Close

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪

দারসুল কুরআন: সুরাতুল বাক্বারাহ || ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত || মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি


মাহে রমজান এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়মাবলি

দারসুল কুরআন | সুরা আল বাক্বারাহ | ১৮৩নং থেকে ১৮৬নং আয়াত
•আরবি ইবারত:
১৮৩:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ
১৮৪:
اَیَّامًا مَّعْدُوْدٰتٍ١ؕ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِیْضًا اَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ١ؕ وَ عَلَى الَّذِیْنَ یُطِیْقُوْنَهٗ فِدْیَةٌ طَعَامُ مِسْكِیْنٍ١ؕ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَیْرًا فَهُوَ خَیْرٌ لَّهٗ١ؕ وَ اَنْ تَصُوْمُوْا خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
১৮৫:
شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَـٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ‌ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ‌ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ‌ۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَٮٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
১৮৬:
 فَإِنِّى قَرِيبٌ‌ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِ‌ۖ فَلْيَسْتَجِيبُواْ لِى وَلْيُؤْمِنُواْ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ


•সরল বাংলা অনুবাদ:
১৮৩:
 হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।
১৮৪:
এ কতিপয় নির্দিষ্ট দিনের রোযা। যদি তোমাদের কেউ হয়ে থাকে রোগগ্রস্ত অথবা মুসাফির তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এই সংখ্যা পূর্ণ করে। আর যাদের রোযা রাখার সামর্থ আছে (এরপরও রাখে না) তারা যেন ফিদিয়া দেয়। একটি রোযার ফিদিয়া একজন মিসকিনকে খাওয়ানো। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে কিছু বেশী সৎকাজ করে, তা তার জন্য ভালো। তবে যদি তোমরা সঠিক বিষয় অনুধাবন করে থাকো তাহলে তোমাদের জন্য রোযা রাখাই ভালো।
১৮৫:
রমযানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাত পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোযা রাখা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় বা সফরে থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোযার সংখ্যা পূর্ণ করে। আল্লাহ তোমাদের সাথে নরম নীতি অবলম্বন করতে চান, কঠোর নীতি অবলম্বন করতে চান না। তাই তোমাদেরকে এই পদ্ধতি জানানো হচ্ছে, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূর্ণ করতে পারো এবং আল্লাহ‌ তোমাদের যে হিদায়াত দান করেছেন সেজন্য যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে ও তার স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
১৮৬:
আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে। 

নামকরণ:
সূরায়ে বাকারায় অষ্টম রুকুতে বণী ইসরাইলদের প্রতি- إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً - নির্দেশ দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সূরার নামকরণ করা হয়।
 

শানে নুযূল: 
হযরত সালমা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বর্ণনা করেন যে-
 وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطَيْقُونَهُ فَدْيَةٌ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল, যার ইচ্ছা হয় সে রোযা রাখতে পারে আর যে রোযা রাখতে না চায় ফিদিয়া দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ নাযিল হলো, তখন ফিদিয়া দেয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ সামর্থ্যবান লোকদের ওপর শুধুমাত্র রোযা রাখাই জরুরী সাব্যস্ত হয়ে গেল এবং বলা হলো যে, রোযা শুধুমাত্র তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি বরং পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও ফরয ছিলো। অতএব তোমাদের যার জীবনেই এটা পাবে অবশ্যই তাকে রোযা রাখতে হবে।

এ সূরাটি নাযিল হওয়ার আরো উল্লেখযোগ্য কারণ হল প্রথমতঃ ইহুদীদের ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের সামনে ইসলামের মূলনীতি উপস্থাপন। 
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষণা। 
তৃতীয়তঃ কাফেরদের সর্বাত্মক বিরোধীতার মোকাবিলার পদ্ধতি। 
চতুর্থঃ মুনাফিকদের চরিত্র বিশ্লেষণ।

আলোচ্য বিষয়:
১. 'সাওম' ইসলামের মৌলিক ইবাদত, এ অংশে তার গুরুত্ব ও বিধি বিধান শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
২ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে 'তাকওয়া' অর্জন করে কুরআন বুঝার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন।
৩. কুরআন নাজিলের কারণেই যে রমযান মাসের এত গুরুত্ব সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।

•শাব্দিক অর্থ ও তার ব্যাখ্যা:
كتب (কুতিবা) ফরয করে দেয়া হয়েছে। লিখে দেয়া হয়েছে। আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

الصَّيَامُ এটা صَوْمٌ সাওম শব্দের বহুবচন। আর সাওম শব্দের অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় 'সুবহেসাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা-সাথে সাথে সকল প্রকার রিপু বন্ধ রেখে আল্লাহ্ ও রাসূলের যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা।

قلكُمْ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের, অতীত জমানার লোকদের, পূর্বেকার যুগের লোকদের। এখানে অন্যান্য নবীগণের উম্মতদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

تَتَّقُوْن (তাত্তাকুন) তাওয়া অর্জন করবে, খোদাভীরু হবে, পরহেজগারী অবলম্বন করবে, আল্লাহভীতি অর্জন করবে, সংযমশীল হবে।

أَيَّامًا مَّعْدُودَات গনা কয়েকদিন, কতেক দিন, নির্দিষ্ট দিন, সুনির্ধারিত দিন। এখানে 'আইয়ামাম মা'দুদাত' বলে রমযান মাসের নির্ধারিত দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে।

مريضًا (মারিদান) রুগ্নাবস্থা, অসুস্থ, এমন অসুস্থতা যাতে সাওম পালন করার কারণে তার রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। ডাক্তার সাওম না রাখার পরামর্শ দিতে পারে।

سفر (সাফারিন) সফর অবস্থা, ভ্রমণ অবস্থায়, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুসাফির ঐ ব্যক্তিকে বলে, যিনি ৪৮ মাইল বা ৭৩ কিঃ মিঃ (প্রায়) পথ অতিক্রম করেন।

فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخْرَ উপরোক্ত দু'অবস্থা তার যতদিন থাকবে, আল্লাহর নির্দেশ হলো সে অন্য মাসে ততদিন রোযা রাখবে।

فدْيّة বদলা, পরিবর্তে যা দেয়া হয়। এখানে রোজা না রাখলে তার' বদলা তথা ফিদিয়া দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهُ থেকে আয়াতের শেষাংশটুকু ইসলামের প্রাথমিক যুগে লোকজনের রোযায় অভ্যস্ত করানোর উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে এর পরের আয়াত (১৮৫ নং আয়াত) অবতীর্ণ করে উপরোক্ত হুকুম রহিত করা হয়।
الزل নাযিল করা হয়েছে। অবতীর্ণ করা হয়েছে, এখানে انزل বলতে এক সাথে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ করার কথা বুঝানো হচ্ছে।
بینت (বাইয়েনাত) দলিল প্রমাণসমূহ, বিস্তারিত, বিশ্লেষণ, হিদায়াতের নির্দেশিকা বা নীতিমালা।

الْفَرْقَانِ (আলফুরক্বান) পার্থক্য সূচনাকারী গ্রন্থ, যে গ্রন্থ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এখানে মহাগ্রন্থ আলকুরআনকে বুঝানো হচ্ছে। এটা কুরআন এর একটি নামও বটে।

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ (ফামানশাহেদা মিনকুম) অতঃপর তোমাদের মধ্য হতে যে কেউ এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে। এ মাসে উপস্থিত থাকবে। রমযান মাস পাবে।

ٱلْيُسْرَ (ইউসরা) মূল ধাতু হচ্ছে 'ইউসরুন', অর্থ-সহজ আরামদায়ক, সহনশীল, ভারসাম্যপূর্ণ, সরল ইত্যাদি।

ٱلْعُسْرَ (উসুরুন) কাঠিন্যতা, এর বিপরীত শব্দ অর্থ সহজ-সরল নয় বরং কঠিন, সাধ্যের বাইরে।

لِتُكْمِلُوا الْعَدَّةَ যাতে তোমরা কাজা রোযার দিন পরবর্তীতে পুরো করে নিতে পারো। এজন্য কাজা করার সিস্টেম করা হয়েছে।

وَتُتُكْبَرُوا اللَّهُ যাতে করে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা করতে পারো। আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে পারো।

•রমজান (রোজা) সম্পর্কিত আলোচনা:

১. সাউম সংক্রান্ত শরয়ী বিধান:
ক) সাউম কাকে বলে: রোযাকে আরবী ভাষায় 'সাউম' বহুবচনে সিয়াম বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ হলো কোন কিছু থেকে বিরত থাকা বা কোন কিছুকে পরিত্যাগ করা।
ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষায় সাউম হলো সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থেকে আল্লাহ্ ও রাসূলের নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।

খ) সাউম এর প্রকারভেদ: ইসলামী শরীয়াতের নিয়মানুযায়ী প্রাথমিকভাবে সাউম দুই প্রকার-

