Close
আলোচনা নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
আলোচনা নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র


আমাদের কেহ তিতুমীর হয়ে জালিমের কন্ঠ রুখবে...
আজ শহীদ তিতুমীরের ১৮৮ তম শাহদাতবার্ষিকী। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর, আজকের এই দিনে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি (১১৮৮ বঙ্গাব্দ, ১৪ মাঘ) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীরের প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরোধী আন্দোলন ও তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশেরকেল্লাতেই শাহাদাৎ বরণ করেন ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে।

সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী শহীদ (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ড-স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজও এদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ ও নির্যাতনমূলক শাসন নির্মূল করে এ দেশে আদর্শভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন।

তিতুমীরের সাথে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজ সাহেবদের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরের অব্যর্থ নিশানা। ইংরেজ পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। প্রায় ৫০০ জমিদার সৈন্য ও ইংরেজ পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসেন কর্নেল স্কট। ১৮৩১ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাছে পৌঁছে তা ঘিরে ফেলে। বহু গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিতুমীরের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।তিতুমীর অসীম বীরত্বের সাথে এই সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ইংরেজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেল্লার সামনে বীরবিক্রমে জুলুমের মোকাবিলা করে ১৮৩১ সালের ১১ নভেম্বর তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হন তার সঙ্গী-সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইংরেজদের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীতে তিতুমীরের ২২৫ জন অনুসারীর বিচারে জেল হয়।

১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তাঁরা বাঁশেরকেল্লা তৈরি করেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ অঞ্চলের মানুষ মারাঠা আর বর্গীদের দ্বারা লুন্ঠিত এবং পশ্চিমবঙ্গের অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের হাতে নিস্পেষিত হয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ছিল। বাঙ্গালী মুসলমানদের উপর বেশ কয়েকজন হিন্দু জমিদার নানা ধরনের অত্যাচার করত, নিবর্তনমূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মুসলমানদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে পূঁজার পাঁঠা জোগাতে হতো, কেউ দাঁড়ি রাখলে সেজন্য চাঁদা দিতে হতো, মসজিদ নির্মাণ করলে কর দিতে হতো, এমনকি কেউ গরু জবাই করলে তার ডান হাত কেটে দেয়ার ঘটনাও কম ছিলনা। এই পটভূমিতে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের পক্ষে প্রতিবাদের আন্দোলন গড়ে তোলেন মীর নেসার আলী তিতুমীর।

ভারতীয় উপমহাদেশে তখন চলছিল ইংরেজ বিরোধী জিহাদ আন্দোলন। বাংলাদেশ থেকেও জিহাদ আন্দোলনে লোকজন শরীক হতেন। তিতুমীরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যে, বাংলার মুসলমানদের ইমান ও আকিদার দিক থেকে সবল করে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে শক্তিশালী করেই তবে তাদের মধ্যে জিহাদের আহবান জানানো যেতে পারে। তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে তিনি জনগণকে সচেতন করতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারকাজে অভাবিত জাগরণ দেখা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসন সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই দুটি ছিল তাঁর মৌলিক কর্মসূচী। তাঁর আহবান ছিল বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদ সংস্কার করে নামাজের ব্যবস্থা করা, পূঁজার চাঁদা দান কিংবা তাতে অংশ নেয়া থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা, শিরক-বিদায়াত হতে দূরে থাকা, মুসলমানদের মুসলিম নাম রাখা, মুসলমানদের ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি বা পাজামা পরা, পীরপূঁজা ও কবরপূঁজা না করা ইত্যাদি। তিতুমীরের ধর্মীয় দাওয়াতের মূলকথা ছিল, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) নির্দেশ পরিপালন সম্পর্কিত। এটি ছিল মূলত ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুণর্গঠনের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচী।

তিতুমীর থাকতেন সরফরাজপুর গ্রামে। গ্রামবাসীদের ওপর জমিদারের বারবার আক্রমণ ও অত্যাচারের কারণে তিনি নিজেই সে গ্রাম ছেড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে। ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি দলবলসহ নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে যান। সেখানে চারিদিক থেকে অব্যাহত হামলার কারণে তিতুমীর তার আস্তানাটিকে নিরাপদ করার জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লা। নারিকেলবাড়ীয়ার পরিত্যক্ত একটি মসজিদকে সংস্কার করে সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ চালু করেন। তাঁর নেতৃত্বে নদীয়া ও ২৪ পরগণা জেলার অনেক এলাকার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। স্বভাবতই এটা জমিদারদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর সহস্রাধিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে আসেন। তিতুমীর তাঁর অনুসারীদের জীবনরক্ষার্থে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এভাবেই বাঁশেরকেল্লা নামক দূর্গটির নাম ছড়িয়ে পড়ে। নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে এসে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার স্বয়ং নিহত হন। শেষে জমিদারদের বাহিনী পিছু হটে যায়।জমিদারদের বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকারের ওপর তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানের পক্ষে চাপ বাড়তে থাকে। খ্রিস্টান পাদ্রী, জমিদার ও নীলকররা অব্যাহতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। শেষে ইংরেজ সরকার তিতুমীরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর মেজর স্কটের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী নারিকেলবাড়ীয়া অবরোধ করে। যুদ্ধ শুরুর আগে ইংরেজ বাহিনী ও তিতুমীরের মধ্যে একটি সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। সংলাপে অংশ নেয়া তিতুমীরের প্রতিনিধি সম্ভবত ইংরেজী জানতেননা। ফলে সংলাপে তিতুমীরের বক্তব্যকে ইংরেজ মেজরের কাছে উপস্থাপন করছিলেন রাজচন্দ্র নামক জনৈক দোভাষী। দুঃখজনকভাবে দোভাষী তিতুমীরের পক্ষে বক্তব্যকে এমন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল যে এতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মেজর স্কট গুলীর নির্দেশ দেন। মূলত ইংরেজ বাহিনীর সুসজ্জিত আধুনিক অস্ত্রের সামনে তিতুমীরের লাঠি আর তীর সড়কি ছাড়া কোন অস্ত্রই ছিলনা। তবে গুলীর মুখে এই দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষগুলি পিছে হটেনি। ইংরেজ বাহিনীর গুলীর মুখে তিতুমীর ও তার সঙ্গীরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। নির্বিচাওে গুলী চালাতে থাকে ইংরেজ সৈন্যরা।

গুলীতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র গরহর আলীসহ ৫০ জন নিহত হয়। ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রাম তল্লাসি করে আরও ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এলাকার বাড়ীঘরগুলিতে আগুন দেয়া হয়। তিতুমীরসহ মৃতদেহগুলিকে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে তাঁদের শহীদ হিসেবে কেউ সম্মান দেখাতে না পারে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৯৭ জনের বিচার হয়। তন্মধ্যে তিতুমীরের প্রধান সহকারী গোলাম মাসুমের প্রাণদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন, ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। বিচারকালে ৪ জনের মৃত্যু হয়। এই অসম যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি নিজেই বলেছেন, যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি সত্য, কিন্তু জীবন দিয়েছে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক এক মহাপুরুষ। তিতুমীর সম্পর্কে ইংরেজ অনেকেই মনে করেন তিতুমীর সাধারণ একজন লাঠিয়াল ছিলেন। আসলে তা নয়, তিতুমীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলার নিরীহ মুসলমানদের এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে বারবার আক্রমণ করে শেষে জীবন রক্ষার জন্য হাতে লাঠি নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। দরিদ্র মুসলিম ও সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কথা বলে তিতুমীর টিকে থাকতে পারেননি সত্য। তাই বলে তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। ঘটনার ২৫ বছর পর ১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতার বিদ্রোহকেও ইংরেজ সরকার নির্মমভাবে দমন করেছিল। সেই ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অত্যাচারী জমিদাররাও আর নেই। আছে শুধু তিতুমীর ও তার বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতিহাস।
-বাশেরকেল্লা ফেইসবুক পেজ থেকে।

রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

নৈতিকতার অবক্ষয়ঃ এর হাত থেকে বাঁচার উপায়

👉এক. ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা

ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতির কারণেই তরুণ ও যুব সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের চোরাবলিতে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনকে সার্থক ও সৌন্দর্যময় করে নৈতিক মূল্যবোধ। উন্নত মানুষ ও সুস্থ সমাজ গঠনে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। নৈতিক মূল্যবোধ বলতে সততা, বিশ^স্ততা, ন্যায়নীতি, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, মায়া-মমতা, ক্ষমা, উদারতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সদাচরণ প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলির সমষ্টিকে বোঝানো হয়। ইসলাম মানবজাতিকে এসব মহৎ গুণ অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে থাকে। তবে ইসলামে নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। ইসলাম আল্লাহভীতি ও পরকালের চেতনা উপস্থাপন করে মানুষের ধ্যান-ধারণাকে এমন এক জগতের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যার কল্পনা মানুষকে যাবতীয় অপরাধ ও গোনাহ থেকে বিরত রাখে। জনমনে আল্লাহ তায়ালা ও পরকালের ভয় সৃষ্টি করা ছাড়া অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। তাই তরুণ প্রজন্মকে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে।

👉দুই. নামাজের প্রশিক্ষণ

পরিবারের সবাইকে নামাজি হিসেবে অভ্যস্ত করে তোলা অভিভাবকদের দায়িত্ব। কারণ নামাজ সব অনাচার ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে পারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি তোমার পরিবারের লোকদেরকে নামাজের আদেশ দাও এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থকো।’ (সূরা ত্বাহা : ১৩২)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, ‘নামাজ কায়েম করো। অবশ্যই নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)। 

👉তিন. অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা 

পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে ভিনদেশিদের সিনেমা-নাটকের কুপ্রভাব তরুণ-তরুণীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। অশ্লীলতা সামাজিক অনাচার সৃষ্টি করে। এ জন্য অশালীন বেশভূষা, অশ্লীল পোশাক ও জেনা-ব্যভিচার ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩২)। 

👉চার. ভালো বন্ধু নির্বাচন

সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে হবে। সন্তানরা কাদের সঙ্গে ওঠবস ও মেলামেশা করছে অভিভাবকদের সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে ভালো বন্ধু নির্বাচনে সহায়তা করতে হবে। ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ এটি শুধু প্রবাদ নয় বরং বাস্তবতাও। ভাল বন্ধু নির্বাচন করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষকে বন্ধু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গী হও।’ (সূরা তওবা : ১১৯)।  

