Close
জীবনী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জীবনী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১

শহীদ আব্দুল মালেক : প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী



হীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও বীর সেনানী।শহীদ আব্দুল মালেক একটি নাম,একটি প্রেরণা, একটি বিশ্বাস, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি মাইলস্টোন।পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ১৯৬৯ সালে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়েই ঢাকায়  ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলার পন্থীদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ১৫ আগস্ট শাহাদাৎ বরণ করেন ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের তাৎপর্য ছাত্র সমাজের কাছে তুলে ধরা এবং তাঁর আত্মত্যাগ থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার নিমিত্তে ইসলামী ছাত্রশিবির এ দিনটিকে ‘ইসলামী শিক্ষা দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর পালন করা আসছে।

শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও ঘটনা:

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান ঝুড়ে ব্যাপক গন-অভ্যুত্থান দেখা দেয়।ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করেন।এরই এক পর্যায়ে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোট প্রকাশিত হয়।এই রিপোট প্রকাশিত হবার পর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়।ছাত্র সমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবী তুলে।শহীদ আব্দুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আব্দুল মালেকের প্রতিনিধি দলের পর দেশের অন্যান্য আরও সংগঠন একই দাবি তুলেন।সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন।গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষা নীতিও ঘোষণা করেন, ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।কিন্তু বাধসাদে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা।তারা এ শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবি জানায়।এমনই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়।জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২ আগস্ট “National Institute of Public Administration” (NIPA) এর উদ্যোগে সরকারের পক্ষ থেকে ‘‘শিক্ষার আদর্শিক ভিত্তি’’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে।।ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন আব্দুল মালেক সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৫ মিনিটের বক্তব্যে বামপন্থী সকল ছাত্র সংগঠনের সকল যুক্তিকে হার মানিয়ে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ইসলামী শিক্ষার পক্ষে মতামত প্রকাশ করায় সেকুলার মহল মরিয়া হয়ে উঠে।ছাত্রদের এ মতামতকে বানচাল করার জন্য পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে ডাকসু কর্তৃক ১২ আগস্ট আরো একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।এর মূল আয়োজক ছিল বামপন্থী শিক্ষকরা।তারা সেখানে আব্দুল মালেককে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।আব্দুল মালেক তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে টিএসসির আলোচনা সভা স্থলেই তার প্রতিবাদ করেন।এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রুপ লাভ করে। সংঘর্ষ এক পর্যায়ে থেমে যায়।কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আব্দুল মালেক ও তার কতিপয় সঙ্গীকে টিএসসির মোড়ে সেকুলারপন্থীরা হামলা করে এবং রেসকোর্সে এনে তার মাথার নীচে ইট দিয়ে উপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে এবং অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে চলে যায়।ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দান করে।আব্দুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।কিন্তু তার আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে,১৫ আগষ্ট তিনি শাহাদাৎ বরন করেন।

ইসলামী শিক্ষার পক্ষে শহীদ আব্দুল মালেকের অবস্থানের যৌক্তিকতা:

শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রধান সোপান,জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি,জাতীয় ঐক্যের প্রতীক,জনগনের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের বিভাজন দূরীকরণের সহায়ক শক্তি এবং জাতীয় মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নের রুপকার।জনগনের সকল প্রকার আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দীপক ও প্রেরণাদানকারী শক্তি হিসেবেও কাজ করে শিক্ষা ব্যবস্থা।শুধু তাই নয় জনগনকে তার সর্বোচ্চ ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত করণে শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিসীম ভূমিকা থাকে।জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে শিক্ষা ব্যবস্থা অদম্য প্রত্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে জনগনের মধ্যে শক্তি যোগায়।মূলতঃ শিক্ষা ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে একটি দেশের গোটা জাতীয় সত্তার কাঠামো।কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত না হওয়ায়  আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আদর্শিক শূর্ন্যতা,নৈতিক দুর্বলতা,ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভাজন,আগামী প্রজন্মের মধ্যে হতাশা,জাতীয় উন্নতিতে স্থবিরতা,জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অশান্তি,বিশৃংখলা ও অস্থিরতা ইত্যাদি ইত্যাদি।এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং ভবিষ্যতে এর সুদূর প্রসারী  আরো নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে সেদিন শহীদ আব্দুল মালেক  ইসলামী শিক্ষার পক্ষে তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

ইসলামী শিক্ষার সুদুরপ্রসারী প্রভাব:

শিক্ষাকে বলা হয় একটি জাতির মেরুদন্ড।যা জাতিকে খাড়া রাখে কিংবা পড়ন্ত অবস্থা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়।এটা তখনই সম্ভব হয় যখন ঐ জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী।মিশরীয় দার্শনিক Professor Muhammad kutub তাঁর “ The Concept of Islamic Education” প্রবন্ধে বলেছেন,“শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করা,গড়ে তোলা এমন একটি কর্মসূচী যা মানুষের দেহ,তার বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা,তার বস্তুগত ও আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের একটিকেও পরিত্যাগ করেনা,আর কোন একটির প্রতি অবহেলাও প্রদর্শন করেনা”।

ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি হল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত।যা সর্বস্তরে উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন, নির্লোভ, সৎ,যোগ্য ও দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরী করে।মানুষের হাত-পা, মনন ও মস্তিষ্ক সবকিছুকে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে থাকে।মানুষের ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে।ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শয়তানের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ চলে।কেননা শয়তান সর্বদা পৃথিবীতে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়।এমতাবস্থায় ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি শয়তানের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সর্বদা পৃথিবীকে সুন্দরভাবে আবাদ করতে চায়।ফলে পৃথিবীর জীবন পদ্ধতি অনেক সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়।

অপরদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এর বিপরীত হয়, তাহলে ঘুণে ধরা বাঁশের মত জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে।আজকের পৃথিবীতে বড় বড় অশান্তির মূল কারণ হল শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ।যাদের শিক্ষায় আল্লাহভীরুতা নেই, আখেরাতে জবাবদিহিতা নেই।স্রেফ রয়েছে দুনিয়া সর্বস্বতা।ফলে শিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে মানবীয়গুনাবলীর বিপরীতে দানবীয় গুনাবলী সৃষ্টি হচ্ছে।তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কোন ঘাটতি না থাকলেও,সততা ও নৈতিকতার দিক থেকে তাদের অবস্থান অনেকটাই শুন্যের কোটায়।এই শ্রেনীর মানুষগুলোই দুনিয়াতে ভদ্রবেশে সকল প্রকার শয়তানী অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।একটি দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহন করতে  কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই।আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের কোন সরকারের জন্য তা অপরিহার্যও বটে।

শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের প্রভাব:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবতঃ আব্দুল মালেক ভাইয়ের মত মেধাবী ছাত্র নেতার শাহাদাৎ এর আগে ঘটেনি।ফলে আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতে গোটা দেশ স্তব্দ হয়ে যায়।সর্বমহলে এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদ পত্র তার সাক্ষী।আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্রনেতা আব্দুল মালেকের শাহাদাতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। এছাড়াও সকল জাতীয় নেতারা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিল।এ থেকেই বুঝা যায়,শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাৎ কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

শহীদ আব্দুল মালেকের জানাযা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে।আওলাদে রাসূল (সা)সাইয়েদ মোস্তফা আল মাদানী জানাযার ইমামতি করেন।জানাজার পূর্বে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন- “শহীদ আব্দুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।বিশ্ববরেন্য ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ)তার শোক বানীতে মন্তব্য করেন, “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নিবে”।তার এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল।

সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “আব্দুল মালেকের মতো একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শহীদ হবার ফলে গোটা আন্দোলনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে,নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি না হলে এতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতোনা।আব্দুল মালেকের শাহাদাত আর পরবর্তী শাহাদাতের তুলনা করলে এটাই দেখি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাতের ফলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল” ।তিনি আরো লিখেছেন, “আব্দুল মালেক জীবিত থেকে এই আন্দোলনের জন্য যে অবদান রাখতে পারতেন শহীদ হয়ে যেন তার চাইতে বেশী অবদান রেখে গেলেন।তা্র এ শাহাদাতের প্রেরণায় আন্দোলন যতদূর অগ্রসর হয়েছে,যত লোকের মধ্যে শাহাদাতের জযবা সৃষ্টি হয়েছে তার মতো যোগ্য কর্মী বেঁচে থাকলেও তিনি যতো যোগ্যই হোন না কেন তার একার জীবনে এতো বড় প্রভাব এবং আন্দোলনে এতটা গতি দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ”।শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.)বলেছিলেন-‘‘আব্দুল মালেক এদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’’

আব্দুল মালেক ভাইকে শহীদ করার মাধ্যমে সেদিন সেকুলার পন্থীরা ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষে আওয়াজ তোলাকে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা সাময়িক বাস্তবায়িত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী তাদের জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।যে কোন আন্দোলনের কোন ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যক্তি যখন শহীদ হন তখন সে আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া সম্ভব হয়না বরং উল্টো সে আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যারা ভীরু এবং কাপুরুষ তারা পিছিয়ে যায়।আর যারা এ আন্দোলনকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিটকে যারা বুঝে আগের চাইতে তারা আরো দ্রুত এগিয়ে যায়।তাছাড়া এ অবস্থায় আন্দোলনে নতুন নতুন লোকও এগিয়ে আসে।বাস্তবে এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।এক আব্দুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আব্দুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে।এক আব্দুল মালেকের শাহাদাতের ফলে আন্দোলন শত শত আব্দুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে-প্রানে শাহাদাৎ কামনা করে।এটা যে কোন আন্দোলনের জন্য সত্য আর ইসলামী আন্দোলনের জন্য বেশী সত্য।শহীদ আব্দুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তব্ধ করা যায়নি।বরং এক মালেকের রক্ত বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।লক্ষ-কোটি মালেক আজ একই আদর্শের ছায়াতলে সমবেত।সুতরাং শহীদ আব্দুল মালেকের খুনীরা আজ অভিশপ্ত, ঘৃণিত এবং পরাজিত।জাতি তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী শহীদ আব্দুল মালেক:

একজন মানুষ এ ভূবনে স্ব-মহিমায়, জ্ঞানে, ধ্যানে, চিন্তা-চেতনায় কত উজ্জ্বল ভাস্বর হতে পারে শহীদ আব্দুল মালেক তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে অনাগত পৃথিবীর কাছে।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন, ছাত্রজীবন,সাংগঠনিক জীবন,তাঁর লেখনি, চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান,  দায়িত্বশীলদের সাথে মেলামেশা, সহপাঠি ও বন্ধুদের প্রকাশিত লেখায় মাধ্যমে যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে তাতে একথা নিদ্ধিধায় বলা যায়, শহীদ আব্দুল মালেক হচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রেরনায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এক অনুপম আদর্শ।তাইতো শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন- “শহীদ আব্দুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা যোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল।একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র মহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশী প্রিয় ছিল।যথাসম্ভব নিয়মিত ক্লাসে হাজির হওয়াই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরীক্ষায় ভাল করার জন্য তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিলনা।ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল।ক্লাসের বাইরে তাঁকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ-আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না।তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না।খুব ভাল রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে।

ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান প্রজন্মের কর্মীদের অনুপ্রেরনার জন্য শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের জীবনের কিছু খন্ড চিত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হল।

১.অদম্য মেধা:

বাড়ীর পাশের খোকসা বাড়ির প্রাইমারি স্কুল থেকে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।আব্দুল জলিল সাহেব ছিলেন খোকশাবাড়ী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক।তিনি স্কুলে ভর্তি হবার সময় শিশু আব্দুল মালেককে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন।সবকটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি এতই অভিভূত হলেন যে আব্দুল মালেককে তিনি সরাসরি ২য় শ্রেনীতে ভর্তি করে নিলেন।বাড়ী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইবাড়ী হাই স্কুল।এলাকার মধ্যে এ স্কুলটির বেশ সুনাম থাকায় শিশু আব্দুল মালেক সে স্কুলে পড়ার আগ্রহ পোষণ করেন।অতঃপর ৪র্থ শ্রেনীতে তাকে সে স্কুলে ভর্তি করা হল।১৯৬০ সালে আব্দুল মালেক জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।আব্দুল মালেক চাচ্ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে।কিন্তু গোসাইবাড়ী হাই স্কুলে তখনও বিজ্ঞান বিভাগ ছিলনা।আব্দুল মালেকের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বগুড়া জেলা স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি করা হল।সেখান থেকে এসএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগে মেধাতালিকায় ত্রয়োদশ স্থান অর্জন করেন।এ সময়ে তার পিতা ইন্তেকাল করেন।এরপর তিনি ভর্তি হন রাজশাহী সরকারী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে।সেখানেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে মেধাতালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকারের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন এবং ডিপার্টমেণ্টের মেধাবী ছাত্র হিসেবে ১ম স্থান অধিকার করেন।স্কুল জীবন থেকে শহীদ আব্দুল মালেক মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর খুব দ্রুত সংগঠনে এগিয়ে এসে সর্বোচ্চ মান সদস্যে উন্নীত হন। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগরী এবং নিখিল পাকিস্তান ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মজলিস-উশ-শূরার সদস্য নির্বাচিত হন।

২.সাদাসিধে জীবন যাপন

শহীদ আব্দুল মালেক অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন।পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামী সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায়না ।রাতের বেলায় নিজ হাতে তিনি তা পরিস্কার করতেন।যেন পরের দিনের সূচনায় তা আবার পরা যায়।অনেকের মত নূর মুহাম্মদ মল্লিকও লিখেছেন,  “সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা পাঞ্জাবী ধোয়া রুটিন কাজের কথা।কোন এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবী আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে।মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাধাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন সাধাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল।প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে তাঁর এক হলমেট লিখেছেন-শহীদ আব্দুল মালেকের পোশাকাদি ও স্যান্ডেল দেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কেউ তাঁকে Underestimate করতে পারতো।কিন্তু তার সাথে কথা বলার স্কোপ হলে ৫ মিনিটের মধ্যে এই ভুল বিশ্বাস অবশ্যই ভেঙ্গে যেতে বাধ্য হত।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের সহকর্মী আবু শহীদ মোহাম্মদ রুহুল সাক্ষাৎকারে আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে বলেছেন- “একদা আমরা একসাথে চকবাজারে কালেকশানে যাই।তখন তাঁর অতি সাধারণ ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবী-পায়জামা এবং চপ্পল দেখে এক সুধী মালেক ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় বলে মনে করেন।এতে সহকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হলে মালেক ভাই আমাদেরকে এ বলে সান্ত্বনা দেন যে,আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিনা তা আল্লাহই ভাল জানেন।আমি আমার জন্য যে মানের পোশাক প্রয়োজন মনে করেছি সে মানের পোশাকই পরিধান করেছি।কে আমার পোশাক দেখে কি ভাবল তাতে আমার কোন ভাবনা নেই”।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের সাথে মারাত্মক আহত হওয়া মাওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বলেন-মালেক ভাই খুব সাদাসিধে থাকতেন।অনেক সময় পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে ইংলিশ সু পরতেন।আমরা বলতাম ,মালেক ভাই এটাতো মিলল না।উনি বলতেন।এত কিছু দেখার সময় আছে নাকি?মালেক ভাই প্রায়ই বলতেন,পড়াশুনা করে শুধু বড় ডিগ্রী নিয়ে কি লাভ যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা না পাওয়া যায়।ডিগ্রি তো নেয়া শুধু বাঁচার তাকিদে।

৩.সংগ্রামী জীবন:

ইসলামী নেতৃত্ব সংগ্রাম,সংঘাত ও কঠিন অগ্নী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়।শহীদ আব্দুল মালেক তাঁর সংগ্রামী জীবনের পদে পদে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন।সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন।আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল একটি পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল।তাই জীবন যাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। সেই কচি বয়সে যখন তাঁর মায়ের কোলে থাকার কথা,তিনি থেকেছেন বাড়ী থেকে অনেক দূরে লজিং বাড়িতে।দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে তাকে।ক্ষুধার যন্ত্রনা,অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোন কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ।সামান্য বৃত্তির টাকা সম্বল করে নিজের জীবন এবং বিধবা মায়ের সংসার চালাতে হতো তাকে ।জনাব নূর মোহাম্মদ মল্লিক এক সময়ে কোন এক কারনে বেশ কিছু দিনের জন্য মালেক ভাইয়ের মেহমান হয়ে ছিলেন।তাকে মেহমানদারী করতে গিয়ে নীরবে নিভৃতে শহীদ আব্দুল মালেক কিভাবে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়েছেন তার চোখ ভেজানো বর্ননা দিয়েছেন তিনি তার ‘চিরভাস্বর একটি নাম’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে : “স্কলারশীপের টাকায় তাঁর সবকিছু চলতো।কিছু টাকা মায়ের কাছেও পাঠাতেন।বাকী টাকা খাওয়া পরা ও আন্দোলনের জন্য খরচ করতেন।বেশ কয়েকদিন থাকার পর আমি লক্ষ্য করলাম মালেক ভাই ডাইনিং হলে খাচ্ছেন না।মনে করলাম মজলিশে শুরার বৈঠকের জন্য হয়তো তাঁদের সকলে একসঙ্গে খান সময় বাঁচানোর জন্য।শুরার বৈঠক শেষ হলো।এরপরও তাকে দেখিনা।এরপর একদিন দেখলাম তিনি রুটি আনাচ্ছেন।কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন,শরীর খারাপ।আমার সন্দেহ হলো,আমার জন্যই বোধ হয় তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে।সামান্য ক’টি টাকাতে হয়তো তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এবং এজন্য বিশেষ করে আমার ভার বহনের জন্যই তাকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে বুঝতে পেরে তাঁর কাছ থেকে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম”।

৪.জ্ঞানপিপাসু:

শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু।জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই।শহীদ আব্দুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকাণ্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন।অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে অনেকটা পিছিয়ে আছেন।

শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহাম্মদ-এর স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি, শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আব্দুল মালেক দীন মুহাম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অন্বেষায়।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইসলামী আন্দোলন করতে হলে কুরআন-হাদীস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-বীমা, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় জানতে হয় কিংবা জ্ঞান থাকতে হয়।

মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : “বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গী বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।”

শহীদ মোহাম্মদ কামারুজ্জমান আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে লিখেছেন –“রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজি একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন।আবার কিছু কিছু নোট করছেন।তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর লিখতেন। বুঝলাম সেই লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।তখন থেকেই বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়”।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের হলমেট ড: এ জামান আব্দুল মালেক ভাইকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় লিখেছেনঃশহীদ আব্দুল মালেকের বৃত্তির একটা বড় অংশ ব্যয় হত বই কেনার পেছনে।ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইসলামী আন্দোলন সংক্রান্ত বহুবিধ পুস্তক তাঁ ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংগৃহীত ছিল।

৫.আন্দোলনের কর্মীদের সাথে আচরণ:

শহীদ আব্দুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ।তাঁর জীবনালেখ্য রচয়িতা ইবনে মাসুম লিখেছেন :“কর্মীদের তিনি ভালোবাসতেন।তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী।তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মত।কর্মীদের সাথে দেখা হলেই কুশল আলাপ করতেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তাঁর রুম ছিল কর্মীদের জন্য তীর্থস্থান।কর্মীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে মিশে জেনে নিতেন তার দুঃখ-বেদনা,তার দুর্বলতা,যোগ্যতা সবকিছু।দুঃখে জানাতেন সহানুভূতি।দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে উপদেশ দিতেন তা শুধরে নিতে।সাধারণ কর্মীদের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিল তাঁর অবস্থান।সকলের সমস্যা শুনতেন অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে,অনুভব করতেন নিজের মত করে এবং সমাধান দিতেন একান্ত আপনজন হিসেবে।কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন, অনুপ্রেরণা যোগাতেন প্রতিভা বিকাশে।ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন।প্রতিটি কর্মীর ব্যাপারে নিজের ধারণা লেখা থাকতো তাঁর ডাইরিতে। এমনিভাবে ভাবতেন তিনি কর্মীদের নিয়ে।ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই, একজন অভিভাবক, একজন নেতা।”

৬.আন্দোলনের প্রতি কমিটমেণ্ট:

শহীদ আব্দুল মালেক বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের অধিকারী হলেও আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল প্রবল।তাঁর এই কমিটমেন্ট শুধু যে সদস্য হওয়ার শপথ বাক্যে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়,সাবেক লজিং মাস্টার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে লেখা চিঠির ভাষাও তাঁর সেই কমিটমেন্টের প্রতিধবনি-‘‘জানি আমার দুঃসংবাদ পেলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকেরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিল উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো নচেৎ সে প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে দোয়া করুন জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের অন্ধকার, সরকারি যাতাকলের নিষ্পেষণ যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”

৭.দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা:

দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আব্দুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এব্যাপারে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শহীদ আব্দুল মালেক ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা ‘আমার প্রিয় সাথী’ তে লিখেছেন -‘‘সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের।বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল’কলেজে আশ্রয় নিয়েছে।আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম।ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কি করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।এ প্রসঙ্গে কথা উঠার আগেই আব্দুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে।বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন।অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।আব্দুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন।তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাক্ষুষ প্রমাণটুকু আমার পক্ষে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো।অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোন কর্মীই ছিল না।আমারতো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছু বুঝিয়ে দেয়া।আব্দুল মালেকের সুদক্ষ  পরিচালনায় সংগৃহিত অর্থের নিখুঁত হিসাব পেলাম।সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন।এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আব্দুল মালেক অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বন্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আব্দুল মালেককে স্বচক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি।আর  আমি মুরুব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছি কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়।এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু শান্ত্বনা দিতে পারতাম।’’

৮.দায়িত্বশীলতা ও দায়িত্বসচেতনতা:

সাধারণত একজন নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার শহীদ আব্দুল মালেকের মধ্যে তার পুরোটাই ছিল।১৯৬৮-৬৯ এর সেশন শুরু হয়েছে। আব্দুল মালেক ঢাকা শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদের নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচিত তিনজন সদস্যের মধ্যে তিনি অন্যতম।ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভীক।তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ অনেকটা গতিশীল হলো।তিনি ছিলেন কর্মীদের একজন আস্থাবান দায়িত্বশীল।এত বড় একজন দায়িত্বশীল হয়েও তিনি কর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে ভুলতেন না।

