Close

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস “ওরা চারজন” || কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ

ওরা চারজন
মেছবাহ উদ্দিন মারুফ 

 মারুফ, আব্দুল্লাহ, তৌহিদ ও আরমান। ওরা চারজন ছোটকাল থেকে খুব ভালো বন্ধু। ওরা যেনো চারজন একই মায়ের সন্তান। গ্রামে নতুন কেউ এলে তারা বুঝতো না এরা বন্ধু নাকি সহোদর, কারণ তাদের চলাফেরা অন্যান্য বন্ধুর মতো না। এরা ছোটকাল থেকে একসাথে খেতো, একসাথে থাকতো। তাদের এই বন্ধনটা যেন চারটি খুঁটি দিয়ে তৈরিকৃত দালান। যার একপাশ ভেঙে গেলে অপর তিনটি পাশ ধ্বসে পড়ার সম্ভবনা আছে। তাদের মাঝেও প্রচুর ঝগড়া হতো, এমনকি মারামারি ও হতো। কিন্তু সকালে ঝগড়া হলে বিকালে আবার তাদের একসাথে খেলার মাঠে দেখা যেত, তাই তাদের মাঝে ঝগড়াঝাটি হলে কেউ তা সমাধান করতে আসতো না, সবাই জানে এরা একটু পর ঠিক হয়ে যাবে, অযথা ওদের কাছে গিয়ে নিজের সময় অপচয় করে লাভ কি! বরং ওদের ঝগড়াঝাটি সবাই উপভোগ করে, ওরা সকালে ঝগড়া করে যখন বিকালে চা খেতে যেতো তখন মানুষ তাদের ব্যাঙ্গ করে বলতো 

-কিরে তোরা না ঝগড়া করলি,ফের একসাথ হয়ে গেলি!

তখন ওরা চারজন বলতো, 

-আমরা একসাথ হলে তোমাদের কি? দেখাও তো আমাদের মতো এমন বন্ধু কোথাও?


 তারা চারজন একই বিদ্যালয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ে ও তাদের একই দশা! এক টেবিলে বসা, একসাথে স্কুলে আসা, স্কুল চুরিসহ তাদের সব কাজ একসাথে হতো। স্যার একদিন ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, তখন এক-এক করে সবার শেষে আসলো চারজন বন্ধুর পালা, এক জনকে ডাকার সাথে সাথে  চারজনই উঠে দাড়ালো, স্যার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো 

-ডাকলাম একজনকে চারজন উঠলি কেন?

তখন চারজন সমস্বরে বলে উঠলো 

-আমাদের চারজনের লক্ষ্য একটাই!

স্যার বললেন, 

-বলতো দেখি তোদের চারজনের লক্ষ্যটা কি?

ওরা আবার সমস্বরে বললো, 

-আমরা চারজনই দেশের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হবো।

তখন স্যার হো হো করে হাসতে লাগলো, স্যারের সাথে ক্লাসের সবাই ও হাসতে থাকলো কিছুক্ষণ। হাসি থামিয়ে স্যার বললো, 

-তোরা দেশের সেরা গোয়েন্দা হবি, আরে বেটা তোরা গ্রামের সেরা গোয়েন্দাও হতে পারবিনা। 

চারবন্ধু খুবই অপমান বোধ করলো, বাকী ক্লাস না করে স্যার যাওয়ার সাথে সাথে ওরা বাড়ির পথ ধরলো। পথেই তারা সিন্ধান্ত নেয়, তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে দেশের সেরা গোয়েন্দা হওয়া। 


এর মধ্যে তারা প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে গেলো, দিনের বেলায় আড্ডা দেওয়া রাতে পড়াশোনা করেই তাদের সময় যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলো আরমান। কোনো কথা শুনলে চটপট উত্তর দিতো না, অনেক ভেবে চিন্তে সঠিক উত্তরটি দিতো। এলাকায় এবং স্কুলে তার সম্মান ছিলো মেধাবী ছাত্র হিসেবে, স্কুলের বাবুল স্যার তো তাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে ডাকতো। আর বাকী তিন বন্ধু মোটামুটি মেধাবী ছিলো, তাঁর মধ্যে কিছুটা হাবলা প্রকৃতির ছিলো মারুফ। 

সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা, তাই স্কুলের স্যারেরা চায় তাদের নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে। যেনো ছাত্রদের মন প্রফুল্ল থাকে, পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে পারে। বাবুল স্যার ক্লাসে আসলেন এবং এক-এক করে সবার মতামত নিলেন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। যে যার মতো করে মতামত দিলো। স্যারের মতামত গুলো মনপুত হলো না। স্যার তখন বলে উঠলেন

-আমার আইনস্টাইন কোথায়? তাকে দেখছি না যে? আজ আসেনি? 

ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে আরমানের কন্ঠস্বর শোনা গেলো, 

-স্যার আসতে পারি? 

তখন স্যার 'অবশ্যই' বলে অনুমতি দিলেন। আরমান শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলো এবং বসে পড়লো। তখন স্যার আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার এতো দেরি হলো কেন বলোতো? 

-স্যার রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো, তাই আসতে দেরি হলো।

আবারো স্যার বললো, 

-তোমায় ছাড়া একটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারছি না। আমরা স্কুল থেকে ঘুরতে যাবো তোমাদের নিয়ে, বলোতো কোথায় যাওয়া যায়? 

তখন আরমান বিনয়ের সাথে বললো, 

-স্যার আমায় একটু সময় দেওয়া যায়?

স্যার বললেন, 

-অবশ্যই, তুমি ভেবে আমাকে বলো। ছুটির সময় আমি আবার আসবো তোমার মতামত জানতে, কারণ আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। 

এই বলে স্যার চলে গেলেন। 


আরমান অনেকক্ষণ ভেবে সিন্ধান্ত নিলো এবার তারা জঙ্গলে যাবে। স্যার এলেন ছুটির সময় আবার আরমানের মতামত জানতে, এসে বললেন, 

-বাবা তোমার মতামত জানাও। 

তখন আরমান বললো 

-স্যার আমরা জঙ্গলে যেতে চাই। 

তখন স্যার মুখে প্রফুল্লতা এনে বললেন, 

-আমি জানতাম, আমার আইনস্টাইন ছাড়া কেউ এই সমাধান দিতে পারবে না!


স্কুল থেকে যাওয়ার তারিখ ঠিক হলো, তারিখ অনুযায়ী সবাই তৈরি হয়ে নিলো। কে জানতো? আরমানের দেওয়া মতামতটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

স্কুল থেকে গাড়ি ছাড়লো ছয়টা নাগাদ, তারা জঙ্গলে পৌঁছায় দশটার দিকে। স্যার আরমানকে দায়িত্ব দিলো সবাইকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। আরমান বাস থেকে নেমে সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করালো এবং সকলের উদ্দেশ্য বললো, 

-প্রিয় বন্ধুরা, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছি। আজ আমাদের আনন্দের দিন, তবে জঙ্গলে চলার পথটা অত্যন্ত দুর্গম তা  আমাদের সকলের জানা। তাই সবাইকে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে চলাফেরা করতে হবে এবং দলবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করবে। 

তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

-অবশ্যই। 

এরপর আরমান সবাইকে সাত দলে ভাগ করে দিলো এবং প্রত্যেক দলের সাথে দিলো একজন করে শিক্ষক। আর ওরা চারজনে মিলে করলো একদল, তারা সবার পিছনে থাকবে। 


খুব সুন্দরভাবে চলতে থাকলো ওদের জমকালো আয়োজন। এরমধ্যে তারা চলতে লাগতো জঙ্গলের ভেতর। পথিমধ্যে হঠাৎ আরমান চলে যায় প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তিন বন্ধু দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আরমানের জন্য, কিন্তু আরমানের আসার কোনো খবর নাই। এইদিকে তিন বন্ধু দাড়িয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে তারা আরমানকে খুঁজতে লাগলো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধা ছুঁইছুঁই। এখনো আরমানের কোনো হদিস মেলেনি।ঘোরাঘুরি পর্ব শেষে সবাই আগের জায়গায় একত্রিত হলো, কিন্তু এই চার বন্ধু কোথায় গেলো? এখনো আসছে না কেন? সবাইকে একরাশ চিন্তায় ঘিরে ধরলো। সবাইকে এক জায়গায় রেখে বাবুল স্যার একাই গেল তাদের খুঁজতে, কিছু দুর যাওয়ার পরে আরমানকে ছাড়া বাকি তিনজনকে পেল খুবই বিমর্ষ অবস্থায়! স্যার তাদের কারণ  জিজ্ঞেস করলে তারা ঘটনার বিস্তারিত জানায়, স্যারসহ আরমানকে খুজতে থাকে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হঠাৎ একটি কর্কশ আওয়াজ শুনতে পায়, 

