ড স্কিলের দক্ষতা এবং দাওয়াতের কার্যক্রমকে বাস্তবমুখী করা। আমরা যদি এই স্তম্ভগুলো দৃঢ় করি, তবে ২০২৫ সাল আমাদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হবে ইনশাআল্লাহ।


যে মৌলিক বিষয়সমূহকে সামনে রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন-

১. অধ্যয়ন পরিকল্পনা
২. অ্যাকাডেমিক পরিকল্পনা
৩. সফট্ ও হার্ড স্কিল উন্নয়ন পরিকল্পনা
৪. দাওয়াতি পরিকল্পনা
৫. সাংগঠনিক পরিকল্পনা
৬. ইবাদতের পরিকল্পনা
৭. প্রফেশনাল টার্গেট
৮. সামাজিক কাজের পরিকল্পনা


১. অধ্যয়ন পরিকল্পনা


অধ্যয়ন হলো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ভিত্তি। তাই এটি কুরআন, হাদীস, ইসলামী সাহিত্য এবং সাম্প্রতিক বিষয়ের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে।

i. কুরআন অধ্যয়ন

পবিত্র কুরআন ইসলামের মৌলিক জ্ঞানভাণ্ডার এবং একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্কের প্রধান মাধ্যম। এটি কেবলমাত্র একটি পবিত্র কিতাব নয়; বরং এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশিকা এবং পথপ্রদর্শক। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন অপরিহার্য। কারণ, কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা করাই একজন মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “এটি একটি কল্যাণময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাজিল করেছি, যাতে তারা এর আয়াতগুলো গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সাদ: ২৯)

কুরআন নিয়মিত অধ্যয়ন করা মুমিনদের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ। কুরআনের প্রতিটি শব্দ আমাদের জন্য আলোর দিশা। এটি আমাদের শেখায় কোন কাজ আল্লাহর পছন্দনীয় এবং কোনটি অপছন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।” (সহিহ বুখারি : ৫০২৭)

কুরআন পাঠ করার সাথে সাথে এর অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝতে চেষ্টা করা জরুরি। কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার জন্য নিয়মিতভাবে এর অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। লক্ষ্য হওয়া উচিত সময়ে সময়ে পুরো কুরআন অধ্যয়ন সম্পন্ন করা, যেন এটি আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত হয় এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারি।

২০২৫ সালে অন্তত একটা তাফসির গ্রন্থ পড়ে শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা কীভাবে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি?

২০২৫ সালে একটি তাফসির গ্রন্থ পড়ে শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং নিয়মিত অধ্যবসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আপনি তাফহীমুল কুরআন গ্রন্থটি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩২৭৬। এক বছর ৩৬৪ দিন। তাহলে মাসিক ও দৈনিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। মাসে ২৭০ পৃষ্ঠা এবং দিনে ৯ পৃষ্ঠা করে পড়লে বছরের মধ্যে তাফসির গ্রন্থটি শেষ করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।

তবে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে:

অবস্থা অনুযায়ী সময় ব্যবহার: বছরের প্রতিটি দিন সমান হবে না। কিছুদিন সময় বেশি পাওয়া যাবে, আবার কিছুদিন ব্যস্ততার কারণে পড়া সম্ভব নাও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে দিনের পড়ার লক্ষ্য পূরণ না হলে পরবর্তী দিনের সাথে সেই পড়া যোগ করতে হবে।

মাসিক পর্যালোচনা ও সংশোধন: কোনো মাসে যদি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হয়, তখন টার্গেটের অপঠিত পৃষ্ঠাগুলো পরবর্তী মাসের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত করতে হবে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য পূরণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

সময় নির্ধারণ ও অগ্রাধিকার: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। বিশেষ করে ফজরের পর বা রাতের সময়টি এমন অধ্যয়ন কাজে খুব উপযোগী হতে পারে।

আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহর ওপর ভরসা: নিয়মিত অধ্যয়ন করার জন্য ধৈর্য ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন, কারণ তিনিই সকল কাজে বরকত দানকারী।

একটি দিকনির্দেশনা: প্রতিদিন একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন, যেখানে পড়ার অগ্রগতি লিখে রাখবেন। যেমন: পৃষ্ঠা সংখ্যা, অধ্যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নোট করুন। এটি আপনাকে আপনার অবস্থান বুঝতে এবং লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“যারা আমার পথে সংগ্রাম করে, তাদের আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা আনকাবুত: ৬৯)

ছোট ছোট ধাপে এগিয়ে গেলে এবং একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন মেনে চললে তাফসির গ্রন্থটি এক বছরে পড়া সম্ভব হবে। আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন। আমিন।

ii. হাদিস অধ্যয়ন

হাদিস ইসলামী জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস এবং কুরআনের ব্যাখ্যা। তাই কুরআনের পাশাপাশি প্রত্যহ হাদিস অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদিস আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন ও আদর্শের সঠিক পথ দেখায় এবং প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কীভাবে চলতে হবে তা শিক্ষা দেয়।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এক হলো আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি আমার সুন্নাহ।” (মুআত্তা মালিক: ১৬২৮)

পঠিত হাদিসের আলোকে নিজের জীবনকে সাজানো এবং চরিত্রকে সমৃদ্ধ করা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আসুন, আমরা কুরআন ও হাদিসকে আমাদের জীবনধারার কেন্দ্রবিন্দু বানাই। কুরআনের ব্যাখ্যা হলো হাদিস। কুরআন ভালোভাবে অনুধাবন ও বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে হাদিস অধ্যয়নের বিকল্প নেই।

কতগুলো হাদিস গ্রন্থ অথবা সংখ্যা এই বছর পড়ে শেষ করতে চাই তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। টার্গেট নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সিহাহ সিত্তাহ, রিয়াদুস সালেহিন, সাথী ও সদস্য সিলেবাসের হাদিসগ্রন্থসমূহকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। টার্গেট নির্ধারণ হয়ে গেলে হিসাব করতে হবে বছরে কতগুলো হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে? তারপর তাফসির গ্রন্থ অধ্যয়নের কার্যকরী উদ্যোগের আলোকে অধ্যয়ন সম্পন্ন করতে হবে।

iii. ইসলামী সাহিত্য

ইসলামী আন্দোলনের যোগ্য কর্মী হতে হলে ইসলামী আদর্শের গভীর জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের পাশাপাশি সমকালীন ভ্রান্ত মতাদর্শের অসারতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল মুখস্থ বুলি বা প্রচলিত ধারণার ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়; বরং নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে আদর্শিক গভীরতা অর্জন করা অপরিহার্য।

ইসলামী সাহিত্য আমাদের কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী ইতিহাসের আলোকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। এটি চিন্তার মৌলিকত্ব সৃষ্টি করে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নে সহায়ক হয় এবং বাতিল মতাদর্শের ফাঁদ থেকে রক্ষা করে। সুতরাং, ইসলামী আদর্শে দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের জন্য নিয়মিত সাহিত্য অধ্যয়ন অপরিহার্য।

যে বিষয়গুলোর ওপর অধ্যয়নের পরিকল্পনা থাকা চাই তা নিম্নে দেয়া হলো। প্রতিটি বিষয়ের ওপর একাধিক বই সিলেক্ট করে পরিকল্পনায় লিখে ফেলা এবং সব বই মিলে মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা হিসাব করে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা। (যেভাবে তাফসির অধ্যয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।)

iv. সংগঠন ও দাওয়াত

* ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস
* চরিত্র ও আদর্শ
* ইসলামী আদর্শ
* ইবাদাত ও তাযকিয়াতুন নফ্স
* ইসলামী জীবনব্যবস্থা
* ইসলামী আন্দোলন
* ইসলামী অর্থনীতি
* ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা
* ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা
* ইসলামী সংস্কৃতি
* ফিকাহ ও প্রাথমিক উসুলে ফিকাহ,
* মাসয়ালা-মাসায়েল

v. বুদ্ধিভিত্তিক অধ্যয়ন, ইতিহাস ও সাম্প্রতিক বিষয়সমূহ

ইসলামী আন্দোলনের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অগ্রগতির জন্য বুদ্ধিভিত্তিক অধ্যয়ন, ইতিহাস, এবং সমকালীন বিষয় জানা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাস আমাদের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিতে এবং সফলতাগুলো থেকে দিকনির্দেশনা পেতে সহায়তা করে। সমকালীন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়।

ইমাম গাজ্জালি (রহ) বলেন, “জ্ঞানের যে শাখাই হোক, তা আল্লাহর সৃষ্টিকে বুঝতে এবং তাঁর পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।” বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞান চিন্তার গভীরতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়, যা একটি আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য। সুতরাং, ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক রাখতে এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

* প্রতিদিন সংবাদ বিশ্লেষণ করা
* বিশ্বরাজনীতি ও সমাজে ইসলামের ভূমিকা বোঝার জন্য গবেষণা
* ইসলামফোবিয়ার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন
* ক্যারিয়ার ও দক্ষতা
* বিভিন্ন মতবাদ
* সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন
* সাম্প্রতিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পলিসি ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন
* মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (Human Resource Management)
* সময় ব্যবস্থাপনা (Time Management)
* চিরন্তন ও সমসাময়িককালের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন
* বিশ্বায়ন (Globalization)
* সুশাসন (Good Governance)
* আইন ও মানবাধিকার (Law & Human Rights)
* দুর্নীতি ও সন্ত্রাস (Corruption & Terrorism)
* স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাথমিক চিকিৎসা (Health Awareness and First Aid)