এক. ইতিবাচক (Positive)
দুই. নেতিবাচক (Nagative)

এক. ইতিবাচক সাউম আবার চার প্রকার-
ক) ফরয, খ) ওয়াজিব, গ) সুন্নাত, ঘ) নফল,

ক. ফরয : যা পবিত্র মাহে রমযানের (চন্দ্রমাস) একমাস আদায় করা হয়।
খ. ওয়াজিব: মান্নত বা কাফফারার সাউম।
গ. সুন্নাত: নবীকরীম (সাঃ) যা নিজে করতেন এবং উম্মাতের প্রতি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন যেমন আশুরার, আরাফার দিনে ও আইয়ামে বীযের ইত্যাদি।
ঘ. নফল: উল্লেখিত তিন প্রকার ব্যতীত সকল ইতিবাচক সাউমই নফল। যেমন শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা।

দুই. নেতিবাচক সাউম দুই প্রকার:
ক) মাকরুহ, খ) হারাম,

ক. মাকরুহ: যে কোন একদিন নির্দিষ্ট করে সাউম পালন করা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল সাউমও মাকরুহ।
খ. হারাম: বছরের পাঁচ দিন সাউম পালন করা হারাম। দুই ঈদের দুই দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। আইয়ামে তাশরীক হলো ১১, ১২, ও ১৩ই জিলহাজ্ব।

গ. সাওম ফরয হওয়ার সময়-কাল: হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় উপনীত হলেন তখন তিনি আশুরার রোযা পালন করেন এবং সাহাবীগণকে তা পালন করার নির্দেশ দেন। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রমযানের রোযা ফরয হয়। রমযানের রোয়া ফরয হওয়ার পূর্বে 'আশুরার' রোযা ফরয ছিল। হিজরতের পর 'আইয়ামুল বিয' এর রোযা ফরয করা হয়েছে। এরপর রমযান মাসের রোযা ফরয হওয়ায় 'আশুরার' ও 'আইয়ামুল বিযের' রোযা মানসুখ হয়ে গিয়েছে। উহা এখন সুন্নাতরূপে পরিগণিত।

. সাউম কেন ফরয করা হলো: সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি দুই কারণে সাউম ফরয করা হয়েছে।

প্রথমত: অতীতের সকল নবীর উম্মতের উপর সাউম এর ইবাদত ফরয ছিল তাই।
দ্বিতীয়ত: তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে সাউম ফরয হয়েছে।
সাওমের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও মর্যাদা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।

এই স্বল্প পরিসরে সাউমের ফজিলত বা গুরুত্ব আলোচনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি হাদীসের অনুবাদ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই।
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أمْثَالِهَا إلى سبع مائة ضعف قَالَ اللهُ تَعَالى الا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِى به .
(بخاری ، مسلم)
রাসূল (সা) বলেছেন- বনী আদমের সকল আমলের বিনিময় দশ থেকে সাতশতগুণ পর্যন্ত দেয়া হবে। (কিন্তু সাওম ব্যতিক্রম)
আল্লাহ্ বলেন- (বনী আদমের সকল আমল তার নিজের) কিন্তু সাউম আমার জন্য তাই আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেবো। (বোখারী ও মুসলিম)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . (بخاری ، مسلم)
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা করবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বোখারী ও মুসলিম)

قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّيَامُ جُنَّةٌ . (بخاری) 
সাউম ঈমানদারদের জন্য ঢাল স্বরূপ। (বোখারী)

এ ধরনের অসংখ্য হাদীসে রাসূলের মাধ্যমে সাওমের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা সাউমের কল্যাণ লাভ করতে পারবো। ইন্‌শাআল্লাহ্।

২. মাহে রমযানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ

ক) তাকওয়া অর্জনই মাহে রমযানের উদ্দেশ্য: আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে (সাউম ফরয হওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে) ঘোষণা করেছেন-
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (উম্মতদের) উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া, খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জন করতে পারো।

তাই নামায যেমনিভাবে মুমিনদেরকে দৈনিক পাঁচবার আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত হয়ে দাসত্বের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে চরিত্র গঠন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে শারীরিক ইবাদত সাউম একমাস পূর্ণ ঈমান ও ইহতেসাবের সহিত পালন করলে অবশ্যই খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম অর্জিত হবে। এই জন্য আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন- 'সাউম আমার জন্যই, যার প্রতিদানও আমি নিজেই' অর্থাৎ ইবাদাত লোক দেখানোর জন্য হতে পারে; কিন্তু সাউম এমন কি ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ্র ভয়ে আল্লাহর জন্যেই হয়ে থাকে।

খ) রমযানের সাথে কোরআনের সম্পর্ক: আমরা সাধারণত: প্রত্যেক বছর রমযান মাস এলেই ঈমাম, আলেমেদ্বীন ও জুময়ার খোতবার মাধ্যমে রমযান মাসের বিশেষ ফাজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে শুনে থাকি। এজন্য মুসলিম মিল্লাত রমযান মাসের বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, রমযান মাসের এত গুরুত্ব ও মর্যাদা কেন হয়েছে? আসুন আমরা রমযানের সাথে কোরআনের আলোচনা করে উক্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর গ্রহণ করি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরায় বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَتِ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

মাহে রমযান তো সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের চলার পথের দিক নির্দেশক হিসেবে, যার মাঝে হেদায়াতের দলিল প্রমাণাদি সহ বিস্ত ারিত বিবরণ রয়েছে। আরো রয়েছে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের বিষয়সমূহ। সূরায়ে কদরে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন-
إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ -
"নিশ্চয় আমি এই কুরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি।"

সুতরাং উল্লেখিত দু'টি আয়াতের মর্মানুযায়ী আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি, কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের এত কদর এত গুরুত্ব হয়েছে। আর কুরআন নাযিলের কারণেই রমযানের সিয়াম সাধনা ফরয করা হয়েছে। অতএব রমযানের সাথে কুরআনের সম্পর্ক আমাদের কাছে এখন সুস্পষ্ট।

গ) তাকওয়া কাকে বলে: তাকওয়া শব্দটি ধাতুগত উৎপত্তির দিক থেকে চিন্তা করলে আরবী ভাষায় এর অর্থ শুধু খোদাভীতি বা খোদাপ্রেম হবে না। আল- কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে যেভাবে তাকওয়ার আলোচনা হয়েছে তাতে মূল উদ্দেশ্য এক হলেও দু'ধরনের অর্থ করতে হবে। যেমন সূরা তাহরীম- এর দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُوْ انْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا.
(হে ঈমানদারগণ) তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।

অতএব তাকওয়ার এক অর্থ যেমন খোদাভীতি অর্জন, মুত্তাকী হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্র নির্দেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকাই খোদাভীতি। আরেক অর্থ বাঁচা, মুক্তি লাভ করা, নিষ্কৃতি পাওয়া, বিজয় লাভ করা।

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে দু'অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং একটি অন্যটির সম্পূরক। সাউমের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যাতে করে তোমরা খোদাভীতি বা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তোমরা প্রকৃতপক্ষে পরিত্রাণ পাবে বা মুক্তি লাভ করবে।

ঘ) তাকওয়ার বাস্তব অবস্থা: এখানে তাকওয়ার বাস্তব অবস্থাটা বা তাকওয়ার সুফল আল-কুরআন থেকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন- وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ لَيَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقُهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

যারা আল্লাহ্ ভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করে, আল্লাহ্ তাদের চলার পথ খুলে দেন। আর তাদেরকে এমন জায়গা থেকে রিঙ্ক এর ব্যবস্থা করে দেন, যা তারা কোনদিন চিন্তাও করতে পারে না। (তালাক-২-৩)

সূরা আলে-ইমরানের ১২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং খোদাভীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করো তাহলে তোমাদের শত্রুদের কোন ষড়যন্ত্র বা কলাকৌশল তোমাদের কোনই ক্ষতিসাধন করতে পারবে
وَانْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوْا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا . -
অতএব তাওয়ার অর্থ বুঝে তার আলোকে একজন মুমিন যদি তার সঠিক চরিত্র গঠন করে এবং জীবনকে তাওয়া ভিত্তিতে পরিচালনার শপথ গ্রহণ করে তাহলে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি সামষ্টিকভাবে ইহ ও পরকালে সুবিধার কথা উল্লেখিত আয়াতসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমাদের বাস্তব জীবনে তাওয়ার সুফল বয়ে আনবো, এটাই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।

ঙ) তাকওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছয়টি। যথা:
১। সত্যের সন্ধান;
২। সত্য গ্রহণ;
৩। সত্যের উপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা;
৪। আল্লাহভীতি;
৫। দায়িত্বানুভূতি;
৬। আল্লাহর নির্দেশ পালন।
এ বৈশিষ্ট্য আমাদের সকলের অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই কেবল তাকওয়াবান হওয়া যাবে।