একটি শিক্ষা শিবির পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।এক সময় জরুরী প্রয়োজনে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।হঠাৎ তাকে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহৃত ল্যাট্রিনের পাশে।তবে ল্যাট্রিন ব্যবহারের জন্য নয়।এক বুক পানিতে নেমে তিনি ল্যাট্রিন মেরামতের কাজে মগ্ন।এ অবস্থা দেখে তো চোখ ছানাবড়া।অথচ এ কাজটি তিনি অন্যকে দিয়েও করাতে পারতেন।কতটুকু দায়িত্ব সচেতনতা তাঁর মধ্যে ছিল এ থেকে তা অনুমান করা যায়।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের একটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিল চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের প্রেরণা যোগানো।তিনি নিয়মিতই বিভিন্ন কর্মীকে চিঠি লিখতেন।এমনি একজন কর্মী বেলালকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-‘‘সৃষ্টির আদি থেকে একটি শ্বাশ্বত নিয়মের মতো এ সত্য চলে এসেছে যে, মহাপুরুষরা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের মন-প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন।নির্মম সমাজ সেই মহাপুরুষকেই কঠিন ও নির্দয়ভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে।বিদ্রুপ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়।আরবের বালুকণা ও প্রস্তর কাদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল? ওমর, ওসমান, আলী আর হাসান হোসাইন এর জীবন নাশের জন্য কারা দায়ী? ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ, মুহাম্মদ ইবনে কাশিম, কোতায়বা কাদের চক্রান্তে নিহত হয়েছিলেন? ইসলামের ইতিহাস পড়ে দেখ, রক্তের লাল স্রোত শুধু কারবালাতেই শেষ হয়ে যায়নি।আজও পৃথিবীর বুকে সহস্র কারবালা সৃষ্টি হচ্ছে।আজো মুসলমান ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে খোদার দ্বীনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তোমরাতো পৃথিবী দেখনি, দেখনি মুসলমানদের উপর নির্যাতন, শোননি তাদের হাহাকার।যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব নিজের জীবন তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন, যার জন্য হাজারো মুজাহিদের তপ্ত রক্ত পৃথিবীর মাটি লাল করে দিয়েছে, সেই ইসলামই লাঞ্ছিত হচ্ছে মুসলমানদের হাতে।”

৯.স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা:

ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের জন্য সংগঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।শহীদ আব্দুল মালেক ভাই ছিলেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অগ্রপথিক।তৎকালীন সময়ে ঢাকা মহানগরীর সভাপতি অধ্যাপক ফজলুর রহমান মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন ঢাকা মহানগরীর সভাপতি,মালের ভাই তখন ছিলেন শাখা সেক্রেটারী।একদিন রাতের বেলায় অফিসে গিয়ে দেখলাম মালেক ভাই মোম জ্বালিয়ে খাতা কলম নিয়ে হিসেব করছেন।আমি ঢুকে সাংগঠনিক কথা শুরু করলে তিনি হটাৎ মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন।মোমবাতি নিভানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,বন্যার্ত মানুষের জন্য সংগৃহীত রিলিফের টাকা দিয়ে মোমটি কেনা হয়েছে।রিলিফের টাকায় কেনা মোম দিয়ে সাংগঠনিক কাজ করা ঠিক নয়।পরে তিনি সংগঠনের টাকায় কেনা মোম জ্বালালেন।বন্যাটি ছিল ১৯৬৭ সালের।এ থেকে তার অত্যধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় পাওয়া যায়”।মালেক ভাইয়ের সেদিনের স্মৃতি আজও আমাকে অনেক বেশী নাড়া দিয়ে থাকে।

১০.আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব:

শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আব্দুল মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন,“আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন জিঞ্জিরা(কেরানীগঞ্জ)পি এম হাই স্কুলে আয়োজিত এক শিক্ষা শিবিরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মালের ভাই।আমিও যোগদান করেছিলাম সেই শিবিরে।আমার মনে হয় সেখানে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ কর্মী।রাতে খাবার পর হাত ধৌত করার সময় মালেক ভাইকে দেখলাম তিনি নিজে থালা বাসন পরিস্কার করছেন।এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমি আরো একটি শিক্ষা শিবিরে অংশ নিয়েছিলাম।শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সেই শিক্ষা শিবিরের পরিচালক ছিলেন।রাতে মালেক ভাইয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ১১২ নম্বর কক্ষে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হলো।আমার সাথে আমার এক সঙ্গীও সেখানে ছিল।রাতে প্রোগ্রাম শেষে আমরা শয়ন করলাম মালেক ভাইয়ের সিটে।লক্ষ্য করলাম অনেক রাতে তিনি শুতে আসলেন।অতঃপর মাথায় পত্রিকার কাগজ দিয়ে ফ্লোরে একটি চাঁদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।এক রাতের ঘটনা।আমার সঙ্গীটি হটাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেলেন।আর মালেক ভাই নীচে থেকে তাকে পাজাকোলে ধরে ফেললেন।ফলে সেই ভাইটি কোন ব্যথা পায়নি।জামালপুরে আশেক মাহমুদ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন একদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠে দেখি ছাত্রাবাসে আমার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি হালকা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে মালেক ভাই।আবেগে অভিভূত হয়ে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।খুব অভিমানে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ দাড়িয়েছেন,ডাক দিলেন না কেন?তিনি জবাবে বললেন তিনটার দিকে পৌঁছেছি।ভাবলাম সকালে তো ফজরের নামাজ পড়তে উঠবেই।তাছাড়া চিন্তা করলাম অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়েছ,তোমার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে লাভ কি?দুইজনের বদলে একজন কষ্ট করাই ভালো।তাই এখানে দাঁড়ালাম।আমার কিছু অসুবিধা হয়নি।

১১.নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা:

শহীদ আব্দুল মালেক একজন নীরব ও নির্ভরযোগ্য কর্মী ছিলেন।অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি কখনো গর্ব করে বেড়াতেন না।তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগুতে চাইতেন।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের দায়িত্বশীল আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন- আব্দুল মালেক ভাই ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক থাকা অবস্থায় অল্প সময়ের মধ্যেই সেই অফিসের চেহারা পাল্টে দিলেন। আব্দুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও সহজে গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নাই।

তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরো লিখেছেন- ‘‘তুমি পরে এসে আগে চলে গেছো, আল্লাহর দরবারে অনেক বড় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছ, তাই তোমাকে বড় ঈর্ষা হয়। শাহাদাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে, একনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে নির্দেশ দিয়েছি।কিন্তু আল্লাহর দরবারে শাহাদাৎ কবুলের মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে নেতা মানছি।তোমার কর্মতৎপরতা, আত্মগঠনে নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রশ্নে সতর্কতা ও ন্যায়নিষ্ঠার যে উদাহরণ তোমার জীবন থেকে আমি পেয়েছি তা সাধ্যমত নিজে অনুসরণ করা ও অন্যকে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি।”

১২.মানবদরদী:

ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর। দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি।আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী লিখেছেন-‘‘ঈদুল আজহা উপলক্ষে কর্মীরা বাড়িতে যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আব্দুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি।সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম।আব্দুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে।কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে উঠেননি।আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন।আমার স্টেশনে যাওয়া তাঁর কাছে কেমন যেন লেগেছে।বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম।অবশ্য একবার খোঁজ করেছি আপনাকে পাইনি।আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম।তিল ধরনের জায়গা নেই।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত।আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার।টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত।কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না।আব্দুল মালেক অকপটে বলেই ফেললেন, এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে।তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনছি।’’

১৩.দৃঢ়তা ও আপোষহীনতা:

শহীদ আব্দুল মালেক জানতেন যে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মানেই কঠিন পরীক্ষাকে মাথা পেতে নেয়া।সেটা জেনে পথ চলার কারণেই কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথ আগলে রাখতে পারেনি।ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভীক।পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সম্মুখ পানে।তাঁর বলিষ্ঠতা, আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী চেতনার পরিচয় মিলে নিম্নের এই বক্তব্যের মাধ্যমে-

শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রাহ.)এক সময়ে শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন : আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দিলাম তখন এক কর্মী শিক্ষা শিবিরে ঢাকায় আসলাম। আব্দুল মালেকের কথা শুনেছি কিন্তু তাঁকে তখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষা শিবিরের ব্যবস্থাপক।কিন্তু প্রায় তাঁকে দেখা যেত না। শেষ দিনে এসে তিনি একটা ছোট্ট বক্তব্য দিলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এরকম-

‘‘আমরা তো জেনে বুঝেই এ পথে এসেছি। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে অনেকদূর পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সামনের দিকে তাকালে মনে হবে আমাদের আরও অনেক পথ চলতে হবে। এই পথে চলতে গিয়ে যদি আমরা দ্রুতগামী কোনো বাহন পাই তাহলে সেটাতে সওয়ার হয়েই মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছবো, যদি তেমনটা না পাই তাহলে শ্লোথ কোনো বাহনে করে হলেও আমরা সেই মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো”।সত্যিই আব্দুল মালেককে কোনো কিছুই ভড়কে দিতে পারেনি। তিনি পাহাড়ের মতো অটল অবিচল থেকে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

১৪.দাওয়াতী চরিত্র:

দ্বীনের দাওয়াতী কাজে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন শহীদ  আব্দুল মালেক । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানরসায়ন বিভাগের সেরা ছাত্র হয়েও দেখুন তিনি কিভাবে দাওয়াতী তৎপরতায় শামিল ছিলেন  এবং দাওয়াতী কাজের প্রতি তাঁর পেরেশানী কেমন ছিলো।

# মাসের এক তারিখেই তিনি লিস্ট করে ফেলতেন কোন কোন ছাত্রদের কাছে তিনি দাওয়াত পৌঁছাবেন।লিস্ট অনুসারে বেরিয়ে পরতেন কাজে।একদিন তার এক বন্ধু সন্ধ্যায় গিয়ে দেখলেন মালেক ভাইয়ের মন অনেক খারাপ।চোখে জল টলমল করছে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, আগামী কাল থেকে ক্যাম্পাস দু’তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকবে।তিনি তার লিস্ট অনুসারে সবার কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে পারেননি বলে তার মন খারাপ।মন বেশী খারাপ হয়েছে তাদের জন্য যাদেরকে সবে দাওয়াত দিয়েছেন।এখন তাদের সাথে দু’তিন দিন দেখা সাক্ষাৎ না থাকা মানে তারা আবার নতুন হয়ে যাবে।

# আব্দুল মালেক ভাই সবাইকেই সালাম দিতেন।এক নাস্তিক তাকে একদিন বলল, আমি সালাম নেইনা তবুও আপনি আমাকে বার বার সালাম দেন কেন ? তিনি বললেন, সালাম মানে তো শান্তি কামনা করা।আমি কেন আপনার শান্তি কামনা করবনা ? এভাবেই কথা শুরু।অবশেষে একদিন এই নাস্তিকটিও ইসলামী আন্দোলনের পথে এসেছিলেন আব্দুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতী তৎপরতার কারনে।মালেক ভাইয়ের মতে, সালাম দিলে কথা বলার একটা সুযোগ এসে যায় আর তাতে দাওয়াতী কাজ করা সহজ হয়ে যায়।

# আব্দুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতে একজন কর্মী হয়েছেন।কিন্ত সেই কর্মী কিছুতেই ফজরের নামাজ পড়তে পারে না। বার বার ক্বাযা করে ফেলে।মালেক ভাই বিচলিত হয়ে পড়েন তার নামাজ ক্বাযা বন্ধ নিয়ে।মালেক ভাই থাকতেন ফজলুল হক হলে আর সেই কর্মী থাকতো পুরোনো ঢাকায়।তথাপিও মালেক ভাই প্রতিদিন ফজরের নামাজ পরতেন সেই কর্মীর মেসের পাশের মসজিদে তাকে সাথে নিয়ে।এভাবে প্রায় কয়েকমাস।অবশেষে কর্মীটি সাথী শপথ নিতে সমর্থ হয়।

# আব্দুল মালেক ভাই গভীর রাতে জায়নামজে বসে কাঁদতেন নিজের গুনাহ মাফের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য, বিশ্ব মুসলিমদের জন্য।আর একটি বিষয় নিয়েও কাঁদতেন।সেটি হল তার দাওয়াতী কাজের সফলতার জন্য।যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর চিন্তা করতেন তাদের নাম ধরে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে হেদায়াতের জন্য দোয়া করতেন।

# দাওয়াতী কাজ ছিল শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের প্রাণ।সে কারনেই তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব আমার ডান হাত দিয়ে, ইসলামের শত্রুরা যদি আমার ডান হাত কেটে ফেলে তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকব, ওরা যদি আমার বাম হাতও কেটে ফেলে দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকব।ওরা যদি আমার দুটো পাও কেটে ফেলে তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার চলার গতিকে স্তব্ধ করে দেয়, তাহলে আমার যে দুটি চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দিয়ে হলেও ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব,আমার চোখ দুটিকে যদি উপরে ফেলে তাহলে আমার হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো।

১৫.ইকামতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকার:

পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশী প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক।দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন।বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, পাক জনাবেষু, ‘বাড়ির কথা ভাবিনা, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন।কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ,দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন।আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না,শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি’।

কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সংকল্প আরও দৃঢ় হল।তাইতো ফজলুল হক হলের ১১২ রুমের দরজার উপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী “আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হবনা, নীরব হবনা, নিথর হবনা, যতদিন না কোরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাব।আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যবরণ করব।” এ মহান মঞ্জিলে পৌছার জন্য মায়ের বন্ধনও ছিন্ন করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন তিনি।১৯৬৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী তাঁর বাবার কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছেন, “মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই।আশীর্বাদ করবেন,সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি।আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন,আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা।আমি চাইনে বড় হতে, আমি ছোট থেকেই স্বার্থকতা পেতে চাই।বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত থেকে ফিরে যদি বাতিল পন্থীদের পিছনে ছুটতে হয়, তবে তাতে কি লাভ?

১৬.পরিশ্রম প্রিয়তা:

শহীদ আব্দুল মালেক ভাই ছিলেন অনেক বেশী পরিশ্রমী। নূর মুহাম্মদ মল্লিকের ভাষায়, ‘ তাঁকে দেখতাম সারাদিন এবং অধিকাংশ রাতভর কত কাজ করতে।ক্লাস করছেন, সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করছেন।রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে।মনে পড়ে মালেক ভাই অনেক  সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যান্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন, তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পীচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।”

১৯৬৯ সালের ৩১ শে মে প্রিয় বেলালকে আব্দুল মালেক ভাই লিখেছেন-মনের অবস্থাটা খুব বেশী ভাল নয়।এ কথাটা কাউকে বলতেও পারছিনা।বিরাট আন্দোলনের নগন্য এক কর্মী আমি ।ঢাকা ইসলামী ছাত্রসংঘের মত বিরাট সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব আমায় হাঁপিয়ে তুলেছে।সবাই কর্মী আর এই কর্মীদের পরিচালনার গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধেই চেপেছে।তাই মন খারাপ থাকলেও কর্মীদের সামনে জোর করে হাসতে হয়।শরীর খারাপ থাকলেও জোর করে বাইরে বেরুতে হয়।কারণ আল্লাহর দ্বীনের এ আন্দোলনের সামান্যতম ক্ষতি হোক ,এটা চিন্তা করাও মুশকিল।যখন এক থাকি,তখনই যত রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় জট পাকায়।জীবনের এক কঠিন দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আমার প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে।

আগামী ১৫ আগষ্ট পালিত হবে শহীদ আব্দুল মালেকের ৪৬তম শাহাদাৎবার্ষিকী এবং ইসলামী শিক্ষা দিবস। শহীদ আব্দুল মালেক আজকে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রেরণা চির ভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের এতো বছর পরেও আরো বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার কথা স্মরণ করার।তার শিক্ষাকে,তার কুরবানীকে,তার আদর্শকে,তার চরিত্রকে বর্তমান ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করার, যাতে এ দেশের ছাত্র মহলে যারা ইসলামী আদর্শের দিকে এগুচ্ছে তারা এ মহান আদর্শ থেকে যাতে বিচ্যুত না হয় এবং শহীদ মালেক যেন তাদেরকে প্রেরণা যোগায়।একজন আব্দুল মালেকের জায়গায় আজ লাখ লাখ আব্দুল মালেক ছুটে এসেছে এ আন্দোলনে। শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য তাঁর উত্তরসূরিরা জানবাজ চেষ্টা করছে এবং করবে। পেছন থেকে প্রেরণা যোগাবে লক্ষ কোটি শহীদের মিছিলে শামিল হওয়া শহীদ আব্দুল মালেক। মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললে বলতে হয়-

‘‘শহীদ মালেক আজো আমায় ডাকে

সকল বাধা পেরিয়ে যেতে

সেই দিশারী আড়াল থেকে হাঁকে …’’


 লেখকঃ-

আতিকুর রহমান 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক। 

মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

নিজামুল মুলক আত তুসী : ইসলামী সভ্যতার মহান সংস্কারক


অন্যান্য সভ্যতার মতো ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসেও এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যারা এই সভ্যতাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী সভ্যতার বিকাশে তাদের ভূমিকা ছিল মৌলিক, চাই সে বিকাশ বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক–যে কোনভাবেই হোক না কেন।

নিজামুল মুলক আত তুসী এই মনীষীদেরই একজন, যিনি কিনা পরপর দুজন সেলজুক সুলতান, আলপ আরসালান এবং তাঁর পুত্র মালিক শাহের অধীনে পূর্ণ ৩০ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতো রাষ্ট্রীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাসে প্রায় বিরল। তাছাড়া তিনি তাঁর গুরুতর প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে ছিলেন একজন বিদ্বান ও সংস্কৃতিমনা পুরুষ। তিনি ইসলামের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসগ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হন। কে এই নিজামুল মুলক তুসী? কী সেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যার জন্য তিনি আজও ইতিহাসের পাতায় একটি বিশেষ স্থানের অধিকারী? কীভাবে তার অসাধারণ সাফল্যগুলো শেষ পর্যন্ত একটি অভিনব উপসংহারে রূপ নিল?


দারিদ্র্য থেকে মন্ত্রিত্বঃ-

আবু আলী আল-হাসান ইবনে আলী ইবনে ইসহাক আত-তুসি ৪০৮ হিজরি মুতাবেক ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তের নিকটে, বর্তমান ইরানের পূর্ব দিকে, একেবারে শেষপ্রান্তে তুস বা মাশহাদ আল রেজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গজনী সম্রাটদের শাসনামলে তার বাবা ছিলেন তুস শহরের নেতা। অর্থাৎ তিনি ছিলেন গজনী প্রশাসনের মাঝারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল। তবে এই পদ থেকে অর্জিত আয় এবং মাসিক বেতন তাঁর ও নিজামুল মুলক-সহ অন্যান্য পুত্রদের জন্য যথেষ্ট ছিল না।

দুধপানের বয়সে নিজামুল মুলকের মায়ের মৃত্যু ছিল তার জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। তার বাবা ছিলেন দরিদ্র। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছেলেকে দুধ পান করানোর মত সামর্থ্য তাঁর ছিল না। যে নারীরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাচ্চাদের দুধপান করাতো, নিজামুল মুলকের পিতা তাকে সে নারীদের কাছে দুধপানের জন্য নিয়ে যেতেন। ফলে তখন থেকেই অর্থসংকটের প্রতি নিজামুল মুলকের দৃষ্টি খুলে যায়। দারিদ্র‍্যের এই অনুভূতিই তাঁকে প্রচণ্ড আশাবাদী করে তুলেছিল এবং তাকে শিক্ষার হাতেখড়ি ও কুরআনুল কারীম মুখস্থ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আসির তাঁর বর্ণণা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি দারিদ্র‍্য ও অর্থসংকটের মাঝে বেড়ে উঠেছিলেন। যা তাকে উদ্দীপ্ত করেছিল উচ্চ মনোবল ও জ্ঞানের স্রোতধারায় ডুবে থাকতে। ফলে তিনি দীনচর্চায় প্রভূত দক্ষতা হাসিল করেন এবং মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।’

তার জন্মশহর নওকানে তিনি ফারসির পাশাপাশি আরবী ভাষার শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং কুরআন, হাদিস, ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন। তিনি শাফেয়ী মাযহাবের ফিকাহশাস্ত্র ও আশআরী মাসলাকের আকীদাশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। হাদীসে নববীর প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ থাকায় তিনি তাঁর অন্যান্য ইলমঅন্বেষী সহপাঠীদের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রবীণ শায়েখদের কাছ থেকে জ্ঞান অন্বেষণ এবং হাদীস শ্রবণের জন্য ইরাক, খোরাসান, রাই, ইস্পাহান, নিশাপুর ইত্যাদি শহর সফর করবেন। অবশেষে তিনি এই শাস্ত্রে এমন উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যা তাকে রাই (বর্তমান তেহরান) শহরের হাদীস-শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের আসনে বসিয়েছিল।

তার বাবা যে প্রশাসনিক কাজে নিরত থাকতেন, সে কাজের প্রতি তুসী নিজে যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি লেখালেখি ও রচনার জ্ঞান লাভ করেন এবং হিসাববিজ্ঞান-সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এগুলো তখনকার মুসলিম বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে স্থানীয় সরকারের কার্যালয়ে নিযুক্তির মূল বিষয় ছিল। অবশেষে তিনি আফগানিস্তানের রাজধানী গজনীতে গজনী সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্মে যুক্ত হন। এভাবেই ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সহকর্মীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে নেন। এ কারণেই হয়তোবা ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘গজনীতে যাওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন একজন কীর্তিমান হিসাবরক্ষক। তার কাছেই চূড়ান্ত হিসাবের দায়িত্ব ছিল। তিনি রচনায়ও দক্ষতা অর্জন করেন। সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন মেধাবী, বুদ্ধিমান ও পূর্ণ নেতৃত্বের অধিকারী।’

সে-সময় সেলজুক শাসকদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটছিল এবং তারা ইতোমধ্যে মাওরাআন নাহার অঞ্চলগুলোতেও নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ধীরে ধীরে তারা গজনীদের হটিয়ে খোরাসানের অঞ্চলগুলোতে (যা বর্তমানের আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরাকের পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত) নিজেদের ক্ষমতার প্রসার ঘটাতে থাকে। হাসান তুসী সেলজুকদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তার দক্ষতা, জ্ঞান এবং বুদ্ধি বাদশাহ আলপ আরসালানের মন্ত্রী আবু আলী বিন শাযানকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে তুসী সেলজুক আমিরদের বিশ্বাসভাজনে পরিণত হন। ইবনে শাযানের মৃত্যু-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভের পূর্বেই তিনি একজন মন্ত্রীর সহকারী পদ থেকে সেলজুকী বাদশাহ আলপ আরসালানের ‘কাতেবে’র পদে উন্নীত হন।

আলপ আরসালান যখন সবচেয়ে বিখ্যাত সেলজুক সুলতানরূপে আবির্ভূত হলেন এবং ঐতিহাসিক ‘মানযিকার্ট’-এর যুদ্ধে বিজয়ী হলেন, তখন ৪৫৫ হিজরিতে তিনি তাঁর কাতেব আবু আলী আত-তুসিকে সেলজুক রাজ্যের মন্ত্রী বানাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থসংকটে বেড়ে ওঠা মন্ত্রীর জীবনে এটাই ছিল অন্যতম মুহূর্ত। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অধ্যবসায় এবং শিক্ষা উপরন্তু তার বুদ্ধিমত্তা তাকে মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যক্তির স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এই পদটি তাকে সেই সময়ের সেরা রাজনীতিবিদ হিসাবে যোগ্য করে তোলে, যেমনটির স্বীকারোক্তি দিয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হুসাইন গোলাম।


নিজামুল মুলকের রাষ্ট্রনীতিঃ-

আলপ আরসালান ও তার পুত্র মালিকশাহ, এই দুই সেলজুক শাসকের অধীনে নিজামুল মুলক দীর্ঘ তিরিশ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দুই দুইজন সেলজুক শাসকের সময়ে মন্ত্রী থাকার কারণে তাকে তাজুল হাযরাতাইন লকব দেয়া হয়। নিজামুল মুলকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আব্বাসি ও সেলজুকদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য তাকে আব্বাসি খলিফার পক্ষ থেকে ‘রাদিয়্যু আমিরিল মুমিনিন’ উপাধি দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কাজকর্মেও নিজামুল মুলক অংশ নিতেন। সৈন্যবাহিনীকে ঢেলে সাজানো ও অধিক শক্তিশালী করার ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। এমনকি তিনি যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের অগ্রভাগে থেকে লড়াই করতেন।

নিজামুল মুলকের প্রকৃত নাম আবু আলি আল হাসান আত তুসী। সেলজুক সাম্রাজ্যকে উন্নত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার কারণে তাকে নিজামুল মুলক বলে ডাকা হতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অনুপম দক্ষতার মাধ্যমে তিনি ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। তার রাজনৈতিক কৌশলের সাহায্যে তিনি একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হন। এই শাসনব্যবস্থা খোরাসান, ইরান ও ইর অঞ্চলে বিস্তৃত সেলজুক সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করত। ইসলামে নবদীক্ষিত সেলজুকদের ইসলামের দিকনির্দেশনার প্রতি মনোযোগী করে তোলেন নিজামুল মুলক। একইসাথে পারস্য বা অন্যান্য অঞ্চলের সফল শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনার নানান নীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত করেন।

সাধারণ মানুষের প্রতি নিজামুল মুলক খুবই আন্তরিক ছিলেন। তারা যাতে জুলুম বা অত্যাচারের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। ইনসাফ কায়েমের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। আল্লামা সুবকি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন, নিজামুল মুলকের কাছে কোন অনিয়ম বা অত্যাচারের অভিযোগ আসলে তিনি কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিচার করতেন। জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারীদের আল্লাহর ভয় দেখাতেন। যার ফলে মানুষ তখন নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারত। সুলতানের আশেপাশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের থেকেও তারা ইনসাফের আশা করত।

সাধারণ মানুষ, মজলুম ও অধিকারবঞ্চিত লোকদের আলাদা গুরুত্ব দিতেন নিজামুল মুলক। মানুষের অভিযোগ-অনুযোগ শোনার জন্য বিশেষ দিনগুলোতে মজলিস হতো। একবার এমন এক মজলিসে খোদ ইমামুল হারামাইন উপস্থিত ছিলেন৷ অভিযোগকারী একব্যক্তি এসে নিজামুল মুলকের দিকে একটা চিরকুট ছুঁড়ে মারল। নিজামুল মুলকের সামনে দোয়াত রাখা ছিল। চিরকুট গিয়ে পড়লো দোয়াতের কালিতে। প্রচুর পরিমাণে কালি থাকার কারণে কালি ছিটকে এসে নিজামুল মুলকের পোষাক কালো করে দিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নিজামুল মুলক ছিলেন খুবই শান্ত। তিনি একটুও রাগান্বিত হন নি। তার চেহারাও মলিন হয় নি। অথচ তিনি ছিলেন চিন থেকে নিয়ে আনাতোলিয়া হয়ে শাম পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী।

তিনি হাত বাড়িয়ে চিরকুটটি নিয়ে অভিযোগকারীর অভিযোগ পড়তে লাগলেন। কিভাবে সমাধান দেয়া যায় এই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁর মতো একজন প্রভাবশালীর ব্যক্তির এমন ধৈর্য আর সহনশীলতা দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রজাদের উপর যাতে জুলুম না হয় এজন্য তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের মজলিস কায়েম করতেন। এরমধ্যে প্রধান অঞ্চল ছিল আব্বাসি খেলাফতের রাজধানী বাগদাদ। বাগদাদে তিনি মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতেন। যারা বাস্তবেই হকদার তাদেরকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দান করতেন।

রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিজামুল মুলক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। একসময় তিনি চাইলেন, রাষ্ট্রসংক্রান্ত তার এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে একটা গ্রন্থ লিখবেন। যে গ্রন্থটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মানুষকে সুস্পষ্ট ধারণা দিবে। এ কারণে রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে লিখিত তাঁর ‘সিয়াসাতনামা’ গ্রন্থটি তার রাষ্ট্রপরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বর্ণনা বলে গণ্য করা হয়৷ নিজামুল মুলক শেষ জীবনে সুলতান মালিক শাহর অধীনে মন্ত্রী থাকার সময় সুলতানের ইচ্ছায় সিয়াসাত নামা গ্রন্থটি লেখেন।

৪৭৯ হিজরীতে সুলতান মালিকশাহ রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সেলজুক সাম্রাজ্যের নানা অসঙ্গতি ও তা থেকে উত্তরণের উপায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক পদ্ধতি সুলতানকে অবহিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতকে সামনে রেখে সুলতান রাজ্যের সংবিধান তৈরি করবেন। তখন রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মেধা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে নিজেদের মতামত সুলতানের সামনে পেশ করে৷ সম্রাট সেসব থেকে কেবল নিজামুল মুলকের লিখিত সিয়াসাতনামা গ্রন্থটিই সংবিধান হিসেবে বেছে নেন। তিনি সিয়াসাতনামার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী রাজ্যপরিচালনার ঘোষণা দেন৷

সন্দেহ নেই, এর পরপরই নিজামুল মুলক মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। রাষ্ট্রীয় নানা সমস্যার সমাধান, রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও সমঝোতা, বিভিন্ন খাতে সম্পদ ব্যয় করা, যে কোনো বিধান জারী করার একচ্ছত্র অধিকার লাভ করেন৷ কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই এসব ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। রাষ্ট্রীয় নীতি ও নৈতিকতা, সাধারণ মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়, যুদ্ধকৌশল ও তার মৌলিক উদ্দেশ্য–সব ক্ষেত্রেই নিজামুল মুলকের পরামর্শ সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হতো।

সে সময় সংবাদ পৌঁছানোর জন্য একটা দক্ষ ও শক্তিশালী বাহিনী ছিল। যারা মানুষের মাঝে মিশে থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করত। জুলুম-নির্যাতন কিংবা কোনো ষড়যন্ত্র অথবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের সংবাদ স্থানীয় প্রশাসকের কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছিয়ে দিত। নিজামুল মুলক সংবাদ পৌঁছানোর ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও দ্রুততর করার জন্য বিভিন্ন স্থানে ডাককেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেন। যে ডাককেন্দ্রগুলো এশিয়ায় বিস্তৃত সেলজুক সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘ দূরত্ব থাকার পরও খুব দ্রুতই সংবাদ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ভাগ করার ক্ষেত্রে জাতিগত সম্পর্ক প্রধান না হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কি বাহিনী বা আরব বাহিনী কিংবা পারস্যবাহিনী এভাবে যাতে ব্যাটালিয়ন ভাগ না করা হয়, সে পরামর্শ নিজামুল মুলক তার সিয়াসাতনামা গ্রন্থে সুলতানকে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল নিজামুল মুলকের সবচে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। বিভিন্ন জাতির সৈন্য দিয়ে ব্যাটালিয়ন সাজানোর অন্যতম ফায়েদা হলো, শাসকশ্রেণী কোনো ধরনের সম্মিলিত বিদ্রোহ অথবা অবাধ্যতা ভয় থেকে মুক্ত থাকেন। নিজামুল মুলক খুবই সতর্ক মানুষ ছিলেন। গজনীরা জাতিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ভাগ করত। এই গজনীদের পরপরই সেলজুকদের শাসন শুরু হয়। এই শক্তিশালী কৌশলটি সেলজুকরা গ্রহণ করে৷ তাদের পরবর্তী যিনকি, আইয়ুবি, দাস ও রোমের সেলজুক এবং উসমানিরাও এই কৌশল অবলম্বন করে।


মাদরাসায়ে নেজামিয়া : উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্রঃ-

আব্বাসি খেলাফতের অধীনে বেড়ে ওঠা তুর্কি সেলজুকদের ইসলামী সাম্রাজ্য শাসন করার আগে শিয়া বুহাইরিয়ারা ইরাক ও ইরানে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই সময়ে শিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তাধারা মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি মিশরের ফাতেমি সাম্রাজ্য শিয়া ইসমাঈলি মতবাদ প্রচারের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে থাকে। বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ ব্যয় ও শিয়া মতাবলম্বী লোকদের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। আব্বাসি ও সেলজুকদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে আহলুস সুন্নাহর শক্তিশালী ভিত্তি দুর্বল করার জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে৷ এই প্রচারণার ভয়াবহ প্রভাবের ব্যাপারটা নিজামুল মুলক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যার ফলে আমরা তাঁর সিয়াসাত নামা গ্রন্থে এই ভ্রান্ত ফেরকার চিন্তাধারা রদ করার ক্ষেত্রে তাঁকে তৎপর দেখতে পাই।

সুলতানকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, শিয়া মতাবলম্বীদের যাতে কোনো সাহায্য না করা হয়। সুলতান তাদেরকে গুরুত্ব দিবেন না। নির্ভরতা বা আস্থার সম্পর্ক রাখবেন না তাদের সাথে। সিয়াসাতনামায় নিজামুল মুলক বলেন, ‘আমি শিয়া মতাবলম্বীদের যেসব ভ্রান্তি ও মন্দকর্মের দিকে ইঙ্গিত করে থাকি, আশা করি খুব শীঘ্রই সুলতান সেসবের সত্যতা অনুভব করবেন। এবং এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতি আমার আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতা সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত হবেন। খুব ভালোভাবেই আমি এই ভ্রান্ত দলের কাজকর্ম ও তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত আছি। বড় বড় শাসকদের কাছে আমি এই বিষয়গুলো পেশ করেছি। কিন্তু তারা এর প্রতি কোনো ধরনের গুরুত্বারোপ করেননি৷ ফলে একসময় আমি তা বলা থেকে বিরত হয়ে পড়ে।’

সে-সময় হাসান সাব্বাহর নেতৃত্বে ইসমাইলি হাশশাশীদের আত্মপ্রকাশ ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক বিষয়। তাদের দুর্গগুলো ইরান ও শামের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বড় বড় আলেম ও আমিরদেরকে এবং যাদেরকে তারা নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের পথে বাধা মনে করতো, এদের সকলকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে হত্যা করতে লাগল৷ ফলে এই শক্তিশালী দলটিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রায়সময় সেলজুক সৈন্যবাহিনীকে পাঠানো হতো। দুর্ভেদ্য দুর্গ ও তৎপরকর্মীদের সাহায্যে তারা ইরানের দামেগান, আলমুতসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল মানুষকে তাদের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। শামের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মতবাদ৷ এই ভ্রান্ত দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিজামুল মুলক প্রায় সময় সেলজুক শাসকদের সতর্ক করতেন৷

নিজামুল মুলক বিশ্বাস করতেন, শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য কেবল সশস্ত্র আক্রমণই যথেষ্ট না। বরং সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা চিন্তার যুদ্ধও চালিয়ে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের বাগদাদ নিশাপুর মার্ভ রাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠার মধ্যে এই চিন্তা কার্যকর ছিল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সরকারি ইউনিভার্সিটির মতো, যেগুলোর পেছনে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ সম্পদ বরাদ্দ রাখত।

এটা সত্য, নিজামুল মুলকের মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইসলামি বিশ্বে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রচলন ছিল। কিন্তু শিক্ষাধারা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মাদরাসায়ে নিজামিয়া নতুন ধরনের তরিকার সূচনা করেছিল। মাদরাসা নিজামিয়াতে ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ভাতা ও থাকার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষকদের বেতন ও বাসস্থান দেয়া হতো। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাতদিনের সবসময় জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল। ছাত্র-শিক্ষক সকলে নিশ্চিন্ত মনে একাগ্র হয়ে জ্ঞানচর্চা করতে পারতেন৷ নিজামুল মুলকের সৌভাগ্য, অনেক বড় বড় আলেম ও ফকিহগণ তার সমসাময়িক ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন, ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালি আল জুওয়াইনি (মৃত্যু : ৪৭৮হিজরী)। তিনি নিজামুল মুলকের মতো শাফেয়ী ছিলেন। তাঁর সাথে নিজামুল মুলকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

ইমাম জুওয়াইনি তার রচিত রিসালায়ে নিজামিয়া গ্রন্থটি নিজামুল মুলককে হাদিয়া দেন। নিজামুল মুলক ইমাম জুওয়াইনির জন্য খোরাসানের রাজধানী নিশাপুরে নিজামিয়া ধারার একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন৷ তার সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যতম আরেকজন হলেন ইমাম আবু হামেদ আল গাযালি। তিনি নিজামুল মুলকের জন্মশহর তুসে জন্মগ্রহণ করেন। নিজামুল মুলক ইমাম গাযালিকে বাগদাদের মাদ্রাসা নিজামিয়ায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানান৷ যে মাদরাসাটি তিনি সাধারণ মানুষ ও তালেবে ইলমদের মাঝে আহলুস সুন্নাহর সঠিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

নিশাপুরের মাদরাসায়ে নিজামিয়ায় প্রতিদিন ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনির দরস শোনার জন্য তিনশো ছাত্র উপস্থিত হতো। এটা চলছিল দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে। আর বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৫৭ থেকে ৪৫৯ পর্যন্ত এই দুইবছরে৷ এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ভাতা এবং শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতনের ব্যবস্থার জন্য ছিল বাজার, হাম্মাম দোকান ও ক্ষেতখামারসহ প্রচুর পরিমাণ ওয়াকফকৃত সম্পত্তি। বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও ছিল। এর বাইরে শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, পাঠাগারের দায়িত্বশীল, পাহারাদার ও কর্মচারীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এই মাদরাসায় নিযুক্ত ছিল। শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য বছরে পনেরো হাজার দিনারের মত ব্যয় হত। ছাত্রসংখ্যা ছিল ছয় হাজারের মত। যারা ভাষা ব্যকরণ, সাহিত্যের নানান অনুষঙ্গ, ফেকাহ, তাফসির, হাদিসসহ ধর্মীয় শিক্ষার অন্যান্য বিষয়গুলোও অধ্যায়ন করত।

বসরা, ইস্পাহান, বলখ, হেরাত, মার্ভ ও মসুলেও নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুনগুলোর ছাত্র শিক্ষকদের অধিকাংশ ছিলেন হিজরী পঞ্চম ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলেমগণ। অবশ্য শাফেয়ী মাযহাব ও আশআরী আকিদা অবলম্বনকারীদের প্রাধান্য ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই পরবর্তীতে ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে৷ এবং নানা ধরনের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়ার প্রথম শিক্ষক আবু ইসহাক আশ শিরাজি বলেন, আমি খলিফা মুকতাদির চিঠি পেয়ে খোরাসানের উদ্দেশে যখন সফর করি তখন যে শহর বা গ্রামে প্রবেশ করেছি, দেখেছি, সেখানকার খতিব-কাজী আমার ছাত্রদের মধ্য থেকেই কেউ একজন।

খুব সম্ভব এই বিপুল সাফল্য দেখতে পেয়ে শামের মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ আল্লামা হাফেজ ইবনে আসাকির মাদরাসায়ে নিজামিয়ার পাঠদান দেখার জন্য ছুটে আসেন। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর তারিখে দামেশক নামে সত্তর খণ্ডের একটা দীর্ঘ ইতিহাসগ্রন্থ লিখেন৷ মাদরাসায়ে নিজামিয়ার সুনাম অনেক দূরদূরান্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। একেবারে পশ্চিমের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এই সুখ্যাতি মুওয়াহহিদিন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুমারতের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে তিনি সুদূর মরক্কো থেকে মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে ছুটে আসেন ইমাম আবু হামেদ আল গাযালী ও অন্যান্যদের কাছে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য। এরপর তিনি নিজদেশে ফিরে গিয়ে আলেমদের বিতর্ক করতে শুরু করেন। এবং মুরাবিতিনদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুওয়াহহিদিন সালতানাতকে শক্তিশালী করে তোলেন।

নিজামিয়া মাদরাসা ইসলামী সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য শহরগুলোতে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যাপনা করা সে সময়ের শিক্ষক ও অধ্যাপকদের জন্য ছিল অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। ফলে তারা মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে অধ্যাপনার স্বপ্ন দেখতেন। কেউ কেউ এইজন্য প্রচুর পরিশ্রম ও অর্থসম্পদ ব্যয় করতে দ্বিধা করত না। আব্দুর রহমান আত তাবারি, আবু হামেদ আল বারদি এই প্রতিষ্ঠানে বেশ পরিশ্রম ও চেষ্টার পর অধ্যাপনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

মাদরাসায়ে নিজামিয়ার শিক্ষক নির্বাচনের ধরন অনেকটা আজকের আধুনিক ইউনিভার্সিটিগুলোর অধ্যাপক নির্বাচনের মতো। মন্ত্রী নিজামুল মুলক আত তুসি নিজেই শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাই করতেন। সময়-পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করতেন৷ বেশকিছু প্রশ্ন তৈরি করে শিক্ষকতাপ্রত্যাশী দের সেগুলো জিজ্ঞেস করতেন। যাকে শিক্ষকতার যোগ্য বলে বিবেচনা করতেন তাকে তার উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করতেন। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করতেন।

বিভিন্ন বাতিল ফেরকা ও ইসমাইলি মতবাদকে রদ করার জন্য নিজামুল মুলক মাদরাসায়ে নিজামিয়ার আলেমদেরকে লেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন৷ যাতে করে এই লিখিত গ্রন্থসমূহ ভ্রান্ত আকিদার অসারতা প্রমাণ করে দেয়। এবং তাদের আকিদার মাঝে যে সুক্ষ্ণ ভ্রান্তিগুলো, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না সেগুলো স্পষ্ট করে দেয়। একই সাথে তাদের লিখিত পুস্তক সঠিক মাযহাব ও মতাদর্শের দিকে মানুষকে পথ দেখাবে। নিজামুল মুলকের এই মতাদর্শিক আন্দোলনকে সফল করে তোলার জন্য আব্বাসি খেলাফত তাকে নানাভাবেই সহায়তা করে৷

বাতিল ফেরকাগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত সবচে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো ইমাম গাযালির বিখ্যাত রিসালা। যে রিসালায় তিনি ভ্রান্ত আকিদার অসারতা বর্ণনা করেছেন। এই রিসালা তিনি আব্বাসি খলিফা মুস্তাজহিরের অনুরোধে লিখেছিলেন। যার ফলে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, আল মুস্তাজহিরি। এরপর তিনি ইসমাইলিদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট কিছু কাজ করেন। এই সময়ে তিনি উম্মাহর নেতৃত্বের বিষয়ে আব্বাসি খলিফার বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান করছিলেন।

ইসমাইলি মতবাদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মাদরাসায়ে নিজামিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ সেইসাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান বিজ্ঞান ও সঠিক আকিদা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। হিজরী পঞ্চম শতাব্দী জুড়ে নিজামুল মুলকের এইসব সংস্কার আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তার রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অনুযায়ী সেলজুকরা রাজ্য শাসন করতো। পরবর্তী যেসব শাসক এসেছেন তারাও দীর্ঘকাল নিজামুল মুলকের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাহায্যে দেশ পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাসংস্কারের আন্দোলনও ছিল খুবই ফলপ্রসূ ও কার্যকর৷ সে সময়ে জ্ঞানচর্চা জারী রাখার জন্য মাদরাসায়ে নিজামিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খোরাসান, ইরান, ইরাকসহ সমগ্র রাজ্যে নিজামুল মুলক যেসকল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেগুলো কেবল ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না। জনসাধারণের ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে ইসলামী আইন ও অন্যান্য শাস্ত্রে যোগ্য আলেম তৈরি করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নিজামিয়া মাদরাসাগুলো দক্ষতার সাথেই তা আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিল। তবে এর পাশাপাশি তিনি মাদরাসাগুলোয় বিজ্ঞান চর্চার সুযোগও রেখেছিলেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি নিয়ে আসেন তৎকালে বিজ্ঞানের ফলিত শাখার স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের। তিনি বিখ্যাত জোত্যির্বিদ ও বহু প্রতিভার অধিকারী উমর খৈয়ামকে একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করে দেন। তার এই কেন্দ্রটি সমকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক কেন্দ্রগুলির একটি। এখানে বসেই উমর খৈয়াম প্রায় নির্ভুলভাবে তার সৌর ক্যালেন্ডারটি তৈরি করেছিলেন। যেটি সেলজুকি বা জালালী দিনপঞ্জি নামে পরিচিত। আজ থেকে প্রায় ১ হাজার বছর আগে , ৪৭২হিজরী মুতাবেক ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালেন্ডারটি তৈরি হয়।

নিজামুল মুলকের অসাধারণ সাফল্য, প্রবল বুদ্ধিমত্তা, রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা, বিস্তৃত জ্ঞান, প্রজাবাৎসল্য ও ন্যায়পরায়ণতা দেখে ইসমাইলি বাতেনিরা তার উপর প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হতে থাকে। যেহেতু এই মন্ত্রী তাদের সমস্ত চেষ্টা প্রচেষ্টা, আশা ও স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছিল। ইসমাইলি একব্যক্তি দরিদ্র সেজে এসে নিজামুল মুলকের কাছে তার উপর অত্যাচারের অভিযোগ জানায়।

নিজামুল মুলক যখনই তার কাছাকাছি হলেন তখন অভিযোগকারী ব্যক্তিটি তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয়। নিজামুল মুলক ততক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ১০৯২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ৪৮৫ হিজরীর দশম রমজানে নেহাওয়ান্দ শহরের কাছে। তার মৃতদেহ ইস্পাহানে নিয়ে আসা হয়৷ এই শহরে তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে নিজামিয়ায় তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল সাতাত্তর বছর৷


লেখক : 
যায়েদ মুহাম্মদ
ছাত্র, জামেয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াহ

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র


আমাদের কেহ তিতুমীর হয়ে জালিমের কন্ঠ রুখবে...
আজ শহীদ তিতুমীরের ১৮৮ তম শাহদাতবার্ষিকী। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর, আজকের এই দিনে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি (১১৮৮ বঙ্গাব্দ, ১৪ মাঘ) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীরের প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরোধী আন্দোলন ও তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশেরকেল্লাতেই শাহাদাৎ বরণ করেন ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে।

সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী শহীদ (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ড-স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজও এদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ ও নির্যাতনমূলক শাসন নির্মূল করে এ দেশে আদর্শভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন।

তিতুমীরের সাথে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজ সাহেবদের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরের অব্যর্থ নিশানা। ইংরেজ পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। প্রায় ৫০০ জমিদার সৈন্য ও ইংরেজ পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসেন কর্নেল স্কট। ১৮৩১ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাছে পৌঁছে তা ঘিরে ফেলে। বহু গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিতুমীরের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।তিতুমীর অসীম বীরত্বের সাথে এই সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ইংরেজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেল্লার সামনে বীরবিক্রমে জুলুমের মোকাবিলা করে ১৮৩১ সালের ১১ নভেম্বর তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হন তার সঙ্গী-সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইংরেজদের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীতে তিতুমীরের ২২৫ জন অনুসারীর বিচারে জেল হয়।

১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তাঁরা বাঁশেরকেল্লা তৈরি করেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ অঞ্চলের মানুষ মারাঠা আর বর্গীদের দ্বারা লুন্ঠিত এবং পশ্চিমবঙ্গের অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের হাতে নিস্পেষিত হয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ছিল। বাঙ্গালী মুসলমানদের উপর বেশ কয়েকজন হিন্দু জমিদার নানা ধরনের অত্যাচার করত, নিবর্তনমূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মুসলমানদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে পূঁজার পাঁঠা জোগাতে হতো, কেউ দাঁড়ি রাখলে সেজন্য চাঁদা দিতে হতো, মসজিদ নির্মাণ করলে কর দিতে হতো, এমনকি কেউ গরু জবাই করলে তার ডান হাত কেটে দেয়ার ঘটনাও কম ছিলনা। এই পটভূমিতে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের পক্ষে প্রতিবাদের আন্দোলন গড়ে তোলেন মীর নেসার আলী তিতুমীর।

ভারতীয় উপমহাদেশে তখন চলছিল ইংরেজ বিরোধী জিহাদ আন্দোলন। বাংলাদেশ থেকেও জিহাদ আন্দোলনে লোকজন শরীক হতেন। তিতুমীরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যে, বাংলার মুসলমানদের ইমান ও আকিদার দিক থেকে সবল করে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে শক্তিশালী করেই তবে তাদের মধ্যে জিহাদের আহবান জানানো যেতে পারে। তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে তিনি জনগণকে সচেতন করতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারকাজে অভাবিত জাগরণ দেখা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসন সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই দুটি ছিল তাঁর মৌলিক কর্মসূচী। তাঁর আহবান ছিল বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদ সংস্কার করে নামাজের ব্যবস্থা করা, পূঁজার চাঁদা দান কিংবা তাতে অংশ নেয়া থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা, শিরক-বিদায়াত হতে দূরে থাকা, মুসলমানদের মুসলিম নাম রাখা, মুসলমানদের ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি বা পাজামা পরা, পীরপূঁজা ও কবরপূঁজা না করা ইত্যাদি। তিতুমীরের ধর্মীয় দাওয়াতের মূলকথা ছিল, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) নির্দেশ পরিপালন সম্পর্কিত। এটি ছিল মূলত ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুণর্গঠনের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচী।

তিতুমীর থাকতেন সরফরাজপুর গ্রামে। গ্রামবাসীদের ওপর জমিদারের বারবার আক্রমণ ও অত্যাচারের কারণে তিনি নিজেই সে গ্রাম ছেড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে। ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি দলবলসহ নারিকেলবাড়ীয়া গ্রামে যান। সেখানে চারিদিক থেকে অব্যাহত হামলার কারণে তিতুমীর তার আস্তানাটিকে নিরাপদ করার জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত বাঁশেরকেল্লা। নারিকেলবাড়ীয়ার পরিত্যক্ত একটি মসজিদকে সংস্কার করে সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ চালু করেন। তাঁর নেতৃত্বে নদীয়া ও ২৪ পরগণা জেলার অনেক এলাকার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। স্বভাবতই এটা জমিদারদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর সহস্রাধিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে আসেন। তিতুমীর তাঁর অনুসারীদের জীবনরক্ষার্থে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এভাবেই বাঁশেরকেল্লা নামক দূর্গটির নাম ছড়িয়ে পড়ে। নারিকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করতে এসে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার স্বয়ং নিহত হন। শেষে জমিদারদের বাহিনী পিছু হটে যায়।জমিদারদের বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকারের ওপর তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানের পক্ষে চাপ বাড়তে থাকে। খ্রিস্টান পাদ্রী, জমিদার ও নীলকররা অব্যাহতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। শেষে ইংরেজ সরকার তিতুমীরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর মেজর স্কটের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী নারিকেলবাড়ীয়া অবরোধ করে। যুদ্ধ শুরুর আগে ইংরেজ বাহিনী ও তিতুমীরের মধ্যে একটি সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। সংলাপে অংশ নেয়া তিতুমীরের প্রতিনিধি সম্ভবত ইংরেজী জানতেননা। ফলে সংলাপে তিতুমীরের বক্তব্যকে ইংরেজ মেজরের কাছে উপস্থাপন করছিলেন রাজচন্দ্র নামক জনৈক দোভাষী। দুঃখজনকভাবে দোভাষী তিতুমীরের পক্ষে বক্তব্যকে এমন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল যে এতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মেজর স্কট গুলীর নির্দেশ দেন। মূলত ইংরেজ বাহিনীর সুসজ্জিত আধুনিক অস্ত্রের সামনে তিতুমীরের লাঠি আর তীর সড়কি ছাড়া কোন অস্ত্রই ছিলনা। তবে গুলীর মুখে এই দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষগুলি পিছে হটেনি। ইংরেজ বাহিনীর গুলীর মুখে তিতুমীর ও তার সঙ্গীরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। নির্বিচাওে গুলী চালাতে থাকে ইংরেজ সৈন্যরা।

গুলীতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র গরহর আলীসহ ৫০ জন নিহত হয়। ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রাম তল্লাসি করে আরও ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এলাকার বাড়ীঘরগুলিতে আগুন দেয়া হয়। তিতুমীরসহ মৃতদেহগুলিকে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে তাঁদের শহীদ হিসেবে কেউ সম্মান দেখাতে না পারে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৯৭ জনের বিচার হয়। তন্মধ্যে তিতুমীরের প্রধান সহকারী গোলাম মাসুমের প্রাণদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন, ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। বিচারকালে ৪ জনের মৃত্যু হয়। এই অসম যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি নিজেই বলেছেন, যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি সত্য, কিন্তু জীবন দিয়েছে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক এক মহাপুরুষ। তিতুমীর সম্পর্কে ইংরেজ অনেকেই মনে করেন তিতুমীর সাধারণ একজন লাঠিয়াল ছিলেন। আসলে তা নয়, তিতুমীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলার নিরীহ মুসলমানদের এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে বারবার আক্রমণ করে শেষে জীবন রক্ষার জন্য হাতে লাঠি নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। দরিদ্র মুসলিম ও সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কথা বলে তিতুমীর টিকে থাকতে পারেননি সত্য। তাই বলে তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। ঘটনার ২৫ বছর পর ১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতার বিদ্রোহকেও ইংরেজ সরকার নির্মমভাবে দমন করেছিল। সেই ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অত্যাচারী জমিদাররাও আর নেই। আছে শুধু তিতুমীর ও তার বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতিহাস।
-বাশেরকেল্লা ফেইসবুক পেজ থেকে।

শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৯

"যা কিছু করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছি" -প্রফেসর ডক্টর নাজমুদ্দিন এরবাকান


একজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে ওঠা তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রণেতা এবং সাবেক তার্কিশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে খ্যাত সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বুকে জায়গা করে নেয়া এক ব্যাক্তিত্বের নাম মুহম্মদ নাজমুদ্দিন এরবাকান। ৭০-৮০ এর দশকের দিকে তুরস্কের একের পর এক প্রজন্ম যখন তথাকথিত সেক্যুলারিজমের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বেড়ে উঠছে,তিনিই সেই নেতা যিনি ইসলামের পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে আসেন এক জিহাদের উদ্দেশ্যে। সেই জিহাদ নিঃসন্দেহে এক বিপ্লব সংঘটিত করেছিল যা আজও আধুনিক তুরস্কে বহমান। তাকে নিয়ে যতবারই পড়েছি,এখনও পড়ছি,ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। অনেক ব্যাস্ততার মাঝে একটু ফুরসত পেয়ে তাকে নিয়ে কিছু লেখার মন:স্থির করলাম।

নাজমুদ্দিন এরবাকানের কর্মজীবন শুরু তৎকালীন জার্মানির সর্ববৃহৎ ইঞ্জিন ফ্যাক্টরি ডয়েজের লিওপার্ডো ট্যাংকের ইঞ্জিন বিষয়ক প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সেখানে কিছুকাল কাজ করার পর দেশে ফিরে আসেন এবং দেশে ফিরে স্থানীয়ভাবে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে তোলেন 'গুমুশ মোটরস' নামক তুরস্কের সর্বপ্রথম ইঞ্জিন কোম্পানি। এটা ছিল তার জীবনে একটা অনেক বড় সংগ্রাম এবং এজন্য তিনি অভ্যন্তরীণ ইয়াহুদি লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। যদিও চড়াই উতরাই পার করে এই কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় তিনি দেখতে পান যে,দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যাতে কোনভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য সরকারি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এর অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে গুরুত্ব দেন যার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক শক্তির বলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