প্রতিটি বিষয়ের উপর একাধিক বই সিলেক্ট করে পরিকল্পনায় লিখে ফেলা এবং সব বই মিলে মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা হিসাব করে অধ্যয়নের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা। (যেভাবে তাফসির অধ্যয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে)

২. অ্যাকাডেমিক অধ্যয়ন

“দ্বীন বিজয়ের লক্ষ্যে সুন্দর ক্যারিয়ার” এই স্লোগানকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। দ্বীন বিজয়ের জন্য একটি সুসংগঠিত, সফল ক্যারিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামিক মূল্যবোধ বজায় রেখে এমন একটি পেশা বেছে নিতে হবে যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। একটি ভালো ক্যারিয়ার শুধু ব্যক্তিগত জীবনে স্থিতিশীলতা আনবে না, বরং দাওয়াহ ও মানবকল্যাণমূলক কাজকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। সততা, পরিশ্রম এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কাজ করলে একজন মুমিন তার পেশাগত জীবনের মাধ্যমেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারে। অ্যাকাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব কেবল ক্যারিয়ার গঠনে নয়, বরং ইসলামী আন্দোলনের বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নকে ফলপ্রসূ করতে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন:

সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ: কী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চান বা কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে চান, তা নির্ধারণ করুন। লক্ষ্য পরিষ্কার থাকলে অধ্যয়নে অগ্রগতি সহজ হয়।

পরিকল্পিত রুটিন তৈরি: প্রতিদিনের পড়াশোনার জন্য একটি রুটিন তৈরি করুন। এতে নির্ধারিত সময়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং সময়ের অপচয় কমবে।

নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি: নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীর শেখার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে পাঠ্য বিষয়গুলোর সঠিক ধারণা পাওয়া যায় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সরাসরি প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা করার সুযোগ তৈরি হয়। নিয়মিত উপস্থিতি পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্সকে উন্নত করে।

গভীর মনোযোগ ও মনোযোগ ধরে রাখা: পড়ার সময় মনোযোগ ধরে রাখুন। প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।

ধারাবাহিক অধ্যয়ন: পড়ার চাপ এড়াতে প্রতিদিন অল্প করে অধ্যয়ন করুন। এতে জ্ঞান দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে ধরে রাখা সহজ হয়।

গবেষণামূলক মনোভাব: কেবল মুখস্থ না করে, প্রতিটি বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রশ্ন করতে শিখুন এবং নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা করুন।

নোট তৈরির অভ্যাস: পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করুন। এটি স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং পরীক্ষার আগে সহজে পুনরায় পড়া সম্ভব হয়।

রিভিশন বা পুনরাবৃত্তি: নতুন জিনিস শিখলে তা বারবার পড়ুন। রিভিশন জ্ঞানকে দীর্ঘস্থায়ী করে এবং ভুলের সম্ভাবনা কমায়।

সঠিক রেফারেন্স ব্যবহার: অধ্যয়ন করার সময় নির্ভরযোগ্য বই, গবেষণাপত্র এবং অনলাইন সোর্স ব্যবহার করুন। ভুল তথ্য এড়িয়ে চলুন।

পড়ার পরিবেশ: পড়ার জন্য একটি শান্ত ও পরিষ্কার পরিবেশ বেছে নিন। এটি মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে।

শিক্ষকের দিকনির্দেশনা: যে কোনো জটিল বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষকের সাহায্য নিন। তাদের দিকনির্দেশনা ভুল সংশোধন ও অগ্রগতি আনতে সহায়ক।

গ্রুপ স্টাডি: সহপাঠীদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করলে ধারণা স্পষ্ট হয় এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়।

বইয়ের বাইরে শেখা: অ্যাকাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি ভিডিও লেকচার, অনলাইন কোর্স, এবং শিক্ষামূলক পডকাস্ট থেকে শেখার চেষ্টা করুন।

সময়ের সদ্ব্যবহার: অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় অপচয় না করে, অধ্যয়ন ও বিশ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করুন।

স্বাস্থ্য সচেতনতা: স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন। সঠিক ডায়েট, পর্যাপ্ত ঘুম, এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে সুস্থ থাকুন।

ইতিবাচক মানসিকতা: ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে বরং তা থেকে শিক্ষা নিন। ধৈর্য এবং আত্মবিশ্বাস অধ্যয়নকে সহজ করে তোলে।

আল্লাহর ওপর ভরসা: অধ্যয়নে সাফল্যের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করুন এবং নিয়মিত দোয়া করুন। এতে অধ্যয়নে বরকত আসবে।

এই বিষয়গুলো মেনে চললে আপনার অ্যাকাডেমিক অধ্যয়ন আরও সুন্দর ও ফলপ্রসূ হবে, ইনশাআল্লাহ। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স দিয়ে দাওয়াতের পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। ভালো রেজাল্টের মাধ্যমে অন্যান্য ছাত্রদের ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়।

৩. সফট ও হার্ড স্কিল উন্নয়ন পরিকল্পনা

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য নেতৃত্ব এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফট স্কিল যেমন যোগাযোগ, নেতৃত্ব ও সমন্বয়, কর্মক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নত করে এবং দলগত কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, হার্ড স্কিল হলো নির্দিষ্ট পেশাগত দক্ষতা যা কর্মদক্ষতা বাড়ায় এবং কাজের মান উন্নত করে। দুই ধরনের দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাফল্য আনতে সাহায্য করে। সফট স্কিল ব্যক্তি হিসেবে মূল্যবান করে তোলে, আর হার্ড স্কিল চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা বাড়ায়। সফল ক্যারিয়ারের জন্য উভয়ের ভারসাম্য প্রয়োজন।

সফট স্কিল উন্নয়ন পরিকল্পনা

যোগাযোগ দক্ষতা:
* প্রতিদিন নতুন শব্দভাণ্ডার শেখা।
* দ্বীনি এবং দাওয়াতি বিষয়ের সঠিক উপস্থাপনা শিখুন।
* স্পিচ প্র্যাকটিস এবং পাবলিক স্পিকিং কোর্স করা।

সময় ব্যবস্থাপনা: প্রতিদিনের কাজগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা।

টিমওয়ার্ক: গ্রুপ প্রজেক্টে অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা নেয়া।

সমস্যা সমাধান দক্ষতা:
* লজিক্যাল গেমস ও সমস্যা সমাধানের কেস স্টাডি করা।
* সংঘাত সমাধান এবং সংগঠন পরিচালনায় দক্ষতা।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স: আত্মজ্ঞান বাড়ানো ও অন্যদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা।

হার্ড স্কিল উন্নয়ন পরিকল্পনা

প্রযুক্তিগত দক্ষতা:
* ডিজিটাল টুল ব্যবহারের দক্ষতা (যেমন: মাইক্রোসফট এক্সেল, গ্রাফিক ডিজাইন)।
* প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার শেখার জন্য অনলাইন কোর্স করা। প্রোগ্রামিং, ভিডিও এডিটিং বা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখুন।

ডাটা অ্যানালাইসিস: এক্সেল, পাইথন, এবং ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন টুল শেখা।

ভাষাগত দক্ষতা: ইংরেজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জনের জন্য নিয়মিত প্র্যাকটিস এবং ভাষা অ্যাপ ব্যবহার করা।

বিশেষায়িত দক্ষতা: পেশাগত কোর্স বা প্রশিক্ষণ এবং অনলাইনে সার্টিফিকেশন কোর্সে অংশগ্রহণ করুন।

সফট ও হার্ড স্কিল অর্জনের মাধ্যম

* অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কোর্স করা।
* লাইভ ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণ।
* নিয়মিত প্র্যাকটিস এবং বাস্তব কাজে প্রয়োগ।
* মেন্টর ও পেশাদারদের পরামর্শ নেওয়া।
* স্ব-শিক্ষার জন্য বই, ভিডিও এবং ব্লগ থেকে জ্ঞান অর্জন।

৪. দাওয়াতি কাজের পরিকল্পনা


দাওয়াত অর্থ আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করা, যা প্রত্যেক মুসলিমের একটি দায়িত্ব ও ফরজ কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। এরা সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যদি একজন মানুষও তোমার মাধ্যমে হেদায়েত পায়, তবে তা তোমার জন্য লাল উটের চেয়েও উত্তম।” (বুখারি: ৩০০৯, মুসলিম: ২৪০৬)

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্যরা “দাওয়াতি দিন প্রতিদিন” এবং “যেখানেই ছাত্র, সেখানেই দ্বীনের দাওয়াত” এই স্লোগান ধারণ করে নিয়মিতভাবে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনের প্রত্যেক জনশক্তি বার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে সুনির্দিষ্ট দাওয়াতি টার্গেট নির্ধারণ করবেন।

দাওয়াতি টার্গেট রেশিও:
সদস্য: বছরে ২০ জন বন্ধু ও ১২ জন সমর্থক।
সাথী: বছরে ১৫ জন বন্ধু ও ১০ জন সমর্থক।
কর্মী: বছরে ১০ জন বন্ধু ও ৫ জন সমর্থক।

দাওয়াতি কাজের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য:

প্রতিটি জনশক্তিকে এমন ছাত্রদের লক্ষ্যবস্তু করতে হবে যারা নিম্নোক্ত গুণাবলি ধারণ করে-

* মেধাবী, বুদ্ধিমান ও কর্মঠ
* চরিত্রবান, নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন
* সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী
* সিঙ্গেল ডিজিট রোলধারী, ষ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত
* বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লেসধারী