৩. রমযানের সাথে কুরআন ও তাকওয়ার সম্পর্ক:
ইতিপূর্বে আমরা তাওয়ার অর্থ পরিচিতি ও বাস্তব দিক আলোচনা করেছি। এখন রমযান ও কুরআন তাওয়া অর্জনে কি ভূমিকা রাখে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

সূরা ফাতিহা আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করেছি এই বলে যে, হে রব, আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর পরিচালিত কর। এর উত্তরে রাব্বুল আলামীন সূরা বাকারার প্রথমেই সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর চলার শর্ত উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন-
ذلك الْكِتَابُ لأَرَيْبَ فِيهِ - هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ .
ইহা এমন এক কিতাব, যার মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যারা মুত্তাকী তাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিবে।

অতএব বুঝা যাচ্ছে, কুরআন থেকে হিদায়াত পেতে হলে মুত্তাকী হওয়। শর্ত। সাউম ফরয করা হয়েছে- তাকওয়া অর্জন করার জন্য এবং কুরআন নাযিলের কারণেই রমযান মাসের এতো গুরুত্ব হয়েছে।

সুতরাং আল-কুরআন মানব জাতির জন্য একমাত্র নির্ভুল জীবন বিধান। আল- কুরআন বুঝতে হলে তাওয়া অর্জন করতে হবে আর তাকওয়ার প্রশিক্ষণের জন্যই একমাত্র সিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই রমযানের প্রশিক্ষণ কুরআন বুঝে তা বাস্তবায়নের জন্য এক বিশেষ প্রশিক্ষণ।
অতএব আল-কুরআন, মাহে রমযান ও তাওয়ার পূর্ণতা অর্জন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নাম নয়, বরং পরিপূরক।

•শিক্ষাঃ 
আলোচ্য দারসের শিক্ষাগুলো নিম্নে দেয়া হচ্ছে:
১. পবিত্র রমযান মাসের সিয়াম সাধনা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয। রোয়া ফরয করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। 

২. অসুস্থ অবস্থায়, মুসাফির, মহিলাদের শরয়ী ওযর ও অক্ষম বৃদ্ধদের জন্য এ মাসে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। (এ ব্যাপারে শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গী ও নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে)

৩. মাহে রমযানের যথাযথ দায়িত্ব পালন বা মর্যাদা দিতে হলে আল- কুরআনকে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাঁর বিধানকে সহজ করেছেন; কঠিন করেন নাই।

৪. কুরআন যে মানব জাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে নাযিল করছেন তা যথাযথ উপলব্ধি করে সে মোতাবেক জীবন চলার শপথ নিতে হবে।

৫. 'রমযান, কুরআন, হিদায়াত ও লায়লাতুল কদর' বিষয়গুলো মজবুত ঈমানের সাথে বুঝে শুনে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৬. উল্লেখিত শিক্ষাগুলো পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে ই'তেকাফের গুরুত্বও কম নয়। তাই যথাসাধ্য আত্মগঠন ও তাকওয়া অর্জনের জন্য ই'তেকাফে অংশ গ্রহণের চেষ্টা থাকতে হবে।

দারস সংকলনে:
www.ArmansDiary.com

শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

বইনোট: ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.

ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী

লেখক: সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.
অনুবাদক: মাওলানা আব্দুল মান্নান তালিব

প্রকাশকের কথা :
কোন উদ্দেশ্য, কোন আন্দোলন, কোন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ সফল হতে হলে সে আন্দোলনের সৈনিকদের বিশেষ কতগুলো গুণ থাকা দরকার। যথা: 
১. সুন্দর, বলিষ্ঠ, উন্নত আর উজ্জল চরিত্রের অধিকারী হওয়া।
২. আন্দোলন ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ।
৩. আখেরাতে আল্লাহরসন্তুষ্টি লাভ।

★★মূল বইটি দু'ভাগে বিভক্ত-
০১. ভূমিকা ও 
০২. মূল বক্তব্য।

★বইয়ের ভূমিকাকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

০১. হতাশার দিক :
১) আগ্রহ, উদ্যোগ ও যোগ্যতার অভাব
২) প্রভাবশালী অংশ সমাজ ভাঙ্গনে লিপ্ত
৩) সমাজ ভাঙ্গনে বৃহত্তম শক্তি সরকার।

০২. আশার দিক :
১) সমাজে কিছু সৎ ও যোগ্যলোক রয়েছে
২) সামষ্টিক ভাবে লোকজন অসৎ প্রবণ নয়
৩) ইসলাম বিরোধী শক্তির দুটি জিনিসের অভাব-
ক) চারিত্রিক শক্তি
খ) ঐক্যের শক্তি।

০৩. করণীয় কাজ সমূহ :
১) আবেগ বর্জিত ধীর ও সুস্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে
২) হঠাৎ ফল পাওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে
৩) সুশিক্ষীত কর্মী বাহিনী গঠন করতে হবে
৪) ব্যক্তি গঠন করতে হবে।

★★ মূল বক্তব্য কে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে :

০১. ব্যক্তিগত গুণাবলি সমূহ :

১) ইসলামের যথার্থ জ্ঞান
২) ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
৩) চরিত্র ও কর্ম
৪) দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য।

০২. দলীয় গুণাবলি সমূহ : 

১) ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা
২) পারস্পরিক পরামর্শ
৩) সংগঠন ও শৃঙ্খলা
৪) সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।

০৩. পূর্ণতা দানকারীর গুণাবলি সমূহ :
১) আল্লাহ সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা
২) আখেরাতের চিন্তা
৩) চরিত্র মাধুর্য

০৪. মৌলিক ও অসৎ গুণাবলি সমূহ :
১) গর্ব ও অহংকার
২) প্রদর্শনেচ্ছা
৩) ত্রুটিপূর্ণ নিয়ত।

০৫. মানবিক দুর্বলতা সমূহ :
১) আত্মপূজা
২) আত্মপ্রীতি
৩) হিংসা ও বিদ্বেষ
৪) কুধারণা
৫) গীবত
৬) চোগলখোরী
৭) কানাকানি ও ফিসফিসানী
৮) মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
৯) একগুঁয়েমী
১০) একদেশদর্শীতা
১১) সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতা
১২) সংকীর্ণমনতা
১৩) দুর্বল সংকল্প।

★ গর্ব অহংকার থেকে বাঁচার উপায় সমূহ :
১) বন্দেগীর অনুভূতি
২) আত্মবিচার
৩) মহৎ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি
৪) দলগত প্রচেষ্টা।

★★কয়েকটি বিষয়ে বইয়ের আলোকে ব্যাখ্যা :

★ চরিত্র মাধুর্যের মূল বিষয়বস্তু :
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হতে হবে উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতা দরদী। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাব সম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্ট সহিষ্ণু। তাদের দ্বারা অন্যদের উপকার বিনে ক্ষতি হবে এমন ধারণাও কেউ করতে পারবে না। তারা নিজের প্রাণের চাইতে কমের উপর সন্তুষ্ট থাকবে ও অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশী দিবে। তারা নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করবে ও অন্যের গুণাবলীর কদর করবে।
তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেবার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষত্রুটি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর উপর প্রতিশোধ নেবে না। তারা অন্যের সেবা গ্রহন করে নয় বরং অন্যকে সেবা করে আনন্দিত হবে। তারা কোন প্রকার প্রসংশার অপেক্ষা না করে এবং কোন প্রকার নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। আল্লাহ ছাড়া কারো পুরষ্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। ধন-সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে ক্রয় করা যাবে না কিন্তু সত্য ন্যায়ের সামনে তারা নির্দ্বিধায় ঝুকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের উপর বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থাই তারা ভদ্রতা ও ন্যায়নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এ চারিত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এগুলো তলোয়ারের চাইতেও ধারালো এবং হীরা মনি মুক্তার চাইতেও মূল্যবান। যে এহেন চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনকারী সে তার চারপাশের জনবসতির উপর বিজয় লাভ করে।

★ "দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য" এর ব্যাখ্যা :
সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায় ভুক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরনের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সংগে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যত প্রতিষ্ঠিত থাকলে এরা তার ভালো নাগরিক হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরনের সৎ লোকদের উপস্থিতি কোন কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোক প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্য রুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যই করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদন করার জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্য নিজেদের সময় সামর্থ ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন- মস্তিষ্কের সকল যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমনকি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরনের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিষ্কার করতে পারে। দ্বীনের সঠিক নির্মূল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্য পরিণত করা এগুলো এমনসব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগত ভাবে অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না। বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দলভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেত পারে না। এজন্য বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

