Close

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র


আমাদের কেহ তিতুমীর হয়ে জালিমের কন্ঠ রুখবে...
আজ শহীদ তিতুমীরের ১৮৮ তম শাহদাতবার্ষিকী। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর, আজকের এই দিনে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি (১১৮৮ বঙ্গাব্দ, ১৪ মাঘ) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীরের প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরোধী আন্দোলন ও তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশেরকেল্লাতেই শাহাদাৎ বরণ করেন ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে।

সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী শহীদ (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ড-স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজও এদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ ও নির্যাতনমূলক শাসন নির্মূল করে এ দেশে আদর্শভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন।

তিতুমীরের সাথে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজ সাহেবদের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরের অব্যর্থ নিশানা। ইংরেজ পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। প্রায় ৫০০ জমিদার সৈন্য ও ইংরেজ পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসেন কর্নেল স্কট। ১৮৩১ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাছে পৌঁছে তা ঘিরে ফেলে। বহু গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিতুমীরের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।তিতুমীর অসীম বীরত্বের সাথে এই সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ইংরেজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেল্লার সামনে বীরবিক্রমে জুলুমের মোকাবিলা করে ১৮৩১ সালের ১১ নভেম্বর তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হন তার সঙ্গী-সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইংরেজদের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীতে তিতুমীরের ২২৫ জন অনুসারীর বিচারে জেল হয়।

১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তাঁরা বাঁশেরকেল্লা তৈরি করেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ অঞ্চলের মানুষ মারাঠা আর বর্গীদের দ্বারা লুন্ঠিত এবং পশ্চিমবঙ্গের অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের হাতে নিস্পেষিত হয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ছিল। বাঙ্গালী মুসলমানদের উপর বেশ কয়েকজন হিন্দু জমিদার নানা ধরনের অত্যাচার করত, নিবর্তনমূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মুসলমানদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে পূঁজার পাঁঠা জোগাতে হতো, কেউ দাঁড়ি রাখলে সেজন্য চাঁদা দিতে হতো, মসজিদ নির্মাণ করলে কর দিতে হতো, এমনকি কেউ গরু জবাই করলে তার ডান হাত কেটে দেয়ার ঘটনাও কম ছিলনা। এই পটভূমিতে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের পক্ষে প্রতিবাদের আন্দোলন গড়ে তোলেন মীর নেসার আলী তিতুমীর।

ভারতীয় উপমহাদেশে তখন চলছিল ইংরেজ বিরোধী জিহাদ আন্দোলন। বাংলাদেশ থেকেও জিহাদ আন্দোলনে লোকজন শরীক হতেন। তিতুমীরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যে, বাংলার মুসলমানদের ইমান ও আকিদার দিক থেকে সবল করে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে শক্তিশালী করেই তবে তাদের মধ্যে জিহাদের আহবান জানানো যেতে পারে। তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে তিনি জনগণকে সচেতন করতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারকাজে অভাবিত জাগরণ দেখা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসন সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই দুটি ছিল তাঁর মৌলিক কর্মসূচী। তাঁর আহবান ছিল বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদ সংস্কার করে নামাজের ব্যবস্থা করা, পূঁজার চাঁদা দান কিংবা তাতে অংশ নেয়া থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা, শিরক-বিদায়াত হতে দূরে থাকা, মুসলমানদের মুসলিম নাম রাখা, মুসলমানদের ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি বা পাজামা পরা, পীরপূঁজা ও কবরপূঁজা না করা ইত্যাদি। তিতুমীরের ধর্মীয় দাওয়াতের মূলকথা ছিল, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) নির্দেশ পরিপালন সম্পর্কিত। এটি ছিল মূলত ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুণর্গঠনের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচী।