প্রত্যেক ক্যাটাগরি থেকে ছাত্রদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে তাদের দাওয়াতের তালিকা তৈরি করতে হবে। যেমন: জিপিএ ৫: আব্দুর রহমান, একাদশ শ্রেণি, মোবাইল নম্বর: ০১XXXXXXX, ঠিকানা: ঢাকেশ্বরী, ঢাকা।


দাওয়াত পৌঁছানোর আরো ধাপসমূহ:
পরিবার: ছোট ভাই-বোন, কাকা, ভাতিজা ইত্যাগি।
মুহাররমা: খালা, ফুফু, ভাগনি, ভাতিজি ইত্যাদি।
প্রতিবেশী: নিজের ঘরের চারপাশের মানুষ।
বন্ধু ও ক্লাসমেট: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বন্ধুরা।

তালিকা তৈরি করে তাদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখুন এবং বছরব্যাপী পরিকল্পিত দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যান।

অতিরিক্ত দাওয়াতি উদ্যোগ

কুরআন শিক্ষা:
* অন্তত ২ জন সাধারণ ছাত্রকে শুদ্ধভাবে কুরআন শেখানো।
* ব্যক্তিগতভাবে একটি অর্থসহ কুরআন বিতরণ।

অ্যাকাডেমিক সহযোগিতা: অন্তত একজন সাধারণ ছাত্রকে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে সাহায্য করা। দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য সমাজে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এ কাজে ধৈর্য, আন্তরিকতা এবং পরিকল্পনার সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে একনিষ্ঠভাবে এ দায়িত্ব পালন করলে এটি দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার পথ সুগম করবে এবং আগামী দিনে ইসলমী বিপ্লবের জন্য ময়দান প্রস্তুত করবে ইনশাআল্লাহ।

৫. সাংগঠনিক কাজের পরিকল্পনা


ইসলামী সংগঠনের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান কায়েম করে মানবজাতিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তিনিই সে সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যেন তা সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী হয়।” (সূরা তাওবা : ৩৩)

এ লক্ষ্য অর্জনে দায়িত্বশীলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন দায়িত্বশীল হলো আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী, রাসূল (সা)-এর উত্তরসূরি এবং মানবতার মুক্তির দিশারি। তারা সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি এবং আদর্শিক প্রতিচ্ছবি। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহিহ বুখারী: ৮৯৩)

সংগঠক হিসেবে পরিকল্পনা ও দায়িত্ব :

পরিকল্পনা গ্রহণ : পরিকল্পনা সাফল্যের প্রথম ধাপ। সংগঠনের লক্ষ্য ও প্রয়োজন বুঝে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করে এবং লক্ষ্য অর্জনের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইবনু খালদুন (রহ) বলেন,

“Planning is the key to organized progress, for a well-structured plan shapes the future.”

পরিকল্পনা হচ্ছে সংগঠিত অগ্রগতির চাবিকাঠি, কারণ একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলে। পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে SMART কৌশল অনুসরণ করতে হবে।

কর্মবণ্টন : কাজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীলদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়া আবশ্যক। এটি কাজের গতি বাড়ায় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যখন কাজ সঠিক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, তখন তা সাফল্যের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। (তিরমিজি)

তত্ত্বাবধান : যেকোনো কাজের অগ্রগতি নির্ভর করে সঠিক তদারকির ওপর। কাজের তদারকি ও প্রতিবন্ধকতা দূর করা সংগঠনের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক। বিখ্যাত চিন্তাবিদ পিটার ড্রাকার বলেন, “Management is doing things right; leadership is doing the right things.” ‘‘ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কাজটি সঠিকভাবে করা; নেতৃত্ব হচ্ছে সঠিক কাজটি করা।’’

রিপোর্টিং: সঠিক ও বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন কাজের কার্যকারিতা মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কর্মপদ্ধতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তা করে। এটা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

* রিপোর্ট বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক হওয়া দরকার।
* আন্দাজ, অনুমান করে কোনো রিপোর্ট দেওয়া বা নেওয়া ঠিক নয়।
* রিপোর্টে ময়দানের Orginal চিত্র আসা দরকার। রিপোর্ট পূরণের জন্য কর্মী, সাথী, সদস্য বানিয়ে বিপ্লব হবে না।

পুনর্মূল্যায়ন : পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করে তার সময়োপযোগী পর্যালোচনার ওপর। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সংশোধন অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা ভালোভাবে লক্ষ্য করো, তোমরা নিজেদের জন্য কী প্রেরণ করছো আগামী দিনের জন্য।” (সূরা হাশর : ১৮)

বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, “Reviewing the past helps guide the future.” অর্থাৎ অতীত পর্যালোচনা ভবিষ্যৎকে দিকনির্দেশনা দেয়।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো যে বিষয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার

সংগঠনের আদর্শিক মান নিশ্চিতকরণ : সংগঠনের আদর্শিক মান হচ্ছে ১:১০:১০০, অর্থাৎ কোনো শাখায় যদি ১ জন সদস্য থাকে ঐ শাখায় ১০ জন সাথী ও ১০০ জন কর্মী থাকবে। ভালো সংগঠকের প্লানে অন্তত একটা শাখা/থানা/ওয়ার্ড/ইউনিয়ন অথবা উপশাখাকে আদর্শ মানে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করে বছরব্যাপী কাজ করা।

সংগঠন বৃদ্ধি : সংগঠন নেই এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এরিয়ায় কাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে SMART প্ল্যান গ্রহণ করা। সেখানে অন্তত একটি উপশাখা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা। Action plan নিয়ে কাজ শুরু করা।

* জনশক্তির মানোন্নয়ন ও মানসংরক্ষণে ভূমিকা পালন করা।
* ব্যাপক দাওয়াত সম্প্রসারণ ও গণভিত্তি রচনা করা।
* সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সংরক্ষণ করা।
* সর্বপর্যায়ে গতিশীলতা সৃষ্টি করা (শাখা>থানা>ওয়ার্ড/ইউনিয়ন >উপশাখা)।

আমানতের সংরক্ষণ : আর্থিক লেনদেনে পরিচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করা। কোনো অবস্থায়ই সংগঠনের কোনো টাকা, কোনো জিনিস, ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য থাকা। কম খরচে বেশি কাজ করা। নেতৃত্বের নিকট সংগঠনের সম্পদ ও জনশক্তি বড় আমানত।

৬. ইবাদাতের পরিকল্পনা


ইবাদাত হলো আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রকাশ, যা মানুষকে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে পরিচালিত করে। এটি শুধু নামাজ, রোজা বা দোয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কাজকেও ইবাদতে রূপান্তর করা সম্ভব, যদি তা আল্লাহর জন্য হয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আমি জিন এবং মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)

ইবাদাত মানুষের অন্তরকে পবিত্র করে, পাপ থেকে দূরে রাখে এবং জীবনের প্রতি দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “ইবাদাত মানুষের হৃদয়কে প্রশান্তি দেয় এবং আত্মাকে বিশুদ্ধ করে।” (বুখারি ও মুসলিম)

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিটি ইবাদাত মানুষকে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করে এবং তাকে জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত করে। ইবাদাত হলো আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

শববেদারি ও তাহাজ্জুদ:
* প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২ দিন তাহাজ্জুদ পড়া।
* রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

নফল রোজা:
* প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস করা।
* প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের রোজা রাখার পরিকল্পনা থাকা।

দান-সদকা:
* মাসিক আয় বা পকেটমানি থেকে দান করা।
* গোপনে এবং প্রকাশ্যে উভয়ভাবে দান করা।

৭. প্রফেশনাল টার্গেট


প্রফেশনাল টার্গেট হলো ক্যারিয়ার সফলতার জন্য নির্ধারিত লক্ষ্য, যা দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ও অর্জনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এটি স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যেমন নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন, প্রমোশন, বা নতুন প্রকল্পে নেতৃত্ব দেয়া। টার্গেট নির্ধারণে নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, বাস্তবসম্মত এবং সময়নির্ধারিত (ঝগঅজঞ) পরিকল্পনা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মানুষ যা চেষ্টা করে, তা-ই সে পায়।” (সূরা আন-নাজম: ৩৯) সুতরাং, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পরিশ্রম করা পেশাগত উন্নতির মূল চাবিকাঠি। ভবিষ্যতে সফল পেশাগত জীবন গঠনে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

পেশাগত পরিকল্পনা:
* যে পেশায় যেতে চান, সে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন।
* প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি।

ইসলামী চিন্তাধারা বজায় রাখা:
* পেশাগত জীবনেও ইসলামের আদর্শ প্রচার।
* অফিস বা প্রতিষ্ঠানে দাওয়াতি পরিবেশ তৈরি।

নেটওয়ার্ক তৈরি:
* পেশাগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করা এবং
* শিল্পের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।

ধৈর্য ও স্থিরতা: লক্ষ্য অর্জনে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধৈর্যশীল থাকা।

আল্লাহর ওপর ভরসা: কাজের সফলতার জন্য আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা এবং দুআ করা। আল্লাহ বলেন, “যারা চেষ্টা করে, আমি তাদের পথ দেখাই।” (সূরা আনকাবুত: ৬৯)

৮.সামাজিক পরিকল্পনা

ছাত্রশিবিরের সদস্য সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেছিলেন ‘‘আমরা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সবার হয়ে উঠতে চাই’’। সমাজের প্রতিটি মানুষ নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। সামাজিক কাজ মানুষকে একত্রিত করে এবং সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করে। এটি ব্যক্তির নৈতিক উন্নয়ন ঘটায় এবং দুঃস্থ ও অসহায়দের সাহায্যের সুযোগ সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে অন্যের উপকারে আসে।” ( সহিহ বুখারি)