★ দূর্বল সংকল্প :
দুর্বল সংকল্পের কারণে মানুষ প্রথম দিকে কাজে ফাঁকি দিতে তাকে। দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইতস্তত করে। উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হয়। যে কাজকে সে নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গন্য করে এগিয়ে এসেছিল দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজকে তার উপর অগ্রাধিকার দিতে থাকে। তার সময়, শ্রম ও সম্পদের মধ্যে তার ঐ তথাকথিত জীবন উদ্দেশ্যের অংশ হ্রাস পেতে থাকে এবং যে দলকে সত্য মনে করে সংযুক্ত হয়েছিল তার সাথেও সে নিছক যান্ত্রিক ও নিয়মানুগ সম্পর্ক কায়েম রাখে। ঐ দলের ভালমন্দের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না এবং তার বিভিন্ন বিষয়ে কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করে না।

★ ধৈর্য :
ক) তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার তড়িৎ ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত না হারানো।
খ) তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতা রোগে আক্রান্ত না হওয়া
গ) বাধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবিলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা।
ঘ) দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া।
ঙ) সকল প্রকার ভয় ভীতি ও লোভ লালসার মোকাবিলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েসের বিপক্ষে কর্তব্য সম্পাদন করা।

★ চরিত্র ও কর্ম :
চরিত্র ও কর্ম হচ্ছে কথা অনুযায়ী কাজ। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে সে তার অনুসরণ করে। যাকে বাতিল বলে গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে থাকে। যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করে। সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, বিরোধীতা ও সকল প্রকার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্য পথে অবিচল থাকে।

★ প্রজ্ঞা :
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। (যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্ব প্রথম যে জিনিসটি সে কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে)। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কম বশেী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এজন্য এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোন কথা অবশ্য নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যই ইসলামী আকিদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা-কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হবে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নিজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্য যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ সরল ভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিক্ষিত লোকদের সকল সন্দেহ সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামী আকিদা ও চিন্তার ভিত্তির উপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মতো গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে।

★ চোগলখোরী :
গীবত যে আগুন জ্বালায় চোগলখোরী তাকে বিস্তৃত করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। স্বার্থবাদিতার প্রেরণাই হয় এর মধ্যে আসল কার্যকর শক্তি। চোগলখোর ব্যক্তি কারুর কল্যাণকামী হতে পারে না। নিন্দিত দুজনের কারুর কল্যাণ তার অভিস্পীত হয় না। সে দুজনেরই বন্ধু সাজে কিন্তু অমঙ্গল চায়। তাই সে মনযোগ দিয়ে দু'জনেরই কথা শুনে, কারোর প্রতিবাদ করে না। তারপর বন্ধুর নিকট এ খবর পৌঁছে দেয়। এভাবে যে আগুন এক জায়গায় লেগেছিল তাকে অন্য জায়গায় লাগাতেও সাহায্য করে। ইসলামী শরীয়তে এ কাজকে হারাম গণ্য করা হয়েছে।

★ "আখেরাতের চিন্তা" এর ব্যাখ্যা :
যারা মুমিন তারা দুনিয়ার সমস্ত কাজ আখেরাতের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই করে। দুনিয়া মুমিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদসত্বেও সে দুনিয়ার জন্যে কাজ করে না বরং আখেরাতের জন্য করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে লক্ষ্য থাকে না বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি। আখেরাতে অকল্যাণ বয়ে আনে এমন সকল কাজ থেকে মুমিন সর্বদা দূরে থাকে। মুমিন তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আখেরাতের জবাবদিহীতার অনুভূতি নিয়ে অতিবাহিত করেন। কারণ আখেরাতের শান্তি ও পুরস্কার দুনিয়ার কাজের উপর ভিত্তি করেই দেয়া হবে। আখেরাতে আল্লাহই একমাত্র বিচারক থাকবেন। আল্লাহকে ভয় করা, তার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আখেরাতের উপলব্ধির উপর নির্ভর করে। তাই বলা যায় আখেরাতের চিন্তা মুমিনের নেক আমল বৃদ্ধির টনিক হিসাবে কাজ করে।

সংকলনে:
আরমানের খেরোখাতা 

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস “ওরা চারজন” || কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ

ওরা চারজন
মেছবাহ উদ্দিন মারুফ 

 মারুফ, আব্দুল্লাহ, তৌহিদ ও আরমান। ওরা চারজন ছোটকাল থেকে খুব ভালো বন্ধু। ওরা যেনো চারজন একই মায়ের সন্তান। গ্রামে নতুন কেউ এলে তারা বুঝতো না এরা বন্ধু নাকি সহোদর, কারণ তাদের চলাফেরা অন্যান্য বন্ধুর মতো না। এরা ছোটকাল থেকে একসাথে খেতো, একসাথে থাকতো। তাদের এই বন্ধনটা যেন চারটি খুঁটি দিয়ে তৈরিকৃত দালান। যার একপাশ ভেঙে গেলে অপর তিনটি পাশ ধ্বসে পড়ার সম্ভবনা আছে। তাদের মাঝেও প্রচুর ঝগড়া হতো, এমনকি মারামারি ও হতো। কিন্তু সকালে ঝগড়া হলে বিকালে আবার তাদের একসাথে খেলার মাঠে দেখা যেত, তাই তাদের মাঝে ঝগড়াঝাটি হলে কেউ তা সমাধান করতে আসতো না, সবাই জানে এরা একটু পর ঠিক হয়ে যাবে, অযথা ওদের কাছে গিয়ে নিজের সময় অপচয় করে লাভ কি! বরং ওদের ঝগড়াঝাটি সবাই উপভোগ করে, ওরা সকালে ঝগড়া করে যখন বিকালে চা খেতে যেতো তখন মানুষ তাদের ব্যাঙ্গ করে বলতো 

-কিরে তোরা না ঝগড়া করলি,ফের একসাথ হয়ে গেলি!

তখন ওরা চারজন বলতো, 

-আমরা একসাথ হলে তোমাদের কি? দেখাও তো আমাদের মতো এমন বন্ধু কোথাও?


 তারা চারজন একই বিদ্যালয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ে ও তাদের একই দশা! এক টেবিলে বসা, একসাথে স্কুলে আসা, স্কুল চুরিসহ তাদের সব কাজ একসাথে হতো। স্যার একদিন ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, তখন এক-এক করে সবার শেষে আসলো চারজন বন্ধুর পালা, এক জনকে ডাকার সাথে সাথে  চারজনই উঠে দাড়ালো, স্যার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো 

-ডাকলাম একজনকে চারজন উঠলি কেন?

তখন চারজন সমস্বরে বলে উঠলো 

-আমাদের চারজনের লক্ষ্য একটাই!

স্যার বললেন, 

-বলতো দেখি তোদের চারজনের লক্ষ্যটা কি?

ওরা আবার সমস্বরে বললো, 

-আমরা চারজনই দেশের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হবো।

তখন স্যার হো হো করে হাসতে লাগলো, স্যারের সাথে ক্লাসের সবাই ও হাসতে থাকলো কিছুক্ষণ। হাসি থামিয়ে স্যার বললো, 

-তোরা দেশের সেরা গোয়েন্দা হবি, আরে বেটা তোরা গ্রামের সেরা গোয়েন্দাও হতে পারবিনা। 

চারবন্ধু খুবই অপমান বোধ করলো, বাকী ক্লাস না করে স্যার যাওয়ার সাথে সাথে ওরা বাড়ির পথ ধরলো। পথেই তারা সিন্ধান্ত নেয়, তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে দেশের সেরা গোয়েন্দা হওয়া। 


এর মধ্যে তারা প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে গেলো, দিনের বেলায় আড্ডা দেওয়া রাতে পড়াশোনা করেই তাদের সময় যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলো আরমান। কোনো কথা শুনলে চটপট উত্তর দিতো না, অনেক ভেবে চিন্তে সঠিক উত্তরটি দিতো। এলাকায় এবং স্কুলে তার সম্মান ছিলো মেধাবী ছাত্র হিসেবে, স্কুলের বাবুল স্যার তো তাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে ডাকতো। আর বাকী তিন বন্ধু মোটামুটি মেধাবী ছিলো, তাঁর মধ্যে কিছুটা হাবলা প্রকৃতির ছিলো মারুফ। 

সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা, তাই স্কুলের স্যারেরা চায় তাদের নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে। যেনো ছাত্রদের মন প্রফুল্ল থাকে, পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে পারে। বাবুল স্যার ক্লাসে আসলেন এবং এক-এক করে সবার মতামত নিলেন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। যে যার মতো করে মতামত দিলো। স্যারের মতামত গুলো মনপুত হলো না। স্যার তখন বলে উঠলেন

-আমার আইনস্টাইন কোথায়? তাকে দেখছি না যে? আজ আসেনি? 

ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে আরমানের কন্ঠস্বর শোনা গেলো, 

-স্যার আসতে পারি? 

তখন স্যার 'অবশ্যই' বলে অনুমতি দিলেন। আরমান শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলো এবং বসে পড়লো। তখন স্যার আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার এতো দেরি হলো কেন বলোতো? 