তিতুমীর থাকতেন সরফরাজপুর গ্রামে। গ্রামবাসীদের ওপর জমিদারের বারবার আক্রমণ ও অত্যাচারের কারণে তিনি নিজেই সে গ্রাম ছেড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে। ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি দলবলসহ নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে যান। সেখানে চারিদিক থেকে অব্যাহত হামলার কারণে তিতুমীর তার আস্তানাটিকে নিরাপদ করার জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লা। নারিকেলবাড়ীয়ার পরিত্যক্ত একটি মসজিদকে সংস্কার করে সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ চালু করেন। তাঁর নেতৃত্বে নদীয়া ও ২৪ পরগণা জেলার অনেক এলাকার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। স্বভাবতই এটা জমিদারদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর সহস্রাধিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে আসেন। তিতুমীর তাঁর অনুসারীদের জীবনরক্ষার্থে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এভাবেই বাঁশেরকেল্লা নামক দূর্গটির নাম ছড়িয়ে পড়ে। নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে এসে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার স্বয়ং নিহত হন। শেষে জমিদারদের বাহিনী পিছু হটে যায়।জমিদারদের বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকারের ওপর তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানের পক্ষে চাপ বাড়তে থাকে। খ্রিস্টান পাদ্রী, জমিদার ও নীলকররা অব্যাহতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। শেষে ইংরেজ সরকার তিতুমীরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর মেজর স্কটের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী নারিকেলবাড়ীয়া অবরোধ করে। যুদ্ধ শুরুর আগে ইংরেজ বাহিনী ও তিতুমীরের মধ্যে একটি সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। সংলাপে অংশ নেয়া তিতুমীরের প্রতিনিধি সম্ভবত ইংরেজী জানতেননা। ফলে সংলাপে তিতুমীরের বক্তব্যকে ইংরেজ মেজরের কাছে উপস্থাপন করছিলেন রাজচন্দ্র নামক জনৈক দোভাষী। দুঃখজনকভাবে দোভাষী তিতুমীরের পক্ষে বক্তব্যকে এমন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল যে এতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মেজর স্কট গুলীর নির্দেশ দেন। মূলত ইংরেজ বাহিনীর সুসজ্জিত আধুনিক অস্ত্রের সামনে তিতুমীরের লাঠি আর তীর সড়কি ছাড়া কোন অস্ত্রই ছিলনা। তবে গুলীর মুখে এই দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষগুলি পিছে হটেনি। ইংরেজ বাহিনীর গুলীর মুখে তিতুমীর ও তার সঙ্গীরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। নির্বিচাওে গুলী চালাতে থাকে ইংরেজ সৈন্যরা।

গুলীতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র গরহর আলীসহ ৫০ জন নিহত হয়। ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রাম তল্লাসি করে আরও ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এলাকার বাড়ীঘরগুলিতে আগুন দেয়া হয়। তিতুমীরসহ মৃতদেহগুলিকে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে তাঁদের শহীদ হিসেবে কেউ সম্মান দেখাতে না পারে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৯৭ জনের বিচার হয়। তন্মধ্যে তিতুমীরের প্রধান সহকারী গোলাম মাসুমের প্রাণদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন, ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। বিচারকালে ৪ জনের মৃত্যু হয়। এই অসম যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি নিজেই বলেছেন, যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি সত্য, কিন্তু জীবন দিয়েছে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক এক মহাপুরুষ। তিতুমীর সম্পর্কে ইংরেজ অনেকেই মনে করেন তিতুমীর সাধারণ একজন লাঠিয়াল ছিলেন। আসলে তা নয়, তিতুমীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলার নিরীহ মুসলমানদের এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে বারবার আক্রমণ করে শেষে জীবন রক্ষার জন্য হাতে লাঠি নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। দরিদ্র মুসলিম ও সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কথা বলে তিতুমীর টিকে থাকতে পারেননি সত্য। তাই বলে তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। ঘটনার ২৫ বছর পর ১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতার বিদ্রোহকেও ইংরেজ সরকার নির্মমভাবে দমন করেছিল। সেই ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অত্যাচারী জমিদাররাও আর নেই। আছে শুধু তিতুমীর ও তার বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতিহাস।
-বাশেরকেল্লা ফেইসবুক পেজ থেকে।