সামাজিক কাজ সমাজে শান্তি, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। এটি কেবল দুনিয়ার সেবা নয়, বরং আখিরাতের নেকি অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

শিক্ষা কার্যক্রম:
* গ্রামে বা সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় পাঠশালা প্রতিষ্ঠা।
* শিক্ষার্থীদের বই, খাতা ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিতরণ।

স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোগ:
* ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন।
* রক্তদান কর্মসূচি চালু করা।

দরিদ্রদের সহায়তা:
* ত্রাণ বিতরণ ও খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম।
* গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি।

পরিবেশ রক্ষা:
* বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।
* পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা।

সামাজিক সচেতনতা:
* মাদকবিরোধী প্রচারণা।
* যৌতুক, ইভটিজিং, নারী ও পুরুষ নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি।

যুব উন্নয়ন:
* দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ আয়োজন।
* উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রম।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রচার:
* ইসলামি মূল্যবোধ নিয়ে কর্মশালা।
* কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা।
* মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

সেচ্ছাসেবক দল গঠন:
* জরুরি প্রয়োজনে সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুত একটি দল গঠন। যেমন: গ্রামের নিরক্ষর বৃদ্ধদের জন্য বিনামূল্যে কুরআন শিক্ষা ও গণশিক্ষা কার্যক্রম, সপ্তাহে একদিন স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ এবং বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম ইত্যাদি।

বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল:


ডেইলি চেকলিস্ট: প্রতিদিনের কাজগুলো নোট করে রাখুন।

সাপ্তাহিক বিশ্লেষণ: কোন কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে তা খুঁজে বের করুন।

মাসিক মূল্যায়ন: কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় মাস শেষে নিজের অবস্থা পর্যালোচনা করুন।

স্মার্ট গোল: স্পেসিফিক, মেজারেবল, অ্যাচিভেবল, রিয়েলিস্টিক এবং টাইম-বাউন্ড লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।

দোয়া ও তাওয়াক্কুল: আল্লাহর উপর ভরসা রেখে পরিশ্রম করুন।

২০২৫ সাল হোক ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইদের জন্য একটি নতুন সূচনা। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, অধ্যবসায় এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আমরা একটি আদর্শিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

এই পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করা উচিত। যদি আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি, তবে নিশ্চিতভাবে আমরা একটি সুশৃঙ্খল এবং সফল ইসলামী আন্দোলনের অংশীদার হতে পারব ইনশাআল্লাহ।

লেখক :
কেন্দ্রীয় ফাউন্ডেশন সম্পাদক,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

মুল লেখা: মাসিক ছাত্রসংবাদ

Saturday, March 1, 2025

বইনোট : কর্মপদ্ধতি || বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

বইনোট কর্মপদ্ধতি, ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মপদ্ধতি, শিবিরের দাওয়াতি কাজ, ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম, কর্মপদ্ধতির আলোকে কাজ, ছাত্রশিবিরের কর্মপদ্ধতি
কর্মপদ্ধতি: কাজ করার কৌশল/নীতিমালা; কর্মসূচীকে সফল করার জন্য যে নীতিমালা গ্রহণ করা হয় তা-ই কর্মপদ্ধতি।

ছাত্রশিবিরের কর্মপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য:

১. রাসুল (সঃ)-এর অনুসৃত পদ্ধতি
২. বিজ্ঞান সম্মত, যুক্তিভিত্তিক
৩. ইসলামী রেনেসাঁর ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত।
৪. সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী
৫. পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে পরিবর্তনশীল।

বইটি ২ ভাগে বিভক্ত:
১. ভূমিকা ২. মূল বই

ভূমিকা- ৬ ভাগে বিভক্ত
১. শিবিরের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য- উদ্দেশ্য
২. ছাত্র শিবির কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিষ্ঠার কারণ
৩. কর্মপদ্ধতির ব্যাখ্যা প্রয়োজনীয়তা
-কর্মপদ্ধতি ছাড়া কোন আন্দোলন সফলকাম হতে পারে না।
-কর্মশক্তি, জনশক্তি এবং জনসমর্থনের সুমাঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার
-প্রতিটি কর্মীর যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, চিন্তাশক্তি, আন্দোলনের
পিছনে সমর্থন সবকিছু আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এ আমানতের
সুষ্পষ্ট ব্যবহারের জন্য যথাযথ, সুষ্ঠ কর্মপদ্ধতির প্রয়োজন তা
না হলে তা খেয়ানতের শামিল হবে।
৪. বাতিল মতাদর্শের সাথে পার্থক্য:
(১) দর্শনগত (২) পদ্ধতিগত
৫. রাসুল (সঃ) এর অনুসৃত পদ্ধতি, উৎস।
৬. কর্মপদ্ধতির কৌশলগত দিক পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে পরিবর্তনশীল।

কর্মপদ্ধতির আলোকে শিবিরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

“আল্লাহর এই জমিনে সকল প্রকার যুলুম ও নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করে আল কোরআন ও আল হাদীসের আলোকে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সৌধের উপর এক আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়ে তোলার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। চমক লাগানো সাময়িক কোন লক্ষ্য হাসিল এর উদ্দেশ্য নয়”

সক্রিয় কর্মীর বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী ৮টি
১. মজবুত ঈমান
২. খোদাভীতি
৩. আদর্শের সুস্পষ্ট জ্ঞান
৪. আন্তরিকতা
৫. নিষ্ঠা
৬. কর্মস্পৃহা
৭. চারিত্রিক মাধুর্য
৮. কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির যথার্থ অনুধাবন

কর্মপদ্ধতি বুঝার জন্য প্রয়োজন-
১. বার বার অধ্যয়ন
২. চিন্তা, গবেষণা ও অধ্যবসায়
৩. সক্রিয় কাজ
৪. আলোচনা-পর্যালোচনা
৫. পুরাতন ও দায়িত্বশীল কর্মীদের অভিজ্ঞতা

মুলবইপাঁচ দফা কর্মসূচী ও তার বাস্তবায়ন

১. দাওয়াত
২. সংগঠন
৩. প্রশিক্ষণ
৪. ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যার সমাধান
৫. ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ


প্রথম দফাঃ দাওয়াত
“তরুণ ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহবান পৌঁছিয়ে তাদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।”

এ দফার ৩টি দিক
প্রথমতঃ ইসলামের ব্যাপক প্রচার
দ্বিতীয়তঃ ছাত্রদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।
তৃতীয়তঃ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার জন্য ছাত্রদের মাঝে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা

প্রথম দফার করণীয় কাজ- ৮টি
১. ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও সম্প্রীতি স্থাপন
২. সাপ্তাহিক ও মাসিক সাধারণ সভা
৩. সিম্পোজিয়াম, সেমিনার
৪. চা-চক্র, বনভোজন
৫. নবাগত সংবর্ধনা
৬. বিতর্ক সভা, রচনা এবং বক্তৃতা প্রতিযোগিতা ও সাধারণ জ্ঞানের আসর
৭. পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, পরিচিতি ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাময়িকী বিতরণ।
৮। সিডি ভিসিডি ক্যাসেট প্রভৃতি বিতরন

•টার্গেটকৃত ছাত্রের গুণাবলী- ৫টি
১. মেধাবী ছাত্র
২. বুদ্ধিমান ও কর্মঠ
৩. চরিত্রবান
৪. নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন
৫. সমাজে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী।

•ক্রমধারা অবলম্বন:
প্রথম সাক্ষাতে মূল দাওয়াত না দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপিতের মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

প্রথমত: টার্গেটকৃত ছাত্রের মন-মগজে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে যাবতীয় ভুল ধারণার অসারতা বুদ্ধিমত্তার সাথে তুলে ধরতে হবে।

দ্বিতীয়ত: আখেরাত তথা পরকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে এবং যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিচয় তুলে ধরতে হবে।

তৃতীয়তঃ তাকে ইসলামী আন্দোলন ও সাংগঠনিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে হবে।

পরবর্তী পর্যায়ে তাকে প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনে অংশগ্রহণ করার আহবান জানাতে হবে।

যোগাযোগকারীর বৈশিষ্ট্য: ১৩টি
১. কম কথা বলা
২. অত্যধিক ধৈর্যের পরিচয় দেয়া
৩. বেশী কথার পরিবর্তে চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে প্রভাব
সৃষ্টি করা।
৪. ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখা
৫. কোন প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে ব্যক্তিত্ব অক্ষুন্ন রেখে সময় নেয়া।
৬. গোঁজামিলের আশ্রয় না নেয়া।
৭. যার সাথে সাক্ষাত করা হচ্ছে তার মন মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখা।
৮. যোগাযোগকৃত ছাত্রের রোগ দূর করার জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করা।
৯. তার দুর্বলতার সমালোচনা না করে সৎগুণাবলীর বিকাশে সহায়তা করা
১০. ব্যবহারে অমায়িক হওয়া
১১. তার সুখ দুঃখের অংশীদার হওয়া।
১২. মনকে অহেতুক ধারণা থেকে মুক্ত রাখা।
১৩. সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে ভ্রমণ, একত্রে নাস্তা, খাওয়া, নিজ বাসায় নিয়ে আসা, তার বাসায় যাওয়া, উপহার দেয়া ইত্যাদি।