-স্যার রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো, তাই আসতে দেরি হলো।

আবারো স্যার বললো, 

-তোমায় ছাড়া একটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারছি না। আমরা স্কুল থেকে ঘুরতে যাবো তোমাদের নিয়ে, বলোতো কোথায় যাওয়া যায়? 

তখন আরমান বিনয়ের সাথে বললো, 

-স্যার আমায় একটু সময় দেওয়া যায়?

স্যার বললেন, 

-অবশ্যই, তুমি ভেবে আমাকে বলো। ছুটির সময় আমি আবার আসবো তোমার মতামত জানতে, কারণ আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। 

এই বলে স্যার চলে গেলেন। 


আরমান অনেকক্ষণ ভেবে সিন্ধান্ত নিলো এবার তারা জঙ্গলে যাবে। স্যার এলেন ছুটির সময় আবার আরমানের মতামত জানতে, এসে বললেন, 

-বাবা তোমার মতামত জানাও। 

তখন আরমান বললো 

-স্যার আমরা জঙ্গলে যেতে চাই। 

তখন স্যার মুখে প্রফুল্লতা এনে বললেন, 

-আমি জানতাম, আমার আইনস্টাইন ছাড়া কেউ এই সমাধান দিতে পারবে না!


স্কুল থেকে যাওয়ার তারিখ ঠিক হলো, তারিখ অনুযায়ী সবাই তৈরি হয়ে নিলো। কে জানতো? আরমানের দেওয়া মতামতটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

স্কুল থেকে গাড়ি ছাড়লো ছয়টা নাগাদ, তারা জঙ্গলে পৌঁছায় দশটার দিকে। স্যার আরমানকে দায়িত্ব দিলো সবাইকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। আরমান বাস থেকে নেমে সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করালো এবং সকলের উদ্দেশ্য বললো, 

-প্রিয় বন্ধুরা, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছি। আজ আমাদের আনন্দের দিন, তবে জঙ্গলে চলার পথটা অত্যন্ত দুর্গম তা  আমাদের সকলের জানা। তাই সবাইকে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে চলাফেরা করতে হবে এবং দলবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করবে। 

তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

-অবশ্যই। 

এরপর আরমান সবাইকে সাত দলে ভাগ করে দিলো এবং প্রত্যেক দলের সাথে দিলো একজন করে শিক্ষক। আর ওরা চারজনে মিলে করলো একদল, তারা সবার পিছনে থাকবে। 


খুব সুন্দরভাবে চলতে থাকলো ওদের জমকালো আয়োজন। এরমধ্যে তারা চলতে লাগতো জঙ্গলের ভেতর। পথিমধ্যে হঠাৎ আরমান চলে যায় প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তিন বন্ধু দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আরমানের জন্য, কিন্তু আরমানের আসার কোনো খবর নাই। এইদিকে তিন বন্ধু দাড়িয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে তারা আরমানকে খুঁজতে লাগলো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধা ছুঁইছুঁই। এখনো আরমানের কোনো হদিস মেলেনি।ঘোরাঘুরি পর্ব শেষে সবাই আগের জায়গায় একত্রিত হলো, কিন্তু এই চার বন্ধু কোথায় গেলো? এখনো আসছে না কেন? সবাইকে একরাশ চিন্তায় ঘিরে ধরলো। সবাইকে এক জায়গায় রেখে বাবুল স্যার একাই গেল তাদের খুঁজতে, কিছু দুর যাওয়ার পরে আরমানকে ছাড়া বাকি তিনজনকে পেল খুবই বিমর্ষ অবস্থায়! স্যার তাদের কারণ  জিজ্ঞেস করলে তারা ঘটনার বিস্তারিত জানায়, স্যারসহ আরমানকে খুজতে থাকে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হঠাৎ একটি কর্কশ আওয়াজ শুনতে পায়, 

-হে পথচারীরা তোমরা এই নিষিদ্ধ জঙ্গলে কেন এলে? দ্রুত তোমরা পালাও না-হয় সবাই মরবে!

এই বলে কন্ঠটি মিশে গেলো, এরপর একটু দুরে তীব্রবেগে  আগুন জ্বলে উঠলো। তারা ভয় পেয়ে সেই জায়গাটি ত্যাগ করলো। মনের ভিতর একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। গাড়ির মধ্যে কারো কোনো কথা নেই, ড্রাইভার যেন কতগুলো লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন নিজ গন্তব্যে এলো, যে যার মতো করে বাড়ির পথ ধরলো আনন্দের দিনটা তাদের বিষাদে পরিণত হলো। বহু পত্রিকায় ছাপানো হলো আরমানের নিখোঁজ সংবাদ, কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারেনি। 


বাকি তিন বন্ধুর বেহাল দশা! খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, বয়সের চাপে তাদের দেহ যেন নুয়ে পড়েছে! সবাই বুঝাচ্ছে আরমান একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ওরা কিছুই মানতে চায়না আরমান কে ছাড়া। 

এভাবে কিছুটা দিন পেরিয়ে গেলো হঠাৎ করে একদিন মারুফের মোবাইলে একটা কল আসলো। কলটি রিসিভ করতে পারেনি বাইরে ছিলো বিধায়। এসেই কল দিলো, ওপার থেকে ভেসে আসলো চিরচেনা কন্ঠ! তা হলো তার বন্ধু আরমানের। তাদের কথা শেষ হলো তিন চার বাক্যে। তা হলো, 

-দোস্ত আমি এখনো বেঁচে আছি, যেখান থেকে হারিয়ে গেছি ঠিক ঐখানে চলে আস আজ রাত দুটোর মধ্যে। রঙ মাখানো ইটের নিচে একটা কাগজ পাবি, ঐ অনুযায়ী কাজ করিস, বিদায়! 

বলে কলটা কেটে দিলো। মারুফ আব্দুল্লাহ এবং তৌহিদকে ব্যাপারটি জানালো। তারা কেউ বিশ্বাস করছে না, বললো

-বন্ধু মজা করা ঠিক না কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। 

তারা মানতে চাইছে না কোনো কিছুতেই, একটা পর্যায়ে মারুফ রেগেমেগে বললো তোরা থাক আমি একাই যাচ্ছি ওর উদ্ধারকাজে, এখন চলি এই বলে সে হাঁটা ধরলো। ওরা তখন চিন্তা করলো, মারুফ তেমন একটা রাগ করেনা, যখন ওর হৃদয়ে লাগে ঠিক তখনই রাগ করে। তাই তারা মারুফের পিছু নিলো। দেখলো কিছুদূর যাওয়ার পরে মারুফ চোখ মুছতেছে। তখন তারা ভাবলো, মারুফের কথাটি সত্য, না-হয় কান্না করতো না। কারণ অতি অল্পে কখনো মারুফ কাঁদেনা, তারা ছোটকাল থেকে তাকে চেনে। তারা সামনে গিয়ে বললো, 

-দোস্ত চল আমরাও যাবো। 

মারুফ তখন বললো, 

-তোরা গেলেও আমি নেবো না। গেলে নিজেদের মতো যা, আমি আমার মতো গেলাম। 

ওরা ভালোভাবে জানে মারুফকে যতই রিকুয়েষ্ট করুক, আর লাভ হবেনা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাকে ফলো করবে যখন সে বের হবে তখন তার পিছু নেবে।যেই কথা সেই অনুযায়ী কাজ। ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো কতক্ষণে বাহির হয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে রাত বারোটা, তার বাহির হওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। তৌহিদ বললো, 

-দোস্ত, মারুফ আমাদের সেইরকম ভাবে বোকা বানালো! বুঝলি? চল বাড়ি চলে যাই

-আব্দুল্লাহ বললো, না বোকা বানায়নি। তার চোখের জল মিথ্যা না। মন চাইলে চলে যা, আমি যাবো না। প্রয়োজনে সারারাত এখানে বসে থাকবো। 

তৌহিদও আর কিছু না বলে বসে রইলো।ঠিক বারোটা ত্রিশ মিনিটে  মারুফের দরজার আওয়াজ হলো, তখন আবদুল্লাহ বললো, 

-ঐ দেখ মারুফ বাহির হচ্ছে। 

তখন তারা কিছুটা দুরত্ব নিয়ে পথ চলতে থাকলো। মারুফ যখন বাইকে উঠলো তখন ওরা বললো, 

-কিরে আমাদের নিবি না? 