👉পাঁচ. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

বিচার কাজে পক্ষপাতিত্ব, বিচারহীনতার অপসংস্কৃৃতি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাজেই অপরাধীদের অতি দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধ বন্ধে এর কোনো বিকল্প নেই। অপরাধীদের কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী বলে কোনো অপরাধী যেন পার পাওয়ার সুযোগ না পায়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। শত্রুতা বা স্বজনপ্রীতির কারণে বিচারে পক্ষপাত করার সুযোগ ইসলামে নেই। আল্লাহ তায়ালার এরশাদ, ‘কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না।’ (সূরা মায়েদা : ৮)। ‘সুবিচার কর, যদিও সে আত্মীয়ও হয়।’ (সূরা আনআম : ১৫২)। ন্যায়বিচারের ব্যাপারে মহানবীর দ্ব্যর্থহীন উক্তি ছিল, ‘আজ আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে যায় তবে আমি প্রথমে আমার মেয়ের হাত কেটে দেব।’ ‘অন্যায়কারী দলের লোক হোক বা যত বড় ক্ষমতাধর হোক ছাড়া পাবে না’ এটা ন্যায়বিচারের মূলনীতি হওয়া উচিত। 

👉ছয়. অপরাধের প্রতি ঘৃণাবোধ

আমাদের সমাজে সততা ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে। অন্যায়কে অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয় না। নীতিভ্রষ্ট ও দুষ্ট মানুষদের অপরাধী বলে গণ্য করা হয় না। জীবনের লক্ষ্য ও উন্নতি বলতে বোঝানো হয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও সম্পদ অর্জন। কিন্তু সে টাকা ও সম্পদ কোন পথে এলো তা নিয়ে কারও ভাবার সময় নেই। যে সন্তান তার বাবাকে অহরহ মিথ্যা বলতে দেখে, কাজে ফাঁকি দিতে দেখে, ঘুষ খেতে দেখে, অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে গ্রাস করতে দেখে তার নৈতিক ভিত তো দুর্বল হবেই। তরুণরা দেখতে পায় যে, বড়রা বা ক্ষমতধররাই নিজেদের স্বার্থে সন্ত্রাসীদের লালন করছে। সন্ত্রাসীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাই তারাও এই পথে অগ্রসর হতে উৎসাহবোধ করে।
সভ্যতা ও নৈতিকতা বিধ্বংসী যাবতীয় অনাচারের মূলোৎপাটনে ইসলাম কঠোর হতে বলেছে। অনুরূপভাবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, শোষণ প্রতিরোধ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা আসবে না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সব ধরনের অন্যায় প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে। যদি সে এতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম : ১৮৬)।

-সম্পাদকীয় 

রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৯

সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

সীরাতে রাসুল (সা):
সফলতা অর্জনের জন্য মানুষ বহু পদ্ধতি, বহু কৌশল অবলম্বন করে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সফল ব্যক্তিত্বদের অনুসরণ। সফল মানুষদের সবাই অনুসরণ করতে চায়। সফলতা যেখানে যে পদ্ধতিতে, মানুষ ছুটে চলে সেখানে, ধাবিত হয় সেই পদ্ধতি অনুসরণে। সফলতা মানুষের তীব্র আকাংখিত বিষয়। মানুষের সামগ্রিক কর্মতৎপরতাই সাফল্যের পেছনে ছুটে চলাকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। তাইতো মানুষ খুঁজতে থাকেন সফল মানুষদের। পৃথিবীতে যারা সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তারা সকলের কাছেই গ্রহণীয়, বরণীয় এবং অনুসরণযোগ্য হয়েছেন। মানুষ অনুসরণ করতে চায় এমন ব্যক্তিত্বদের যাদের অনুসরণ করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছা যায়।

সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছার জন্য আমরা কতই না সফল ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করি। কত শত সফল ব্যক্তির জীবনী পড়ি। নিজে পড়ি, অন্যকেও তা পড়তে এবং অনুসরণ করতে বলি। মাঝে মধ্যে আমাদের পিতা-মাতাও এমন সফল ব্যক্তিদের কথা শুনিয়ে সে অনুযায়ী আমাদের পথ চলতে বলেন। আমরা আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন অনেক ব্যক্তিত্বের লেকচার শুনেছি যাদের অনুসরণে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের জীবনী আলোচনা করে আমাদের মোটিভেশন চালানো হয়েছে। আমরাও হরহামেশা লেখনীতে, বক্তব্য বিবৃতিতে বহু সফল ব্যক্তিত্বের উদাহরণ টেনে অন্যকে উপদেশ দিই অনুসরণের। এই সকল উপদেশ, মোটিভেশন সফলতার পানে ছুটে চলা ব্যক্তির জন্য আশাব্যঞ্জক। কিন্তু নিরাশার দিক হলো, আমরা যাদের জীবনী পড়ে, যাদের সফলতার উদাহরণ টেনে সাফল্যের মোটিভেশন চালাই তাদের সফলতা জীবনের পূর্ণাঙ্গ দিকে না হয়ে কোন না কোন একটা দিকে তারা সফলতার স্বাক্ষর রাখলেও তারাই আমাদের গোটা জিন্দেগির অনুসরণীয় সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হয়ে যান। 

আমাদের অনেকেরই টেবিলে এ ধরনের অনেক সফল ব্যক্তিত্বের বইয়ের সমাহার থাকে। একবার আমি আমার এক বন্ধুর টেবিলে সফল ব্যক্তিদের জীবনীমূলক অনেক বইয়ের স্তূপ দেখে কৌতূহলবশত সবগুলো বই হাতে নিয়ে দেখলাম। বিশ্বের নামীদামি অনেক সফল ব্যক্তিত্বের বই ছিল সেখানে। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম সফল ব্যক্তিত্ব এবং মনীষীদের এত্তসব বই সংগ্রহের উদ্দেশ্য কী? প্রত্যাশিত উত্তরই পেলাম তার কাছে, এসব সফল ব্যক্তিত্বের অনুসরণে জীবনটাকে সফল করতে চায়, জীবনটাকে বদলে দিতে চায় সে। আমার বন্ধুটির কাছে জানতে চাইলাম আচ্ছা বন্ধু, সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব কে? যার জীবনে কোনো ব্যর্থতা ছিল না, যিনি সর্বক্ষেত্রেই সফল ছিলেন, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, যাকে নির্দ্বিধায় অনুসরণ করা যায়? আমার বন্ধুটি কিছুক্ষণ চিন্তা করেই জবাব দিল এমন সফল ব্যক্তিত্বতো একজনই তিনি হলেন সর্বশেষ নবী মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা)। বন্ধুকে শেষ প্রশ্নটি করলাম সত্যই যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে টেবিলে রাখা সফল ব্যক্তিদের বইয়ের সারিতে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সিরাতগ্রন্থ বা জীবনীমূলক বই নেই কেন? আমার বন্ধুটি এ প্রশ্নে খানিকটা বিব্রত হলো, মাথা নিচু করে বলল, আসলে বিষয়টিতো সেভাবে ভাবিনি। 

যিনি জীবনের সব দিকেই ছিলেন সফল, সব বিভাগেই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। যিনি তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন-বৃদ্ধ সব বয়সেই অনুকরণীয়। যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। আমরা বিষয়টি শতভাগ মুখে স্বীকার এবং অন্তরে বিশ্বাস করলেও তাঁকে অনুসরণ করতে আমরা অনেকেই ভুলেই যাই। তার জীবনালেখ্য দিয়ে সফল জীবনের চিত্র অঙ্কন করতে আমরা অনেকেই পিছপা হই। আমাদের বক্তব্য বিবৃতি লেখনীতে আমরা তাঁর উদাহরণ টেনে আনতে শঙ্কোচ বোধ করি। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! আমাদের পিতা-মাতাও তার জীবনী থেকে উদাহরণ আমাদের কমই দেন। শিক্ষকরা ক্লাসে যত বেশি পারেন বিভিন্ন সফল ব্যক্তিত্বের উদাহরণ দেন কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদাহরণ খুব কমই সামনে আনেন। তাহলে যাকে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকার করি তাকে অনুসরণ না করে কিভাবে আমরা সফল হওয়ার কিংবা জীবন বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখি!

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবন। মানুষের জীবনের ব্যাপ্তি খুবই ছোট এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের। পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু তত কমছে। ক্ষুদ্র জীবনেও সফল হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা আর সুন্দর স্বপ্ন আমাদের। ক্ষুদ্র এই জীবনে মানুষকে সফলতার সিংহাসনে আরোহণ করতে হলে বহু বাধা অতিক্রম করতে হয়। পার হতে হয় নানা সময়ে নানা সঙ্কট। জন্মের পর থেকেই মানুষকে প্রতিবন্ধকতা টপকাতে হয়। শিশু-কৈশোর, তরুণ-যুবক, বৃদ্ধÑ এই সব বয়সের গ-িতে নানা বাধা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়েই মানুষকে সফলতার স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। একটি কথা আছে, মানুষের জীবনের যত বাঁক, বাধা প্রতিবন্ধকতার তত হাঁক। এই বাধা প্রতিবন্ধকতার হাঁক-ডাক মাড়িয়েই মানুষকে সফলতার মঞ্জিলে পৌঁছতে হয়। কিন্তু যদি বলা হয় শিশু, কৈশোর, তরুণ, যুবক, বিবাহিত জীবন, বৃদ্ধ এবং মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ধাপেই সফল ছিলেন শ্রেষ্ঠ ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্বের নাম বলো। হিসাব করে বললে দেখা যায়, সচরাচর আমরা যাদের নাম বলি তারা কোনো একটি সময়ে কোনো একটি বয়সে কোনো এক বিষয়ে সফল ছিলেন। কিন্তু সব বয়সে সব সময়ে যিনি সফল ছিলেন, সব দিক থেকেই যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি হলেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)।

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত বীর-মহাবীর, নেতা-মহানেতা, রাজা-মহারাজা, সমাজসংস্কারক ও সফল ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে, এদের সবাই সভ্যতার বিভিন্ন অংশে অসামান্য অবদান রেখেছেন। পৃথিবীতে তাদের বহু অমর কীর্তি স্থাপিত হয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এসব ব্যক্তি বহু জীবনদর্শন দিয়ে মানবজাতির উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। এসব সফল ব্যক্তির অনুসরণ করেও অনেকেই সফলতার শিখরে আরোহণ করেছেন। কিন্তু সফল এসব ব্যক্তিত্বের অবদান, চেষ্টা-সাধনা ও কৃতিত্ব অনেকাংশেই পূর্ণতা পায়নি। বরং তা ছিল আংশিক, অপরিপূর্ণ, জীবনের কোনো একটি বিষয়ে, কোনো একটি সময়ে বা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ (সা) এমনই একজন মাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বত্র সফলতা ও কৃতিত্ব দিয়ে মানবজীবনের জন্য আদর্শ হয়ে রয়েছেন। তাঁর সফলতার এ অবদান শুধু ব্যক্তিজীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রীয়জীবন তথা সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল ব্যক্তিত্ব। একটি সুন্দর বসুন্ধরা বিনির্মাণে, একটি সফল ব্যক্তিত্বপূর্ণ জীবনগঠনে, পরিপূর্ণ অবদান, কীর্তি এবং দর্শন রয়েছে শুধুমাত্র তাঁর জীবনেই।