-হে পথচারীরা তোমরা এই নিষিদ্ধ জঙ্গলে কেন এলে? দ্রুত তোমরা পালাও না-হয় সবাই মরবে!

এই বলে কন্ঠটি মিশে গেলো, এরপর একটু দুরে তীব্রবেগে  আগুন জ্বলে উঠলো। তারা ভয় পেয়ে সেই জায়গাটি ত্যাগ করলো। মনের ভিতর একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। গাড়ির মধ্যে কারো কোনো কথা নেই, ড্রাইভার যেন কতগুলো লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন নিজ গন্তব্যে এলো, যে যার মতো করে বাড়ির পথ ধরলো আনন্দের দিনটা তাদের বিষাদে পরিণত হলো। বহু পত্রিকায় ছাপানো হলো আরমানের নিখোঁজ সংবাদ, কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারেনি। 


বাকি তিন বন্ধুর বেহাল দশা! খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, বয়সের চাপে তাদের দেহ যেন নুয়ে পড়েছে! সবাই বুঝাচ্ছে আরমান একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ওরা কিছুই মানতে চায়না আরমান কে ছাড়া। 

এভাবে কিছুটা দিন পেরিয়ে গেলো হঠাৎ করে একদিন মারুফের মোবাইলে একটা কল আসলো। কলটি রিসিভ করতে পারেনি বাইরে ছিলো বিধায়। এসেই কল দিলো, ওপার থেকে ভেসে আসলো চিরচেনা কন্ঠ! তা হলো তার বন্ধু আরমানের। তাদের কথা শেষ হলো তিন চার বাক্যে। তা হলো, 

-দোস্ত আমি এখনো বেঁচে আছি, যেখান থেকে হারিয়ে গেছি ঠিক ঐখানে চলে আস আজ রাত দুটোর মধ্যে। রঙ মাখানো ইটের নিচে একটা কাগজ পাবি, ঐ অনুযায়ী কাজ করিস, বিদায়! 

বলে কলটা কেটে দিলো। মারুফ আব্দুল্লাহ এবং তৌহিদকে ব্যাপারটি জানালো। তারা কেউ বিশ্বাস করছে না, বললো

-বন্ধু মজা করা ঠিক না কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। 

তারা মানতে চাইছে না কোনো কিছুতেই, একটা পর্যায়ে মারুফ রেগেমেগে বললো তোরা থাক আমি একাই যাচ্ছি ওর উদ্ধারকাজে, এখন চলি এই বলে সে হাঁটা ধরলো। ওরা তখন চিন্তা করলো, মারুফ তেমন একটা রাগ করেনা, যখন ওর হৃদয়ে লাগে ঠিক তখনই রাগ করে। তাই তারা মারুফের পিছু নিলো। দেখলো কিছুদূর যাওয়ার পরে মারুফ চোখ মুছতেছে। তখন তারা ভাবলো, মারুফের কথাটি সত্য, না-হয় কান্না করতো না। কারণ অতি অল্পে কখনো মারুফ কাঁদেনা, তারা ছোটকাল থেকে তাকে চেনে। তারা সামনে গিয়ে বললো, 

-দোস্ত চল আমরাও যাবো। 

মারুফ তখন বললো, 

-তোরা গেলেও আমি নেবো না। গেলে নিজেদের মতো যা, আমি আমার মতো গেলাম। 

ওরা ভালোভাবে জানে মারুফকে যতই রিকুয়েষ্ট করুক, আর লাভ হবেনা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাকে ফলো করবে যখন সে বের হবে তখন তার পিছু নেবে।যেই কথা সেই অনুযায়ী কাজ। ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো কতক্ষণে বাহির হয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে রাত বারোটা, তার বাহির হওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। তৌহিদ বললো, 