মারুফ বললো, 

-নিজের মতো করে যা।

মারুফ বাইক স্টার্ট দিলো, তৌহিদও  আবদুল্লাহ কে সাথে নিয়ে আরেকটা বাইক স্টার্ট করে রওয়ানা দিলো।


দেড়টার মধ্যে সেই স্থানে পৌঁছে যায় ওরা, বাইক দুটোকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসলো এবং সেই জায়গায় গেলো যেইখান থেকে আরমান হারিয়ে গিয়েছিল। ওখানে আরমানের কথা অনুযায়ী রঙ মাখা ইট থাকার কথা, কিন্তু তা পেলোনা! হঠাৎ তৌহিদ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো এবং মৃদু চিৎকার করলো। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো একটা রঙিন ইট, তখন মারুফ কে  বললো, 

-এইতো রঙিন ইট পেয়ে গেছি। 

মারুফ বললো, 

-ধাক্কা খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোকে। 

তখন ইটটি উল্টালো, আরমানের কথা অনুযায়ী একটা কাগজ ফেলো।আব্দুল্লাহকে পড়তে দিলো, আবদুল্লাহ চিঠি খানা পড়তে লাগলো:

"প্রিয় বন্ধুরা,

প্রথমে আমার সালাম নিস, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি যখন প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই, ঠিক তখন মৃদু আওয়াজে একটি মেয়েলি গলা শুনতে পাই, বাঁচাও বাঁচাও! একবার দুইবার নয় অনেকবার শুনতে পাই, তাই আমি আগ্রহী হয়ে সেদিকে যাই। তখন যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলামনা! দেখলাম, একটি মেয়েকে বস্তাবন্দি করা হচ্ছে। তখন আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, তোমরা কারা? কাপুরুষের মতো কেনো একটা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও ওকে। তারা বললো, তুই কেরে? আর নিষিদ্ধ জঙ্গলে কি করিস? আমি কিছু বলতে যাবো তখন শক্ত কিছু একটার বাড়ি অনুভব করলাম। আমি অজ্ঞান হইনি, কিন্তু ওরা ভেবেছিলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। এই সুযোগে আমি ওদের কিছু কথোপকথন শুনে নিয়েছি। একজন বলতেছে মেরে রেখে যাই। আরেকজন বলতেছে তুই জানিসনা এইখানকার কিছুই, বসের হুকুম কেউ অমান্য করেনা। চল একে বসের কাছে নিয়ে যাই। আমাকে তারা কিছু সবুজ ঘাসের সামনে রাখলো। এরপর একটি লোহার ধাতু নিলো বট গাছের নিচ থেকে। সেটা দিয়ে বৃত্তাকারে মাটি খনন করলো এবং দুজনে ধরাধরি করে একটি গামলা উঠালো। তখন দেখলাম একটি সুড়ঙ্গ পথ, যেখানে আছে দুটো সিড়ি একটা লাল অপরটি সবুজ তারা সবুজটি দিয়ে নামলো এবং ভয়ংকর আওয়াজে সাইরেন বেজে উঠলো। এরপর আমাকে এবং মেয়েটিকে ধপাস করে নিচে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করিনি ভয়ে। কারণ তারা জানে আমি অজ্ঞান। তাদের বস লোকটি বললো কিরে রাহুল শিকার আনতে গেলি একটা, এখন নিয়ে এলি দু'টো ব্যাপারটা কি খুলে বলতো দেখি, তখন রাহুল পুরো ঘটনা বললো। মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো এবং বস লোকটা বললো মালটাকে স্পে কর। আমাকে কি দিয়ে স্পে করলো জানিনা, তবে প্রথম স্পেতে আমি পচন্ড রকম কেশে উঠলাম। তখন বস লোকটা চিৎকার মেরে বলে উঠলো, রাহুল মালটা এনে ভালো কাজ করছিস, এর নার্ভ অনেক ভালো। যেখানে পাঁচ ছয়বার স্পে করার পরেও জ্ঞান ফিরানো কষ্ট হয়ে যায়। আর সেখানে একবারে ওর জ্ঞান ফিরে এলো। একে আমাদের কাজে ব্যবহার করবো। বস লোকটা রাহুলকে বললো এর মুখে আর স্পে করিস না, শুধু পানি ছিটা, রাহুল আমার মুখে পানি ছিটাতে লাগলো। আমি চিৎকার মেরে উঠে দাড়াই বলতে থাকি আমি এখন কোথায়? বস লোকটা বললো, দেখো যুবক আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো তার যদি ঠিকঠাক উত্তর দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো, না-হয় এখানে পঁচে মরতে হবে তোমায়। বলো, এখানে কেনো এসেছো? আমি শিক্ষা সফরে এসেছি  বলেছি এবং নানাবিধ কথা জিজ্ঞেস করার পরে এবার জিজ্ঞেস করলো পড়াশোনার ব্যাপারে কোথায় পড়ি কোন শ্রেণীতে পড়ি, আমি যখন বলেছি এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন ওর চোখ গুলো রসের গোল্লার মতো করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো কোন বিভাগ? আমি যখন বললাম বিজ্ঞান, তখন সে রাহুলকে বললো ঠিক লোককে নিয়ে এসেছিস। এবার সামান্য একে স্মৃতি হারানোর ইনজেকশনটা পুশড করে দে। আমি তার দিকে ভয়ার্ত চেহারায় তাকালে সে বাছাধন ভয় পেয়োনা অল্প কিছুক্ষণ কষ্ট হবে। এরপর তুমি আমাদেরই একজন হয়ে যাবে। এই বলে বস লোকটা চলে গেলো, রাহুল আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো একটা রুমে। যে রুমটা গ্লাস দিয়ে তৈরি, সেখানে অনেক গুলো মানুষ দেখতে পেলাম তারা আমায় দেখে বলে উঠলো রাহুল আমাদের নতুন অতিথি এলো বুঝি। রাহুল তাদের থেকে দুজনকে ডাকলো ইশারায় এবং বললো আমাকে শক্ত করে ধরতে। রাহুল আমার দিকে আগাচ্ছে  একটা ইনজেকশন নিয়ে পুশড করবে এইসময় আমি আমাকে ধরে রাখা দুজনকে সজোরে লাথি মারলাম, তখন তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাহুল কোনো দিকে না তাকিয়ে আমায় শক্ত করে ধরে ইনজেকশনটা পুশড করে, আমার নড়াচড়ার কারণে ইনজেকশনটা তোশকে পুশড হয়ে যায়, মনে হয় এখনো তোশকটি স্মৃতি হারিয়ে আছে। ইনজেকশন যে আমার শরীরে পুশড হয়নি তা রাহুল জানতো না। আমিও আমার স্মৃতি হারিয়ে ফেলছি ঐরকম অভিনয় করি। তাদের সকল কথা মেনে চলি, যা করতে বলা হয় তাই ঠিকঠাক ভাবে করে দিই। এখন তারা জানে আমি তাদের আওতাধীন। আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাহির হয়। চাইলে তখনই পালিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমি আসিনি তাদের পরিকল্পনা আমি জেনে গেছি তাই। আসি নাই কারণ তারা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র। যারা বিশ্ব দখল করতে চায়। তাই তারা বিশ্বের জ্ঞানী লোকদের নিয়ে এসে ইনজেকশন পুশড করে নিজেরদের অধীনে  নিয়ে আসে।আমি চাচ্ছি তাদের ঘৃণ্য স্বপ্ন প্রাসাদ ভেঙে দিতে। কারণ ওদের সকল ডকুমেন্ট আমার হাতে। এই যাত্রায় তোদের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই আজ সকালে মারুফকে কল করি, এরা এখানকার সকল দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেছে। আর তিনজন প্রহরী রেখে গেছে, তোরা চাইলে রাত দুটোয় আঘাত হানা সম্ভব, তোরা যেখানে আছিস, সেখান থেকে দুইশো হাত সামনে হেটে আয়। এরপর একটা বটগাছ পাবি, তার নিচে পাবি লোহার একটা ধাতু সেটা দিয়ে সবুজ ঘাসের চারদিকে বৃত্তাকারে খুঁড়ে ফেল ভালোভাবে। একটা গামলা পাবি দু'জনে শক্তকরে গামলাটি উঠা। এরপর লাল সিড়ি দিয়ে নামবি কারণ লাল সিড়ি শুধু তাদের বসের ব্যবহারের অনুমতি আছে অন্য কারো না, তাহলে শুরুতে বিপদ মুক্ত ভাবে আসতে পারবি। নেমেই দুজন প্রহরী দেখতে পাবি তারা তোদের কুর্নিশ করতে আসবে বস ভেবে। তখনই তাদের মোকাবিলা করবি সুন্দর ভাবে। চিৎকার মেরে বলতে থাকবি, শুভ কোথায় তোরা? এই অবস্থা কেনো আস্তানার? তখন শুভ আসলে মুখ চেপে বেধে অজ্ঞান করে দিবি। বাকি যা করার আমি করবো। আজ এই পর্যন্ত রাখি।"

আবদুল্লাহ পড়া শেষ করলে সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সবাই একসাথে বলে উঠলো, 

-বাবুল স্যার ঠিকই বলতো, আরমান হলো আমাদের আইনস্টাইন। 

এরমধ্যে মারুফের মনে পড়লো তার দুলাভাইয়ের কথা। তার দুলাভাই শীর্ষ পর্যায়ের সিআইডি অফিসার, সে দেরি না করে দুলাভাইকে ফোন দিলো এবং তাদের লোকেশন জানিয়ে রাখলো। বললো, আগামী দুই ঘন্টার ভিতরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এই বলে কল কেটে দিয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। 