অসংখ্য সফল ব্যক্তিত্বের জীবনী আমাদের সামনে রয়েছে। তাদের বহু সাফল্যের নজিরও রয়েছে আমাদের সামনে। কিন্তু এর কোনো একটিই মানুষের পরিপূর্ণ জীবনটাকে বদলায়নি। এর কোনো একটিই কোন ব্যক্তির জীবনে পূর্ণাঙ্গ সফলতা এনে দেয়নি। বরং প্রতিটি ঘটনাই আংশিক বা কিয়দাংশ সফলতার মুখ দেখেছে। সফল ব্যক্তিদের প্রতিটি সাফল্যই ব্যক্তিকে পুরোপুরি না বদলিয়ে বা ভেতর থেকে না বদলিয়ে শুধু বাইরের পরিবেশটা বদলানোর চেষ্টা করেছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাফল্যের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, মানুষ ভেতর থেকে বদলে গিয়েছিল। শুধু বদলে যায়নি বরং তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনে সংঘটিত হয়েছিল আমূল পরিবর্তন। রাসূলের অনুসরণে একটি জাহেলি সমাজ আমূল পরিবর্তন হয়ে কল্যাণমুখী সমাজে পরিণত হয়েছিল। হযরত ওমর (রা)-এর মত দোর্দন্ড প্রতাপশালী দাম্ভিক মানুষটি হয়ে গেলেন বিনয়ী সত্যনিষ্ঠ মানুষ। আওস এবং খাজরাজ গোত্রের দীর্ঘ ৪০ বছরের খুনকা বদলা খুনের নীতি পরিবর্তন হয়ে তারা হয়ে গেলেন পরস্পরের কল্যাণকামী। উচ্ছৃঙ্খল, মদখোর, হতাশ যুবকেরা রাসূল (সা)-এর মত ব্যক্তিত্বের অনুসরণে বিলাসী জীবনের মুখে পদাঘাত করে আদর্শিক জীবনযাপন করতে শুরু করলেন। একটি বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এলো আলোকিত একটি সমাজ। এমন সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া আর কে হতে পারেন?

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল এবং শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে শুরু করে ওফাত পর্যন্ত রাসূল (সা)-এর জীবনের প্রতিটি ধাপই আমাদের জন্য অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়। ছোটবেলায় শিশুদের মধ্যে রাসূল (সা) ছিলেন আদর্শ শিশু। কারণ তিনি কখনো খেলার ছলেও শিশুদের আঘাত করেননি। রাসূল (সা) যখন কিশোর বয়সে উপনীত হন তখন তিনি আরবের জাহেলি সমাজের চিত্র দেখে ব্যথিত হন। সে সময়কার গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ বিগ্রহসহ বিধ্বস্ত সমাজের করুণ চিত্র রাসূল (সা) উপলব্ধি করেন। কিশোর হওয়ার পরও তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিশোর হয়েও সফল হন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন হিলফুল ফুজুল সংগঠন। ২৫ বছর বয়সে আরবের ধনাঢ্য মহিলা হযরত খাদিজা (রা)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হজরত খাদিজা (রা) ব্যবসার সকল দায়িত্ব রাসূল (সা)-এর ওপর অর্পণ করেন। রাসূল (সা) দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন। রাসূল (সা)-এর হাত ধরে ব্যবসার ব্যাপক উন্নতি হয়। সে হিসেবে রাসূল (সা) একজন সফল ব্যবসায়ীও ছিলেন বটে। ৪০ বছর ধরে চলা আওস এবং খাজরাজ গোত্রের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান রাসূল (সা)। কাবাঘর মেরামতের সময় হাজরে আসওয়াদ কারা স্থাপন করবে এ নিয়ে সৃষ্ট সংঘাত ও উত্তেজনা রাসূল (সা) সফলতার সাথেই সমাধান করেন। 

৪০ বছর বয়সে নবুওয়ত লাভের মাধ্যমে রাসূল (সা)-এর শ্রেষ্ঠত্ব আরো বেশি উদ্ভাসিত হয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিটি জীবনেই রাসূল (সা) একজন শ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিজীবনে তিনি মহানুভব, পরোপকারী, দয়ালু, দানশীল ও হৃদয়বান। পারিবারিক জীবনে তিনি শ্রেষ্ঠ শিশু, শ্রেষ্ঠ কিশোর, শ্রেষ্ঠ যুবক, শ্রেষ্ঠ স্বামী, শ্রেষ্ঠ পিতা। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একাধারে তিনি শ্রেষ্ঠ সফল রাষ্ট্রনায়ক, শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক, শ্রেষ্ঠ সেনাপতি, শ্রেষ্ঠ সমরবিদ, শ্রেষ্ঠ কৌশলী, শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী। মদিনায় রাষ্ট্রগঠনে রাসূলের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। মদিনা সনদ প্রণয়ন করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহে বিজয়ী হয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে তিনি সাফল্যের নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তিনি সাফল্যের ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন। এভাবে তার জিন্দেগির প্রতিটি ধাপের শ্রেষ্ঠত্ব ও সফলতা বর্ণনা করে সহজেই শেষ করা যাবে না। 

রাসূল (সা)-এর সিরাত বা জিন্দেগি আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে পড়ি তাতে শুধু আবেগতাড়িত হই। কারো ক্ষেত্রে এ আবেগ রাসূল (সা)কে জানতে উদ্বুদ্ধ করে মানতে নয়। এমন মুসলমানদের সংখ্যা নেহাত কম নয় যারা শুধু সওয়াব হাসিল করার জন্যই সিরাত তথা রাসূল (সা)-এর জীবনীচর্চার আগ্রহ পোষণ করে থাকে। কোথাও কোথাও খুবই ধুমধামের সাথে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, কোথাও মিষ্টি ম-া বিতরণ, কোথাও ফুলের ছড়াছড়ি, কোথাও আগরবাতি ও আতর-লোবানের মাত্রাতিরিক্ত ছড়াছড়ি এবং কোথাও বিচিত্র আলোকসজ্জা দ্বারা উক্ত বিশ্বাসেরই অভিব্যক্তি ঘটে। দুর্ভাগ্যবশত, এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রেরণা নিয়ে রাসূল (সা)-এর জীবনী অধ্যয়ন করাতে আমরা খুব কমই সফল হচ্ছি। রাসূলের জীবনী থেকে জীবনের প্রতিটি ধাপের অনুসরণ করে তদানুসারে জীবনকে গড়ে তুলতে হবেÑ এরূপ মনোভাব দ্বারা আমরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছি না। ফলে জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সাফল্যও পাচ্ছি না। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষ হয়েও তিনি এমন অতুলনীয় সাফল্যমন্ডিত জীবনের নমুনা পেশ করেছেন যা সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনে ছিল অনেক গুণের সমাহার। তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ এই যে, তার দৃঢ়তা-সাহসিকতা, নীতি-আদর্শ, কোরবানি-আত্মত্যাগ, দায়িত্বসচেতনতা, মানবতার সেবাসহ সামগ্রিক কাজই ছিল মানবতার কল্যাণে। তাইতো তিনি সফল হয়েছেন সর্বক্ষেত্রে, গড়েছেন এক পুণ্যময় জীবন যা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে এবং তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আদর্শ রয়েছে।

আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে? এমন প্রশ্নের জবাবে বহু লোককেই দেখেছি যারা তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা)-কেই বেছে নেন। কিন্তু সামগ্রিক জীবনে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর আদর্শ তারা অনুসরণ করেন না। তাদের জীবনাচরণ দেখলে সামান্যটুকুও বলার সুযোগ নেই যে, অমুকের ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (সা)। এ সকল ব্যক্তি প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রাসূলকে মনোনীত করেন ঠিকই কিন্তু তার জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন না। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনাদর্শ থেকে সমভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে একজন রাষ্ট্রনায়ক, একজন প্রশাসক, একজন শাসনকর্তা, একজন মন্ত্রী, একজন কর্মকর্তা, একজন মনিব, একজন চাকুরেজীবি, একজন ব্যবসায়ী, একজন শ্রমিক, একজন বিচারক, একজন শিক্ষক, একজন সেনাপতি, একজন বক্তা, একজন নেতা, একজন সংস্কারক, একজন দার্শনিক এবং একজন সাহিত্যিকও। সেখানে একজন পিতা, একজন সহযাত্রী ও একজন প্রতিবেশীর জন্য একই রকম অনুকরণীয় আদর্শ রয়েছে। মানুষ তার জীবনটিকে সাফল্যম-িত করতে যে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম উৎকর্ষ অর্জন করা প্রয়োজন তার সবই আছে রাসূল (সা)-এর ব্যক্তিত্বে। এ জন্যই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব। সমগ্র মানব ইতিহাসে অনুসরণীয় ‘শ্রেষ্ঠমানুষ’ কেবল এই একজনই। 
রাসূল (সা) যে অনুকরণীয় অনুসরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তার ঘোষণা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূল (সা)-এর জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আহজাব : ২১) রাসূল (সা) যে সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা সবসময়ই আলোচিত এবং স্বীকৃত। 

আল্লাহ তায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। মুসলমানতো বটেই, দুনিয়ার প্রায় সব অমুসলিম মনীষী, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঐতিহাসিক, গবেষক সকলেই সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তি হিসেবে সাইয়েদুল মুরসালিন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা)কে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের বক্তব্য বিবৃতি লেখনীতে। বিশে^র অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক জজ বার্নাড শ রাসুল (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, I believe that if a man like Mohammad (PBUH) was to assume the dictatorship of the modern world, he would succeed in solving its problems in a way that would bring it the much needed peace and happiness. অথ্যাৎ- আমার বিশ্বাস নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর মতো কোন ব্যাক্তি যদি বর্তমান বিশ্বের একনায়কের পদে আসীন হতেন, তাহলে তিনিই বর্তমান বিশ্বের সমস্যাবলীর এমন সমাধান দিতে পারতেন, যার ফলে বিশ্বে কাঙিখত শান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধি নেমে আসত। আজকের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে সফল জীবন গঠন করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর প্রকৃত অনুসরণের বিকল্প নেই।

লেখকঃ সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৯

"যা কিছু করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছি" -প্রফেসর ডক্টর নাজমুদ্দিন এরবাকান


একজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে ওঠা তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রণেতা এবং সাবেক তার্কিশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে খ্যাত সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বুকে জায়গা করে নেয়া এক ব্যাক্তিত্বের নাম মুহম্মদ নাজমুদ্দিন এরবাকান। ৭০-৮০ এর দশকের দিকে তুরস্কের একের পর এক প্রজন্ম যখন তথাকথিত সেক্যুলারিজমের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বেড়ে উঠছে,তিনিই সেই নেতা যিনি ইসলামের পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে আসেন এক জিহাদের উদ্দেশ্যে। সেই জিহাদ নিঃসন্দেহে এক বিপ্লব সংঘটিত করেছিল যা আজও আধুনিক তুরস্কে বহমান। তাকে নিয়ে যতবারই পড়েছি,এখনও পড়ছি,ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। অনেক ব্যাস্ততার মাঝে একটু ফুরসত পেয়ে তাকে নিয়ে কিছু লেখার মন:স্থির করলাম।