তুরস্কে ইসলামী আন্দোলনের পদযাত্রা শুরু হয় তারই রাজনৈতিক দল 'মিল্লি গুরুস' এর মাধ্যমে। তিনি বলতেন,'আমি রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত নই,জিহাদ দ্বারা প্রভাবিত'। মিল্লি গুরুস অর্থ হল জাতীয় ভিশন, এটি ছিল প্রতীকী শব্দ কারণ তুরস্কে ইসলামের নামে যে কোন ধরণের সংগঠন করা নিষিদ্ধ ছিল। যদিও তিনি মিল্লি গুরুস দ্বারা সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝাতেন। মিল্লি গুরুসের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল-
আধ্যাত্মিক উন্নতি,অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বিতা এবং অনুগত কামালিস্ট ইউনিয়নের বদলে সাম্যবাদী ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা। মিল্লি গুরুস প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিল্লি নিজাম পার্টি। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রোষানলে পড়ে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর নাম বদলিয়ে গঠন করেন মিল্লি সালামত পার্টি। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার অনুমতি পায় এবং এরবাকান হন উপ-প্রধানমন্ত্রী। তার এই কোয়ালিশন সরকারের সময় ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেয়া থেকে শুরু করে সাইপ্রাসকে গ্রিস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা,নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করা,ব্যাপক কোরআন কোর্স চালু করা,মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া,বিশ্ববিখ্যাত আলেম বদিউজ্জামান সাইদ নূরসীর রিসালায়ে নূরের উপর থেকে নিষধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা,সকল প্রতিষ্ঠানে মসজিদ নির্মাণ করা এবং অশ্লীলতা বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করাসহ তিনি অনেক কাজ করেন। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০তে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকগণ ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে দেয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। অবশেষে ৮৩ সালে তার উপর যুলুম নির্যাতনের অবসান হয় এবং জেল থেকে বেরিয়ে গঠন করেন রেফাহ পার্টি। একাধিকবার তার রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের পর এই পার্টিই অনেকদিন সংগ্রামে টিকে থাকে। ৮৪ সালে রেফাহ পার্টিতে যোগদান করেন বর্তমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং সমগ্র বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় নেতা রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান। ১৯৮৭ সালে গণভোট করে এরবাকানের উপর থেকে রাজনৈতিক নিষধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারো পূর্ণাঙ্গভাবে রাজনীতিতে আসেন এবং রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সভাপতিত্ত্বে রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারই ধারাবাহিকতায় ৯৪-তে এরদোয়ান রেফা পার্টি থেকে ইস্তাম্বুলের সিটি কর্পোরেশনে জয়লাভ করে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে তার দল জয়লাভ করে। কিন্তু এই সরকার মাত্র ১১ মাস ক্ষমতায় টিকতে পারে। পরবর্তীতে এক পোস্ট মর্ডাণ ক্যূ করে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়। এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে ইসলামকে সমৃদ্ধ করার জন্য  একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে সবথেকে বড় উদ্যোগ ছিল ৮টি মুসলিম দেশ নিয়ে D-8 সম্মেলন প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও সুদের হার কমিয়ে আনা,সকলের বেতন বৃদ্ধি,শিল্পায়নে গতি ফিরিয়ে আনা এমন বেশ কিছু উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তিনি রাজনীতিতে একটু আলোর মুখ দেখতেন,তখন থেকেই তার পুনরায় সংগ্রামের প্রহর গোনা শুরু হয়ে যেত। এবার তাকে প্রতারণার মুখে পড়তে হয়। তার উক্ত সফলতায় সেক্যুলাররা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রোপাগান্ডা চালায় ও তার পার্টি শরিয়ত কায়েম করবে এমন অযুহাতে তাকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এই অবস্থায় এরবাকান প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেয়ার ঘোষণা দেন,তবে শর্ত আরোপ করেন যে সে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলে তার কোয়ালিশন পার্টির নেতা তানসু চিলারকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। কিন্তু সেক্যুলারিস্ট ও ইহুদিদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতা সোলায়মান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী করে এবং রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার নীলনকশার চূড়ান্ত পদক্ষেপটি নেওয়া হয় এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। এরপরে এরবাকান হুজার(শিক্ষকরুপে সম্বোধন করে হুজা বলত সবাই) রাজনৈতিক জীবনের পরিসর অল্প এবং কম গুরুত্বপূর্ণ। রেফাহ পার্টি নিষিদ্ধ হলে তারই দলের নেতা রেজাই কুতান ফাজিলত পার্টি গঠন করে যা '৯৯ এর নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ে। ৯৬ সালে ২২% ভোট পেয়ে কোয়ালিশনে আসতে পারলেও '৯৯ সালের নির্বাচনে সেই হার তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

 ১৯৯৯-২০০১ সাল ছিল সম্ভবত তুরস্কের সবচেয়ে বাজে রাজনৈতিক সময়। সেই সময়ই তুরস্ক ইউরোপের রুগ্ন দেশ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কোয়ালিশনে থাকা দলগুলোর মধ্যকার কোন্দল, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ভূমিকম্পে দেশে টালমাটাল অবস্থা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার মতো সামর্থ্য ছিল না সরকারের। ২০০১ সালে এরবাকানের দলীয় নেতাদের মধ্যে মতানৈক্যের অভাব দেখা দেয়। দুইটি ধারার অনুসারীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রবীণ নেতাসহ বেশ কিছু নেতারা গতানুগতিক প্রথা ধরে রাখার অনুসারী ছিল। তারা আবার নতুন নাম করে নতুন একটি দল গঠন করার চিন্তাভাবনা করছিলো। অপর দিকে নবীণ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার নেতারা গত ২০-২৫ বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করে তাদের রাজনীতিতে ভিন্ন কিছু পলিসি ও বৈশিষ্ট্য আনার পক্ষপাতি ছিল। ট্রাডিশনাল ধারার নেতা ছিলেন এরবাকান এবং তাদের প্রবীণ অনুসারীরা। এবং নতুন ধারার অনুসারী ছিল এরবাকানেরই শিষ্য এরদোয়ান ও নতুন এবং উৎসাহী বেশ কিছু নেতা। যদিও তাদের মধ্যকার যেই মূল বিশ্বাস অর্থাৎ ইসলামপন্থী ও জিহাদের রাজনৈতিক আদর্শে কোন ছেদ পড়েনি। এরদোয়ান কনজারভেটিভ ডেমোক্রেসি আদর্শ সংযোজন করে একে পার্টি গঠন করেন এবং মূলধারার রাজনীতিতে এরবাকানের আদর্শ বহমান রাখেন। এরবাকান গঠন করেন সা'দাত পার্টি। ২০০২ সালের নির্বাচনে একে পার্টির ভূমিধস জয় হয়।আল্লাহর শুকরিয়া তখন থেকে এখনও পর্যন্ত এরদোয়ান সফলভাবে তাদের মিশন ও ভিশন চালু রাখতে সমর্থ হয়েছেন এবং আধুনিক তুরস্কে গণতন্ত্র ও কল্যাণকামী একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একে পার্টির উত্তরোত্তর সফলতায় এরবাকানের রাজনৈতিক অবদান ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার আদর্শেরই জয় হয়েছে,তার আদর্শ পূর্ণতা পেয়েছে হোক তা তার শিষ্যের মাধ্যমে। আনুমানিক তার দীর্ঘ ৩০ বছরের সংগ্রামে তিনি যেভাবে তুরস্ক গঠন করতে চেয়েছিলেন বর্তমান তুরস্ক তেমনই হয়তোবা তার থেকেও সুন্দর। তার আদর্শ আজ প্রতিষ্ঠিত। শত ঘাত-প্রতিঘাতময় তার সংগ্রামী জীবন আমাদের এটাই শেখায় যে যতই বিপদ-বিপর্যয় আসুক,থেমে থাকা যাবে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও শুকরিয়া আদায় করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ চিত্তে প্রাণ থাকবে।

তার কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১- আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে সরকারী কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরন
২- পুনরায় মাদ্রাসা স্থাপন
৩- ৫০০০ এর বেশী কুরআন কোর্স চালু করা
৪- সকল স্কুলে দ্বীন ও আখলাক দারস বাধ্যতামূলক করে দেওয়া
৫- মুসলিম দেশসমূহ থেকে পাশ করে আসা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেওয়া। (বর্তমান সময়েও যা নাই। কয়েকটি দেশের সার্টিফিকেটকে এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না)
৬- তুরস্ককে ওআইসির অন্তর্ভুক্তিকরন
৭- ইসলামীক ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন
৮- তুরস্কে সুদ মুক্ত ব্যাংক চালু করা (বর্তমানে যেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অবস্থিত)
৯- ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা। ২৭০ টির বেশি ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
১০- নতুন বৃহৎ তুরস্কের পরিকল্পনা
১১- ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির সামনে ১০০ বছরের বিস্তারিত ভিশন পেশ করা।
১২- তুরস্ক এবং ইরানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা।
১৩- বসনিয়াকে স্বাধীন করার জন্য মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ এবং সেখানে অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করা।
মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত কারখানা-
১৮ টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি,
১৬ টি সার-কারখানা,
১৪ টি চিনির ফ্যাক্টরি...
২৩ টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি
৬ টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরী
৭৭ টি বৃহৎ শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠান
৬৩ টি organized industrial Zone
২৫৩ টি ছোট শিল্প-কারখানা,
৩২ টি বৃহৎ মেশিনারী ফ্যাক্টরী
৪ টি নৌ কারখানা
১০ টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরী
১১ টি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল শিল্প-কারখানা
৩ টি গবেষণা সেন্টার(প্রাকৃতিক সম্পদ)
৪ টি ইলেক্ট্রোনিক শিল্প-কারখানা এবং
সর্বশেষ Taksan প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ছিলো “ফ্যাক্টরী বানানোর ফ্যাক্টরী।” মানে অন্যান্য ফ্যাক্টরী বানাতে হলে যা সরঞ্জাম লাগবে তা এই ফ্যাক্টরি সরবরাহ করবে।
এতো কম সময়ে এরকম উৎপাদন আর কেউ করে দেখাতে পারে নি তার্কির ইতিহাসে।

৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারী সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর কাছে চলে যান মহান এই নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণে লোক হয়েছিল যে,তুরস্কের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয় নি। অফিশিয়াল তথ্য মতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল তার জানাযায়। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,তার মৃত্যুর পর সরকার বিশেষ কোন সম্মানে যেন তাকে দাফন না করা হয়। অতঃপর তার দুই ছাত্র তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান এবং আব্দুল্লাহ গুল লাশের খাটিয়া ধরে তার লাশ বহন করেন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে ভূষিত করা হয়।

তথ্যসূত্র: দাওয়াম:আমার সংগ্রাম; প্রফেসর ডক্টর নাজমুদ্দিন এরবাকান ও উইকিপিডিয়া