•ক্রমান্বয়ে কর্মী পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায়- ৫টি
১. সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আগ্রহী করতে হবে।
২. সাধারণ সভা, চা-চক্র ও বনভোজনে শামিল করা
৩. ছাত্রদের জ্ঞান, বুদ্ধি, আন্তরিকতা, মানসিকতা ও ঈমানের দৃঢ়তা লক্ষ্য করে পরিকল্পিতভাবে বই পড়ানো৪. বিভিন্ন ইবাদতের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা
৫. সময় সময় মন-মানসিকতা বুঝে ছোট খাট কাজ দেয়া

প্রথম দফার অতিরিক্ত কাজ: ৫টি
১. গ্রুপ দাওয়াতী কাজ
২. দাওয়াতী গ্রুপ প্রেরণ
৩. দাওয়াতী সপ্তাহ ও পক্ষ
৪. মুহরামাদের মাঝে কাজ
৫. মসজিদভিত্তিক দাওয়াতী কাজ


দ্বিতীয় দফা- সংগঠন
“যেসব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা”

সংবিধান অনুযায়ী জনশক্তির স্তর-
১. সদস্য
২. সাথী

কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী আরো ২ স্তর-
৩. কর্মী
৪. সমর্থক

কর্মীর কাজ- ৮টি
১. কুরআন ও হাদীস নিয়মিত বুঝে পড়ার চেষ্টা চালানো।
২. নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য পড়া
৩. ইসলামের প্রাথমিক দাবীসমূহ মেনে চলার চেষ্টা করা।
৪. বায়তুল মালে নিয়মিত এয়ানত দান।
৫. নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা ও দেখানো
৬. কর্মী সভা সাধারণসভা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে যোগদান
৭. সংগঠন কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
৮. অপরের কাছে সংগঠনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা।

সাথী
একজন কর্মীকে সংবিধানের ৯ নং ধারায় বর্ণিত শর্তাবলি পূরণ করে 'সাথী' হতে হয়। শর্তাবলি হচ্ছে- (৪টি)

১. সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা।
২. সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে সচেতনভাবে একমত হওয়া
৩. ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন করা।
৪. সংগঠনের সামগ্রিক তৎপরতায় পূর্ণভাবে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

সদস্য
সংবিধানের ৪ নং ধারায় বর্ণিত সদস্য হওয়ার শর্তসমূহ নিম্নরূপ : (৬টি)

১. সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা।
২. সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করা এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা।
৩. সংবিধানকে মেনে চলা।
৪. ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করা।
৫. কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা।
৬. শিবিরের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সাথে সম্পর্ক না রাখা।

২য় দফার করণীয় কাজ: (১০টি)
১. কর্মী বৈঠক,
২. সাথী বৈঠক,
৩. সদস্য বৈঠক,
৪. দায়িত্বশীল বৈঠক
৫. কর্মী যোগাযোগ,
৬. বায়তুলমাল,
৭. সাংগঠনিক সফর,
৮. পরিচালক নির্বাচন।
৯. পরিকল্পনা,
১০. রিপোর্টিং।

কর্মী বৈঠকের কর্মসূচী:
* অর্থসহ কুরআন তেলাওয়াত-১০মি.
* ব্যক্তিগত রিপোর্ট পেশ, মন্তব্য ও পরামর্শ ৩০ মি.
* পরিকল্পনা গ্রহণ-২০ মি.
* কর্ম বণ্টন-২০ মি.
* সভাপতির বক্তব্য ও মুনাজাত- ১০ মি.কর্মী

যোগাযোগের পদ্ধতি:
উদ্দেশ্যঃ নিষ্ক্রিয় কর্মীকে সক্রিয় করা ও ভুল বুঝাবুঝি দূর করা

১. পরিকল্পনা
২. স্থান ও সময় নির্বাচন
৩. ঐকান্তিকতা
৪. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা আলোচনা৫. সাংগঠনিক আলোচনা
৬. সার্বিক আন্দোলনের আলোচনা
৭. সালাম ও দোয়া বিনিময়

সাংগঠনিক পরিকল্পনা: প্রণয়নের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক নজর রাখতে হবে।
১. জনশক্তি (শ্রেণীবিন্যাসসহ)
২. কর্মীদের মান
৩. কাজের পরিধি ও পরিসংখ্যানমূলক তথ্য
৪. অর্থনৈতিক অবস্থা
৫. পারিপার্শ্বিক অবস্থা।
৬. বিরোধী শক্তির তৎপরতা


৩য় দফা: প্রশিক্ষণ
“এই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ার কার্যকরী ব্যবস্থা করা”

তৃতীয় দফার করণীয় কাজ- ১৩টি
ক. পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
খ. ইসলামী সাহিত্য পাঠ ও বিতরণ
গ. পাঠচক্র, আলোচনা চক্র, সামষ্টিক পাঠ ইত্যাদি
ঘ. শিক্ষাশিবির, শিক্ষাবৈঠক
ঙ. স্পিকারস ফোরাম
চ. লেখকশিবির
ছ. শববেদারি বা নৈশ ইবাদত
জ. সামষ্টিক ভোজন
ঝ. ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ
ঞ. দুআ ও নফল ইবাদত
ট. ইহতেসাব বা গঠনমূলক সমালোচনা
ঠ. আত্মসমালোচনা
ড. কুরআন তালিম/কুরআন ক্লাস

পাঠচক্র: পাঠচক্রের শর্ত ৯ টিঃ
১. সদস্য নির্দিষ্টকরণ
২. পরিচালক নির্ধারণ
৩. বিষয়বস্তু নির্ধারণ
৪. লক্ষ্য নির্ধারণ
৫. অধ্যয়ন
৬. নোট
৭. সময়ানুবর্তিতা
৮. মনোযোগ
৯. সক্রিয় সহযোগিতা

তওবার নিয়ম:
১. সর্বপ্রথম আন্তরিকতার সাথে নিজ ভুলের স্বীকৃতি দেয়া।
২. ভুলের জন্য আল্লাহরকাছে মাফ চাওয়া।
৩. দ্বিতীয়বার ভুল না করার ওয়াদা করা।
৪. নামাজ রোযা বা আর্থিক কুরবানীর বিনিময়ে ভুলের কাফফারা আদায় করা।

আত্ম সমালোচনার পদ্ধতি: ৭টি
১. সময় নির্বাচন: শোয়ার সময় এর চেয়ে ভাল
ফজরের পর এবং এর চেয়েও ভাল ঈশার নামাজের পর।
২. আল্লাহকেহাজির নাজির জেনে জায়নামাযে বসা।
৩. সারাদিনের কর্মব্যস্ততাকে স্মরণ করা (ভাল কাজের শুকরিয়া ও ভুলের জন্য তওবা করা)।
৪. ফরজ ও ওয়াজিব আদায়কালে আন্তরিকতা যথার্থ ছিল কি না চিন্তা করা।
৫. আজকের সাংগঠনিক কাজ নিয়ে চিন্তা করা, অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন হয়েছে কিনা এজন্যে সময় ও সামর্থ যা ছিল তা পুরোপুরি ব্যয় হয়েছে কি না।
৬. ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা।
৭. আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।


চতুর্থ দফা : ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যার সমাধান
“আদর্শ নাগরিক তৈরীর উদ্দেশ্যে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের দাবীতে সংগ্রাম এবং ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।”

এ দফার দিক দুটি
১. 'ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম' জানা।
২. ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।

•ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এর কর্মসূচী
১. ইসলামী শিক্ষা কি? এর বৈশিষ্ট্য কিভাবে প্রবর্তন করা যায়? বর্তমান শিক্ষাস্বরূপ দোষ-এটা কি কি? এর সুদূর প্রসারী শিক্ষাব্যবস্থা।
২. জনমত সংগ্রহ করা।
৩. পোস্টারিং পত্রিকায় বিবৃতি, পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে লিখা।
৪. শিক্ষার ইসলামীকরণের পরিকল্পনা প্রণয়ন মৌলিক গলদ কোথায় চিন্তাবিদদের দিয়ে ইসলামী শিক্ষার রূপরেখা প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করা।
৫. শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিশেষ সংকলন প্রকাশ করা।

ছাত্র সমস্যা দু'ভাগে বিভক্ত
১. ব্যক্তিগত
২. সমষ্টিগত

ব্যক্তিগত সমস্যা দূরীকরণে ছাত্রকল্যাণ বিভাগের কাজ
* লজিং যোগাড় করে দেয়া
* স্টাইপেন্ড চালু করা
* লেন্ডিং লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা
* ফ্রি কোচিং ক্লাশ চালু করা
* বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র বিলি
* ভর্তি সহায়িকা প্রকাশ
* কর্জে হাসানা

সমষ্টিগত সমস্যা-
*ভর্তি ও আসন সমস্যা।
*শিক্ষকের অভাব।
*পাঠাগারের অভাব।
*মসজিদ না থাকা।
*কেন্টিনের সমস্যা।
*নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা।
*পাঠ্য বই এর মূল্য ও বেতন বৃদ্ধি।

সমাধানের কর্মসূচী
১. কারণ নির্ণয় করে কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ।
২. প্রতিবাদ সভা, নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ, পোস্টারিং, পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান।
৩. প্রতীক ধর্মঘট পালন ও সুশৃংখল আন্দোলন

ছাত্র সংসদ নির্বাচন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী নেতৃত্বেও জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ।


পঞ্চম দফা কর্মসূচী- ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ
“অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।”