নাজমুদ্দিন এরবাকানের কর্মজীবন শুরু তৎকালীন জার্মানির সর্ববৃহৎ ইঞ্জিন ফ্যাক্টরি ডয়েজের লিওপার্ডো ট্যাংকের ইঞ্জিন বিষয়ক প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সেখানে কিছুকাল কাজ করার পর দেশে ফিরে আসেন এবং দেশে ফিরে স্থানীয়ভাবে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে তোলেন 'গুমুশ মোটরস' নামক তুরস্কের সর্বপ্রথম ইঞ্জিন কোম্পানি। এটা ছিল তার জীবনে একটা অনেক বড় সংগ্রাম এবং এজন্য তিনি অভ্যন্তরীণ ইয়াহুদি লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। যদিও চড়াই উতরাই পার করে এই কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় তিনি দেখতে পান যে,দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যাতে কোনভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য সরকারি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এর অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে গুরুত্ব দেন যার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক শক্তির বলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

তুরস্কে ইসলামী আন্দোলনের পদযাত্রা শুরু হয় তারই রাজনৈতিক দল 'মিল্লি গুরুস' এর মাধ্যমে। তিনি বলতেন,'আমি রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত নই,জিহাদ দ্বারা প্রভাবিত'। মিল্লি গুরুস অর্থ হল জাতীয় ভিশন, এটি ছিল প্রতীকী শব্দ কারণ তুরস্কে ইসলামের নামে যে কোন ধরণের সংগঠন করা নিষিদ্ধ ছিল। যদিও তিনি মিল্লি গুরুস দ্বারা সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝাতেন। মিল্লি গুরুসের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল-
আধ্যাত্মিক উন্নতি,অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বিতা এবং অনুগত কামালিস্ট ইউনিয়নের বদলে সাম্যবাদী ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা। মিল্লি গুরুস প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিল্লি নিজাম পার্টি। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রোষানলে পড়ে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর নাম বদলিয়ে গঠন করেন মিল্লি সালামত পার্টি। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার অনুমতি পায় এবং এরবাকান হন উপ-প্রধানমন্ত্রী। তার এই কোয়ালিশন সরকারের সময় ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেয়া থেকে শুরু করে সাইপ্রাসকে গ্রিস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা,নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করা,ব্যাপক কোরআন কোর্স চালু করা,মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া,বিশ্ববিখ্যাত আলেম বদিউজ্জামান সাইদ নূরসীর রিসালায়ে নূরের উপর থেকে নিষধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা,সকল প্রতিষ্ঠানে মসজিদ নির্মাণ করা এবং অশ্লীলতা বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করাসহ তিনি অনেক কাজ করেন। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০তে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকগণ ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে দেয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। অবশেষে ৮৩ সালে তার উপর যুলুম নির্যাতনের অবসান হয় এবং জেল থেকে বেরিয়ে গঠন করেন রেফাহ পার্টি। একাধিকবার তার রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের পর এই পার্টিই অনেকদিন সংগ্রামে টিকে থাকে। ৮৪ সালে রেফাহ পার্টিতে যোগদান করেন বর্তমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং সমগ্র বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় নেতা রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান। ১৯৮৭ সালে গণভোট করে এরবাকানের উপর থেকে রাজনৈতিক নিষধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারো পূর্ণাঙ্গভাবে রাজনীতিতে আসেন এবং রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সভাপতিত্ত্বে রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারই ধারাবাহিকতায় ৯৪-তে এরদোয়ান রেফা পার্টি থেকে ইস্তাম্বুলের সিটি কর্পোরেশনে জয়লাভ করে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে তার দল জয়লাভ করে। কিন্তু এই সরকার মাত্র ১১ মাস ক্ষমতায় টিকতে পারে। পরবর্তীতে এক পোস্ট মর্ডাণ ক্যূ করে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়। এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে ইসলামকে সমৃদ্ধ করার জন্য  একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে সবথেকে বড় উদ্যোগ ছিল ৮টি মুসলিম দেশ নিয়ে D-8 সম্মেলন প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও সুদের হার কমিয়ে আনা,সকলের বেতন বৃদ্ধি,শিল্পায়নে গতি ফিরিয়ে আনা এমন বেশ কিছু উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তিনি রাজনীতিতে একটু আলোর মুখ দেখতেন,তখন থেকেই তার পুনরায় সংগ্রামের প্রহর গোনা শুরু হয়ে যেত। এবার তাকে প্রতারণার মুখে পড়তে হয়। তার উক্ত সফলতায় সেক্যুলাররা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রোপাগান্ডা চালায় ও তার পার্টি শরিয়ত কায়েম করবে এমন অযুহাতে তাকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এই অবস্থায় এরবাকান প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেয়ার ঘোষণা দেন,তবে শর্ত আরোপ করেন যে সে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলে তার কোয়ালিশন পার্টির নেতা তানসু চিলারকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। কিন্তু সেক্যুলারিস্ট ও ইহুদিদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতা সোলায়মান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী করে এবং রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার নীলনকশার চূড়ান্ত পদক্ষেপটি নেওয়া হয় এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। এরপরে এরবাকান হুজার(শিক্ষকরুপে সম্বোধন করে হুজা বলত সবাই) রাজনৈতিক জীবনের পরিসর অল্প এবং কম গুরুত্বপূর্ণ। রেফাহ পার্টি নিষিদ্ধ হলে তারই দলের নেতা রেজাই কুতান ফাজিলত পার্টি গঠন করে যা '৯৯ এর নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ে। ৯৬ সালে ২২% ভোট পেয়ে কোয়ালিশনে আসতে পারলেও '৯৯ সালের নির্বাচনে সেই হার তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

 ১৯৯৯-২০০১ সাল ছিল সম্ভবত তুরস্কের সবচেয়ে বাজে রাজনৈতিক সময়। সেই সময়ই তুরস্ক ইউরোপের রুগ্ন দেশ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কোয়ালিশনে থাকা দলগুলোর মধ্যকার কোন্দল, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ভূমিকম্পে দেশে টালমাটাল অবস্থা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার মতো সামর্থ্য ছিল না সরকারের। ২০০১ সালে এরবাকানের দলীয় নেতাদের মধ্যে মতানৈক্যের অভাব দেখা দেয়। দুইটি ধারার অনুসারীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রবীণ নেতাসহ বেশ কিছু নেতারা গতানুগতিক প্রথা ধরে রাখার অনুসারী ছিল। তারা আবার নতুন নাম করে নতুন একটি দল গঠন করার চিন্তাভাবনা করছিলো। অপর দিকে নবীণ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার নেতারা গত ২০-২৫ বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করে তাদের রাজনীতিতে ভিন্ন কিছু পলিসি ও বৈশিষ্ট্য আনার পক্ষপাতি ছিল। ট্রাডিশনাল ধারার নেতা ছিলেন এরবাকান এবং তাদের প্রবীণ অনুসারীরা। এবং নতুন ধারার অনুসারী ছিল এরবাকানেরই শিষ্য এরদোয়ান ও নতুন এবং উৎসাহী বেশ কিছু নেতা। যদিও তাদের মধ্যকার যেই মূল বিশ্বাস অর্থাৎ ইসলামপন্থী ও জিহাদের রাজনৈতিক আদর্শে কোন ছেদ পড়েনি। এরদোয়ান কনজারভেটিভ ডেমোক্রেসি আদর্শ সংযোজন করে একে পার্টি গঠন করেন এবং মূলধারার রাজনীতিতে এরবাকানের আদর্শ বহমান রাখেন। এরবাকান গঠন করেন সা'দাত পার্টি। ২০০২ সালের নির্বাচনে একে পার্টির ভূমিধস জয় হয়।আল্লাহর শুকরিয়া তখন থেকে এখনও পর্যন্ত এরদোয়ান সফলভাবে তাদের মিশন ও ভিশন চালু রাখতে সমর্থ হয়েছেন এবং আধুনিক তুরস্কে গণতন্ত্র ও কল্যাণকামী একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একে পার্টির উত্তরোত্তর সফলতায় এরবাকানের রাজনৈতিক অবদান ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার আদর্শেরই জয় হয়েছে,তার আদর্শ পূর্ণতা পেয়েছে হোক তা তার শিষ্যের মাধ্যমে। আনুমানিক তার দীর্ঘ ৩০ বছরের সংগ্রামে তিনি যেভাবে তুরস্ক গঠন করতে চেয়েছিলেন বর্তমান তুরস্ক তেমনই হয়তোবা তার থেকেও সুন্দর। তার আদর্শ আজ প্রতিষ্ঠিত। শত ঘাত-প্রতিঘাতময় তার সংগ্রামী জীবন আমাদের এটাই শেখায় যে যতই বিপদ-বিপর্যয় আসুক,থেমে থাকা যাবে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও শুকরিয়া আদায় করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ চিত্তে প্রাণ থাকবে।

তার কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১- আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে সরকারী কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরন
২- পুনরায় মাদ্রাসা স্থাপন
৩- ৫০০০ এর বেশী কুরআন কোর্স চালু করা
৪- সকল স্কুলে দ্বীন ও আখলাক দারস বাধ্যতামূলক করে দেওয়া
৫- মুসলিম দেশসমূহ থেকে পাশ করে আসা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেওয়া। (বর্তমান সময়েও যা নাই। কয়েকটি দেশের সার্টিফিকেটকে এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না)
৬- তুরস্ককে ওআইসির অন্তর্ভুক্তিকরন
৭- ইসলামীক ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন
৮- তুরস্কে সুদ মুক্ত ব্যাংক চালু করা (বর্তমানে যেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অবস্থিত)
৯- ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা। ২৭০ টির বেশি ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
১০- নতুন বৃহৎ তুরস্কের পরিকল্পনা
১১- ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির সামনে ১০০ বছরের বিস্তারিত ভিশন পেশ করা।
১২- তুরস্ক এবং ইরানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা।
১৩- বসনিয়াকে স্বাধীন করার জন্য মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ এবং সেখানে অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করা।
মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত কারখানা-
১৮ টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি,
১৬ টি সার-কারখানা,
১৪ টি চিনির ফ্যাক্টরি...
২৩ টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি
৬ টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরী
৭৭ টি বৃহৎ শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠান
৬৩ টি organized industrial Zone
২৫৩ টি ছোট শিল্প-কারখানা,
৩২ টি বৃহৎ মেশিনারী ফ্যাক্টরী
৪ টি নৌ কারখানা
১০ টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরী
১১ টি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল শিল্প-কারখানা
৩ টি গবেষণা সেন্টার(প্রাকৃতিক সম্পদ)
৪ টি ইলেক্ট্রোনিক শিল্প-কারখানা এবং
সর্বশেষ Taksan প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ছিলো “ফ্যাক্টরী বানানোর ফ্যাক্টরী।” মানে অন্যান্য ফ্যাক্টরী বানাতে হলে যা সরঞ্জাম লাগবে তা এই ফ্যাক্টরি সরবরাহ করবে।
এতো কম সময়ে এরকম উৎপাদন আর কেউ করে দেখাতে পারে নি তার্কির ইতিহাসে।

৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারী সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর কাছে চলে যান মহান এই নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণে লোক হয়েছিল যে,তুরস্কের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয় নি। অফিশিয়াল তথ্য মতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল তার জানাযায়। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,তার মৃত্যুর পর সরকার বিশেষ কোন সম্মানে যেন তাকে দাফন না করা হয়। অতঃপর তার দুই ছাত্র তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান এবং আব্দুল্লাহ গুল লাশের খাটিয়া ধরে তার লাশ বহন করেন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে ভূষিত করা হয়।

তথ্যসূত্র: দাওয়াম:আমার সংগ্রাম; প্রফেসর ডক্টর নাজমুদ্দিন এরবাকান ও উইকিপিডিয়া

রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯

২৮ অক্টোবর প্রেরণার উঁচু মিনার-মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

ক্ষমতালিপ্সুদের হিংস্র থাবায় ২৮ অক্টোবর ২০০৬ রক্তরঞ্জিত হলো রাজধানীর কালো পিচঢালা রাজপথ। লগি-বৈঠার আঘাতে ও লাশের ওপর নর্দন-কুর্দন করে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীদের নিঃশেষ করাই ছিল ইসলাম বিদ্বেষীদের টার্গেট। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে জীবন উৎসর্গ করলেন দ্বীনের মুজাহিদেরা কিন্তু পিছু হঠলেন না এককদমও। মিডিয়ার সুবাদে আওয়ামী হায়েনাদের বীভৎসতা ভয়ানক তাণ্ডব, নীচুতা ও পাশবিকতা প্রতক্ষ্য করল বিশ্বমানবতা। শহীদ ও আহতদের রাজপথে রেখে এক মুহূর্তের জন্য পিছুটান নিলেন না আন্দোলনের সাথীরা। এ যেন কারবালার আর এক নিষ্ঠুর প্রান্তর। ভাইয়ের সামনে ভাইয়ের লাশ। জান্নাতের মেহমানেরা পাখি হয়ে ঘুরছেন জান্নাতে। বছর ঘুরে ২৮ অক্টোবর আসে। শহীদের সাথীরা প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহায় নবোদ্দীপনায় জাগ্রত হয়। আজ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে ২৮ অক্টোবর প্রেরণার সুউচ্চ মিনার।

২৮ অক্টোবর চারদলীয় ঐক্যজোটের সরকারের মেয়াদকালের পরদিন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ছিল প্রথম দিন। পল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোকাররম উত্তরগেট ছিল জামায়াতের পূর্বনির্ধারিত এবং অনুমোদিত সভাস্থল। পাল্টা আওয়ামী লীগও পল্টন ময়দানে সভা করার ঘোষণা দেয়। এ যেন রাজনীতির চরম শিষ্টাচারিতার লঙ্ঘন। যার কারণে বিএনপি সঙ্ঘাত এড়িয়ে নির্ধারিত স্থানে তাদের সমাবেশ না করে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাদের কর্মসূচি পালন করছিল।

 

আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা! বলে এক রকম, করে অন্য রকম। তাদের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ভয়াল নগ্ন চেহারা তারা সেদিন প্রদর্শন করেছিল। তাদের কার্যালয় বাদ দিয়ে জামায়াতের নির্ধারিত সভাস্থল বিনা উসকানিতে দখলের চেষ্টা করে সাহারা, তোফায়েল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মায়া, ডাক্তার ইকবাল ও হাজী সেলিমের লগি-বৈঠা বাহিনীর নেতৃত্বে। তাদের গতিবিধি আচার-আচরণ দেশবাসীর কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছিল যে, এ ধরনের আচরণ ছিল অত্যন্ত পূর্বপরিকল্পিত। চোরাপথে ক্ষমতায় আসার ডিজিটাল নাটকের মঞ্চায়ন। কথিত স্বাধীনতার চেতনার একক দাবিদার আওয়ামী হায়েনাদের তাণ্ডবে সেদিন জান্নাতের পাখি হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন টগবগে অকুতোভয় তরুণ শহীদ মুজাহিদ, শিপন, রফিক, ফয়সাল, মাসুম ও শাহাজাহান আলী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো যারা সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লিখালেন শহীদ জসিম-১, সাবের, শহীদ জসিম-২, আরাফাত, আব্বাস, রুহুল আমিন, হাবিব ও বয়োবৃদ্ধ জাবেদ আলী।

জীবনের স্বপ্নসাধ তাদেরকে মুহূর্তের জন্যও স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এ যেন শাহাদাতের পেয়ালা পানের এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিযোগিতা। আন্দোলনের সাথীরা ইয়ারমুকের যুদ্ধের ন্যায় পানি পান না করে পাশের ভাইকে পানি পান করানো, নিজের সুরক্ষা নয় আন্দোলনের ভাইয়ের সুরক্ষার জন্য ইস্পাত দেয়াল হয়ে যান। দুনিয়ার মায়া মমতা যেন তাদের কাছে তুচ্ছ। নিজেরা মজলুম হয়েছিলেন সেদিন, জালিমের কাতারে শামিল না হয়ে শহীদের কাতারে রিক্তহস্তে নিজেদের শামিল করে কালের অনাগত বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস মিনারস্বরূপ। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন, সত্য-অসত্য কখনো এক হতে পারে না; যেভাবে আলো-আঁধার এক হতে পারে না। দেশে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী তাদের নেতৃত্ব বাছাই করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্র্রাজ্যবাদীদের নখরে ফ্যাসিবাদীদের জয়ধ্বনিতে বাংলাদেশের রাজধানী থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়েও এর আঁচড় লেগেছিল। যে কারণে একটি অনাকাঙ্খিত পরিবেশ তৈরি হলো। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে সাজানো নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল সমগ্র জাতি। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন,- এক-এগারো আমাদের আন্দোলনের ফসল।

খুন করে ঘটনাস্থল থেকে লাশ চুরি করে অপরাজনীতি করার মতো নির্লজ্জ ইতিহাস উপহার দিতেও আওয়ামী লীগ কুণ্ঠিত হয়নি। ২৮ অক্টোবর কালো অধ্যায় রচনাকারীদের স্বপ্নসাধ সাময়িকভাবে বাস্তবায়ন হলেও শহীদের সাথীরা রক্তের বদলা নিতে কফিন ছুঁয়ে আন্দোলনের কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দীপ্তশপথ গ্রহণ করেন। পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে কুৎসিত ফ্যাসিবাদীদের চেহারা পুনরায় প্রকাশ করল আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ইসলামপন্থীদের নানা অভিযোগে দমনের ভয়ঙ্কর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো আওয়ামী তাবেদারী সরকার। সত্যপন্থীদের জীবন দিয়ে হলেও আন্দোলনের সুরক্ষার তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে একটি স্পর্শকাতর কথিত ‘যুদ্ধাপরাধ’ ইস্যু এনে ঘায়েল করার জন্য ক্ষমতাসীনরা নীলনকশা করেছিল।

সেদিন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নেতৃত্বের নির্দেশে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশস্থলে অবস্থান করেছিলেন। এত লগি-বৈঠার আক্রমণের শিকার একটা দলের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবে বেপরোয়া ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দলের আমীরের গঠনতান্ত্রিক বক্তব্যের মাধ্যমে সবাই হানাহানির পরিবর্তে চরম ধৈর্য ধারণ করেছিলেন। সেদিনের ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের অনেকের ভাষ্যমতে- সেদিন যদি দলের আমীরের বক্তব্য বেপরোয়া হতো হয়তো বা পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। আবার ইসলামী সংগঠন ব্যতীত অন্য বৈষয়িক দল হলে সেই ধৈর্য ও ক্ষমা প্রদর্শনের নমুনা প্রদর্শন করা সম্ভব হতো কি না তাও ভাববার বিষয় ছিল।

বাংলাদেশের যেসব প্রান্তরে শহীদের খুন ঝরেছে সেসব প্রান্তরেই আন্দোলন গতিশীল হয়েছে, গণভিত্তি রচিত হয়েছে। ভিন্ন দল-মত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দল সম্পর্কে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ জন্মেছে। ঢাকা শহরে ২৮ অক্টোবর ছিল দেশের ইতিহাসে জনশক্তির আত্মত্যাগের সবচেয়ে বড় নজির। আন্দোলনের কর্মীরা দৃঢ়চিত্তে মনে করে এ রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না।
 রাজধানীসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে আন্দোলনের সেই প্রত্যাশিত ও যৌক্তিক আহ্বান পৌঁছিয়ে দিয়ে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে আমরা এর প্রতিশোধ নিতে চাই।

২৮ অক্টোবরের শহীদ পরিবারগুলোর আত্মীয়দের সাথে যখনই আমরা দেখা করতে গিয়েছি প্রশান্তিতে হৃদয় ভরে গিয়েছে, বার বার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। শহীদদের স্বজনদের বক্তব্য আমাদের আন্দোলনের কাজে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে। শহীদের মা-বাবা এখনও আমাদের কণ্ঠে মা-বাবা ডাক শুনে তাদের হৃদয়ের অপূরণীয় রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন, আন্দোলনের নেতাকর্মীদেরকে নিজের সন্তান মনে করেন, আমাদের সুখ যেন ওনাদের পরম পাওয়া, আমাদের দুঃখ-কষ্ট যেন ওনাদের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার। আমাদের মাঝে তাদের সন্তাদেরকে খোঁজে ফেরেন। তারা আমাদের আপনেরও আপন। আর সন্তানের আত্মত্যাগের চূড়ান্ত মনজিলের সার্থকতার অপেক্ষায় থাকেন- ‘কবে এ দেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে!’

দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নয়া জঘন্যতম অধ্যায় রচনা করল আওয়ামী লীগ। যে দলের দলীয়প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে লঠি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় তিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার ষড়যন্ত্রের মুখোশ প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে থাকে। বিরোধী দল-মতের ওপর চলতে থাকে নির্যাতনের স্টিম রোলার। তার আচরণে বার বার তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন তিনি চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী, যা অনাগত কালেও সম্ভব নয়। তার শেকড় বাংলাদেশে নয়, তার শেকড় যেন ভিনদেশে। যে কারণে দেশ ও দশের প্রতি নেই কোনো মায়া। একের পর এক পর দেশের সাথে চুক্তি করে সর্বস্বান্ত করে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন সব কিছু। বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের ওপর দমন পীড়ন দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। ২৮ অক্টোবরের শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের স্বজনেরা অপেক্ষায় আছেন খুনিদের বিচারের প্রত্যাশায়। যাদের নির্দেশে একটা শান্ত জনপদ অশান্ত হয়ে গেল, সামাজিক সম্প্রীতি খান খান হয়ে গেল। দেশাভ্যন্তরে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের কালো মেঘ প্রলেপ করল, কে না চায় তাদের বিচার। সে বিচারের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জমিনে হবেই, ইনশাআল্লাহ।

২৮ অক্টোবর আমাদের প্রেরণার সুউচ্চ মিনার। ২৮ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আন্দোলনকে মনজিলে পৌঁছাতে হলে ত্যাগ কোরবানির বিকল্প নেই। আন্দোলন হলো একটি নির্মাণাধীন ঘর। শহীদেরা এ ঘরের চিরস্থায়ী খুঁটি। যারা জীবন্ত শহীদ হাত-পা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে বারবার তাকিয়ে একটি প্রত্যাশিত দিনের জন্য প্রতীক্ষা করছেন তারা ঘরের ছাদ। এখানে আন্দোলনের কর্মীরা ছায়া নেয়, উজ্জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে সম্মুখে এগিয়ে চলে সাহসের সাথে দ্বিধাহীন সোজা রাজপথে। এখানে কেউ কেউ এই ঘরের চিরস্থায়ী অধিবাসী হয়ে যান অনন্তকালের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণার চিহ্নস্বরূপ। এ পথে শাহাদাত, ত্যাগ, কোরবানি স্বাভাবিক পরিক্রমা। কেউ শহীদ কেউ বা গাজী। কারণ খোদাদ্রোহী জনপদকে বদলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ সমাজের নরখাদকদের মুখে এক প্রচণ্ড চাপেটাঘাত। আর মুক্তিকামী হেরার রাহের যাত্রীদের কাছে এর বিকল্প কোনো মঞ্জিল খোলা নেই।

কবি আল মাহমুদের কবিতায় (আমাদের মিছিল) সে কথার প্রতিধ্বনি যেন বারবার অনুরণিত হচ্ছে-

আমাদের এই মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্তকালের দিকে
আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,
শত সঙ্ঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি।
কে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথা যাব?
আমরাতো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্তকালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনোদিনই বিহবল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত।
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মোতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত।

তারিখ-১৯/০৯/১৯
zabbarics@gmail.com

শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ও ব্যবহারিক জীবন || ড. মোবারক হোসাইন

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ও ব্যবহারিক জীবন || ড. মোবারক হোসাইন

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা কি দেখ না আল্লাহ্ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।” (সূরা লুকমান : ২০) এ পৃথিবীতে আল্লাহ পাক যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহ পাকের গোটা সৃষ্টিজগৎ হলো পরিবেশ। পরিবেশ কথাটি আভিধানিক অর্থে ঠিকানা, অবস্থা এবং প্রকৃতিকে বোঝানো হয়া। আল্লাহ পাক কুরআনে পরিবেশের কথা বলেছেন নিম্নোক্তভাবে, যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না। (সূরা হাজ : ২৬) তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। (সূরা আরাফ : ৭৪) আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা বলেন, “যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।” (সূরা শামস : ৯-১০) ইসলাম ধর্ম হলো মানবতার জন্য বিশ্বজনীন এক ধর্ম। এ ধর্ম মানুষকে সর্বদা সুন্দর চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেয় সিদ্দীকগণের আমলসমূহের ভেতর এটা সর্বোত্তম। যারা নিজেদের জীবনকে সুন্দর ও ঠিক রাখবে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাদের মর্যাদা ও সম্মান দুনিয়া এবং আখেরাত দুই জীবনে উন্নতি হবে। ইসলাম মানুষকে কিভাবে নীতি-নৈতিকতার দিকে পরিচালিত করবে সে ব্যাপারে রয়েছে কিছু বিশ্বাস ও নীতিমালা।

– পরিবেশ ব্যতীত কোন প্রাণী বাঁচতে পারে না।
– পরিবেশ অনুযায়ী লোক তৈরি হয় না।
– লোক অনুযায়ী পরিবেশ তৈরি হয় না।
– তাই মানুষ তৈরির জন্য পরিবেশ মৌলিক শর্ত।
– পরিবেশ যত ভাল ও উন্নত হয় ততই ভাল মানুষ তৈরি হয়। ব্যবহারিক জিন্দেগির বাস্তব প্রতিফলন ঘটে Practical life-এ.
– ব্যবহারিক জীবন সাধারণত পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে প্রভাবিত হয়- যেমন পরীক্ষার হলে নকল প্রবণতা
– মুখের কথার চেয়ে নবী ও সাহাবীদের ব্যবহারিক জীবন দেখে লোকজন বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। হাদীস- “বুইসতু লিউতিম্মা মাকারিমাল আখলাখ।”
– একজন ঈমানদারের বাস্তব জীবন হবে রুচিসম্মত, সুন্দর, মার্জিত, অনুকরণীয়, আকর্ষণীয়

সংগঠনের উপাদান ৩টি
১. নেতৃত্ব
২. জনশক্তি
৩. কার্যবিধি

ইসলাম হলো :
ISLAM,
l S=Shall
l L=Love
l A=All
l M=Mankind
l I shall Love all mankind
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ধর্ম
ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম
ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থা

ইসলামী সংগঠন : যে সংঘ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাকে ইসলামী সংগঠন বলে।

ইসলামী সংগঠনের উপাদান :
১. ইসলামী নেতৃত্ব
২. ইসলামী কর্মী বাহিনী
৩. ইসলামী পরিচালনা বিধি

পরিবেশ বলতে কী বুঝি?
(What is environment?)
The environment includes factors outside the organization which can lead to opportunities for or threats to the organization
– Oxford Dictionary তে বলা হয়েছে।
Surrounding and conditions in which people.অর্থ চতুর্পাশ্ব এবং তার অবস্থা যেখানে মানুষ বসবাস করে।
The sorrounding or condition in which a person or any things livees or oparates
– আমরা সাধারণত : আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে তাকে পরিবেশ বলি।
– গোপালনাথ খান্না বলেন, “Environment as the sum of total effects the development and life of organism.”

ইসলামী সংগঠনের পরিবেশ :
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির আলোকে মানুষ যে কর্মতৎপরতা চালায় তাতে একটা অবস্থা সৃষ্টি হয় একেই বলে পরিবেশ।
তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত বা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে লক্ষ্য উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির আলোকে যে কর্মতৎপরতা চালায় তাতে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাকে ইসলামী সংগঠনের পরিবেশ বলে।
নেতা ও কর্মীর মাঝে কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাকে ইসলামী সংগঠনের পরিবেশ বলে। ইসলামে সাংগঠনিক পরিধি এবং তার অবস্থা যেখানে কর্মী, সাথী, সদস্য বা নেতা-কর্মী বসবাস করে।
সাংগঠনিকভাবে আমাদের চার পাশে আছে- সমর্থক, কর্মী, সাথী, সদস্য ও শুভাকাক্সক্ষী।
দায়িত্বশীল > কর্মী
কর্মী > দায়ীত্বশীল
দায়িত্বশীল ও কর্মী > সাধারণ এর সাথে। (সমর্থক, শুভাকাক্সক্ষী)।

ইসলামী পরিবেশ : ড. মাহমুদ সালেহ আদেলী বলেন, “মানবমণ্ডলীকে বেষ্টন করে আল্লাহ তায়ালার যে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ তাকেই ইসলামী পরিবেশ বলা হয়া। v”
ইসলামী পরিবেশ নির্ভর করে :
নেতা দায়িত্বশীলের আচরণের ওপর।
কর্মীদের আচরণের ওপর।
নেতা ও কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর।

পরিবেশের গুরুত্ব : ইসলাম পরিবেশকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। মিসরের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা সাইয়েদ তানতাবী তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনের মধ্যে পাঁচ শতবার পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে বলেছেন, এই পৃথিবী তোমাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তোমরা একে আবাদ কর। তিনি বলেন : ‘তিনিই জমিন হতে তোমাদেরকে পয়দা করেছেন এবং তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন।’ (সূরা হুদ : ৬১) পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবী আবাদ হতে পারে; মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে। আর পরিবেশ যখন সংরক্ষণ করা হবে না তখন এই দুনিয়া বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
পরিবেশ প্রধানত দুই প্রকার :

অভ্যন্তরীণ পরিবেশ (internal environment) : internal environment includes the forces inside the organization that can influence the organization and its performance. সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নির্ভর করে সংগঠনের নেতা ও কর্মীর পারস্পরিক প্রচেষ্টার ওপর। অভ্যন্তরীণ পরিবেশের জন্য সংগঠন এগিয়েও যেতে পারে, পিছিয়েও যেতে পারে। যেমন, সমর্থক, কর্মী, সাথী, সদস্য।

বাহ্যিক পরিবেশ(external environment): external environment includes the major forces outside the organization that influence the abilitiy to achive organizational goal. সংগঠনের বাইরের বিভিন্ন অবস্থা এবং পক্ষসমূহের কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ যা সংগঠনের কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করে।

বাহ্যিক পরিবেশ (external environment) : আবার দুই প্রকার
ক. কার্য পরিবেশ (Task environment) : বাইরের যে সকল পক্ষ সংগঠনের কাজের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে তাকেই কার্য পরিবেশ বলে। যেমন, শুভাকাক্সক্ষী, অন্যান্য ইসলামী সংগঠন, অন্যান্য ছাত্রসংগঠন, সকল পেশার মানুষ, সাধারণ মানুষ ইত্যাদি
খ. সাধারণ পরিবেশ (Genaral environment) : Genaral environment is the part of external environment composed of forces that have a general influence on the organizationa. সাধারণ পরিবেশ হলো বাইরের পরিবেশের সমন্বয়ে সৃষ্ট শক্তিসমূহ যা সংগঠনের কাজের ওপর সাধারণ প্রভাব বিস্তার করে। যেমন ভৌগোলিক উপাদান, অর্থনৈতিক উপাদান, কারিগরি উপাদান, সামাজিক উপাদান, রাজনৈতিক উপাদান, আইনগত উপাদান, আন্তর্জাতিক উপাদান।

সাংগঠনিক পরিবেশ বলতে আমরা কোন পরিবেশকে বোঝাবো:
ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা।
সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির অনুকরণ করা।
ভারসাম্যপূর্ণ কর্মসূচি পালন।
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ।
আদেশ আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করা।
বৈঠকের পরিবেশ :
Full concentration.
মতামত দেয়া এবং শুনা।
অনুমতি নিয়ে কথা বলা।
অনুমতি নিয়ে বাইরে যাওয়া।
নিজের মত (বাস্তবায়ন) সিদ্ধান্ত হিসেবে পেতে চৎবংংঁৎব না দেয়া।
যা সিদ্ধান্ত হবে, যার কথাই সিদ্ধান্ত হবে তা বাস্তবায়নে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়া।