-দোস্ত, মারুফ আমাদের সেইরকম ভাবে বোকা বানালো! বুঝলি? চল বাড়ি চলে যাই

-আব্দুল্লাহ বললো, না বোকা বানায়নি। তার চোখের জল মিথ্যা না। মন চাইলে চলে যা, আমি যাবো না। প্রয়োজনে সারারাত এখানে বসে থাকবো। 

তৌহিদও আর কিছু না বলে বসে রইলো।ঠিক বারোটা ত্রিশ মিনিটে  মারুফের দরজার আওয়াজ হলো, তখন আবদুল্লাহ বললো, 

-ঐ দেখ মারুফ বাহির হচ্ছে। 

তখন তারা কিছুটা দুরত্ব নিয়ে পথ চলতে থাকলো। মারুফ যখন বাইকে উঠলো তখন ওরা বললো, 

-কিরে আমাদের নিবি না? 

মারুফ বললো, 

-নিজের মতো করে যা।

মারুফ বাইক স্টার্ট দিলো, তৌহিদও  আবদুল্লাহ কে সাথে নিয়ে আরেকটা বাইক স্টার্ট করে রওয়ানা দিলো।


দেড়টার মধ্যে সেই স্থানে পৌঁছে যায় ওরা, বাইক দুটোকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসলো এবং সেই জায়গায় গেলো যেইখান থেকে আরমান হারিয়ে গিয়েছিল। ওখানে আরমানের কথা অনুযায়ী রঙ মাখা ইট থাকার কথা, কিন্তু তা পেলোনা! হঠাৎ তৌহিদ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো এবং মৃদু চিৎকার করলো। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো একটা রঙিন ইট, তখন মারুফ কে  বললো, 

-এইতো রঙিন ইট পেয়ে গেছি। 

মারুফ বললো, 

-ধাক্কা খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোকে। 

তখন ইটটি উল্টালো, আরমানের কথা অনুযায়ী একটা কাগজ ফেলো।আব্দুল্লাহকে পড়তে দিলো, আবদুল্লাহ চিঠি খানা পড়তে লাগলো:

"প্রিয় বন্ধুরা,

প্রথমে আমার সালাম নিস, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি যখন প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই, ঠিক তখন মৃদু আওয়াজে একটি মেয়েলি গলা শুনতে পাই, বাঁচাও বাঁচাও! একবার দুইবার নয় অনেকবার শুনতে পাই, তাই আমি আগ্রহী হয়ে সেদিকে যাই। তখন যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলামনা! দেখলাম, একটি মেয়েকে বস্তাবন্দি করা হচ্ছে। তখন আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, তোমরা কারা? কাপুরুষের মতো কেনো একটা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও ওকে। তারা বললো, তুই কেরে? আর নিষিদ্ধ জঙ্গলে কি করিস? আমি কিছু বলতে যাবো তখন শক্ত কিছু একটার বাড়ি অনুভব করলাম। আমি অজ্ঞান হইনি, কিন্তু ওরা ভেবেছিলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। এই সুযোগে আমি ওদের কিছু কথোপকথন শুনে নিয়েছি। একজন বলতেছে মেরে রেখে যাই। আরেকজন বলতেছে তুই জানিসনা এইখানকার কিছুই, বসের হুকুম কেউ অমান্য করেনা। চল একে বসের কাছে নিয়ে যাই। আমাকে তারা কিছু সবুজ ঘাসের সামনে রাখলো। এরপর একটি লোহার ধাতু নিলো বট গাছের নিচ থেকে। সেটা দিয়ে বৃত্তাকারে মাটি খনন করলো এবং দুজনে ধরাধরি করে একটি গামলা উঠালো। তখন দেখলাম একটি সুড়ঙ্গ পথ, যেখানে আছে দুটো সিড়ি একটা লাল অপরটি সবুজ তারা সবুজটি দিয়ে নামলো এবং ভয়ংকর আওয়াজে সাইরেন বেজে উঠলো। এরপর আমাকে এবং মেয়েটিকে ধপাস করে নিচে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করিনি ভয়ে। কারণ তারা জানে আমি অজ্ঞান। তাদের বস লোকটি বললো কিরে রাহুল শিকার আনতে গেলি একটা, এখন নিয়ে এলি দু'টো ব্যাপারটা কি খুলে বলতো দেখি, তখন রাহুল পুরো ঘটনা বললো। মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো এবং বস লোকটা বললো মালটাকে স্পে কর। আমাকে কি দিয়ে স্পে করলো জানিনা, তবে প্রথম স্পেতে আমি পচন্ড রকম কেশে উঠলাম। তখন বস লোকটা চিৎকার মেরে বলে উঠলো, রাহুল মালটা এনে ভালো কাজ করছিস, এর নার্ভ অনেক ভালো। যেখানে পাঁচ ছয়বার স্পে করার পরেও জ্ঞান ফিরানো কষ্ট হয়ে যায়। আর সেখানে একবারে ওর জ্ঞান ফিরে এলো। একে আমাদের কাজে ব্যবহার করবো। বস লোকটা রাহুলকে বললো এর মুখে আর স্পে করিস না, শুধু পানি ছিটা, রাহুল আমার মুখে পানি ছিটাতে লাগলো। আমি চিৎকার মেরে উঠে দাড়াই বলতে থাকি আমি এখন কোথায়? বস লোকটা বললো, দেখো যুবক আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো তার যদি ঠিকঠাক উত্তর দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো, না-হয় এখানে পঁচে মরতে হবে তোমায়। বলো, এখানে কেনো এসেছো? আমি শিক্ষা সফরে এসেছি  বলেছি এবং নানাবিধ কথা জিজ্ঞেস করার পরে এবার জিজ্ঞেস করলো পড়াশোনার ব্যাপারে কোথায় পড়ি কোন শ্রেণীতে পড়ি, আমি যখন বলেছি এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন ওর চোখ গুলো রসের গোল্লার মতো করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো কোন বিভাগ? আমি যখন বললাম বিজ্ঞান, তখন সে রাহুলকে বললো ঠিক লোককে নিয়ে এসেছিস। এবার সামান্য একে স্মৃতি হারানোর ইনজেকশনটা পুশড করে দে। আমি তার দিকে ভয়ার্ত চেহারায় তাকালে সে বাছাধন ভয় পেয়োনা অল্প কিছুক্ষণ কষ্ট হবে। এরপর তুমি আমাদেরই একজন হয়ে যাবে। এই বলে বস লোকটা চলে গেলো, রাহুল আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো একটা রুমে। যে রুমটা গ্লাস দিয়ে তৈরি, সেখানে অনেক গুলো মানুষ দেখতে পেলাম তারা আমায় দেখে বলে উঠলো রাহুল আমাদের নতুন অতিথি এলো বুঝি। রাহুল তাদের থেকে দুজনকে ডাকলো ইশারায় এবং বললো আমাকে শক্ত করে ধরতে। রাহুল আমার দিকে আগাচ্ছে  একটা ইনজেকশন নিয়ে পুশড করবে এইসময় আমি আমাকে ধরে রাখা দুজনকে সজোরে লাথি মারলাম, তখন তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাহুল কোনো দিকে না তাকিয়ে আমায় শক্ত করে ধরে ইনজেকশনটা পুশড করে, আমার নড়াচড়ার কারণে ইনজেকশনটা তোশকে পুশড হয়ে যায়, মনে হয় এখনো তোশকটি স্মৃতি হারিয়ে আছে। ইনজেকশন যে আমার শরীরে পুশড হয়নি তা রাহুল জানতো না। আমিও আমার স্মৃতি হারিয়ে ফেলছি ঐরকম অভিনয় করি। তাদের সকল কথা মেনে চলি, যা করতে বলা হয় তাই ঠিকঠাক ভাবে করে দিই। এখন তারা জানে আমি তাদের আওতাধীন। আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাহির হয়। চাইলে তখনই পালিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমি আসিনি তাদের পরিকল্পনা আমি জেনে গেছি তাই। আসি নাই কারণ তারা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র। যারা বিশ্ব দখল করতে চায়। তাই তারা বিশ্বের জ্ঞানী লোকদের নিয়ে এসে ইনজেকশন পুশড করে নিজেরদের অধীনে  নিয়ে আসে।আমি চাচ্ছি তাদের ঘৃণ্য স্বপ্ন প্রাসাদ ভেঙে দিতে। কারণ ওদের সকল ডকুমেন্ট আমার হাতে। এই যাত্রায় তোদের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই আজ সকালে মারুফকে কল করি, এরা এখানকার সকল দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেছে। আর তিনজন প্রহরী রেখে গেছে, তোরা চাইলে রাত দুটোয় আঘাত হানা সম্ভব, তোরা যেখানে আছিস, সেখান থেকে দুইশো হাত সামনে হেটে আয়। এরপর একটা বটগাছ পাবি, তার নিচে পাবি লোহার একটা ধাতু সেটা দিয়ে সবুজ ঘাসের চারদিকে বৃত্তাকারে খুঁড়ে ফেল ভালোভাবে। একটা গামলা পাবি দু'জনে শক্তকরে গামলাটি উঠা। এরপর লাল সিড়ি দিয়ে নামবি কারণ লাল সিড়ি শুধু তাদের বসের ব্যবহারের অনুমতি আছে অন্য কারো না, তাহলে শুরুতে বিপদ মুক্ত ভাবে আসতে পারবি। নেমেই দুজন প্রহরী দেখতে পাবি তারা তোদের কুর্নিশ করতে আসবে বস ভেবে। তখনই তাদের মোকাবিলা করবি সুন্দর ভাবে। চিৎকার মেরে বলতে থাকবি, শুভ কোথায় তোরা? এই অবস্থা কেনো আস্তানার? তখন শুভ আসলে মুখ চেপে বেধে অজ্ঞান করে দিবি। বাকি যা করার আমি করবো। আজ এই পর্যন্ত রাখি।"