•এ দফার কাজ দুভাবে করা যায়:
১. যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী গঠন
(ক) ক্যারিয়ার তৈরি [TO BUILD UP CARREER]
(খ) নেতৃত্ব তৈরি [TO MAKE UP LEADERSHIP]
(গ) কর্মী তৈরি [TO BUILD WORKER]
(ঘ) জ্ঞান অর্জন [TO ACQUIRE KNOWLEDGE]

২. বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ।
(ক) সহযোগিতা
(খ) পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ

পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ: চারিত্রিক শক্তি দিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বদ্ধ পরিকর।

Career তৈরি: সকল Sector এ লোক দেয়ার মত যোগ্য লোক তৈরী।


সংকলনে:
সেক্রেটারি, 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 
ফেনী জেলা 

Tuesday, January 21, 2025

মিডিয়াতে অপপ্রচার ও আমাদের দায়িত্ব - ইউনুছ আব্দুদ্দাইয়ান

আগেকার দিনে চিঠি বা দূত পাঠিয়ে সংবাদের আদান প্রদান হতো। আল্লাহর রাসূল (সা) মাঝে মধ্যে পাহাড়ের উপরে উঠে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করতেন যাতে করে দুরবর্তী লোকেরাও তাঁর কথা শুনতে পায় এবং তাঁকে দেখতে পান। রাসূলে কারীম (সা) মাঝে মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাটিতে লাঠি দ্বারা চিত্র অংকন করে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝাতেন। কালপরিক্রমায় প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক এই দুই ধরনের মিডিয়ার সাথে আমরা পরিচতি হই। বর্তমানে এর সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন ও সোশাল মিডিয়া। মূলত সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, লিফলেট, পোস্টার, ওয়েবসাইট প্রভৃতির মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবর জানা যায়। বিশেষভাবে অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে যেকোন সংবাদ বিশ্বের আনাচে কানাচে অতিদ্রুত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। এরফলে জনমত গড়ে উঠে। আরব বসন্তের কথা আমরা জানি। আরব বসসন্ত ও পরবর্তীতে পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সরকার পরিবর্তনে কিংবা সরকার বিরোধী বিক্ষোভে জনমত গঠনে সোশাল মিডিয়া তথা টুইটার, ফেইসবুক ও ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজকের তরুণ সমাজ অনলাইন মিডিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট। অডিও, ভিডিও, কার্টুন ইউটিউবই ইন্টারনেটে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ টেলিভিশন দেখে। অতএব, মিডিয়া বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। জিম মরিসন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, Whoever controles the media- controls the mind.

মিডিয়া কোনো একজন ব্যক্তি, বা সংগঠন কিংবা দেশের ইমেজ বৃদ্ধি বা নষ্ট করার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। একজন ভালো মানুষও মিডিয়ার অব্যাহত অপপ্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে খারাপ মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে পারে। আমরা দেখি অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে যায় মিডিয়া কভারেজের অভাবে। আর মিডিয়া কভারেজ পেয়ে অনেক নন ইস্যুও ইস্যুতে পরিণত হতে সময় লাগেনা। অখ্যাত যে কোনো ব্যক্তি মিডিয়ার কভারেজ পেয়ে বিশ্ব পরিচিতি লাভ করতে পারে। আফগানিস্তানের কিশোরী মালালা মিডিয়ার বদৌলতেই বিশ্বে এতো খ্যতি অর্জন করেছেন। অথচ মালালার মতো লাখো শিশু-কিশোর পৃথিবীর আনাচে কানাচে নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তার খবরও কেউ জানেনা। মিডিয়ার প্রচারণার ফলেই অল্প সময়ে মানুষের মধ্যে কোনো আদর্শ জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে। আবার কোনো আদর্শ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে বিশ্বজনমত গঠনে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

কিন্তু দু:খজনক বাস্তবতা এই যে বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংস্থাগুলো ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে। রয়টারের ৮০% কর্মকর্তা-কর্মচারী ইহুদী। এসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর ৯০% পুঁজিই ইহুদীদের। আমেরিকান ব্রড কাস্টিং কর্পরোরেশান (এবিসি), ন্যাশনাল ব্রড কাস্টিং সিস্টেম (এনবি এস), ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সি এন এন), ফ্রান্স নিউজ এজেন্সেী, বিবিসি প্রভৃতি সংবাদ সংস্থা ইহুদী নিয়ন্ত্রিত। অঅন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পত্রের মধ্যে লন্ডন টাইমস, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, অবজারভার প্রভৃতি পত্রপত্রিকাও ইহুদী নিয়ন্ত্রণাধীন। ইহুদীরা মুসলমানদের এক নম্বর শত্রু। তাই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে মুসলমানদেরকে মৌলবাদী (Fundamentalist), সাম্প্রদায়িক (Communal) বর্বর সন্ত্রাসী (Terrorist) হিসেবে চিত্রিত করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের নবজাগরণ ঠেকাতে চায়। মুসলিম দেশগুলোতেও তাদের দালালরা একই পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলাম, ইসলামী অন্দোলন ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে। পাশ্চাত্যের মিথ্যা প্রচারণায় মুসলমানরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েও উল্টো ‘টেরোরিস্ট’ হিসেবে চিহিৃত হচ্ছে।

মিডিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্তমানে কাউকে বুঝাতে হবে বলে আমার মনে হয়না। ইসলামের বিরোধিতা যেভাবেই করা হোকনা কেন তার মোকাবিলায় ভূমিকা পালন করা মুসলমানদের উপর অপরিহার্য। যদি মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের বিরোধিতা করা হয় তাহলে মিডিয়ার মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিরোধিতা হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। যদি বুদ্ধিবৃত্তিক কুট কৌশলে বিরোধিতা হয় বৃদ্ধিবৃত্তিক কুটকৌশলের মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। কলমের মাধ্যমে বিরোধিতা হলে কলমের মাধ্যমে জবাব দিতে হবে। মিডিয়া অপপ্রচারের জবাব মিডিয়ার মাধমে না দিয়ে অন্যভাবে দেয়া যায়না। এই প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “শত্রুর মোকাবিলার জন্য যত বেশি সম্ভব যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সদাপ্রস্তুত অশ্ব বাহিনী সংগ্রহ করে রাখো। এসব নিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রুদের এবং তারা ছাড়া আরও কিছু লোককে যাদের তোমরা চেননা, আল্লাহ চেনেন, ভীত ও সন্ত্রস্ত করে দিতে পারবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করো তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে। তোমাদের উপর কোনোক্রমেই যুলম করা হবেনা’ -আনফাল ৬০।

আল্লাহ তায়ালা এখানে কুওয়াত বা শক্তি অর্জনের কথা বলেছেন। বর্তমানে আধুনিক যে সমরাস্ত্র আছে তার শক্তি, জ্ঞানের শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রাসূলের যুগে তীর ও অশ্ব যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন ছিল তাই তিনি তা সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সময় বৈষয়িক প্রস্তুতি কাফেরদের তুলনায় কম থাকলেও এমনটি কখনও হয়নি যে, তিনি আদৌ কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। তাই ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচার মোকাবিলায় বিকল্প মিডিয়া করার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়নে চেষ্টা করা মিডিয়া জিহাদের অন্তর্ভুক্ত।

আফসোসের বিষয় হচ্ছে, অনেকেই মুসলমানদের শক্তিশালী মিডিয়া নাই কেন তার জন্য নানা ধরনের প্রশ্ন করছেন। অথচ তাঁদের সামনে যখন মিডিয়ার কোনো প্রজেক্ট প্রস্তাবনা দেয়া হয় তখন তাঁরা বলে বসেন, “টাকা মিডিয়াতে ইনভেস্ট করলে কি লাভ হবে”? অমুক ব্যবসাতে খাটালে এতো % লাভ হবে। আমি মনে করি শুধু নগদ জাগতিক লাভ নয় বরং মিডিয়া চ্যলেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন, প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করা ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া উদ্যোগসমূহকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড কিছু মিডিয়াতে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েতই কম। তবে ইউরোপে এখনও মূলধারার কোনো মিডিয়া মুসলমানদের নেই বললেই চলে। তাই মুসলমানদেরকে এই দিকে গুরুত্বের সাথে নজর দেয়া উচিত।

এছাড়া প্রতিনিয়ত মিডিয়াতে ইসলাম সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়। সে সম্পর্কে ভারসাম্যমূলক জবাব আসা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলমানদের তেমন কোনো স্পোকসম্যান নেই। তাই মিডিয়াতে ভারসাম্যমূলক বক্তব্য তুলে ধরার মতো যোগ্য লোক তৈরি করতে হবে। মিডিয়াতে নেতিবাচক প্রচারণার ফলে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত রূপ মিডিয়াতে তুলে ধরা। কিন্তু কারো কারো প্রবণতা হচ্ছে বসে বসে শুধু সমালোচনা করা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, সমালোচনা করা সহজ কিন্তু বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং উক্ত উদ্যোগকে সফল করা কঠিন। এছাড়া মিডিয়াতে ভূমিকা রাখার মতো যাদের যোগ্যতা আছে তারা প্রতিনিয়ত লেখা-লেখি করা এবং শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

মিডিয়া কর্মীদেরকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা দরকার। আর মুসলমানদেরকেও নিজস্ব মিডিয়া তৈরি করার প্রতি সিরিয়াস হতে হবে এবং মুসলিম মিডিয়া কর্মীদেরকে মেইনস্ট্রিম মিডয়াসমূহে কাজ করার প্রতি আগ্রহী হতে হবে। পাশ্চাত্যের মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা মিডিয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আসল পথ নয়। এর আসল জবাব হচ্ছে ‘বিকল্প শক্তিশালী মিডিয়া’।

মিডিয়াতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণার ইতিবাচক ফলও রয়েছে। পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তাশীল মিডিয়াতে ঢালাওভাবে ইসলাম সম্পর্কে বিষোদাগার করায় তারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং তাদের মনের নানা প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে সত্যের সন্ধ্যান খুঁজে পান। এছাড়া মুসলমানদের একটি অংশ যারা ইসলাম ভালোভাবে জানতোনা তারা সহকর্মী ও বন্ধুদের নানা প্রশ্নের সঠিক জবাব জানতে গিয়ে নিজেরা ভালোভাবে ইসলাম জানার চেষ্টা করছে। এরফলে যেসব মুসলমান আগে ইসলাম অনুশীলন করতেননা তাঁরা ইসলাম অনুশীলন শুরু করেন। যেসব মুসলিম মহিলা আগে হিজাব পরিধান করতেননা তাঁরা হিজাব পরিধান করা আরম্ভ করেন। তাঁদের মাঝে ইসলামের প্রতি মহব্বত ও আকর্ষণ অনেকগুণ বৃদ্বি পাচ্ছে।

ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার ফলে অমুসলিম চিন্তাশীলদের কেউ কেউ কুরআন অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রসংগে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে অংশ গ্রহণ করি; তুরুষ্কের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান উক্ত সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন। রাত দশটার দিকে সেমিনার শেষ হওয়ার পর লন্ডন ফেরার পথে অক্সফোর্ড বিশ্বদিল্যায়ের একজন ছাত্রী ও দুইজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হয়। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে জানলাম উক্ত ছাত্রীর নাম মারইয়াম এবং সে নও মুসলিমাহ। আমি তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাইলাম। প্রতি উত্তরে সে জানায় যে তার বাড়ি ফ্রান্সে। তার পিতা-মাতা ও পুরো পরিবার প্রচ-ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী ছিল। ৯/১১ এর পর তার পিতা একটি বই তাকে পড়ার জন্য দেয়। উক্ত বইতে মুসলমানদেরকে কুকুরের সাথে তুলনা করা প্রচ-ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়। মারইয়াম এই ধরনের মন্তব্য পাঠ করার পর চিন্তা করে “আসলেই মুসলমানরা কি এতো বেশি খারাপ? সে এই প্রশ্নের জবাব জানার জন্য তার মুসলিম বন্ধুদের সাথে মত-বিনিময় করতে আগ্রহী হয়। মুসলিম বন্ধুরা তাকে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে তার সকল প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার জন্য কুরআন অধ্যয়ন করার উপদেশ দেয়। সে তাদের উপদেশমতো কুরআন পাঠ করা শুরু করে। কিন্তু প্রথম তিন মাস কুরআন পাঠ করে কোনো মজা অনুভব করেনি। তার মতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কুরআন পাঠের চেষ্টা করায় প্রথম তিন মাস সে কোনো মজা পায়নি। তিন মাস পর উন্মুক্ত মন-মগজ নিয়ে কুরআন পাঠ শুরু করার পর তার মনে হয়েছে কুরআনের প্রতিটি আয়াত যেন তার মনের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। এইভাবে ছয়মাস তিলাওয়াত করে কুরআন পাঠ শেষ করে। কুরআন পাঠ করতে গিয়েই সে নিজেকে ‘কুরআনী’ বলে পরিচয় দেয়া শুরু করে এবং এক পর্যায়ে ইসলাম কবুল করেন। মারইয়াম আল-কুরআন অধ্যয়ন করেই ইসলাম কবুল করে। কিন্তু তার মতে কুরআন পাঠ করে ইসলাম জানার চেষ্টা না করলে তার পক্ষে ইসলাম কবুল করা হয়তো বা সম্ভব হতোনা। কেননা কুরআনে ইসলামের যেসব বিধান চমৎকারভাবে বিবৃত আছে তা খুব কম মুসলমানই অনুসরণ করে।

উপরের ঘটনা থেকে এই বাস্তব সত্য ফুটে উঠেছে যে, অনেক অমুসলিম ইসলাম সম্পর্কে পরিচালিত অপপ্রচারের জবাব খুঁজতে গিয়েই ইসলামের সুমহান আদর্শের সন্ধান পায়। এছাড়াও মুসলমানদের সাথে উঠা-বসা, লেন-দেন করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অমুসলিমদের কেউ কেউ ইসলাম কবুল করছে। অতি সম্প্রতি ইস্ট লন্ডন মসজিদে একটি যুবক ইসলাম কবুল করে। ইসলাম কবুল প্রসংগে সে জানায় যে, দীর্ঘদিন ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে আরো জানায় যে, তার মুসলিম বন্ধুদের চলাফেরা, কথা-বার্তা, উঠা-বসা, লেন-দেন প্রভৃতি তাকে বিমোহিত করে। এইভাবে অনেক মুসলমান সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদের জীবন গড়ার চেষ্টা করছেন এবং তাঁদেরকে দেখেই চিন্তাশীল অনেক অমুসলিম এই কথা অকপটে স্বীকার করছেন যে, “মুসলিমরা সন্ত্রাসী নয় বরং পরোপকারী’’। এই প্রসংগে একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যে একজন অমুসলিম তার ঘর বিক্রির সময় পার্শ্ববর্তী ঘরের চেয়ে তার ঘরের মুল্য ত্রিশ হাজার পাউন্ড বেশি দাবি করে। এজেন্ট বেশি মূল্য চাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জবাব দেন যে, “আমার পার্শ্বে একজন পরোপকারী মুসলিম ভালো প্রতিবেশী রয়েছেন। তিনি কাউকে কষ্ট দেননা বরং সব সময় প্রতিবেশীর প্রতি যত্নশীল থাকেন। যেকোন স্থানে ঘর কেনা সম্ভব কিন্তু ভালো প্রতিবেশী পাওয়া কঠিন’।

পাশ্চাত্যে ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে কিছু ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়াতে অব্যাহতভাবে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা পরিচালিত হচ্ছে। কিছু মিডয়াতে মুসলমানদেরকে টেরোরিস্ট হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে এবং ইসলামকে পাশ্চাত্যের জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউরোপে যে শতাব্দীকাল থেকে মুসলমানদের বসবাস রয়েছে সে কথা প্রকাশ না করে শুধু ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে এবং মুসলানরা ইউরোপের মুলস্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তারা মনে করে। তাদের প্রচারণা হচ্ছে, ইসলাম আজকের যুগে অচল এবং মুসলমানরা রক্ষণশীল, উগ্র ও টেরোরিস্ট। মিডিয়াতে মুসলমানদের বিরদ্ধে এই ধরনের প্রচারণার ফলে মুসলমানদের উপর বিশেষভাবে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের উপর গ্যাং এ্যটাক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই Q News এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফুয়াদ নাহদী পাশ্চাত্যের মিডিয়ার সমালোচনা করে বলেন, A western news agenda dominated by hostile, careless coverage of islam distors reality and destroys trust. Western reports, when positive, are seen as selective and partisan; when negative, hypocritical and insensitive (Diana Abdel- Maged, The British Media: Fair or biased )