তারা অভিযানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আরমানের দেওয়া চিত্র অনুযায়ী তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছলো। প্রহরী তিনজনকে অজ্ঞান করে বেঁধে রাখলো। এরপর ওরা আরমান কে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে এবং যাবতীয় ডকুমেন্ট নিয়ে নিলো এবং প্রাসাদের তালা মেরে উপরের দিকে চলে আসলো। কিছুদুর যাওয়ার পরে মারফের দুলাভাই কে দেখলো একটা জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বললো, 

-এতো রাতে না আসলে ও পারতেন। 

তখন তিনি বললেন, 

-সিআইডির কোনো রাতদিন নেই। তাদের জন্য সর্বক্ষণই হলো দিন। 

মারুফের দুলাভাই আরমানের সাথে কথা বললো এবং বিস্তারিত জেনে নিলো। সাথে সাথে পুলিশ হের্ডকোয়াটারে ফোন দিয়ে জানালো এবং বললো একটি কম্পিউটার সহ পুলিশ পাঠানোর জন্য। পুলিশ আসলো কম্পিউটার নিয়ে। কম্পিউটার আরমানের নিয়ে আসা হার্ডডিক্সটি সেট করা হলো, তাতে যা দেখলো পুলিশ রীতিমতো হয়ে গেলো। এতো সহজে সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। সাথ সাথে হার্ডডিক্সটির কপি পাঠানো হলো পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি তা পেয়ে রীতিমতোই বিস্মিত! চাকরির বয়সে তিনি অনেক সন্ত্রাসী ধরেছেন কখনো এতো খুশি হননি। হার্ডডিক্স কপি পাওয়ার পরে, তিনি সারাদেশে একযোগে অভিজান চালিয়ে পুরো সন্ত্রাসী চক্রকে ধরে ফেললেন এবং তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করেন। সেই সাথে চার বন্ধুকেও নিয়ে যান। এই বিষয়টি সরকারকে যখন জানানো হয় তখন তিনি সরেজমিনে চলে আসেন চার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। 


এইদিকে মারুফ, আবদুল্লাহ, তৌহিদের মা-বাবা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তিনটা ছেলে কোথায় গেলো? মারুফের দাদা যখন টিভি চালু করলো তখন দেখলো তার নাতিসহ চারজন বন্ধুর ছবি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে। আর সব সংবাদ মাধ্যম গুলো বারবার প্রচার করতে লাগলো আজকের টপ নিউজ, "বিশ্ব পেলো চারজন সাহসী যুবক, যাদের হাতে ধরা পড়লো শীর্ষ সন্ত্রাসী চক্র। যাদের সাক্ষাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত।" তখন মারুফের দাদা তার ছেলে ও বউকে বললো আমার নাতি কোথাও যায়নি ঐ দেখো টিভিতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মারুফের বাবা বললো, 

-বাবা কি আজেবাজে বকছো, তুমি ঠিক আছো তো? 

তখন মারুফের দাদা গরম হয়ে বললো,

 -আমি ঠিক আছি, যা ঐ দেখ টিভিতে।

একরকম বিরক্তি নিয়ে মারুফের বাবা টিভির সামনে এলো তিনি যা দেখলেন তারজন্য প্রস্তুত ছিলেননা! দেখলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছেলেসহ বাকি তিনজনকে ফুলের মালা পড়াচ্ছেন। নিজের চোখ যেনো বিশ্বাস করতে চাইছে না। চোখ কচলিয়ে আবার দেখলো ঠিকতো সব চ্যানেলে এক যোগে তাই দেখাচ্ছে। এরমধ্যে মারুফের দুলাভাই ফোন করলো, তিনি সব বুঝিয়ে বললেন। তাদের কাজে সারাবিশ্বে হৈচৈ পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের গোয়েন্দা হিসেবে নেওয়ার জন্য একের পর অফার আসতে থাকে, কিন্তু তারা কোনোটিকে গ্রহণ করেনি।তাদের একটাই কথা যা করবে তারা দেশের জন্যই করবে। তাদের জন্য একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যেখানে অতিথি হিসেবে থাকবেন আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ। জমকালো আয়োজন করা হলো এবং সেইদিন তাদের দেশের শীর্ষ পর্যায়ে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। এরমধ্যে তারা কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে, মা-বাবার সাথে দেখা করবে বলে। সে খবর শুনে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া জন্য এলাকার মানুষেরা অনুষ্ঠান করে বসে আছে। তারা আসা মাত্র সংবর্ধনা দিয়ে চমকে দেবে। আর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সেই স্যারটি।

তারা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই ফুল দিয়ে বরণ করলো বাবুল স্যার। তখনও তিনি বললেন, 

-বাবা আইনস্টাইন, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি? 

এই বলে তিনি হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। আরমান বললো,

 -স্যার, আমি এসেছি। আজ আপনার কাঁদার দিন নয়, হাসবার দিন। তখন স্যার বললেন, 

-বাছা, এ আমার সুখের কান্না। এ আমার বিজয়ের কান্না।

কথাগুলো বলে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। প্রাইমারি স্কুলের স্যারটিকে তারা চার বন্ধু পা ছুঁয়ে সালাম করলো এবং তাদের সবার মা-বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। স্যারকে ওরা বললো, 

-স্যার, আমরা তো সার্টিফিকেট বিহীন গোয়েন্দা হয়ে গেলাম। তখন স্যার একটা কথাই বললেন,

-সবাইকে তোদের মতোই দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত!



লেখক:
কবি মেছবাহ উদ্দিন মারুফ
সোনাগাজী, ফেনী
প্রথম প্রকাশকাল: ২০১৯ ইং, মাসিক কিশোরপাতা।

বইনোট : চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান || লেখক : নঈম সিদ্দিকী


চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান

নঈম সিদ্দিকী


লেখক পরিচিতি:

নঈম সিদ্দিকী, প্রসিদ্ধ ইসলামী সাহিত্যিক। মাসিক তরজমানুল কুরআন এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত "চেরাগে রাহ" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রাসূল (সা.) এর সীরাত "মুহসিনে ইনসানিয়্যাত" নামক গ্রন্থটি (অনুবাদঃ- মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সাঃ) প্রণয়ন করেন। এ বইয়ের মূল নাম ছিল 'তামীরে সীরাত কে লাওয়াযিম'।


চরিত্র: আচার, আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতি, ব্যবহারবিধি, রীতিনীতি, কায়দাকানুন অর্থাৎ যা দ্বারা মানুষের ভালমন্দ বিচার করা যায় তাকে চরিত্র বলে।

ইসলামী সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে কর্মীদের চরিত্রই মুখ্য হাতিয়ার।



বইটি চার ভাগে বিভক্ত :


১. ভূমিকা


২. আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৩. সংগঠনের সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৪. সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক।



ভূমিকাঃ-

মানুষের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, শয়তানের হস্তক্ষেপও ততই ব্যাপকতর হতে থাকে।


শয়তানী তৎপরতার রুপঃ


* পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপুজারী সভ্যতা জাতির নৈতিক পতনকে চরম পর্যায়ে উপনীত করেছে


* সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা জাতির মৌলিক ঈমান আকীদার মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে।


এটি যেন সূরা আরাফের ১৭ নং আয়াতে বর্ণিত শয়তানের চ্যালেঞ্জেরই বাস্তবরুপঃ


" আমি (হামলা করার জন্য) এদের (মানব জাতির) সামনে থেকে পেছন থেকে, ডান দিক থেকে বাম দিক থেকে আসবো।"


. এ অবস্থায় বৈরাগ্যবাদী চিল্লার কিছু মুসলমান আত্মরক্ষার উপদেশ দান করে, যদিও নৈতিক উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশে উন্নত নৈতিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও তা যথেষ্ট নয়-


উদাহারণঃ-


১. মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে আত্মরক্ষার্থে পলায়ন করা স্বার্থপরতার শামীল।


২. নূন্যতম পুজি হলেও তা নিয়ে ময়দানে নামা


৩. চরিত্রের মূলধনকে অনুৎপাদক না রেখে বাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে? এর পরিচালনা ও দেখাশুনার জন্য যাবতীয় উপায় অবলম্বন করা উচিত। মহামারি আক্রান্ত এলাকায় জনগণের সেবা করার জন্য আমাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।"


আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক: উপায় ৪টি


১. পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতা এবং আল্লাহভীতি, নত ও বিনম্ন ভাবসহ মৌলিক ইবাদত সমূহ পালন- বিশেষ করে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে। ইবাদাতের সাথে সাথে আত্মাবিচারে অভ্যস্ত হতে হবে।


২ . কোরআন ও হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন, সাথে ইসলামী সাহিত্যও অধ্যয়ন করতে হবে।