আবদুল্লাহ পড়া শেষ করলে সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সবাই একসাথে বলে উঠলো, 

-বাবুল স্যার ঠিকই বলতো, আরমান হলো আমাদের আইনস্টাইন। 

এরমধ্যে মারুফের মনে পড়লো তার দুলাভাইয়ের কথা। তার দুলাভাই শীর্ষ পর্যায়ের সিআইডি অফিসার, সে দেরি না করে দুলাভাইকে ফোন দিলো এবং তাদের লোকেশন জানিয়ে রাখলো। বললো, আগামী দুই ঘন্টার ভিতরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এই বলে কল কেটে দিয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। 

তারা অভিযানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আরমানের দেওয়া চিত্র অনুযায়ী তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছলো। প্রহরী তিনজনকে অজ্ঞান করে বেঁধে রাখলো। এরপর ওরা আরমান কে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে এবং যাবতীয় ডকুমেন্ট নিয়ে নিলো এবং প্রাসাদের তালা মেরে উপরের দিকে চলে আসলো। কিছুদুর যাওয়ার পরে মারফের দুলাভাই কে দেখলো একটা জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বললো, 

-এতো রাতে না আসলে ও পারতেন। 

তখন তিনি বললেন, 

-সিআইডির কোনো রাতদিন নেই। তাদের জন্য সর্বক্ষণই হলো দিন। 

মারুফের দুলাভাই আরমানের সাথে কথা বললো এবং বিস্তারিত জেনে নিলো। সাথে সাথে পুলিশ হের্ডকোয়াটারে ফোন দিয়ে জানালো এবং বললো একটি কম্পিউটার সহ পুলিশ পাঠানোর জন্য। পুলিশ আসলো কম্পিউটার নিয়ে। কম্পিউটার আরমানের নিয়ে আসা হার্ডডিক্সটি সেট করা হলো, তাতে যা দেখলো পুলিশ রীতিমতো হয়ে গেলো। এতো সহজে সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। সাথ সাথে হার্ডডিক্সটির কপি পাঠানো হলো পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি তা পেয়ে রীতিমতোই বিস্মিত! চাকরির বয়সে তিনি অনেক সন্ত্রাসী ধরেছেন কখনো এতো খুশি হননি। হার্ডডিক্স কপি পাওয়ার পরে, তিনি সারাদেশে একযোগে অভিজান চালিয়ে পুরো সন্ত্রাসী চক্রকে ধরে ফেললেন এবং তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করেন। সেই সাথে চার বন্ধুকেও নিয়ে যান। এই বিষয়টি সরকারকে যখন জানানো হয় তখন তিনি সরেজমিনে চলে আসেন চার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। 


এইদিকে মারুফ, আবদুল্লাহ, তৌহিদের মা-বাবা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তিনটা ছেলে কোথায় গেলো? মারুফের দাদা যখন টিভি চালু করলো তখন দেখলো তার নাতিসহ চারজন বন্ধুর ছবি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে। আর সব সংবাদ মাধ্যম গুলো বারবার প্রচার করতে লাগলো আজকের টপ নিউজ, "বিশ্ব পেলো চারজন সাহসী যুবক, যাদের হাতে ধরা পড়লো শীর্ষ সন্ত্রাসী চক্র। যাদের সাক্ষাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত।" তখন মারুফের দাদা তার ছেলে ও বউকে বললো আমার নাতি কোথাও যায়নি ঐ দেখো টিভিতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মারুফের বাবা বললো, 

-বাবা কি আজেবাজে বকছো, তুমি ঠিক আছো তো? 

তখন মারুফের দাদা গরম হয়ে বললো,

 -আমি ঠিক আছি, যা ঐ দেখ টিভিতে।

একরকম বিরক্তি নিয়ে মারুফের বাবা টিভির সামনে এলো তিনি যা দেখলেন তারজন্য প্রস্তুত ছিলেননা! দেখলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছেলেসহ বাকি তিনজনকে ফুলের মালা পড়াচ্ছেন। নিজের চোখ যেনো বিশ্বাস করতে চাইছে না। চোখ কচলিয়ে আবার দেখলো ঠিকতো সব চ্যানেলে এক যোগে তাই দেখাচ্ছে। এরমধ্যে মারুফের দুলাভাই ফোন করলো, তিনি সব বুঝিয়ে বললেন। তাদের কাজে সারাবিশ্বে হৈচৈ পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের গোয়েন্দা হিসেবে নেওয়ার জন্য একের পর অফার আসতে থাকে, কিন্তু তারা কোনোটিকে গ্রহণ করেনি।তাদের একটাই কথা যা করবে তারা দেশের জন্যই করবে। তাদের জন্য একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যেখানে অতিথি হিসেবে থাকবেন আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ। জমকালো আয়োজন করা হলো এবং সেইদিন তাদের দেশের শীর্ষ পর্যায়ে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। এরমধ্যে তারা কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে, মা-বাবার সাথে দেখা করবে বলে। সে খবর শুনে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া জন্য এলাকার মানুষেরা অনুষ্ঠান করে বসে আছে। তারা আসা মাত্র সংবর্ধনা দিয়ে চমকে দেবে। আর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সেই স্যারটি।

তারা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই ফুল দিয়ে বরণ করলো বাবুল স্যার। তখনও তিনি বললেন, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি? 

এই বলে তিনি হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। আরমান বললো,

 -স্যার, আমি এসেছি। আজ আপনার কাঁদার দিন নয়, হাসবার দিন। তখন স্যার বললেন, 

-বাছা, এ আমার সুখের কান্না। এ আমার বিজয়ের কান্না।

কথাগুলো বলে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। প্রাইমারি স্কুলের স্যারটিকে তারা চার বন্ধু পা ছুঁয়ে সালাম করলো এবং তাদের সবার মা-বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। স্যারকে ওরা বললো, 

-স্যার, আমরা তো সার্টিফিকেট বিহীন গোয়েন্দা হয়ে গেলাম। তখন স্যার একটা কথাই বললেন,

-সবাইকে তোদের মতোই দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত!



লেখক:
কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ
সোনাগাজী, ফেনী
প্রথম প্রকাশকাল: ২০১৯ ইং, মাসিক কিশোরপাতা।