একশ্রেণীর পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচারের কারণে বাস্তব অবস্থা খারাপভাবে চিহ্নিত হচ্ছে এবং আস্থা নষ্ট করছে। কোনো ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করা হলে তা হয় বাছাই করা এবং একপেশে। আর যখন কোনো নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরা হয় তা জয় মোনাফেকি সূলভ এবং অসংবেদনশীল। (ডায়ানা আবদেল মাজেদ. দি ব্রিটিশ মিডিয়া : ফেয়ার অর বায়াসড) কিছু মিডিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নীতি পোষণ করলেও যেকোন সন্ত্রাসী ঘঁটনার জন্য মুসলমানদেরকে অভিযুক্ত করার একটা প্রবণতা প্রায় সকল মিডিয়াতেই রয়েছে। যেকোন ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে সকল মুসলমানকে দায়ী করা যৌক্তিক নয়। ইতোপূর্বে সন্দেজনকভাবে বিভিন্ন ঘটনায় যাদেরকে আটক করা হয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন; তাঁদের কেহই কথিত ঘটঁনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলনা। তাই সন্ত্রাসের সাথে ইসলাম ও মুসলমানকে ঢালাওভাবে সম্পৃক্ত করার সুযোগ নেই। যেমনিভাবে খৃস্টান ও ইয়াহুদী কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করলে তার জন্য পুরো খৃস্টান বা ইয়াহুদী ধর্মাবলম্বীকে দায়ী করা যায়না। কতিপয় মিডিয়ার প্রবণতা হচ্ছে মুসলমান কেউ সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ত হবার সন্দেহের তালিকায় থাকলেও তা যেভাবে ফলাও করে ছাপা হয় অপরদিকে একই ধরনের ঘটনা কোনো নন-মুসলিম করলে তা মিডিয়াতে উপক্ষো করা হয়। এই সস্পর্কে বিগত ৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ ’ দি মুসলিম পোস্ট পত্রিকায় এইভাবে শিরোনাম করা হয়, Media Silent as non-Muslim bomb makers pleads guilt। উক্ত রিপোর্ট অনুসারে Terence Gavan নামক বৃটিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির জনৈক মেম্বার বোমা তৈরিসহ ২২ টি ঘটঁনায় অভিযুক্ত হয়। এর মাঝে ৬টি টেরোরিজম এ্যাক্টের অধীন ছিল। Woolwich Crown Court তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়। অথচ বোমা সন্ত্রাসের মত ঘটনায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও বৃটিশ মিডিয়া তা উপেক্ষা করে। কিন্তু শুধুমাত্র সন্দেহের তালিকায় থাকার কারণে অনেক মুসলমানের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। এধাধহ যদি মুসলমান হতো তাহলে প্রায় সকল পত্রিকাতেই সম্ভবত হেডলাইন করা হতো এভাবে ÒIslamic terrorist found guilty of possessibg bomb factory/Evil Muslim bomb maker admits guilty/Mastermind Muslim bomb expert Guilty ... বাংলাদেশে কিছু মিডিয়া আন্তর্জাতিক কতিপয় মিডিয়ার মতো জঙ্গি, টেরোরিস্ট, আল কায়েদা, তালেবানী রাষ্ট্র ইত্যাদি পরিভাষা একইভাবে ব্যবহার করে। ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের উপর নির্যাতনের কল্পিত কাহিণী প্রচার করে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। প্রকৃত সত্য প্রকাশ না করে তারা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে তারা দেশে-বিদেশে নেতিবাচক ধারণা দিতে চায়। তারা ইসলামী আন্দোলনন ও তার নেতৃত্ব সম্পর্কে মনগড়া রিপোর্ট প্রচার করছে অথচ তাঁদের বক্তব্য, স্টেমেন্ট পত্রিকায় ছাপায়না। তারা আওয়ামী-ছাত্রলীগ কর্তৃক মন্দির ভাংগা হলেও জামায়াত-শিবেরর উপর তার দায় বর্তায় অথচ জামাত শিবিরের কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় যে মন্দির পাহারা দেয় তার সংবাদ ও ছবি ছাপায়না। অপরাধ সংক্রান্ত সংবাদ ব্কিৃত করে প্রচার করছে যার ফলে সত্যিকার অপরাধীরা আরও অপরাধ করতে উতসাহীত হয়। যেমন নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার পর প্রথমেই জামায়াত-শিবিরের উপর দোষ চাপায়। অথচ ত্বকীর পিতা পরে স্পষ্ট করেই বলে দেয় যে, “এর সাথে জামাত শিবিরের কেউ সম্পৃক্ত নয়। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাই জড়িত‘। আভ্যন্তরীন রাজনীেিত বিদেশেী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরি করে। কিছু পত্রিকায় বিদেশেী কয়েকজন রাষ্ট্রদুতের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী-ও বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। কিছু মিডিয়াতে বাংলাদেশকে অকার্যকর জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। এমনকি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের জীবন ধারা মুল্যবোধ কটাক্ষ করা হয়। দাঁড়ি টুপী ধারীদেরকে রেডিও টিভিতে নাটক উপন্যাসে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে দর্শকের ঘৃণা জন্মে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া সাধারণত লোকাল মিডিয়াকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। এরফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে নেতিবাচক প্রচারণা চলে যার ফলে প্রকারন্তরে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ছে। অথচ দেশ গড়ার জন্য জাতীয় ঐক্য জরুরী। জঙ্গিবাদের উথ্যান হতে তা সহায়তা করছে। জনগনের মধ্যে দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ। আমাদের দেশের নদ-নদীতে মাছ আছে; বনে জংগলে কাঠ আছে। জমিতে হরেক রকমের ফসল ফলে। গ্যাস ও কয়লার খনি আছে। এই সকল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাবার জন্য আছে মানব সম্পদ। তাই মানব সমপদকে কাজে লাগানোর জন্য রাজনৈতিক স্থিতীশীলতার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। মেধাবীদেরকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগীতে না দেখে তাদেও মেধা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো প্রয়োজন। পর্ণোগ্রাফী যুব চরিত্র নষ্ট করছে। অথচ যুবকরাই হচ্ছে দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি।

মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তাদের অনেকই বিশ্বাস ও চেতনায় ইসলাম বিদ্বেষী। ভিনদেশীদের এজেন্ট হিসেবে কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করেন। এই জন্য তাঁরা মাসিক ভাতা পান। ব্যবসায়ী মিডিয়া মালিকরা নিজেদের স্বার্থের কারণে একজনের অপরাধ আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামা চাপা দিতে চায়।

হতাশা বা সমালোচনা নয় প্রয়োজন বাস্তব উদ্যোগ ও সহযোগিতার : আফসোস হচ্ছে মুসলমানদের হাতে প্রচুর সম্পদ আছে। আলজাজিরা বাদ দিলে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার মত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নেই। দি টাইমস, দি গার্ডিয়ান, দি ইন্ডেপেন্ডেন্স এর মত আন্তর্জাতিক মানের কোনো পত্রিকা নেই। তাই মুসলমানেরা পাশ্চাত্যে মিডিয়ার আক্রমন ও অপপ্রচারের শিকার। কেননা অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মত কোনো শক্তিশালী মাধ্যম মুসলমানদের হাতে নেই। এমতাবস্থায় মুসলিম তরূন সমাজের যাদের মিডিয়া স্টাডিজ পড়ার আগ্রহ আছে তাদেরকে মিডিয়া কর্মী হিসেবে ক্যারিয়ার গঠনের পরিকল্পনা নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। রেডিও, টিভি ও পত্রপত্রিকায় কাজ করা মুসলিম তরূন সমাজের একটি অংশের ক্যারিয়ার ফিল্ড হওয়া উচিত। যারা সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত তাদের প্রশিক্ষন কর্মসুচী থাকা দরকার। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। নিজেদের সাধ্যমত অনলাইন পত্রিকা, ব্লগও ওয়েবসাইট চালু করা যায়। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগ মিডিয়া হাউজ করা যেতে পারে। মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধি করে তাদের নানা লেখনীতে নিজেদের কিছু ইস্যু নিয়ে আসার চেষ্টা করা। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট করে সাংবাদিকদের বৃত্তি ও চিকিতসা সেবা করা দরকার। গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং টীম করা প্রয়োজন –তারা বিভিন্ন মিডিয়া মনিটরিং করবেন এবং অনলাইন আক্রাইভ রাখবেন। মিডিয়াতে স্পোকস পারসন হিসেবে বিভিন্ন ভাষায় পারদশী একটি গ্রুপ সৃষ্টি করতে হবে।

মিডিয়ার নাই নাই বলে হা হুতাশ করে যেমনি মিডিয়া অভাব পুরণ করা যাবেনা। তেমনিভাবে সফল মিডিয়া গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচের মানসিকতা না থাকলে মিডিয়া প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হবেনা। এই প্রসংগে অনেক দিন আগে শুনা একটি গল্প মনে পড়ছে। একজন লোক খাবার সহ কুকুরকে নিয়ে পথ চলছে। কিছু দুর যাওয়ার পর কুকুরটি ক্ষুধায় ছটফট কওে মারা যাওয়ার উপক্রম। লোকটি তা দেখে কাঁদছে। আরেকজন পথিক তার কান্নার কারণ জানতে চায়। তিিেন জবাবে বলেন, “ভাই আমার কুকুর ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে তাই কাঁদছি”। লোকটি আবার জানতে চায় “তোমার সাথে এগুলো কি”? তিনি জবাব দেন “এগুলো খাবার”। পথিক তাকে বলে, “তোমার খাবার থেকে কিছু খাবার দিলেইতো কুকুরটির ক্ষুধা নিবারন হয়”। লোকটি জবাব দেয় “ভাই কাঁদতে পয়সা লাগেনা কিন্তু খাবার দিলেতো পয়সা খরচ হয়”। আমাদেরকে মিডিয়ার জন্য শুধু কাঁদলে হবেনা প্রূেয়াজনের আলোকে অর্থ খরচ করতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও মিশনারী টাগেট নিয়ে কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালের পর ব্যবসায়ীদের ইনভেস্টমেন্ট কিছু পত্রিকা ও স্যটেলাইট চ্যানেল চালু করা হয়। বিদেশী সাহায্যেও কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই তাদের অর্থের অভাব হয়না। কিন্তু যারা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী তাদেরকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই মিডিয়া করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক কিছু ব্যক্তিকে অর্থ উপর্জনের মেধা দিয়েছেন আর কিছু ব্যক্তিকে মিডিয়া কর্মী হওয়ার যোগ্যতা দান করেছেন। মিডিয়া কর্মীদের অনেকর কাছে অনকে সুন্দর পরিকল্পনা আছে কিন্তু উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নাই। আর কিছু ব্যক্তির অর্থ আছে কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রজেক্ট নাই। যাদের অর্থ আছে তারা এমন জায়গায় ইনভেমস্ট করতে চান যেখান থেকে দ্রুত রিটার্ন আসবে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তা সঠিক। কিন্তু মুসলিম কিছু ব্যবসায়ী ও সামর্থবান বিত্তশালীরা যদি মিডিয়া, রিসার্চ, থিঙ্ক ট্যাঙ্কসহ জ্ঞান গবেষনার কাজে বিনিয়োগ না করেন তাহলে তাদের অধিক মুনাফার জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থ তাঁরা যে ভোগ করতে পারবেন তার কি কোনো নিশ্চিয়তা আছে? আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত অনেক ধনী ব্যক্তির কথা জানি যাঁরা দুনিয়ার মোড়লদের অনুমতি ছাড়া নিজের এ্যকাউন্ট থেকে নিজের খরচের জন্যও টাকা উত্তোলন করতে পারছেননা। তাই সময়ের অনিবার্য্য দাবি পুরণে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্টেড, অনলাইন ও সোশাল মিডিয়ায় কাংখিত ভূমিকা পালন করা জরুরী।