জান্নাতি পরিবেশ : তিনটি
১. আখেরাতের কল্যাণের চিন্তা
২. দুনিয়াবি স্বার্থত্যাগের মানসিকতা
৩. সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য

দ্বীনি পরিবেশ সংরক্ষণে প্রতিবন্ধকতা :
আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব।
মান আসার পূর্বে মানোন্নয়নের চেষ্টা করা।
সাবেক দায়িত্বশীলদের দুর্বলতা।
মানসম্মত ও সময় উপযোগী দায়িত্বশীল তৈরি না হলে।
দায়িত্বশীল ও জনশক্তির মাঝে দূরত্ব থাকলে।

কাক্সিক্ষত পরিবেশের জন্য নেতার গুণাবলি :
১. জ্ঞানগত যোগ্যতা
২. যথাযথ শৃঙ্খলা বিধানের যোগ্যতা
৩. পরিচালনার যোগ্যতা
৪. জনশক্তির মাঝে মধ্যমণি হওয়া
৫. কর্মীর প্রেরণার উৎস হওয়া
৬. সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা
৭. ঊর্ধ্বতন সংগঠনের যথাযথ আনুগত্য
৮. সার্বিক দিক থেকে সংগঠনের গতিশীল করা যোগ্যতা অর্জন
৯. সামগ্রিক কাজে ভারসাম্য রক্ষা : এর জন্য
সময়ের সদ্ব্যবহার
পরিশ্রমপ্রিয়তা
কম কথা বেশি কাজ
৫ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো যাবে না

পরিবেশ বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ :
আদেশের সুরে কথা বলা
গিবত
হিংসা-বিদ্বেষ
কুধারণা
চোগলখুরি
কানাকানি ও ফিসফিসানি
মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
একগুঁয়েমি
সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতা
সঙ্কীর্ণমনতা

পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক বিষয় সমূহ :
দায়িত্বশীল কর্তৃক সকল জনশক্তিকে কাজে লাগানো।
গিবত মুক্ত পরিবেশ সংরক্ষণ করা।
কর্মসূচি পালনে কর্মপদ্ধতির অনুসরণ।
এহতেছাবের প্রচলন থাকা।
ইসলামী জ্ঞান অর্জনে প্রচুর বই পুস্তক থাকতে হবে।
কিছু ইসলামী স্কলারস তৈরি করা।
আমাদের ও সংবিধান অনুসরণ করা।
প্রাক্তন ভাইদের সাথে পরামর্শ করা।
দায়িত্ব পালনে সচেতন থাকা।
শহীদদের জীবনী জানা ও শাহাদাদের চেতনা।
দায়িত্বশীলদের উত্তম আমল ও উন্নত আচরণ।

পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের দুর্বলতা :
ধৈর্যের অভাব।
দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়া।
ইলম অনুযায়ী আমল না করা।
যোগাযোগের অভাব।
ভুল বুঝা বুঝি।
সময়ের অপচয়।
তত্তাবধানের নামে সীমা অতিক্রম করা। v br />দায়িত্বশীলের অদূরদর্শী মন্তব্য
সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে না পারা।
কর্ম বণ্টনে সুবিচার না করা।
দায়িত্বশীলদের লেন-দেন অপরিচ্ছন্নতা।
যথা সময়ে প্রোগ্রাম শুরু করতে না পারা।
সকল জনশক্তির ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে না পারা।
ইসলামী নীতি অনুসরণ না করা।

পরিবেশ সংরক্ষণ না হলে ক্ষতি :
সংগঠনের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে।
সংগঠনের গ্রহণ যোগ্যতা হ্রাস পায়।
জাতি সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
সকলের মাঝে ইসলামী দাওয়াতের প্রসার কমে যায়।
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়।
সাংগঠনিক সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায়।
বিরোধীদের অপপ্রচার বৃদ্ধি পায়।

নেতা দায়িত্বশীলের আচরণ বা ভূমিকা হবে :
বিনম্র্র ভাষায় নির্দেশ দিবেন।
নেতৃত্ব কর্মীদের সাথে আনুষ্ঠানিক আলাপ ও করবেন।
কোমলতা, উদারতা, ও ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন। আপনি বটবৃক্ষের মতো বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হবেন। আপনার ছায়ায় ঘুমোবে, যাওয়ার সময় একটা ডালও ভেঙে নিয়ে যাবে।
সবাইকে সমান গুরুত্ব দেয়া ও সমান ভালোবাসা দেয়া। সবাইকে আপন করে নেয়া। Gift দেয়া; Wish করা, উৎসাহ দেয়া
প্রাপ্য অনুযায়ী মর্যাদা দেয়া।
সকল জনশক্তিকে প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখা।
জনশক্তির মানোন্নয়নের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা।
যে কোন সমস্যায় তাৎক্ষণিক সমাধান। এক্ষেত্রে যোগ্য ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।
জনশক্তিদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করা। এটা যেন গিবতের পরিবেশ না হয়।
এহতেসাব বা গঠনমূলক সমালোচনা করা।
সকল ক্ষেত্রে সংগঠনের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া।
পরিবেশ বিনষ্টকারী গুণাবলি থেকে সংগঠনকে হেফাযত করা।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বিধানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া।
দূরদৃষ্টি, যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরবর্তী পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারা।
কর্মী, সদস্য বানানো, বাতিল বা স্থানান্তরের জন্য-
বৈঠকের সিদ্ধান্ত যথাযথ বাস্তবায়ন করা।
সিদ্ধান্ত কোনভাবেই যেন বাইরে না যায়।
পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
দায়িত্বশীল বাছাই করতে ভুল না করা।One man preparation
– Nursing not for one man but for a teamস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দায়িত্বশীল বানাতে হবে।
আঞ্চলিক চেতনা কঠোর হাতে দমন করা।
কোন অভিযোগ শুনা মাত্র কমান্ড না করা।
জনশক্তির বক্তব্য ধীরস্থিরভাবে শুনা।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিজের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।

ব্যবহারিক জীবন :
ব্যবহারিক জীবন হলো এমন মূল্যবোধ যে অনুযায়ী মানুষের আচরণ হওয়া প্রয়োজন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল ওয়াদুদ মাকরূম বলেছেন, “ব্যবহারিক জীবন হচ্ছে আচরণের রীতি-নীতির সমষ্টি, যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত ও সংহত করে এবং যাকে চিন্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে মানুষের অনুসরণ করা উচিত।” রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, “তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” (মুসলিম)
ব্যবহারিক জিন্দেগির বিভিন্ন দিক
ব্যক্তিগত জীবন
সাংগঠনিক জীবন
পারিবারিক জীবন
সামাজিক জীবন

ব্যক্তিগত জীবন : 
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা হাদীস “আত্তুহরো সাতরুল ঈমান” একদিন এক ব্যক্তিকে রাসূল (সা) বললেন, আপনি যে চুল রাখছেন, চুলের হক্ক কী? তখন লোকটি বলল হে রাসূল, জানি না; তখন রাসূল (সা) বললেন, ঘুম থেকে ওঠার পর ও ঘুমানোর পূর্বে মাথা দু’বার আঁচড়াবে।” এমনকি হাদীসে কাঁচা পেঁয়াজ খেয়ে মসজিদে যাওযা নিষেধ করা হয়েছে।

শৃঙ্খলাবদ্ধতা : সকল কিছু পরিপাটি সাজানো গুছানো থাকবে। খাওয়া, ঘুম, লিখাপড়া, বই পুস্তক, কাপড় চোপড়, রাখা টেবিল চেয়ার ইত্যাদির মধ্যে যেন কোন বিশৃঙ্খলা না থাকে।- সব কিছুতে সুশৃঙ্খল না হলে অনেক সময় ডায়েরি খুঁজতে চাবি নেই, চাবি খুঁজতে অমুক নেই ইত্যাদি। সবকিছু সুশৃঙ্খল হলে মন ভালো থাকে, সময়ের অপচয় হয় না।

ক্রোধ দমন করা : একটি ঘটনা জনৈক ব্যক্তির ছেলে সকাল থেকে তিন তলার ওপর কাজ করছে। সে তার ছেলেকে বার বার বলছে এত রৌদ্রে কাজ না করার জন্য। কুরআন : হামিম আস সাজদা- ৩৬ অর্থ : যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হন, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। হাদীস : তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি বীর নয় যে কাউকে গায়ের জোরে হারিয়ে ফেলে বরং বীর ঐ ব্যক্তি যে রাগকে হজম করে। একবার হযরত আলী (রা) একজন লোকের বুকে ছুরি চালানোর সুযোগ পেয়েও বাদ দিলেন…..

ত্যাগী মনোভাব : আত্মত্যাগ, আর্থিক কোরবানি, আরাম আয়েশের কোরবানি, স্বভাব প্রকৃতির কোরবানি। কুরআন : সূরা হাসর : “এবং তারা নিজের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা রয়েছে অনটনের মধ্যে। হাদীস : অভাব-অনটনে আত্মত্যাগ : “একদিন রাসূলে করীম (সা) এর কাছে একজন ক্ষুধার্ত লোক এলো। তখন হযরতের গৃহে কোন খাবার ছিল না। তিনি বললেন : যে ব্যক্তি আজ রাতে এ ব্যক্তিকে মেহমান হিসেবে রাখবে, আল্লাহ তার প্রতি করুণা বর্ষণ করবেন। হযরত আবু তালহা লোকটিকে নিজ ঘরে নিয়ে গেলেন।…
সকালে রাসূলে করীম (সা) খেদমতে হাজির হলে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার এ সদাচরণে অত্যান্ত খুশি হয়েছেন; এবং এ আয়াত পড়ে শুনালেন।” জিহাদের ময়দানে আত্মত্যাগ : মুতার যুদ্ধ প্রথম-ষষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নিজে পানি পান না করে অপরের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকলেই জীবন দিলেন।
কুরআন : “তোমরা একে অপরকে অগ্রাধিকার দান কর।” আরে ইমরান ৯২ : তোমরা কস্মিনকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় না কর। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন।
ইমরান ২০০ : হে ঈমানদারগণ ধৈর্যধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর, আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারো।

সবর ও তায়াক্কুল : সবরের কয়েকটি অর্থ : ইমরান ২০০ : ইয়া আইয়্যুহাল লাজিনা …
সূরা আসর তায়াক্কুল 
কঠিন থেকে কঠিন অবস্থায় আল্লাহর ওপর তায়াক্কুল করা। হিজরতের সময় গুহার ভেতর রাসূল (সা) এর অবস্থান। ইবরাহিম (আ) কে আগুনে ফেলার পর যখন ফেরেস্তা এসে সাহায্য করতে চেয়েছিল তখন ফেরেস্তার ওপর ভরসা না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করেছিলেন।- ফেরাউন যখন মূসা (আ) কে দৌড়িয়ে নিয়ে সমুদ্রের ধার পর্যন্ত যাওয়ার পর আল্লাহর ওপর তায়াক্কুল করায় তা হাতের লাঠির ইশারায় সমুদ্রে ১২টি গোত্রের জন্য ১২টি রাস্তা হয়ে যায়।