৩. নফল ইবাদত-নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ), নফল রোজা, আল্লাহরপথে অর্থ ব্যয় এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা।


৪. সার্বক্ষণিক যিকির ও দোয়া।


সংগঠনের সাথে সম্পর্ক


আমাদের নিকট সংগঠন কেবল একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনই নয় বরং আমাদের দ্বীনদারী, নৈতিকতা, আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্যের মূর্তপ্রকাশ।


১. আদেশ আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করা। (নিসা-৫৮)


২. অন্ধ আনুগত্য না করা। (মায়েদা-২)


৩. সমালোচনা সুধারণার ভিত্তিতে


৪. ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন না করা। (ইমরান-১৪৪)


৫. কর্মীদের তুলনায় কর্তৃত্বশীলদের দায়িত্ব অনেক বেশী নাজুক প্রকৃতির।


(ক) কোন ভেদাভেদ না করা


(গ) মাফ করে দেয়া সংশোধন করা ও তাদের জন্য দোয়া করা


(গ) বিভিন্ন বিষয়ে কর্মীদের সাথে পরামর্শ করা। (ইমরান-১৫৯)


(ঘ) স্থির সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর তার উপর একাগ্রচিত্তে অটল থাকা।


৫. (ক) চিঠি সার্কুলারকে গুরুত্ব দান


(খ) সময়মত বৈঠকে হাজির হওয়া


(গ) আল্লাহরকাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি নিয়ে কাজ করা। দলীয় চরিত্রে দুর্বলতার প্রকাশ বৃহত্তর গোনাহ এ অনুভূতি নিয়ে কাজ করা।


(ঘ) দায়িত্বানুভূতি নিয়ে কাজ করা। (আল্লাহরনিকট অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করা)।


সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক: ৮টি


১. ফাসেক সংবাদ-বাহকের সংবাদে তড়িৎ সিদ্ধান্ত না নেয়া। বরং অনুসন্ধান করা। (হুজুরাত-৬)


২. ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা। (হুজুরাত-১০)


৩. কাউকে বিদ্রূপ না করা।


৪. পরস্পরের সম্পর্কে কুধারণা না করা, অবস্থা জানবার জন্য গোয়েন্দাগিরি না করা, গীবত না করা। (হুজুরাত-১২)


-সংকলিত

মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়? -মাওলানা ইমাম হোসাইন


দ্বীন বিজয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিহত হয় ইসলামের পরিভাষাগত তাদেরকে শহীদ বলা হয়।

"শহীদ" এই পরিভাষাকে রাসুল (স) আরো ব্যাপকতা অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন: জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে, আগুনে পুড়ে নিহত হওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে,পানিতে ডুবে মারা যাওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুকেও শহীদি মৃত্যু বলে। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রেখে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকেও শহীদি মৃত্যু বলে।

কিন্তু সম্মুখ সমরে দ্বীনের জন্যে লড়াই করে শাহাদাত আর উল্লেখিত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, আগুন এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের মর্যাদা এক নয়। বস্তুত এই দুই অবস্থার মৃত্যুকে তখনই শহীদি মৃত্যু বলা যাবে যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়। অর্থাৎ শাহাদাতের সাথে ঈমান বা বিশ্বাসের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর সকল ন্যায় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তি কি শহীদ?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অধিকার, সাম্য সমতা, মানবিক মর্যাদা, দেশ জাতির জন্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মানুষ অসংখ্য আন্দোলনে মারা গিয়েছে। এদের সবাইকে শরীয়াহর মানদন্ডে শহীদ বলা যাবেনা। শহীদ বলতে হলে ঐ ন্যায্য আন্দোলনের সাথে ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, দেশ ও জাতির দ্বীন এবং ঈমানের অপরিহার্যতার সম্পর্ক লাগবে। এইজন্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের শহীদ বলা গেলেও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নিহতদেরকে ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ডে কি শহীদ বলা যাবে? শহীদ হতে হলে ইসলামের বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। কারণ শহীদ মর্যাদাটি ইসলামী পরিভাষা। মোটকথা কাউকে শহীদ বলতে হলে তার ইমানের অপরিহার্য সম্পৃক্ততা লাগবেই।

বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীদের শহীদ বলা হলেও কথিত মুলধারার জাতিয়তাবাদি, সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী কর্মীদেরকে কি শহীদ বলা যাবে?

[এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার পুর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটগত এবং ব্যবহারগত শহীদ শব্দটির ২টি ধারা বিদ্যমান। যেমন: বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় মর্যাদাগত উপাধিতে দেশের আন্দোলনের যেকোন ব্যক্তিকে শহীদ বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক হিন্দু, নাস্তিক বামদেরকেও শহীদ উপাধি দিয়ে থাকে রাস্ট্র। যা ইসলামের মুলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাইকে মানতে হয়।

দ্বিতীয়ত, দ্বীন আর ইসলামী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিকে ইসলামী দলসমূহ শহীদ বলে থাকে।ফিকহী উসুলের দিক থেকে ইসলামে এটাকেই শাহাদাত বলা হয়ে থাকে যা সকল যুগেরই প্রারম্ভনা আজ পর্যন্ত। ]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো স্বৈরাচার জুলুমকে প্রতিহত করতে সকল দলমতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিহত সবাইকে শহীদ বলতে হলে তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে বলতে হবে। উদাহরণগত জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রবাদি, সেকুলারদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ন্যায্য হলেও পরক্ষণে তাদের বিশ্বাস যে তারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের মানব রচিত বিশ্বাসকে তারা প্রতিষ্ঠিত করবে। সুতরাং তাদের ন্যায্যত আন্দোলন সত্বেও বিশ্বাসের বিচ্যুতকারনে ইসলামী মুলনীতিতে শহীদ হবেনা। বিপরীতে ইসলামি দলগুলো স্বৈরাচার বিরোধী ন্যায্যত আন্দোলনে জুলুমের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামকেই প্রতিষ্ঠারই কর্মপ্রয়াস চালাবে। ফলশ্রুতি তাদের ন্যায্যত আন্দোলনে মাকাসাদ শরীয়াহ থাকার কারণে তাদের কোন কর্মী নিহত হলে শরীয়াহর মূলনীতিতে তাদেরকে শহীদ বলা যাবে।

মৌলিক জিজ্ঞাসা হলো স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামি দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়?

সাধারণত ইসলামি দলগুলো সামগ্রিক গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে না। মুলত গনতন্ত্র হলো আজকের বিশ্বের একটা নিয়মাতান্ত্রিক রাস্ট্রিয় পরিচালনা প্রক্রিয়া। যেখানে গনতন্ত্রের সকল মুলনীতির মাঝে কিছু আছে ইসলামের মূলনীতি সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে আর কিছু আছে যা ইসলামের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামস্টিক দিক ইসলামের সমর্থন যোগ্য।তাই ইসলামি দলগুলো রাস্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে গনতন্ত্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাহন হিসেবে দেখে। যা একালের সকল ইসলামী রাস্ট্রচিন্তাবিদ্বের সর্বসম্মত মত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনমত তৈরীর একটি বাহন হিসেবে গনতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীকে শহীদ বলা যাবে। বাহনগত দিক থেকে তা গনতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও মাকাসাদে শরিয়াহ তথা উদ্দ্যেশ্যগত দিক থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

[এছাড়াও বাংলাদেশের এখনকার আন্দোলন মুলত নিয়মাতান্ত্রিক জুলুম তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ জাতি এবং সামগ্রিক ইসলামকে অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলন। শুধুমাত্র একটা গনতন্ত্র শব্দ দিয়ে এই ন্যায্য আন্দোলনকে হালাল হারাম ফতোয়ার প্যাঁচে ফেলানো নিতান্তই চাটুলতা। ]

সুতরাং সকল আন্দোলনে যে কাউকে শহীদ বলতে হলে তার বিশ্বাস এবং মাকাসাদ তথা উদ্দ্যেশ্যে হতে হবে ইসলাম এবং শরীয়াহ। আর সকল ইসলামী দল তাদের সকল আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের মাকাসাদ থাকে মূলত হুকুমতে শরিয়াহ এবং ইকামাতে দ্বীন।

[বি: দ্র: শাহাদাতের কবুলিয়াত আল্লাহর দিকেই নিসবত। কাউকে আমাদের শহীদ বলা না বলার মধ্যে শহীদি মর্যাদা নির্ভর করে না। মূলত এটি আখেরাতের অর্জন। দুনিয়াতে আপনি যাকে শহীদ বলতেছেন পরকালে সে হয়তো আল্লাহর নিকট শহীদ না। আবার আমরা যাকে শহীদ মনে করতেছিনা হয়তো সে আল্লাহর নিকট শহীদ। এইজন্য মুমিন সবসময় তার ভাইয়ের শাহাদাতের দোয়া করবে।]


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।