দৃষ্টিশক্তির হেফাজত :
সূরা নূর- “মুমিনদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।” চোখের জেনার শাস্তি হচ্ছে : কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে চোখের জেনা করলে সীসাকে জ্বালিয়ে তার চোখে ছেঁকা দেয়া হবে।”

 বাকশক্তি বা জবানের হেফাজত : হাদীস “তোমরা হয় ভালো কথা বল নতুবা চুপ থাক”, “তোমরা যদি ২টি জিনিসের জিম্মাদারি হও তবে আমি জান্নাতের জিম্মাদারি হবো।
 যৌনশক্তি ও বাকশক্তি।” রাসূল (সা) বলেন, “কোন কটুভাষী ও বদস্বভাববিশিষ্ট লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কোন মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকি আর তার সঙ্গে লড়াই করা ফাসেকি।” একদা রাসূল (সা) মায়াজকে বিভিন্ন নসিহত করার পর নিজের জিহবা আঁকড়ে ধরে বললেন, “তোমার কর্তব্য হচ্ছে একে বিরত রাখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যা কিছু বলা-কওয়া করি সে সম্পর্কেও কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? তিনি বললেন : জবানের কামাই ছাড়া আর কোন জিনিস মানুষকে দোজখের আগুনে নিক্ষেপ করবে?”
“আর বদনাম করো না বিকৃত উপাধির সঙ্গে, ঈমানের পর বিকৃত নামকরণ হচ্ছে বদকারী।” “কিয়ামতের দিন আমার দৃষ্টিতে সবচাইতে অভিশপ্ত এবং আমার থেকে সবচাইতে দূরে থাকবে বাচাল, অশ্লীলভাষী, ইলমের মিথ্যা দাবিদার, এবং অহঙ্কারী ব্যক্তিগণ।

 রিয়া বা অহঙ্কার মুক্ত মন : সূরা বনি ইসরাইল- ৩৭, লোকমান-৩ “জমিনে দাম্ভিকতার সাথে চল না”, নিশ্চয়ই তুমি ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।”

 আড়ম্বরহীন জীবন : সূরা লোকমান-১৯ পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।

 প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল গুনাহ থেকে রক্ষা : সূরা নাজম-৩২ যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কার্য থেকে বেঁচে থাকে ছোটখাটো অপরাধ করলেও নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তার ক্ষমা সুদূর বিস্তৃত। তিনি তোমাদের সম্পর্কে ভালো জানেন, যখন তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা থেকে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে কচি শিশু ছিলে। অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা কর না। তিনি ভালো জানেন কে সংযমী? সূরা আনআম-১৫১ : নির্লজ্জতার কাছেও যেও না, প্রকাশ্যে হোক কিংবা অপ্রকাশ্যে।
আত্মসমালোচনা
আত্মপর্যালোচনায় অভ্যস্ত হওয়া
নিজেকে যাচাই করা
হাদীস : “তুমি নিজেকে এমনভাবে যাচাই কর যাতে অন্যের দিকে চাওয়ার সুযোগ না থাকে।”
পরিকল্পিত জীবন

কথা ও কাজের মিল :
মিল না থাকা মুনাফিকির লক্ষণ
ত্যাগের বক্তৃতা কাজে নাই
ঈমানদারের বাস্তব জীবন হবে কথা ও কাজের মিল
মুনাফিকের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম


সাংগঠনিক জীবন :
সহযোগীদের সাথে ব্যবহার : তিনটি নেক কাজে পাপ কাজ মার্জনা হয়:
ক. সরল ব্যবহার
খ. প্রফুল্ল মন
গ. মিষ্টি ভাষণ
– শত ব্যস্ততার মাঝেও অপর ভাইকে দেখলে সালাম দেয়া হাত মেলানো, হাসিমুখে কথা বলা। কেউ রোগাক্রান্ত বা অভাবগ্রস্ত হলে দেখতে যাওয়া
সহনশীলতা ও উদারতা : সূরা ইমরান-১৫৯ আরাফ- ১৯৯। একটি ঘটনা : একজন লোক মসজিদে নববীতে প্রস্রাব করে চলে যাচ্ছিল।
যাচাই না করে শুনা কথার ওপর ধারণা না করা : বনি ইসরাইল-৩৬ জাকাত আদায়ের ঘটনা-

পারিবারিক জীবন :
মাতা-পিতার প্রতি ব্যবহার : হাদীস “আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর নিকট প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন, নামাজ, আবার প্রশ্ন করলেন পর পর দুইবার বললেন মাতা-পিতার খেদমত ও জিহাদ করা।”
মায়ের পদতলে জান্নাত
তোমরা মাতা-পিতাকে গালি দিও না
দুনিয়ায় একমাত্র নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাস মাতা-পিতাকে
বিরোধী মাতা-পিতার জন্যও দোয়া কর। (আবু হুরাইরার ঘটনা)
আমাদের ব্যবহারে যেন পিতা-মাতার মন থেকে আহ শব্দও বের না হয়।

ভাইবোনদের প্রতি ব্যবহার :
আত্মীয়স্বজনদের প্রতি ব্যবহার :
সামাজিক জীবন
মন্দের মোকাবেলায় উত্তম আচরণ : Tit for tat ঈমানদারদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
হামিম আস সাজদা : ৩৪-৩৫। ভালো ও মন্দ সমান নয়। জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা আছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয় যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান।
প্রতিবেশীর সাথে ব্যবহার। হাদীস : “সেই ব্যক্তি মুসলমান যার হাত ও মুখ হতে প্রতিবেশী নিরাপদ, যারা মুসলমানদের কষ্ট দেয় তাদেরকে কেয়ামতের দিন পাকড়াও করা হবে।” “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন প্রতিবেশীকে সম্মান করে।”
“যে ব্যক্তি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
সাহায্য চাইলে দেয়া
জানাজা পড়া
খোঁজ খবর নেয়া
বিয়ে শাদি অনুষ্ঠানাদিতে সাহায্য করা
চাকর-বাকরের প্রতি ব্যবহার : “তোমরা যা খাও ও পর চাকরদেরও তা খাইতে ও পরতে দাও।” একটি ঘটনাÑ হযরত উমর (রা) এর উট টেনে নিয়ে যাওয়া

বিরোধীদের সাথে ব্যবহার :
অন্যান্য
শিক্ষক-কর্মচারী
রোগীদের প্রতি
রিক্সাওয়ালা
ফকির বা সাহায্যপ্রার্থী
পশুপক্ষী
গাছপালা

লিও টলস্টয় ও মার্কিন তরুণীর দৃষ্টিতে : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় যখন নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাস্তার ধারে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন, সে সময় তার কোটের পকেট থেকে তার নিত্য সময়ের সঙ্গী যে বইটি পাওয়া যায়, সেটি ছিল আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী লিখিত ‘দ্য সেয়িংস অব প্রফেট মহাম্মদ (সা)। বাংলায় যার শিরোনাম ‘মহানবী (সা)-এর বাণী’ বইটির একটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (সা) বলেছেন ‘তুমি নিজের জন্য যা ভালো মনে করবে, অন্যের জন্যও তা ভাববে। আর যা নিজের জন্য মন্দ মনে করবে, অন্যের জন্যও তাই মনে করবে। (বুখারী ও মুসলিম)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর আবদুর নূর ‘আয যিকর ওয়াল ফালাহ গ্রন্থে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন : ‘এক মার্কিন তরুণী দীর্ঘ দুই বছর মেলামেশার পর, তার বাংলাদেশী পুরুষ বন্ধুকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বন্ধুটি বলে যে, সে রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান। তাই তাকে বিয়ে করতে মেয়েটিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হতে হবে। মার্কিন তরুণীটি ইসলাম ধর্ম কী, তা বুঝতে চাইলো। ছেলেটি তাকে আল্লামা আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী কর্তৃক ইংরেজি অনূদিত পবিত্র কুরআন শরিফের একটি কপি দিয়ে বললো যে, এটি পড়লে ইসলাম সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারবে। দুই মাস কুরআন অধ্যয়নের পর মার্কিন তরুণীটি এসে জানালো, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করবো। ইসলামের সৌন্দর্য ও সমন্বিত নীতিমালা আমাকে আকর্ষণ করছে। এ ব্যাপারে আমার মা-বাবার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাকে আর বিয়ে করতে পারব না। কারণ তোমার আচার-আচরণ লক্ষ্য করছি সম্পূর্ণ কুরআন-পরিপন্থী। রুশ দেশীয় লিও টলস্টয় ও মার্কিন তরুণী যা বুঝতে ও অনুধান করতে পারছেন, মুসলমানরা সেটা কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে?
সমাজে তিন ধরনের মানুষ বসবাস করে তাই তাদের দাওয়াত দিতে হলেও তিন ধরনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এই তিন ধরনের ব্যক্তিরা হলেন
1. First Mover 2. First Flower 3. Late Mover
1. First Mover যারা তারা প্রথম শ্রেণীর লোক। তারা সবকিছু আগে শুনে করে। তাদের কাছে দাওয়াত দিতে হলে দায়ীকে সেভাবেই চিন্তা করতে হবে।2. First Flower যারা কোনকিছু আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে অনুসরণ করে। 3. Late Mover যারা তারা সবকিছু ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে তাদের দাওয়াত দিতে হবে।

জীবনে চলার পথে ধ্রুব সত্য :
স্বার্থবাদী এক অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ I এড়িয়ে চলুন সন্তুষ্টজনক দুই অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ We সর্বদা ব্যবহার করুন, তিন অক্ষরবিশিষ্ট দূষিত শব্দ Ago ধ্বংস করুন বহুল ব্যবহৃত চার অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Love মুল্যায়ন করুন আনন্দদায়ক পাঁচ অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Smile সর্বদা ধারণ করুন দ্রুতবেগে ছড়ানো ছয় অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Rumour অবজ্ঞা করুন শ্রমসাধ্য সাত অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Success অর্জন করুন ঈষার্ধ উদ্রেককারী আট অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Jealousy দূরে থাকুন সবচেয়ে শক্তিশালী নয় অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Knowledge অধিকার করুন সবচেয়ে দরকারি দশ অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ Confidence বিশ্বাস করুন
সুতরাং আগামী দিনে ইসলামী বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হলে মানুষের পরিবেশ ও মেজাজ বুঝে সাংগঠনিক কাজ করতে হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর সকল প্রাণীর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই আখলাকে হাসানার উপাদানগুলো অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বকে ধরে রাখতে পারে।


লেখকঃ-
ড. মোবারক হোসাইন
এমফিল গবেষক ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি 
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির